০২৮. সূরা আল কাসাস
আয়াতঃ ৮৮; রুকুঃ ০৯; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
২৫ আয়াতের وَقَصَّ
عَلَيْهِ الْقَصَصَ বাক্যংশ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ যে সূরায় الْقَصَصَ শব্দটি
এসেছে। আভিধানিক অর্থে কাসাস বলতে
ধারাবাহিকভাবে ঘটনা বর্ণনা করা বুঝায়। এ দিক দিয়ে এ শব্দটি অর্থের দিক দিয়েও এ সূরার শিরোনাম হতে পারে। কারণ এর মধ্যে হযরত মূসার কাহিনী
বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
নাযিলের হওয়ার সময়-কালঃ
সূরা নামলের ভূমিকায় আমি ইবনে আব্বাস রা. ও জাবের ইবনে যায়েদের রা. একটি উক্তি
উদ্ধৃত করে এসেছি। তাতে বলা হয়েছিল, সুরা
শু’আরা, সুরা নামল ও সূরা কাসাস একের পর এক নাযিল হয়। ভাষা,
বর্ণনাভংগী
ও বিষয়বস্তু থেকেও একথাই অনুভূত হয় যে,
এ
তিনটি সূরা প্রায় একই সময় নাযিল হয়। আবার এদিক দিয়েও এদের মধ্যে নিকটতম সম্পর্ক রয়েছে যে, এ
সূরাগুলোতে হযরত মূসা আ. এর কাহিনীর যে বিভিন্ন অংশ বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো
পরস্পর মিলিত আকারে একটি পূর্ণ কাহিনীতে পরিণত হয়ে যায়। সূরা শু’আরায় নবুওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে
অক্ষমতা প্রকাশ করে হযরত মূসা বলেনঃ “ফেরাউনী জাতির বিরুদ্ধে একটি অপরাধের জন্য
আমি দায়ী। এ কারণে আমার ভয় হচ্ছে, সেখানে
গেলেই তারা আমাকে হত্যা করে ফেলবে।” তারপর হযরত মূসা যখন ফেরাউনের কাছে যান তখন সে বলেঃ “আমরা কি তোমাকে আমাদের
এখানে ছোট্ট শিশুটি থাকা অবস্থায় লালন পালন করিনি? এবং
তুমি আমাদের এখানে কয়েক বছর থাকার পর যা করে গেছো তাতো করেছই।” এ দু’টি কথার কোন বিস্তারিত বর্ণনা সেখানে নেই। এ সূরায় তার বিস্তারিত বিবরণ এসে গেছে। অনুরূপভাবে সূরা নামলে এ কাহিনী সহসা একথার
মাধ্যমে শুরু হচ্ছে যে, হযরত মূসা তাঁর পরিবার পরিজনদের নিয়ে যাচ্ছিলেন
এমন সময় হঠাৎ তিনি একটি আগুন দেখলেন। এটা কোন ধরনের সফর ছিল, তিনি কোথায় থেকে আসছিলেন এবং
কোথায় যাচ্ছিলেন এর কোন বিবরণ সেখানে নেই। এর বিস্তারিত বিবরণ এ সূরায় পাওয়া যায়। এভাবেএ তিনটি সূরা মিলে হযরত মূসা আ. এর
কাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেছে।
বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়ঃ
এর বিষয়বস্তু হচ্ছে, নবী সা.এর রিসালাতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ ও
আপত্তি উত্থাপন করা হচ্ছিল সেগুলো দূর করা এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে যেসব
ওজুহাত পেশ করা হচ্ছিল সেগুলো নাকচ করে দেয়া।
এ উদ্দেশ্যে প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে হযরত মূসার কাহিনী”। সুরা নাযিলের সময়কালীন অবস্থা সাথে মিলে এ কাহিনী
স্বতষ্ফূর্তভাবেই শ্রোতার মনে কতিপয় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ঃ
একঃ আল্লাহ যা কিছু করতে চান সে জন্য তিনি সবার অলক্ষ্যে
কার্যকারণ ও উপায়-উপরকণ সংগ্রহ করে দেন। যে শিশুর হাতে শেষ পর্যন্ত ফেরাউনের রাজরত্বের অবসান ঘটবার
কথা, তাকে আল্লাহ স্বয়ং ফেরাউনের গৃহে তার নিজের হাতেই
প্রতিপালনের ব্যবস্থা করেন এবং ফেরাউন জানতে পারেনি সে কাকে প্রতিতপালন করছেন। সেই আল্লাহর ইচ্ছার সাথে কে লড়াই করতে পারে
এবং তাঁর মোকাবিলায় কার কৌশল সফল হতে পারে।
দুইঃ কোন বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে
কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার মাধ্যমে কাউকে এ নবুওয়াত দান করা হয় না। তোমরা অবাক ইচ্ছো, মুহাম্মাদ
সা. কোথা থেকে চুপিচুপি এ নবুওয়াত লাভ করেন এবং ঘরে বসে বসে তিনি কেমন করে নবী হয়ে
গেলেন। কিন্তু তোমরা নিজেরাই যে
মুসা আ. এর বরাত দিয়ে থাকে যে, لَوْلَا أُوتِيَ مِثْلَ مَا أُوتِيَ مُوسَىٰ (৪৮ আয়াত) তিনিও
এভাবে পথে চলার সময় নবুওয়াত লাভ করেছিলেন এবং সেদিন সিনাই পাহাড়ের নিঝুম উপত্যকায়
কি ঘটনা ঘটে গেলো তা ঘূণাক্ষরেও কেউ জানতে পারলো না। মূসা নিজেও এক সেকেণ্ড আগে জানতেন না তিনি কি জিনিস পেতে
যাচ্ছেন। যাচ্ছিলেন আগুন আনতে, পেয়ে
গেলেন পয়গম্বরী।
তিনঃ যে বান্দার সাহায্যে আল্লাহ কোন কাজ নিতে চান, কোন
দলবল-সেনাবাহিনী ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই তার উত্থান ঘটে থাকে। কেউ তাঁর সাহায্যকারী হয় না। বাহ্যত তার কাছে কোন শক্তির বহর থাকে না। কিন্তু বড় বড় দলবল, সেনাবাহিনী
ও সাজ-সরঞ্জাম ওয়ালারা শেষ পর্যন্ত তার মোকাবিলায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যায়। তোমরা আজ তোমাদের ও মুহাম্মাদ সা.এর মধ্যে যে
আনুপাতিক পার্থক্য দেখতে পাচ্ছো তার চেয়ে অনেক বেশী পার্থক্য ছিল মূসা আ. ও
ফেরাউনের শক্তির মধ্যে।
কিন্তু দেখে নাও কে জিতলো এবং কে হারলো।
চারঃ তোমরা বার বার মূসার বরাত দিয়ে থাকো। তোমরা বলে থাকো,
মূসাকে
যা দেয়া হয়েছিল তা মুহাম্মাদকে দেয়া হলো না কেন? অর্থাৎ লাঠি, সাদা হাত ও অন্যান্য
প্রকাশ্য মু’জিযা সমূহ।
ভাবখানা এ রকম যেন তোমরা ঈমান আনার জন্য তৈরী হয়েই বসে আছো, এখন
শুধু তোমাদেরকে সেই মু’জিযাগুলো দেখাতে হবে যা মূসা ফেরাউনকে দেখিয়েছিলেন। তোমর তার অপেক্ষায় রয়েছো। কিন্তু যাদেরকে এসব মু’জিয়া দেখানো হয়েছিল তারা কি করেছিল
তা কি তোমরা জানো? তারা এগুলো দেখেও ঈমান আনেনি। তারা নির্দ্বিধায় বলেছিল, এসব
জাদু। কারণ তারা সত্যের বিরুদ্ধে
বিদ্বেষ ও হঠকারিতায় লিপ্ত হয়েছিল। এই একই রোগে আজ তোমরাও ভুগছো। তোমরা কি ঐ ধরনের মু’জিযা দেখে ঈমান আনবে?
তারপর
তোমরা কি এ খবরও রাখো, যারা ঐ মু’জিযা দেখে সত্যকে অস্বীকার করেছিল
তাদের পরিণাম কি হয়েছিল? শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে
দিয়েছিলেন। এখন তোমরাও কি একই প্রকার
হঠকারিতা সহকারে মু’জিযা দাবী জানিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনতে চাচ্ছো?
মক্কার কুফরী ভারাক্রান্ত পরিবেশে যে ব্যক্তি হযরত মূসার এ কাহিনী শুনতো তার মনে
কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আপনা আপনিই একথাগুলো বদ্ধমূল হয়ে যেতো। কারণ সেসময় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া
সাল্লাম ও মক্কার কাফেরদের মধ্যে ঠিক তেমনি ধরনের একটি দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল যেমন
ইতিপূর্বে চলেছিল ফেরাউন ও হযরত মূসা আ. এর মধ্যে। এ অবস্থায় এ কাহিনী শুনাবার অর্থ ছিল এই যে, এর
প্রত্যেকটি অংশ সম সাময়িক অবস্থার ওপর আপনা আপনি প্রযুক্ত হয়ে যেতে থাকবে। যদি এমন একটি কথাও না বলা হয়ে থাকে যার
মাধ্যমে কাহিনীর কোন অংশটি সে সময়ের কোন অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল তা জানা যায়, তাহলেও
তাতে কিছু এসে যায় না।
এরপর পঞ্চম রুকু’ থেকে মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা শুরু হয়েছে। মুহাম্মাদ সা. উম্মী তথা নিরক্ষর হওয়া
সত্ত্বেও দু’হাজার বছর আগের ঐতিহাসিক ঘটনা একেবারে হুবহু শুনিয়ে যাচ্ছেন, অথচ
তাঁর শহর ও তাঁর বংশের লোকেরা ভালোভাবেই জানতো,
তাঁর
কাছে এসব তথ্য সংগ্রত করার জন্য উপযুক্ত কোন উপায় উপকরণ ছিল না। প্রথমে এ বিষয়টিকে তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ
হিসেবে গণ্য করা হয়।
তারপর তাঁকে নবুওয়াত দান করার ব্যাপারটিকে তাদের পক্ষে আল্লাহর রহমত হিসেবে
গণ্য করা হয়। কারণ তারা গাফিলতির মধ্যে
ডুবে গিয়েছিল এবং আল্লাহ তাদের সৎপথ দেখাবার জন্য এ ব্যবস্থা করেন।
তারপর তারা বারবার “এই নবী এমন সব মু’জিযা আনছেন না কেন? যা
ইতিপূর্বে মূসা এনেছিলেন।” এ
মর্মে যে অভিযোগ করছিল তার জবাব দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়,
মূসার
ব্যাপারে তোমরা স্বীকার করছো যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে
মু’জিযা এনেছিলেন। কিন্তু তাঁকেই বা তোমরা কবে
মেনে নিয়েছিলে? তাহলে এখন এ নবীর মু’জিযার দাবী করছো কেন? তোমরা
যদি প্রবৃত্তির কামনা বাসনার দাসত্ব না করো,
তাহলে
সত্য এখনো তোমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে পারে। কিন্তু তোমরা যদি এ রোগে ভূগতে থাকো, তাহলে
যে কোন মু’জিযা আসুক না কেন তোমাদের চোখ খুলবে না।
তারপর সে সময়কার একটি ঘটনার ব্যাপারে মক্কার কাফেরদেরকে শিক্ষা ও লজ্জা দেয়া
হয়েছে। ঘটনাটি ছিলঃ সে সময় বাহির
থেকে কিছু খৃষ্টান মক্কার আসেন এবং নবী সা.এর মুখে কুরআন শুনে ঈমান আনেন। কিন্তু মক্কার লোকেরা নিজেদের গৃহের এ নিয়ামত
থেকে লাভবান তো হলোই না।
উপরন্তু আবু জেহেল প্রকাশ্যে তাদেরকে লাঞ্ছিত করে।
সবশেষে মক্কার কাফেররা নবী সা.এর কথা না মানার জন্য তাদের পক্ষ থেকে যে আসল
ওযর পেশ করতো সে প্রসংগ আলোচিত হয়েছে। তারা বলতো, যদি আরববাসীদের প্রচলিত পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ
করে আমরা এ নতুন তাওহীদী ধর্ম গ্রহণ করি,
তাহলে
সহসাই এদেশ থেকে আমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে।
তখন আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছুবে যার ফলে আমরা আরবের সবচেয়ে বেশী
প্রভাবশালী গোত্রের মর্যাদা হারিয়ে বসবো এবং এ ভূ-খণ্ডে আমাদের জন্য কোন
আশ্রয়স্থলও থাকবে না।
এটিই ছিল কুরাইশ সরদারদের সত্য বৈরিতার মূল উদ্যোক্তা। অন্যান্য সমস্ত সন্দেহ,
অভিযোগ, আপত্তি
ছিল নিছক বাহানাবাজী।
জনগণকে প্রতারিত করার জন্য তারা সেগুলো সময়মতো তৈরী করে নিতো। তাই আল্লাহ সূরার শেষ পর্যন্ত এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা
করেছেন এবং এক একটি দিকের ওপর আলোকপাত করে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এমন সমস্ত
মৌলিক রোগের চিকিৎসা করেছেন যেগুলোর কারণে তারা পার্থিব ও বৈষয়িক স্বার্থের
দৃষ্টিতে সত্য ও মিথ্যার ফায়সালা করতো।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
﴿طسم﴾
﴿تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ
الْمُبِينِ﴾
২) এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।
﴿نَتْلُو عَلَيْكَ مِن نَّبَإِ
مُوسَىٰ وَفِرْعَوْنَ بِالْحَقِّ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
৩) আমি মূসা ও ফেরাউনের কিছু যথাযথ
বৃত্তান্ত তোমাকে শুনাচ্ছি১ এমনসব
লোকদের সুবিধার্থে যারা ঈমান আনে।২
১. তুলনামূলক অধ্যায়নের জন্য দেখুন আল বাকারাহ ৬ রুকূ', আল'আরাফ
১৩-১৬ রুকূ', ইউনুস ৮-৯ রুকূ', হূদ ৯
রুকূ', বনী ইসরাঈল ১২ রুকূ', মারয়াম ৪
রুকূ', তা-হা ১-৪ রুকূ', আল মু'মিনুন ৩ রুকূ', আশ্ শু'আরা ২-৪
রুকূ', আন নামল ১ রুকূ', আল আনকাবুত ৪
রুকূ', আল মুমিন ৩-৫ রুকূ', আয্ যুখরুফ
৫ রুকূ', আদ্ দুখান ১ রুকূ', আয্
যারিয়াত ২ রুকূ', এবং আন্-নাযি'আত ১
রুকূ'।
২. অর্থাৎ যারা কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয় তাদেরকে কথা শুনানো
তো অর্থহীন। তবে যারা মনের দুয়ারে
একগুঁয়েমীর তালা ঝুলিয়ে রাখে না। এ আলোচনায় তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে।
﴿إِنَّ
فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً
مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ ۚ إِنَّهُ كَانَ مِنَ
الْمُفْسِدِينَ﴾
৪) প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ফেরাউন পৃথিবীতে বিদ্রোহ করে৩ এবং তার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন
দলে বিভক্ত করে দেয়।৪ তাদের মধ্য
থেকে একটি দলকে সে লাঞ্ছিত করতো,তাদের ছেলেদের হত্যা করতো এবং মেয়েদের
জীবিত রাখতো।৫ আসলে সে
বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৩. মূলে عَلَا فِي الْأَرْضِ শব্দাবলী
ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সে পৃথিবীতে মাথা উঠিয়েছে,
বিদ্রোহাত্মক নীতি অবলম্বন করেছে, নিজের আসল
মর্যাদা অর্থাৎ দাসত্বের স্থান থেকে উঠে স্বেচ্ছাচারী ও প্রভুর রূপ ধারণ করেছে,
অধীন হয়ে থাকার পরিবর্তে প্রবল হয়ে গেছে এবং স্বৈরাচারী ও অহংকারী
হয়ে জুলুম করতে শুরু করেছে।
৪. অর্থাৎ তার রাজ্য শাসনের নীতি অনুযায়ী আইনের চোখে দেশের
সকল অধিবাসী সমান থাকেনি এবং সবাইকে সমান অধিকারও দেয়া হয়নি। বরং সে সভ্যতা-সংস্কৃতি ও রাজনীতির এমন পদ্ধতি অবলম্বন
করেছে যার মাধ্যমে রাজ্যের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়া হয়। একদলকে সুযোগ সুবিধা ও বিশেষ অধিকার দিয়ে শাসক
দলে পরিণত করা হয় এবং অন্যদলকে অধীন করে পদানত, পর্যুদস্ত, নিষ্পেষিত
ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়।
এখানে কারো এ ধরনের সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, ইসলামী রাষ্ট্রেও তো মুসলিম ও
জিম্মীর মধ্যে ফারাক করা হয় এবং তাদের অধিকার ও ক্ষমতাও সকল দিক দিয়ে সমান রাখা
হয়নি। এ সন্দেহ এজন্য সঠিক নয় যে, ফেরাউনী বিধানে যেমন বংশ,
বর্ণ, ভাষা বা শ্রেণীগত বিভেদের উপর বৈষম্যের
ভিত্ রাখা হয়েছে ইসলামী বিধানে ঠিক তেমনটি নয়। বরং ইসলামী বিধানে নীতি ও মতবাদের উপর এর ভিত রাখা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জিম্মী ও মুসলমানের
মধ্যে আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে মোটেই কোন ফারাক নেই ।সকল পার্থক্য একমাত্র রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে। আর এ পার্থক্যের কারণ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, একটি আদর্শিক রাষ্ট্রে শাসকদল
একমাত্র তারাই হতে পারে যারা হবে রাষ্ট্রের মূলনীতির সমর্থক। এ দলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি শামিল হতে পারে যে
এ মূলনীতি মেনে মেবে না। এ
পার্থক্য ও ফেরাউনী ধরনের পার্থক্যের মধ্যে কোন মিল নেই। কারণ, ফেরাউনী পার্থক্যের ভিত্তিতে পরাধীন প্রজন্মের কোন ব্যক্তি
কখনো শাসক দলে শামিল হতে পারে না। সেখানে পরাধীন প্রজন্মের লোকেরা রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার
তো দূরের কথা মৌলিক মানবিক অধিকারও লাভ করে না। এমনকি জীবিত থাকার অধিকারও তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেখানে কখনো পরাধীনদের জন্য কোন অধিকারের
জামানত দেয়া হয় না। সব ধরনের স্বার্থ, মুনাফা, সুযোগ-সুবিধা
ও মর্যাদা একমাত্র শাসক সমাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে এবং এ বিশেষ অধিকার একমাত্র
জাতির মধ্যে জন্মলাভকারী ব্যক্তিই লাভ করে।
৫. বাইবেলে এর নিম্নরুপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়ঃ পরে মিশরের
উপরে এক নতুন রাজা উঠিলেন, তিনি যোসেফকে জানিতেন না। তিনি আপন প্রজাদিগকে কহিলেন দেখ, আমাদের অপেক্ষা ঈসরায়েল
সন্তানদের জাতি বহু সংখ্যক ও বলবান। আইস, আমরা তাহাদের সহিত বিবেচনা পূর্বক ব্যবহার করি। পাছে তাহারা বাড়িয়া উঠে এবং যুদ্ধ উপস্থিত
হইলে তাহারাও শত্রুপক্ষে যেগ দিয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করে এবং এদেশ হইতে প্রস্থান
করে। অতএব তাহারা ভার বহন দ্বারা
উহাদিগকে দুঃখ দিবার জন্য উহাদের উপরে কার্য শাসকদিগকে নিযুক্ত করিল। আর উহারা ফরৌনের নিমিত্ত ভান্ডারের নগর পিথোম
ও রামিষেষ গাথিল। কিন্তু উহারা তাহাদের
দ্বারা যত দুঃখ পাইল ততই বৃদ্ধি পাইতে ও ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তাই ইস্রায়েল সন্তানদের বিষয়ে তাহারা অতিশয় উদ্বিগ্ন হইল। আর মিসরিয়রা নির্দয়তাপূর্বক ইস্রায়েল
সন্তানদিগকে দাস্যকর্ম করাইল। তাহারা কর্দম, ইস্টক ও ক্ষেত্রের সমস্ত কার্যে কঠিন দাস্যকর্ম দ্বারা উহাদের প্রাণ তিক্ত
করিতে লাগিল। তাহারা
উহাদের দ্বারা যে দাস্যকর্ম করাইত সে সমস্ত নির্দয়তাপূর্বক করাইত। পরে মিশরের রাজা শিফ্রা ও পুয়া নামে দুই
ইব্রিয়া ধাত্রিকে একথা কহিলেন, যে সময়ে তোমরা ইব্রীয় স্ত্রীলোকদেরকে ধাত্রী কার্য করিবে ও
তাহাদিগকে প্রসব আধারে দেখিবে, যদি পুত্র সন্তান হয়, তাহাকে বধ করিবে; আর যদি কন্যা সন্তান হয়, তাহাকে জীবিত রাখিবে। (যাত্রাপুস্তক ১:৮-১৬)
এ থেকে জানা যায়, হযরত ইউসূফ আ. এর যুগ অতিক্রান্ত হবার পর মিসরে একটি জাতীয়তাবাদী বিপ্লব
সাধিত হয়েছিল এবং কিবতীদের হাতে যখন পূণর্বার শাসন ক্ষমতা এসেছিল তখন নতুন
জাতীয়তাবাদী সরকার বনী ঈসরাইলের শক্তি নির্মূল করার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এ ব্যাপারে শুধুমাত্র বনী ঈসরাঈলকে লাঞ্ছিত ও
পদদলিত এবং তাদেরকে নিকৃষ্ট ধরণের সেবাকর্ম নির্দিষ্ট করেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি বরং
এ থেকে আরো অগ্রসর হয়ে তাদের ছেলেদের হত্যা করে মেয়েদের জীবিত রাখার নীতি অবলম্বন
করা হয়, যাতে করে তাদের মেয়েরা ধীরে ধীরে কিবতীদের অধীনে এসে যেতে থাকে এবং তাদের
থেকে ইসরাঈলের পরিবর্তে কিবতীদের বংশ বিস্তার লাভ করে। তালমূদ এর আরো বিস্তারিত বিবরণ এভাবে দিয়েছে যে, হযরত ইউসূফ আ. এর ইন্তিকালের
সময় থেকে একশতকের কিছু বেশি সময় অতিক্রান্ত হবার পর থেকে এ বিপ্লব আসে। সেখানে বলা হয়েছে, নতুন জাতীয়তাবদী সরকার প্রথমে
বনী ইসরাঈলকে তাদের উর্বর কৃষিক্ষেত্র, বাসগৃহ ও সম্পত্তি
থেকে বঞ্চিত করে।
তারপর তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদ থেকে বেদখল করে দেয়। এরপরও যখন কিবতী শাসকরা অনুভব করে যে, বনী ইসরাঈল ও তাদের সমধর্মবলম্বী
মিশরীয়রা যথেষ্ট প্রভাবশালী তখন তারা ইসরাঈলীদেরকে লাঞ্ছিত ও হীনবল করতে থাকে এবং
তাদের থেকে কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য পারিশ্রমিক বা বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ
আদায় করতে থাকে।
কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, "তারা মিসরের অধিবাসীদের একটি গোষ্ঠিকে লাঞ্ছিত ও হীনবল
করতো" এ বক্তব্য সেই উক্তির ব্যাখ্যা বিবেচিত হতে পারে। আর সূরা আল বাকারায় আল্লাহ যে বলেছেন, েফরাউনের বংশধররা বনী
ইসরাঈলদের কঠোর শাস্তি দিতো। يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ এরও ব্যাখা এটিই।
কিন্তু বাইবেল ও কোরআনে এ ধরনের কোন আলোচনা নেই যাতে বলা হয়েছে যে, কোন জোতিষী ফেরাউনকে বলেছিল,
বনী ইসরাঈলে একটি শিশু জন্ম নেবে, তার হাতে
ফেরাউনী কর্তৃত্বের মৃত্যু ঘটবে এবং এ বিপদের পথ রোধ করার জন্য ফেরাউন ইসরাঈলীদের
পুত্র সন্তানদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। অথবা ফেরাউন কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিল এবং তার তা'বীর এভাবে দেয়া হয়েছিল যে,
বনী ইসরাঈলের মধ্যে এ ধরণের বিশেষ গুণ বিশিষ্ট শিশু জন্ম নেবে। তালমূদ ও অন্যান্য ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে এ
কাহিনী আমাদের মুফাসসিরগণ উদ্বৃত করেছেন। (দেখুন জুয়িশ ইনসাইক্লোপেডিয়া, নিবন্ধ "মুসা এবং The
Talmud selections. P.123-24)
﴿وَنُرِيدُ
أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً
وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ﴾
৫) আমি সংকল্প করেছিলাম, যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্ছিত করে
রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো,তাদেরকে নেতৃত্ব দান করবো,(৬ তাদেরকেই
উত্তরাধিকারী করবো৭
৬. অর্থাৎ তাদেরকে দুনিয়ায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দান করবো।
৭. অর্থাৎ তাদেরকে পৃথিবীর উত্তরাধিকার দান করবো এবঙ তারা হবে
রাস্ট্র পরিচালক ও শাসনকর্তা।
﴿وَنُمَكِّنَ
لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُم مَّا
كَانُوا يَحْذَرُونَ﴾
৬) পৃথিবীতে তাদেরকে কর্তৃত্ব দান করবো। এবং তাদের
থেকে ফেরাউন, হামান৮ ও তার সৈন্যদেরকে সে সবকিছুই
দেখিয়ে দেবো, যার আশংকা
তারা করতো।
৮. পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা এ বিষয়টি নিয়ে বেশ ঠাট্টা বিদ্রুপ
করেছেন যে, হামান তো ছিল ইরানের বাদশা আখসোবিরাস অর্থাৎ খাশিয়ারশার দরবারের একজন
আমীর। আর এ বাদশাহর আমল হযরত
মুসার শত শত বছর পরে খৃ: পূ: ৪৮৬ ও ৪৬৫ সালে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোরআন তাকে মিসরে নিয়ে গিয়ে ফিরাউনের মন্ত্রী
বানিয়ে দিয়েছে। তাদের বিবেক বুদ্ধি যদি
বিদ্বেষের আবরণে আচ্ছাদিত না থাকতো তাহলে তারা নিজেরাই এ বিষয়টি ভেবে দেখতো। আখসোবিরাসের সভাসদ হামানের পূর্বে দুনিয়ায় এ
নামে আর কোন ব্যক্তি কোথাও ছিল কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলার মত তাদের কাছে
কি এমন ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে? যে ফেরাউনের আলোচনা এখানে হচ্ছে যদি তার সমস্ত মন্ত্রী,
আমীর-ওমরা ও সভাসদদের কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা একেবারে নির্ভরযোগ্য
সূত্রে কোন প্রাচ্যবিদ পেয়ে গিয়ে থাকেন, যাতে হামানের নাম
নেই, তাহলে তিনি তা লুকিয়ে রেখেছেন কেন? এখনই তার ফটোকপি ছাপিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ কোরআনকে মিথ্যা প্রমাণিত করার এর চেয়ে আর বড়
প্রভাবশালী অস্ত্র তিনি আর পাবেন না।
﴿وَأَوْحَيْنَا
إِلَىٰ أُمِّ مُوسَىٰ أَنْ أَرْضِعِيهِ ۖ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيهِ فِي
الْيَمِّ وَلَا تَخَافِي وَلَا تَحْزَنِي ۖ إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ
مِنَ الْمُرْسَلِينَ﴾
৭) আমি৯ মূসার মাকে ইশারা করলাম, "একে স্তন্যদান করো, তারপর যখন এর প্রাণের ভয় করবে
তখন একে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে এবং কোন ভয় ও দুঃখ করবে না, তাকে তোমারই কাছে ফিরিয়ে আনবো এবং তাকে
রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করবো।"১০
৯. মাঝখানে এ আলোচনা উহ্য রাখা হয়েছে যে, এ অবস্থায় এক ইসরাঈলী পরিবারে
একটি শিশুর জন্ম হয়, সারা দুনিয়ায় যাকে মূসা আ. বলে জানে। বাইবেল ও তালমুদের বর্ণনা অনুযায়ী এটি ছিল হযরত ইয়াকুবের
