্
০১৪. সূরা ইবরাহীম
আয়াতঃ ৫২; রুকুঃ ০৭; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
৩৫ নং আয়াতে উল্লেখিত وَإِذْ
قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا বাক্যাংশ থেকে এ সূরার নাম গৃহীত হয়েছে। এ
নামকরণের মানে এ নয় যে, এ সূরায় হযরত ইবরাহীমের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা
করা হয়েছে। বরং অধিকাংশ সূরার নামের মতো এখানেও আলামত হিসেবে এ নাম ব্যবহৃত
হয়েছে। অর্থাৎ এটি এমন একটি সূরা যেখানে ইব্রাহীম আ. এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়-কালঃ
সূরাটির সাধারণ বর্ণনা পদ্ধতি মক্কার শেষ যুগের সূরাগুলোর মতো। তাই এটি সূরা
রা’আদের নিকটবর্তী কালে অবতীর্ণ বলে মনে হয়। বিশেষ করে ১৩ নং আয়াতের وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ
لَنُخْرِجَنَّكُم مِّنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا এবং অস্বীকারকারীরা নিজেদের রাসূলদের বললো, তোমাদের
ফিরে আসতে হবে আমাদের ধর্মীয় জাতিসত্তার মধ্যে,
অন্যথায়
আমরা তোমাদের বের করে দেবো আমাদের দেশ থেকে শব্দাবলী থেকে পরিষ্কার ইংগিত পাওয়া
যায় যে, সে সময় মক্কায় মুসলমানদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চরম
পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মক্কাবাসীরা অতীতের কাফের জাতিগুলোর মতো তাদের দেশের
মুমিন সমাজকে দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এ জন্য অতীতে তাদের মতো
যেসব জাতি একই কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল তাদেরকে যে ধরনের হুমকি দেয় হয়েছিল
তাদেরকেও সেই একই হুমকি দেয়া হয়। অতীতের কাফের জাতিসমূহকে হুমকি দেয়া হয়েছিল, لَنُهْلِكَنَّ
الظَّالِمِينَ (আমি জালেমদেরকে ধবংশ করে ছাড়বো)। অন্যদিকে
মুমিনদেরকে তাদের পূর্ববর্তীদের মতো একই সান্ত্বনা দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়ঃ وَلَنُسْكِنَنَّكُمُ الْأَرْضَ مِن بَعْدِهِمْ অর্থাৎ এ জালেমদেরকে খতম করার পর আমি এ ভূখন্ডে
তোমাদের বসতি স্থাপন করাবো।
এভাবে শেষ রুকূ’র আলোচ্য বিষয় থেকেও অনুমান করা যায় যে, এ
সূরাটি মক্কার শেষ যুগের সাথে সম্পর্ক রাখে।
কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ
যারা নবী সা. এর রিসালাত মেনে নিতে অস্বীকার করছিল এবং তাঁর দাওয়াতকে ব্যর্থ
করে দেবার জন্য সব রকমের নিকৃষ্টতম প্রতারণা ও চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের
প্রতি উপদেশ ও সতর্কবাণী এ সূরার কেন্দ্রীয় বক্তব্য। কিন্তু উপদেশের তুলনায় এ
সূরায় সতর্কীকরণ, তিরষ্কার হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের ভাবধারাই
বেশী উচ্চকিত। এর কারণ, এর আগের সূরাগুলোতে বুঝাবার কাজটা পুরোপুরি
এবং সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। এরপরও কুরাইশ কাফেরদের হঠকারিতা, হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টি, অনিষ্টকর ক্রিয়াকর্ম ও জুলুম-নির্যাতন দিনের পর
দিন বেড়ে যাচ্ছিল ।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿الر ۚ
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ﴾
১। আলিফ-লাম-রা। হে
মুহাম্মদ। এটি একটি কিতাব, তোমার প্রতি এটি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে অন্ধকার
থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো তাদের রবের প্রদত্ত সুযোগ ও সামর্থের ভিত্তিতে, এমন এক আল্লাহর পথে১ যিনি প্রবল প্রতাপান্বিত ও
আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত২
১. অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে আনার মানে হচ্ছে, শয়তানের
পথ থেকে সরিয়ে আল্লাহর পথে নিয়ে আসা। অন্য কথায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নেই সে আসলে অজ্ঞতা ও
মূর্খতার অন্ধকারে বিভ্রান্তের মতো পথ হাতড়ে মরেছে। সে নিজেকে যতই উন্নত চিন্তার অধিকারী এবং জ্ঞানের আলোকে
যতই উদ্ভাসিত মনে করুক না কেন তাতে আসল অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না পক্ষান্তরে যে
ব্যক্তি আল্লাহর পথের সন্ধান পেয়েছে,
গ্রামীণ
এলাকার একজন অশিক্ষিত লোক হলেও সে আসলে জ্ঞানের আলোর রাজ্যে পৌঁছে গেছে।
তারপর এই যে, বলা হয়েছে যাতে তুমি এদেরকে রবের প্রদত্ত
সুযোগ ও সামর্থের ভিত্তিতে আল্লাহর পথে নিয়ে এসো এ উক্তির মধ্যে আসলে এদিকে
ইংগিত করা হয়েছে যে, কোন প্রচারক, তিনি
নবী হলেও, সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া ছাড়া তিনি পুরোপুরি
আল্লাহর দেয়া সুযোগ ও সামর্থের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহর কাউকে সুযোগ দিলে সে হেদায়াত লাভ করতে পারে। নয়তো নবীর মতো সফল ও পূর্ণ শক্তিধর প্রচারকও
নিজের সকল শক্তি নিয়োগ করেও তাকে হেদায়াত দান করতে পারেন না। আর আল্লাহর সুযোগ দান সম্পর্কে বলা যায়, এর
একটি স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, আল্লাহর
পক্ষ থেকে হেদায়াত লাভের সুযোগ একমাত্র সেই ব্যক্তি পায় যে নিজেই হেদায়াতের
প্রত্যাশী হয়, জিদ,
হঠকারিতা
ও হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত থাকে, নিজের প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনার দাস হয় না, পরিষ্কার
খোলা চোখে দেখে সজাগ ও সতর্ক কানে শোনে,
মুক্ত
সুস্থ ও পরিষ্কার মস্তিষ্কে চিন্তা করে এবং যুক্তিসংগত কথাকে কোন প্রকার
পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় না নিয়ে মেনে নেয়।
২. মূল আয়াতে বলা হয়েছে 'হামীদ'। হামীদ শব্দটি 'মাহমুদ' (প্রশংসিত)-এর
সমার্থক হলেও উভয় শব্দের মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে। কাউকে মাহমুদ তখনই বলা হবে যখন তার প্রশংসা করা হয়েছে বা
হয়। কিন্তু "হামীদ"
বললে বুঝা যাবে কেউ তার প্রশংসা করুক বা না করুক সে নিজেই প্রশংসার অধিকারী ও
যোগ্য। এখানে প্রশংসিত, প্রশংসার
যোগ্য ও প্রশংসা লাভের হকদার ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে এ শব্দটির পূর্ণ অর্থ প্রকাশ
হয় না। তাই আমি এর অনুবাদ করেছি
আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত শব্দাবলীর মাধ্যমে।
﴿اللَّهِ
الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَوَيْلٌ لِّلْكَافِرِينَ
مِنْ عَذَابٍ شَدِيدٍ﴾
২। এবং
পৃথিবী ও আকাশের যাবতীয় বস্তুর মালিক। আর কঠিন
ধ্বংসকর শাস্তি রয়েছে তাদের জন্য যারা সত্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করে
﴿الَّذِينَ يَسْتَحِبُّونَ
الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا
عِوَجًا ۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ﴾
৩। যারা
দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের ওপর প্রাধান্য দেয়৩ যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ
থেকে রুখে দিচ্ছে এবং চাচ্ছে এ পথটি (তাদের আকাংখা অনুযায়ী) বাঁকা হয়ে যাক।৪ ভ্রষ্টতায় এরা অনেক দূর এগিয়ে
গেছে।
৩. অথবা অন্য কথায় যারা শুধুমাত্র দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের
কথাই চিন্তা করে, আখেরাতের কোন পরোয়া করে না। যারা বৈষয়িক লাভ, স্বাদ
ও আরাম-আয়েশের বিনিময়ে আখেরাতের ক্ষতি কিনে নিতে পারে কিন্তু আখেরাতের সাফল্য ও
সমৃদ্ধির বিনিময়ে দুনিয়ার কোন ক্ষতি,
কষ্ট
ও বিপদ এমনকি কোন স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়াও বরদাশত করতে পারে না। যারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের পর্যালোচনা করে
ধীরে ও সুস্থ মস্তিষ্কে দুনিয়াকে বেছে নিয়েছে এবং আখেরাতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
নিয়েছে যে, তার স্বার্থ যেসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বার্থের
সাথে সংঘর্ষশীল হবে সেসব ক্ষেত্রে তাকে ত্যাগ করে যেতে থাকবে।
৪. অর্থাৎ তারা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে থাকতে চায় না। বরং আল্লাহর দীনকে নিজেদের ইচ্ছার অনুগত করে
রাখতে চায়। নিজেদের প্রত্যেকটি
ভাবনা-চিন্তা, মতবাদ ও ধারণা-অনুমানকে তারা নিজেদের
চিন্তারাজ্যে অবস্থান করতে দেয় না যা তাদের ভাবনার সাথে খাপ খায় না। তারা চায় আল্লাহর দীন তাদের অনুসৃত প্রত্যেকটি
রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও অভ্যাসকে বৈধতার ছাড়পত্র দিক এবং
তাদের কাছে এমন কোন পদ্ধতির অনুসরণের দাবী না জানাক যা তারা পছন্দ করে না। এরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও শয়তানের অনুসরণে
যেদিকে মুখ ফিরায়, আল্লাহর দীনও যেন এদের গোলাম হয়ে ঠিক সেদিকেই
মুখ ফিরায়। সে যেন কোথাও এদেরকে বাধা
না দেয় বা সমালোচনা না করে এবং কোথাও এদেরকে নিজের পথের দিকে ফিরিয়ে নেবার
চেষ্টা না করে। আল্লাহ তাদের কাছে এ ধরনের
দীন পাঠালেই তারা তা মানতে প্রস্তুত।
﴿وَمَا
أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ۖ فَيُضِلُّ
اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
৪। আমি নিজের
বাণী পৌছাবার জন্য যখনই কোন রাসূল পাঠিয়েছি, সে তার নিজের সম্প্রদায়েরই
ভাষায় বাণী পৌছিয়েছে, যাতে সে তাদেরকে খুব ভালো করে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে।৫ তারপর আল্লাহ যাকে চান তাকে পথভ্রষ্ট
করেন এবং যাকে চান হেদায়াত দান করেন।৬ তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও
জ্ঞানী।৭
৫. এর দু'টি অর্থ হয়ঃ এক, আল্লাহ
যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নবী পাঠিয়েছেন তার ওপর তার ভাষায়ই নিজের বাণী অবতীর্ণ
করেছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, সংশ্লিষ্ট
সম্প্রদায় যেন তা ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারা এ ধরনের কোন ওজর
পেশ করতে না পারে যে, আপনার পাঠানো শিক্ষা তো আমরা বুঝতে পারিনি
কাজেই কেমন করে তার প্রতি ঈমান আনতে পারতাম। দুই, আল্লাহ কখনো নিছক অলৌকিক
ক্ষমতা দেখাবার জন্য আরব দেশে নবী পাঠিয়ে তাদের মুখ দিয়ে জাপানী বা চৈনিক ভায়ায়
নিজের কালাম শুনাননি। এ
ধরনের তেলেসমাতি দেখিয়ে লোকদের অভিনবত্ব প্রিয়তাকে পরিতৃপ্ত করার তুলনায় আল্লাহর
দৃষ্টিতে শিক্ষা ও উপদেশ দান এবং বুঝিয়ে বলা ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করাই বেশী
গুরুত্বের অধিকারী। এ উদ্দেশ্যে কোন জাতিকে
তার নিজের ভাষায়, যে ভাষা সে বোঝে, পয়গাম
পৌঁছানো প্রয়োজন।
৬. অর্থাৎ সমগ্র জাতি যে ভাষা বোঝে নবী সে ভাষায় তার সমগ্র
প্রচার কার্য পরিচালনা ও উপদেশ দান করা সত্ত্বেও সবাই হেদায়াত লাভ করে না। কারণ কোন বাণী কেবলমাত্র সহজবোধ্য হলেই যে, সকল
শ্রোতা তা মেনে নেবে এমন কোন কথা নেই। সঠিক পথের সন্ধান লাভ ও পথভ্রষ্ট হওয়ার মূল সূত্র রয়েছে
আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে চান নিজের বাণীর
সাহায্যে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং যার জন্য চান এ একই বাণীকে তার জন্য
পথভ্রষ্টাতার উপকরণে পরিণত করেন।
৭. অর্থাৎ লোকেরা নিজে নিজেই সৎপথ লাভ করবে বা পথভ্রষ্ট হয়ে
