১০২. সূরা আত তাকাসুর
আয়াতঃ ০৮; রুকুঃ ০১; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
প্রথম শব্দ আত তাকাসুরকে (التَّكَاثُرُۙ) এই সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নাযিলের সময়-কালঃ
আবু হাইয়ান ও শওকানী বলেন, সকল তাফসীরকার একে মক্কী সূরা গণ্য করেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ুতির বক্তব্য হচ্ছে, মক্কী সূরা হিসেবেই এটি বেশী
খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু কিছু কিছু বর্ণনায় একে মাদানী সূরা বলা হয়েছে। যেমনঃ
ইমাম আবু হাতেম আবু বুরাইদার রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ বনী হারেসা ও বনিল হারস নামক আনসারদের দু’টি
গোত্রের ব্যাপারে এ সূরাটি নাযিল হয়। উভয় গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রথমে নিজেদের জীবিত
লোকদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে। তারপর কবরস্থানে গিয়ে মৃত লোকদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে। তাদের এই আচরণের ফলে আল্লাহর এই বাণী أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ নাযিল হয়। কিন্তু শানে নুযূল বা নাযিল হওয়ার কারণ ও উপলক্ষ্য বর্ণনার
ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা সামনে রাখলে এই
রেওয়ায়াত যে উপলক্ষ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তাকে এই সূরা নাযিলের উপলক্ষ্য বলে মেনে
নেবার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। বরং এ থেকে এই অর্থ গ্রহণ করা যায় যে, এই দু’টি গোত্রের কর্মকাণ্ডের
সাথে সূরাটি খাপ খেয়ে যায়।
ইমাম বুখারী ও ইবনে জারীর হযরত উবাই ইবনে কাবের রা. একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেছেনঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর এ
বাণীটিকে لَوْ أَنَّ لِابْنِ آدَمَ
وَادِيَيْنِ مِنْ مَالٍ لَتَمَنَّى وَادِيًا ثَالِثًا, وَلَا يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ
آدَمَ إِلَّا التُّرَابُ (বনী আদমের কাছে যদি দুই উপত্যকা সমান সম্পদ থাকে তারপরও সে তৃতীয় একটি
উপত্যকা আকাঙ্ক্ষা করবে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া আর কিছু দিয়ে ভরে না)--- কুরআনের মধ্যে মনে করতাম। এমনকি শেষ পর্যন্ত আল হাকুমুত তাকাসুর সূরাটি
নাযিল হয়।” হযরত উবাই মদীনায় মুসলমান
হয়েছিলেন বলে এই হাদীসটিকে সূরা আত তাকাসুরের মদীনায় অবতীর্ণ হবার সপক্ষে প্রমাণ
হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু হযরত উবাইর এই
বক্তব্য থেকে সাহাবায়ে কেরাম কোন অর্থে রাসূলের এই বাণীকে কুরআনের মধ্যে মনে করতেন
তা সুস্পষ্ট হয় না। যদি এর অর্থ এই হয়ে থাকে যে, তারা একে কুরআনের একটি আয়াত
মনে করতেন তাহলে একথা মেনে নেয়া যেতে পারে না। কারণ সাহাবীগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কুরআনের প্রতিটি
হরফ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এই হাদীসটিকে কুরআনের আয়াত মনে করার মতো ভুল ধারণা তাঁরা কেমন করে পোষণ করতে
পারতেন! আর কুরআনের মধ্যে হবার মানে যদি কুরআন থেকে হওয়া মনে করা হয় তাহলে এই
হাদীসটির এ অর্থও হতে পারে যে, মদীনা তাইয়েবায় যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা প্রথমবার নবী
সা. এর পবিত্র কণ্ঠে এই সূরা উচ্চারিত হতে শুনে মনে করেন, সূরাটি
এই মাত্র নাযিল হয়েছে এবং রাসূলের উপরোল্লিখিত বাণী সম্পর্কে তাঁরা মনে করতে থাকেন
এটি এই সূরা থেকেই গৃহীত।
ইবনে জারীর, তিরমিযী ও ইবনুল মুনযির প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হযরত আলীর রা. একটি উক্তি
উদ্ধৃত করেছেন।
তাতে তিনি বলেছেনঃ “কবরের আযাব সম্পর্কে আমরা সব সময় সন্দেহের মধ্যে ছিলাম। এমন কি শেষ পর্যন্ত ‘আলহা-কুমুত তাকাসুর’
নাযিল হলো। হযরত আলীর রা. এই
