০৭১. নূহ
আয়াতঃ ২৮; রুকুঃ ০২; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
‘নূহ’ এ সূরার নাম। এর বিষয়বস্তুর শিরোনামও ‘নূহ’। কারণ এতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত ‘নূহ’
আ. এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কালঃ
এটিও রাসূলুল্লাহ সা. এর মক্কী জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিল হওয়া সূরাসমূহের
অন্যতম। তবে এর বিষয়বস্তুর
আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যে সময় রাসূলুল্লাহ সা. এর দাওয়াত ও
তাবলীগের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের শত্রুতামূলক আচরণ বেশ তীব্রতা লাভ করেছিল তখন এ
সূরাটি নাযিল হয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ
এতে হযরত নূহ আ. এর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তবে তা কেবল কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্যে করা হয়নি।বরং এর উদ্দেশ্য মক্কার কাফেরদের এ মর্মে
সাবধান করা যে, হযরত নূহ আ. এর সাথে তার কওম যে আচরণ করেছিল তোমরাও হযরত মুহাম্মাদ সা.
এর সাথে সে একই আচরণ করছো। তোমরা যদি এ আচরণ থেকে বিরত না হও তাহলে তোমাদেরও সে একই পরিণতির সম্মুখীন
হতে হবে যার সম্মুখীন হয়েছিল ঐসব লোকেরা। গোটা সূরার মধ্যে একথাটি স্পষ্ট ভাষায় কোথাও বলা হয়নি। কিন্তু যে অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মক্কীবাসীদের
এ কাহিনী শুনানো হয়েছে তার পটভূমিতে এ বিষয়টি আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যে সময় আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ আ. কে রিসালাতের পদ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন
সে সময় তাঁর ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন প্রথম আয়াতে তা বলা হয়েছে।
তিনি তাঁর দাওয়াত কিভাবে শুরু করেছিলেন এবং স্বজাতির মানুষের সামনে কি বক্তব্য
পেশ করেছিলেন।
২ থেকে ৪ পর্যন্ত আয়াতে তা সংক্ষিপ্তাকারে বলা হয়েছে, এরপর দীর্ঘকাল পর্যন্ত দ্বীনের
দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরণ করার পর তার যে বর্ণনা হযরত নূহ আ.
আল্লাহর দরবারে পেশ করেছিলেন ৫ থেকে ২০ আয়াতে তা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তাঁর জাতিকে সত্য পথে আনার জন্য কিভাবে
চেষ্টা-সাধনা করেছেন আর তাঁর জাতির লোকেরা কি রকম হঠকারিতার মাধ্যমে তার
বিরোধিতা করেছে এ পর্যায়ে তিনি তার সবই তাঁর প্রভুর সামনে পেশ করেছেন।
এরপর ২১ থেকে ২৪ আয়াতে হযরত নূহ আ. এর শেষ আবেদনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তিনি মহান আল্লাহর কাছে এ মর্মে আবেদন
করেছেন যে, এ জাতি আমার দাওয়াত চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরা তাদের নেতাদের হাতে নিজেদের লাগাম তুলে
দিয়েছে এবং বিরাট ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করেছে। এখন তাদের থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার শুভবুদ্ধি ও যোগ্যতা
ছিনিয়ে নেয়ার সময় এসে গেছে। হযরত নূহ আ. এর পক্ষ থেকে এটা কোন প্রকার অধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং শত শত বছর ধরে ধৈর্যের চরম পরীক্ষার মত
পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে দ্বীনের তাবলীগের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পর যে সময় তিনি
তাঁর কওমের ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়ে গেলেন কেবল তখনই তিনি এ সিদ্ধান্তে
পৌঁছলেন যে, এখন এ জাতির সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। তাঁর এ সিদ্ধান্ত ছিল হুবহু আল্লাহ তা’আলার
ফায়সালার অনুরূপ। তা-ই এর পরবর্তী ২৫ আয়াতেই
বলা হয়েছে। এ জাতির কৃতকর্মের কারণে
তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাব নাযিল হলো।
আযাব নাযিল হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে হযরত নূহ আ. আল্লাহ তা’আলার কাছে যে