যাবে, এটা সম্ভব নয়। কারণ তারা পুরোপুরি স্বাধীন নয়। বরং আল্লাহর কর্তৃত্বের অধীন। কিন্তু আল্লাহ নিজের এ কর্তৃত্বের অধীন। কিন্তু আল্লাহ নিজের এ কর্তৃত্বের অন্ধের মতো প্রয়োগ
করেন না। কোন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই
তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করবেন এবং যাকে ইচ্ছা প্রথভ্রষ্ট করবেন এটা তাঁর রীতি
নয় কর্তৃত্বশীল ও বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে তিনি জ্ঞানী এবং প্রাজ্ঞাও। তাঁর কাছ থেকে কোন বঞ্চিত করে ভ্রষ্টতার
মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয় সে নিজেই নিজের ভ্রষ্টতাপ্রীতির কারণে এহেন আচরণ লাভের অধিকারী
হয়।
﴿وَلَقَدْ
أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
وَذَكِّرْهُم بِأَيَّامِ اللَّهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ﴾
৫। আমি এর
আগে মূসাকেও নিজের নিদর্শনাবলী সহকারে পাঠিয়েছিলাম। তাকেও আমি
হুকুম দিয়েছিলাম, নিজের
সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে এসো এবং তাদেরকে ইতিহাসের৮ শিক্ষণীয় ঘটনাবলী শুনিয়ে
উপদেশ দাও। এ ঘটনাবলীর মধ্যে বিরাট নির্দশণ৯ রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির
জন্য যে সবর করে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।১০
৮. আরবী ভাষায় পারিভাষিক অর্থে ঐতিহাসিক ঘচনাবলীর স্মারককে
"আইয়াম" বলা হয়। "আইয়ামূল্লাহ" বলতে মানুষের ইতিহাসের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
বুঝায় যেখানে আল্লাহ অতীতের জাতসিমূহ ও বড় বড় ব্যক্তিত্বকে তাদের কর্মকান্ড
অনুযায়ী শাস্তি বা পুরষ্কার দিয়েছেন।
৯. অর্থাৎ এসব ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে এমন সব নিদর্শন রয়েছে যার
মাধ্যমে এক ব্যক্তি আল্লাহর একত্বের সত্যতা ও নির্ভূলতার প্রমাণ পেতে পারে। এ সংগে এ সত্যের পক্ষেও অসংখ্য সাক্ষ-প্রমাণ
সংগ্রহ করতে পারে যে, প্রতিদানের বিধান একটি বিশ্বজনীন আইন, তা
পুরোপুরি হক ও বাতিলের তাত্ত্বিক ও নৈতিক পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং তার
দাবী পূরণ করার জন্য অন্য একটি জগত অর্থাৎ পরকালীন জগত অপরিহার্য। তাছাড়া এ ঘটনাবলীর মধ্যে এমনসব নিদর্শনও রয়েছে
যার সাহায্যে কোন ব্যক্তি বাতিল বিশ্বাস ও মতবাদের ভিত্তিতে জীবনের ইমারত তৈরী
করার অশুভ পরিণামের সন্ধান লাভ করতে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
১০. অর্থাৎ এ নিদর্শনসমূহ তো যথাস্থানে আছে। কিন্তু একমাত্র তারাই এ থেকে শাভবান হতে পারে
যারা আল্লাহর পরীক্ষায় ধৈর্য ও অবিচলতার সাথে এগিয়ে চলে এবং আল্লাহর নিয়ামতসমূহকে
যথাযথভাবে অনুভব করে তাদের জন্য যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। নীচমনা, সংকীর্ণচেতা ও কৃতঘ্ন
স্বভাবের লোকেরা যদি এ নিদর্শনগুলো উপলদ্ধি করেও তাহলে তাদের এ নৈতিক দুর্বলতা
তাদেরকে সেই উপলব্ধি দ্বারা লাভবান হতে দেয় না।
﴿وَإِذْ
قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ أَنجَاكُم مِّنْ
آلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ وَيُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ
نِسَاءَكُمْ ۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَاءٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَظِيمٌ﴾
৬। স্মরণ করো
যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বললো, “আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো যা
তিনি তোমাদের প্রতি করেছেন। তিনি তোমাদের ফিরাউনী
সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্ত করেছেন, যারা তোমাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাতো, তোমাদের ছেলেদের হত্যা করতো
এবং তোমাদের মেয়েদের জীবিত রাখতো। এর মধ্যে
তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মহা পরীক্ষা ছিল।
﴿وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ
لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ﴾
৭। আর স্মরণ
করো তোমাদের রব এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যদি কৃতজ্ঞ থাকো১১ তাহলে আমি তোমাদের আরো বেশী
দেবো আর যদি নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি বড়ই কঠিন।১২
১১. অর্থাৎ যদি আমার নিয়ামতসমূহের অধিকার ও মর্যাদা চিহ্নিত
করে সেগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করো,
আমার
বিধানের মোকাবিলার অহংকারে মত্ত হতে ও বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ না হও এবং আমার
অনুগ্রহের অবদান স্বীকার করে নিয়ে আমার বিধানের অনুগত থাকো।
১২. এ বিষয়বস্তু সম্বলিত ভাষণ বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকে
বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। এ ভাষণে হযরত মূসা আ. তার ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে বনী ইসলরাঈলকে তাদের
ইতিহাসের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারপর মহান আল্লাহ তার মাধ্যমে বনী ইসরাঈলের নিকট তাওরাতের
যেসব বিধান পাঠিয়েছিলেন তিনি সেগুলোরও পুনরাবৃত্তি করেছেন। এর পর একটি সুদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন। এ ভাষণে তিনি বলেছেন,
যদি
তারা তাদের রবের হুকুম মেনে চলে তাহলে তাদেরকে কিভাবে পুরস্কৃত করা হবে আর যদি নাফরমানির
পথ অবলম্বন করে তাহলে কেমন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। এ ভাষণটি দ্বিতীয় বিবরণের ৪,৬,১০,১১, ও
২৮ থেকে ৩০ অধ্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এর কোন কোন স্থানে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষণীয়। উদাহরণ স্বরূপ এর কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। এ থেকে সমগ্র ভাষণটির ব্যাপারে একটা ধারণা করা
যাবে।
"হে ইসরায়েল শুন; আমাদের
সদাপ্রভু একই সাদপ্রভূঃ আর তুমি তোমার সমস্ত হৃদয়, তোমার
সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া আপন সদাপ্রভুকে প্রেম করিবে। আর এই যে সকল কথা আমি, তেমাকে
আজ্ঞা করি, তাহা তোমার হৃদয়ে থাকুক। আর তোমরা প্রত্যেকে আপন আপন সন্তানগণকে এ সকল যত্নপূর্বক
শিক্ষা দিবে এবং গৃহে বসিবার কিংবা পথে চলিবার সময়ে এবং শয়ন কিংবা
গাত্রোত্থানকালে ঐ সমস্তের বিষয়ে কথোপকথন করিবে।" (২:৪-৭)
"এখন হে ঈসরায়েল, তোমার
সদাপ্রভু তোমার কাছে কি চাহেন? কেবল এই, যেন
তুমি আপন সদাপ্রভুকে ভয় করো, তাঁহার সকল পথে চল ও তাঁহাকে
প্রেম কর এবং তোমার সমস্ত হৃদয় ও তোমার সমস্ত প্রাণের সহিত তোমার সদাপ্রভুর
সেবা কর, অদ্য আমি তোমার মংগলার্থে সদাপ্রভুর যে যে
আজ্ঞা ও বিধি তোমাকে দিতেছি, সেই সকল যেন পালন কর। দেখ স্বর্গ এবং পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয়
বস্তু তোমার সদাপ্রভুর।
(১০:১২-১৪)
"আমি তোমাকে অদ্র যে সকল
আজ্ঞা আদেশ করিতেছি, যত্নপূর্বক সেই সকল পালন করিবার জন্য যদি তুমি
আপন সদাপ্রভুর রবে মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত কর,
তবে
তোমার সদাপ্রভু পৃথিবীস্থ সমস্থ জাতির উপরে তোমাকে উন্নত করিবেন; আর
তোমার সদাপ্রভুর রবে কর্ণপাত করিলে এ সকল আশীর্বাদ তোমার উপর বর্তিবে ও তোমাকে
আশ্রয় করিবে। তুমি নগরে আশীর্বাদযুক্ত
হইবে ও ক্ষেত্রে আশীবার্দযুক্ত হইবে।............ তোমার যে শত্রুগণ তোমার ওপর আক্রমণ চালায় তাহাদিগকে সদাপ্রভু তোমার
সম্মুখে আঘাত করাইবেন....... সদাপ্রভু আজ্ঞা করিয়া তোমার গোলাঘর সম্বন্ধে ও তুমি
যে কোন কার্যে হস্তক্ষেপ কর তৎসম্বন্ধে আশীর্বাদকে তোমার সহচর করিবেন;........ সদাপ্রভু আপন দিব্যানুসারে তোমাকে আপন পবিত্র প্রজা বলিয়া স্থাপন করিবেন; কেবল
তোমার সদাপ্রভুর আজ্ঞা পালন ও তাহার পথে গমন করিতে হইবে। আর পৃথিবীর সমস্ত জাতি দেখিতে পাইবে যে, তোমার
উপরে সদা প্রভুর নাম কীর্তিত হইয়াছে এবং তাহারা তোমা হইতে ভীত হইবে।......... এবং তুমি অনেক জাতিকে ঋণ দিবে, কিন্তু
আপনি ঋণ লইবে না। আর সদাপ্রভু তোমাকে মস্তক
স্বরূপ করিবেন, পুচ্ছ স্বরূপ করিবেন না। তুমি অবনত না হইয়া কেবল উন্নত হইবে।"(২৮:১-১৩)
"কিন্তু যদি তুমি আপন ঈশ্বর
সদাপ্রভুর রবে কর্ণপাত না কর, আমি অদ্য তোমাকে যে সকল
আজ্ঞা ও বিধি আদেশ করিতেছি, যত্নপূর্বক সেই সকল পালন না কর, তবে
এ সমস্ত অভিশাপ তোমার প্রতি বর্তিবে ও তোমাকে আশ্রয় করিবে। তুমি নগরে শাপগ্রস্ত হইবে ও ক্ষেত্রে শাপগ্রস্ত হইবে। ............. যে কোন কার্যে তুমি হস্তক্ষেপ
কর, সেই কার্যে সদাপ্রভু তোমার উপর অভিশাপ, উদ্বেগ
ও র্ভৎসনা প্রেরণ করিবেন।
......... তুমি যে দেশ অধিকার করিতে যাইতেছ,
সেই
দেশ হইতে যাবৎ উচ্ছিন্ন না হও, তাবৎ সদাপ্রভু তোমাকে
মহামারীর আশ্রয় করিবেন।
............ তোমার মস্তকের উপরিস্থিত আকাশ পিত্তল ও নিম্নস্থিত ভূমি লৌহস্বরূপ
হইবে। ............সদাপ্রভু
তোমার শত্রুদের সম্মুখে তোমাকে পরাজিত করাইবেন; তুমি
একপথ দিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে যাইবে,
কিন্তু
সাত পথ দিয়া তাহাদের সম্মুখে হইতে পলায়ন করিবে।......... তোমার সাথে কন্যার বিবাহ হইবে, কিন্তু
অন্য পুরুষ তাহার সহিত সংগম করিবে। তুমি গৃহ নির্মাণ করিবে, কিন্তু তাহাতে বাস করিতে
পারিবে না। দ্রাক্ষাক্ষেত্র প্রস্তুত
করিবে, কিন্তু তাহার ফল ভোগ করিবে না। তোমার গরু তোমার সম্মুখে জবাই হইবে, .......সদাপ্রভু তোমার বিরুদ্ধে যে শত্রুগণকে পাঠাইবেন, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, উলংগতায়
ও সকল বিষয়ের অভাব ভোগ করিতে করিতে তাহাদের দাসত্ব করিবে; এবং
যে পর্যন্ত তিনি তোমার বিনাশ না করেন,
সে
পর্যন্ত শত্রুরা তোমার গ্রীবাতে লৌহের জোয়াল দিয়া রাখিবে। ............আর সদাপ্রভু তোমাকে পৃথীবীর এক প্রান্ত হইতে
অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র জাতির মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন করিবেন।"(২৮:১৫-১৬)
﴿وَقَالَ
مُوسَىٰ إِن تَكْفُرُوا أَنتُمْ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ
حَمِيدٌ﴾
৮। আর মূসা
বললো, “যদি তোমরা
কুফরী করো এবং পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীও কাফের হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কিছুই আসে যায়
না এবং তিনি আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত।”১৩
১৩. এখানে হযরত মূসা আ. ও
তাঁর জাতির ইতিহাসের প্রতি এ সংক্ষিপ্ত ইংগিত করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হচ্ছে,
মক্কাবাসীদেরকে
একথা জানানো যে, আল্লাহ যখন কোন জাতির প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং
এর জবাবে সংশ্লিষ্ট জাতি বিশ্বাসাঘাতকতা ও বিদ্রোহ করে তখন এ ধরনের জাতির এমন
মারাত্মক ও ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হতে হয় যার সম্মুখীন আজ তোমাদের চোখের সামনে
বনী ইসলাঈলরা হচ্ছে।
কাজেই তোমরাও কি আল্লাহর নিয়ামত ও তার অনুগ্রহের পাওয়া যে অকৃতজ্ঞ মনোভাব
প্রদর্শন করে নিজেদের এ একই পরিণাম দেখতে চাও?