বক্তব্যটিকে এই সূরার মাদানী হবার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করার কারণ হচ্ছে এই যে, কবরের আযাবের আলোচনা মদীনায়
শুরু হয়। মক্কায় এ সম্পর্কে কোন
আলোচনাই হয়নি। কিন্তু একথাটি আসলে ঠিক নয়। কুরআনের মক্কী সূরাগুলোর বিভিন্ন স্থানে এমন
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কবরের আযাবের কথা বলা হয়েছে যে, এ সম্পর্কে সন্দেহের কোন
অবকাশই সেখানে নেই। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন সূরা আল আনআ’মঃ ৯৩ আয়াত, আন নামলঃ ২৮ আয়াত, আল মু’মিনূনঃ ৯৯-১০০ আয়াত, আল মু’মিনঃ ৪৫-৪৬ আয়াত। এগুলো সবই মক্কী সূরা। তাই হযরত আলীর রা. উক্তি থেকে যদি কোন জিনিস প্রমাণ হয়
তাহলে তা হচ্ছে এই যে, উপরোল্লিখিত মক্কী সূরাগুলো নাযিলের পূর্বে সূরা আত তাকাসুর নাযিল হয় এবং
এই সূরাটি নাযিল হবার ফলে সাহাবীগণের মধ্যে বিরাজিত কবরের আযাব সম্পর্কিত সংশয় দূর
হয়ে যায়।
এ কারণে এই হাদীসগুলো সত্ত্বেও মুফাস্সিরগণের অধিকাংশই এর মক্কী হবার ব্যাপারে
একমত। আমার মতে এটি শুধু মক্কী
সূরাই নয় বরং মক্কী জীবনের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ
এই সূরায় মানুষকে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার অশুভ পরিণাম
সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই ভালোবাসা ও স্বার্থ পূজার কারণে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশী বেশী
ধন-সম্পদ আহরণ, পার্থিব লাভ, স্বার্থ উদ্ধার, ভোগ,
প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ এবং তার
মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একজন আর একজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব অর্জন করার ব্যাপারে অহংকারে মত্ত থাকে। এই একটি মাত্র চিন্তা তাদেরকে এমনভাবে মশগুল
করে রেখেছে যার ফলে এর চেয়ে উন্নততর কোন জিনিসের প্রতি নজর দেবার মানসিকতাই তাদের
নেই। এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে
সতর্ক করে দেবার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে, এই যেসব নিয়ামত তোমরা নিশ্চিন্তে সংগ্রহ
করতে ব্যস্ত, এগুলো শুধুমাত্র নিয়ামত নয় বরং এগুলো তোমাদের
জন্য পরীক্ষার বস্তুও। এগুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটি নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿أَلْهَىٰكُمُ ٱلتَّكَاثُرُ﴾
১। বেশী বেশী এবং একে অপরের থেকে বেশী দুনিয়ার স্বার্থ
লাভ করার মোহ তোমাদের গাফলতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।১
১. মূলে বলা হয়েছে اَلۡهٰٮكُمُ التَّكَاثُرُۙ এখানে মাত্র দু’টি শব্দ
ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই দু’টি শব্দের
মধ্যে এত বেশী ব্যাপকতা রয়েছে যা মাত্র একটি বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
‘আলহাকুম’ (اَلۡهٰٮكُمْ) শব্দটির মূলে রয়েছে লাহউন। لهو এর আসল অর্থ গাফলতি।
কিন্তু যেসব কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ এত বেশী বেড়ে যায় যে সে তার মধ্যে
মগ্ন হয়ে অন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল হয়ে পড়ে সেই ধরনের প্রত্যেকটি
কাজের জন্য আরবী ভাষায় এ শব্দটি বলা হয়ে থাকে। আলহাকুম শব্দটিকে যখন এর মূল অর্থে বলা হবে তখন এর অর্থ
হবে কোন ‘লাহওয়া’ তোমাকে তার মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যে, তার চাইতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ
কোন জিনিসের প্রতি আর তোমার আকর্ষণ ও আগ্রহ থাকেনি। তার মোহ তোমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তারই চিন্তায় তুমি নিমগ্ন। আর এই মোহ ও নিমগ্নতা তোমাকে একেবারে গাফেল করে দিয়েছে।
তাকাসুর (تَكَاثُرُۙ) এর মূল কাসরাত (كَثرَتْ)। এর তিনটি অর্থ হয়। একঃ মানুষের বেশী বেশী প্রাচুর্য লাভ করার চেষ্টা করা। দুইঃ প্রাচুর্য লাভ করার জন্য মানুষের পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা। তিনঃ লোকদের অন্যের তুলনায় বেশী প্রাচুর্য লাভ করার কথা
