
০৭০. আল মাআরিজ
আয়াতঃ ৪৪; রুকুঃ ০২; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
সূরার তৃতীয় আয়াতের ذِي الْمَعَارِجِ যিল মা'আরিজি শব্দটি থেকে এর নামকরণ হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কালঃ
কাফেররা কিয়ামত, আখেরাত এবং দোযখ ও বেহেশত সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে বিদ্রূপ ও উপহাস করতো
এবং রাসূলুল্লাহ সা.কে এ মর্মে চ্যালেঞ্জ করতো যে, তুমি যদি
সত্যবাদী হয়ে থাকো আর তোমাকে অস্বীকার করে আমরা জাহান্নামের শাস্তিলাভের উপযুক্ত
হয়ে থাকি তাহলে তুমি আমাদেরকে যে কিয়ামতের ভয় দেখিয়ে থাকো তা নিয়ে এসো। যে কাফেররা এসব কথা বলতো এ সূরায় তাদের সতর্ক
করা হয়েছে এবং উপদেশ বাণী শোনানো হয়েছে। তাদের এ চ্যালেঞ্জের জবাবে এ সূরার গোটা বক্তব্য পেশ করা
হয়েছে।
সূরার প্রথমে বলা হয়েছে প্রার্থনাকারী আযাব প্রার্থনা করছে। নবীর দাওয়াত অস্বীকারকারীর ওপর সে আযাব অবশ্যই
পতিত হবে। আর যখন আসবে তখন কেউ তা
প্রতিরোধ করতে পারবে না।
তবে তার আগমন ঘটবে নির্ধারিত সময়ে। আল্লাহর কাজে দেরী হতে পারে। কিন্তু তার কাছে বেইনসাফী বা অবিচার নেই। কিন্তু আমি দেখছি তা অতি নিকটে।
এরপর বলা হয়েছে, এসব লোক হাসি-ঠাট্টাচ্ছলে কিয়ামত দ্রুত নিয়ে আসার দাবি করছে। অথচ কত কঠোর ও ভয়ানক সেই কিয়ামত।যখন তা আসবে তখন এসব লোকের কি যে ভয়ানক পরিণতি
হবে। সে সময় এরা আযাব থেকে
বাঁচার জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি এবং নিকট আত্মীয়দেরকে বিনিময় স্বরূপ দিয়ে দেয়ার জন্য
প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু কোনভাবেই আযাব থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না।
এরপর মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সেদিন মানুষের ভাগ্যের ফায়সালা হবে
সম্পূর্ণরূপে তাদের আকীদা-বিশ্বাস নৈতিক চরিত্র ও কৃতকর্মের ভিত্তিতে। দুনিয়ার জীবনে যারা ন্যায় ও সত্য থেকে মুখ
ফিরিয়ে নিয়েছে এবং ধন-সম্পদ জমা করে ডিমে তা দেয়ার মত সযত্নে আগলে রেখেছে তারা হবে
জাহান্নামের উপযুক্ত। আর
যারা আল্লাহর, আযাবের ভয়ে ভীত থেকেছে। আখেরাতকে বিশ্বাস করেছে, নিয়মিত নামায পড়েছে, নিজের উপার্জিত
সম্পদ দিয়ে আল্লাহর অভাবী বান্দাদের হক আদায় করেছে, ব্যভিচার
থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে, আমানতের খেয়ানত করেনি, ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি এবং কথাও কাজ যথাযথভাবে রক্ষা করে চলেছে এবং
সাক্ষ্যদানের বেলায় সত্যবাদিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে তারা সম্মান ও মর্যাদার
সাথে জান্নাতে স্থান লাভ করবে।
পরিশেষে মক্কার কাফেরদের সাবধান করা হয়েছে যারা রাসুলুল্লাহ সা.কে দেখামাত্র
বিদ্রূপ ও উপহাস করার জন্য চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তাদেরকে বলা হয়েছে যদি তোমরা তাঁকে না মানো তাহলে আল্লাহ
তা'আলা
অন্যদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। রাসূলুল্লাহ সা.কে এই বলে উপদেশ দেয়া যেন তিনি এসব উপহাস-
বিদ্রূপের তোয়াক্কা না করেন। এরা যদি কিয়ামতের লাঞ্ছনা দেখার জন্যই জিদ ধরে থাকে তাহলে তাদেরকে এ অর্থহীন
তৎপরতায় লিপ্ত থাকতে দিন।
তারা নিজেরাই এর দুঃখজনক পরিণতি দেখতে পাবে।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿سَأَلَ سَآئِلٌۢ بِعَذَابٍۢ
وَاقِعٍۢ﴾
(১) এক প্রার্থনাকারী আযাব প্রার্থনা করেছে১