এ প্রসংগে একথাও মনে রাখতে হবে যে,
আল্লাহ
একথাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তার যে নিয়ামতের কদর করার জন্য এখানে
কুরাইশদের কাছে দাবী জানাচ্ছে তা বিশেষভাবে তার এ নিয়ামতটি যে, তিনি
মুহাম্মাদ (সা) কে তাদের মধ্যে পয়দা করেছেন এবং তার মাধ্যমেই তাদের কাছে এমন
মহিমান্বিত শিক্ষা পাঠিয়েছেন যে সম্পর্কে নবী (সা) বারবার কুরাইশদেরকে বলতেনঃ
كَلِمَةٍ وَاحِدَةٍ تعطونيها تملكون بِهَا
الْعَرَبُ وَ تدين لكم الْعَجَمُ
"আমার একটি মাত্র কথা মেনে
নাও। আরব ও আজম সব তোমাদের
করতলগত হয়ে যাবে।"
﴿أَلَمْ
يَأْتِكُمْ نَبَأُ الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ ۛ وَالَّذِينَ
مِن بَعْدِهِمْ ۛ لَا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا اللَّهُ ۚ جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ
فَرَدُّوا أَيْدِيَهُمْ فِي أَفْوَاهِهِمْ وَقَالُوا إِنَّا كَفَرْنَا بِمَا أُرْسِلْتُم
بِهِ وَإِنَّا لَفِي شَكٍّ مِّمَّا تَدْعُونَنَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ﴾
৯। তোমাদের
কাছে কি১৪ তোমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত
জাতিগুলোর বৃত্তান্ত পৌঁছেনি? নূহের জাতি, আদ, সামূদ এবং তাদের পরে আগমনকারী
বহু জাতি, যাদের
সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ জানেন? তাদের রাসূলরা যখন তাদের কাছে
দ্ব্যর্থহীন কথা ও সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আসেন তখন তারা নিজেদের মুখে হাত চাপা
দেয়১৫ এবং বলে, “যে বার্তা সহকারে তোমাদের
তোমাদের পাঠানো হয়েছে আমরা তা মানি না এবং তোমরা আমাদের যে জিনিসের দাওয়াত দিচ্ছে
তার ব্যাপারে আমরা যুগপৎ উদ্বেগ ও সংশয়ের মধ্যে আছি।”১৬
১৪. হযরত মুসার আ. ভাষণ ওপরে শেষ হয়ে গেছে। এখন সরাসরি মক্কার কাফেরদেরকে সম্বোধন করা
হচ্ছে।
১৫. এ শব্দগুলোর ব্যাখ্যার তাফসীরকারদের মধ্যে বেশ কিছু
মতবিরোধ দেখা গেছে।
বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন। আমাদরে মতে এর সবচেয়ে নিকবর্তী অর্থ তাই হতে পারে যা প্রকাশ করার জন্য আমরা
বলে থাকি, কানে হাত চাপা দিয়েছে, বা
মুখে হাত চাপা দিয়েছে।
কারণ পরবর্তী বাক্যের বক্তব্যের মধ্যে পরিষ্কার অস্বীকৃতি ও এ সাথে হতবাক হয়ে
যাওয়ার ভাব প্রকাশ পেয়েছে এবং এর মধ্যে কিছু ক্রোধের ভাবধারাও মিশে আছে।
১৬. অর্থাৎ এমন সংশয় যার ফলে প্রশান্তি বিদায় নিয়েছে। সত্যের দাওয়াতের বৈশিষ্ট হচ্ছে এই যে, এ
দাওয়াত যখন শুরু হয় তখন তার কারণে চতুরদিকে অবশ্যি একটা ব্যাকুলতা, হৈ
চৈ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায় ঠিকই এবং অস্বীকার ও বিরোধিতাকারীরাও ঠাণ্ডা মাথায়
চিন্তা-ভাবনা করে পূর্ণ প্রশান্তির সাথে তা অস্বীকার বা তার বিরোধিতা করতে পারে
না। তারা যত প্রবলভাবেই তাকে
প্রত্যাখ্যান করুক এবং যতই শক্তি প্রয়াগ করে তার বিরোধিতা করুক না কেন দাওয়াতের
সত্যতা, তার ন্যায় সংগত যুক্তি সমূহ, তার
সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্তহীন কথা, তাহার মনোমুগ্ধ কর ভাষা, তার
আহবায়কের নিখুঁত চরিত্র, তার প্রতি বিশ্বাসীদের জীবনধারায় সূচীত
সুস্পষ্ট বিপ্লব এবং তাদের নিজেদের সত্য কথা অনুযায়ী পরিচ্ছন্ন কার্যাবলী -এসব
জিনিস মিলেমিশে অতীব কট্টর বিরোধীর মনেও একস্থিরতার তরংগ সৃষ্টি করে দেয়। সত্যের আহবায়কদেরকে যারা অস্থির ও ব্যাকুল করে
দেয় তারা নিজেরাও স্থিরতা ও মানসিক প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
﴿قَالَتْ
رُسُلُهُمْ أَفِي اللَّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ
لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۚ قَالُوا إِنْ أَنتُمْ
إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا تُرِيدُونَ أَن تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا
فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُّبِينٍ﴾
১০। তাদের রাসূলরা
বলে, আল্লাহর
ব্যাপারে কি সন্দেহ আছে, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা?১৭ তিনি তোমাদের ডাকছেন তোমাদের
গুনাহ মাফ করার এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেয়ার জন্য।”১৮ তারা জবাব দেয়, “তোমরা আমাদের মতো মানুষ ছাড়া
আর কিছুই নও।১৯ বাপ-দাদাদের থেকে যাদের ইবাদাত চলে আসছে
তোমরা তাদের ইবাদাত থেকে আমাদের ফেরাতে চাও। ঠিক আছে
তাহলে আনো কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ।”২০
১৭. রাসূলদের একথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক
যুগের মুশরিকরা আল্লাহর অস্তিত্ব মানতো এবং আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা একথাও
স্বীকার করতো। এরি ভিত্তিতে রাসূলগণ
বলেছেন, এরপর তোমাদের সন্দেহ থাকে কিসে? আমরা
যে জিনিসের দিকে তোমাদের দাওয়াত দিচ্ছি তা এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, পৃথিবী
ও আকাশের স্রষ্টা আল্লাহ তোমাদের বন্দেগী লাভের যথার্থ হকদার। এরপরও কি আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদের সন্দেহ
আছে?
১৮. নির্দিষ্ট সময় মানে ব্যক্তির মৃত্যুকালও হতে পারে আবার
কিয়ামতেও হতে পারে। জাতিসমূহের উত্থান ও পতনের
ব্যাপারে বলা যেতে পারে, আল্লাহর কাছে তাদের উত্থান-পতনের সময় কাল নির্দিষ্ট
হওয়ার বিষয়টি তাদের গুণগত অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একটি ভালো জাতি যদি তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিকৃতির
সৃষ্টি করে তাহলে তার কর্মের অবকাশ কমিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। আর একটি ভ্রষ্ট জাতি যদি নিজেদের অসৎগুণাবলীকে
শুধরে নিয়ে সৎগুণাবলীতে পরিবর্তিত করে তাহলে তার কর্মের অবকাশ বাড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি তা কিয়ামত পর্যন্তও দীর্ঘায়িত হতে পারে। এ বিষয়বস্তুর দিকেই সূরা রা'আদের
১১ আয়াতে ইংগিত করে।
আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার ততক্ষন পরিবর্তন
ঘটান না যতক্ষণ না সে নিজের গুণাবলীর পরিবর্তন করে।
১৯. তাদের কথার অর্থ ছিল এই যে, তোমাকে
আমরা সব দিক দিয়ে আমাদের মত একজন মানুষই দেখছি। তুমি পানাহার করো,
নিদ্রা
যাও, তোমার স্ত্রী ও সন্তানাদি আছে তোমার মধ্যে ক্ষুধা, পিপাসা, রোগ, শোক, ঠান্ডা
ও গরমের তথা সব জিনিসের অনুভূতি আছে। এসব ব্যাপারে এবং সব ধরনের মানবিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে আমাদের সাথে তোমার
সাদৃশ্য রয়েছে। তোমার মধ্যে এমন কোন
অসাধারণত্ব দেখছি না যার ভিত্তিতে আমরা এ কথা মেনে নিতে পারি যে, তুমি
আল্লাহর কাছে পৌঁছে গিয়েছো, আল্লাহ তোমার সাথে কথা বলনে
এবং ফেরেশতারা তোমার কাছে আসে।
২০. অর্থাৎ এমন কোন প্রমাণ যা আমরা চোখে দেখি এবং হাত দিয়ে
স্পর্শ করি। যে প্রমাণ দেখে আমরা
বিশ্বাস করতে পারি যে, যথার্থই আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন এবং তুমি এই
যে বাণী এনেছো তা আল্লাহর বাণী।
﴿قَالَتْ
لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِن نَّحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ
عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ۖ وَمَا كَانَ لَنَا أَن نَّأْتِيَكُم بِسُلْطَانٍ
إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾
১১। তাদের
রসূলুরা তাদেরকে বলে, “যথার্থই আমরা তোমাদের মতো মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। কিন্তু
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন।২১ আর তোমাদের কোন প্রমাণ এনে
দেবো, এ ক্ষমতা
আমাদের নেই। প্রমাণ তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে আসতে
পারে এবং ঈমানদারদের আল্লাহরই ওপর ভরসা রাখা উচিত।
২১. অর্থাৎ নিসন্দেহে আমি তো মানুষই। তবে আল্লাহ সত্যের তত্বজ্ঞান ও পূর্ণ অন্তরদৃষ্টি দান করে
তোমাদের মধ্য থেকে আমাকে বাছাই করে নিয়েছেন। এখানে আমার সামর্থর কোন ব্যাপার নেই। এ তো আল্লাহর পূর্ণ ইখতিয়ারের ব্যাপার। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে যা ইচ্ছা
দেন। আমার কাছে যা কিছু এসেছে তা
আমি তোমাদের কাছে পাঠাতে বলতে পারি না এবং আমার কাছে যে সত্যের দ্বার উন্মুক্ত
হয়ে গেছে তা থেকে আমি নিজের চোখ বন্ধ করে নিতেও পারি না।
﴿وَمَا
لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا ۚ وَلَنَصْبِرَنَّ
عَلَىٰ مَا آذَيْتُمُونَا ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ﴾
১২। আর আমরা
আল্লাহরই ওপর ভরসা করবো না কেন, যখন আমাদের জীবনের পথে তিনি আমাদের পথ
দেখিয়েছেন? তোমরা আমাদের যে যন্ত্রণা দিচ্ছো তার ওপর আমরা সবর করবো এবং