দোয়া করেছিলেন শেষ আয়াতটিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তিনি নিজের ও ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন
এবং নিজ কওমের কাফেরদের জন্য এ মর্মে আল্লাহর কাছে আবেদন করছেন যেন তাদের কাউকেই
পৃথিবীর বুকে বসবাস করার জন্য জীবিত রাখা না হয়, কারণ তাদের মধ্যে এখন আর কোন
কল্যাণই অবশিষ্ট নেই। তাই তাদের ঔরসে এখন যারাই জন্মলাভ করবে তারাই কাফের এবং পাপী হিসেবেই বেড়ে
উঠবে।
এ সূরা অধ্যয়নকালে ইতিপূর্বে কুরআন মজীদে হযরত নূহ আ. এর কাহিনীর যে বিস্তারিত
ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে তাও সামনে থাকা দরকার। দেখুন সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ৫৯ থেকে ৬৪; ইউনূস,
৭১ থেকে ৭৩; হুদ, ২৫
থেকে ৪৯; আল মু’মিনূন, ২৩ থেকে ৩১;
আশ শু’আরা, ১০৫ থেকে ১২২; আল আনকাবুত, ১৪ ও ১৫, আস
সাফফাত, ৭৫ থেকে ৮২ এবং আল কামার, ৯
থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿إِنَّآ أَرْسَلْنَا نُوحًا
إِلَىٰ قَوْمِهِۦٓ أَنْ أَنذِرْ قَوْمَكَ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ﴾
(১) আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম (এ নির্দেশ দিয়ে) যে,
একটি কষ্টদায়ক আযাব আসার আগেই তুমি তাদেরকে সাবধান করে দাও।১
১. অর্থাৎ একথা জানিয়ে দেবেন যে, তারা যে বিভ্রান্তি ও নৈতিক
অনাচারের মধ্যে পড়ে আছে যদি তা থেকে বিরত না হয় তাহলে তা তাদের আল্লাহর আযাবের
উপযুক্ত করে দেবে। এ
আযাব থেকে বাঁচার জন্য কোন্ পথ অবলম্বন করতে হবে তাও তাদের বলে দেবেন।
﴿قَالَ يَـٰقَوْمِ إِنِّى
لَكُمْ نَذِيرٌۭ مُّبِينٌ﴾
(২) সে বললো, হে আমার জাতি, আমি তোমাদের জন্য একজন সতর্ককারী
﴿أَنِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ
وَٱتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ﴾
(৩) (বার্তাবাহক, আমি তোমাদের জানিয়ে
দিচ্ছি) যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো,২
২. হযরত নূহ আ. তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনের শুরুতেই তাঁর
জাতির সামনে এ তিনটি বিষয় পেশ করেছিলেন। অর্থাৎ এক, আল্লাহর দাসত্ব, দুই,
তাকওয়া বা আল্লাহভীতি এবং তিন, রাসূলের
আনুগত্য। আল্লাহর দাসত্বের মানে অন্য
সবকিছুর দাসত্ব ও গোলামী বর্জন করে এক আল্লাহকেই শুধু উপাস্য মেনে নিয়ে কেবল
তাঁরই উপাসনা করা এবং তাঁরই আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তাকওয়া বা আল্লাহভীতির মানে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা যা
আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও গযবের কারণ হয় এবং নিজেদের জীবনে এমন নীতি গ্রহণ করো যা
একজন আল্লাহ ভীরু মানুষের গ্রহণ করা উচিত। আর আমার আনুগত্য করো একথাটির মানে হলো, আল্লাহর রাসূল হিসেবে তোমাদের
যেসব আদেশ দেই তা মেনে চলো।
﴿يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ
وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّى ۚ إِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ إِذَا جَآءَ لَا
يُؤَخَّرُ ۖ لَوْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
(৪) আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন৩ এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের
অবকাশ দেবেন।৪ প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহর নির্ধারিত সময়
যখন এসে যায় তখন তা থেকে বাঁচা যায় না।৫ আহ্! যদি তোমরা তা জানতে।৬
৩. মূল ইবারতে শব্দ আছে يَغْفِرُلَكُمْ مِنْ ذُنُوْبَكُمْ (ইয়াগফিরলাকুম মিন জুনুবিকুম) এ
আয়াতাংশের অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তোমাদের কিছু গোনাহ মাফ
করে দেবেন। বরং এর সঠিক অর্থ হলো, যে তিনটি বিষয় তোমাদের সামনে
পেশ করা হচ্ছে তা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলে এতদিন পর্যন্ত যে গোনাহ তোমরা
করেছো তা সবই আল্লাহ মাফ করে দেবেন। এখানে مِنْ (মিন) শব্দটি অংশবিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।