১. মূল আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো سَأَلَ سَائِلٌ (ছায়ালা ছাইলুন)। কোন কোন মুফাস্সির এখানে ছায়ালা اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ
فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
(الانفال : 32) শব্দটিকে জিজ্ঞেস করা অর্থে
গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে আয়াতের অর্থ হলো
একজন জিজ্ঞেসকারী জানতে চেয়েছে যে, তাদেরকে যে আযাব সম্পর্কে অবহিত করা হচ্ছে
তা কার ওপর অপতিত হবে? আল্লাহ তা'আলা
এ প্রশ্নের জওয়াব দিয়েছেন এই বলে যে, তা কাফেরদের ওপর পতিত
হবেই। তবে অধিকাংশ মুফাস্সির
এক্ষেত্রে চাওয়াকে দাবী করা অর্থ গ্রহণ করেছেন। নাসায়ী এবং আরো কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস ইবনে আব্বাস থেকে
একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিস হাকেম এটিকে সহীহ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হলো নাদর ইবনে হারেস ইবনে কালাদা বলেছিলঃ
اَلّلهُمَّ اِنْ كَانَ هَذَا
هُوَ الْحَقَّ مِنْعِنْدِكَ فَاَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَالسَّمَاءِ اَوِئتِنَا
بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ
"হে আল্লাহ, এটি যদি সত্যিই তোমার পক্ষ থেকে আসা
একটা সত্য বাণী হয়ে থাকে, তাহলে আসমান থেকে আমাদের ওপর পাথর
বর্ষণ করো অথবা আমাদেরকে ভীষণ কষ্টদায়ক শাস্তি দাও।” (আল আনফালঃ ৩২)
এটি ছাড়াও কুরআন মজীদের আরো অনেক স্থানে মক্কার কাফেরদের এ চ্যালেঞ্জের
উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুমি আমাদের যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছো তা নিয়ে আসছো না কেন? উদাহরণস্বরূপ নীচে উল্লেখিত স্থানসমূহ দেখুন। সূরা ইউনুস, আয়াত ৪৬ থকে ৪৮; সূরা
আম্বিয়া, আয়াত ৩৬ থেকে ৪১; সূরা আন
নামল আয়াত ৬৭ থেকে ৭২; সূরা সাবা আয়াত ২৬ থেকে ৩০; ইয়াসীন, আয়াত, ৪৫থেকে ৫২ এবং
সূরা মূলক ২৪ থেকে ২৭।
﴿لِّلْكَـٰفِرِينَ لَيْسَ
لَهُۥ دَافِعٌۭ﴾
(২) যে আযাব কাফেরের জন্য অবধারিত। তা প্রতিরোধ করার
কেউ নেই।
﴿مِّنَ ٱللَّهِ ذِى ٱلْمَعَارِجِ﴾
(৩) আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি
উর্ধ্বারোহণের সোপান সমূহের অধিকারী২
২. মূল ইবারতে ذِي الْمَعَارِجِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। معرج শব্দের বহুবচন হলো معارج । এর অর্থ হলো ধাপ বা সিড়ি, অথবা এমন জিনিস যার সাহায্যে
ওপরে ওঠা যায়।
আল্লাহ তা’আলাকে معارج এর অধিকারী বলার মানে হলো তাঁর সত্তা অনেক
উচ্চ ও সমুন্নত। তার দরবারে পৌঁছার জন্য
ফেরেশতাদের একের পর এক ওপর দিকে উঠতে হয়। পরবর্তী আয়াতে এ বিষয়টিই বলা হয়েছে।
﴿تَعْرُجُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ
وَٱلرُّوحُ إِلَيْهِ فِى يَوْمٍۢ كَانَ مِقْدَارُهُۥ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍۢ﴾
(৪) ফেরেশতারা এবং রূহ৩ তার দিকে উঠে যায়৪ এমন এক দিনে যা পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।৫
৩. রূহ অর্থ জিবরাঈল আ.। অন্য সব ফেরেশতাদের থেকে আলাদাভাবে জিবরাঈলকে
উল্লেখ তাঁর বিশেষ মর্যাদা প্রকাশ করে।
সূরা শূ’আরায় বলা হয়েছে,نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ - عَلَى قَلْبِكَ (রূহুল আমীন এ কুরআন নিয়ে তোমার দিলের মধ্যে
নাযিল হয়েছে)।
সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,
قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا
لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ..............