পুত্র লাভীর সন্তানদের মধ্যে কারোর পরিবার। ঐ গ্রন্থ দুটিতে হযরত মূসার পিতার নাম বলা হয়েছে ঈমরাম। কুরআন একেই ইমরান শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। মূসার আ. জন্মের পূর্বে তাদের আরো দুটি
সন্তান হয়েছিল। সবচেয়ে বড় মেয়েটির নাম ছিল
মার্য়াম। তার আলোচনা সামনের দিকে
আসছে। তার ছেআট ছিল হযরত হারুন আ.। সম্ভবত বনী ইসরাঈলদের মধ্যে কোন পুত্র সন্তান
জন্ম নিলে তাকে হত্যা করতে হবে-এই নির্দেশনামা জারী হবার পূর্বে হযরত হারুন আ. এর
জন্ম হয়েছিল। তাই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর এই আইন জারী হয় এবং তৃতীয় সন্তানের জন্ম
হয়।
১০. অর্থাৎ জন্মের সাথে সাথেই সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার হুকুম দেয়া
হয়নি। বরং বলা হয়, যতক্ষণ ভয়ের কারণ না থাকে
শিশুকে স্তন্য দান করতে থাক। যখন গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে গেছে বলে মনে হবে এবং আশংকা দেখা দেবে শিশুর আওযাজ
শুনে বা অন্য কোনভাবে শত্রুরা তার জন্মের কথা জানতে পারবে অথবা স্বয়ং বনী
ঈসরাঈলীদের নীচ ব্যাক্তি গোয়েন্দগিরী করবে, তখন নির্ভয়ে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে তাকে
সাগরে ভাসিয়ে দেবে। বাইবেলের বর্ণনা মতে জন্মের পর তিনমাস পর্যন্ত হযরত মূসার আ. এর মা তাকে
লুকিয়ে রাখেন। তালমুদ এর উপর আরো বাড়তি
খবর দিয়েছে যে, ফেরাউন সে সময় নারী গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছিল। তারা নিজেদের সাথে ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে ইসরাঈলী পরিবারে
যেতো এবং কোন না কোনভাবে তাদেরকে সেখানে কাদাঁতো। এর ফলে কোন ইসলাঈলী শিশু যদি সেখানে থাকত তবে শিশুর
কান্না শুনে সেও কাঁদতো। এই
নতুন ধরনের গোয়েন্দাগিরী হযরত মূসার মাকে পেরেশান করে দেয়। তিনি নিজ পুত্রের প্রাণ বাচাঁনোর জন্য জন্মের তিনমাস পরে
তাকে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেন। এ
পর্যন্ত এ দুটি গ্রন্থের বর্ণনা কুরআনের সাথে মিলে যায়। আর দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবার অবস্থাও তারা ঠিক একই ধরণের বর্ণনা
করেছে যা কুরআনে বলা হয়েছে। সূরা তা-হা এ বলা হয়েছে اقْذِفِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِفِيهِ فِي الْيَمِّ "শিশুকে
একটি সুন্দর সিন্দুকে রেখে দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও"। বাইবেল ও তালমূদ এরই সমর্থন করে। তাদের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত মূসার মাতা নলখাগড়ার একটি ঝুড়ি বানিয়ে
তার গায়ে তৈলাক্ত মাটি আর আলকাতরা লেপন করে তাদের পানি থেকে সংরক্ষিত করে। তারপর হযরত মূসাকে তারমধ্যে শায়িত করে নীলনদের
মধ্যে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, যা কোরআনে বণর্না করা হয়েছে
তার কোন উল্লেখ ইসরাঈলী বর্ণনাগুলোতে নেই। অর্থাৎ হযরত মূসার মাতা আল্লাহর ইশারায় এ কাজ করেছিলেন এবং
আল্লাহ এ ব্যাপারে পূর্বেই তাকে নিশ্চয়তা দান করেছিলেন যে, এভাবে কাজ করলে শুধু তোমার
পুত্রের প্রাণ রক্ষাই পাবে তাই নয় বরং আমি শিশুকে আবার তোমার কাছেই ফিরিয়ে আনবো
এবং তোমার এ শিশুকে ভবিষ্যতে রসুলের মর্যদাও দেয়া হবে।
﴿فَالْتَقَطَهُ
آلُ فِرْعَوْنَ لِيَكُونَ لَهُمْ عَدُوًّا وَحَزَنًا ۗ إِنَّ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ
وَجُنُودَهُمَا كَانُوا خَاطِئِينَ﴾
৮) শেষ পর্যন্ত ফেরাউনের পরিবারবর্গ তাকে
(দরিয়া থেকে) উঠিয়ে নিল,যাতে সে তাদের শত্রু এবং
তাদের দুঃখের কারণ হয়।১১ যথার্থই
ফেরাউন, হামান ও
তার সৈন্যরা (তাদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ) ছিল বড়ই অপরাধী।
১১. এটা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না বরং এ ছিল তাদের কাজের পরিণাম। যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল। তারা এমন এক শিশুকে উঠাচ্ছিল যার হাতে শেষ
পর্যন্ত তাদেরকে ধ্বংস হতে হবে।
﴿وَقَالَتِ
امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ ۖ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَىٰ أَن يَنفَعَنَا
أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
৯) ফেরাউনের স্ত্রী (তাকে) বললো, "এ শিশুটি আমার ও তোমার চোখ
জুড়িয়েছে। কাজেই একে হত্যা করো না, বিচিত্র কি সে আমাদের জন্য
উপকারী প্রমাণিত হতে পারে অথবা আমরা তাকে সন্তান
হিসেবেই গ্রহণ করতে পারি। "১২ আর তারা (এর পরিণাম) জানতো না।
১২. এ বর্ণনা থেকে বিষয়টির যে চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হচ্ছে
এই যে, সিন্দুক বা
ঝুড়ি নদীতে ভাসতে ভাসতে যখন ফেরাউনের প্রাসাদের কাছে চলে আসে তখন ফেরাউনের
চাকর-বাকররা তা ধরে ফেলে এবং উঠিয়ে নিয়ে বাদশাহ এবং বেগমের সামনে পেশ করে। সম্ভবত বাদশাহ এবং বেগম সে সময় নদীর কিনারে
ভ্রমণরত অবস্থায় ছিলেন এমন সময় ঝুড়িটি তাদের চোখে পড়ে এবং তাদের হুকুমে সেটিকে
নদী থেকে উঠানো হয়।
তার মধ্যে একটি শিশু রাখা আছে দেখে অতি সহজেই এ অনুমান করা যেত পারত যে, নিঃসন্দেহে এটি কোন ইসরাঈলীর
সন্তান হবে। কারণ ইসরাঈলী জনবসতির দিক
থেকে ঝুড়িটি আসছিল এবং সে সময় তাদের পুত্র সন্তানদেরকেই হত্যা করা হচ্ছিল। তাদের সম্পর্কেই ধারণা করা যেতে পারত যে, কেউ তাদের সন্তানকে লুকিয়ে
কিছুদিন লালন পালন করার পর এখন যখন দেখছে যে আর লুকানো যাবে না তখন এ আশায় নদীতে
ভাসিয়ে দিয়েছে যে, হয়তো সে প্রাণে বেঁচে যাবে এবং তাকে
উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে লালন পালন করা হবে। এ কারণে কিছু অতি বিশ্বস্ত গোলাম এ পরামর্শ দেয় যে, হুজুর একে এখনই হত্যা করুন। এতো কোন সাপেরই বাচ্চা। কিন্তু ফেরাইনের স্ত্রীতো ছিলেন একজন নারীই এবং নিঃসন্তান। তাছাড়া শিশুও ছিল বড়ই মিস্টি চেহারার। যেমন সূরা তা-হা-য় আল্লাহ নিজেই বলেছেন, وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي "আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালবাসা সঞ্চার করে দিয়েছিলাম"। অর্থাত আমি তোমাকে এমন প্রিয় দর্শন ও
মনোমুগ্ধকর চেহারা দান করেছিলাম যে, দর্শনকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমাকে আদর
করতো। তাই মহিলা আত্ম সম্বরণ করতে
পারেননি। তিনি বলে উঠলেন, একে হত্যা করো না বরং উঠিয়ে
নিয়ে প্রতিপালন করো। সে যখন আমাদের এখানে প্রতিপালিত হবে এবং আমরা তাকে নিজের পুত্র করে নেবো তখন
সে যে ইসরাঈলী সে কথা সে কেমন করে জানবে। সে নিজেকে ফেরাউন বংশেরই একজন মনে করবে এবং তার
যোগ্যতাগুলো বনী ইসরাঈলের পরিবর্তে আমাদের কাজে লাগবে।
বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা মতে যে ভদ্র শঞিলা হযরত মূসাকে লালন পালন করা ও
পুত্রে পরিণত করার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি ফেরাউনের স্ত্রী নন বরং তার কন্যা
ছিলেন। কিন্তু কোরআন পরিস্কার
ভাষায় তাকে বলছে, امرأة فرعون "ফেরাউনের স্ত্রী"। আর একথা সু-স্পষ্ট যে, শত শত বছর পরে মুখ ফুটে রটে
যাওয়ায় লোককাহিনীর তুলনায় সরাসরি আল্লাহর বর্ণিত ঘটনাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য হতে
পারে। অযথা ইসরাঈলী বর্ণনার সাথে
সামঞ্জস্য রাখার জন্য আরবী পরিভাষা ও প্রচলিত বাকরীতির বিরুদ্ধে امرأة فرعون এর অর্থ 'ফেরাউনী পরিবারের
মেয়ে"করার কোন কারণ দেখি না।
﴿وَأَصْبَحَ
فُؤَادُ أُمِّ مُوسَىٰ فَارِغًا ۖ إِن كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَن رَّبَطْنَا
عَلَىٰ قَلْبِهَا لِتَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
১০) ওদিকে মূসার মায়ের মন অস্থির হয়ে
পড়েছিল। সে তার রহস্য প্রকাশ করে দিতো যদি আমি
তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম, যাতে সে (আমার অংগীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়।
﴿وَقَالَتْ لِأُخْتِهِ قُصِّيهِ
ۖ فَبَصُرَتْ بِهِ عَن جُنُبٍ وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
১১) সে শিশুর বোনকে বললো, এর পিছনে পিছনে যাও। কাজেই সে
তাদের (শত্রুদের ) অজ্ঞাতসারে তাকে দেখতে থাকলো।১৩
১৩. অর্থাৎ, মেয়েটি এমনভাবে ঝুড়ির উপর নজর রাখে যারফলে ভাসমান ঝুড়ির সাথে
সাথে সে চলতেও থাকে এবং তার প্রতি নজর রাখতেও থাকে। আবার শত্রু যাতে না বুঝতে পারে তার কোন সম্পর্ক ঝুড়ির
শিশুটির সাথে আছে সেদিকেও খেয়াল রাখে। ইসলাঈলি বর্ণনা অনুযায়ী সে সময় হযরত মূসার বোনের বয়স ছিল দশ বারো বছর। সে বড়ই সতর্কতার সাথে ভাইয়ের অনুসরণ করে এবং সে যে ফেরাউনের
মহলে পৌছে গেছে তা বুঝতে পারে এবং তার তীব্র বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
﴿وَحَرَّمْنَا
عَلَيْهِ الْمَرَاضِعَ مِن قَبْلُ فَقَالَتْ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ أَهْلِ بَيْتٍ
يَكْفُلُونَهُ لَكُمْ وَهُمْ لَهُ نَاصِحُونَ﴾
১২) আর আমি পূর্বেই শিশুর জন্য স্তন্য
দানকারিনীদের স্তন পান হারাম করে রেখেছিলাম।১৪ (এ অবস্থা দেখে) সে মেয়েটি তাদেরকে বললো, "আমি তোমাদের এমন পরিবারের
সন্ধান দেবো যারা এর প্রতিপালনের দায়িত্ব নেবে এবং এর কল্যাণকামী হবে?"১৫
১৪. অর্থাৎ ফেরাউনের স্ত্রী যে ধাত্রীকে স্তন্যদান করার জন্য
ডাকতেন শিশু তার স্তনে মুখ লাগাতো না।
১৫. এ থেকে জানা যায়, ভাই ফেরাউনের মহলে পৌছে যাবার পর বোন ঘরে
বসে থাকে নি।
বরং সে একই প্রকার সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তা সহকারে মহলের আশে পাশে চক্কর দিতে থাকে। তারপর যখন জানতে পারে শিশু কারো স্তন মুখে
নিচ্ছে না এবং বাদশাহ-বেগম শিশুর পছন্দনীয় ধাত্রীর সন্ধান লাভের জন্য পেরেশান হয়ে
পড়েছে তখন সেই বুদ্ধিমতি মেয়ে সোজা রাজমহলে পৌছে যায়। সে ঘটনাস্থালে গিয়ে বলে আমি একজন ভাল ধাত্রীর সন্ধান দিতে
পারি, যে বড়ই
স্নেহ ও মমতা সহকারে এই শিশুর লালন-পালন করতে পারবে।
এ প্রসংগে এ কথাও বুঝে নিতে হবে, প্রাচিন কালে বড় ও অভিজাত বংশীয় লোকেরা
নিজেদের শিশু সন্তান নিজেদের কাছে রেখেই তাদের লালন পালন করার পরিবর্তে সাধারণত
ধত্রীদের হাতে সোপর্দ করে দিতো এবং তারাই নিজেদের কাছে রেখেই তাদের লালন পালন
করত। নবী সা.এর জীবন কাহিনী এ
কথার উল্লেখ আছে যে, মক্কার আসে পাশে মহিলারা মাঝে মাঝে মক্কায় আসতো ধনীর সেবা দান করার জন্য
এবং সরদারদের সন্তানদেরকে মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দুধ পান করাবার জন্য নিয়ে
যেতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া
সাল্লাম নিজেও হালীমা সাদীয়ার গৃহে মরুভূমির বুকে প্রতিপালিত হয়েছেন। মিসরেও ছিল এই একই রেওয়াজ। একারনে হযরত মূসার বোন একথা বলেননি, "আমি একজন ভালো ধাত্রী
এনে দিচ্ছি বরং বলেন, এমন গৃহের সন্ধান দিচ্ছি যার অধিবাসীরা
এর প্রতিপালনের দায়িত্ব নেবে এবং তারা কল্যাণকামিতার সাথে একে লালন পালন করবে।"
﴿فَرَدَدْنَاهُ
إِلَىٰ أُمِّهِ كَيْ تَقَرَّ عَيْنُهَا وَلَا تَحْزَنَ وَلِتَعْلَمَ أَنَّ وَعْدَ اللَّهِ
حَقٌّ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
১৩) এভাবে আমি মূসাকে১৬ তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে আনলাম, যাতে তার চোখ শীতল হয়, সে দুঃখ ভারাক্রান্ত না হয়
এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য বলে জেনে নেয়।১৭ কিন্তু অধিকাংশ লোক একথা
জানে না।
১৬. বাইবেল ও তালমূদ থেকে জানা যায়, শিশুর মূসা নাম ফেরাউনের গৃহেই
রাখা হয়। এটি হিব্রু নয় বরং কিবতী
ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, আমি তাকে পানি থেকে বের করতাম। প্রাচীন মিসরীয় ভাষা থেকেও হযরত মূসার নামের এ
অর্থকরণ সঠিক প্রমানিত হয়। সে ভাষায় 'মু' মানে পানি এবং 'উশা'
এর মানে হয় উদ্ধার প্রাপ্ত।
১৭. আর আল্লাহর এ কুশলী ব্যাবস্থার ফলে এ লাভটিও হয় যে, হযরত মূসা প্রকৃতপক্ষে
ফেরাউনের শহাজাদা হতে পারেননি বরং নিজের মা-বাপ-ভাই-বোনদের মধ্যে প্রতিপালিত হবার
কারনে নিজের আসল পরিচয় তিনি ভালোভাবেই অবহিত থাকতে পেরেছেন। নিজের পারিবিরিক ঐতিহ্য ও পিতৃ পুরুষের ধর্ম
এবং নিজের জাতি থেকে তারঁ সম্পর্কচ্যূতি ঘটতে পারেনি। তিনি ফেরাউন পরিবারের একজন সদস্য হবার পরিবর্তে নিজের
মানসিক আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে পুরোপুরিভাবে বনী ইসরইলেরই একজন সদস্যে
পরিনত হন। নবী সা. একটি হাদীসে বলেছনঃ
مثل الذي يعمل ويحتسب في صنعته الخير كمثل أم موسى ترضع ولدها وتأخذ
أجرها
"যে ব্যাক্তি নিজের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করে এবং
সে কাজে লক্ষ থাকে আল্লহর সন্তুষ্টি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত হযরত মূসার মায়ের মতোঃ তিনি
নিজেরই সন্তানকে দুধ পান করান আবার তার বিনিময়ে লাভ করেন।" অর্থাৎ এধরনের লোক যদিও নিজের এবং
নিজের সন্তানদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেয়ার জন্যকাজ করে কিন্তু যেহেতু সে
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ঈমানদারীর সাথে কাজ করে, যার সাথেই কাজ কারবার করে তার
হক যথাযথভাবে আদায় করে এবং হালাল রিজিকের মাধ্যামে নিজের এবং নিজের পরিবার পরিজনের
ভরণ পোষণকে আল্লহর ইবাদাত মনে করে, তাই নিজের জীবিকা
উপার্জনের জন্যেও সে আল্লাহর কাছে পুরুস্কার লাভের অধিকারী হয়। অর্থাৎ একদিকে জীবিকাও উপার্জন করা হয় এবং
অন্যদিকে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব ও প্রতিদানও লাভ করা হয়।
﴿وَلَمَّا
بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَىٰ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي
الْمُحْسِنِينَ﴾
১৪) মূসা যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেলো এবং
তার বিকাশ পূর্ণতা লাভ করলো১৮ তখন আমি
তাকে হুকুম ও জ্ঞান দান করলাম,১৯ সৎলোকদেরকে
আমি এ ধরনেরই প্রতিদান দিয়ে থাকে।
১৮. অর্থাৎ যখন তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সর্ম্পূণ হয়ে গেলো। ইহুদী বিবরন সমূহে এ সময় হযরত মূসার বিভিন্ন
বয়সের কথা বলা হয়েছে।
কোথাও ১৮,কোথাও ২০ আবার কোথাও ৪০ বছরো বলা হয়েছে। বাইবেলের নূতন নিয়মে ৪০বছর বলা হয়েছে(প্রেরিতদের কার্য
বিবরন ৭:২৩) কিন্তু কোরআন কোন বয়স নির্দেশ করেনি। যে উদ্দেশ্যে কাহীনি বর্ণনা করা হয়েছে সেজন্য কেবল মাত্র
এতটুকু জেনে নেয়াই যতেষ্ঠ যে, সামনের দিকে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে তা এমন এক সময়ের, যখন হযরত মূসা আলাহিসসালাম পূর্ণ যৌবনে পৌছে গিয়েছিলেন।
১৯. হুকুম অর্থ হিকমত, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা,
ধী-শক্তি ও বিচারবুদ্ধি। আর জ্ঞান বলতে বুঝানো হয়েছে দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় ধরনের
তত্ত্বজ্ঞান। কারণ নিজের পিতামাতার সাথে
সম্পর্ক-সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে তিনি নিজের বাপ-দাদা তথা ইউসুফ, ইয়াকুব ও ইসহাক আ. এর শিক্ষার
সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন। আবার তদানীন্তন বাদশাহর পরিবারে প্রতিপালিত হবার কারণে সমকালীন মিসরবাসীদের
মধ্যে প্রচলিত জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ হুকুম ও জ্ঞানদান অর্থ নবুওয়াত দান নয়। কারণ নবুওয়াত তো মূসাকে এর কয়েক বছর পরে দান
করা হয়। সামনের দিকে একথা বর্ণনা
করা হয়েছে। ইতিপূর্বে সূরা শু'আরায়ও (২১ আয়াত) এ বর্ণনা এসেছে।
এ রাজপুত্র থাকাকালীন সময়ের শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে বাইবেলের নূতন নিয়মের
প্রেরিতদের কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছেঃ “আর মোশি মিস্রীয়দের সমস্ত বিদ্যায় শিক্ষিত হইলেন, এবং তিনি বাক্যে ও কার্যে পরাক্রমী ছিলেন।” (৭:২২) তালমূদের বর্ণনা মতে মূসা আ. ফেরাউনের গৃহে একজন সূদর্শন যবা পুরুষ হিসেবে
বড় হয়ে ওঠেন। রাজপুত্রদের মতো পোশাক পরতেন। রাজপুত্রের মতো বসবাস করতেন। লোকেরা
তাঁকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। তিনি প্রায়ই জুশান এলাকায় যেতেন। সেখানে ছিল
ইসরাঈলীদের বসতি, তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের সাথে
কিবতী সরকারের কর্মচারীরা যেসব দূর্ব্যবহার ও বাড়াবাড়ি করতো সেসব নিজের চোঁখে
দেখতেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ফেরাউন ইসরাঈলীদের জন্র সপ্তাহে একদিন ছুটির বিধান করে।
তিনি ফেরাউনকে বলেন, চিরকাল
দিনের পর দিন অবিশ্রান্ত কাজ করতে থাকলে এরা
দূর্বল হয়ে পড়বে এবং এর ফলে সরকারেরই কাজের ক্ষতি হবে। এদের শক্তির
পূণর্বহালের জন্য সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করা দরকার। এভাবে নিজের
বৃদ্ধিমত্তার সাহায্যে তিনি এমনি আরো বহু কাজ করেছিলেন যার ফলে সারা মিশর দেশে
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। (তালমূদের বিবরণ ১২৯ পৃঃ)
﴿وَدَخَلَ
الْمَدِينَةَ عَلَىٰ حِينِ غَفْلَةٍ مِّنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلَانِ
هَٰذَا مِن شِيعَتِهِ وَهَٰذَا مِنْ عَدُوِّهِ ۖ فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِن شِيعَتِهِ
عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوسَىٰ فَقَضَىٰ عَلَيْهِ ۖ قَالَ هَٰذَا
مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ ۖ إِنَّهُ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِينٌ﴾
১৫) (একদিন) সে শহরে এমন সময় প্রবেশ করলো যখন শহরবাসী উদাসীন
ছিল।২০ সেখানে সে
দেখলো দু'জন লোক
লড়াই করছে। একজন তার নিজের সম্প্রদায়ের এবং অন্যজন
তার শত্রু সম্প্রদায়ের। তার সম্প্রদায়ের লোকটি
শত্রু সম্প্রদায়ের লোকটির বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করার জন্য ডাক দিল। মূসা তাকে
একটি ঘুষি মারলো২১ এবং তাকে মেরে ফেললো। (এ কাণ্ড
ঘটে যেতেই) মূসা বললো, "এটা শয়তানের কাজ, সে ভয়ংকর শত্রু এবং প্রকাশ্য
পথভ্রষ্টকারী।"২২
২০. হতে পারে এটা ছিলো একেবারে ভোর বেলা অথবা গরম কালের
দুপুরের সময় কিংবা শীত কালে রাতের বেলা। মোটকথা, তখন সময়টা এমন ছিল যখন পথ ঘাট ছিল জন কোলাহল মুক্ত এবং সারা
শহর ছিল নিরব নিঝুম।
"শহরে প্রবেশ করলো" এ শব্দ গুলো থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাজ প্রাসাদ সাধরন জনবসতি থেকে দূরে অবস্থিত ছিল। হযরত মুসা যেহেতু রাজপ্রাসাদে থাকতেন তাই শহরে
বের হলেন, না বলে বলা হয়েছে, শহরে প্রবেশ করলেন।
২১. মূলে وكـز শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ চড় মারাও হতে পারে আবার ঘুষি মারাও হতে পারে। চড়ের তুলনায় ঘুষির আঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা
বেশী। তাই আমি এখানে অনুবাদে ঘুষি
শব্দ গ্রহণ করেছি।
২২. এ থেকে অনুমান করা যায়, ঘুঁষি খেয়ে মিসরীয়টি যখন পড়ে গেল এবং পড়ে
গিয়ে মারা গেল তখন কী ভিষন লজ্জা ও শংকার মধ্যে হযরত মুসার মুখ থেকে কথা গুলো বের
হয়ে গিয়ে খাকবে।
হত্যা করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। হত্যা করার উদ্দেশ্যে ঘুঁষি মারাও হয়নি। কেও এটা আশাও করেনি, একটি ঘুঁষি খেয়েই একজন সুস্থ সবল লোক মারা
যাবে। তাই হযরত মুসা বললেন, এটা শয়তানের কোন খারাপ
পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে। সে একটি বড় বিপর্যয় ঘটাবার জন্য আমার হাত দিয়ে একাজ করিয়েছে। ফলে আমার বিরুদ্ধে একজন ইসরাঈলীকে সাহায্য
করার জন্য একজন কিবতীকে হত্যা করার অভিযোগ আসবে এবং শুধু আমার বিরুদ্ধে নয় বরং
সমগ্র ইসরাঈলী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিসরে একটি বিরাট হাংগামা সৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে বাইবেলের বর্ণনা কুরআন থেকে ভিন্ন। বাইবেল হযরত মূসার বিরুদ্ধে সেচ্চাকৃত হত্যার
আভিযোগ এনেছে। তার বর্ণনা মতে মিসরীয় ও
ইসরাঈলীকে লড়াই করতে দেখে হযরত মূসা "এদিক ওদিক চহিয়া কাহাকেও দেখিতে না
পাওয়াতে ঐ মিস্রীয়কে বধ করিয়া বালির মধ্যে পুতিয়া রাখিলেন।" (যাহা পুস্তক ২:১২) তালমূদেও একথা বলা হয়েছে ।এখন বনী ইসরাঈল কিভাবে নিজেদের মনীষীদের চরিত্রে নিজেরাই
কলংক লেপন করেছে এবং কুরআন কিতাবে তাঁদের ভূমিকা পরিচ্ছন্ন ও কলঙকমূক্ত করেছে তা
যে কোন ব্যাক্তি বিচার করতে পারে। সাধারন বিবেক বুদ্ধিও এ কথা বলে, একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিমান,
বিচক্ষন ব্যাক্তি, পরবর্তীকালে যাঁকে হতে হবে
একজন মহীমান্বিত পয়গম্বর এবং মানুষকে ইনসাফ ও ন্যায়নীতির একটি মর্যাদাশালী আইন
ব্যাবস্থা দান করা হবে যাঁর দায়িত্ব, তিনি এমন একজন অন্ধ
জাতীয়তাবাদী হতে পারেন না যে, নিজের জাতির একজনকে অন্য জাতীর
কোন ব্যাক্তির সাথে মারামারি করতে দেখে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে সেচ্ছায় বিপক্ষীয়
ব্যাক্তিকে মেরে ফেলবেন। ইসরাইলীকে মিসরীয়দের কবজায় দেখে তাকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য হত্যা করা যে, বৈধ হতে পারে না, তা বলাই নিস্প্রয়োজন।
﴿قَالَ
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ
الرَّحِيمُ﴾
১৬) তারপর সে বলতে লাগলো, "হে আমার রব! আমি নিজের ওপর
জুলুম করেছি, আমাকে
ক্ষমা করে দাও?"২৩ তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে
দিলেন তিনি ক্ষমাশীল মেহেরবান।২৪
২৩. মূল শব্দ হচ্ছে"মাগিফরাত" এর অর্থ ক্ষমা করা ও
মাফ করে দেয়াও হয় আবার গোপনীয়তা রক্ষা করাও হয়। হযরত মূসা আ. দোয়ার অর্থ ছিল, আমার এ গোনাহ (যা তুমি জানো,
আমি জেনে-বুঝে করিনি) তুমি
মাফ করে দাও এবং এর ওপর আবরন দিয়ে ঢেকে দাও, যাতে শত্রুরা
জানতে না পারে।
২৪. এরও দুই অর্থ এবং দুটিই এখানে প্রযোজ্য। অর্থাত আল্লাহ তাঁর এ ত্রুটি মাফ করে দেন এবং