৪. অর্থাৎ যদি তোমরা এ তিনটি বিষয় মেনে নাও তাহলে আল্লাহ
তা’আলা তোমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য যে সময় নির্ধারিত রেখেছেন সে সময় পর্যন্ত
এ পৃথিবীতে তোমাদের বেঁচে থাকার অবকাশ হবে।
৫. কোন কওমের ওপর আযাব নাযিল করার জন্য আল্লাহ তা’আলা যে
সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এখানে সে সময়টিকে বুঝানো হয়েছে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা
হয়েছে যে, কোন কওমের জন্য আযাবের ফায়সালা হয়ে যাওয়ার পর ঈমান আনলেও তাদের আর মাফ
করা হয় না।
৬. অর্থাৎ যদি তোমরা এ বিষয়টি বুঝতে যে, আমার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার
বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছার পর যে সময়টা অতিবাহিত হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে তোমাদের
জন্য একটা অবকাশ।
তোমাদেরকে এ অবকাশ দেয়া হয়েছে ঈমান আনায়নের জন্য। এ অবকাশের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর
আযাব থেকে তোমাদের নিষ্কৃতি পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় ঈমান আনায়নের জন্য তোমরা দ্রুত এগিয়ে আসবে। আযাব আসার সময় পর্যন্ত তা আর বিলম্বিত করবে না।
﴿قَالَ رَبِّ إِنِّى دَعَوْتُ
قَوْمِى لَيْلًۭا وَنَهَارًۭا﴾
(৫) সে৭ বললোঃ হে আমার বর, আমি আমার কওমের লোকদের
রাত-দিন আহবান করেছি।
৭. মাঝখানে একটি দীর্ঘকালের ইতিহাস বাদ দিয়ে নূহ আ. এর আবেদন
তুলে ধরা হচ্ছে, যা তিনি তাঁর রিসালাতের শেষ যুগে আল্লাহর সামনে পেশ করেছিলেন।
﴿فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَآءِىٓ
إِلَّا فِرَارًۭا﴾
(৬) কিন্তু আমার আহবান তাদের দূরে সরে যাওয়াকে কেবল বাড়িয়েই
তুলেছে।৮
৮. অর্থাৎ আমি যতই তাদেরকে আহবান করেছি তারা ততই দূরে সরে
গিয়েছে।
﴿وَإِنِّى كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ
لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوٓا۟ أَصَـٰبِعَهُمْ فِىٓ ءَاذَانِهِمْ وَٱسْتَغْشَوْا۟ ثِيَابَهُمْ
وَأَصَرُّوا۟ وَٱسْتَكْبَرُوا۟ ٱسْتِكْبَارًۭا﴾
(৭) তুমি যাতে তাদের ক্ষমা করে দাও৯ এ উদ্দেশ্যে আমি যখনই তাদের আহবান করেছি
তখনই তারা কানে আঙুল দিয়েছে,১০ এবং কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে, নিজেদের আচরণে অনড় থেকেছে
এবং অতিমাত্রায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে।১১
৯. এর মধ্যেই একথাটি নিহিত আছে যে, তারা নাফরমানীর আচরণ পরিহার
করে ক্ষমা প্রার্থী হবে। কারণ কেবল এভাবেই তারা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করতে পারতো।
১০. মুখ ঢাকার একটি কারণ হতে পারে, তারা হযরত নূহ আ. এর বক্তব্য
শোনা তো দূরের কথা তাঁর চেহারা দেখাও পছন্দ করতো না। আরেকটি কারণ হতে পারে, তারা তাঁর সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার
সময় মুখ ঢেকে চলে যেতো যাতে তিনি তাদের চিনে কথা বলার কোন সুযোগ আদৌ না পান। মক্কার কাফেররা রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে যে
ধরণের আচরণ করেছিলো সেটিও ছিল অনুরূপ একটি আচরণ। সূরা হূদের ৫ আয়াতে তাদের এ আচরণের উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে
“দেখ, এসব লোক
তাদের বক্ষ ঘুরিয়ে নেয় যাতে তারা রাসূলের চোখের আড়ালে থাকতে পারে। সাবধান! যখন এরা কাপড় দ্বারা নিজেদেরকে ঢেকে
আড়াল করে তখন আল্লাহ তাদের প্রকাশ্য বিষয়গুলোও জানেন এবং গোপন বিষয়গুলোও জানেন। তিনি তোমাদের মধ্যকার গোপন কথাও জানেন।” (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা হূদ, টীকা ৫ ও ৬)
১১. এখানে تكبير বা ঔদ্ধত্যের মানে হলো তারা ন্যায় ও সত্যকে
মেনে নেয়া এবং আল্লাহর রাসূলের উপদেশ গ্রহণ করাকে তাদের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের
তুলনায় নীচু কাজ বলে মনে করেছে। উদাহরণস্বরূপ কোন সৎ ও ভাল লোক যদি কোন দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে উপদেশ দান