নিয়ে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করে বেড়ানো।
কাজেই “আলহাকুমুত তাকাসুরের” অর্থ দাঁড়ায় তাকাসুর বা প্রাচুর্য তোমাদেরকে তার
নিজের মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে নিয়েছে, যার ফলে তার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা তোমাদের
তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে। তাকাসুরের মধ্যে কোন জিনিসের প্রাচুর্য রয়েছে, ‘আলহাকুম’---এ কোন জিনিস থেকে
গাফেল হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং আলহাকুম---এ কাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে---এ
বাক্যে সে কথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। অর্থের এই অস্পষ্টতার কারণে এই শব্দগুলো ব্যাপকতর অর্থে
ব্যবহারের দুয়ার খুলে গেছে। এক্ষেত্রে ‘তাকাসুর’ বা প্রাচুর্যের অর্থ সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। বরং দুনিয়ার সমস্ত সুবিধা ও লাভ, বিলাস দ্রব্য, ভোগের সামগ্রী, শক্তি ও কর্তৃত্বের উপকরণ বেশী বেশী
অর্জন করার প্রচেষ্টা চালানো, এগুলো অর্জন করার জন্য একে
অন্যের থেকে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করা এবং এগুলোর প্রাচুর্যের কারণে পরস্পরের
মোকাবেলায় বড়াই করা এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে ‘আলহাকুম’---এ যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও
সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি।
বরং প্রত্যেক যুগের লোকেরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সামগ্রিকভাবে এর সম্বোধনের
আওতাভুক্ত হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, বেশী বেশী বৈষয়িক স্বার্থ
অর্জন করা, তার মধ্যে একে অন্যের অগ্রবর্তী হওয়া এবং অন্যের
মোকাবেলায় তা নিয়ে গর্ব করার মোহ যেমন ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আচ্ছন্ন করে
গোত্র ও জাতিকেও।
অনুরূপভাবে ‘আলহাকুমুত তাকাসুর’---এ যেহেতু একথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, প্রাচুর্য লোকদেরকে নিজের
মধ্যে নিমগ্ন করে কোন জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে, তাই এর
অর্থের মধ্যেও ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এই প্রাচুর্যের মোহ লোকদেরকে এর চেয়ে বেশী
গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে। তারা আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে গেছে। আখেরাত থেকে গাফেল হয়ে গেছে। নৈতিকতার সীমা ও নৈতিক দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে গেছে। অধিকারীর অধিকার এবং তা আদায় করার ব্যাপারে
নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফেল হয়ে গেছে। তারা নিজেদের জীবন যাপনের মান উন্নয়নের চিন্তায় ব্যাকুল। মানবতার মান কত নেমে যাচ্ছে সে চিন্তা তাদেরকে
একটুও ব্যতিব্যস্ত করে না। তাদের চাই বেশী বেশী অর্থ। কোন
পথে এ অর্থ অর্জিত হচ্ছে তার কোন পরোয়াই তাদের নেই। তারা বিলাস দ্রব্য ও ভোগের সামগ্রী বেশী বেশী চায়। এই প্রবৃত্তি পূজায় লিপ্ত হয়ে তারা এহেন
আচরণের পরিণাম থেকে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে গেছে। তারা বেশী বেশী শক্তি, সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের
চিন্তায় মশগুল। এ
প্রশ্নে তারা একে অপরকে ডিঙ্গিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এ চিন্তা করছে না যে, এগুলো আল্লাহর দুনিয়াকে জুলুমে
পরিপূর্ণ করার এবং মানবতাকে ধ্বংস ও বরবাদ করার সরঞ্জাম মাত্র। মোটকথা, এভাবে অসংখ্য ধরনের ‘তাকাসুর’ ব্যক্তি ও
জাতিদেরকে তার মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যে, দুনিয়া
এবং বৈষয়িক স্বার্থ ও ভোগের চাইতে বড় কোন জিনিসের কথা তারা মুহূর্তকালের জন্য