হজরত মূসার গোপনীয়তাও রক্ষা করেন। অর্থাত কিবতী জাতির কোন ব্যাক্তি এবং কিবতী সরকারের কোন লোকের সে সময়
তাদের আশেপাশে বা ধারে কাছে গমনাগমন হয়নি। ফলে তারা কেউ এ হত্যাকান্ড দেখেনি। এভাবে হযরত মূসার পক্ষে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়ার
সুযোগ ঘটে।
﴿قَالَ
رَبِّ بِمَا أَنْعَمْتَ عَلَيَّ فَلَنْ أَكُونَ ظَهِيرًا لِّلْمُجْرِمِينَ﴾
১৭) মূসা শপথ করলো, "হে আমার রব! তুমি আমার প্রতি
এই যে অনুগ্রহ করেছো২৫ এরপর আমি
আর অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না।"২৬
২৫. অর্থাৎ আমার কাজটি যে গোপন থাকতে পেরেছে, শত্রু জাতির কোন ব্যক্তি যে
আমাকে দেখতে পায়নি এবং আমার সরে যাওয়ার যে সুযোগ ঘটেছে, এই
অনুগ্রহ।
২৬. মূসার এ অংগীকার অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দাবলীর
মাধ্যমে সাধিত হয়েছে। এর
অর্থ কেবল এই নয় যে, আমি কোন অপরাধীর সহায়ক হবো না বরং এর অর্থ এটাও হয় যে, আমার সাহায্য-সহায়তা কখনো এমন লোকদের পক্ষে থাকবে না যারা দুনিয়ায় জুলুম ও
নিপীড়ণ চালায় ।
ইবনে জারীর এবং অন্য কয়েকজন তাফসীরকারক এভাবে এর একেবারে সঠিক অর্থ নিয়েছেন যে, সেই দিনই মূসা ফেরাউন ও তার
সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অংগীকার করেন।কারণ ফেরাউনের সরকার ছিল একটি জালেম সরকার এবং সে আল্লাহর এ
সরযমীনে একটি অপরাধমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল। তিনি অনুভব করেন, কোন ঈমানদার ব্যক্তি একটি জালেম সরকারের
হাতিয়ারে পরিণত হতে এবং তার শক্তি ও পরাক্রান্ত বৃদ্ধির কাজে সহায়তা করতে পারে না।
মুসলিম আলেমগণ সাধারণভাবে মূসার এ অংগীকার থেকে একথা প্রমাণ করেছেন যে, একজন মু'মিনের
কোন জালেমকে সাহায্য করা থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা উচিত। সে জালেম কোন ব্যক্তি, দল, সরকার
বা রাষ্ট্র যেই হোক না কেন । প্রখ্যাত তাবেঈ আতা ইবনে আবী রাবাহর কাছে এক ব্যক্তি বলে, আমার ভাই বনী উমাইয়া সরকারের
অধীনে কূফার গভর্ণরের কাতিব (সচিব), বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা
করা তার কাজ নয়, তবে যেসব ফায়সালা করা হয় সেগুলো তার কলমের
সাহায্যেই জারী হয়। এ চাকুরী না করলে সে ভাতে মারা যাবে। আতা জবাবে এ আয়াতটি পাঠ করেন এবং বলেন, তোমার ভাইয়ের নিজের কলম ছুঁড়ে
ফেলে দেয়া উচিত, রিযিকদাতা হচ্ছেন আল্লাহ । আর একজন কাতিব 'আমের শা'বীকে
জিজ্ঞেস করেন, "হে আবু 'আমর! আমি
শুধুমাত্র হুকুমনামা লিখে তা জারী করার দায়িত্ব পালন করি মূল ফায়সালা করার দায়িত্ব
আমার নয়। এ জীবিকা কি আমার জন্য বৈধ? "তিনি জবাব দেন,
"হতে পারে কোন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যার ফায়সালা করা হয়েছে
এবং তোমার কলম দিয়ে তা জারী হবে। হতে পারে, কোন সম্পদ নাহক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে অথবা কারো গৃহ ধ্বসানোর
হুকুম দেয়া হয়েছে এবং তা তোমার কলম দিয়ে জারী হচ্ছে" । তারপর ইমাম এ আয়াতটি পাঠ করেন। আয়াতটি শুনেই কাতিব বলে ওঠেন, "আজকের পর থেকে আমার কলম
বনী উমাইয়ার হুকুমনামা জারী হবার কাজে ব্যবহৃত হবে না।" ইমাম বললেন, "তাহলে আল্লাহও তোমাকে রিযিক থেকে
বঞ্চিত করবেন না।"
আবদুর রহমান ইবনে মুসলিম যাহ্হাককে শুধুমাত্র বুখারায় গিয়ে সেখানকার লোকদের
বেতন বণ্টন করে দেবার কাজে পাঠাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি সে দায়িত্ব গ্রহণ করতেও অস্বীকার করেন। তাঁর বন্ধুরা বলেন, এতে ক্ষতি কি? তিনি বলেন, আমি জালেমদের কোন কাজেও সাহায্যকারী হতে
চাই না। (রুহুল মা’আনী ৩ খন্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা)
ইমাম আবু হানীফার একটি ঘটনা তাঁর নির্ভরযোগ্য জীবনীকারগণ আল মুওয়াফ্ফাক আল
মক্কী, ইবনুল
বায্যার আল কারওয়ারী, মুল্লা আলী কারী প্রমূখ সবাই তাঁদের
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বলা হয়েছে, তারই পরামর্শক্রমে বাদশাহ মনসূরের প্রধান সেনাপতি হাসান ইবনে কাহ্তুবাহ
একথা বলে নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, আজ পর্যন্ত এতটুকুই
যথেষ্ট। কিন্তু এ যদি জুলুমের পথে
হয়ে থাকে তাহলে আমার আমল নামায় আমি আর কোন অপরাধের সংখ্যা বাড়াতে চাই না।
﴿فَأَصْبَحَ
فِي الْمَدِينَةِ خَائِفًا يَتَرَقَّبُ فَإِذَا الَّذِي اسْتَنصَرَهُ بِالْأَمْسِ يَسْتَصْرِخُهُ
ۚ قَالَ لَهُ مُوسَىٰ إِنَّكَ لَغَوِيٌّ مُّبِينٌ﴾
১৮) দ্বিতীয় দিন অতি প্রত্যুষে সে ভয়ে ভয়ে
এবং সর্বদিক থেকে বিপদের আশংকা করতে করতে শহরের মধ্যে চলছিল। সহসা
দেখলো কি, সেই
ব্যক্তি যে গতকাল সাহায্যের জন্য তাকে ডেকেছিল আজ আবার তাকে ডাকছে। মূসা
বললো,
"তুমি তো দেখছি স্পষ্টতই বিভ্রান্ত।"২৭
২৭. অর্থাৎ তুমি ঝগড়াটে স্বভাবের বলে মনে হচ্ছে। প্রতিদিন কারো না কারো সাথে তোমার ঝগড়া হতেই
থাকে। গতকাল একজনের সাথে ঝগড়া
বাধিয়েছিল, আজ আবার আর একজনের সাথে বাধিয়েছো।
﴿فَلَمَّا
أَنْ أَرَادَ أَن يَبْطِشَ بِالَّذِي هُوَ عَدُوٌّ لَّهُمَا قَالَ يَا مُوسَىٰ أَتُرِيدُ
أَن تَقْتُلَنِي كَمَا قَتَلْتَ نَفْسًا بِالْأَمْسِ ۖ إِن تُرِيدُ إِلَّا أَن تَكُونَ
جَبَّارًا فِي الْأَرْضِ وَمَا تُرِيدُ أَن تَكُونَ مِنَ الْمُصْلِحِينَ﴾
১৯) তারপর মূসা যখন শত্রু সম্প্রদায়ের
লোকটিকে আক্রমণ করতে চাইলো২৮ তখন সে
চিৎকার করে উঠলো,২৯ "হে মূসা! তুমি কি আজকে আমাকে
ঠিক তেমনিভাবে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছো যেভাবে গতকাল একজনকে হত্যা করেছিলে? "তুমি তো দেখছি এদেশে
স্বেচ্ছাচারী হয়ে থাকতে চাও, সংস্কারক হতে চাও না?
২৮. বাইবেলের বর্ণনা এখানে কোরআন থেকে আলাদা। বাইবেল বলে, দ্বিতীয় দিনের ঝগড়া ছিল দু'জন ইসরাঈলীর মদ্ধে। কিন্তু কোরআন বলেছে, এঝগড়াও ইসরাঈলী ও মিসরীয়ের মদ্ধে ছিল। এ দ্বিতীয় বর্ণনাটিই যুক্তি সংগত বলে মনে হয়। কারন প্রথম দিনের হত্যার রহস্য প্রকাশ হবার যে
কথা সামনের দিকে আসছে মিসরীয় জাতীর একজন লোক সে ঘটনা জানতে পারলেই তা প্রকাশ
পাওয়া সম্ভব হতো। একজন ইসরাঈলী তা জানতে
পারলে সে সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জাতির পালক-রাজপুত্রের এত বড় অপরাধের খবর ফেরাউনী
সরকারের গোচরীভূত করবে এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
২৯. যে ইসরাঈলীকে সাহায্য করার জন্য মূসা এগিয়ে গিয়েছিলেন, এ ছিল তারই চিৎকার। তাকে ধমক দেবার পর যখন তিনি মিসরীয়টিকে মারতে
উদ্যত হলেন তখন ইসরাঈলীটি মনে করলো মূসা বুঝি তাকে মারতে আসছেন। তাই সে চিৎকার করতে থাকলো এবং বোকামির জন্য
গতকালের হত্যা রহস্যও প্রকাশ করে দিল।
﴿وَجَاءَ
رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَىٰ قَالَ يَا مُوسَىٰ إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ
بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِينَ﴾
২০) এরপর এক ব্যক্তি নগরীর দূর প্রান্ত
থেকে ছুটে এলো৩০ এবং বললো, "হে মূসা! সরদারদের মধ্যে
তোমাকে হত্যা করার পরামর্শ চলছে। এখান থেকে
বের হয়ে যাও। আমি তোমার মঙ্গলাকাংখী।"
৩০. অর্থাৎ এ দ্বিতীয় ঝগড়ার ফলে হত্যা রহস্য প্রকাশ হয়ে যাবার
পর সংশ্লিষ্ট মিসরীয়টি যখন গিয়ে সরকারকে জানিয়ে দিল তখন এ পরামর্শের ঘটনা ঘটে।
﴿فَخَرَجَ
مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ ۖ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
২১) এ খবর শুনতেই মূসা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে
পড়লো এবং সে দোয়া করলো, "হে আমার রব! আমাকে জালেমদের হাত থেকে বাঁচাও।"
﴿وَلَمَّا تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ
مَدْيَنَ قَالَ عَسَىٰ رَبِّي أَن يَهْدِيَنِي سَوَاءَ السَّبِيلِ﴾
২২) (মিসর থেকে বের হয়ে) যখন মূসা মাদয়ানের দিকে রওয়ানা হলো৩১ তখন সে বললো, "আশা করি আমার রব আমাকে সঠিক
পথে চালিত করবেন।"৩২
৩১. হযরত মূসার মিসর থেকে বের হয়ে মাদয়ানের দিকে যাবার
ব্যাপারে বাইবেলের বর্ণনা কোরআনের সাথে মিলে যায়। কিন্তু তালমুদের এ প্রসংগে এক ভিত্তি হীন কাহিনীর বর্ণনা
করেছেন। সেটা এই যে, হযরত মূসা মিসর থেকে হাবসায়
পালিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে বাদশাহর পারিষদে পরিনত হয়। তারপর বাদশহর মৃত্যুর পর লোকেরা তাঁকেই নিজেদের বাদশহের
সিংহাসনে বসায় এবং বাদশহর বিধবা স্ত্রীর সাথে তার বিবাহ দেন। ৪০ বছর তিনি সেখানে রাজত্ব করেন। কিন্তু এ সুদীর্ঘ সময় কালে তিনি কখনো নিজের হাবশী স্ত্রীর
নিকটবর্তী হননী। ৪০ বছর অতিক্রান্ত হবার পর
ঐ ভদ্র মহিলা হাবশার জনগনের কাছে এ মর্মে অভিযাগ করেন যে, ৪০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও আজ
পর্যন্ত এ ব্যাক্তি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক রক্ষা করেননি এবং হাবসার দেবতাদের পূজা
করেনি। এ কথায় রাষ্ট্রের প্রশাসনিক
কর্মকর্তারা তাকে পদচূত করে বিপুল পরিমান ধন-সম্পদ দিয়ে সসম্মানে বিদায় করে দেয়। তখন তিনি হাবশা ত্যাগ করে মাদয়ানে পৌছে যান
এবং সেখানে সামনের যে সব ঘঠনার কথা বলা হয়েছে সেগুলো ঘটে। তখন তার বয়স ছিল ৬৭ বছর।
এ কাহিনীটি যে ভিত্তিহীন এর একটি সুস্পষ্ট প্রমান হচ্ছে যে, এতে এ কথাও বলা হয়েছে যে একসময়
আসিরীয়ায়দের বিদ্রহ দমন করার জন্য হযরত মূসা ও তাঁর পূর্ববতি বাদশহরাও সামরিক
অভিযান চালান।
সামান্যতম ইতিহাস-ভূগোল জ্ঞান যার আছ সে এ পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে একটু নজর দিলেই
দেখতে পাবে যে, আসিরীয়ার উপর হাবশার শাসন বা হাবশি সেনা দলের আক্রমনের ব্যাপারটি
কেবলমাত্র তখনই ঘটতে পারতো যখন মিসর, ফিলিস্তীন ও সিরিয়া
তার দখলে থাকত অথবা সমগ্র আরব দেশ তার কর্তৃত্বাধীন হত কিংবা হাবশার নৌবাহিনী এতই
শক্তিশালী হত যে, তা ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপ মহাসাগর
অতিক্রম করে ইরাক দখল করতে সক্ষম হতো। দেশগুলোয় কখনো হাবশিদের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অথবা
তাদের নৌশক্তি কখনো এতো শক্তির অধিকারী ছিল এ ধরনের কোন কথা ইতিহাসে নেই। এ থেকে বুঝা যায় যে, নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে বনী
ইসরাঈলের জ্ঞান কতটা অপরিপক্ক ছিল এবং কোরআন তাদের ভুলগুলো সংশোধন করে কেমন
সুস্পষ্ট আকারে সঠিক ঘটনাবলী পেশ করেছেন। কিন্তু ইহুদী খ্রৃষ্টান প্রাচ্যবিদগণ একথা বলতে লজ্জা
অনুভব করেন না যে, কোরআন এসব কাহিনী বনী ইসরাঈল থেকে সংগ্রহ করেছে।
৩২. অর্থাৎ এমন পথ যার সাহায্যে সহজে মাদয়ানে পৌঁছে যাবো। উল্লেখ্য, সে সময় মাদয়ান ছিল ফেরাউনের রাজ্য-সীমার
বাইরে । সমগ্র সিনাই উপদ্বীপে
মিসরের কর্তৃত্ব ছিল না।
বরং তার কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিম ও দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত। আকাবা উপসাগরের পূর্ব ও পশ্চিম তীরে ছিল বনী
মাদয়ানের বসতি এবং এ এলাকা ছিল মিসরীয় প্রভাব ও কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এ কারণে মূসা মিসর থেকে বের হয়েই মাদয়ানের পথ
ধরেছিলেন। কারণ এটাই ছিল নিকটতম
জনবসতিপূর্ণ স্বাধীন এলাকা। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তাঁকে অবশ্যই মিসর অধিকৃত এলাকা দিয়েই এবং মিসরীয়
পুলিশ ও সেনা-চৌকিগুলোর নজর এড়িয়ে যেতে হতো। তাই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আমাকে এমন পথে নিয়ে যাও যেপথ
দিয়ে আমি সহি-সালামতে মাদয়ান পৌঁছে যেতে পারি।
﴿وَلَمَّا
وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِّنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ
مِن دُونِهِمُ امْرَأَتَيْنِ تَذُودَانِ ۖ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا ۖ قَالَتَا لَا نَسْقِي
حَتَّىٰ يُصْدِرَ الرِّعَاءُ ۖ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ﴾
২৩) আর যখন সে মাদয়ানের কুয়ার কাছে পৌঁছুল,৩৩ সে দেখলো, অনেক লোক তাদের পশুদের পানি
পান করাচ্ছে এবং তাদের থেকে আলাদা হয়ে একদিকে দু'টি মেয়ে নিজেদের পশুগুলো আগলে
রাখছে। মূসা মেয়ে দু'টিকে জিজ্ঞেস করলো, "তোমাদের সমস্যা কি?" তারা বললো, "আমরা আমাদের জানোয়ারগুলোকে
পানি পান করাতে পারি না যতক্ষণ না এ রাখালেরা তাদের জানোয়ারগুলো সরিয়ে নিয়ে যায়, আর আমাদের পিতা একজন অতি
বৃদ্ধ ব্যক্তি।"৩৪
৩৩. এ স্থানটি, যেখানে মূসা পৌঁছেছিলেন, এটি আকাবা উপসাগরের পশ্চিম তীরে মানকা থেকে কয়েক মাইল উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্তমানে এ জায়গাটিকে আল বিদ্'আ বলা হয়। সেখানে একটি ছোট মতো শহর গড়ে উঠেছে। আমি ২০০৪ সালে তাবুক যাওয়ার পথে এ জায়গাটি
দেখেছি। স্থানীয় অধিবাসীরা আমাকে
জানিয়েছে, বাপ-দাদাদের আমল থেকে আমরা শুনে আসছি মাদয়ান এখানেই অবস্থিত ছিল। এর সন্নিকটে সামান্য দূরে একটি স্থানকে
বর্তমানে "মাগায়েরে শু'আইব" বা "মাগারাতে শু'আইব"
বলা হয়। সেখানে সামূদী প্যাটার্নের
কিছু ইমারত রয়েছে। আর এর প্রায় এক মাইল দু'মাইল দূরে কিছু প্রাচীন
ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর
মধ্যে আমরা দেখেছি দু'টি অন্ধকূপ। স্থানীয় লোকেরা আমাদের জানিয়েছে, নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারি না তবে
আমাদের এখানে একথাই প্রচলিত যে, এ দু'টি
কূয়ার মধ্য থেকে একটি কূয়ায় মূসা তাঁর ছাগলের পানি পান করিয়েছেন। এ এলাকার অধিবাসীরা এ স্থানেই মূসার ঐ কূয়াটি
চিহ্নিত করে থাকে। এ থেকে জানা যায়, এ বর্ণনাটি শত শত বছর থেকে
সেখানকার লোকদের মুখে মুখে বংশানুক্রমে চলে আসছে এবং এটি ভিত্তিতে দৃঢ়তার সাথে বলা
যেতে পারে, কুরআন মজীদে যে স্থানটির কথা বলা হয়েছে এটা সেই
স্থান।
৩৪. অর্থাৎ আমরা মেয়েমানুষ । এ রাখালদের সাথে টক্কর দিয়ে ও সংঘর্ষ বাধিয়ে নিজেদের
জানোয়ারগুলোকে আগে পানি পান করাবার সামর্থ্য আমাদের নেই। অন্যদিকে আমাদের পিতাও এতবেশি বয়োঃবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন যে, তিনি নিজে আর কষ্টের কাজ করতে
পারেন না। আমাদের পরিবারে আর দ্বিতীয়
কোন পুরুষ নেই। তাই আমরা মেয়েরাই এ কাজ
করতে বের হয়েছি। সব রাখালদের তাদের
পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে নিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে
হয়। মেয়ে দু'টি শুধুমাত্র একটি সংক্ষিপ্ত
বাক্যের মাধ্যমে এ বক্তব্য উপস্থাপন করে। এ থেকে একদিকে তাদের লজ্জাশীলতার প্রকাশ ঘটে। অর্থ্যাৎ একজন পর পুরুষের সাথে তারা বেশি কথাও
বলতে চাচ্ছিল না। আবার এটাও পছন্দ করছিল না
যে, এ ভিন দেশী
অপরিচিত লোকটি তাদের ঘটনা সম্পর্কে কোন ভুল ধারনা পোযণ করুক এবং মনে মনে ভাবুক যে,
এরা কেমন লোক যাদের পুরুষরা ঘরে বসে রয়েছে আর ঘরের মেয়েদেরকে এ কাজ
করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এ মেয়েদের বাপের ব্যাপারে আমদের এখানে এ কথা প্রচার হয়ে গেছে যে, তিনি ছিলেন হযরত শু'আইব আ.।
কিন্তু কুরআন মজীদে ইশারা ইঙ্গিতে কোথাও এমন কথা বলা হয়নি যা থেকে বুঝা যেতে পারে
তিনি শু'আইব আ. ছিলেন। অথচ শু'আইব আ. কুরআন মজীদে একটি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এ মেয়েদের পিতা যদি তিনিই হতেন তাহলে এখানে একথা সুস্পষ্ট
করে দেয়ার কোন কারনই ছিল না। নিঃসন্দেহে কোন কোন হাদীসে তাঁর নাম স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লামা ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর উভয়ে
এ ব্যাপারে একমত যে, এগুলোর কোনটিরও সনদ তথা বর্ণনাসূত্র নির্ভুল নয়। তাই ইবনে আব্বাস, ইবনে বসরী, আবু উবাইদাহ ও সাঈদ ইবনে জুবাইরের ন্যায় বড় বড় তফসীরকারক বনী ইসরাইলের
বর্ণনার উপর নির্ভর করে তালমূদ ইত্যাদি গ্রণ্থে এ মণীষীর যে নাম উল্লেখিত হয়েছে
সেটিই বলেছেন।
অন্যথায় বলা নিষ্প্রয়োজন, যদি নবী সা. থেকে হযরত শুআইবের নাম স্পষ্ট করে বলা হতো তাহলে তাঁরা কখনো
অন্য নাম উল্লেখ করতেন না।
বাইবেলের এক জায়গায় এ মনীষীর নাম বলা হয়েছে রূয়েল এবং অন্য জায়গায় বলা হয়েছে
যিথ্রো। এবং বলা হয়েছে তিনি
মাদয়ানের যাজক ছিলেন।
(যাত্রা পুস্তক ২: ১৬-১৮, ৩:১ এবং ১৮:৫) তালমূতদীয় সাহিত্যে
রূয়েল, যিথ্রো ও হুবাব তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম বলা হয়েছে। আধুনিক ইহুদী আলেমগণের মতে যিথ্রো ছিল 'হিজ এক্সেলেন্সী' এর সমার্থক একটি উপাধি এবং আসল নাম ছিল রূয়েল বা হুবাব। অনুরূপভাবে কাহেন বা যাজক (কড়যবহ গরফরধহ) শব্দটির ব্যাখ্যার ব্যাপারেও ইহুদী আলেমগণের
মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে পুরোহিত
(চৎরবংঃ) বা এর সমার্থক হিসেবে নিয়েছেন
আবার কেউ রাইস বা আমীর (চৎরহপব) অর্থে
নিয়েছেন।
তালমূদে তাঁর যে জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসার জন্মের পূর্বে
ফেরাউনের কাছে তাঁর যাওয়া-আসা ছিল। ফেরাউন তাঁর জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রতি আস্থা রাখতো। কিন্তু যখন বণী ইসরাইলের উপর জুলুম শোষন
চালাবার জন্য মিশরের রাজ পরিষদে পরামর্শ হতে লাগলো এবং তাদের সন্তানদের জন্মের পর
পরই হত্যা করার সিদ্ধান্ত হলো তখন তিনি ফেরাউনকে এ অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য
অনেক চেষ্টা চালান। তাকে এ জুলুমের অশুভ
পরিণামের ভয় দেখালেন।
তিনি পরামর্শ দিলেন, এদের অস্তিত্ব যদি আপনার কাছে এতই অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে এদেরকে মিশর থেকে
বের করে এদের পিতৃ পুরুষের দেশ কেনানের দিকে পাঠিয়ে দিন। তাঁর এ ভূমিকায় ফেরাউন তাঁর প্রতি অসন্তষ্ট
হয়ে তাঁকে অপদস্থ করে নিজের দরবার থেকে বের করে দিয়েছিল। এ সময় থেকে তিনি নিজের দেশ মাদ্য়ানে চলে এসে সেখানেই
অবস্থান করছিলেন।
তাঁর ধর্ম সম্পর্কে অনুমান করা হয়, হযরত মুসা আ. এর মত তিনিও ইবরাহীমী দীনের
অনুসারী ছিলেন।
কেননা, যেভাবে হযরত
মুসা ছিলেন ইসহাক ইবনে ইবরাহীমের আ. আউলাদ
ঠিক তেমনি তিনিও ছিলেন মাদ্য়ান ইবনে ইবরাহীমের বংশধর। এ সম্পর্কের কারনেই সম্ভবত তিনি ফেরাউনকে নবী ইসরাইলের উপর
জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ণ করতে নিষেধ করেন এবং তার বিরাগভাজন হন। কুরআন ব্যাখ্যাতা নিশাপুরী হযরত হাসান বাসরীর বরাত দিয়ে
লিখেছেনঃ
إنه كان رجلا مسلما قبل الدين من شعيب
"তিনি একজন মুসলমান ছিলেন। হযরত শু'আইবের দীন তিনি গ্রহন করে নিয়েছিলেন।"
তালমূদে বলা হয়েছে, তিনি মাদ্য়ানবসীদের মূর্তিপূজাকে প্রকাশ্যে নির্বুদ্ধিতা বলে সমালোচনা
করতেন। তাই মাদয়ানবাসীরা তাঁর
বিরোধী হয়ে গিয়েছিল।
﴿فَسَقَىٰ
لَهُمَا ثُمَّ تَوَلَّىٰ إِلَى الظِّلِّ فَقَالَ رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ
مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ﴾
২৪) একথা শুনে মূসা তাদের জানোয়ারগুলোকে
পানি পান করিয়ে দিল। তারপর সে একটি ছায়ায় গিয়ে
বসলো এবং বললো,
"হে আমার প্রতিপালক! যে কল্যাণই তুমি আমার প্রতি নাযিল করবে আমি
তার মুখাপেক্ষী।"
﴿فَجَاءَتْهُ إِحْدَاهُمَا
تَمْشِي عَلَى اسْتِحْيَاءٍ قَالَتْ إِنَّ أَبِي يَدْعُوكَ لِيَجْزِيَكَ أَجْرَ مَا
سَقَيْتَ لَنَا ۚ فَلَمَّا جَاءَهُ وَقَصَّ عَلَيْهِ الْقَصَصَ قَالَ لَا تَخَفْ ۖ
نَجَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
২৫) (বেশিক্ষণ অতিবাহিত হয়নি এমন সময়) ঐ দু'টি মেয়ের মধ্য থেকে একজন লজ্জাজড়িত পদ
বিক্ষেপে তার কাছে এলো৩৫ এবং বলতে
লাগলো,
"আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, আপনি আমাদের জানোয়ারগুলোকে
যে পানি পান করিয়েছেন আপনাকে তার পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য।"৩৬ মূসা যখন তার কাছে পৌঁছুল এবং
নিজের সমস্ত কাহিনী তাকে শুনালো তখন সে বললো, "ভয় করো না, এখন তুমি জালেমদের হাত থেকে
বেঁচে গেছো।"
৩৫. উমর রা. এ বাক্যাংশটির এরূপ ব্যাখ্যা করেছেনঃ
جاءتْ تمشي على استحياءٍ قائلةً بثَوبِها
على وجهِها ليسَتْ بسَلْفَعٍ من النساء دلاجة ولَّاجةٌ خرَّاجةٌ
"সে নিজের মুখ ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে লজ্জাজড়িত পায়ে হেঁটে এলো। সেই সব ধিংগি চপলা মেয়েদের মতো হন হন করে ছুটে
আসেনি, যারা যেদিকে
ইচ্ছা যায় এবং যেখানে খুশী ঢুকে পড়ে।"
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত কয়েকটি রেওয়ায়েত সাঈদ ইবনে মানসুর, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনুল মুনযির নির্ভরযোগ্য সনদ সহকারে উমর থেকে উদ্ধৃত
করেছেন। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, সাহাবায়ে কেরামের যুগে কুরআন ও
নবী সা.এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে এ মনীষীগণ লজ্জাশীলতার ইসলামী ধারণা লাভ
করেছিলেন তা অপরিচিত ও ভিন্ পুরুষদের সামনে চেহারা খুলে রেখে ঘোরাফেরা করা এবং
বেপরোয়াভাবে ঘরের বাইরে চলাফেরা করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। উমর রা. পরিষ্কার ভাষায় এখানে চেহারা ঢেকে
রাখাকে লজ্জাশীলতার চিহ্ন এবং তা ভিন পুরুষের সামনে উন্মুক্ত রাখাকে নির্লজ্জতা
গণ্য করেছেন।
৩৬. একথাও সে বলে লজ্জা-শরমের কারণে। কেননা, নির্জনে একজন ভিন পুরুষের কাছে একাকী আসার কোন কারণ বলা জরুরী
ছিল। অন্যথায় একথা সুস্পষ্ট,একজন ভদ্রলোক যদি কোন মেয়ে
মানুষকে পেরেশান দেখে তাকে কোন সাহায্য করে থাকে, তাহলে তার
প্রতিদান দেবার কথা বলা কোন ভালো কথা ছিল না। তারপর এ প্রতিদানের নাম শোনা সত্ত্বেও মূসার মতো একজন
মহানুভব ব্যক্তির উঠে এগিয়ে যাওয়া একথা প্রমাণ করে যে, তিনি সে সময় চরম দুরবস্থায়
পতিত ছিলেন। একেবারে খালি হাতে অকস্মাৎ