করে আর সেজন্য ঐ ব্যক্তি ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়ে এবং মাটিতে পদাঘাত করে বেরিয়ে
যায় তাহলে বুঝা যাবে যে, সে ঔদ্ধত্যের সাথে উপদেশ বাণী প্রত্যাখ্যান করেছে।
﴿ثُمَّ إِنِّى دَعَوْتُهُمْ
جِهَارًۭا﴾
(৮) অতঃপর আমি তাদেরকে উচ্চকণ্ঠে আহবান জানিয়েছি।
﴿ثُمَّ إِنِّىٓ أَعْلَنتُ
لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًۭا﴾
(৯) তারপর প্রকাশ্যে তাদের কাছে তাবলীগ করেছি এবং গোপনে চুপে
চুপে বুঝিয়েছি।
﴿فَقُلْتُ ٱسْتَغْفِرُوا۟
رَبَّكُمْ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارًۭا﴾
(১০) আমি বলেছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয়
ক্ষমাশীল।
﴿يُرْسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيْكُم
مِّدْرَارًۭا﴾
(১১) তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন।
﴿وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَٰلٍۢ
وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّـٰتٍۢ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَـٰرًۭا﴾
(১২) সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দিবেন।১২
১২. একথাটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহদ্রোহিতার আচরণ মানুষের
জীবনকে শুধু আখেরাতেই নয় দুনিয়াতেও সংকীর্ণ করে দেয়। অপরপক্ষে কোন জাতি যদি অবাধ্যতার বদলে ঈমান, তাকওয়া এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ
মেনে চলার পথ অনুসরণ করে তাহলে তা শুধু আখেরাতের জন্যই কল্যাণকর হয় না, দুনিয়াতেও তার ওপর আল্লাহর অশেষ নিয়ামত বর্ষিত হতে থাকে। সূরা-ত্বা-হায় বলা হয়েছেঃ “যে দিন আমি তাকে
অন্ধ করে উঠাবো।” (আয়াত ১২৪) সূরা মা-য়েদায়
বলা হয়েছেঃ “আহলে কিতাব যদি তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত ‘তাওরাত’, ‘ইনজিল’ ও অন্যান্য আসমানী
কিতাবের বিধানাবলী মেনে চলতো তাহলে তাদের জন্য ওপর থেকেও রিযিক বর্ষিত হতো এবং
নীচ থেকেও ফুটে বের হতো।” (আয়াত ৬৬) সূরা আ’রাফে বলা হয়েছেঃ জনপদসমূহের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো এবং
তাকওয়ার নীতি অনুসরণ করতো তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকতের দরজাসমূহ
খুলে দিতাম। (আয়াত ৯৬) সূরা হূদে বর্ণিত
হয়েছে যে, হযরত হূদ আ. তাঁর কওমের লোকদের বললেনঃ “হে আমার কওমের লোকরা, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তাঁর
দিকে ফিরে যাও।
তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি ও
ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবেন।” (আয়াত ৫২) খোদ নবী সা.কে দিয়ে মক্কার লোকদের সম্বোধন করে এ সূরা হূদেই
বলা হয়েছেঃ “আর তোমরা যদি তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাঁর দিকে
ফিরে আসো তাহলে তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দান
করবেন।” (আয়াত ৩) হাদীসে উল্লেখিত
হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. কুরাইশদের বললেনঃ একটি কথা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলে আরব
ও আজমের শাসনদণ্ডের অধিকারী হয়ে যাবে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা মা-য়েদাহ, টীকা ৯৬; সূরা হূদ, টীকা ৩ ও
৫৭; সূরা ত্বা-হা, টীকা ১০৫ এবং সূরা
সোয়াদের ভূমিকা)।
কুরআন মজীদের এ নির্দেশনা অনুসারে কাজ করতে গিয়ে একবার দুর্ভিক্ষের সময় হযরত
উমর রা. বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে বের হলেন এবং শুধু ইতসিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা)
করেই শেষ করলেন। সবাই বললো, “হে আমীরুল মু’মিনীন আপনি তো
আদৌ দোয়া করলেন না। তিনি বললেনঃ আমি আসমানের ঐসব দরজায় করাঘাত করেছি যেখান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। একথা বলেই তিনি সূরা নূহের এ আয়াতগুলো তাদের
পাঠ করে শুনালেন। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর)