ভরসাকারীদের ভরসা আল্লাহরই ওপর হওয়া উচিত।”
﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا
لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُم مِّنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا ۖ
فَأَوْحَىٰ إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِينَ﴾
১৩। শেষ
পর্যন্ত অস্বীকারকারীরা তাদের রাসূলদের বলে দিল, “হয় তোমাদের ফিরে আসতে হবে
আমাদের মিল্লাতে২২ আর নয়তো আমরা তোমাদের বের করে দেবো আমাদের
দেশ থেকে।” তখন তাদের রব তাদের কাছে অহী পাঠালেন, “আমি এ জালেমদের ধ্বংস করে দেবো।
২২. এর মানে এ নয় যে,
নবুওয়াতের
মর্যাদায় সামসীন হবার আগে নবী গণ নিজেদের পথভ্রষ্ট সম্প্রদয়ের মিল্লাত বা ধর্মের
অন্তরভুক্ত হতেন। বরং এর মানে হচ্ছে, নবুওয়াত
লাভের পূর্বে যেহেতু তারা এক ধরনের নীরব জীবন যাপন করতেন, কোন
ধর্ম প্রচার করতেন না এবং প্রচলিত কোন ধর্মের প্রতিবাদও করতেন না তাই তাঁদের
সম্প্রদায় মনে করতো তাঁরা তাদেরই ধর্মের অন্তরভুক্ত রয়েছেন। তারপর নবুওয়াতের কাজ শুরু করে দেয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে
দোষারোপ করা হতো যে, তাঁর বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করেছেন। অথচ নবুওয়াত লাভের আগেও তাঁরা কখনো মুশরিকদের
ধর্মের অন্তরভুক্ত ছিলেন না। যার ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্মচ্যুতির অভিযোগ করা যেতে পারে।
﴿وَلَنُسْكِنَنَّكُمُ
الْأَرْضَ مِن بَعْدِهِمْ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِي وَخَافَ وَعِيدِ﴾
১৪। এবং এদের
পর পৃথিবীতে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করবো।২৩ এটা হচ্ছে তার পুরস্কার, যে আমার সামনে জবাবদিহি করার
ভয় করে এবং আমার শাস্তির ভয়ে ভীত।”
২৩. অর্থাৎ ভীত হয়ো না,
এরা
বলছে, তোমরা এ দেশে থাকতে পারবে না কিন্তু আমি বলছি এখন আর এরা এ
দেশে থাকতে পারবে না।
এখন যারা তোমাকে মানবে তারাই এখানে থাকবে।
﴿وَاسْتَفْتَحُوا
وَخَابَ كُلُّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ﴾
১৫। তারা
ফায়সালা চেয়েছিল (ফলে এভাবে তাদের ফায়সালা হলো) এবং প্রত্যেক উদ্ধত সত্যের দুশমন
ব্যর্থ মনোরথ হলো।২৪
২৪. মনে রাখা দরকার,
এখানে
এ ঐতিহাসিক ধারা বিবরণীর আকারে আসলে মক্কার কাফেরদের কথার জবাব দেয়া হচ্ছে, যা
তারা নবী (সা) কে বলতো।
আপাতদৃষ্টিতে অতীতের নবীগণ এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের ঘটনাবলী উল্লেখ করা হচ্ছে, কিন্তু
তা প্রযুক্ত হচ্ছে এ সূরা নাযিলের সময় যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল তার ওপর। এ স্থানে মক্কার কাফেরদেরকে বরং আরবের
মুশরিকদেরকে যেন পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের
ভবিষ্যত এখন নির্ভর করবে তোমরা মুহাম্মাদী দাওয়াত গ্রহণ করো তাহলে আরব ভূখন্ডে
থাকতে পারবে আর যদি তা প্রত্যাখ্যান করো তাহলে এখান থেকে তোমাদের নাম-নিশানা
মুছে যাবে। কার্যত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
একথাটিকে একটি প্রমাণিত সত্যে পরিণত করে দিয়েছে। এ ভবিষ্যত বাণীর পর পুরো পনের বছর পার হতে না হতেই দেখা
গেলো সমগ্র আরব ভূখন্ডে একজন মুশরিকেরও অস্তিত্ব নেই।
﴿مِّن وَرَائِهِ
جَهَنَّمُ وَيُسْقَىٰ مِن مَّاءٍ صَدِيدٍ﴾
১৬। এরপর
সামনে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। সেখানে
তাকে পান করতে দেয়া হবে গলিত পুঁজের মতো পানি
﴿يَتَجَرَّعُهُ وَلَا يَكَادُ
يُسِيغُهُ وَيَأْتِيهِ الْمَوْتُ مِن كُلِّ مَكَانٍ وَمَا هُوَ بِمَيِّتٍ ۖ وَمِن وَرَائِهِ
عَذَابٌ غَلِيظٌ﴾
১৭। যা সে
জবরদস্তি গলা দিয়ে নামাবার চেষ্টা করবে এবং বড় কষ্টে নামাতে পারবে। মৃত্যু
সকল দিক দিয়ে তার ওপর ছেয়ে থাকবে কিন্তু তার মৃত্যু হবে না এবং সামনের দিকে একটি
কঠোর শাস্তি তাকে ভোগ করতে হবে।
﴿مَّثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا
بِرَبِّهِمْ ۖ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيحُ فِي يَوْمٍ عَاصِفٍ
ۖ لَّا يَقْدِرُونَ مِمَّا كَسَبُوا عَلَىٰ شَيْءٍ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ﴾
১৮। যারা
তাদের রবের সাথে কুফরী করলো তাদের কার্যক্রমের উপমা হচ্ছে এমন ছাই-এর মতো, যাকে একটি ঝনঝাক্ষুব্ধ দিনের
প্রবল বাতাস উড়িয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের কোনই
ফল লাভ করতে পারবে না।২৫ এটিই চরম বিভ্রান্তি।
২৫. অর্থাৎ যারা নিজেদের রবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অবিশ্বস্ততা, অবাধ্যতা, স্বেচ্ছাচারমূলক
আচরণ, নাফরমানী ও বিদ্রোহাত্মক কর্মপন্থা অবলম্বন করলো এবং
নবীগণ যে আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করার দাওয়াত নিয়ে আসেন তা গ্রহণ করতে
অস্বীকার করলো, তাদের সমগ্র জীবনের কর্মকাণ্ড এবং সারা জীবনের
সমস্ত আমল শেষ পর্যন্ত এমনি অর্থহীন প্রমাণিত হবে যেমন এটি ছাই -এর স্তপ, দীর্ঘদিন
ধরে এক জায়গায় জমা হতে হতে তা এক সময় একটি বিরাট পাহাড়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাত্র একদিনের ঘুর্ণিঝড়ে তা এমনভাবে
উড়ে গেলো যে তার প্রত্যেকটি কণা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। তাদের চাকচিক্যময় সভ্যতা, বিপুল
ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, বিস্ময়কর শিল্প-কল-কারখানা, মহা
প্রতাপশালী রাষ্ট্র, বিশালায়তন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং তাদের
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চারুকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্যের
বিশাল ভাণ্ডার, এমনি তাদের ইবাদাত-বন্দেগী, বাহ্যিক
সৎকার্যাবলী এবং দান ও জনকল্যাণমূলক এমন সব কাজ-কর্ম যেগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায়
গর্ব করে বেড়ায়, সবকিছুই শেষ পর্যন্ত ছাই-এর স্তুপে পরিণত হবে। কিয়ামতের দিনের ঘুর্ণিঝড় এ ছাই-এর স্তুপকে
সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং আখেরাতের জীবনে আল্লাহর মীযানে রেখে
সামান্যতম ওজন পাওয়ার জন্য তার একটি কণাও তাদের কাছে থাকবে না।
﴿أَلَمْ
تَرَ أَنَّ اللَّهَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ إِن يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ
وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ﴾
১৯। তুমি কি
দেখছো না, আল্লাহ
আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন?২৬ তিনি চাইলে তোমাদের নিয়ে যান
এবং একটি নতুন সৃষ্টি তোমাদের স্থলাভিসিক্ত হয়।
২৬. ইতিপূর্বে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছিল এটি হচ্ছে তার
সপক্ষে যুক্তি। এর মানে হচ্ছে, একথা
শুনে তোমরা অবাক হচ্ছো কেন? তোমরা কি দেখছো না এ যমীন
ও আসমানের বিরাট সৃষ্টি কারখানা মিথ্যার ওপর নয় বরং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত? এখানে
যে জিনিসটি সত্য ও যথার্থতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় না বরং নিছক একটি ধারণা-অনুমানের
ওপর যার ভিত রাখা হয় সেটি কখনো স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। তার প্রতিষ্ঠা ও মজবুতী-লাভের কোন সম্ভাবনা থাকে না। তার ওপর ভরসা করে যে ব্যক্তি কাজ করে সে কখনো
নিজের ভরসার ক্ষেত্রে সফল-কাম হতে পারে না। যে ব্যক্তি পানির ওপর নকশা কাটে এবং বালির বাঁধ নির্মাণ
করে, সে যদি মনে করে তার এ নকশা স্থায়ী হবে এবং এ বাঁধ কায়েম
থাকবে তাহলে তার এ আশা কখনো পূর্ণ হতে পারে না। কারণ পানির প্রকৃতিই এমন যে তাতে কোন নকশা টিকে থাকে না
এবং বাঁধের জন্য যে মজবুত বুনিয়াদের প্রয়োজন তা সরবরাহ করার ক্ষমতা বালির নেই। কাজেই সত্যতা ও বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে যে
ব্যক্তি মিথ্যা আশা-আকাংখার ওপর কর্মের ভিত গড়ে তোলে তার ব্যর্থতা অনিবার্য। একথা যদি তোমরা বুঝতে পেরে থাকো তাহলে একথা
শুনে তোমরা অবাক হচ্ছো কেন যে, আল্লাহর এ বিশ্ব-জাহানে যে
ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য মুক্ত মনে করে কাজ করবে অথবা আল্লাহ ছাড়া
অন্য কারোর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে (যার আসলে কোন সার্বভৌম
ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নেই) জীবন যাপন করবে তার জীবনের সমস্ত কাজ নষ্ট হয়ে যাবে? যখন
মানুষ এখানে যথার্থই স্বাধীন নয় এবং আল্লাহ ছাড়া অণ্য কারোর বান্দাও নয় তখন এ
মিথ্যা ও অবাস্তব কল্পনার ওপর নিজের সমগ্র চিন্তা ও কর্মের ভিত্তি স্থাপনকারী
মানুষ যদি তোমাদের মতে পানির ওপর নকশা অংকনকারী নির্বোধের পরিণাম না ভোগে তাহলে
তার জন্য তোমরা আর কোন ধরনের পরিণাম আশা করো"?