মিসর থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন। মাদয়ান পর্যন্ত পৌঁছতে কমপক্ষে আটদিন লাগার কথা। ক্ষুধা, পিপাসা এবং সফরের ক্লান্তিতে অবস্থা কাহিল না হয়ে পারে না। বিদেশে-পরবাসে কোন থাকার জায়গা পাওয়া যায় কিনা
এবং এমন কোন সমব্যথী পাওয়া যায় কিনা যার কাছে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে, এ চিন্তা সম্ভবত তাকে সবচেয়ে
বেশী পেরেশান করে দিয়েছিল। এ অক্ষমতার কারণেই এত সামান্য সেবা কর্মের পারিশ্রমিক দেবার জন্য ডাকা হচ্ছে
শুনে মূসা যাওয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করেননি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে, আল্লাহর কাছে এখনই আমি যে দোয়া
করেছি তা কবুল করার এ ব্যবস্থা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে, তাই
এখন অনর্থক আত্মমর্যাদার ভান করে আল্লাহর দেয়া আতিথ্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা
সংগত নয়।
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত কয়েকটি রেওয়ায়েত সাঈদ ইবনে মানসুর, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনুল মুনযির নির্ভরযোগ্য সনদ সহকারে উমর থেকে উদ্ধৃত
করেছেন। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, সাহাবায়ে কেরামের যুগে কুরআন ও
নবী সা.এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে এ মনীষীগণ লজ্জাশীলতার ইসলামী ধারণা লাভ
করেছিলেন তা অপরিচিত ও ভিন্ পুরুষদের সামনে চেহারা খুলে রেখে ঘোরাফেরা করা এবং
বেপরোয়াভাবে ঘরের বাইরে চলাফেরা করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। উমর রা. পরিষ্কার ভাষায় এখানে চেহারা ঢেকে
রাখাকে লজ্জাশীলতার চিহ্ন এবং তা ভিন পুরুষের সামনে উন্মুক্ত রাখাকে নির্লজ্জতা
গণ্য করেছেন।
﴿قَالَتْ
إِحْدَاهُمَا يَا أَبَتِ اسْتَأْجِرْهُ ۖ إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ
الْأَمِينُ﴾
২৬) মেয়ে দু'জনের একজন তার পিতাকে বললো, "আব্বাজান! একে চাকরিতে নিয়োগ
করো, কর্মচারী
হিসেবে ব্যক্তিই উত্তম হতে পারে যে বলশালী ও আমানতদার।"৩৭
৩৭. হযরত মূসার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় মেয়েটি তার বাপকে
একথা বলেছিল কিনা এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বেশির ভাগ সম্ভবনা এটাই যে, তার বাপ পরিচিত মুসাফিরকে দু-একদিন
নিজের কাছে রেখে থাকবেন এবং এ সময়ের মধ্যে কথনো মেয়ে তার বাপকে এ পরামর্শ দিয়ে
থাকবে। এ পরামর্শের অর্থ ছিল, আপনার বার্ধক্যের কারণে বাধ্য
হয়ে আমাদের মেয়েদের বিভিন্ন কাজে বাইরে বের হতে হয়। বাইরের কাজ করার জন্য আমাদের কোন ভাই নেই। আপনি এ ব্যক্তিকে কর্মচারী নিযুক্ত করুন। সুঠাম দেহের অধিকারী বলশালী লোক। সবরকমের পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে। আবার নির্ভরযোগ্যও । নিছক নিজের ভদ্রতা ও আভিজাত্যের কারণে সে আমাদের মতো
মেয়েদেরকে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাদের সাহায্য করেছে এবং আমাদের দিকে কখনো
চোখ তুলে তাকায়ওনি।
﴿قَالَ
إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَىٰ أَن تَأْجُرَنِي
ثَمَانِيَ حِجَجٍ ۖ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِندِكَ ۖ وَمَا أُرِيدُ أَنْ
أَشُقَّ عَلَيْكَ ۚ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ﴾
২৭) তার পিতা (মূসাকে) বললো,৩৮ "আমি আমার এ
দু'মেয়ের মধ্য
থেকে একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই।শর্ত হচ্ছে, তোমাকে আট বছর আমার এখানে
চাকরি করতে হবে। আর যদি দশ বছর পুরো করে দাও, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার
ওপর কড়াকড়ি করতে চাই না। তুমি ইনশাআল্লাহ আমাকে
সৎলোক হিসেবেই পাবে।
৩৮. এ কথাও জরুরী নয় যে, মেয়ের কথা শুনেই বাপ সংগে সংগেই হযরত
মূসাকে এ কথা বলে তাকবেন। সম্ভবত তিনি মেয়ের পরামর্শ সম্পর্কে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করার পর এই মত
স্থির করেছিলেন যে, লোকটি ভদ্র ও অভিজাত, একথা ঠিক। কিন্তু ঘরে যেখানে জোয়ান মেয়ে রয়েছে সেখানে
একজন জোয়ান, সুস্থ্য, সবল লোককে এমনি কর্মচারী হিসেবে রাখা ঠিক
নয়। এ ব্যক্তি যখন ভদ্র, শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান ও অভিজাত বংশীয় (যেমন হযরত মূসার মুখে তাঁর কাহিনী শুনে তিনি
মনে করে থাকবেন) তখন একে জামাতা করেই ঘরে
রাখা হোক। এ সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর কোন
উপযুক্ত সময়ে তিনি হযরত মূসাকে এ কথা বলে থাকবেন।
এখানে দেখুন বনী ইসরাঈলের আর একটি কীর্তি। তারা তাদের মহান মর্যাদাসম্পন্ন নবী এবং নিজেদের সবচেয়ে বড়
হিতকারী ও জাতীয় হিরোর কী দুর্গতি করেছে। তালমূদে বলা হয়েছে, "মূসা রূয়েলের বাড়িতে অবস্থান করতে
থাকেন। তিনি নিজের মেজবানের মেয়ে
সফুরার প্রতি অনুগ্রহ দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে বিয়ে করলেন।" আর একটি ইহুদী বর্ণনা জুয়িশ
ইনসাইক্লোপেডিয়ায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে,
"হযরত মূসা যখন যিথ্রোকে সমস্ত ঘটনা শুনালেন তখন তিনি বুঝতে
পারলেন এ ব্যক্তির হাতেই ফেরাউনের রাজ্য ধ্বংস হবার ভবিষ্যতদ্বানী করা হয়েছিল। তাই তিনি সংগে সংগেই হযরত মূসাকে বন্দী করে
ফেললেন, যাতে তাঁকে ফেরাউনের হাতে সোপর্দ করে দিয়ে পুরস্কার লাভ করতে পারেন। সাত বা দশ বছল পর্যন্ত তিনি তার বন্দীশালায়
থাকলেন। ভূ-গর্ভস্থ একটি অন্ধকার কুঠুরীতে
তিনি বন্দী ছিলেন। কিন্তু যিথ্রোর মেয়ে সফূরা
(বা সাফূরা), যার সাথে কূয়ার পাড়ে তাঁর প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল, চুপি
চুপি তার সাথে কারাগৃহে সাক্ষাত করতে থাকে। সে তাকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করতো। তাদের দুজনের মধ্যে বিয়ের গোপন চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। সাত বা দশ বছর পর যাফূরা তার বাপকে বললো এত
দীর্ঘকাল হয়ে গেল আপনি এক ব্যক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তারপর তার কোন
খবরও নেননি। এতদিন তার মরে যাবারই কথা। কিন্তু যদি জীবিত থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে কোন
আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি।
যিথ্রো তার একথা শুনে কারাগারে গেলেন। সেখানে হযরত মূসাকে জীবিত থাকতে দেখে তার মনে বিশ্বাস জন্মালো অলৌকিকতার
মাধ্যমে এ ব্যক্তি জীবিত আছে। তখন তিনি যাফূরার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন।"
যেসব পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদ কুরআনী কাহিনীগুলোর উৎস খুঁজে বেড়ান, কুরআনী বর্ণনা ও ইসরাঈলী
বর্ণনার মধ্যে এই যে সুস্পষ্ট পার্থক্য এখানে দেখা যাচ্ছে তা কি কখনো তাদের চোখে
পড়ে?
﴿قَالَ
ذَٰلِكَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ ۖ أَيَّمَا الْأَجَلَيْنِ قَضَيْتُ فَلَا عُدْوَانَ عَلَيَّ
ۖ وَاللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِيلٌ﴾
২৮) মূসা জবাব দিল,"আমার ও আপনার মধ্যে একথা
স্থিরীকৃত হয়ে গেলো, এ দু'টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেটাই
আমি পূরণ করে দেবো তারপর আমার ওপর যেন কোন চাপ দেয়া না হয়। আর যা
কিছু দাবী ও অঙ্গীকার আমরা করছি আল্লাহ তার তত্বাবধায়ক।"৩৯
৩৯. কেউ কেউ হযরত মূসার সাথে মেয়ের বাপের এ কথাবার্তাকে বিয়ের
ইজাব কবুল মনে করে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, বাপের সেবা মেয়ের বিয়ের
মোহরানা হিসেবে গণ্য হতে পারে কিনা? এবং বিয়ে অনুষ্ঠানের
ক্ষেত্রে এ ধরনের বাইরের শর্ত শামিল হতে পারে কি? অথচ আলোচ্য
আয়াতের ভাষ্য থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে একথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এটি
বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল না। বরং এটি ছিলো প্রাথমিক কথাবার্তা, বিয়ের পূর্বে বিয়ের প্রস্তাব আসার পর
সাধারণভাবে দুনিয়ায় যে ধরনের কথাবার্তা হয়ে থাকে। এটা কেমন করে বিয়ের ইজাব কবুল হতে পারে যখন একথাই
স্থিরীকৃত কৃত হয়নি দু'টি মেয়ের মধ্য থেকে কোনটি কোনটির সাথে বিয়ে দেয়া হচ্ছে? কথাবার্তা শুধূ এতটুকু হয়েছিল যেঃ "আমার মেয়েদের মধ্য থেকে একটির
সাথে আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই। তবে শর্ত হচ্ছে, তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আট দশ বছর আমার এখানে
থেকে আমার কাজে সাহায্য করতে হবে। কারন এ আত্মীয়তা সম্পর্ক সংস্থাপনের পেছনে আমার আসল উদ্দেশ্য
হচ্ছে, আমি বৃদ্ধ
লোক কোন ছেলে সন্তান আমার নেই, যে আমার সম্পত্তি দেখাশুনা ও
ব্যবস্থাপনা করতে পারে। আমার আছে মেয়ে।
বাধ্য হয়ে তাদেরকে আমি বাইরে পাঠাই। আমি চাই আমার জামাতা আমার দক্ষিণ হস্ত হয়ে থাকবে। এ দায়িত্ব যদি তুমি পালন করতে পারো এবং বিয়ের পরেই স্ত্রীকে
নিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা না তাকে তাহলে আমার মেয়ের বিয়ে আমি তোমার সাথে দেব। হযরত মূসা নিজেই এসময় একটি আশ্রয়ের সন্ধানে
ছিলেন। তিনি এ প্রস্তাব মেনে নিলেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, বিয়ের পূর্বে বর পক্ষ ও কনে
পক্ষের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়ে থাকে এটি ছিলো সে ধরনের একটি চুক্তি। এরপর যথারীতি আসল বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকবে এবং
তাতে মোহরানাও নির্ধারিত হয়ে থাকবে। সে বিয়েতে সেবা কর্মের কোন শর্ত শামিল হওয়ার কোন কারন ছিল না।
﴿فَلَمَّا
قَضَىٰ مُوسَى الْأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ آنَسَ مِن جَانِبِ الطُّورِ نَارًا قَالَ
لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آنَسْتُ نَارًا لَّعَلِّي آتِيكُم مِّنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ
جَذْوَةٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ﴾
২৯) মূসা যখন মেয়াদ পূর্ণ করে দিল,৪০ এবং নিজের
পরিবার পরিজন নিয়ে চললো তখন তূর পাহাড়ের দিক থেকে একটি আগুন দেখতে পেলো।৪১ সে তার পরিবারবর্গকে বললো, "থামো! আমি একটি আগুন দেখছি, হয়তো আমি সেখান থেকে কোন খবর
আনতে পারি অথবা সেই আগুন থেকে কোন অংগারই নিয়ে আসতে পারি যাতে তোমরা আগুন পোহাতে
পারো।"
৪০. হাসান ইবনে আলী ইবনে আবু তালেব রা.মা বলেন, মূসা আ. আট বছরের জায়গায় দশ বছরের মেয়াদ পুরা করেছিলেন। ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে এ বক্তব্যটি নবী সা.
থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন,
قضى موسى اتم الاجلين واطيبهما عشر سنين
"মূসা আ. দু'টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেটি বেশী পরিপূর্ণ
এবং তাঁর শ্বশুরের জন্য বেশী সন্তোষজনক সেটি পূর্ণ করেছিলেন অর্থাৎ দশ বছর।"
৪১. এ সফরে মূসার তূর পাহাড়ের দিকে যাওয়া দেখে অনুমান করা যায়
তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে সম্ভবত মিসরের দিকে যেতে চাচ্ছিলেন। কারণ মাদয়ান থেকে মিসরের দিকে যে পথটি গেছে তূর পাহাড় তার
উপর অবস্থিত। সম্ভবত মূসা মনে করে থাকবেন, দশটি বছর চলে গেছে, যে ফেরাউনের শাসনামলে তিনি মিসর থেকে বের হয়েছিলেন সে মারা গেছে, এখন যদি আমি নীরবে সেখানে চলে যাই এবং নিজের পরিবারের লোকজনদের সাথে
অবস্থান করতে থাকি তাহলে হয়তো আমার কথা কেউ জানতেই পারবে না।
ঘটনা বিন্যাসের দিক দিয়ে বাইবেলের বর্ণনা এখানে কুরআন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
বাইবেল বলে, হযরত মুসা তাঁর শ্বশুরের ছাগল চরাতে চরাতে “প্রান্তরের
পশ্চাদভাগে মেষপাল লইয়া গিয়ো হোরেবে ঈশ্বরের পর্বতে চলে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি
নিজের শ্বশুরের কাচে ফিরে গিয়েছিলেন। এবং তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজের সন্তান
সন্ততি সহকারে মিশরের পথে যাত্রা করেছিলেন। (যাত্রা পুস্তক ৩:
১ এবং ৪:১৮) অপর দিকে
কুরআন বলে, হযরত মূসা মেয়াদ পুরা করার পর নিজের পরিবার পরিজন
নিয়ে মাদয়ান থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং এ সফরে আল্লাহর সাথে কথাবার্তা এবং
নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
বাইবেল ও তালমুদের সম্মিলিত বর্ণনা হচ্ছে< যে ফেরাউনের পরিবারে হযরত মূসা
প্রতিপালিত হয়েছিলেন তাঁর মাদয়ানে অবস্থান কালে সে মারা গিয়েছিল এবং তারপর অন্য
একজন ফেরাউন ছিল মিশরের শাসক।
﴿فَلَمَّا
أَتَاهَا نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ
مِنَ الشَّجَرَةِ أَن يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾
৩০) সেখানে পৌঁছার পর উপত্যকার ডান
কিনারায়৪২ পবিত্র ভূখণ্ডে৪৩ একটি বৃক্ষ থেকে আহ্বান এলো, "হে মূসা! আমিই আল্লাহ। সমগ্র
বিশ্বের অধিপতি।"
৪২. অর্থাৎ মূসার ডান হাতের দিকে যে কিনারা ছিল সেই কিনারায়।
৪৩. অর্থাৎ, আল্লাহর দ্যুতির আলোকে যে ভূখণ্ড আলোকিত হচ্ছিল।
﴿وَأَنْ
أَلْقِ عَصَاكَ ۖ فَلَمَّا رَآهَا تَهْتَزُّ كَأَنَّهَا جَانٌّ وَلَّىٰ مُدْبِرًا وَلَمْ
يُعَقِّبْ ۚ يَا مُوسَىٰ أَقْبِلْ وَلَا تَخَفْ ۖ إِنَّكَ مِنَ الْآمِنِينَ﴾
৩১) আর (হুকুম দেয়া হলো) ছুঁড়ে দাও তোমার লাঠিটি। যখনই মূসা
দেখলো লাঠিটি সাপের মতো মোচড় খাচ্ছে তখনই সে পেছন ফিরে ছুটতে লাগলো এবং একবার
ফিরেও তাকালো না। বলা হলো,"হে মূসা! ফিরে এসো এবং ভয়
করো না, তুমি
সম্পূর্ন নিরাপদ।
﴿اسْلُكْ يَدَكَ فِي جَيْبِكَ
تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوءٍ وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ
ۖ فَذَانِكَ بُرْهَانَانِ مِن رَّبِّكَ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ ۚ إِنَّهُمْ كَانُوا
قَوْمًا فَاسِقِينَ﴾
৩২) তোমার হাত বগলে রাখো উজ্জল হয়ে বের
হয়ে আসবে কোন প্রকার কষ্ট ছাড়াই।৪৪ এবং ভীতিমুক্ত হবার জন্য
নিজের হাত দু'টি চেপে
ধরো।৪৫ এ দু'টি উজ্জল নিদর্শন তোমার রবের
পক্ষ থেকে ফেরাউন ও তার সভাসদদের সামনে পেশ করার জন্য, তারা বড়ই নাফরমান।"৪৬
৪৪. এ মু'জিযা দু'টি তখন মূসাকে দেখানোর কারণ
হচ্ছে, প্রথমত যাতে তার মনে পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে যে
প্রকৃতপক্ষে যে সত্তা বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থার স্রষ্টা, অধিপতি, শাসক ও পরিচালক তিনিই তাঁর সাথে কথা বলছেন। দ্বিতীয়ত এ মু'জিযাগুলো দেখে তিনি এ মর্মে
নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন যে, তাঁকে ফেরাউনের কাছে যে ভয়াবহ
দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে সেখানে তিনি একেবারে খালি হাতে তার মুখোমুখি হবেন না
বরং প্রচণ্ড শক্তিশালী অস্ত্র নিয়ে যাবেন।
৪৫. অর্থাৎ যখন কোন ভয়াবহ মুহূর্ত আসে, যার ফলে তোমার মনে ভীতির
সঞ্চার হয় তখন নিজের বাহু চেপে ধরো। এর ফলে তোমার মন শক্তিশালী হবে এবং ভীতি ও আশংকার কোন রেশই
তোমার মধ্যে থাকবে না।
বাহু বা হাত বলতে সম্ভবত ডান হাত বুঝানো হয়েছে। কারন সাধারনভাবে হাত বললে ডান হাতই বুঝানো হয়। চেপে ধরা দু'রকম হতে পারে। এক, হাত পার্শ্বদেশের সাথে লাপিয়ে চাপ দেওয়া। দুই, এক হাতকে অন্য হাতের বগলের মধ্যে রেখে চাপ দেয়া। এখানে প্রথম অবস্থাটি প্রযোজ্য হবার সম্ভাবনা
বেশি। কারন এ অবস্থায় অন্য কোন
ব্যক্তি অনুভব করতে পারবে না যে, এ ব্যক্তি মনের ভয় দূর করার জন্য কোন বিশেষ কাজ করছে।
হযরত মূসাকে যেহেতু একটি জালেম সরকারের মোকাবিলা করার জন্য কোন সৈন্য সামন্ত ও
পার্থিব সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই পাঠানো হচ্ছিলো তাই তাকে এ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বলা
হয়। বার বার এমন ভয়ানক ঘটনা
ঘটতে যাচ্ছিলো যাতে একজন মহান দৃঢ়চেতা নবীও আতংকমুক্ত থাকতে পারতেন না। মহান আল্লাহ বলেন, এ ধরনের কোন অবস্থা দেখা দিলে
তুমি স্রেফ এ কাজটি করো, ফেরাউন তার সমগ্র রাষ্ট্রশক্তি
ব্যবহার করেও তোমার মনের জোর শিথিল করতে পারবে না।
৪৬. এ শব্দগুলোর মধ্যে এ বক্তব্য নিহিত রয়েছে যে, এ নিদর্শনগুলো নিয়ে ফেরাউনের
কাছে যাও এবং আল্লাহর রাসূল হিসেবে নিজেকে পেশ করে তাকে ও তার রাষ্ট্রীয়
প্রশাসকবৃন্দকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আনুগত্য ও বন্দেগীর দিকে আহবান জানাও। তাই এখানে তাঁর ও নিযুক্তির বিষয়টি সুস্পষ্ট ও
বিস্তারিত বলা হয়নি।
তবে কুরআনের অন্যান্য স্থানে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা ত্ব-হা ও সূরা নাযি'আতে বলা হয়েছেঃ اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ ফেরাউনের কাছে যাও, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে"
সূরা আশ শূরায় বলা হয়েছেঃ وَإِذْ نَادَىٰ رَبُّكَ مُوسَىٰ أَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ "যখন তোমার রব মূসাকে ডেকে
বললেন, যাও জালেম জাতির কাছে, ফেরাউনের
জাতির কাছে।"
﴿قَالَ
رَبِّ إِنِّي قَتَلْتُ مِنْهُمْ نَفْسًا فَأَخَافُ أَن يَقْتُلُونِ﴾
৩৩) মূসা নিবেদন করলো, "হে আমার প্রভু! আমি যে তাদের
একজন লোককে হত্যা করে ফেলেছি, ভয় হচ্ছে, তারা আমাকে মেরে ফেলবে।৪৭
৪৭. এর অর্থ এ ছিল না যে, এ ভয়ে আমি সেখানে যেতে চাই না। বরং অর্থ ছিল, আপনার পক্ষ থেকে এমন কোন
ব্যবস্থা থাকা দরকার যার ফলে আমার সেখানে পৌঁছার সাথে সাথেই কোন প্রকার কথাবার্তা
ও রিসালাতের দায়িত্বপালন করার আগেই তারা যেন আমাকে হত্যার অপরাধে গ্রেফতার করে না
নেয়। কারণ এ অবস্থায় তো আমাকে যে
উদ্দেশ্যে এ অভিযানে সেখানে পাঠানো হচ্ছে তা ব্যর্থ হয়ে যাবে । পরবর্তী ইবারত থেকে একথ স্বতঃস্ফূতভাবে
সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মূসার এ আবেদনের উদ্দেশ্য মোটেই এরূপ ছিল না যে, তিনি
ভয়ে নবুওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ এবং ফেরাউনের কাছে যেতে অস্বীকার করতে চাচ্ছিলেন।
﴿وَأَخِي
هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي
ۖ إِنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ﴾
৩৪) আর আমার ভাই হারূন আমার চেয় বেশী
বাকপটু, তাকে
সাহায্যকারী হিসেবে আমার সাথে পাঠাও, যাতে সে আমাকে সমর্থন দেয়, আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ
করবে।"
﴿قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَكَ
بِأَخِيكَ وَنَجْعَلُ لَكُمَا سُلْطَانًا فَلَا يَصِلُونَ إِلَيْكُمَا ۚ بِآيَاتِنَا
أَنتُمَا وَمَنِ اتَّبَعَكُمَا الْغَالِبُونَ﴾
৩৫) বললেন, তোমার ভাইয়ের সাহায্যে আমি
তোমার শক্তি বৃদ্ধি করবো এবং তোমাদের দু'জনকে এমনই প্রতিপত্তি দান
করবো যে, তারা
তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমার
নিদর্শনগুলোর জোরে তোমার ও তোমাদের অনুসারীরাই বিজয় লাভ করবে।"৪৮
৪৮. আল্লাহর সাথে হযরত মূসার এ সাক্ষাত ও কথাবার্তার অবস্থা এর
চাইতেও বিস্তারিতভাবে সূরা ত্ব-হার ৯ থেকে ৪৮ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন মজীদ এ ব্যাপারে যে বর্ণনা দিয়েছে তাকে
যে ব্যক্তি বাইবেলের যাত্রা পুস্তকের ৩ ও ৪ অধ্যায়ের এতদ সংক্রান্ত বর্ণনার সাথে
তুলনা করবে, সে যদি কিছুটা ভারসাম্যপূর্ন রুচির অধিকারী হয়ে থাকে তাহলে এ দুয়ের মধ্য
থেকে কোনটি আল্লাহর কালাম এবং কোনটি মানুষের তৈরি গল্প বলা যাবে তা সে নিজেই
উপলদ্ধি করতে পারবে। তাছাড়া কুরআনের এ বর্ণনা নাউযুবিল্লাহ বাইবেল ও ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে নকল করা
হয়েছে, না যে
আল্লাহ হযরত মূসাকে তাঁর সাথে সাক্ষাত করিয়েছিলেন তিনি নিজেই আসল ঘটনা বর্ননা
করেছেন, এ ব্যাপারে সে সহজে নিজের মত স্থির করতে পারবে। (আরো বেশি জানতে হলে দেখুন তাফহীমূল কুরআন, সূরা ত্ব-হা, ১৯ টীকা) ।
﴿فَلَمَّا
جَاءَهُم مُّوسَىٰ بِآيَاتِنَا بَيِّنَاتٍ قَالُوا مَا هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّفْتَرًى
وَمَا سَمِعْنَا بِهَٰذَا فِي آبَائِنَا الْأَوَّلِينَ﴾
৩৬) তারপর মূসা যখন তাদের কাছে আমার
সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো নিয়ে পৌঁছুলো তখন তারা বললো, এসব বানোয়াট যাদু ছাড়া আর
কিছুই নয়।৪৯ আর এসব কথা
তো আমরা আমাদের বাপ দাদার কালে কখনো শুনিনি।৫০
৪৯. মূলে বলা হয়েছে سِحْرٌ مُّفْتَرًى "বানোয়াট
যাদু"। এ বানোয়াটকে যদি মিথ্যা
অর্থে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, এ লাঠির সাপে পরিণত হওয়া এবং হাতের ঔজ্জ্বল্য বিকীরণ করা মূল
জিনিসের প্রকৃত পরিবর্তন নয় বরং এটা হচ্ছে নিছক একটি লোক দেখানো প্রতারণামূলক
কৌশল, একে মু'জিযা বলে এ ব্যক্তি
আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। আর যদি একে বানোয়াট অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, এ
ব্যক্তি কোন কৌশল অবলম্বন করে এমন একটি জিনিস তৈরী করে এনেছে, যা দেখতে লাঠির মতো কিন্তু যখন সে সেটাকে ছুঁড়ে দেয় তখন সাপের মতো দেখায়। আর নিজের হাতেও সে এমন কিছু জিনিস মাখিয়ে
নিয়েছে যার ফলে তা বগল থেকে বের হবার পর হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ কৃত্রিম যাদু সে নিজেই তৈরী করেছে কিন্তু
আমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে এ বলে যে, এটি আল্লাহ প্রদত্ত একটি মু'জিযা।
৫০. রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মূসা যেসব কথা বলেছিলেন
সে দিকে ইংগিত করা হয়েছে।
কুরআনের অন্যান্য জায়গায় এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। আন-নাযি'আতে বলা হয়েছে, মূসা তাকে বলেনঃ
هَل لَّكَ إِلَىٰ أَن تَزَكَّىٰ، وَأَهْدِيَكَ إِلَىٰ رَبِّكَ فَتَخْشَىٰ
“তুমি কি পবিত্র-পরিচ্ছন্ন নীতি অবলম্বন করতে আগ্রহী?