অনুরূপ একবার এক ব্যক্তি হাসান বাসরীর মজলিসে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করলে তিনি বললেনঃ
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অপর এক ব্যক্তি দারিদ্রের অভিযোগ করলো। তৃতীয় এক ব্যক্তি বললোঃ আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই। চতুর্থ এক ব্যক্তি বললোঃ আমার ফসলের মাঠে ফলন
খুব কম হচ্ছে। তিনি সবাইকে একই জবাব দিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। লোকেরা বললোঃ কি ব্যাপার যে, আপনি প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন
অভিযোগের একই প্রতিকার বলে দিচ্ছেন? তখন তিনি সূরা নূহের এ
আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন। (কাশশাফ)
﴿مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ
لِلَّهِ وَقَارًۭا﴾
(১৩) তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা
আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে বলে মনে করছো
না।১৩
১৩. অর্থাৎ দুনিয়ার ছোট ছোট নেতা ও বিশেষ ব্যক্তিদের
সম্পর্কে তো তোমরা মনে করো, তাদের মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা
পরিপন্থী কোন আচরণ বিপদজনক। কিন্তু বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহ সম্পর্কে এতটুকুও মনে করো না যে, তিনিও মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার অধিকারী সত্তা। তোমরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছো, তাঁর প্রভুত্বের মধ্যে অন্যকে
শরীক করছো, তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করছো, এসব সত্ত্বেও তাঁকে তোমরা একটুকু ভয়ও করো না যে, এজন্য
তিনি তোমাদের শাস্তি দেবেন।
﴿وَقَدْ خَلَقَكُمْ أَطْوَارًا﴾
(১৪) অথচ তিনিই তোমাদের পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন।১৪
১৪. অর্থাৎ সৃষ্টিকর্মের বিভিন্ন পর্যায় ও স্তর অতিক্রম করে
তোমাদের বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানো হয়েছে। প্রথমে তোমরা বীর্য আকারে মা-বাপের দেহে ছিলে। অতঃপর আল্লাহর বিধান ও সৃষ্টি কৌশল অনুসারে এ
দু’টি বীর্য সংমিশ্রিত হয়ে তোমরা মাতৃগর্ভে স্থিতি লাভ করেছিলে। এরপর মাতৃগর্ভে দীর্ঘ নয়টি মাস ধরে ক্রমবিকাশ
ও উন্নয়ন ঘটিয়ে তোমাদের পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতি দেয়া হয়েছে এবং মানুষ হিসেবে
দুনিয়াতে কাজ করার জন্য যে শক্তি ও যোগ্যতার প্রয়োজন তা তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি
করা হয়েছে। তারপর তোমরা একটি জীবন্ত
শিশু হিসেবে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছো, প্রতি মুহূর্তেই একটি অবস্থা থেকে আরেকটি
অবস্থায় তোমাদের উত্তরণ ঘটানো হয়েছে। অবশেষে তোমরা যৌবনে ও প্রৌঢ়ত্যে উপনীত হয়েছো। এসব পর্যায় অতিক্রম কালে প্রতি মুহূর্তেই
তোমরা পুরোপুরি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ ও কবজায় ছিলে। তিনি ইচ্ছা করলে তোমার জন্মের জন্য গর্ভ সঞ্চারই হতে
দিতেন না এবং সে গর্ভে তোমার পরিবর্তে অন্য কেউ স্থিতিলাভ করতো। তিনি চাইলে মাতৃগর্ভেই তোমাদের অন্ধ, বধির, বোবা
কিংবা বিকলাঙ্গ করে দিতেন অথবা তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি বিশৃঙ্খল ও ত্রুটিপূর্ণ করে
দিতেন। তিনি চাইলে তোমরা জীবন্ত
শিশুরূপে জন্ম লাভই করতে পারতে না। জন্মলাভের পরও যে কোন মুহূর্তে তিনি তোমাদের ধ্বংস করতে পারতেন। তাঁর একটি মাত্র ইঙ্গিতেই তোমরা কোন
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যেতে। যে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে তোমরা এতটা অসহায় তাঁর সম্পর্কে কি করে এ
ধারণা পোষণ করে বসে আছো যে, তাঁর সাথে সব রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অকৃতজ্ঞতার আচরণ করা যেতে
পারে, তাঁর বিরুদ্ধে সব রকম বিদ্রোহ করা যেতে পারে, কিন্তু এসব আচরণের জন্য তোমাদের কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে না?