﴿وَمَا
ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ﴾
২০। এমনটি করা
তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়।২৭
২৭. দাবীর সপক্ষে যুক্তি পেশ করার সাথে সাথেই উপদেশ হিসেবে এ
বাক্য উচ্চারণ করা হয়েছে এবং এ সাথে ওপরের দ্ব্যর্থহীন কথা শুনে মানুষের মনে যে
সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে তা দূর করার ব্যবস্থাও এতে রয়েছে। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে এ আয়াতগুলোতে যে কথা বলা হয়েছে তাই
যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে প্রত্যেক মিথ্যাপূজারী ও দৃষ্কৃতকারী ধবংস হয় না কেন? এর
জবাব হচ্ছে, হে নির্বোধ! তুমি কি মনে করো তাকে ধ্বংস করা
আল্লাহর জন্য তেমন কোন কঠিন কাজ অথবা আল্লাহর সাথে তার কোন আত্মীয়তা আছে যে
কারণে তার দুষ্কৃতি সত্ত্বেও নিছক স্বজন প্রীতির বশে বাধ্য হয়ে আল্লাহ তাকে
অব্যাহতি দিয়েছেন? যদি এমনটি না হয়ে থাকে এবং তুমি নিজে জানো এমন
কোন ব্যাপার নেই তাহলে তোমার অবশ্যি বুঝা উচিত, একটি
মিথ্যাপূজারী ও দুস্কৃতিকারী জাতি সবসময় তাকে সরিয়ে দেয়ার এবং তার জায়গায় অন্য
কোন জাতিকে কাজ করার সুযোগ দেয়ার আশংকা করে থাকে। এ আশংকা করে থাকে। এ আশংকার বাস্তবে রূপ নিতে দেরী হয়ে থাকলে আদতে আশংকার
কোন অস্তিত্বই নেই এ ধরনের বিভ্রান্তির নেশায় মত্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়। অবকাশের প্রত্যেকটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে
করো এবং নিজের মিথ্যা চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থার অস্থায়িত্ব অনুভব করে তাকে দ্রুত
স্থায়ী বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো।
﴿وَبَرَزُوا
لِلَّهِ جَمِيعًا فَقَالَ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ
تَبَعًا فَهَلْ أَنتُم مُّغْنُونَ عَنَّا مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِن شَيْءٍ ۚ قَالُوا
لَوْ هَدَانَا اللَّهُ لَهَدَيْنَاكُمْ ۖ سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَجَزِعْنَا أَمْ صَبَرْنَا
مَا لَنَا مِن مَّحِيصٍ﴾
২১। আর এরা
যখন সবাই একত্রে আল্লাহর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে,২৮ সে সময় এদের মধ্য থেকে যারা দুনিয়ায়
দুর্বল ছিল তারা যারা নিজেদেরকে বড় বলে জাহির করতো তাদেরকে বলবে, “দুনিয়ায় আমরা তোমাদের অনুসারী
ছিলাম, এখন কি
তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে আমাদের বাঁচাবার জন্যও কিছু করতে পারো? তারা জবাব দেবে, “আল্লাহ যদি আমাদের
মুক্তিলাভের কোন পথ দেখাতেন তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তোমাদেরও দেখিয়ে দিতাম। এখন তো সব
সমান, কান্নাকাটি
করো বা সবর করো- সর্বাবস্থায় আমাদের বাঁচার কোন পথ নেই।”২৯
২৮. মূল শব্দ 'বারাযা' মানে
শুধু বের হয়ে সামনে আসা এবং উপস্থাপিত হওয়া নয় বরং এর মধ্যে প্রকাশ হয়ে যাওয়া এবং
খুলে যাওয়ার অর্থও রয়েছে।
তাই আমি এ অনুবাদ করেছি সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে বান্দা তো সবসময় তার রবের সামনে উন্মুক্ত
রয়েছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন নিজের
রবের সামনে পেশ হওয়ার সময় যখন সবাই আল্লাহর আদালতে হাযির হবে তখন তারা নিজেরাও
জানবে যে, তারা সকল বিচারপতির শ্রেষ্ঠ বিচারপতি এবং শেষ
বিচার দিনের সর্বময় কর্তার সামনে একেবারে অনাবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের কোন
কাজ বরং কোন চিন্তাও হৃদয়ের গহন কোণে লুকানো কোন ইচ্ছাও তাঁর কাছে গোপন নেই।
২৯. এটি এমন সব লোকের জন্য সতর্কবাণী যারা দুনিয়ায় চোখ বন্ধ
করে অন্যের পেচনে চলে অথবা নিজেদের দুর্বলতাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে শক্তিশালী
জালেমদের আনুগত্য করে।
তাদের জানানো হচ্ছে, আজ যারা তোমাদের নেতা, কর্মকর্তা
ও শাসক হয়ে আছে আগামীকাল এদের কেউই তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে সামান্যতম
নিষ্কৃতিও দিতে পারবে না।
কাজেই আজই ভেবে নাও, তোমরা যাদের পেছনে ছুটে চলছো অথবা যাদের
হুকুম মেনে চলছো তারা নিজেরাই কোথায় যাচ্ছে এবং তোমাদের কোথায় নিয়ে যাবে।
﴿وَقَالَ
الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدتُّكُمْ
فَأَخْلَفْتُكُمْ ۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلَّا أَن دَعَوْتُكُمْ
فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنفُسَكُم ۖ مَّا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ
وَمَا أَنتُم بِمُصْرِخِيَّ ۖ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِن قَبْلُ ۗ
إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
২২। আর যখন
সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, “সত্যি বলতে কি আল্লাহ তোমাদের
সাথে যে ওয়াদা করে ছিলেন তা সব সত্যি ছিল এবং আমি যেসব ওয়াদা করেছিলাম তার মধ্য
থেকে একটিও পুরা করিনি।৩০ তোমাদের ওপর আমার তো কোন জোর
ছিল না, আমি
তোমাদের আমার পথের দিকে আহ্বান জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি এবং তোমরা আমার আহ্বানে
সাড়া দিয়েছিলে।৩১ এখন আমার নিন্দাবাদ করো না, নিজেরাই নিজেদের নিন্দাবাদ
করো। এখানে না আমি তোমাদের অভিযোগের প্রতিকার
করতে পারি আর না তোমরা আমার। ইতিপূর্বে তোমরা যে আমাকে
আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কতৃত্বের শরীক করেছিলে৩২ তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক
নেই, এ ধরনের
জালেমদের জন্য তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবধারিত।
৩০. অর্থাৎ আল্লাহ সত্যবাদী ছিলেন এবং আমি ছিলাম মিথ্যেবাদী
তোমাদের এতটুকুন অভিযোগ ও দোষারোপ যে পুরোপুরি সত্যি এতে কোন সন্দেহ নেই। একথা আমি অস্বীকার করছি না। তোমরা দেখতেই পাচ্ছো, আল্লাহর
প্রত্যেকটি প্রতিশ্রুতি ও হুমকি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে আমি তোমাদের যেসব আশ্বাস দিয়েছিলাম, যেসব
লাভের লোভ দেখিয়েছিলাম, যেসব সুদৃশ্য আশা- আকাংখার জালে তোমাদের
ফাঁসিয়েছিলাম এবং সর্বাগ্রে তোমাদের মনে যে বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছিলাম যে, ওসব
আখেরাত টাখেরাত বলে কিছুই নেই। এগুলো নিছক প্রতারণা ও গাল-গল্প,
আর
যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে অমুক বুযুর্গের বদৌলতে তোমরা সোজা
উদ্ধার পেয়ে যাবে, কাজেই তাদের খেদমতে নযরানা ও অর্থ-উপাচারের
উৎকোচ প্রদান করতে থাকো এবং তারপর যা মন চায় তাই করে যেতে থাকো আমি তোমাদের এই
যেসব কথা নিজে এবং আমার এজেন্টদের মাধ্যমে বলেছিলাম, এগুলো
সবই ছিল নিছক প্রতারণা।
৩১. অর্থাৎ আপনারা যদি এ মর্মে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন যে, আপনারা
নিজেরা সত্য-সঠিক পথে চলতে চাচ্ছিলেন এবং আমি জবরদস্তি আপনাদের হাত ধরে আপনাদেরকে
ভুল পথ থেকে টেনে নিয়েছিলাম তাহলে অবশ্যি তা দেখান। এর যা শাস্তি হয় আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু আপনারা নিজেরাও স্বীকার করবেন, আসল
ঘটনা তা নয়। আমি হকের আহবানের
মোকাবিলায় বাতিলের আহবান আপনাদের সামনে পেশ করেছি। সত্যের মোকাবিলায় মিথ্যার দিকে আপনাদেরকে ডেকেছি। সৎকাজের কিছুই করিনি। আমার কথা মানা না মানার পূর্ণ স্বাধীনতা আপনাদের ছিল। আপনাদেরকে বাধ্য করার কোন ক্ষমতা আমার ছিল না। এখন আমার এ দাওয়াতের জন্য নিসন্দেহে আমি নিজে
দায়ী ছিলাম এবং এর শাস্তিও আমি পাচ্ছি। কিন্তু আপনারা যে এ দাওয়াতে সাড়া দিয়েছেন,
এর
দায়ভার কেমন করে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছেন?
নিজেদের
ভুল নির্বাচন এবং নিজেদের ক্ষমতার অসৎ ব্যবহারের দায়ভার পুরোপুরি আপনাদের বহন
করতে হবে।
৩২. এখানে আবার বিশ্বাসগত শিরকের মোকাবিলায় শিরকের একটি
স্বতন্ত্র ধারা অর্থাৎ কর্মগত শিরকের অস্তিত্বের একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। একথা সুস্পষ্ট, বিশ্বাসগত
দিক গিয়ে শয়তানকে কেউই আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে শরীক করে না এবং কেউ
তার পূজা, আরাধনা ও বন্দেগী করে না। সবাই তাকে অভিশাপ দেয়। তবে তার আনুগত্য ও দাসত্ব এবং চোখ বুজে বা খুলে তার
পদ্ধতির অনুসরণ অবশ্যি করা হচ্ছে। এটিকেই এখানে শিরক বলা হয়েছে। কেউ বলতে পারেন, এটা তো শয়তানের উক্তি, আল্লাহ
এটা উদ্ধৃত করেছেন মাত্র।
কিন্তু আমরা বলবো, প্রথমত তার বক্তব্য যদি ভুল হতো তাহলে আল্লাহ
নিজেই তার প্রতিবাদ করতেন। দ্বিতীয়ত কুরআনে কর্মগত শিরকের শুধু এ একটিমাত্র দৃষ্টান্ত নেই বরং
পূর্ববর্তী সূরাগুলোয় এর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সামনের দিকে আরো পাওয়া
যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইহুদী
ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগঃ তারা আল্লাহ ছাড়া নিজেদের "আহবার"
(উলামা) ও "রাহিব"দেরকে (সংসার বিরাগী সন্যাসী) রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। জাহেলিয়াতে আচার অনুষ্ঠান উদ্ভাবনকারীদের
সম্পর্কে একথা বলাঃ তাদের অনুসারীরা তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছে। [ আল আন'
আমঃ
১৩৭ ] প্রবৃত্তির কামনা বাসনার পূজারীদের সম্পর্কে বলাঃ তারা নিজেদের প্রবৃত্তির
কামনা বাসনাকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। (আল ফুরকানঃ ৪৩) নাফরমান বান্দাদের সম্পর্কে এ উক্তিঃ তারা শয়তানের ইবাদাত
করতে থেকেছে। (ইয়াসীনঃ ৬০) মানুষের গড়া
আইন অনুযায়ী জীবন যাপন কারীদেরকে এ বলে র্ভৎসনা করাঃ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া যারা
তাদের জন্য শরীয়াত প্রণয়ন করেছে তারা হচ্ছে তাদের "শরীক"। (আশ-শূরাঃ ২১) এগুলো সব কি কর্মগত শিরকের
নজীর নয়? এ নজীরগুলো থেকে একথা পরিষ্কার জানা যায় যে, কোন
ব্যক্তি আকীদাগতভাবে কোন গাইরুল্লাহকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব শরীক করলো, শিরকের
শুধুমাত্র এ একটিই আকৃতি নেই এর আর একটি আকৃতিও আছে। সেটি হচ্ছে,
আল্লাহর
অনুমোদন ছাড়াই অথবা আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোন গাইরুল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য
করতে থাকা। এ ধরনের অনুসারী বা
আনুগত্যকারী যদি নিজের নেতার বা যার আনুগত্য করছে তার ওপর লানত বর্ষণ করা অবস্থায়ও
কার্যত এ আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করে তাহলে কুরআনের দৃষ্টিতে সে তাকে আল্লাহর
সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের শরীক করছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে আকীদাগত মুশরিকদের জন্য যে বিধান তাদের
জন্য সেই একই বিধান না হলেও তাতে কিছু আসে যায় না। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন [সূরা আন'আমের
৮৭ ও ১০৭ টীকা এবং সূরা আল কাহাফের ৫০ টীকা]
﴿وَأُدْخِلَ
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
خَالِدِينَ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ ۖ تَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ﴾
২৩। অপরদিকে
যারা দুনিয়ায় ঈমান এনেছে এবং যারা সৎ কাজ করেছে তাদেরকে এমন বাগীচার প্রবেশ করানো
হবে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত হবে। সেখানে
তারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে চিরকাল বসবাস করবে। সেখানে
তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হবে শান্তি ও নিরাপত্তার মোবারকবাদ সহকারে।৩৩
৩৩. মূল শব্দ تَحِية এর
শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, দীর্ঘয়ুর জন্য দোয়া। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে আরবী ভাষায় এ শব্দটিকে সম্বর্ধনা ও
অভ্যর্থনা সূচক শব্দ বা স্বাগত বচন হিসেবে বলা হয়ে থাকে। লোকেরা পরস্পর মুখোমুখি হলে সবার আগে একজন অন্যজনের
উদ্দেশ্যে এ শব্দটিই উচ্চারণ করে। আমাদের ভাষায় এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে। "সালাম" বা 'সালাম কালাম'। কিন্তু প্রথম শব্দটি