"বলো, যে ব্যক্তি শুধু এ কারণে জিবরাঈলের দুশমন হয়ে
গিয়েছেন যে, সে তোমার অন্তরে কুরআন নাযিল
করেছেন..............।"
এ দু’টি আয়াত এক সাথে পড়লে বুঝা যায় যে, রূহ মানে জিবরাইল আ. ছাড়া আর কিছু নয়।
৪. এ পুরো বিবরণটি “মুতাশাবিহাতের” অন্তর্ভুক্ত। এর কোন নির্দিষ্ট অর্থ করা যায় না। আমরা ফেরেশতার সঠিক তাৎপর্য কি তা জানিনা। আমরা তাদের উর্ধ্বারোহণের সঠিক রূপও জানি না। যে ধাপগুলো পেরিয়ে ফেরেশতারা ওপরে ওঠেন তা
কেমন তাও আমরা জানি না।
মহান আল্লাহ সম্পর্কে ও এ ধারণ করা যায় না যে, তিনি কোন বিশেষ স্থানে অবস্থান করেন। কারণ তাঁর মহান সত্তা স্থান ও কালের গণ্ডিতে
আবদ্ধ নয়।
৫. সূরা হজ্জের ৪৭ আয়াতে বলা হয়েছেঃ এসব লোক এ মুহূর্তেই
আযাব নিয়ে আসার জন্য তোমার কাছে দাবী করেছে। আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। তবে তোমরা রবের হিসেবের একদিন তোমাদের
হিসেবের হাজার হাজার বছরের সমান হয়ে থাকে। সূরা আস সাজদার ৫ আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তিনি আসমান থেকে যমীন
পর্যন্ত গোটাবিশ্ব-জাহানের সব বিষয় পরিচালন করেন। এরপর (তার রিপোর্ট) এমন একটি দিনে তার কাছে পৌঁছে যা
তোমাদের গণনার এ হাজার বছরের সমান।” আর এখানে আযাব দাবী করার জবাবে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলার একদিন পঞ্চাশ
হাজার বছরের সমান।
এরপর রাসূলুল্লাহ সা.কে উপদেশ দেয়া হচ্ছে যারা বিদ্রূপ করে আযাব দাবী করেছে তাদের
এসব কথায় ধৈর্য ধারণ করুন। তারপর বলা হচ্ছে, এসব লোক আযাবকে দূরে মনে করছে। কিন্তু আমি দেখছি তা অত্যাসন্ন। এসব বক্তব্যের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ বিষয়টি
স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষ তার মন-মানসিকতা, চিন্তা ও দৃষ্টির পরিসর
সংকীর্ণ হওয়ার কারণে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলীকে নিজেদের সময়ের মান অনুযায়ী
পরিমাপ করে থাকে।
তাই একশো বছর বা পঞ্চাশ বছর সময়ও তাদের কাছে অত্যন্ত দীর্ঘ সময় বলে মনে হয়। কিন্তু আল্লাহর এক একটি পরিকল্পনা হাজার হাজার
বছর বা লাখ লাখ বছর মেয়াদের হয়ে থাকে। এ সময়টিও বলা হয়েছে উদাহরণ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে মহা বিশ্ব ভিত্তিক পরিকল্পনা লক্ষ লক্ষ ও শত
শত কোটি বছর মেয়াদেও হয়ে থাকে। এসব পরিকল্পনার মধ্য থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অধীনে এ পৃথিবীতে
মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তাদেরকে এখানে একটি বিশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ
করার অবকাশ দেয়া হবে।
কোন মানুষই জানে না এ পরিকল্পনা কখন শুরু হয়েছে, তা কার্যকরী করার জন্য কি
পরিমাণ সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তির জন্য কোন
মুহূর্তটি নির্ধারিত করা হয়েছে যে, মুহূর্তটিতে কিয়ামত
সংঘটিত হবে এবং সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত জন্মলাভকারী সমস্ত মানুষকে এক
সাথে জীবিত করে উঠিয়ে বিচার করার জন্য কোন সময়টি ঠিক করে রাখা হয়েছে। আমরা এ মহা পরিকল্পনার ততটুকুই কেবল জানি
যতটুকু আমাদের চোখের সামনে সংঘটিত হচ্ছে অথবা অতীত মহাকালে সংঘটিত ঘটনাবলীর যে
আংশিক ইতিহাসটুকু আমাদের সামনে বিদ্যমান আছে। এর সূচনা ও পরিণতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, সে সম্পর্কে জানা তো দূরের
কথা তা বুঝার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। এখন কথা হলো, যেসব লোক দাবী করছে যে, এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তার পরিণাম এখনই তাদের সামনে এনে হাজির করা হোক। আর যদি তা না করা হয় তাহলে পরিণাম সম্পর্কে যা
বলা হচ্ছে সেটিই মিথ্যা, তারা আসলে নিজেদের অজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাহফীমুল কুরআন, সূরা আল হজ্ব, টীকা ৯২-৯৩ এবং আস সাজদা, টীকা ৯)
﴿فَٱصْبِرْ صَبْرًۭا جَمِيلًا﴾
(৫) অতএব, হে নবী, তুমি
উত্তম ধৈর্য ধারণ করো।৬
৬. অর্থাৎ এমন ধৈর্য যা একজন মহত উদার ও সাহসী মানুষের
মর্যাদার উপযোগী।
﴿إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُۥ بَعِيدًۭا﴾
(৬) তারা সেটিকে অনেক দূরে মনে করেছে।
﴿وَنَرَىٰهُ قَرِيبًۭا﴾
(৭) কিন্তু আমি দেখছি তা নিকটে।৭
৭. এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তারা এ