এবং আমি তোমাকে তোমার রবের পথ বাতলে দিলে কি তুমি ভীত হবে?”
(আন নাযিআতঃ ১৮-১৯)
সূরা ত্বা-হায়ে বলা হয়েছেঃ
قَدْ جِئْنَاكَ بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكَ ۖ وَالسَّلَامُ عَلَىٰ مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَىٰ، إِنَّا
قَدْ أُوحِيَ إِلَيْنَا أَنَّ الْعَذَابَ عَلَىٰ مَن كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ
“আমরা তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আর যে
ব্যক্তি সঠিক পথের অনুসারী হয় তার জন্য রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা। আমাদের প্রতি
অহী নাযিল করা হয়েছে এ মর্মে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যা
আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” আর
إِنَّا رَسُولَا رَبِّكَ فَأَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ
“আমরা তোমার রবের পয়গাম্বর, তুমি বনী ইসরাঈলকে আমাদের
সাথে যেতে দাও।”
এ কথাগুলো সম্পর্কেই ফেরাউন বলে, আমাদের বাপ দাদারাও কখনো একথা শোনেনি যে,
মিসরের ফেরাউনের উপরেও কোন কর্তৃত্বশালী সত্তা আছে, যে তাকে হুকুম করার ক্ষমতা রাখে, তাকে নির্দেশ দেবার
জন্য কোন লোককে তার দরবারে পাঠাতে পারে এবং যাকে ভয় করার জন্য মিসরের বাদশাহকে
উপদেশ দেয়া যেতে পারে। এ সম্পূর্ণ অভিনব কথা আমরা আজ এক ব্যক্তির মুখে শুনছি।
﴿وَقَالَ
مُوسَىٰ رَبِّي أَعْلَمُ بِمَن جَاءَ بِالْهُدَىٰ مِنْ عِندِهِ وَمَن تَكُونُ لَهُ
عَاقِبَةُ الدَّارِ ۖ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ﴾
৩৭) মূসা জবাব দিল, "আমার রব তার অবস্থা ভালো
জানেন, যে তার
পক্ষ থেকে পথ নির্দেশনা নিয়ে এসেছে এবং কার শেষ পরিণতি ভালো হবে তাও তিনিই ভালো
জানেন, আসলে জালেম
কখনো সফলকাম হয় না।"৫১
৫১. অর্থাৎ তুমি আমাকে যাদুকর ও মিথ্যুক গণ্য করছো কিন্তু আমার
রব আমার অবস্থা ভালো জানেন। তিনি জানেন তাঁর পক্ষ থেকে যাকে রাসূল নিযুক্ত করা হয়েছে সে কেমন লোক। পরিণামের ফায়সালা তাঁরই হাতে রয়েছে। আমি মিথ্যুক হলে আমার পরিণাম খারাপ হবে এবং
তুমি মিথ্যুক হলে ভালোভাবে জেনে রাখো তোমার পরিণাম ভালো হবে না। মোট কথা জালেমের মুক্তি নেই, এ সত্য অপরিবর্তনীয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল নয় এবং মিথ্যা রাসূল
সেজে নিজের কোন স্বার্থোদ্ধার করতে চায় সেও জালেম এবং সেও মুক্তি ও সাফল্য থেকে
বঞ্চিত থাকবে। আর যে ব্যক্তি নানা ধরনের
মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সত্য রাসূলকে মিথ্যা বলে এবং ধোঁকাবাজদের সাহায্যে সত্যকে দমন
করতে চায় সেও জালেম এবং সেও কখনো মুক্তি ও সাফল্য লাভ করবে না।
﴿وَقَالَ
فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ
لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَل لِّي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَىٰ
إِلَٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
৩৮) আর ফেরাউন বললো, "হে সভাসদবর্গ! তো আমি নিজেকে
ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না।৫২ ওহে হামান! আমার জন্য ইঁট
পুড়িয়ে একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো তাতে উঠে আমি মূসার প্রভুকে দেখতে
পাবো, আমিতো
তাকে মিথ্যুক মনে করি।"৫৩
৫২. "এ উক্তির মাধ্যমে ফেরাউন যে বক্তব্য পেশ করেছে তার
অর্থ এ ছিল না এবং এ হতেও পারত না যে, আমিই তোমাদের এবং পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। কারন কেবলমাত্র কোন পাগলের মুখ দিয়েই এমন কথা
বের হতে পারত। অনুরূপভাবে এ অর্থ এও ছিল
না এবং হতে পারত না যে, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই। কারন মিশরবাসীরা বহু দেবতার পুজা করত এবং স্বয়ং ফেরাউনকেই
যেভাবে উপাস্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল তাও শুধূমাত্র এই ছিল যে, তাকে সূর্য দেবতার অবতার
হিসেবে স্বীকার করা হতো। সবচেয়ে বড় সাক্ষী কুরআন মজীদ নিজেই। কুরআনে বলা হয়েছে ফেরাউন নিজে বহু দেবতার পূজারী ছিলঃ
وَقَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ
وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ
"আর ফেরাউনের জাতির সরদাররা বলল, তুমি কি মুসা ও তার
জাতিকে অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে দেবে যে, তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি
করুক এবং তোমাকে ও তোমার উপাস্যদেরকে ত্যাগ করুক?" (আল
আ'রাফঃ ১২৭)
তাই ফেরাউন অবশ্যই এখানে "ইলাহ" শব্দটি নিজের জন্য স্রষ্টা ও উপাস্য
অর্থে নয় বরং সার্বভৌম ও স্বয়ং সম্পূর্ণ শাসক এবং তাকে আনুগত্য করতে হবে, এ অর্থে ব্যবহার করেছিল। তার বলার উদ্দেশ্য ছিল, আমি মিশরের এ সরযমীনের মালিক। এখানে আমারই হুকুম চলবে। আমারই আইনকে এখানে আইন বলে মেনে নিতে হবে। আমারই স্বত্তাকে এখানে আদেশ ও নিষেধের উৎস বলে
স্বীকার করতে হবে। এখানে অন্য কেউ তার হুকুম
চালাবার অধিকার রাখে না। এ
মুসা কে? সে রাব্বুল আলামীনের প্রতিনিধি সেজে দাঁড়িয়েছে এবং আমাকে এমনভাবে হুকুম
শুনাচ্ছে যেন সে আসল শাসনকর্তা এবং আমি তার হুকুমের অধীন? এ
কারনে সে তার দরবারের লোকদের সম্বোধন করে বলেছিলঃ
يَا قَوْمِ أَلَيْسَ لِي مُلْكُ مِصْرَ وَهَٰذِهِ الْأَنْهَارُ
تَجْرِي مِن تَحْتِي
হে আমার জাতি! মিসরের বাদশাহী কি আমারই নয় এবং এ নদীগুলো কী আমার অধীনে
প্রবাহিত নয়? (আয যুখরুফঃ৫১)
আর এ কারনেই সে বারবার হযরত মুসাকে বলেছিলঃ
أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا
وَتَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ
"তুমি কি এসেছ আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে যে পদ্ধতি চলে আসছে তা থেকে
আমাদের সরিয়ে দিতে এবং যাতে এ দেশে তোমাদের দু'ভাইয়ের
আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়?" (ইউনুসঃ ৭৮)
أَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ أَرْضِنَا بِسِحْرِكَ يَا مُوسَىٰ
"হে মুসা! তুমি কি নিজের যাদুবলে আমাদের ভূখন্ড থেকে আমাদের উৎখাত করতে
এসেছো? (ত্বা-হাঃ
৫৭)
إِنِّي أَخَافُ أَن يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَن يُظْهِرَ فِي
الْأَرْضِ الْفَسَادَ
"আমি ভয় করছি এ ব্যক্তি তোমাদের দ্বীন পরিবর্তিত করে দেবে অথবা দেশে
বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।"(আল মু'মিনঃ২৬)
এদিক দিয়ে চিন্তা করলে যেসব রাষ্ট্র আল্লাহর নবী প্রদত্ত শরীয়তের অধীনতা
প্রত্যাখান করে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের দাবীদার ফেরাউনের
অবস্থা তাদের থেকে ভিন্নতর ছিল না। তারা আইনের উৎস এবং আদেশ নিষেধের কর্তা হিসেবে অন্য কোন বাদশাকে মানুক অথবা
জাতির ইচ্ছার আনুগত্য করুক যতক্ষণ তারা এরূপ নীতি অবলম্বন করে চলবে যে দেশে আল্লাহ
ও তার রাসুলের নয় বরং আমাদের হুকুম চলবে, ততক্ষণ তাদের ও ফেরাউনের নীতি ও ভূমিকার
মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য থাকবে না। এটা ভিন্ন কথা যে, অবুঝ লোকেরা একদিকে ফেরাউনকে অভিসম্পাত
করতে থাকে, অন্যদিকে ফেরাউনী রীতিনীতির অনুসারী এসব শাসককে
বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্যের জ্ঞান রাখে, সে শব্দ ও পরিভাষা নয়, অর্থ ও প্রাণশক্তি দেখবে। ফেরাউন নিজের জন্য "ইলাহ" শব্দ ব্যবহার করছিল
এবং এরা সেই একই অর্থে সার্বভৌমত্বের পরিভাষা ব্যবহার করছে, এতে এমন কী পার্থক্য সৃষ্টি
হয়! (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা
ত্বা-হা ২১ টীকা।) "
৫৩. "বর্তমান যুগের রুশীয় কম্যুনিষ্টরা একই ধরনের
মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে। তারা স্পুটনিক ও লুনিকে চড়ে মহাশূন্যে উঠে দুনিয়াবাসীকে খবর দিচ্ছে, আমাদের মহাশূন্য যাত্রীরা উপরে
কোথাও আল্লাহর সন্ধান পায়নি। [অবশ্য ১৯৯১ তে এসে রুশী কম্যুনিষ্টদের আর আল্লাহর সন্ধানে স্পুটনিকে ও
লুনিকে চড়তে হচ্ছেনা। এখন বাস্তবতার প্রচন্ড আঘাতে তারা কম্যুনিজম ত্যাগ করে
আল্লাহকে স্বীকৃতি দেবার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। -অনুবাদক] ওদিকে এ নির্বোধটিও
মিনারে উঠে আল্লাহ কে দেখতে চাচ্ছিল। এ থেকে জানা যায়, বিভ্রান্ত লোকদের মানসিকতা সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যেমনটি ছিল আজো তেমনটিই
আছে। এদিক দিয়ে তারা এক ইঞ্চি
পরিমানও উন্নতি করতে পারেনি। জানিনা কোন আহাম্মক তাদেরকে এ খবর দিয়েছিল যে, আল্লাহ বিশ্বাসী লোকেরা যে
রব্বুল আলামীনকে মানে তিনি তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী উপরে কোথাও বসে আছেন। আর এ কুলকিনারাহীন মহাবিশ্বে কয়েক হাজার ফুট
বা কয়েক লাখ মাইল উপরে উঠে যদি তারা তাঁর সাক্ষাত না পায় তাহলে যেন এ কথা পুরোপুরি
প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, তিনি কোথাও নেই।
কুরআন এখানে এ কথা বলছে না যে, ফেরাউন সত্যি সত্যিই একটি ইমারত এ
উদ্দেশ্যে বানিয়েছিল এবং তাতে উঠে আল্লাহকে দেখার চেষ্টা করেছিল। বরং কুরআন শুধুমাত্র তার এ উক্তি উদ্ধৃত করছে। এ থেকে আপাতদৃষ্টে মনে হয় সে কার্যত এ বোকামি
করেনি। এ কথাগুলোর মাধ্যমে
কেবলমাত্র মানুষকে বোকা বানানোই ছিল তার উদ্দেশ্য।
ফেরাউন সত্যিই বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করত, না নিছক জিদ ও হঠকারিতার
বশবর্তী হয়ে নাস্তিক্যবাদী কথাবার্তা বলত, তা সুস্পষ্টভাবে
জানা যায় না।
তার উক্তিগুলো থেকে ঠিক একই ধরনের মানসিক অস্থি'রতার সন্ধান পাওয়া যায় যেমন রুশ
কম্যুনিষ্টদের কথাবার্তায় পাওয়া যায়। কখনো সে আকাশে উঠে দুনিয়াবাসীকে জানাতে চাইতো, আমি উপরে সব দেখে এসেছি,
মুসার আল্লাহ কোথাও নেই। আবার কখনো বলতো-
فَلَوْلَا أُلْقِيَ عَلَيْهِ أَسْوِرَةٌ مِّن
ذَهَبٍ أَوْ جَاءَ مَعَهُ الْمَلَائِكَةُ مُقْتَرِنِينَ
"যদি সত্যিই মূসা আল্লাহর প্রেরিত হয়ে থাকে, তাহলে কেন তার জন্য সোনার
কাঁকন অবতীর্ন হয়নি অথবা ফেরেশতারা তার আরদালী হয়ে আসেনি কেন?"
এ কথাগুলো রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিঃ ক্রুশ্চেভের কথা থেকে মোটেই
ভিন্নতর নয়। তিনি কখনো আল্লাহ কে
অস্বীকার করতেন আবার কখনো বারবার আল্লাহর নাম নিতেন এবং তাঁর নামে কসম খেতেন। আমাদের অনুমান, হযরত ইউসুফ আ. ও তাঁর খলিফাদের
যুগ শেষ হবার পর মিসরে কিব্তী জাতীয়তাবাদের শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং স্বদেশ প্রীতির
ভিত্তিতে দেশে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়। এ সময় নতুন নেতৃত্ব জাত্যাভিমানের আবেগে আল্লাহর বিরুদ্ধেও
বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হযরত ইউসুফ ও তাঁর অনুসারী
ইসরাঈলী এবং মিসরীয় মুসলমানরা তাদেরকে আল্লাহকে মেনে চলার দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন। তারা মনে করলো, আল্লাহকে মেনে নিয়ে আমরা
ইউসুফীয় সংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত হতে পারবো না এবং এ সংস্কৃতি জীবিত থাকলে আমাদের
রাজনৈতিক প্রভাবও শক্তিশালী হতে পারবে না। তারা আল্লাহকে স্বীকৃতি দেবার সাথে মুসলিম কর্তৃত্ব কে
অংগাংগীভাবে জড়িত মনে করেছিল। তাই একটির হাত থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য অন্যটিকে অস্বীকার করা তাদের জন্য
জরুরী ছিল, যদিও তার অস্বীকৃতি তাদের অন্তরের ভেতর থেকে বের হয়েও বের হচ্ছিল না।"
﴿وَاسْتَكْبَرَ
هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لَا
يُرْجَعُونَ﴾
৩৯) সে এবং তার সৈন্যরা পৃথিবীতে কোন
সত্য ছাড়াই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করলো৫৪ এবং মনে করলো তাদের কখনো
আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না।৫৫
৫৪. অর্থাৎ এ বিশ্ব জাহানে একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনই
শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
কিন্তু ফেরাউন এবং তার সৈন্যরা পৃথিবীর একটু ক্ষুদ্র অংশে সামান্য একটু কর্তৃত্বের
অধিকারী হয়ে মনে করে বসলো এখনো একমাত্র তারাই শ্রেষ্ঠ এবং তাদেরই সর্বময় কর্তৃত্ব
ও আধিপত্য বিরাজিত।
৫৫. অর্থাৎ, তারা নিজেদের ব্যাপারে মনে করলো তাদেরকে কোথাও জিজ্ঞাসিত হতে
হবে না। আর তাদেরকে কারো কাছে
জবাবদিহি করতে হবে না মনে করে তারা স্বেচ্ছাচারমূলক কাজ করতে লাগলো।
﴿فَأَخَذْنَاهُ
وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ ۖ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ﴾
৪০) শেষে আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে
পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম।৫৬ এমন এ জালেমদের পরিণাম কি
হয়েছে দেখে নাও।
৫৬. এ শব্দগুলোর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ তাদের মিথ্যা অহমিকার
মোকাবেলায় তাদের নিকৃষ্টতা ও হীনতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তারা নিজেদেরকে অনেক বড় কিছু মনে করে বসেছিল। কিন্তু সঠিক পথে আসার জন্য আল্লাহ্ তাদেরকে যে
অবকাশ দিয়েছিলেন তা যখন খতম হয়ে গেলো তখন তাদেরকে এমনভাবে সাগরে নিক্ষেপ করা হলো
যেমন খড়কুটা ও ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করা হয়।
﴿وَجَعَلْنَاهُمْ
أَئِمَّةً يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يُنصَرُونَ﴾
৪১) তাদেরকে আমি জাহান্নামের দিকে
আহবানকারী নেতা করেছিলাম৫৭ এবং
কিয়ামতের দিন তারা কোথাও থেকে কোন সাহায্য লাভ করতে পারবে না।
৫৭. অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা একটি দৃষ্টান্ত কায়েম
করে গেছে। জুলুম কিভাবে করা হয়, সত্য অস্বীকার করে শেষ মুহূর্ত
পর্যন্ত তার উপর কিভাবে অবিচল থাকা যায় এবং সত্যের মোকাবিলায় বাতিলের জন্য লোকেরা
কেমন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, এসব তারা করে দেখিয়ে
দিয়ে গেছে। দুনিয়াবাসীকে এসব পথ দেখিয়ে
দিয়ে তারা জাহান্নামের দিকে এগিয়ে গেছে। এখন তাদের উত্তরসূরীরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে সেই
মনযিলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
﴿وَأَتْبَعْنَاهُمْ
فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ هُم مِّنَ الْمَقْبُوحِينَ﴾
৪২) এ দুনিয়ায় আমি তাদের পেছনে লাগিয়ে
দিয়েছি অভিসম্পাত এবং কিয়ামতের দিন তারা হবে বড়ই ঘৃণার্হ ও ধিকৃত।৫৮
৫৮. মূলে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন তারা "মাকবূহীন"দের
অন্তরভুক্ত হবে। এর
কয়েকটি অর্থ হতে পারে।
তারা হবে প্রত্যাখ্যাত ও বহিস্কৃত । আল্লাহর রহমত থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হবে। তাদের অবস্থা বড়ই শোচনীয় করে দেয়া হবে। তাদের চেহারা বিকৃত করে দেয়া হবে।
﴿وَلَقَدْ
آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ مِن بَعْدِ مَا أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ الْأُولَىٰ بَصَائِرَ
لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
৪৩) পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোকে ধ্বংস করার
পর আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম লোকদের জন্য আত্মজ্ঞান লাভের সহায়ক, পথনির্দেশনা ও রহমত হিসেবে, যাতে লোকেরা শিক্ষা গ্রহণ করে।৫৯
৫৯. অর্থাৎ পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলো যখন পূর্বের নবীদের
শিক্ষাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার অশুভ পরিণাম ভোগ করেছিল এবং ফেরাউন ও তার সৈন্যরা
যে পরিণতি দেখেছিল তাই হলো তাদের শেষ পরিণতি। তখন তার পরে মূসা আ.কে কিতাব দেয়া হয়েছিল, যাতে মানব জাতির একটি নব যুগের
সূচনা হয়।
﴿وَمَا
كُنتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَىٰ مُوسَى الْأَمْرَ وَمَا كُنتَ
مِنَ الشَّاهِدِينَ﴾
৪৪) (হে মুহাম্মদ!) তুমি সে সময় পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত ছিলে না।৬০ যখন মূসাকে এ শরীয়াত দান
করেছিলাম এবং তুমি সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্তও ছিল না।৬১
৬০. পশ্চিম প্রান্ত বলতে সিনাই উপদ্বীপের যে পাহাড়ে মূসাকে
শরীয়াতের বিধান দেয়া হয়েছিল সেই পাহাড় বুঝানো হয়েছে। এ এলাকাটি হেজাযের পশ্চিম দিকে অবস্থিত।
৬১. অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের সত্তর জন প্রতিনিধি যাদেরকে শরীয়াতের
বিধান মেনে চলার অংগীকার করার জন্য মূসার সাথে ডাকা হয়েছিল । (সূরা আ'রাফের ১৫৫ আয়াতে এ প্রতিনিধিদের ডেকে নেবার কথা উল্লেখিত হয়েছে
এবং বাইবেলের যাত্রা পুস্তকের ২৪ অধ্যায়েও এর আলোচনা করা হয়েছে।)
﴿وَلَٰكِنَّا
أَنشَأْنَا قُرُونًا فَتَطَاوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ ۚ وَمَا كُنتَ ثَاوِيًا فِي
أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَلَٰكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ﴾
৪৫) বরং এরপর (তোমার যুগ পর্যন্ত) আমি বহু প্রজন্মের উদ্ভব ঘটিয়েছি এবং তাদের ওপর
অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।৬২ তুমি মাদয়ানবাসীদের মধ্যেও
উপস্থিত ছিলে না, যাতে
তাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে পারতে৬৩ কিন্তু আমি
সে সময়কার এসব তথ্য জানাচ্ছি।
৬২. অর্থাৎ সরাসরি এ তথ্যগুলো লাভ করার কোন উপায় তোমাদের ছিল
না। আজ দু'হাজার বছরের বেশী সময় অতিবাহিত
হয়ে যাবার পরও যে, তোমরা এ ঘটনাবলীকে এমনভাবে বর্ণনা করছো
যেন তোমাদের চোখে দেখা ঘটনা, আল্লাহর অহীর মাধ্যমে এসব তথ্য
তোমাদের সরবরাহ করা হচ্ছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া এর আর কোন কারণ নেই।
৬৩. অর্থাৎ যখন মূসা মাদয়ানে পৌঁছেন, তাঁর সাথে সেখানে যা কিছু ঘটে
এবং দশ বছর অতিবাহিত করে যখন তিনি সেখান থেকে রওয়ানা দেন তখন সেখানে কোথাও আপনার
কোন পাত্তাই ছিল না। আপনি আজ মক্কার অলিতে গলিতে যে কাজ করে বেড়াচ্ছেন সে সময় মাদয়ানে
জনবসতিগুলোতে সে কাজ করতেন না। আপনি চোখে দেখে এ ঘটনাবলীর উল্লেখ করছেন না বরং আমার মাধ্যমেই তোমরা এ জ্ঞানও
লাভ করছো।
﴿وَمَا
كُنتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا وَلَٰكِن رَّحْمَةً مِّن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ
قَوْمًا مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
৪৬) আর তুমি তূর পাহাড়ের পাশেও তখন
উপস্থিত ছিলে না যখন আমি (মূসাকে প্রথমবার) ডেকেছিলাম। কিন্তু
এটা তোমার রবের অনুগ্রহ (যার ফলে তোমাকে এসব তথ্য দেয়া হচ্ছে)৬৪ যাতে তুমি তাদেরকে সতর্ক করো
যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসেনি,৬৫ হয়েতা তারা
সচেতন হয়ে যাবে।
৬৪. এ তিনটি কথাই পেশ করা হয়েছে মুহাম্মদ সা. এর নবুওয়াতের সপক্ষে প্রমান হিসেবে। যখন এ কথাগুলো পেশ করা হয়েছিল তখন মক্কার
সমস্ত সরদার ও সাধারন কাফেররা কোন প্রকারে তাঁকে অ-নবী এবং নাউযুবিল্লাহ নবুওয়াতের
মিথ্যা দাবীদার প্রমান করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। তাদেরকে সাহায্য করার জন্য ইয়াহুদী উলামা ও খৃষ্টান 'রাহিব' তথা
সংসারত্যাগী-যোগী সন্ন্যাসীরাও হেজাযের জনপদগুলোতে উপস্তিত ছিল। আর মুহাম্মদ সা.ও কোন মহাশূন্য থেকে এসে কোরআন
শুনিয়ে যেতেন না। বরং তিনি ছিলেন সেই মক্কারই
বাসিন্দা। তাঁর জীবনের কোন একটি দিকও
তাঁর জনপদ ও গোত্রের লোকদের কাছে গোপন ছিল না। এ কারনেই যখন এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের আকারে নবী সা. এর
নবুওয়াতের প্রমানস্বরূপ এ তিনটি কথা বলা হলো তখন মক্কা, হেজায এবং সারা আরবের কোন এক
ব্যক্তিও উঠে এমন বেহুদা কথা বলেনি যা আজকের পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদরা বলছেন। যদিও মিথ্যা তৈরি করার ব্যাপারে তারা এদের
চেয়ে কম যেতো না তবুও যে ডাহা মিথ্যা এক মুহুর্তের জন্যও চলতে পারে না তা তারা
বলতো কেমন করে। তারা কেমন করে বলতো, হে মুহাম্মদ, তুমি অমুক অমুক ইহুদী আলেম ও খৃষ্টান রাহেবের কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ
করে এনেছো! কারন সারাদেশে এ উদ্দেশ্যে তারা কোন একজনেরও নাম নিতে পারত না। তারা কারো নাম নেবার সাথে সাথেই প্রমান হয়ে
যেত যে, নবী সা. তার কাছ থেকে কোন তথ্য
সংগ্রহ করেননি।
তারা কেমন করে বলতো, হে মুহাম্মদ! বিগত ইতিহাস এবং সাহিত্য ও যাবতীয় বিদ্যার গ্রন্থরাজি
সম্বলিত একটি লাইব্রেরী তোমার আছে! সেই গ্রন্থরাজির সহায়তায় তুমি এসব বক্তৃতা
দিচ্ছো। কারন লাইব্রেরী তো দূরের
কথা, মুহাম্মদ সা.