চিন্তা করে না।
﴿حَتَّىٰ زُرْتُمُ ٱلْمَقَابِرَ﴾
২। এমনকি (এই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে) তোমরা কবর পর্যন্ত
পৌঁছে যাও।২
২. অর্থাৎ সারাটা জীবন তোমরা এই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছো। মরার এক মুহূর্ত আগেও এ চিন্তা থেকে তোমাদের
রেহাই নেই।
﴿كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾
৩। কখ্খনো না, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।৩
৩. অর্থাৎ তোমরা ভুল ধারণার শিকার হয়েছো। বৈষয়িক সম্পদের এ প্রাচুর্য এবং এর মধ্যে পরস্পর থেকে
অগ্রবর্তী হয়ে যাওয়াকেই তোমরা উন্নতি ও সাফল্য মনে করে নিয়েছো। অথচ এটা মোটেই উন্নতি ও সাফল্য নয়। শীঘ্রই তোমরা এর অশুভ পরিণতি জানতে পারবে। সারাটা জীবন যে ভুলের মধ্যে তোমরা লিপ্ত ছিলে
সেটা যে কত বড় ভুল ছিল তা তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। শীঘ্রই অর্থ আখেরাতও হতে পারে। কারণ আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমগ্রকাল ব্যাপী যে সত্তার
দৃষ্টি প্রসারিত তাঁর কাছে কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ বছরও কালের সামান্য একটি অংশ
মাত্র। কিন্তু এর অর্থ মৃত্যুও হতে
পারে। কারণ কোন মানুষ থেকে তার
অবস্থান বেশী দূরে নয়। আর
মানুষ তার সারা জীবন যে সব কাজের মধ্যে কাটিয়ে এসেছে সে মরে যাবার সাথে সাথেই
সেগুলো তার জন্য সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ও অশুভ পরিণামের বাহন ছিল কিনা তা তার কাছে
একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
﴿ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾
৪। আবার (শুনে নাও) কখ্খনো না শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।
﴿كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ
عِلْمَ ٱلْيَقِينِ﴾
৫। কখ্খনো না, যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে
(এই আচরণের পরিণাম) জানতে (তাহলে তোমরা এ ধরনের কাজ করতে না)।
﴿لَتَرَوُنَّ ٱلْجَحِيمَ﴾
৬। তোমরা জাহান্নাম দেখবেই।
﴿ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ
ٱلْيَقِينِ﴾
৭। আবার (শুনে নাও) তোমরা একেবারে স্থির নিশ্চিতভাবে তা
দেখবেই।
﴿ثُمَّ لَتُسْـَٔلُنَّ يَوْمَئِذٍ
عَنِ ٱلنَّعِيمِ﴾
৮। তারপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের এই নিয়ামতগুলো সম্পর্কে
জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে।৪
৪. এই বাক্যে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পর জিজ্ঞাসাবাঃদ করা
হবে এই অর্থে ‘তারপর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। বরং এর অর্থ হচ্ছেঃ তারপর এ খবরটিও আমি তোমাদের দিয়ে
দিচ্ছি যে, এসব নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে। আর একথা সুস্পষ্ট, আল্লাহর আদালতে হিসেব নেবার
সময় এ জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে
বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, মহান
আল্লাহ বান্দাদেরকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন সে সম্পর্কে মু’মিন ও কাফের সবাইকে
জবাবদিহি করতে হবে। এটা আলাদা ব্যাপার যারা নিয়ামত অস্বীকার করেনি এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে
জীবন যাপন করেছে তারা এই জিজ্ঞাসাবাঃদে সফলকাম হবে। আর যারা আল্লাহর নিয়ামতের হক আদায় করেনি এবং নিজেদের কথা ও
কাজের মাধ্যমে অথবা উভয়ের সাহায্যে তাঁর নাফরমানি করেছে তারা ব্যর্থ হবে।
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের এখানে
এলেন। আমার তাঁকে তাজা খেজুর
খাওয়ালাম এবং ঠাণ্ডা পানি পান করালাম। তিনি বললেনঃ “এগুলো এমন সব নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের
জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে।”
(মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে জারীর, ইবনুল