ব্যাপারটিকে অসম্ভব মনে করে। অথচ আমাদের কাছে তা অত্যসন্ন।
দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, তারা কিয়ামতের
অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে তা এত কাছের
যেন আগামীকালই সংঘটিত হবে।
﴿يَوْمَ تَكُونُ ٱلسَّمَآءُ
كَٱلْمُهْلِ﴾
(৮) (যেদিন সেই আযাব আসবে) সেদিন৮ আসমান গলিত রূপার মত বর্ণ ধারণ করবে।৯
৮. একদল মুফাস্সির এ আয়াতাংশকে فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ আয়াতাংশের সাথে সম্পৃক্ত বলে ধরে নিয়েছেন। তারা বলেনঃ যে দিনটির
স্থায়িত্ব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলা হয়েছে সেটি কিয়ামতের দিন। মুসনাদে আহমাদ ও তাফসীরে
ইবনে জারীরে হযরত আবু সায়িদ খুদরী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ
আয়াতটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা.কে বলা হলো, তাহলে তো
সেদিনটি খুবই দীর্ঘায়িত হবে।
একথা শুনে তিনি বললেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্তার শপথ
একটি ফরয নামায পড়তে দুনিয়াতে যতটুকু সময় লাগে একজন ঈমানদারের জন্য সেদিনটি তার
চাইতেও সংক্ষিপ্ত হবে।” এটি সহীহ সনদে বর্ণিত রেওয়াতের হলে এটি ছাড়া এ আয়াতের অন্য কোন ব্যাখ্যা
করার অবকাশই থাকতো না। হাদীসটির
সনদে উল্লেখিত বর্ণনাকারী দাররাজ এবং তার উস্তাদ আবুল হাইসাম উভয়েই যয়ীফ।
৯. অর্থাৎ বার বার রং পরিবর্তন হবে।
﴿وَتَكُونُ ٱلْجِبَالُ كَٱلْعِهْنِ﴾
(৯) আর পাহাড়সমূহ রংবেরং-এর ধুনিত পশমের মত হয়ে যাবে। ১০
১০. পাহাড়সমূহের রং যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন তাই তখন তা স্থানচ্যুত
ওজনহীন হয়ে উড়তে থাকবে তখন মনে হবে যেন রংবেরংয়ের ধুনিত পশম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
﴿وَلَا يَسْـَٔلُ حَمِيمٌ
حَمِيمًۭا﴾
(১০) কোন পরম বন্ধুও বন্ধুকে জিজ্ঞেস করবে না।
﴿يُبَصَّرُونَهُمْ ۚ يَوَدُّ
ٱلْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِى مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍۭ بِبَنِيهِ﴾
(১১) অথচ তাদেরকে পরস্পরে দৃষ্টি সীমার মধ্যে রাখা হবে।১১ অপরাধী সেদিনের আযাব থেকে মুক্তির বিনিময়ে
তার সন্তান-সন্ততিকে,
১১. অর্থাৎ তারা একজন আরেকজনকে দেখতে পাবে না বলে জিজ্ঞেস করবে
না তা নয়। বরং অন্যের ব্যাপারে
যা ঘটেছে তা প্রত্যেকেই নিজ চোখে দেখতে পাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তাকে জিজ্ঞেস
করবে না। কেননা, সে তখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।
﴿وَصَـٰحِبَتِهِۦ وَأَخِيهِ﴾
(১২) স্ত্রীকে, ভাইকে এবং
﴿وَفَصِيلَتِهِ ٱلَّتِى تُـْٔوِيهِ﴾
(১৩) তাকে আশ্রয়দানকারী জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর আপনজনকে
﴿وَمَن فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًۭا
ثُمَّ يُنجِيهِ﴾
(১৪) এমনকি, পৃথিবীর সবকিছুই দিতে চাইবে।
﴿كَلَّآ ۖ إِنَّهَا لَظَىٰ﴾
(১৫) কখনো নয়, তা তো হবে জলন্ত আগুনের
লেলিহান শিখা
﴿نَزَّاعَةًۭ لِّلشَّوَىٰ﴾
(১৬) যা শরীরের গোশত ও চামড়া ঝলসিয়ে নিঃশেষ করে দেবে।
﴿تَدْعُوا۟ مَنْ أَدْبَرَ
وَتَوَلَّىٰ﴾
(১৭) তাদেরকে সে অগ্নিশিখা উচ্চ স্বরে নিজের কাছে ডাকবে,
যারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, পৃষ্ঠ
প্রদর্শন করেছিল
﴿وَجَمَعَ فَأَوْعَىٰٓ﴾
(১৮) আর সম্পদ জমা করে ডিমে তা দেয়ার মত করে আগলে রেখেছিল১২
১২. এ স্থানে ও আখেরাতের মানুষের মন্দ পরিণামের দু’টি কারণ বলা
হয়েছে যা সূরা আল হাক্কার ৩৩ও ৩৪ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। একটি হলো হক থেকে ফিরে যাওয়া এবং ঈমান আনয়নের অস্বীকৃতি। অপরটি হলো দুনিয়া পূজা ও কৃপণতা। এ কারণেই মানুষ সম্পদ জমা করে এবং কোন
কল্যাণকর কাজের জন্য তা খরচ করে না।
﴿إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ خُلِقَ
هَلُوعًا﴾
(১৯) মানুষকে ছোট মনের অধিকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে।১৩
১৩. যে বিষয়টিকে আমরা আমাদের ভাষায় এভাবে বলে থাকি, “এটি মানুষের প্রকৃতিগত অথবা
এটা তার সহজাত দুর্বলতা” সে বিষয়টিকে আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেন যে, “মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এভাবে।” এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, কুরআন মজীদের বহু জায়গায় মানব