এর আশে পাশে কোথাও থেকে তারা এসব তথ্য সম্বলিত একটি কাগজের টুকরোও বের করতে সক্ষম
ছিল না। মক্কার প্রতিটি শিশুও জানতো, মুহাম্মদ সা. লেখাপড়া জানা লোক
নন। আবার কেউ একথাও বলতে পারত
না যে, তিনি কিছু
অনুবাদক নিযুক্ত করে রেখেছেন, তারা হিব্রু, সুরিয়ানী ও গ্রীক গ্রন্থরাজি থেকে তরজমা করে তাঁকে দেয়। তারপর তাদের সবচেয়ে বড় বেহায়া লোকটিও এ দাবী
করার সাহস করতো না যে, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বাণিজ্য সফরে গিয়ে আপনি এ তথ্যাবলী সংগ্রহ করে
এনেছিলেন। কারন এ সফরে তিনি একা ছিলেন
না। মক্কারই বাণিজ্যিক কাফেলা
প্রত্যেক সফরে তাঁর সাথে থাকতো। যদি তখন কেউ এ ধরনের দাবী করতো তাহলে শত শত জীবিত সাক্ষী এ সাক্ষ্য দিতো যে, সেখানে তিনি কারো কাছ থেকে কোন
পাঠ নেননি। আর তাঁর ইন্তিকালের পর তো
দু'বছরের মধ্যেই
রোমানদের সাথে মুসলমানরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যদি মিথ্যামিথ্যাই সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে কোন খৃষ্টান রাহেব
বা ইহুদী রব্বির সাথে নবী সা. কোন আলাপ
আলোচনা করে থেকে থাকতেন তাহলে রোমান সরকার তিলকে তাল করে দিত এবং এ প্রপাগন্ডা
করতে একটুও পিছপাও হতো না যে, মুহাম্মদ সা. (নাউযুবিল্ল্হ)
সবকিছু এখান থেকে শিখে গেছেন এবং এখান
থেকে মক্কায় গিয়ে নবী সেজে বসেছেন। মোটকথা যে যুগে কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ কুরাইশদের কাফের ও
মুশরিকদের জন্য মৃত্যুর বারতা ঘোষণা করত এবং তাকে মিথ্যা বলার প্রয়োজন বর্তমান
যুগের পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদদের তুলনায় তাদের জন্য ছিল অনেক বেশি, সে যুগে কোন ব্যক্তিও কোথাও
থেকে এমন কোন উপাদান সংগ্রহ করে আনতে পারেনি যা থেকে একথা প্রমান হতে পারতো যে,
মুহাম্মদ সা. এর কাছে ওহী ছাড়া এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করার দ্বিতীয় এমন
কোন মাধ্যম আছে যার উল্লেখ করা যেতে পারে।
এ কথাও জেনে রাখা উচিত, কুরআন এই চ্যালেঞ্জ শুধু এখানেই দেয়নি বরং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কাহিনী
প্রসঙ্গে দিয়েছে।
হযরত যাকারিয়া ও হযরত মারয়ামের কাহিনী বর্ণনা করে বলেছেঃ
ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ
إِلَيْكَ ۚ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ
أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ
يَخْتَصِمُونَ
"এ হচ্ছে অদৃশ্য খবরের অন্তরভূক্ত, যা আমি ওহীর
মাধ্যমে তোমাকে দিচ্ছি। তুমি তাদের আশেপাশে কোথাও ছিলে না যখন তারা মারয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বকে
গ্রহন করবে একথা জানার জন্য তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল। তুমি তখনও উপস্থিত ছিলে না যখন তারা ঝগড়া করছিল। (আলে ইমরানঃ ৪৪)
হযরত ইউসুফের কাহিনী বর্ণনা করার পর বলা হচ্ছেঃ
ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ
وَهُمْ يَمْكُرُونَ
"এ হচ্ছে গায়েবের খবরের অন্তরভূক্ত, যা আমি ওহীর
মাধ্যমে তোমাকে দিচ্ছি। তুমি তাদের (অর্থাৎ ইউসুফের ভাইদের) আশেপাশে কোথাও উপস্থিত ছিলে না। যখন তারা নিজেদের করনীয় সম্পর্কে ঐকমত্য পোষন
করেছিল এবং যখন তারা ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল।" (ইউসুফঃ ১০২)
অনুরূপভাবে হযরত নূহের বিস্তারিত কাহিনী বর্ননা করে বলা হয়েছেঃ
تِلْكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهَا إِلَيْكَ ۖ مَا كُنتَ تَعْلَمُهَا أَنتَ وَلَا قَوْمُكَ مِن قَبْلِ
هَٰذَا
"এ কথাগুলো গায়েবের খবরের অন্তরভূক্ত, যা আমি তোমাকে
অহীর মাধ্যমে জানিয়েছি। তোমার ও তোমার জাতির ইতিপূর্বে এর কোন জ্ঞান ছিল না।" (হুদঃ ৪৯)
এ জিনিসটির বার বার পুনরাবৃত্তি থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব এবং মুহাম্মদ সা. যে আল্লাহর রাসূল
তার একটি প্রধান যুক্তি এই ছিল যে, শত শত হাজার হাজার বছর
আগে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা আসছে একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ থেকে। ওহী ছাড়া সেগুলো জানার কোন উপায় তাঁর করায়ত্ব
নেই। যেসব গুরুত্বপূর্ণ কারনের
ভিত্তিতে নবী সা. এর সমকালীন লোকেরা বিশ্বাস করতে চলেছিল যে, যথার্থই তিনি আল্লাহর নবী এবং
তাঁর কাছে আল্লাহর ওহী আসে এ জিনিসটি ছিল তাঁর অন্যতম। এখন যেকোন ব্যক্তি নিজেই ধারনা করতে পারে, ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীদের
জন্য সে যুগে এ চ্যালেঞ্জের প্রতিবাদ করা কতটা গুরুত্ববহ হয়ে থাকতে পারে এবং তারা
এর বিরুদ্ধে প্রমান সংগ্রহ করার জন্য কিভাবে সর্বাত্নক চেষ্টা চালিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া এটাও অনুমান করা যেতে পারে যে, যদি এ চ্যালেঞ্জের মধ্যে
সামান্যতমও কোন দুর্বলতা থাকত তাহলে তাকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য সাক্ষ-প্রমান
সংগ্রহ করা সমকালীন লোকদের জন্য কঠিন হতো না।
৬৫. আরবে হযরত ইসমাঈল ও হযরত শো'আইব আ. ছাড়া আর কোন নবী আসেননি। প্রায় দু'হাজার বছরের এ সুদীর্ঘ সময়ে বাইরের নবীদের
দাওয়াত অবশ্যই সেখানে পৌঁছেছে। যেমন হযরত মূসা, হযরত সুলাইমান ও হযরত ঈসা আ. এর দাওয়াত। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন নবীর আবির্ভাব সেখানে ঘটেনি।
﴿وَلَوْلَا
أَن تُصِيبَهُم مُّصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ فَيَقُولُوا رَبَّنَا لَوْلَا
أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آيَاتِكَ وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
৪৭) (আর আমি এজন্য করেছি যাতে) এমনটি যেন না হয় যে, তাদের নিজেদের কৃতকর্মের
বদৌলতে কোন বিপদ তাদের ওপর এসে যায়, আর তারা বলে, "হে আমাদের রব! তুমি কেন
আমাদের কাছে কোন রাসূল পাঠাওনি? তাহলে তো আমরা তোমার আয়াত মেনে চলতাম এবং
ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।৬৬
৬৬. এ জিনিসটিকেই কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে রাসূল পাঠাবার কারণ
হিসেবে বর্ণনা করেছে।
কিন্তু এ থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সঠিক হবে না যে, এ উদ্দেশ্যে সব সময় প্রত্যেক
জায়গায় একজন রাসূল আসা উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ায় একজন রসূলের পয়গাম তার সঠিক আকৃতিতে বিদ্যমান থাকে
এবং লোকদের কাছে তা পৌঁছে যাবার মাধ্যমও অপরিবর্তিত থাকে ততক্ষণ কোন নতুন রসূলের
প্রয়োজন হয় না। তবে যদি আগের নবীর আনীত
শরীয়াতের মধ্যে কোন কিছু বৃদ্ধি করার এবং কোন নতুন বিধান দেবার প্রয়োজন হয়, তাহলে নতুন রাসূল আসেন। অবশ্যই যখন নবীদের পয়গাম বিলুপ্ত হয়ে যায় অথবা
গোমরাহীর মধ্যে এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে যায় যে, তা থেকে হেদায়াত লাভের কোন উপায় থাকে না। তখন লোকদের জন্য এ ওজর পেশ করার সুযোগ সৃষ্টি
হয়ে যায যে, আমাদের হক ও বাতিলের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন করার ও সঠিক পথ দেখাবার কোন
ব্যবস্থাই আদতে ছিল না, এ অবস্থায় আমরা কেমন করে হেদায়াত লাভ
করতে পারতাম! এ অজুহাত দেখানোর পথ বন্ধ করার জন্য মহান আল্লাহ্ এ ধরনের অবস্থায়
নবী পাঠান, যাতে এর পর যে ব্যক্তিই ভুল পথে চলবে তাকে সে
জন্য দায়ী করা সম্ভব না হয়।
﴿فَلَمَّا
جَاءَهُمُ الْحَقُّ مِنْ عِندِنَا قَالُوا لَوْلَا أُوتِيَ مِثْلَ مَا أُوتِيَ مُوسَىٰ
ۚ أَوَلَمْ يَكْفُرُوا بِمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ مِن قَبْلُ ۖ قَالُوا سِحْرَانِ تَظَاهَرَا
وَقَالُوا إِنَّا بِكُلٍّ كَافِرُونَ﴾
৪৮) কিন্তু যখন আমার কাছ থেকে সত্য তাদের
কাছে পৌঁছে গেলো তখন তারা বলতে লাগলো, মূসাকে যা দেয়া হয়েছিল কেন তাকে সে সব
দেয়া হলো না?৬৭ এর আগে মূসাকে যা দেয়া হয়েছিল
তা কি তারা অস্বীকার করেনি?৬৮ তারা বললো, "দু'টোই যাদু,৬৯ যা একে
অন্যকে সাহায্য করে।" আর বললো, "আমরা কোনটাই মানি না।"
৬৭. অর্থাৎ হযরত মূসাকে আ. যেসব মু'জিযা দেয়া হয়েছিল হযরত মুহাম্মাদ সা. কে সে
সবগুলো দেয়া হলো না কেন? ইনিও লাঠিকে সাপ বানিয়ে আমাদের
দেখাতেন। এঁর হাতও বগল থেকে বের করার
পর সূর্যের মত উজ্জ্বল বিকিরণ করতো। এঁর ইশারায়ও অস্বীকারকারীদের উপর একের পর এক তুফান এবং আকাশ ও পৃথিবীর
বালা-মুসীবত নাযিল হতো।
ইনিও পাথরের গায়ে লিখিত বিধান এনে আমাদের দিতেন।
৬৮. এ হচ্ছে তাদের অভিযোগের জবাব। এর অর্থ হচ্ছে মুজিজা সত্ত্বেও তোমরা কি মূসা (আঃ) প্রতি ঈমান এনেছিলে? তাহলে আজ মুহাম্মদ সা. এর কাছে
সেগুলোর দাবী করছো কেন? তোমরা নিজেরাই বলছো, মূসাকে এসব মুজিজা দেয়া হয়েছিল কিন্তু তার পরও তোমরা তাকে নবী বলে মেনে
নিয়ে কোনদিন তার আনুগত্য গ্রহণ করোনি। সূরা সাবার ৩১ আয়াতেও মক্কার কাফেরদের এ উক্তি উদ্বৃত করা
হয়েছেঃ "আমরা এই কুরআনও মানবো না, এর আগের কিতাবগুলোকেও মানবো না।"
৬৯. অর্থাৎ কুরআন ও তাওরাত।
﴿قُلْ فَأْتُوا
بِكِتَابٍ مِّنْ عِندِ اللَّهِ هُوَ أَهْدَىٰ مِنْهُمَا أَتَّبِعْهُ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
৪৯) (হে নবী?) তাদেরকে
বলো,
"বেশ, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তাহলে আনো আল্লাহর পক্ষ থেকে
কোন কিতাব, যা এ দু'টির চাইতে বেশী হিদায়াতদানকারী
হবে; আমি তারই
অনুসরণ করবো।"৭০
৭০. অর্থাৎ আমকে তো হিদায়াতের অনুসরণ করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে, তা কারো মনগড়া হলে হবে না। বরং হতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকৃত ও
যথার্থ হিদায়াত। যদি তোমাদের কাছে এমন কোন
কিতাব থাকে যা কুরআন ও তাওরাতের চাইতে ভাল পথ নির্দেশনা দিতে পারে তাহলে তোমরা
তাকে লুকিয়ে রেখেছো কেন? তাকে সবার সামনে নিয়ে এসো। আমি বিনা দ্বিধায় তার বিধান মেনে চলবো।
﴿فَإِن
لَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ ۚ وَمَنْ
أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا
يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
৫০) এখন যদি তারা তোমার এ দাবী পূর্ণ না
করে, তাহলে জেনে
রাখো, তারা আসলে
নিজেদর প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর
হিদায়াত ছাড়াই নিছক নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে হবে? আল্লাহ এ ধরনের জালেমদেরকে
কখনো হিদায়াত দান করেন না।
﴿وَلَقَدْ وَصَّلْنَا لَهُمُ
الْقَوْلَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
৫১) আর আমি তো অনবরত তাদের কাছে (উপদেশ
বাণী) পৌঁছিয়ে দিয়েছি, যাতে তারা গাফলতি থেকে সজাগ
হয়ে যায়।৭১
৭১. অর্থাৎ উপদেশের ব্যাপারে আমি কোন কসুর করিনি। এ কুরআনে আমি অনবরত উপদেশ বিতরন করে এসেছি। কিন্তু যে জিদ ও একগুয়েমি পরিহার করে হৃদয়কে
বিদ্বেষমুক্ত রেখে সত্যকে সোজাসুজি গ্রহন করতে প্রস্তুত হয়ে যায় সে-ই একমাত্র
হিদায়াত লাভ করতে পারে।
﴿الَّذِينَ
آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ مِن قَبْلِهِ هُم بِهِ يُؤْمِنُونَ﴾
৫২) যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম
তারা এর (কুরআন ) প্রতি ঈমান আনে।৭২
৭২. এর অর্থ এটা নয় যে, সমস্ত আহলি কিতাব (ইহুদী ও ঈসায়ী) এর প্রতি ঈমান আনে । বরং সূরা নাযিল হবার সময় যে ঘটনা ঘটেছিল এখানে আসলে সেদিকে
ইশারা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মক্কাবাসীদেরকে
এই মর্মে লজ্জা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, তোমাদের নিজেদের গৃহে যে নিয়ামত এসেছে তাকে
তোমরা প্রত্যাখ্যান করছো। অথচ দূর দেশ থেকে লোকেরা এর খবর শুনে আসছে এবং এর মূল্য অনুধাবন করে এ থেকে
লাভবান হচ্ছে।
ইবনে হিশাম ও বাইহাকী এবং অন্যরা এ ঘটনাকে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বরাত দিয়ে
নিন্মোক্তভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আবিসিনিয়ায় হিজরাতের পর নবী সা.এর নবুওয়াত প্রাপ্তি
এবং তার দাওয়াতের খবর যখন সেই দেশে ছড়িয়ে পড়লো তখন সেখান থেকে প্রায় ২০ জনের একটি
খৃষ্টান প্রতিনিধি দল প্রকৃত অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য মক্কা মু'আয্যামায় এলো। তারা নবী সা.এর সাথে মসজিদে হারামে সাক্ষাৎ
করলো। কুরাইশদের বহু লোকও এ
ব্যাপারে দেখে আশপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রতিনিধি দলের লোকেরা নবী সা.কে কিছু প্রশ্ন করলেন। তিনি সেগুলোর জবাব দিলেন। তারপর তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআন মজীদের
আয়াত তাদের সামনে পাঠ করলেন। কুরআন শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগলো। তারা একে আল্লাহর বাণী বলে অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করলেন এবং
নবীর সা. প্রতি ঈমান আনলেন। মজলিস শেষ হবার পর আবু জেহেল ও তার কয়েকজন
সাথী প্রতিনিধিদলের লোকদেরকে পথে ধরলো এবং তাদেরকে যাচ্ছে তাই বলে তিরস্কার করলো। তাদেরকে বললো, "তোমাদের সফরটাতো বৃথাই
হলো। তোমাদের স্বধর্মীয়রা
তোমাদেরকে এজন্য পাঠিয়েছিল যে, এ ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে তোমরা যথাযথ অনুসন্ধান চালিয়ে
প্রকৃত ও যথার্থ ঘটনা তাদেরকে জানাবে। কিন্তু তোমরা সবেমাত্র তার কাছে বসেছিলে আর এরি মধ্যেই
নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে তার প্রতি ঈমান আনলে? তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কখনো আমরা
দেখিনি।" একথায় তারা জবাব দিল, "ভাইয়েরা, তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা তোমাদের সাথে জাহেলী বিতর্ক করতে চাই না। আমাদের পথে আমাদের চলতে দাও একং তোমাদের পথে চলতে থাকো। আমরা জেনেবুঝে কল্যাণ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত
করতে পারি না।" (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৩২
পৃষ্ঠা এবং আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩ খণ্ড, ৮২ পৃষ্ঠা। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল
কুরআন, সূরা শূ'আরা, ১২৩ টীকা।)
﴿وَإِذَا
يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ قَالُوا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّنَا إِنَّا كُنَّا
مِن قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ﴾
৫৩) আর যখন তাদেরকে এটা শুনানো হয়, তারা বলো, "আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এটি যথার্থই সত্য আমাদের রবের
পক্ষ থেকে, আমরা তো
আগে থেকেই মুসলিম।"৭৩
৭৩. "অর্থাৎ এর আগেও আমরা নবীদের ও আসমানী কিতাবের
আনুগত্য করে এসেছি। তাই ইসলাম ছাড়া আমাদের অন্য
কোন দ্বীন ছিল না। এখন যে নবী আল্লাহর পক্ষ
থেকে কিতাব এনেছেন তাকেও আমরা মেনে নিয়েছি । কাজেই মূলত আমাদের দ্বীনের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং আগেও যেমন আমরা মুসলমান ছিলাম তেমনি এখনও
মুসলমান আছি।
একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ সা. যে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন
কেবলমাত্র তার নামই ইসলাম নয় বরং ""মুসলিম"" পরিভাষাটি
শুধুমাত্র নবী করীমের সা. অনুসারীগণ
পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিল সকল নবীর দ্বীন এবং সব জামানায় তাঁদের সবার
অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। এ মুসলমানেরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোন সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে
থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং আগত নবীকে মেনে
নিয়েছে তাদের ইসলামে কোন ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিল, পরেও তেমনি থেকেছে।
আশ্চর্যের কথা, বড় বড় জ্ঞানী গুনী ও আলেমদের মধ্যেও কেউ কেউ এ সত্যটি অনুধাবন করতে অক্ষম
হয়েছেন। এমনকি এ সুস্পষ্ট আয়াতটি
দেখেও তারা নিশ্চিন-হননি।
আল্লামা সুয়ুতি "মুসলিম" পরিভাষাটি কেবলমাত্র মুহাম্মদ সা. এর উম্মতের
সাথেই বিশেষভাবে জড়িত এ মর্মে বিস-ারিত আলোচনা সম্বলিত একটি বই লিখেছেন। তারপর যখন এ আয়াতটি সামনে এসেছে তখন নিজেই
বলেছেন, এখন তো আমার আক্কেল গুড়-ম হয়ে গেছে। কিন' এরপর বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে দোয়া
করলাম এ মর্মে যে, এ ব্যাপারে আমার হৃদয় প্রসারিত করে দাও। শেষে নিজের অভিমত প্রত্যাহার করার পরিবর্তে
তিনি তারই ওপর জোর দিয়েছেন এবং আয়াতটির কয়েকটি ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। এ ব্যাখ্যাগুলোর একটি অন্যটির চেয়ে বেশি ওজনহীন। যেমন তাঁর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ إِنَّا كُنَّا مِن قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমরা কুরআর আসার আগেই মুসলিম
হয়ে যাবার সংকল্প পোষন করতাম। কারন আমাদের কিতাবসমূহ থেকে আমরা এর আসার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম এবং আমাদের
সংকল্প ছিল, তিনি আসলেই আমরা ইসলাম গ্রহন করে নেব। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ বাক্যাংশে مُسْلِمِينَ শব্দের পরে بِهِ
শব্দ
উহ্য রয়েছে। অর্থ্যাৎ আগে থেকেই আমরা
কুরআন মানতাম। কারন আমরা তার আগমনের আশা
পোষন করতাম এবং পূর্বাহ্নেই তাঁর প্রতি ঈমান এনে বসেছিলাম। তাই তাওরাত ও ইন্জিল মানার ভিত্তিতে নয় বরং কুরআনকে তাঁর
নাযিল হবার পূর্বে যথার্থ সত্য বলে মেনে নেবার জন্যই আমরা মুসলিম ছিলাম। তৃতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ আল্লাহর তকদীরে পূর্বেই
আমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, মুহাম্মদ সা. ও কুরআনের আগমনে আমরা ইসলাম
গ্রহন করে নেবো ।
তাই আসলে আমরা আগে থেকেই মুসলিম ছিলাম। এই ব্যাখ্যাগুলোর মধ্য থেকে কোনটি দেখে আল্লাহ প্রদত্ত হৃদয়ের প্রশস-তার কোন
প্রভাব সেখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কুরআন কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয় বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্য বর্ণনা
করেছে। কুরআন বলছে, আসল দ্বীন হচ্ছে একমাত্র
""ইসলাম"" (আল্লাহর আনুগত্য) এবং আল্লাহর বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সৃষ্টির জন্য
এছাড়া দ্বিতীয় কোন দ্বীন হতে পারে না। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথ নির্দেশ দেবার
জন্য এসেছেন তিনি এ দ্বীন নিয়েই এসেছেন । আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম
হয়ে থাকার তাগিদ করেছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহর
ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতি যুগে মুসলিমই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র গুটিকয়
আয়াত পেশ করছিঃ
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
"আসলে আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন।" (আল ইমরানঃ ১৯)
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ
"আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অবলম্বন করে তা কখনো গৃহীত হবে
না।" (আল ইমরানঃ ৮৫)
হযরত নূহ আ. বলেনঃ
إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ ۖ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
"আমার প্রতিদান দেবার দায়িত্ব তো আল্লাহর এবং আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি
যেন মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে যাই।"(ইউনুসঃ ৭২) হযরত ইবরাহীম আ.