ব্যবহার করলে অনুবাদ যথাযর্থ হয় না। এবং দ্বিতীয় শব্দটি হালকা হয়ে যায়। তাই আমি এর অনুবাদে "অভ্যর্থনা" শব্দ ব্যবহার
করেছি।
تَحِيَّتُهُمْ শব্দের মানে এও হতে পারে যে, তাদের
মধ্যে পারস্পরিক অভ্যর্থনার পদ্ধতি এ হবে। আবার এ মানেও হতে পারে যে, তাদের
অভ্যর্থনা এভাবে হবে।
তাছাড়া سَلَامٌ শব্দের মধ্যে নিরাপত্তার
দোয়ার অর্থ রয়েছে এবং নিরাপত্তার জন্য মোবারকবাদও রয়েছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমি এখানে অনুবাদ
উল্লেখিত অর্থ গ্রহণ করেছি।
﴿أَلَمْ
تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا
ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ﴾
২৪। তুমি কি
দেখছো না আল্লাহ কালেমা তাইয়েবার৩৪ উপমা দিয়েছেন কোন্ জিনিসের সাহায্যে? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো
জাতের গাছ, যার শিকড়
মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে।৩৫
৩৪. "কালেমা তাইয়েবা"র শাব্দিক অর্থ "পবিত্র
কথা" কিন্তু এ শব্দের মাধ্যমে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে, এমন
সত্য কথা এবং এমন পরিচ্ছন্ন বিশ্বাস যা পুরোপুরি সত্য ও সরলতার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ
উক্তি ও আকীদা কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে অপরিহার্যভাবে এমন একটি কথা ও বিশ্বাস হতে
পারে যার মধ্যে রয়েছে তাওহীদের স্বীকৃতি,
নবীগণ
ও আসমানী কিতাবসমূহের স্বীকৃতি এবং আখেরাতের স্বীকৃতি। কারণ কুরআন এ বিষয়গুলোকেই মৌলিক সত্য হিসেবে পেশ করে।
৩৫. অন্য কথায় এর অর্থ হলো, পৃথিবী
থেকে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা যেহেতু এমন একটি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত
যার স্বীকৃতি এমজন মুমিন তার কালেমা তাইয়েবার মধ্যে দিয়ে থাকে, তাই
কোন স্থানের প্রাকৃতির আইন এর সাথে সংঘর্ষ বাধায় না, কোন
বস্তুর আসল, স্বভাব ও প্রাকৃতিক গঠন একে অস্বীকার করে না
এবং কোথাও কোন প্রকৃত সত্য ও সততা এর সাথে বিরোধ করে না। তাই পৃথিবী ও তার সমগ্র ব্যবস্থা তার সাথে সহযোগিতা করে
এবং আকাশ তথা সমগ্র মহাশূন্য জগত তাকে স্বাগত জানায়।
﴿تُؤْتِي
أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا ۗ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ
لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
২৫। প্রতি
মুহূর্তে নিজের রবের হুকুমে সে ফলদান করে।৩৬ এ উপমা আল্লাহ এ জন্য দেন
যাতে লোকেরা এর সাহায্যে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
৩৬. অর্থাৎ সেটি একটি ফলদায়ক ও ফলপ্রসূ কালেমা। কোন ব্যক্তি বা জাতি তার তার ভিত্তিতে জীবন
ব্যবস্থা গড়ে তুললে প্রতি মুহূর্তে সে তার সূফল লাভ করতে থাকে। সেটি চিন্তা ধারায় পরিপক্কতা ও পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে
প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, এ
জীবন ধারায় মজবুতী, চরিত্রে পবিত্রতা, আত্মায়
প্রফুল্লতা, ও স্নিগ্ধতা, শরীরে
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, আচরণে মাধুর্য, ব্যবহার
ও লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা
ও অংগীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কৃষ্টিতে
ঔদার্য ও মহত্ব, সভ্যতায় ভারসাম্য, অর্থনীতিতে
আদল ও ইনসাফ, রাজনীতিতে বিশ্বস্ততা, যুদ্ধে
সৌজন্য, সন্ধিতে আন্তরিকতা এবং চুক্তি ও অংগীকারে
বিশ্বস্ততা সৃষ্টি করে।
সেটি এমন একটি পরশ পাথর যার প্রভাব কেউ যথাযথভাবে গ্রহণ করলে খাঁটি সোনায় পরিণত
হয়।
﴿وَمَثَلُ
كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِن فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا
مِن قَرَارٍ﴾
২৬। অন্যদিকে অসৎ
বাক্যের৩৭ উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে
নিক্ষেপ করা হয়, যার কোন
স্থায়িত্ব নেই।৩৮
৩৭. এটি কালেমা তাইয়েবার বিপরীত শব্দ। যদিও প্রতিটি সত্য বিরোধী ও মিথ্যা কথার ওপর এটি প্রযুক্ত
হতে পারে তবুও এখানে এ থেকে এমন প্রতিটি বাতিল আকীদা বুঝায়, যার
ভিত্তিতে মানুষ নিজের জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ বাতিল আকীদা নাস্তিক্যবাদ, নিরীশ্বরবাদ, ধর্মদ্রোহিতা, অবিশ্বাস
শিরক, পৌত্তলিকতা অথবা এমন কোন চিন্তাধারাও হতে পারে যা নবীদের
মাধ্যমে আসেনি।
৩৮. অন্য কথায় এর অর্থ হলো, বাতিল
আকীদা যেহেতু সত্য বিরোধী তাই প্রাকৃতিক আইন কোথাও তার সাথে সহযোগিতা করে না। বিশ্ব জগতের প্রতিটি অণুকণিকা তাকে মিথ্যা
প্রতিপন্ন করে। পৃথিবী ও আকাশের প্রতিটি
বস্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। জমিতে তার বীজ বপন করার চেষ্টা করলে জমি সবসময় তাকে উদগীরণ করার জন্য তৈরী
থাকে। আকাশের দিকে তার শাখা
প্রশাখা বেড়ে উঠতে থাকলে আকাশ তাদেরকে নিচের দিকে ঠেলে দেয়। পরীক্ষার খাতিরে মানুষকে যদি নির্বাচন করার স্বাধীনতা ও
কর্মের অবকাশ না দেয়া হতো তাহলে এ অসৎজাতের গাছটি কোথাও গজিয়ে উঠতে পারতো না। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ আদম সন্তানকে নিজের
স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবণতা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ দান করেছেন, তাই
যেসব নির্বোধ লোক প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে লড়ে এ গাছ লাগাবার চেষ্টা করে তাদের
শক্তি প্রয়োগের ফলে জমি একে সামান্য কিছু জায়গা দিয়েও দেয়, বাতাস
ও পানি থেকে সে কিছু না কিছু খাদ্য পেয়েই যায় এবং শূন্যও তার ডালপালা ছড়াবার জন্য
অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু জায়গা তাকে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু যতদিন এ গাছ বেঁচে থাকে ততদিন তিতা, বিস্বাদ
ও বিষাক্ত ফল দিতে থাকে এবং অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথেই আকস্মিক ঘটনাবলীর এক
ধাক্কাই তাকে সমূলে উৎপাটিত করে।
পৃথিবীর ধর্মীয়, নৈতিক,
চিন্তাগত
ও তামাদ্দুনিক ইতহাস অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই কালেমায়ে তাইয়েবা তথা ভালো কথা
এবং মন্দ কথার এ পার্থক্য সহজে অনুভব করতে পারে। সে দেখবে ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ভালো কথা একই
থেকেছে। কিন্তু মন্দ কথা সৃষ্টি
হয়েছে অসংখ্য। ভালো কথাকে কখনো
শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা যায়নি। কিন্তু মন্দ কথার তালিকা হাজারো মৃত কথার নামে ভরে আছে। এমনকি তাদের অনেকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, আজ
ইতিহাসের পাতা ছাড়া আর কোথাও তাদের নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। স্ব স্ব যুগে যেসব কথার প্রচণ্ড দাপট ছিল আজ
সে সব কথা উচ্চারিত হলে মানুষ এই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, একদিন
এমন পর্যায়ের নির্বুদ্ধিতাও মানুষ করেছিল।
তারপর ভালো কথাকে যখনই যে জাতি বা ব্যক্তি যেখানেই গ্রহণ করে সঠিক অর্থে প্রয়োগ
করেছে সেখানেই তার সমগ্র পরিবেশ তার সুবাসে আমোদিত হয়েছে। তার বরকতে শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি বা জাতিই সমৃদ্ধ হয়নি বরং
তার আশপাশের জগতও সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কোন মন্দ কথা যেখানেই ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে শিকড় গেড়েছে সেখানেই তার
দুর্গদ্ধে সমগ্র পরিবেশ পুতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে এবং তার কাঁটার আঘাত থেকে তার
মান্যকারীরা নিরাপদ থাকেনি এবং এমন কোন ব্যক্তিও নিরাপদ থাকতে পারেনি যে তার
মুখোমুখি হয়েছে।
এ প্রসংগে একথা উল্লেখ্য যে, এখানে উপমার মাধ্যমে ১৮
আয়াতে যে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছিল সেটিই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৮ আয়াতে বলা হয়েছিল,
নিজের
রবের সাথে যারা কুফরী করে তাদের দৃষ্টান্ত এমন ছাই-এর মতো যাকে ঝনঝা বিক্ষুব্ধ
দিনের প্রবল বাতাস উড়িয়ে গিয়েছে। এ একই বিষয়বস্তু ইতিপূর্বে সূরা আর রা'দ-এর ১৭ আয়াতে অন্যভাবে
বন্যা ও গলিত ধাতুর উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
﴿يُثَبِّتُ
اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي
الْآخِرَةِ ۖ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ ۚ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ﴾
২৭।
ঈমানদারদেরকে আল্লাহ একটি শাশ্বত বাণীর ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে
প্রতিষ্ঠা দান করেন।৩৯ আর জালেমদেরকে আল্লাহ
পথভ্রষ্ট করেন।৪০ আল্লাহ যা চান তাই করেন।
৩৯. অর্থাৎ এ কালেমার বদৌলতে তারা দুনিয়ায় একটি স্থায়ী
দৃষ্টিভংগী, একটি শক্তিশালী ও সুগঠিত চিন্তাধারা এবং একটি ব্যাপকভিত্তিক
মতবাদ ও জীবন দর্শন লাভ করে। জীবনের সকল জটিল গ্রন্থীর উন্মোচনে এবং সকল সমস্যার সমাধানে তা এমন এক চাবির
কাজ করে যা দিয়ে সকল তালা খোলা যায়। তার সাহায্যে চরিত্র মজবুত এবং নৈতিক বৃত্তিগুলো সুগঠিত হয়। তাকে কালের আবর্তন একটুও নড়াতে পারে না। তার সাহায্যে জীবন যাপনের এমন কতগুলো নিরেট
মূলনীতি পাওয়া যায় যা একদিকে তাদের হৃদয়ে প্রশান্তি ও মস্তিষ্কে নিশ্চিন্ততা এনে
দেয় এবং অন্যদিকে তাদেরকে প্রচেষ্টা ও কর্মের পথে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াবার
দ্বারে দ্বারে ঠোকর খাওয়ার এবং অস্থিরতার শিকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। তারপর যখন তারা মৃত্যুর সীমানা পার হয়ে
পরলোকের সীমান্তে পা রাখে তখন সেখানে তারা বিস্ময়াভিভূত, হতবাক
ও পেরেশান হয় না। কারণ সেখানে তাদের
প্রত্যাশা অনুযায়ী সবকিছু হতে থাকে। সে জগতে তারা এমনভাবে প্রবেশ করতে থাকে যেন সেখানকার আচার-অনুষ্ঠান ও
রীতিনীতি সম্পর্কে তারা পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিল। সেখানে এমন কোন পর্যায় উপস্থাপিত হয় না যে সম্পর্কে তাদের
পূর্বাহ্নে খবর দেয়া হয়নি এবং যে জন্য তারাপূর্বেই প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন করে
রাখেনি। তাই সেখানে প্রত্যেক মনযিলই
তারা দৃঢ়পদে অতিক্রম করে যায়। পক্ষান্তরে কাফের ব্যক্তি মৃত্যুর পরপরই নিজের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত
অকস্মাত এক ভিন্ন অবস্থার মুখোমুখি হয়। তার অবস্থা মুমিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়।
৪০. অর্থাৎ যেসব জালেম কালেমায়ে তাইয়েবা বাদ দিয়ে কোন মন্দ
কালেমার অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মন-মানসকে দিশেহারা করে দেন এবং
তাদের প্রচেষ্টাবলীর মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেন। তারা কোন দিক দিয়েও চিন্তা কর্মের সঠিক পথে পাড়ি জমাতে
পারে না। তাদের কোন তীরও সঠিক
লক্ষ্যস্থলে লাগে না।
﴿أَلَمْ
تَرَ إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَتَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّوا قَوْمَهُمْ دَارَ
الْبَوَارِ﴾
২৮। তুমি
দেখেছো তাদেরকে, যারা
আল্লাহর নিয়ামত লাভ করলো এবং তাকে কৃতজ্ঞতায় পরিণত করলো আর (নিজেদের সাথে) নিজেদের
সম্প্রদায়কেও ধ্বংসের আবর্তে ঠেলে দিল।
﴿جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا
ۖ وَبِئْسَ الْقَرَارُ﴾
২৯। অর্থাৎ
জাহান্নাম, যার মধ্যে
তাদরেকে ঝল্সানো হবে এবং তা নিকৃষ্টতম আবাস।
﴿وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا
لِّيُضِلُّوا عَن سَبِيلِهِ ۗ قُلْ تَمَتَّعُوا فَإِنَّ مَصِيرَكُمْ إِلَى النَّارِ﴾
৩০। এবং
আল্লাহর কিছু সমকক্ষ বানিয়ে নিল, যাতে তারা তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট
করে দেয়। এদেরকে বলো, ঠিক আছে, মজা ভোগ করে নাও, শেষ পর্যন্ত তোমাদের তো ফিরে
যেতে হবে দোযখের মধ্যেই
﴿قُل لِّعِبَادِيَ الَّذِينَ
آمَنُوا يُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُنفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً
مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خِلَالٌ﴾
৩১। হে নবী!