জাতির সাধারণ নৈতিক দুর্বলতা উল্লেখ করার পর ঈমান ও সত্যের পথ অনুসরণকারীদের তা
থেকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে এ বিষয়টিই বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে এ সত্যটি আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের জন্মগত এসব দুর্বলতা
অপরিবর্তনীয় নয়। বরং
আল্লাহর দেয়া হিদায়াত গ্রহণ করে মানুষ যদি আত্মশুদ্ধির জন্য সত্যিকার প্রচেষ্টা
চালায় তাহলে সে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। পক্ষান্তরে যদি সে তার প্রবৃত্তিকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়
তাহলে দূর্বলতাগুলো তার মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে যায়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আম্বিয়া, টীকা ৪১;সূরা আয যুমার, টীকা
২৩ থেকে ২৮ এবং সূরা আশ শূরা, টীকা ৭৫)
﴿إِذَا مَسَّهُ ٱلشَّرُّ جَزُوعًۭا﴾
(২০) বিপদ-মুসিবতে পড়লেই সে ঘাবড়ে যায়,
﴿وَإِذَا مَسَّهُ ٱلْخَيْرُ
مَنُوعًا﴾
(২১) আর যে-ই সচ্ছলতার মুখ দেখে অমনি সে কৃপণতা করতে শুরু করে।
﴿إِلَّا ٱلْمُصَلِّينَ﴾
(২২) তবে যারা নামায পড়ে১৪ (তারা এ দোষ থেকে
মুক্ত)।
১৪. কোন ব্যক্তির নামায পড়ার অপরিহার্য অর্থ হলো সে আল্লাহ, রাসূল কিতাব ও আখেরাতের ওপর
বিশ্বাস এবং সাথে সাথে নিজের ও বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করার প্রচেষ্টা ও চালিয়ে যায়।
﴿ٱلَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ
دَآئِمُونَ﴾
(২৩) যারা নামায আদায়ের ব্যাপারে সবসময় নিষ্ঠাবান।১৫
১৫. অর্থাৎ কোন প্রকার অলসতা, আরামপ্রিয়তা, ব্যস্ততা, কিংবা আকর্ষণ তাদের নামাযের ক্ষেত্রে
নিয়মানুবর্তিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নামাযের সময় হলে সে সবকিছু ফেলে রেখে তার প্রভুর ইবাদতের
জন্য প্রস্তুত হয়। عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ এর আর একটি অর্থ বর্ণনা করেছেন হযরত উকবা ইবনে
আমের। তাহলো, সে পূর্ণ প্রশান্তি এবং বিনয় ও
নিষ্ঠাসহ নামায পড়ে, কাকের মত ঠোকর মারে না। ঠোকর মেরেই কোন রকমে নামায শেষ করার চেষ্টা
করে না। আবার নামাযের মধ্যে এদিক
সেদিক তাকিয়েও দেখেনা।
প্রচলিত আরবী বাক রীতিতে বদ্ধ বা স্থির পানিকে ماء
دائم মায়ে দায়েম বলা হয়। এরই আলোকে এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে।
﴿وَٱلَّذِينَ فِىٓ أَمْوَٰلِهِمْ
حَقٌّۭ مَّعْلُومٌۭ﴾
(২৪) যাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক আছে
﴿لِّلسَّآئِلِ وَٱلْمَحْرُومِ﴾
(২৫) প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।১৬
১৬. সূরা যারিয়াতের ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের সম্পদে প্রার্থী এবং
বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট হকে আছে।” কেউ কেউ এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হকের অর্থ মনে করেছেন ফরয যাকাত। কারণ ফরয যাকাতেই নেসাব ও হার দু’টিই
নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সূরা মা"আরিজ সর্বসম্মত মতে মক্কায় অবতীর্ণ সূরা। কিন্তু নেসাব ও হার নির্দিষ্ট করে যাকাত ফরয
হয়েছে মদীনায়। অতএব হকের সঠিক অর্থ হলো, প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য
তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পদে একটা অংশ নির্দিষ্টকরে রেখেছে। এটাকে তাদের হক মনে করে তারা নিজেরাই তা দিয়ে
দেয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর,
মুজাহিদ, শা"বী এবং ইবরাহীম নাখয়ী এ
অর্থই বর্ণনা করেছেন।
প্রার্থী মানে পেশাদার ভিক্ষুক নয়, বরং যেসব অভাবী মানুষ অন্যের
সাহায্যপ্রার্থী তারা। আর বঞ্চিত অর্থ এমন লোক যার কোন আয়-উপার্জন নেই। অথবা সে উপার্জনের জন্য চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু তাতে তার
প্রয়োজন পূরণ হয় না।
অথবা কোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হয়ে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অথবা
আয়-উপার্জনের সামর্থ্যই নেই। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে যখনই জানা যাবে যে, তারা প্রকৃতই বঞ্চিত তখন একজন