এবং তাঁর সন-ানদের সম্পর্কে বলা হয়ঃ
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ، وَوَصَّىٰ
بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ
لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ، أَمْ كُنتُمْ
شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ
مِن بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ
وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَٰهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
"যখন রব তাঁকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো আমি মুসলিম
হয়ে গেলাম রব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই অসিয়াত করে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং
ইয়াকুবওঃ হে আমার সন-ানরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দিনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলিম না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো
না। তোমরা কি তখন উপসি'ত ছিলে যখন ইয়াকূবের মৃত্যুর
সময় এসে গিয়েছিল, যখন সে তার পুত্রদের জিজ্ঞেস করেছিল,
আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার বন্দেগী করবে আপনার মাবুদের এবং আপনার
বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের মাবুদের তাঁকে একক মাবুদ
হিসেবে মেনে নিয়ে। আর
আমরা তাঁরই অনুগত মুসলিম।"
(আল বাকারাহঃ ১৩১-১৩৩)
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن
كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا
"ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃষ্টানও ছিল না বরং একনিষ্ট মুসলিম।" (আলে ইমরানঃ ৬৭)
হযরত ইবরাহীম আ. ও ইসমাইল আ. নিজেই দোয়া করেনঃ
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا
أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ
"হে আমাদের রব! আমাকে তোমরা মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো
যে হবে তোমার মুসলিম।"
(আল বাকারাহঃ ১২৮)
فَمَا وَجَدْنَا فِيهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِينَ
হযরত লূতের কাহিনীতে বলা হচ্ছেঃ "আমরা লূতের জাতির জনপদে কএকটি ঘর ছাড়া
মুসলমানদের আর কোন ঘর পাইনি।" (আয-যারিয়াতঃ ৩৬)
হযরত ইউসুফ আ. মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেনঃ
تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
"আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।" (ইউসুফঃ ১০১)
হযরত মূসা আ. তাঁর নিজের জাতিকে বলেনঃ
يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا
إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ
"হে আমার জাতি! যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁরই ওপর ভরসা করো যদি
তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো।" (ইউনুসঃ ৮৪)
বনী ইসরাইলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয় বরং ইসলাম ছিল। বন্ধু ও শত্রু সবাই এ কথা জানতো। কাজেই ফেরাউন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছেঃ
آمَنتُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو
إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
"আমি মেনে নিলাম বনী ইসরাইল যার প্রতি ঈমান এনেছি তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ
নেই এবং আমি মুসলিমদের অন-রভূক্ত।"(ইউনুসঃ ৯০)
বনী ইসরাইলের সকল নবীর দীনও ছিল এ ইসলামঃ
إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ
أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا
"আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যাতে ছিল হোদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগন তারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফায়সালা করতো যারা
ইহুদী হয়ে গিয়েছিল।" (আল মায়েদাহঃ ৪৪)
এটিই ছিল হযরত সুলাইমান আ. এর দীন। সেজন্য সাবার রানী তাঁর প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে বলেছেনঃ
أَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
"আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মুসলিম হয়ে গেলাম।" (আন্ নাম্লঃ ৪৪)
আর এটিই চিল হযরত ঈসা আ. ও তাঁর হাওয়ারীদের (সহযোগী) দীনঃ
وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي
وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ
"আর যখন আমি হাওয়ারীদের কাছে ওহী পাঠালাম এ মর্মে যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার
রসূলের প্রতি তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী
থাকো আমরা মুসলিম।"(আল
মায়েদাহঃ ১১১) যদি সন্দেহ পোষন করা হয় যে, আরবী ভাষায় "ইসলাম"
ও "মুসলিম" শব্দ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন ভাষায় কেমন করে
ব্যবহৃত হতে পারতো, তাহলে বলতে হয় যে, এটা
নিছক একটা অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। কারন এ আরবী শব্দগুলো আসল বিবেচ্য নয়, আরবী ভাষায় এ শব্দগুলো যে অর্থে ব্যবহৃত হয়
সেটিই মূল বিবেচ্য বিষয়। আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে প্রকৃত
দীনটি এসেছে তা খৃষ্টবাদ, মূসাবাদ বা মুহাম্মদবাদ নয় বরং তা
হচ্ছে নবীগন ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহর ফরমানের সামনে আনুগত্যের
শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহর যে বান্দা যেখানেই যে যুগে অবলম্বন করেছে সে
হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও সত্য চিরন-ন সত্য দীনের অনুসারী। যারা এ দীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন-রিকতা
সহকারে গ্রহন করেছে তাদের জন্য মূসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে মুহাম্মদ সা.কে মেনে
নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না বরং হতে হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার
স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী। পক্ষান-রে যারা আম্বিয়া আ. এর উম্মতের মধ্যে না জেনে বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা
তাদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বর্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত
হয়ে গেছে তারা ইহুদী ও খৃষ্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং মুহাম্মদ সা. এর আগমনে তাদের
মূর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারন তারা আল্লাহর শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে
মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয় বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে
তারা প্রমান করে দিয়েছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও "মুসলিম" ছিল না নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন
নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে
রেখেছিল। "
﴿أُولَٰئِكَ
يُؤْتَوْنَ أَجْرَهُم مَّرَّتَيْنِ بِمَا صَبَرُوا وَيَدْرَءُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ
وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾
৫৪) তারা এমন লোক যাদেরকে দু'বার পারিশ্রমিক দেয়া হবে৭৪ এমন অবিচলতার প্রতিদানে যা
তারা দেখিয়েছে।৭৫ তারা ভালো
দিয়ে মন্দের মোকাবিলা করেছে৭৬ এবং আমি
তাদেরকে যা কিছু রিযিক দিয়েছি তা ব্যয় করে।৭৭
৭৪. অর্থাৎ একটি পারিশ্রমিক দেয়া হবে সাইয়েদিনা ঈসা আ. এর প্রতি
ইতিপূর্বে যে ঈমান রাখতো সেজন্য এবং দ্বিতীয় পারিশ্রমিকটি দেয়া হবে এখন মুহাম্মাদ সা.এর
প্রতি ঈমান আনার জন্য।
একথাটিই একটি হাদীসে ব্যক্ত করা হয়েছে। হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবু মূসা আশ'আরী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী সা. বলেছেনঃ
ثلاثة لهم أجران رجل من أهل
الكتاب آمن بنبيه، وآمن بمحمد،
“তিন ব্যক্তি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবে। তাদের একজন হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে আহলি
কিতাবের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং নিজের নবীর প্রতি ঈমান রাখতো, তারপর মুহাম্মদ সা. এর
প্রতি ঈমান আনে।”
৭৫. অর্থাৎ তাদের এ দ্বিগুণ প্রতিদান লাভ করার কারণ হচ্ছে এই
যে, তারা জাতীয়,
বংশীয়,দলীয় ও স্বদেশের স্বার্থপ্রীতি মুক্ত
থেকে দ্বীনের উপর অবিচল ছিল এবং নতুন নবীর আগমনে যে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে
হয়েছিল তাতে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, আসলে তারা ঈসা পূজারী নয়
বরং আল্লাহর পূজারী ছিল। তারা ব্যক্তি ঈসার ভক্ত-অনুরক্ত ছিল না বরং ছিল "ইসলামের"
আনুগত্যকারী। একারণে ঈসার পর যখন অন্য
নবী ঈসার মত সেই একই ইসলাম নিয়ে এলেন তখন তারা দ্বিধাহীন চিত্তে তাঁর নেতৃত্বে
ইসলামের পথ অবলম্বন করলো এবং যারা খৃষ্টবাদের উপর অবিচল ছিল তাদের পথ পরিহার করলো।
৭৬. অর্থাৎ তারা মন্দের জবাব মন্দ দিয়ে নয় বরং ভালো দিয়ে দেয়। মিথ্যার মোকাবিলায় মিথ্যা নয় বরং সত্য নিয়ে
আসে। জুলুমকে জুলুম দিয়ে নয় বরং
ইনসাফ দিয়ে প্রতিরোধ করে।
দুষ্টামির মুখোমুখি দুষ্টামির সাহায্যে নয় বরং ভদ্রতার সাহায্যে হয়।
৭৭. অর্থাৎ তারা সত্যের পথে সম্পদ উৎসর্গও করে। সম্ভবত এখানে এদিকেও ইংগিত করা হয়েছে যে, তারা নিছক সত্যের সন্ধানে হাব্শা
থেকে সফর করে মক্কায় এসেছিল। এ পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের পেছনে তাদের কোন বৈষয়িক লাভের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা যখন শুনল মক্কায় এক ব্যক্তি নবুওয়াতের
দাবী করেছেন তখন তারা নিজেরা সশরীরে এসে অনুসন্ধান চালনো জরুরী মনে করল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে অনুসন্ধানের পর যদি
প্রমাণিত হয় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন সত্য নবী, তাহলে
তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর থেকে পথ-নির্দেশনা লাভ করা থেকে বঞ্চিত থাকবে
না।
﴿وَإِذَا
سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ
سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ﴾
৫৫) আর যখন তারা বাজে কথা শুনেছে,৭৮ একথা বলে
তা থেকে আলাদা হয়ে গেছে যে, "আমাদের কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য এবং
তোমাদের কর্মকাণ্ড তোমাদের জন্য, তোমাদের প্রতি সালাম, আমরা মূর্খদের মতো পথ
অবলম্বন করতে চাই না।"
৭৮. আবু জেহেল ও তার সাথীরা হাবশার খৃষ্টান প্রতিনিধি দলের
সাথে যেসব আজে বাজে কথা বলেছিল সেদিকে ইশারা করা হয়েছে। উপরে ৭২ টীকায় এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
﴿إِنَّكَ
لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ أَعْلَمُ
بِالْمُهْتَدِينَ﴾
৫৬) হে নবী! তুমি যাকে চাও তাকে হিদায়াত
দান করতে পারো না কিন্তু আল্লাহ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন এবং যারা হিদায়াত
গ্রহণ করে তাদেরকে তিনি খুব ভাল করেই জানেন।৭৯
৭৯. আলোচনার প্রেক্ষাপট থেকে একথা প্রকাশিত হয় যে, হাব্শার খৃষ্টানদের ঈমান ও
ইসলামের কথা উল্লেখ করার পর নবী সা.কে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল আসলে মক্কার কাফেরদেরকে লজ্জা
দেয়া। বক্তব্য ছিলঃ অভাগার দল!
তোমরা নিজেদের কপাল কিভাবে পুড়াচ্ছো তা ভেবে দেখো। অন্যেরা কোথায় কেন দূরদেশ থেকে এসে এ নিয়ামতের কল্যাণ লাভে
ধন্য হচ্ছে আর তোমরা তোমাদের নিজেদের গৃহ অভ্যন্তরে এই যে কল্যাণের স্রোতধারা প্রবাহিত
হচ্ছে এ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছো। কিন্তু কথাটা এভাবে বলা হয়েছেঃ হে মুহাম্মদ সা.! তুমি চাচ্ছো তোমার
সম্প্রদায়ের লোকেরা, তোমার ভাই-বন্ধু, বান্ধবরা, তোমার
আত্নীয়-স্বজরা এই আবেহায়াতের সঞ্জীবনী ধারায় লাভবান হোক কিন্তু তুমি চাইলে কি হবে,
হিদায়াত তো আল্লাহর হাতে, যেসব লোকের মধ্যে
তিনি এ হিদায়াত গ্রহন করার আগ্রহ দেখতে পান তাদেরকেই এ কল্যান ধারায় অবগাহন করান। তোমার আত্নীয় পরিজনদের মধ্যে যদি এই আগ্রহ না
দেখা যায় তাহলে এ কল্যাণ তাদের ভাগ্যে কেমন করে জুটতে পারে।
বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে এ আয়াতটি নবী সা. এর চাচা আবু তালেবের
প্রসঙ্গে নাযিল হয়। তাঁর শেষ সময় উপস্থিত হলে
নবী সা. নিজের সামর্থ মোতাবেক কালেমা লা-ইলাহা ইল্লালাহু-এর প্রতি তাঁর ঈমান আনবার
জন্য চুড়ান্ত চেষ্টা চালান। তিনি চাচ্ছিলেন তাঁর চাচা ঈমানের মধ্য দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন। কিন্তু চাচা তা গ্রহন না করে আব্দুল
মুত্তালিবের অনুসৃত ধর্মের মধ্যে অবস্থান করে জীবন দেয়াকে অগ্রাধিকার দেন। এ ঘটনায় আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ
"তুমি যাকে ভালবাসো তাকে হিদায়াত করতে পারো না"
কিন্তু মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণের পরিচিত পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, একটি আয়াত নবীর যামানায় একটি
বিশেষ ঘটনা বা ব্যাপারের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয় তাকে তাঁরা আয়াতটির শানে নুযুল বা
নাযিল হওয়ার উপলক্ষ ও কার্যকারণ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাই এ হাদীসটি এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত তিরমিযী ও মুসনাদে
আহমদ ইত্যাদিতে আবু হুরাইরা (রাঃ) ইবনে
আব্বাস রা. ইবনে উমর রা. প্রমুখ সাহাবীগণ বর্ণিত অন্যান্য হাদীসগুলো থেকে
অনিবার্যভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না যে, সূরা আল কাসাসের এ আয়াতটি আবু তালেবের
ইন্তেকালের সময় নাযিল হয়েছিল। বরং এ থেকে শুধুমাত্র এটুকু জানা যায় যে, এ আয়াতের বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বাস্তবতা এ
ঘটনার সময়ই সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়। যদিও আল্লাহর প্রত্যেকটি বান্দাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা ছিল
নবী করীমের সা. আন্তরিক ইচ্ছা, তথাপি কোন ব্যক্তির কুফরীর উপর
মৃত্যু বরণ করা যদি তার কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হতো এবং ব্যক্তিগত ভালবাসা ও
সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির হিদায়াত লাভ করার তিনি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ও
আকাংখা পোষন করতেন তাহলে তিনি ছিলেন আবু তালেব। কিন্তু তাঁকেই হিদায়াত দান করার শক্তি যখন তিনি লাভ করলেন
না তখন একথা একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কাউকে হিদায়াত দান করা বা কাউকে হিদায়াত
বঞ্চিত করা নবীর কাজ নয়। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। আর আল্লাহর কাছ থেকে এ সম্পদটি কোন আত্নীয়তা ও পারিবারিক
সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষের সত্যানুরাগ, সত্যপ্রীতি ও সত্যাগ্রহী মানসিকতার
ভিত্তিতেই দান করা হয়।
﴿وَقَالُوا
إِن نَّتَّبِعِ الْهُدَىٰ مَعَكَ نُتَخَطَّفْ مِنْ أَرْضِنَا ۚ أَوَلَمْ نُمَكِّن لَّهُمْ
حَرَمًا آمِنًا يُجْبَىٰ إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ رِّزْقًا مِّن لَّدُنَّا
وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৫৭) তারা বলে, "যদি আমরা তোমার সাথে এ
হেদায়াতের অনুসরণ করি তাহলে নিজেদের দেশ থেকে আমাদেরকে উৎখাত করে দেয়া হবে।"৮০ এটা কি সত্য নয়, একটি নিরাপদ হারমকে আমি তাদের
জন্য অবস্থানস্থলে পরিণত করেছি, যেদিকে সব ধরনের ফলমূল চলে আসে আমার পক্ষ
থেকে রিযিক হিসেবে? কিন্তু
তাদের অধিকাংশই জানে না।৮১
৮০. কুরাইশ বংশীয় কাফেররা ইসলাম গ্রহণ না করার অজুহাত হিসেবে
একথাটি বলতো। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে
জানা যাবে, এটিই ছিল তাদের কুফরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কারণ। একথাটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে আমাদের
দেখতে হবে ঐতিহাসিকভাবে সে সময় কুরাইশদের কি মর্যাদা ছিল, যার ওপর আঘাত আসার আশংকা ছিল।
শুরুতে আরবে যে জিনিসটি জন্য কুরাইশ গোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে, সেটি হচ্ছে তাদের হযরত ইসমাঈল
আ. এর বংশধর হওয়ার বিষয়টি আরবীয় বংশধারা দিক দিয়ে সুস্পষ্টভাবে
প্রমাণিত ছিল। এ কারণেতাদের বংশটি চিল আরবদের দৃষ্টিতে পীরজাদার বংশ। তারপর যখন
কুসাই ইবনে কিলাবের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে তারা কাবা গৃহের মুতাওয়াল্লী ও
পরিচালকে পরিণত হলো এবং মক্কায় তাদের আবাস গড়ে উঠলো তখন তাদের গুরুত্ব আগের চেয়ে
অনেক বেশী বেড়ে গেলো। কারণ একণ তারা ছিল আরবের সবচেয়ে বড় তীর্থ স্থানের পরিচালক।
আরবের সকল গোত্রে মধ্যে ধর্মীয় পুরোহিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর হজ্জের কারণে
আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না যারা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতো না। এ কেন্দ্রীয়
মর্যাদাকে পূঁজি করে কুরাইশরা ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ করতে থাকে।
সৌভাগ্যক্রমে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদেরকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি
গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করে। সে সময় রোম, গ্রীস, মিসর ও সিরিয়ার যত প্রকার বাণিজ্য চীন, ভারত,
ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার সাথে চলতো তার সমস্ত পথই ইরান বন্ধ
করে দিয়েছিল। লোহিত সাগরের পথটি ছিল সর্বশেষ পথ। একমাত্র এ পথটিই খোলা ছিল। পরে
ইরান যখন ইয়ামান দখন করে নিল, তখন সে এ পথটিও বন্ধ করে দিল।
একণ আরব বণিকরা একদিকে রোম অধিকৃত এলাকায় পণ্য সম্ভার আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের
বন্দর সমূহে পৌছিয়ে দিতে লাগলো এবং অন্য
দিকে একই বন্দর সমূহ থেকে পূর্বদেশীয় বাণিজ্যপণ্য নিয়ে রোম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন
এলাকায় পৌছাতে থাকলো। এ ছাড়া এ বাণিজ্যটি চালু রাখার আর কোন পথ খোলা ছিল না। এ
অবস্থার ফলে মক্কা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হলো। এ
সময় কুরাইশরাই বলতে গেলে এ ব্যবসায়ের ইজারাদারী লাভ করে বসেছিল। কিন্তু যে সব
উপজাতীয় এলার মধ্য দিয়ে এ বাণিজ্য পথগুলো গিয়েছিল তাদের সাথে আরবদের গভীর বন্ধুত্ব
সম্পর্ক ছাড়া আরবের রাজনৈকি অরাজকতার পরিবেশে এ ব্যবসায়িক আদান প্রদান সম্ভবপর ছিল
না। এ উদ্দেশ্যে কুরইশ সরদাররা শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর করতে
পারতো না। এজন্য তারা সকল উপজাতির সাথে সন্ধিচুক্তি সাক্ষর করে রেখেছিল। ব্যবসায়িক
মুনাফায়ও তাদেরকে অংশীদার করতো। উপজাতীয় শেখ ও প্রভাবশালী সরদারদেরকে মূল্যবান
তোহফা দিয়েও তুষ্ট করতো। এই সংগে পাতা ছিল সূদী ব্যবসায়ের জাল। এতে জড়িয়ে পড়েছিল
প্রায় সকল প্রতিবেশী উপজাতীয় ব্যবসায়ী ও সরদারবৃন্দ।
এ অবস্থায় যখন নবী সা. এর তাওহীদের দাওয়াত সম্প্রসারিত হতে লাগলো তখন বাপ-দাদার
ধর্মের প্রতি অন্ধপ্রীতির চাইতে বড় হয়ে যে জিনিসটি কুরাইশদেরকে তার বিরুদ্ধে
ক্ষেপে ওঠার কারণ হয়ে দেখা দিল সেটি ছিল এই যে, এ দাওয়াতের
ফলে তারা নিজেদের স্বার্থহানির আশংকা করছিল। তারা মনে করছিল, যুক্তিপূর্ণ দলি-প্রমাণের মাধ্যমে শিরক ও মূর্তিপূজা
মিথ্যা ও তাওহীদ সঠিক প্রমানিথ হয়ে গেলেও তো তাকে পরিত্যাগ করে একে গ্রহণ করে নেয়া
আমাদের জন্য ধ্বংসকর হবে। এমনটি করার সাথে সাথেই সমগ্র অধিবাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে
বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কারাগৃহের পরিচালনার দায়িত্ব থেকে আমাদের সরিয়ে দেবে। সন্ধি
চূক্তির ফলে মূর্তিপূজক উপজাতিগুলোর সাথে আমাদের
যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যার ভিত্তিতে আমাদের বাণিজ্য
কাফেরা দিনরাত আরবের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা সবই
ছিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে এ দীনটি আমাদের ধর্মীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি
এবং এই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও অবসান ঘটাবে। বরং বিচিত্র নয় যে, আরবের সমস্ত উপজাতি মিলে আমাদের মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করবে।
এখানে এসে দুনিয়া পূজারীদের প্রজ্ঞা ও অন্তরদৃষ্টির অভাবের এক বিস্ময়কর চিত্র
মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। রাসূলুল্লাহ সা. বরাবর তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করছিলেন যে,
তোমাদের সামনে আমি যে কালেমা পেশ করছি তা মেনে নাও, আরব ও আজম তোমাদের পদানত হয়ে যাবে। (দেখুন তাফহীমুল
কুরআন, সূরা সা’দ, ভূমিকাঃ ঐতিহাসিক পটভূমি) কিন্তু তারা এর মধ্যে নিজেদের মৃত্যু দেখছিল। তারা মনে
করছিল, আমরা আজ যে সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি
লাভ করেছি এও খতম হয়ে যাবে। তারা আশংকা করছিল, এ কালেমা
গ্রহণ করার সাথে সাথেই আমরা এ সরযমীনে এমনই বন্ধু-বান্ধব ও
সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়বো যে, চিল-কাকেরা
আমাদের গায়ের গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা এ দৃশ্য
দেখতে পাচ্ছিল না যে, মাত্র কয়েক বছর পরেই সমগ্র আরব ভূখন্ড
মুহাম্মদ সা. এর অধীনে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার
আওতাভূক্ত হতে যাচ্ছিল। তারপর এ একই প্রজন্মের জীবনকালেই ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর সব দেশই এক
এক করে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাধীন হতে চলছিল। আর এ উক্তির পরে এক শতক অতিক্রান্ত
হবার আগেই কুরাইশ বংশীয় খলিফাগনই সিন্ধু থেকে স্পেন এবং কাফকাজ থেকে ইয়ামেনের
উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত দুনিয়ার একটি বৃহত্তম অংশের শাসন পরিচালনা করতে যাচ্ছিল।
৮১. এটি হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের আপত্তির প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, যে হারামের শান্তি ও নিরাপত্তা
এবং কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বদৌলতে আজ তোমরা এমন যোগ্যতার অধিকারী হয়েছো, যার ফলে সারা দুনিয়ার বাণিজ্যপণ্যের স্রোত এহেন অনুর্বর ধূলিবিবর্ণ
উপত্যকায় চলে আসছে, তার এই নিরাপদ ও কেন্দ্রীয় মর্যাদা কি
তোমাদের কোন কৌশল অবলম্বনের ফলে অর্জিত হয়েছে? আড়াই হাজার
বছর আগে আল্লাহর এক বান্দা জনশূন্য পাহাড়ের মাঝখানে এ পানি ও বৃক্ষলতাহীন উপত্যকায়
তাঁর স্ত্রী ও দুধের বাচ্চাকে নিয়ে এখানে আসেন। তিনি এখানে পাথর ও কাদা দিয়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করেন এবং
একে ডাক দিয়ে বলেন, আল্লাহ একে হারমে পরিণত করেছেন, এসো এ ঘরের দিকে এবং
একে প্রদক্ষিণ করো। এখন ২৫ শতক বছর থেকে এ জায়গাটি আরবের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে, মারাত্মক ধরনের
নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশে দেশের এ একটিমাত্র স্থানে নিরাপত্তা লাভ করা যায়, আরবের আবালবৃদ্ধবণিতা একে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এবং প্রতি বছর হাজার
হাজার মানুষ একে প্রদক্ষিণ করার জন্য চলে আসে। এসব আল্লাহ প্রদত্ত বরকত ও সমৃদ্ধি নয়তো আর কি হতে পারে? এ নিয়ামত লাভের ফলেই তো তোমরা
আরবের সরদার হয়ে গেছো এবং বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বড় অংশ তোমাদের করতলগত হয়েছে। এখন কি তোমরা মনে করো, যে আল্লাহ তোমাদেরকে এ নিয়ামত
দান করেছেন তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে
তোমরা সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে আর তাঁর দ্বীনের অনুগত হয়ে চললেই ধ্বংস হয়ে যাবে?
﴿وَكَمْ
أَهْلَكْنَا مِن قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيشَتَهَا ۖ فَتِلْكَ مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن
مِّن بَعْدِهِمْ إِلَّا قَلِيلًا ۖ وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِينَ﴾
৫৮) আর এমন কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি
যেখানকার লোকেরা তাদের সম্পদ-সম্পত্তির দম্ভ করতো। কাজেই
দেখে নাও, ঐসব তাদের
ঘরবাড়ি পড়ে আছে, যেগুলোর
মধ্যে তাদের পরে কদাচিত কেউ বসবাস করেছে, শেষ পর্যন্ত আমিই হয়েছি
উত্তরাধিকারী।৮২
৮২. এটি তাদের আপত্তির দ্বিতীয় জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, যে ধনদৌলত ও সমৃদ্ধির জন্য তোমরা অহংকারী
হয়ে উঠেছো এবং যার বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশংকায় বাতিলের উপরে টিকে থাকতে ও সত্য থেকে
মুখ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছো সেই জিনিসই এক সময় আদ, সামূদ,
সাবা, মাদয়ান ও লূতের জাতির লোকদের দেয়া
হয়েছিল। এ জিনিস কি তাদেরকে ধ্বংস
থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? মোট কথা জীবন যাপনের উন্নত মানই তো একমাত্র কাম্যবস্তু নয়, যে মানুষ সত্য-মিথ্যার পরোয়া না করে শুধুমাত্র তারই পেছনে পড়ে থাকবে এবং
সঠিক পথ অবলম্বন করলে এ ইপ্সিত মুক্তোখণ্ডটি হস্তচ্যুত হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে বলেই
তা অবলম্বন করতে অস্বীকার করবে। যেসব অসৎ ও ভ্রষ্টতামূলক কাজ অতীতের সমৃদ্ধিশালী জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে
তার উপর টিকে থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে এবং তাদের মতো তোমাদের
উপর কখনো ধ্বংস নেমে আসবে না এর কোন গ্যারাণ্টি কি তোমাদের কাছে আছে?
﴿وَمَا
كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَىٰ حَتَّىٰ يَبْعَثَ فِي أُمِّهَا رَسُولًا يَتْلُو
عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا ۚ وَمَا كُنَّا مُهْلِكِي الْقُرَىٰ إِلَّا وَأَهْلُهَا ظَالِمُونَ﴾
৫৯) আর তোমার রব জনপদগুলো ধ্বংস করেন না
যতক্ষণ না তাদের কেন্দ্রে একজন রাসূল পাঠান, যে তাদের কাছে আমার আয়াত
শুনায়। আর আমি জনপদগুলো ধ্বংস করি না যতক্ষণ না
সেগুলোর বাসিন্দারা জালেম হয়ে যায়।৮৩
৮৩. এটি হচ্ছে তাদের আপত্তির তৃতীয় জবাব। পূর্বে যেসব জাতি ধ্বংস হয়েছিল তাদের লোকেরা জালেম হয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে
ধ্বংস করার পূর্বে নিজের রাসূল পাঠিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রাসূলদের সতর্ক করে দেবার পরও যখন তারা বাঁকা
পথে চলা থেকে বিরত হয়নি তখন তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তোমরা এখন এ একই অবস্থায় পতিত হয়েছো। তোমরাও জালেম হয়ে গেছো। একজন রাসূল তোমাদেরকেও সতর্ক করার জন্য এসেছেন। এখন তোমরা কুফরী ও অস্বীকারের নীতি অবলম্বন
করে নিজেদের আয়েশ-আরাম ও সমৃদ্ধিকে রক্ষা করতে পারবে না বরং উল্টা বিপদের মুখে
ঠেলে দেবে। যে ধ্বংসের আশংকা তোমরা
করছো তা ঈমান আনার জন্য নয় বরং অস্বীকার করার কারণে তোমাদের উপর আপতিত হবে।
﴿وَمَا
أُوتِيتُم مِّن شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَزِينَتُهَا ۚ وَمَا عِندَ
اللَّهِ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾
৬০) তোমাদের যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা নিছক
দুনিয়ার জীবনের সাজ-সরঞ্জাম এবং তার সৌন্দর্য-শোভা আর যা কিছু আল্লাহর কাছে আছে
তা হচ্ছে তার চেয়ে ভালো এবং অধিকতর স্থায়ী। তোমার কি
বিবেচনা করবে না?