আমার যে বান্দারা ঈমান এনেছে তাদেরকে বলে দাও, তারা যেন নামায কায়েম করে এবং
যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে (সৎপথে) ব্যয় করে৪১-সেই দিন আসার আগে যেদিন না
বেচা-কেনা হবে আর না হতে পারবে বন্ধু বাৎসল্য।৪২
৪১. এর মানে হচ্ছে,
মুমিনদের
মনোভাব ও কর্মনীতি কাফেরদের মনোভাব ও কর্মনীতি থেকে আলাদা হওয়া উচিত। ওরা তো নিয়ামত অস্বীকারকারী। অন্যদিকে এদের হতে হবে কৃতজ্ঞ। আর এ কৃতজ্ঞতার বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য
এদের নামায কায়েম এবং আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে হবে।
৪২. অর্থাৎ সেখানে কোন কিছুর বিনিময়ে নাজাত কিনে নেয়া যাবে না
এবং আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচবার জন্য কারো বন্ধুত্ব কাজে লাগবে না।
﴿اللَّهُ
الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ
بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ ۖ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي
الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ ۖ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ﴾
৩২। আল্লাহ তো
তিনিই,৪৩ যিনি এ পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি
করেছেন এবং আকাশ তেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর তার মাধ্যমে তোমাদের
জীবিকা দান করার জন্য নানা প্রকার ফল উৎপন্ন করেছেন। যিনি
নৌযানকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন, যাতে তাঁর হুকুমে তা সাগরে
বিচরণ করে এবং নদী সমূহকে তোমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন।
৪৩. অর্থাৎ সেই আল্লাহ,
যাঁর
নিয়ামত অস্বীকার করা হচ্ছে, যাঁর বন্দেগী ও আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া
হচ্ছে, যাঁর সাথে জোর করে অংশীদার বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনিই তো সেই আল্লাহ, এসব
এবং ওসব যাঁর দান, যাঁর দানের কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
﴿وَسَخَّرَ
لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ ۖ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ﴾
৩৩। যিনি
সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, তারা অবিরাম চলছে এবং রাত ও
দিনকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন।৪৪
৪৪. "তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন"কে সাধারণত
লোকেরা ভুল করে "তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন"-এর অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। তারপর এ বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত থেকে বিভিন্ন
অদ্ভুত ধরনের অর্থ বের করে থাকেন। এমন কি কোন কোন লোক এ থেকে এ ধারণা করে নিয়েছেন যে, পৃথিবী
ও আকাশ জয় করা হচ্ছে মানুষের জীবনের মূল লক্ষ। অথচ মানুষের জন্য এসবকে অনুগত করে দেয়ার অর্থ এ ছাড়া আর
কিচুই নয় যে, মহান আল্লাহ এদেরকে এমন সব আইনের অধীন করে
রেখেছেন যেগুলোর বদৌলতে তারা মানুষের জন্য উপকারী হয়েছে। নৌযান যদি প্রকৃতির কতিপয় আইনের অনুসারী না হতো, তাহেলে
মানুষ কখনো সামুদ্রিক সফর করতে পারতো না। নদ-নদীগুলো যদি কতিপয় বিশেষ আইনের জালে আবদ্ধ না থাকতো, তাহলে
কখনো তা থেকে খাল কাটা যেতো না। সূর্য, চন্দ্র,
এবং
দিন ও রাত যদি বিশেষ নিয়ম কানুনের অধীনে শক্ত করে বাঁধা না থাকতো তাহলে এ
বিকাশমান মানব সভ্যতা সংস্কৃতির উদ্ভব তো দূরের কথা, এখানে
জীবনের ষ্ফূরণই সম্ভবপর হতো না।
﴿وَآتَاكُم
مِّن كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ ۚ وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ
إِنَّ الْإِنسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ﴾
৩৪। যিনি এমন
সবকিছু তোমাদের দিয়েছেন যা তোমরা চেয়েছো৪৫ যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ
গণনা করতে চাও তাহলে তাতে সক্ষম হবে না। আসলে
মানুষ বড়ই বে-ইনসাফ ও অকৃতজ্ঞ।
৪৫. অর্থাৎ তোমাদের প্রকৃতির সর্ববিধ চাহিদা পূরণ করেছেন। তোমাদের জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই
সরবরাহ করেছেন। তোমাদের বেঁচে থাকা ও
বিকাশ লাভ করার জন্য যেসব উপাদান ও উপকরণের প্রয়োজন ছিল তা সবই যোগাড় করে
দিয়েছেন।
﴿وَإِذْ
قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ
أَن نَّعْبُدَ الْأَصْنَامَ﴾
৩৫। স্মরণ কর
সেই সময়ের কথা যখন ইবরাহীম দোয়া করছিল,৪৬ “হে আমার রব! এ শহরকে৪৭ নিরাপত্তার শহরে পরিণত করো
এবং আমার ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচাও।
৪৬. সাধারণ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করার পর এবার আল্লাহ
কুরাইশদের প্রতি যেসব বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন সেগুলার কথা বলা হচ্ছে। এ সংগে একথাও বলা হচ্ছে যে, তোমাদের
প্রপিতা ইবরাহীম আ. কোন ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে তোমাদের এখানে আবাদ করেছিলেন, তাঁর
দোয়ার জবাবে আমি তোমাদের প্রতি কোন ধরনের অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম এবং এখন
তোমরা নিজেদের প্রপিতার প্রত্যাশা ও নিজেদের রবের অনুগ্রহের জবাবে কোন ধরনের
ভ্রষ্টতা ও দুষ্কর্মের অবতারণা করে যাচ্ছো।
৪৭. অর্থাৎ মক্কাকে।
﴿رَبِّ
إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ ۖ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي
ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৩৬। হে আমার
রব! এ মূর্তিগুলো অনেককে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে,৪৮ (হয়তো আমার সন্তানদেরকেও এরা পথভ্রষ্ট করতে
পারে, তাই তাদের
মধ্য থেকে) যে আমার পথে চলবে সে আমার অন্তরগত আর যে আমার বিপরীত পথ অবলম্বন করবে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যি তুমি
ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।৪৯
৪৮. অর্থাৎ আল্লাহর দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নিজের ভক্তে পরিণত
করেছে। এ বাক্যটিকে রূপক হিসেবে
ব্যবহার করা হয়েছে। মূর্তি যেহেতু অনেকের
পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে তাই পথভ্রষ্ট করার কাজকে তার কৃতকর্ম হিসেবে উল্লেখ করা
হয়েছে।
৪৯. হযরত ইবরাহীম আ. কোন অবস্থাতেও মানুষকে আল্লাহর আযাবের
শিকার দেখতে চান না।
বরং শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করার আবেদন জানাতে থাকেন। এটি তাঁর আন্তরিক কোমলতা এবং মানুষের অবস্থার
প্রতি চরম স্নেহ-মমতার ফল। জীবিকার ব্যাপারে তো তিনি এতটুকু বলে দিতেও কুন্ঠবোধ করেননি যে-
وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آمَنَ
مِنْهُم بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
"এর অধিবাসীরে মধ্য থেকে যারা
আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা প্রদান করো।" আল বাকারাহঃ ১২৬
কিন্তু যেখানে আখেরাতে পাকড়াও করার প্রশ্ন আসে সেখানে তাঁর কণ্ঠ থেকে একথা
ধ্বনিত হয় না যে, আমার পথ ছেড়ে যে অন্য পথে চলে তাকে শাস্তি দিয়ে
দিয়ো। বরং তিনি উল্টো একথা বলেন
যে, তাদের ব্যাপারে আর কীইবা আবেদন জানাবো, তুমি
তো পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল। আর এ আপাদমস্তক স্নেহ ও মমতার পুতলী মানুষটির এ মনোভাব শুধুমাত্র তার নিজের
সন্তান ও বংশধরদের ব্যাপারেই নয় বরং যখন ফেরেশতারা লূতের সম্প্রদায়ের মতো
দুষ্কৃতকারী সম্প্রদায়কে ধবংস করতে যাচ্ছিল তখনো মহান আল্লাহ বড়ই প্রীতিপূর্ণ
কন্ঠে বলেন, ইবরাহীম আমার সাথে ঝগড়া করতে লাগলো"
(হূদঃ ৭৪) হযরত ঈসা আ. এরও এ একই অবস্থা। আল্লাহ যখন তাঁর সামনেই খৃষ্টবাদীদের ভ্রষ্টতা প্রমাণ করে
দেন তখন তিনি আবেদন জানানঃ যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন তাহলে তারা তো আসলে আপনার
বান্দা আর যদি ক্ষমা করেন তাহলে আপনি প্রবল প্রতাপান্বিত ও জ্ঞানী।" (আল মায়েদাহঃ ১১৮)
﴿رَّبَّنَا
إِنِّي أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ
رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ
وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ﴾
৩৭। হে আমাদের রব! আমি একটি তৃণ পানিহীন
উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি।
পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামায কায়েম করবে। কাজেই
তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো,৫০ হয়তো এরা শোকরগুজার হবে।
৫০. এ দোয়ারই বরকতে প্রথমে সমস্ত আরবের লোকেরা হজ্জ ও উমরাহ
করার জন্য মক্কায় ছুটে আসতো আবার এখন সারা দুনিয়ার লোক সেখানে দৌড়ে যাচ্ছে। তারপর এ দোয়ার বরকতেই সব যুগে সব ধরনের ফল, ফসল
ও অন্যান্য জীবন ধারণ সামগ্রী সেখানে পৌঁছে থাকে। অথচ এ তৃণপানি হীন অনুর্বর এলাকায় পুশুখাদ্যও উৎপন্ন হয় না।
﴿رَبَّنَا
إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ ۗ وَمَا يَخْفَىٰ عَلَى اللَّهِ مِن شَيْءٍ
فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ﴾
৩৮। হে
পরওয়ারদিগার! তুমি জানো যা কিছু আমরা লুকাই এবং যা কিছু প্রকাশ করি।”৫১- আর৫২ যথার্থই আল্লাহর কাছে কিছুই
গোপন নেই, না
পৃথিবীতে না আকাশে
৫১. অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি মুখে যা কিছু বলছি তা তুমি শুনছো
এবং যেসব আবেগ-অনুভুতি আমার হৃদয় অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে তাও তুমি জানো।
৫২. এটি একটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। হযরত ইবরাহীমের আ. কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ
একথা বলেন।
﴿الْحَمْدُ
لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي
لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ﴾
৩৯। “শোকর সেই
আল্লাহর, যিনি এ
বৃদ্ধ বয়সে আমাকে ইসমাঈল ও ইসহাকের মতো পুত্র দিয়েছেন। আসলে আমার
রব নিশ্চয়ই দোয়া শোনেন।
﴿رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ
الصَّلَاةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ﴾
৪০। হে আমার
রব আমাকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী করো এবং আমার বংশধরদের থেকেও (এমন লোকদের উঠাও যারা
এ কাজ করবে)। পরওয়ারদিগার! আমার দোয়া কবুল করো
﴿رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ
وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ﴾
৪১। হে পরওয়াদিগার!