আল্লাহভীরু মানুষ এ জন্য অপেক্ষা করে না যে, সে তার কাছে
সাহায্য প্রার্থনা করুক। বরং তার বঞ্চিত থাকার কথা জানা মাত্র সে নিজেই অগ্রসর হয়ে তাকে সাহায্য করে। (আরো জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যারিয়াত, টীকা ১৭)
﴿وَٱلَّذِينَ يُصَدِّقُونَ
بِيَوْمِ ٱلدِّينِ﴾
(২৬) যারা প্রতিফলের দিনটিকে সত্য বলে মানে।১৭
১৭. অর্থাৎ দুনিয়াতে নিজেকে দায়িত্বহীন এবং জবাবদিহি থেকে
মুক্ত মনে করে না। বরং এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস
পোষণ করে যে, একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে তাদেরকে নিজেদের সব কাজের সব হিসেব দিতে
হবে।
﴿وَٱلَّذِينَ هُم مِّنْ عَذَابِ
رَبِّهِم مُّشْفِقُونَ﴾
(২৭) যারা তাদের প্রভুর আযাবকে ভয় করে।১৮
১৮. অন্য কথায় তাদের অবস্থা কাফেরদের মত নয়। কাফেররা দুনিয়াতে সব রকম গোনাহ, অপরাধ ও জুলুম-অত্যাচারে লিপ্ত
থেকেও আল্লাহকে ভয় করে না। কিন্তু তারা নিজস্বভাবে যথাসম্ভব নৈতিকতা ও কাজ-কর্মে সদাচরণ করা সত্ত্বেও
সবসময় আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। সবসময় তারা এআশঙ্কা করে যে, আল্লাহর আদালতে আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের নেক কাজের
তুলনায় অধিক বলে প্রমাণিত না হয় এবং এভাবে আমরা শাস্তির উপযুক্ত বলে প্রমাণিত না
হই। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিনূন টীকা ৫৪ এবং সূরা আয যারিয়াত, টীকা
১৯)
﴿إِنَّ عَذَابَ رَبِّهِمْ
غَيْرُ مَأْمُونٍۢ﴾
(২৮) কারণ তাদের প্রভুর আযাব এমন বস্তু নয় যে সম্পর্কে নির্ভয়
থাকা যায়।
﴿وَٱلَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ
حَـٰفِظُونَ﴾
(২৯) যারা নিজেদের লজ্জাস্থান নিজের স্ত্রী অথবা মালিকানাধীন
স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যদের থেকে হিফাযত করে।১৯
১৯. লজ্জাস্থানের হিফাজতের অর্থ ব্যভিচার না করা এবং উলঙ্গপনা
থেকেও দূরে থাকা। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিনূন টীকা ৬; আন নূর, টীকা ৩০-৩২ এবং আল আহযাব, টীকা ৬২)।
﴿إِلَّا عَلَىٰٓ أَزْوَٰجِهِمْ
أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ﴾
(৩০) স্ত্রী ও মালিকানাধীন স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে তারা তিরস্কৃত
হবে না।
﴿فَمَنِ ٱبْتَغَىٰ وَرَآءَ
ذَٰلِكَ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْعَادُونَ﴾
(৩১) তবে যারা এর বাইরে আর কেউকে চাইবে তারা সীমালংঘনকারী।২০
২০. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল-মু’মিনূন, টীকা-৭।
﴿وَٱلَّذِينَ هُمْ لِأَمَـٰنَـٰتِهِمْ
وَعَهْدِهِمْ رَٰعُونَ﴾
(৩২) যারা আমানত রক্ষা করে ও প্রতিশ্রুতি পালন করে।২১
২১. আমানতসমূহ বলতে এমন সব আমানত বুঝায়, যা আল্লাহ তা’আলা বান্দার
হাতে সোপর্দ করেছেন এবং একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের ওপর আস্থা স্থাপন করে
“আমানত” হিসেবে অর্পণ করে। ঠিক তেমনি চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি মানে বান্দা আল্লাহর সাথে যে চুক্তি বা
প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয় এবং মানুষ পরস্পরের সাথে যেসব চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিতে
আবদ্ধ হয় ও উভয় প্রকার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি। এ উভয় প্রকার আমানত এবং উভয় প্রকার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি
রক্ষা করা একজন মু’মিনের চরিত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। হাদীসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সামনে
যে বক্তব্যই পেশ করতেন তাতে অবশ্যই বলতেনঃ
لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ
لَهُ، وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
"সাবধান, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না
তার দ্বীনদারী নেই। (বায়হাকী-শু’আবুল ঈমান।)
﴿وَٱلَّذِينَ هُم بِشَهَـٰدَٰتِهِمْ
قَآئِمُونَ﴾
(৩৩) আর যারা সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে সততার ওপর অটল থাকে।২২
২২. অর্থাৎ তারা সাক্ষ্য যেমন গেপন করে না, তেমনি তাতে তেমন কোন কম বেশীও
করে না
﴿وَٱلَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ
صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ﴾
(৩৪) যারা নামাযের হিফাযত করে।২৩
২৩. এ থেকে নামাযের গুরুত্ব বুঝা যায়। যে ধরনের উন্নত চরিত্র ও মহৎ কর্মশীল লোক জান্নাতের
উপযুক্ত তাদের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে নামায দিয়ে শুরু করা হয়েছে এবং নামায
দিয়েই শেষ করা হয়েছে।
তাদের প্রথম গুণ হলো তারা হবে নামাযী।
দ্বিতীয় গুণ হলো, তারা হবে নামাযের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সর্বশেষ গুণ হলো, তারা নামযের হিফাযত করবে। নামাযের হিফাযতের অর্থ অনেক কিছু। যথা সময়ে নামায পড়া, দেহ ও পোশাক-পরিচ্ছদ পাক-পবিত্র আছে কিনা
নামাযের পূর্বেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া, অজু থাকা এবং অজু
করার সময় অঙ্গ-প্রত্যংগগুলো ভালভাবে ধোয়া, নামাযের ফরয
ওয়াজিব ও মোস্তাহাব গুলো ঠিকমত আদায় করা, নামাযের
নিয়ম-কানুন পুরোপুরি মেনে চলা, আল্লাহর নাফরমানী করে
নামাযকে ধ্বংস না করা, এসব বিষয়ও নামাযের হিফাযতের
অন্তর্ভুক্ত।
﴿أُو۟لَـٰٓئِكَ فِى جَنَّـٰتٍۢ
مُّكْرَمُونَ﴾
(৩৫) এসব লোক সম্মানের সাথে জান্নাতের বাগানসমূহে অবস্থান করবে।
﴿فَمَالِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟
قِبَلَكَ مُهْطِعِينَ﴾
(৩৬) অতএব হে নবী, কি ব্যাপার যে, এসব কাফের তোমার দিকে ছুটে আসছে?২৪
২৪. যে সমস্ত লোক নবী সা. এর দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ দেখে এবং
কুরআনের বক্তব্য শুনে তা নিয়ে হাসি-তামাসা করা এবং তার প্রতি বিদ্রূপবান নিক্ষেপ
করার জন্য চারদিক থেকে ছুটে আসতো এখানে তাদের কথা বলা হয়েছে।
﴿عَنِ ٱلْيَمِينِ وَعَنِ ٱلشِّمَالِ
عِزِينَ﴾
(৩৭) ডান দিকে ও বাম দিক হতে দলে দলে
﴿أَيَطْمَعُ كُلُّ ٱمْرِئٍۢ
مِّنْهُمْ أَن يُدْخَلَ جَنَّةَ نَعِيمٍۢ﴾
(৩৮) তাদের প্রত্যেকে কি এ আশা করে যে, তাকে
প্রাচুর্যে ভরা জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে?২৫
২৫. অর্থ হলো যেসব লোকের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এই মাত্র
বর্ণনা করা হলো আল্লাহর জান্নাত তো তাদের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু যারা সত্যের বাণী শোনা পর্যন্ত পছন্দ করে না এবং
ন্যায় ও সত্যের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য এভাবে ছুটে আসছে তারা জান্নাতের
দাবীদার কিভাবে হতে পারে? আল্লাহ কি এমন সব লোকদের জন্যই তার জান্নাত তৈরি করেছেন? এ পর্যায়ে সূরা আল কলমের ৩৪ থেকে ৪১ আয়াত সামনে থাকা দরকার। মক্কার কাফেররা বলতো, আখেরাত যদি থাকেও তাহলে এ
দুনিয়ায় তারা যেভাবে আমোদ প্রমোদ মত্ত থাকছে সেখানেও একইভাবে মত্ত থাকবে। আর মুহাম্মাদ সা. এর প্রতি ঈমান পোষণকারী
লোকেরা দুনিয়ায় যেভাবে দুরবস্থার শিকার হয়ে আছে সেখানেও ঠিক তাই থাকবে। উল্লেখিত আয়াতসমূহে কাফেরদের এ ধ্যান-ধারণার
জবাব দেয়া হয়েছে।
﴿كَلَّآ ۖ إِنَّا خَلَقْنَـٰهُم
مِّمَّا يَعْلَمُونَ﴾
(৩৯) কখখনো না। আমি যে জিনিস দিয়ে তাদের সৃষ্টি করেছি
তারা নিজেরা তা জানে।২৬
২৬. এখানে এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ হতে পারে। আগে বর্ণিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ধরে নিলে এর
অর্থ হবে, যে উপাদানে এসব লোককে সৃষ্টি করা হয়েছে সে হিসেবে সব মানুষ সমান। জান্নাতে যাওয়ার কারণ যদি ঐ উপাদানটি হয় তাহলে
সৎ ও অসৎ, জালেম ও ন্যায়নিষ্ঠা, অপরাধী ও নিরপরাধ সবারই
জান্নাতে যাওয়া উচিত। কিন্তু জান্নাতে যাওয়ার অধিকার যে, মানুষের সৃষ্টির উপাদানের ভিত্তিতে সৃষ্টি
হয় না বরং শুধু তার গুণাবলীর ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টির ফায়সালার জন্য সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিই যথেষ্ট। আর এ আয়াতাংশকে যদি পরবর্তী বিষয়ের পূর্বাভাস
বা ভূমিকা হিসেবে ধরে নেয়া হয় তাহলে তার অর্থ হবে এসব লোক নিজেরাই নিজেদেরকে আমার
আযাব থেকে নিরাপদ মনে করছে আর যে ব্যক্তি আমরা কাছে জবাবদিহি সম্পর্কে তাদেরকে
সাবধান করে দেয় তাকে বিদ্রূপ ও হাসি-তামাসা করছে। অথচ আমি চাইলে যখন ইচ্ছা দুনিয়াতেও তাদেরকে আযাব দিতে পারি
আবার যখন ইচ্ছা মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেও উঠাতে পারি। তারা জানে নগণ্য এক ফোটা বীর্য দিয়ে আমি তাদের সৃষ্টির