মুনযির, ইবনে মারদুইয়া, আবদ ইবনে
হুমাইদ ও বাইহাকী ফিশ্ শুআ’ব)।
হযরত আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উমরকে রা. বললেন, চলো আবুল হাইসাম ইবনুত তাইহান
আনসারীর ওখানে যাই। কাজেই তাদেরকে নিয়ে তিনি ইবনুত তাইহানের খেজুর বাগানে গেলেন। তিনি এক কাঁদি খেজুর এনে মেহমানদের সামনে
রাখলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাকে বললেন, তুমি নিজে খেজুর ছিঁড়ে আনলে না
কেন? তিনি বললেন আমি চাচ্ছিলাম আপনারা নিজেরা বেছে বেছে
খেজুর খাবেন।
কাজেই তারা খেজুর খেলেন এবং ঠাণ্ডা পানি পান করলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন “সেই সত্তার কসম
যার হাতে আমার প্রাণ সমর্পিত, কিয়ামতের দিন যেসব নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে এই
ঠাণ্ডা ছায়া, ঠাণ্ডা খেজুর ও ঠাণ্ডা পানি--- এগুলো তার
অন্তর্ভুক্ত।”
(এই ঘটনা মুসলিম, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, তিরমিযী,
নাসায়ী, ইবনে জারীর ও আবুল ইয়ালা প্রমুখ
মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে আবু হুরাইরাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এদের কেউ কেউ উক্ত আনসার সাহাবীর নাম উল্লেখ
করেছেন আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র একজন আনসারী বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এ ঘটনাটি বিভিন্ন সূত্রে এবং বিস্তারিত আকারে
ইবনে আবু হাতেম হযরত উমর থেকে এবং ইমাম আহমাদ রাসূলুল্লাহ সা. এর আবু আসী নামক
একজন মুক্তি প্রাপ্ত গোলাম থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে হাইয়ান ও ইবনে মারদুইয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস
রা. থেকে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তা থেকে জানা যায়, প্রায় এই একই ধরনের ঘটনা হযরত আবু আইউব আনসারীর ওখানেও ঘটেছিল)।
এই হাদীসগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জিজ্ঞাসাবাঃদ
কেবল কাফেরদেরকে করা হবে না, সৎ মু’মিনদেরকেও করা হবে। আর
আল্লাহ মানুষকে যে নিয়ামতগুলো দান করেছেন সেগুলো সীমা সংখ্যাহীন।
সেগুলো গণনা করা সম্ভব নয়। বরং এমন অনেক নিয়ামতও আছে যেগুলোর মানুষ কোন
খবরই রাখে না। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে (وَاِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَتَ
اللّٰهِ لَا تُحۡصُوۡهَا ) অর্থাৎ “যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতগুলো গণনা করতে
থাকো তাহলে সেগুলো পুরোপুরি গণনা করতেও পারবে না।” (ইব্রাহীমঃ ৩৪) এই
নিয়ামতগুলোর মধ্য থেকে অসংখ্য নিয়ামত মহান আল্লাহ সরাসরি মানুষকে দিয়েছেন।
আবার বিপুল সংখ্যক নিয়ামত মানুষকে দান করা হয় তার নিজের উপার্জনের মাধ্যমে।
নিজের উপার্জিত নিয়ামতগুলো মানুষ কিভাবে উপার্জন ও ব্যয় করেছে সে সম্পর্কে তাকে
জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি যে নিয়ামতগুলো সে লাভ
করেছে সেগুলোকে সে কিভাবে ব্যবহার করেছে তার হিসেব তাকে দিতে হবে। আর
সামগ্রিকভাবে সমস্ত নিয়ামত সম্পর্কে তাকে বলতে হবে যে, সেগুলো যে
আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এর স্বীকৃতি সে দিয়েছিল কিনা এবং নিজের ইচ্ছা, মনোভাব ও কর্মের সাহায্যে সেগুলোর জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করেছিল কি না? অথবা সে কি একথা মনে করতো, এসব কিছু হঠাৎ ঘটনাক্রমেই সে পেয়ে গেছে? অথবা সে কি
একথা মনে করেছিল যে, অনেকগুলো খোদা তাকে এগুলো দিয়েছেন?
অথবা সে কি একথা মনে করেছিল যে, এগুলো একজন
আল্লাহর নিয়ামত ঠিকই কিন্তু এগুলো দান করার ব্যাপারে আরো অনেক সত্তার হাত রয়েছে?
এ কারণে তাদেরকে মাবুদ গণ্য করেছিল এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করেছিল?
--- সমাপ্ত ---
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।