﴿أَلَمْ تَرَوْا۟ كَيْفَ خَلَقَ
ٱللَّهُ سَبْعَ سَمَـٰوَٰتٍۢ طِبَاقًۭا﴾
(১৫) তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ কিভাবে
সাত স্তরে বিন্যস্ত করে আসমান সৃষ্টি করেছেন?
﴿وَجَعَلَ ٱلْقَمَرَ فِيهِنَّ
نُورًۭا وَجَعَلَ ٱلشَّمْسَ سِرَاجًۭا﴾
(১৬) ওগুলোর মধ্যে চাঁদকে আলো এবং সূর্যকে প্রদীপ হিসেবে
স্থাপন করেছেন।
﴿وَٱللَّهُ أَنۢبَتَكُم مِّنَ
ٱلْأَرْضِ نَبَاتًۭا﴾
(১৭) আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে মাটি থেকে বিস্ময়কররূপে উৎপন্ন
করেছেন।১৫
১৫. এ স্থানে মাটির উপাদান থেকে মানুষ সৃষ্টি করাকে উদ্ভিদ
উৎপন্ন হওয়ার সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। কোন এক সময় যেমন এই গ্রহে উদ্ভিদরাজি ছিল না। মহান আল্লাহই এখানে উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছেন। ঠিক তেমনি এক সময়ে এ ভূপৃষ্ঠে কোন মানুষের
অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহ তা’আলাই এখানে তাদের
সৃষ্টি করেছেন।
﴿ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا
وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًۭا﴾
(১৮) আবার এ মাটির মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন এবং অকস্মাৎ এ
মাটি থেকেই তোমাদের বের করে আনবেন।
﴿وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ
ٱلْأَرْضَ بِسَاطًۭا﴾
(১৯) আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য বিছানার মত করে পেতে
দিয়েছেন।
﴿لِّتَسْلُكُوا۟ مِنْهَا سُبُلًۭا
فِجَاجًۭا﴾
(২০) যেন তোমরা এর প্রশস্ত পথে চলতে পারো
﴿قَالَ نُوحٌۭ رَّبِّ إِنَّهُمْ
عَصَوْنِى وَٱتَّبَعُوا۟ مَن لَّمْ يَزِدْهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥٓ إِلَّا خَسَارًۭا﴾
(২১) নূহ বললোঃ হে প্রভু, তারা আমার কথা
প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঐসব নেতার অনুসরণ করেছে যারা সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পেয়ে
আরো বেশী ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে।
﴿وَمَكَرُوا۟ مَكْرًۭا كُبَّارًۭا﴾
(২২) এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করে রেখেছে।১৬
১৬. ষড়যন্ত্রের অর্থ হলো জাতির লোকদের সাথে নেতাদের
ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা।
নেতারা জাতির লোকদের হযরত নূহ আ. এর শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার
চেষ্টা করতো। যেমন, তারা বলতোঃ “নূহ তো তোমাদের
মতই একজন মানুষ।
আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর কাছে অহী এসেছে তা কি করে মেনে নেয়া যায়?” (সূরা আ’রাফ ৬৩; হূদ-২৭) “আমাদের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা না বুঝে শুনে নূহের আনুগত্য করছে। তাঁর কথা যদি সত্যিই মূল্যবান হতো তাহলে
জাতির নেতা ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করতো।” (হূদ-২৭) “আল্লাহ যদি পাঠাতেই চাইতেন তাহলে
কোন ফেরেশতা পাঠাতেন।”
(আল মু’মিনূন, ২৪) এ ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হতেন, তাহলে
তাঁর কাছে সবকিছুর ভাণ্ডার থাকতো, তিনি অদৃশ্য বিষয়
সম্পর্কে জানতেন এবং ফেরেশতাদের মত সব রকম মানবীয় প্রয়োজন ও অভাব থেকে মুক্ত হতেন। (সূরা হূদ, ৩১) নূহ এবং তাঁর অনুসারীদের এমন কি
অলৌকিকত্ব আছে যার জন্য তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতে হবে?