সূচনা করেছি এবং তারপর তাদেরকে সচল ও সক্ষম মানুষ বানিয়েছি। তাদের এ সৃষ্টি কৌশল সম্পর্কে যদি তারা চিন্তা-ভাবনা করতো
তাহলে কখনো এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী তারা হতো না যে, এখন তারা আমার কর্তৃত্বের
গণ্ডির বাইরে কিংবা আমি তাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম নই।
﴿فَلَآ أُقْسِمُ بِرَبِّ
ٱلْمَشَـٰرِقِ وَٱلْمَغَـٰرِبِ إِنَّا لَقَـٰدِرُونَ﴾
(৪০) অতএব না,২৭ আমি শপথ করছি উদয়াচল
ও অস্তাচলসমূহের মালিকের।২৮ আমি তাদের চাইতে উৎকৃষ্টতর লোকদেরকে তাদের
স্থলাভিষিক্ত করতে সক্ষম।
২৭. অর্থাৎ তারা যা মনে করে বসে আছে ব্যাপার আসলে তা নয়।
২৮. এখানে মহান আল্লাহ নিজেই নিজের সত্তার শপথ করেছেন। “উদয়াচলসমূহ ও অস্তাচলসমূহ” এ শব্দ ব্যবহারের
কারণ হলো, গোটা বছরের আবর্তন কালে সূর্য প্রতিদিনই একটি নতুন কোণ থেকে উদিত হয় এবং
একটি নতুন কোণে অস্ত যায়। তাছাড়া ও ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে সূর্য ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ক্রমাগত উদিত ও
অস্তমিত হতে থাকে। এ হিসেবে সূর্যের উদয় হওয়ার
ও অস্ত যাওয়ার স্থান একটি নয়, অনেক। আরেক হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের তুলনায় একটি দিক হলো পূর্ব এবং আরেকটি দিক
হলো পশ্চিম। তাই সূরা শূ’আরার ২৮ আয়াতে
এবং সূরা মুয্যাম্মিলের ১৯ আয়াতে رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ রাব্বিল
মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরেক বিচারে পৃথিবীর দু’টি উদয়াচল এবং দু’টি অস্তাচল আছে। কারণ পৃথিবীর এক গোলার্ধে যখন সূর্য অস্ত যায়
তখন অপর গোলার্ধে উদিত হয়। এ কারণে সূরা আর রহমানের ১৭ আয়াতে رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ রাব্বুল মাশরিকাইনি ওয়া
রাব্বুল মাগরিবাইনি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য, দেখুন, তাফহীমুল কুরআন,
সূরা আর রহমান, টীকা ১৭)।
﴿عَلَىٰٓ أَن نُّبَدِّلَ خَيْرًۭا
مِّنْهُمْ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ﴾
(৪১) আমাকে পেছনে ফেলে যেতে পারে এমন কেউ-ই নেই।২৯
২৯. এ কথাটির জন্যই আল্লাহ তা’আলা তাঁর দু’টি উদয়াচল ও দু’টি
অস্তাচলের মালিক হওয়ার শপথ করেছেন। এর অর্থ হলো, আমি যেহেতু উদয়াচল ও অস্তাচলসমূহের মালিক তাই গোটা পৃথিবীই আমার
কর্তৃত্বাধীন।
আমার কর্তৃত্ব ও পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া তোমাদের সাধ্যাতীত। যখন ইচ্ছা আমি তোমাদের ধ্বংস করতে পারি এবং তোমাদের
চাইতে উৎকৃষ্টতর কোন জাতির উত্থান ঘটিয়ে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারি।
﴿فَذَرْهُمْ يَخُوضُوا۟ وَيَلْعَبُوا۟
حَتَّىٰ يُلَـٰقُوا۟ يَوْمَهُمُ ٱلَّذِى يُوعَدُونَ﴾
(৪২) অতএব তাদেরকে অর্থহীন কথাবার্তা ও খেল- তামাসায় মত্ত থাকতে
দাও, যেদিনটির প্রতিশ্রুতি তাদেরকে দেয়া হচ্ছে যতদিন না
সেদিনটির সাক্ষাত তারা পায়।
﴿يَوْمَ يَخْرُجُونَ مِنَ
ٱلْأَجْدَاثِ سِرَاعًۭا كَأَنَّهُمْ إِلَىٰ نُصُبٍۢ يُوفِضُونَ﴾
(৪৩) সেদিন তারা কবর থেকে বেরিয়ে এমনভাবে দৌড়াতে থাকবে যেন তারা
নিজেদের দেব-প্রতিমার আস্তানার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।৩০
৩০. মূল আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো إِلَى نُصُبٍ يُوفِضُونَ । نصب (নুছুব) শব্দের অর্থের ব্যাপারে মুফাস্সিরগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। অনেকে এর অর্থ করেছেন মূর্তি বা প্রতিম। তাদের মতে এর অর্থ হলো, তারা হাশরের অধিপতি নির্ধারিত
জায়গার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হতে থাকবে ঠিক; আজ যেমন তারা
তাদের দেব-দেবীর আস্তানার দিকে ছুটে যায়। আবার অন্য আরেক দল মুফাস্সিরের মতে এর অর্থ দৌড়ে অংশ
গ্রহণকারীদের জন্য চিহ্নিত গন্তব্য স্থল। প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী যাতে সবার আগে সেখানে পৌঁছতে
চেষ্টা করে।
﴿خَـٰشِعَةً أَبْصَـٰرُهُمْ
تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌۭ ۚ ذَٰلِكَ ٱلْيَوْمُ ٱلَّذِى كَانُوا۟ يُوعَدُونَ﴾
(৪৪) সেদিন চক্ষু হবে আনত, লাঞ্চনা তাদের
আচ্ছন্ন করে রাখবে। ঐ দিনটিই সেদিন যার প্রতিশ্রুতি এদেরকে দেয়া হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।