যেদিন হিসেব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ
করে দিয়ো।”৫৩
৫৩. হযরত ইবরাহীম আ. স্বদেশ ভূমি থেকে বের হবার সময় سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي (অর্থাৎ "আমি তোমার জন্য আমার রবের কাছে
দোয়া করবো।"-তাওবাঃ ১১৪) বলে
নিজের বাপের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তারি ভিত্তিতে তিনি মাগফেরাতের দোয়ার মধ্যে
নিজের বাপকেও অন্তরভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন তিনি অনুভব করলেন যে,
তাঁর
বাপ তো আল্লাহর দুশমন ছিল তখন আবার সুস্পষ্টভবে এ থেকে নিজেকে আলাদা করে
নিয়েছিলেন।
﴿وَلَا
تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ ۚ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ
لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ﴾
৪২। এখন এ
জালেমরা যা কিছু করছে আল্লাহকে তোমরা তা থেকে গাফেল মনে করো না। আল্লাহ তো
তাদেরকে সময় দিচ্ছেন সেই দিন পর্যন্ত যখন তাদের চক্ষু বিস্ফরিত হয়ে যাবে,
﴿مُهْطِعِينَ مُقْنِعِي رُءُوسِهِمْ
لَا يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ ۖ وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَاءٌ﴾
৪৩। তারা মাথা
তুলে পালাতে থাকবে, দৃষ্টি
ওপরের দিকে স্থির হয়ে থাকবে ৫৪৫৪ এবং মন উড়তে থাকবে।
৫৪. অর্থাৎ কিয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্য তাদের সামনে হবে। বিষ্ফারিত দৃষ্টিতে তারা তা দেখতে থাকবে যেন
তাদের চোখের মনি স্থির হয়ে গেছে, পলক পড়ছে না। ঠায় এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকবে।
﴿وَأَنذِرِ
النَّاسَ يَوْمَ يَأْتِيهِمُ الْعَذَابُ فَيَقُولُ الَّذِينَ ظَلَمُوا رَبَّنَا أَخِّرْنَا
إِلَىٰ أَجَلٍ قَرِيبٍ نُّجِبْ دَعْوَتَكَ وَنَتَّبِعِ الرُّسُلَ ۗ أَوَلَمْ تَكُونُوا
أَقْسَمْتُم مِّن قَبْلُ مَا لَكُم مِّن زَوَالٍ﴾
৪৪। হে
মুহাম্মদ! সেই দিন সম্পর্কে এদেরকে সতর্ক করো, যে দিন আযাব এসে এদেরকে ধরবে। সে সময় এ
জালেমরা বলবে, “হে আমাদের
রব! আমাদের একটুখানি অবকাশ দাও, আমরা তোমার ডাকে সাড়া দেবো এবং রাসূলদের
অনুসরণ করবো।” (কিন্তু তাদেরকে পরিষ্কার জবাব দেয়া হবেঃ
“তোমরা কি তারা নও যারা ইতিপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতো, আমাদের কখনো পতন হবে না?”
﴿وَسَكَنتُمْ فِي مَسَاكِنِ
الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ وَتَبَيَّنَ لَكُمْ كَيْفَ فَعَلْنَا بِهِمْ وَضَرَبْنَا
لَكُمُ الْأَمْثَالَ﴾
৪৫। অথচ তোমরা
সেই সব জাতির আবাস ভূমীতে বসবাস করেছিলে যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল এবং আমি
তাদের সাথে কি ব্যবহার করেছি তা দেখেও ছিলে আর তাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে দিয়ে আমি
তোমাদের বুঝিয়েও ছিলাম।
﴿وَقَدْ مَكَرُوا مَكْرَهُمْ
وَعِندَ اللَّهِ مَكْرُهُمْ وَإِن كَانَ مَكْرُهُمْ لِتَزُولَ مِنْهُ الْجِبَالُ﴾
৪৬। তারা
তাদের সব রকমের চক্রান্ত করে দেখেছে কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি চক্রান্তের জবাব
আল্লাহর কাছে ছিল, যদিও তাদের
চক্রান্তগুলো এমন পর্যায়ের ছিল যাতে পাহাড় টলে যেতো।৫৫
৫৫. অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো আল্লাহর আইনের
বিরুদ্ধাচরণের পরিণাম থেকে নিষ্কৃতি লাভের এবং নবীগণের দাওয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য
কেমন সব শক্তিশালী কৌশল অবলম্বন করেছিল তোমরা তাও দেখেছো। আবার আল্লাহর একটি মাত্র কৌশলের কাছে তারা কিভাবে পরাজয়
বরণ করে নিয়েছিল। তাও দেখেছো। কিন্তু তবুও তোমরা হকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত
করা থেকে বিরত থাকছো না এবং তোমরা মনে করে আসছো তোমাদের চক্রান্ত নিশ্চয়ই সফল
হবে।
﴿فَلَا
تَحْسَبَنَّ اللَّهَ مُخْلِفَ وَعْدِهِ رُسُلَهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ ذُو انتِقَامٍ﴾
৪৭। কাজেই হে
নবী! কখখনো এ ধারণা করো না যে, আল্লাহ তাঁর নবীদের প্রতি প্রদত্ত ওয়াদার
বিরুদ্ধাচরণ করবেন।৫৬ আল্লাহ প্রতাপান্বিত ও
প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
৫৬. এ বাক্যে আপাত দৃষ্টে নবী সা. কে লক্ষ করে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর বিরোধীদেরকে
শুনানো। তাদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ
পূর্বেই তাঁর রসূলেদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা পূর্ণ করেছন এবং তাদের
বিরোধীদের কে লাঞ্ছিত করেছেন। আর এখনও নিজের রাসূল মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে তিনি যে ওয়াদা করছেন তা পূর্ণ
করবেন এবং যারা এর বিরোধিতা করছে তাদেরকে বিধ্বস্ত করে দেবেন।
﴿يَوْمَ
تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ ۖ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ
الْقَهَّارِ﴾
৪৮। তাদেরকে
সেই দিনের ভয় দেখাও যেদিন পৃথিবী ও আকাশকে পরিবর্তিত করে অন্য রকম করে দেয়া হবে৫৭ এবং সবাই এক মহাপরাক্রমশালী
আল্লাহর সমানে উন্মুক্ত হয়ে হাযির হবে।
৫৭. এ আয়াত এবং কুরআনের অন্যান্য বিভিন্ন ইশারা থেকে জানা যায়
কিয়ামতের সময় পৃথিবী ও আকাশ সম্পূর্ণ ধবংস হয়ে যাবে না। বরং শুধুমাত্র বর্তমান প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ওলট পালট করে
দেয়া হবে। এর পর প্রথম শিংগা ধ্বনি ও
শেষ শিংগা ধ্বনির মাঝখানে একটি বিশেষ সময়কালের মধ্যে-যা একমাত্র আল্লাহই
জানেন-পৃথিবী ও আকাশের বর্তমান কাঠামো বদলে দেয়া হবে এবং ভিন্ন একটি প্রাকৃতিক
অবকাঠামো ভিন্ন একটি প্রাকৃতিক আইনসহ তৈরী করা হবে। সেটিই হবে পরলোক। তারপর শেষ শিংগাধ্বনির সাথে সাথেই আদমের সৃষ্টির পর থেকে
কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ জন্ম নিয়েছিল তাদের সবাইকে পুনর্বার জীবিত করা হবে এবং
তারা আল্লাহর সামনে উপস্থাপিত হবে। কুরাআনের ভাষায় এরি নাম হাশর। এর শাব্দিক অর্থ এক জায়গায় জমা ও একত্র করা। কুরআনের ইশারা ইংগিত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে
প্রমাণ হয় যে পৃথিবীর এ সরযমীনেই হাশর অনুষ্ঠিত হবে, এখানেই
আদালত কায়েম হবে, এখানেই মীযান তথা তুলাদণ্ড বসানো হবে এবং
পৃথিবীর বিষয়াবলী পৃথিবীর মাটিতেই চুকিয়ে দেয়া হবে। তাছাড়া কুরআন ও হাদীস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, আমাদের
সেই দ্বিতীয় জীবনটি-যেখানে এসব ব্যাপার সংঘটিতে হবে নিছক আত্মিক জীবন হবে না। বরং আজ আমরা যেভাবে দেহ ও আত্মা সহকারে জীবিত
আছি সেখানেও আমাদের তেমনিভাবে জীবিত করা হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যে ব্যক্তিসত্তা সহকারে দুনিয়া থেকে
বিদায় নিয়েছিল সেখানে ঠিক সেই একই ব্যক্তিসত্তা সহকারে উপস্থিত হবে।
﴿وَتَرَى
الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُّقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ﴾
৪৯। সেদিন
তোমরা অপরাধীদের দেখবে, শিকলে তাদের হাত পা বাঁধা,
﴿سَرَابِيلُهُم مِّن قَطِرَانٍ
وَتَغْشَىٰ وُجُوهَهُمُ النَّارُ﴾
৫০। আলকাতরার৫৮ পোশাক পরে থাকবে এবং আগুনের
শিখা তাদের চেহারা ডেলে ফেলতে থাকবে।
৫৮. কোন কোন অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতা قَطِرَانٍ শব্দের অর্থ করেছেন গন্ধক আবার কেউ কেউ করেছেন গলিত তামা। কিন্তু আসলে আরবী ভাষায় "কাতেরান"
শব্দটি আলকাতরা, গালা ইত্যাদির প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
﴿لِيَجْزِيَ
اللَّهُ كُلَّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
৫১। এটা এ
জন্য হবে যে, আল্লাহ
প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের বদলা দেবেন। হিসেব
নিতে আল্লাহর একটুও দেরী হয় না।
﴿هَٰذَا بَلَاغٌ لِّلنَّاسِ
وَلِيُنذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ وَلِيَذَّكَّرَ أُولُو
الْأَلْبَابِ﴾
৫২। এটি একটি পয়গাম সব মানুষের
জন্য এবং এটি পাঠানো হয়েছে এ জন্য যাতে এর মাধ্যমে তাদেরকে সতর্ক করা যায় এবং তারা
জেনে নেয় যে, আসলে আল্লাহ মাত্র একজনই আর
যারা বুদ্ধি-বিবেচনা রাখে তারা সচেতন হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।