(হূদ, ২৭) এ ব্যক্তি আসলে তোমাদের মধ্যে তাঁর
নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। (আল মু’মিনূন, ২৫) প্রায় এ রকম কথা বলেই কুরাইশ নেতারা লোকদের নবী সা. এর বিরুদ্ধে
বিভ্রান্ত করতো।
﴿وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ
ءَالِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّۭا وَلَا سُوَاعًۭا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًۭا﴾
(২৩) তারা বলেছে, তোমরা নিজেদের
দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না। আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকেও১৭ পরিত্যাগ করো না।
১৭. নূহের কওমের উপাস্যদের দেবীদের মধ্য থেকে এখানে সেসব
দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তীকালে মক্কাবাসীরা যাদের পূজা করতে শুরু
করেছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বিভিন্ন স্থানে তাদের মন্দিরও বর্তমান ছিল। এটা অসম্ভব নয় যে, মহাপ্লাবনে যেসব লোক রক্ষা
পেয়েছিল পরবর্তী বংশধরগণ তাদের মুখ থেকে নূহের আ. জাতির প্রাচীন উপাস্য
দেব-দেবীদের নাম শুনেছিল এবং পরে তাদের বংশধরদের মধ্যে নতুন করে জাহেলিয়াত ছড়িয়ে
পড়লে তারা সেসব দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরী করে তাদের পূজা অর্চনা শুরু করেছিল।
‘ওয়াদ্দ’ ছিল ‘কুদা’আ’ গোত্রের “বনী কালব ইবনে দবরা” শাখার উপাস্য দেবতা। “দুমাতুল জানদাল” নামক স্থানে তারা এর বেদী
নির্মাণ করে রেখেছিল।
আরবের প্রাচীন শিলা লিপিতে তার নাম “ওয়াদ্দম আবাম” (ওয়াদ্দ বাপু) উল্লেখিত আছে। কালবীর মতে তার মূর্তি ছিল এক বিশালদেহী
পুরুষের আকৃতিতে নির্মিত।
কুরাইশরাও তাকে উপাস্য দেবতা হিসেবে মানতো। তাদের কাছে এর নাম ছিল “উদ্দ”। তার নাম অনুসারে ইতিহাসে “আবদে উদ্দ” নামে এক ব্যক্তির
উল্লেখ দেখা যায়।
“সুওয়া” ছিল হুযাইল গোত্রের দেবী। তার মূর্তি ছিল নারীর আকৃতিতে তৈরী। ইয়াম্বুর সন্নিকটস্থ “রুহাত” নামক স্থানে তার মন্দির ছিল।
“ইয়াগুস” ছিল “তায়” গোত্রের “আনউম” শাখার এবং “মাযহিজ” গোত্রের কোন কোন
শাখার উপাস্য দেবতা। “মাযহিজে”র শাখা গোত্রের লোকেরা ইয়ামান ও হিজাযের মধ্যবর্তী “জুরাশ” নামক
স্থানে তার সিংহাকৃতির মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিল। কুরাইশ গোত্রেরও কোন কোন লোকের নাম আবদে ইয়াগুস ছিল
বলে দেখা যায়।
“ইয়াউক” ইয়ামানের হামদান অঞ্চলের অধিবাসী হামদান গোত্রের “খায়ওয়ান” শাখার
উপাস্য দেবতা ছিল। এর
মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির।
“নাসর” ছিল হিমইয়ার অঞ্চলের হিমইয়ার গোত্রের “আলে যুল-কুলা” শাখার দেবতা। “বালখা” নামক স্থানে তার মূর্তি ছিল। এ মূর্তির আকৃতি ছিল শকুনের মত। সাবার প্রাচীন শিলালিপিতে এর নাম উল্লেখিত
হয়েছে “নাসূর”। এর মন্দিরকে লোকেরা “বায়তে
নাসূর” বা নাসূরের ঘর এবং এর পূজারীদের “আহলে নাসূর” বা নাসূরের পূজারী বলতো। প্রাচীন মন্দিরসমূহের যে ধ্বংসাবশেষ আরব এবং
তার সন্নিহিত অঞ্চলসমূহে পাওয়া যায় সেসব মন্দিরের অনেকগুলোর দরজায় শকুনের চিত্র
খোদিত দেখা যায়।
﴿وَقَدْ أَضَلُّوا۟ كَثِيرًۭا
ۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّـٰلِمِينَ إِلَّا ضَلَـٰلًۭا﴾
(২৪) অথচ এসব দেব-দেবী বহু লোককে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছে। তুমিও এসব জালেমদের
জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।১৮
১৮. এ সূরার ভূমিকাতেই আমরা এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি যে, হযরত নূহ আ. এর এ বদদোয়া কোন
প্রকার ধৈর্যহীনতার কারণ ছিল না। বরং এ বদদোয়া তাঁর মুখ থেকে তখনই উচ্চারিত হয়েছিল যখন
তাবলীগ ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর জাতির
ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়েছিলেন। হযরত মূসাও এরূপ পরিস্থিতিতেই ফেরাউন ও ফেরাউনের কওমের জন্য এ বলে বদদোয়া
করেছিলেনঃ “হে প্রভু! তুমি এদের অর্থ-সম্পদ ধ্বংস করে দাও এবং তাদের দিলের ওপর
মোহর লাগিয়ে দাও, এরা কঠিন আযাব না দেখা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।” তার জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেছিলেনঃ তোমার দোয়া কবুল
করা হয়েছে। (ইউনূস, আয়াত ৮৮-৮৯) হযরত মূসা আ. এর
বদদোয়ার মত নূহ আ. এর এ বদদোয়াও ছিল আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। তাই সূরা হূদে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
وَ اُوْحِىَ اِلَى نُوْحٍ
اَنَّهُ لَنْ يُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ اِلاَّ مَنْ قَدْ اَمَنَ فَلاَ تَبْتَئِسْ بَمَا
كَا نُوْا يَفْعَلُوْنَ
“আর অহী পাঠিয়ে নূহকে জানিয়ে দেয়া হলো, এ পর্যন্ত
তোমার কওমের যেসব লোক ঈমান এনেছে এখন তারা ছাড়া আর কেউ ঈমান আনবে না। তাদের কৃতকর্মের জন্য আর দুঃখ করো না।” (হূদ, ৩৬)
﴿مِّمَّا خَطِيٓـَٔـٰتِهِمْ
أُغْرِقُوا۟ فَأُدْخِلُوا۟ نَارًۭا فَلَمْ يَجِدُوا۟ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ أَنصَارًۭا﴾
(২৫) নিজেদের অপরাধের কারণেই তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল তারপর
আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।১৯ অতঃপর তারা আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার
জন্য কোন সাহায্যকারী পায়নি।২০
১৯. অর্থাৎ নিমজ্জিত হওয়াতেই তাদের ব্যাপারটি চূড়ান্তভাবে শেষ
হয়ে যায়নি। বরং ধ্বংস হওয়ার পরপরই
তাদের রূহসমূহকে আগুনের কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ আচরণের সাথে ফেরাউন ও তার জাতির সাথে কৃত
আচরণের হুবহু মিল রয়েছে। এ
বিষয়টিই সূরা আল মু’মিনের ৪৫ ও ৪৬ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিন, টীকা-৬৩) যেসব আয়াত দ্বারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের আযাব বা কবরের আযাব
প্রমাণিত হয় এ আয়াতটি তারই একটি।
২০. অর্থাৎ তারা যেসব দেব-দেবীকে সাহায্যকারী মনে করতো, সেসব দেব-দেবীর কেউ-ই তাদের
রক্ষা করতে আসেনি।
এটা যেন মক্কাবাসীদের জন্য এ মর্মে সতর্কবাণী যে, তোমরাও যদি আল্লাহর আযাবে
পাকড়াও হও তাহলে যেসব দেব-দেবীর ওপর তোমরা ভরসা করে আছো তারা তোমাদের কোন কাজেই
আসবে না।
﴿وَقَالَ نُوحٌۭ رَّبِّ لَا
تَذَرْ عَلَى ٱلْأَرْضِ مِنَ ٱلْكَـٰفِرِينَ دَيَّارًا﴾
(২৬) আর নূহ বললোঃ হে আমার রব, এ
কাফেরদের কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না।
﴿إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا۟
عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوٓا۟ إِلَّا فَاجِرًۭا كَفَّارًۭا﴾
(২৭) তুমি যদি এদের ছেড়ে দাও তাহলে এরা তোমার বান্দাদের
বিভ্রান্ত করবে এবং এদের বংশে যারাই জন্মলাভ করবে তারাই হবে দুষ্কৃতকারী ও কাফের।
﴿رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ
وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًۭا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ وَلَا تَزِدِ
ٱلظَّـٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢا﴾
(২৮) হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।