﴿أَفَمَن وَعَدْنَاهُ وَعْدًا
حَسَنًا فَهُوَ لَاقِيهِ كَمَن مَّتَّعْنَاهُ مَتَاعَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ثُمَّ
هُوَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الْمُحْضَرِينَ﴾
৬১) আচ্ছা, যাকে আমি উত্তম প্রতিশ্রুতি
দিয়েছি এবং সে তা পেতে যাচ্ছে, সে ব্যক্তি কি কখনো এমন ব্যক্তির মতো
হতে পারে, যাকে আমি
কেবলমাত্র দুনিয়ার জীবনের সাজ-সরঞ্জাম দিয়েছি এবং তারপর কিয়ামতের দিনের শাস্তির
জন্য তাকে হাজির করা হবে?৮৪
৮৪. এটা হচ্ছে তাদের আপত্তির চতুর্থ জবাব। এ জবাবটি বুঝতে হলে প্রথমে দু'টি কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবেঃ
একঃ দুনিয়ার বর্তমান জীবন। এর সময়কাল কারো জন্যই কতকগুলো বছরের বেশী হয়
না। এটি নিছক একটি সফরের সাময়িক
পর্যায় মাত্র। আসল জীবনটি হবে চিরস্থায়ী। সেটি সামনের দিকে আসছে। বর্তমান সাময়িক জীবনে মানুষ যতই সহায়-সম্পদ জমা করুক না
কেন এবং কয়েক বছরের এ জীবনে যতই আয়েশ আরাম করুক, এ জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবেই
এবং এখানকার সমস্ত বিত্ত-বৈভব সবকিছুই এখানে রেখেই তাকে চলে যেতে হবে। এ সংক্ষিপ্ত জীবনকালের আয়েশ আরামের বিনিময়ে
যদি মানুষকে আগামীর অন্তহীন জীবনে চিরকালীন দুরবস্থা ও বিপদের মধ্যে কাটাতে হয়, তাহলে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ
ক্ষতির সওদা করতে পারে না। এর মোকাবিলায় একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এখানে কয়েক বছর বিপদ আপদের মধ্যে জীবন
কাটিয়ে দেয়াকে প্রাধান্য দেবে। সে এর মাধ্যমে এমন সব কল্যাণ ও নেকী উপার্জন করতে চাইল, যা পরবর্তী অন্তহীন জীবনে তার
চিরকালীন আয়েশ আরামের কারণ হবে।
দুইঃ আল্লাহর দীন মানুষের কাছে দাবী করে না যে, সে এ দুনিয়ার জীবনোপকরণ থেকে
লাভবান হতে পারবে না এবং এখানকার রূপ সৌন্দর্য অযথা পদদলিত করে তাকে এগিয়ে যেতে
হবে। তার দাবী শুধু এতটুকু যে, দুনিয়ার জীবনের উপর তাকে
আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ দুনিয়া ধ্বংসশীল এবং আখেরাত চিরস্থায়ী। দুনিয়ার ভোগ-তৃপ্তি নিম্ন পর্যায়ের । পক্ষান্তরে আখেরাতের ভোগ-তৃপ্তি উচ্চ ও উন্নত পর্যায়ের । তাই মানুষকে দুনিয়ার এমন সম্পদ ও সৌন্দর্য
করায়ত্ত করতে হবে যা আখেরাতের চিরন্তন জীবনে তাকে সফলকাম করবে অথবা কমপক্ষে
সেখানকার চিরন্তন ক্ষতির সাগরে তাকে ভাসিয়ে দেবে না। কিন্তু যেখানে মোকাবিলার ব্যাপারে এসে যায় অর্থাৎ দুনিয়ার
সাফল্য ও আখেরাতের সাফল্য পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়ায় সেখানে মানুষের কাছে সত্য
দীনের দাবী এবং ভারসাম্যপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির দাবীও এটিই যে, মানুষ দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য
উৎসর্গ করে দিক এবং এ দুনিয়ার সাময়িক সম্পদ সৌন্দর্যের জন্য সে কখনো এমন পথ
অবলম্বন না করুক যার ফলে তার পরকাল চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায়।
এ দু'টি কথা সামনে রেখে দেখুন উপরের বাক্যগুলোতে আল্লাহ মক্কার কাফেরদেরকে কি
বলছেন।তিনি একথা বলছেন না যে, তোমরা নিজেদের ব্যবসায় গুটিয়ে
নাও, কারবার খতম করে দাও এবং আমার নবীকে মেনে নিয়ে ফকির
দরবেশ হয়ে যাও।
বরং তিনি বলছেন, দুনিয়ার যে ধন সম্পদের জন্য তোমরা পাগলপারা তা অতি সামান্য সম্পদ এবং
দুনিয়ার জীবনে মাত্র সামান্য ক'দিনের জন্য তোমরা তা থেকে
লাভবান হতে পারো।
অন্য দিকে আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে তা এর তুলনায় গুণগত ও পরিমাণগত (Quality and Quantity) দিক দিয়েও ভালো এবং চিরন্তন
স্থায়ীত্বের অধিকারী। তাই যদি তোমরা এ সাময়িক জীবনের সীমাবদ্ধ নিয়ামত দ্বারা লাভবান হবার উদ্দেশ্যে
এমন নীতি অবলম্বন করো যার ফল আখেরাতে চিরন্তন ক্ষতির আকারে ভোগ করতে হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় বোকামি আর কী
হতে পারে? এক ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রম করে নিজের রবের খিদমত করে
এবং তারপর চিরকালের জন্য তাঁর পুরস্কার লাভ করে ধন্য হয়। আর এক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে আল্লাহর আদালতে
অপরাধী হিসেবে আনীত হয় এবং গ্রেফতারীর পূর্বে সে নিছক কয়েকদিন হারাম সম্পদের মজা
লুটবার সুযোগ পায়। এ দু'জনের মধ্যে কে সফলকাম হলো?
তোমরা নিজেরাই তুলনা করে দেখে নাও।
﴿وَيَوْمَ
يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تَزْعُمُونَ﴾
৬২) আর (তারা যেন ভুলে না যায়) সে দিনটি যখন তিনি তাদেরকে ডাকবেন এবং জিজ্ঞেস
করবেন,
"কোথায় তারা যাদেরকে তোমরা আমার শরীক বলে মনে করতে?"৮৫
৮৫. এ ভাষণটিও চতুর্থ জবাবের সাথেই সংশ্লিষ্ট। উপরের আয়াতের শেষ অংশের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, নিছক নিজেদের পার্থিব
স্বার্থের খাতিরে শিরক, মূর্তিপূজা ও নবুওয়াত অস্বীকারের যে
গোমরাহীর ওপর তারা জোর দিচ্ছে, তার জন্য আখেরাতের চিরন্তন
জীবনে তাদের কেমন অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। যে অনুভূতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে একথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে
এই যে, মনো করো,
দুনিয়ায় তোমাদের কোন বিপদের সম্মুখীন হতে না হলেও এবং এখানকার
সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তোমরা দুনিয়ার জীবনের সম্পদ ও সৌন্দর্য খুব বেশি উপভোগ করলেও
যদি আখেরাতে এর পরিণাম খারাপ হওয়াই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে
নিজেই ভেবে দেখো তোমরা যা কিছু করছো তা লাভজনক ব্যবসায় না ক্ষতির ব্যবসায়?
﴿قَالَ
الَّذِينَ حَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَغْوَيْنَا أَغْوَيْنَاهُمْ
كَمَا غَوَيْنَا ۖ تَبَرَّأْنَا إِلَيْكَ ۖ مَا كَانُوا إِيَّانَا يَعْبُدُونَ﴾
৬৩) এ উক্তি যাদের ওপর প্রযোজ্য হবে৮৬ তারা বলবে, "হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই এ
লোকদেরকেই আমরা গোমরাহ করেছিলাম। এদেরকে
ঠিক সেভাবেই গোমরাহ করেছিলাম যেভাবে আমরা নিজেরা গোমরাহ হয়েছিলাম। আমরা
আপনার সামনে দায় মুক্তির কথা প্রকাশ করছি।৮৭ এরা তো আমাদের বন্দেগী করতো
না।"৮৮
৮৬. এখানে জিন ও মানব জাতির শয়তানদের কথা বলা হয়েছে, যাদেরকে দুনিয়ায় আল্লাহর সাথে
শরীক করা হয়েছিল, যাদের কথার মোকাবিলায় আল্লাহ ও রাসূলের কথা
প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং যাদের ওপর ভরসা করে সরল সঠিক পথ পরিত্যাগ করে জীবনের
ভুল পথ অবলম্বন করা হয়েছিল। এ ধরনের লোকদেরকে কেই ইলাহ ও রব বলুক বা না বলুক মোট কথা যখন তাদের আনুগত্য
এমনভাবে করা হয়েছে যেমন আল্লাহর আনুগত্য হওয়া উচিত। তখন অবশ্যই তাদেরকে আল্লাহর সার্বভৌম কতৃর্ত্বে শরীক করা
হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন
তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল কাহ্ফ ৫০ টীকা)
৮৭. আমরা জোর করে এদেরকে গোমরাহ করিনি। আমরা এদের দৃষ্টি ও শ্রবনশক্তি ছিনিয়ে নিইনি। এদের চিন্তা ও অনুধাবন শক্তিও কেড়ে নিইনি এবং
এমন অবস্থারও সৃষ্টি করিনি যে, এরা সঠিক পথের দিকে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু আমরা হাত ধরে টেনে
জোর করে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিলাম। বরং আমরা যেমন স্বেচ্ছায় ভুলপথ অবলম্বন করেছিলাম, তেমনি এদের সামনেও আমরা ভুলপথ
পেশ করেছিলাম এবং এরা স্বেচ্ছয় তা গ্রহন করেছিল। কাজেই আমরা এদের দায়িত্ব গ্রহন করছি না। আমরা নিজেদের কাজের জন্য দায়ী এবং এরা এদের
নিজেদের কাজের জন্য দায়ী।
এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় প্রণিধানযোগ্য। সেটি হচ্ছে আল্লাহ যদিও প্রশ্ন করবেন যারা শরীক করতো
তাদেরকে। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই
জবাব দিতে আরম্ভ করবে তাদের সেই উপাসিতরা যাদেরকে শরীক করা হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, যখন সাধারন মুশরিকদেরকে এ
প্রশ্ন করা হবে তখন তাদের নেতৃবর্গ অনুভব করবে, এবার আমাদের
সর্বনাশের পালা এসে গেছে এবং আমাদের সাবেক অনুসারীরা নিশ্চয়ই এবার বলতে শুরু করবে
এরাই আমাদের পথভ্রষ্টতার জন্য মূলত দায়ী। তাই অনুসারীদের বলার আগেই তারা নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে নিজেদের
সাফাই পেশ করতে থাকবে।
৮৮. অর্থাৎ, এরা আমাদের নয় বরং এদের নিজেদেরই প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে
গিয়েছিল।
﴿وَقِيلَ
ادْعُوا شُرَكَاءَكُمْ فَدَعَوْهُمْ فَلَمْ يَسْتَجِيبُوا لَهُمْ وَرَأَوُا الْعَذَابَ
ۚ لَوْ أَنَّهُمْ كَانُوا يَهْتَدُونَ﴾
৬৪) তারপর তাদেরকে বলা হবে, এবার তোমরা যাদেরকে শরীক
বানিয়েছিলে তাদেরকে ডাকো।৮৯ এরা তাদেরকে ডাকবে কিন্তু
তারা এদের কোন জবাব দেবে না এবং এরা আযাব দেখে নেবে। হায়! এরা
যদি হিদায়াত গ্রহণকারী হতো!
৮৯. অর্থাৎ, তাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকো, দুনিয়ায়
তোমরা তাদের প্রতি নির্ভর করে আমার কথা রদ করে দিয়েছিলে। এখন এখানে তাদেরকে আসতে, তোমাদের সাহায্য করতে বলো এবং
তোমাদেরকে আযাব থেকে বাঁচাতে বলো।
﴿وَيَوْمَ
يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ﴾
৬৫) আর তারা (যেন না ভুলে যায়) সেদিনের কথা যেদিন তিনি ডাকবেন এবং জিজ্ঞেস
করবেন,
"যে রাসূল পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে তোমরা কি জবাব দিয়েছিলে?"
﴿فَعَمِيَتْ عَلَيْهِمُ الْأَنبَاءُ
يَوْمَئِذٍ فَهُمْ لَا يَتَسَاءَلُونَ﴾
৬৬) সেদিন তাদের কোন জবাব থাকবে না, তারা নিজেদের মধ্যে
জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না।
﴿فَأَمَّا مَن تَابَ وَآمَنَ
وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَىٰ أَن يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ﴾
৬৭) তবে যে ব্যক্তি আজ তওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে
সে-ই সাফল্যলাভের আশা করতে পারে।
﴿وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ
وَيَخْتَارُ ۗ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ ۚ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَىٰ عَمَّا
يُشْرِكُونَ﴾
৬৮) তোমার রব যা চান সৃষ্টি করেন এবং
(তিনি নিজেই নিজের কাজের জন্য যাকে চান) নির্বাচিত করে নেন। এ
নির্বাচন তাদের কাজ নয়।৯০ আল্লাহ পবিত্র এবং তারা যে
শিরক করে তার অনেক ঊর্ধ্বে।
৯০. আসলে শির্ককে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে এ উক্তি করা হয়েছে। মুশরিকরা আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিকে তাদের
উপাস্য পরিণত করেছে।
নিজেদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বিভিন্ন মর্যাদা, পদ ও গুণাবলী দান করা করেছে। এর প্রতিবাদ করে আল্লাহ বলেছেন, আমার সৃষ্ট মানুষ, ফেরেশতা, জিন ও অন্যান্য বান্দাদের মধ্য থেকে আমি
নিজেই যাকে যেমন চেয়েছি গুণাবলী, যোগ্যতা ও শক্তি দান করেছি
এবং যার মাধ্যমে যে কাজ নিতে চাই নিয়ে থাকি। কাজেই আমার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজেদের ইচ্ছামতো
বিপদ থেকে উদ্ধারকারী, অন্নদাতা ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী ইত্যাদি মনে করার অধিকার মুশরিকরা কেমন করে ও
কোথা থেকে লাভ করলো? কিভাবে তারা যাকে ইচ্ছা তাকে বৃষ্টি
বর্ষণ, রুজি-রোজগার ও সন্তান দান এবং রোগ ও রোগ নিরাময় করার
ক্ষমতা অর্পণ করে? কেমন করে তারা যাকে ইচ্ছা তাকে আমার
সার্বভৌম কর্তৃত্বাধীন এলাকার একটি অংশের শাসনকর্তা নিয়োগ করে? আমার ক্ষমতার মধ্য থেকে যা কিছু যাকে চায় তাকে তারা কেমন করে সোপর্দ করে। কেউ ফেরেশতা, জিন, নবী
বা অলী যাই কিছু থাক আমার সৃষ্টির কারণেই আছে। যে গুণাবলীই যে কেউ লাভ করেছে তা আমারই দান। যাকে আমি যে কাজে লাগাতে চেয়েছি লাগিয়ে দিয়েছি। তাদেরকে বিভিন্ন কাজের জন্য এভাবে নির্বাচিত
করার এ অর্থ কেমন করে হয়ে গেলো যে, এ বান্দাদেরকে বন্দেগীর স্থান থেকে উঠিয়ে
খোদায়ী মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে হবে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের সামনে আনুগত্যের
শির নত করে দিতে হবে, তাদেরকে সাহায্য দান করার জন্য ডাকতে
হবে, অভাব পূরণ করার জন্য তাদের কাছে আবেদন জানাতে হবে,
তাদেরকে ভাগ্য ভাঙাগড়ার মালিক এবং আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের
গুণাবলী ও ক্ষমতার অধিকারী আখ্যায়িত করতে হবে?
﴿وَرَبُّكَ
يَعْلَمُ مَا تُكِنُّ صُدُورُهُمْ وَمَا يُعْلِنُونَ﴾
৬৯) তোমার রব জানেন যা কিছু তারা মনের
মধ্যে লুকিয়ে রাখে এবং যা কিছু তারা প্রকাশ করে।৯১
৯১. চলমান ভাষণের মধ্যে যে উদ্দেশ্যে একথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, কোন ব্যক্তি বা দল দুনিয়ার
মানুষের সামনে এ দাবী করতে পারে যে, সে যে গোমরাহীতে লিপ্ত
হয়েছে বলে মনে করা হয়। তার ভ্রান্তিহীনতার কারনে অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারনে সে নিশ্চিন্ত এবং তার
বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি প্রমান পেশ করা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সে সন্তুষ্ট হতে
পারেনি। আর এ গোমরাহীকে সে কোন অসৎ
উদ্দেশ্যে নয় বরং পুরোপুরি সৎ উদ্দেশ্যে অবলম্বন করেছে এবং তার সামনে কখনো এমন কোন
জিনিস আসেনি যার সাহায্যে তার ভুল তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু আল্লাহর সামনে তার এ দাবী চলতে পারে না। তিনি কেবল বাইরেরটা দেখেন না। তাঁর সামনে তো মানুষের মন ও মস্তিস্কের এক
একটি অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে। তিনি তাঁর জ্ঞান, অনুভূতি, আবেগ, আকাংখা,
সংকল্প, বিবেক তথা প্রত্যেকটি জিনিস সরাসরি
জানেন। তিনি জানেন, কোন্ ব্যক্তিকে কোন্ কোন্
সময় কোন্ কোন্ পন্থায় সতর্ক করা হয়েছে, কোন্ কোন্ পথে
তার কাছে সত্য পৌঁছেছে এবং কোন্ কোন্ পথে বাতিলের বাতিল হওয়ার বিষয়টি তার কাছে
সুস্পষ্ট হয়েছে। যে
মূল কারণগুলোর ভিত্তিতে সে হক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের গোমরাহীকে প্রাধান্য
দিয়েছিল সেগুলো কি ছিল তাও তিনি জানেন।
﴿وَهُوَ
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَىٰ وَالْآخِرَةِ ۖ وَلَهُ
الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
৭০) তিনিই এক আল্লাহ যিনি ছাড়া ইবাদাতের
আর কোন হকদার নেই। তাঁরই জন্য প্রশংসা দুনিয়ায়ও, আখেরাতেও। শাসন
কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।
﴿قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِن جَعَلَ
اللَّهُ عَلَيْكُمُ اللَّيْلَ سَرْمَدًا إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَٰهٌ غَيْرُ
اللَّهِ يَأْتِيكُم بِضِيَاءٍ ۖ أَفَلَا تَسْمَعُونَ﴾
৭১) হে নবী! তাদেরকে বলো, তোমরা কি কখনো চিন্তা
করেছো, আল্লাহ যদি
কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের ওপর চিরকালের জন্য রাত্রিকে অব্যাহত রাখেন, তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কোন্
মাবুদ আছে তোমদের আলো এনে দেবে? তোমরা কি শুনছো না?
﴿قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِن جَعَلَ
اللَّهُ عَلَيْكُمُ النَّهَارَ سَرْمَدًا إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَٰهٌ
غَيْرُ اللَّهِ يَأْتِيكُم بِلَيْلٍ تَسْكُنُونَ فِيهِ ۖ أَفَلَا تُبْصِرُونَ﴾
৭২) তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছো, আল্লাহ যদি কিয়ামত পর্যন্ত
তোমাদের ওপর চিরকালের জন্য দিবস অব্যাহত রাখেন তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কোন্ মাবুদ
আছে তোমাদের রাত্রি এনে দেবে, যাতে তোমরা তার মধ্যে বিশ্রাম করতে পারো? তোমরা কি ভেবে দেখছো না? এটা ছিল
﴿وَمِن رَّحْمَتِهِ جَعَلَ
لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِن فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ
تَشْكُرُونَ﴾
৭৩) তাঁরই অনুগ্রহ, তিনি তোমাদের জন্য তৈরী
করেছেন রাত ও দিন, যাতে তোমরা
(রাতে) শান্তি এবং (দিনে) নিজের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো, হয়তো তোমরা শোকরগুজার হবে।
﴿وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ
أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تَزْعُمُونَ﴾
৭৪) (তারা যেন স্মরণ রাখে) সেদিনে কথা যখন তিনি তাদেরকে ডাকবেন, তারপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, "কোথায় তারা যাদেরকে তোমরা
আমার শরীক মনে করতে?
﴿وَنَزَعْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ
شَهِيدًا فَقُلْنَا هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ فَعَلِمُوا أَنَّ الْحَقَّ لِلَّهِ وَضَلَّ
عَنْهُم مَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ﴾
৭৫) আর আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে
একজন সাক্ষী বের করে আনবো৯২ তারপর বলবো, "আনো এবার তোমাদের প্রমাণগুলো।"৯৩ সেসময় তারা জানবে,সত্য রয়েছে আল্লাহর কাছে এবং
তারা যা কিছু মিথ্যা বানিয়ে রেখেছিল তা সবই উধাও হয়ে যাবে।
৯২. অর্থাৎ নবী, যিনি সংশ্লিষ্ট উম্মতকে সতর্ক করেছিলেন। অথবা নবীদের অনুসারীদের মধ্য থেকে এমন কোন
হিদায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি সংশ্লিষ্ট উম্মতের মধ্যে সত্য প্রচারের দায়িত্ব পালন
করেছিলেন। কিংবা কোন প্রচার মাধ্যম
যার সাহায্যে সংশ্লিষ্ট উম্মতের কাছে সত্যের পয়গাম পৌঁছেছিল।
৯৩. অর্থাৎ নিজেদের সাফাইয়ের মধ্যে এমন কোন প্রমান পেশ করো যার
ভিত্তিতে তোমাদের মাফ করে দেয়া যেতে পারে। অথবা তোমরা যে শির্ক এবং যে আখেরাত ও নবুওয়াত অস্বীকারের
ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলে তা সঠিক ছিল এবং তোমরা যুক্তি সংগত কারনে এ পথ অবলম্বন
করেছিলে একথা প্রমাণ করো।
কিংবা এ না হলেও কমপক্ষে একথাই প্রমান করো যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে এ ভুলের জন্য
সতর্ক করে দেবার এবং তোমাদের কাছে সঠিক কথা পৌঁছাবার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি।
﴿إِنَّ
قَارُونَ كَانَ مِن قَوْمِ مُوسَىٰ فَبَغَىٰ عَلَيْهِمْ ۖ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ
مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ
قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ﴾
৭৬) একথা সত্য,৯৪ কারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ের
লোক, তারপর সে
নিজের সম্প্রদায়ে বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো।৯৫ আর আমি তাকে এতটা ধনরত্ন দিয়ে
রেখেছিলাম যে, তাদের
চাবিগুলো বলবান লোকদের একটি দল বড় কষ্টে বহন করতে পারতো।৯৬ একবার যখন এ সম্প্রদায়ের
লোকেরা তাকে বললো,
"অহংকার করো না, আল্লাহ অহংকারকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
৯৪. সাতান্ন আয়াত থেকে মক্কার কাফেরদের যে আপত্তি সম্পর্কে
লাগাতার ভাষন চলছে এ ঘটনাটিও তারই জবাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একথাটিও মনে রাখতে হবে যে, যারা মুহাম্মদ সা.এর দাওয়াতের
কারণে জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবার ভয় প্রকাশ করেছিল তারা আসলে ছিল মক্কার বড় বড়
শেঠ, মহাজন ও পুঁজিপতি। আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও সূদী কারবার তাদেরকে সমকালীন কারূণে
পরিণত করেছিলো। তারাই মনে করছিল বেশি বেশি
করে ধন সম্পদ আহরণ করাই হচ্ছে আসল সত্য। এ উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে গিয়ে যে জিনিস থেকেই কিছু ক্ষতি
হবার আশংকা থাকে তা সরাসরি বাতিল করতে হবে। কোন অবস্থাতেই তা গ্রহন করা যেতে পারে না। অন্যদিকে সাধারন মানুষ ধন-সম্পদের এ
উঁচুস্তম্ভগুলোকে আকাংখার দৃষ্টিতে দেখতো এবং তাদের চুড়ান্ত কামনা হতো, যে উচ্চতায় এরা পৌঁছেছে হায়। যদি আমাদের সেখানো পৌছুবার সৌভাগ্য হতো! চলমান
অর্থ গৃধনুতার পরিবেশে এ যুক্তি বড়ই শক্তিশালী মনে করা হচ্ছিল যে, মুহাম্মদ সা. যে তাওহীদ,
আখেরাত ও নৈতিক বিধি-বন্ধনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন তা মেনে নেয়া হলে
কুরাইশদের উচ্চ মর্যাদার গগনচুম্বী প্রাসাদ ধূলোয় লুটিয়ে পড়বে এবং এ ক্ষেত্রে
ব্যবসা বাণিজ্য তো দূরের কথা জীবন ধারনই কঠিন হয়ে পড়বে।
৯৫. বাইবেল ও তালমূদে কারূনকে কোরহ (Korah) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে ছিল হযরত মূসা আ. এর চাচতো ভাই। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে (৬ অধ্যায় ১৮-২১ শ্লোক)
যে বংশধারা বর্ণনা করা হয়েছে, তার দৃষ্টিতে বলা যায় হযরত
মূসা ও কারূনের পিতা উভয়ই ছিল পরস্পর সহোদর ভাই। কুরআন মজীদের অন্য স্থানে বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি বণী ইসরাইলের
অন্তরভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও ফেরাউনের সাথে হাত মিলিয়েছিল এবং তার নৈকট্য লাভ করে এমন
পর্যায়ে গিয়েছিল যে, মূসা আ. এর দাওয়াতের মোকবিলায় ফেরাউনের
পরে বিরোধিতার ক্ষেত্রে যে দু'জন প্রধান দলপতি বেশি অগ্রসর
ছিল তাদের একজন ছিল কারূনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِآيَاتِنَا وَسُلْطَانٍ مُّبِينٍ، إِلَىٰ
فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَقَارُونَ فَقَالُوا سَاحِرٌ كَذَّابٌ
"আমি মূসাকে আমার নিদর্শন সমূহ এবং সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে ফেরাউন, হামান ও কারূনের কাছে পাঠালাম। কিন্তু তারা বলল, এ একজন যাদুকর ডাহা মিথ্যুক।" (আল-মুমিনঃ ২৩-২৪)
এ থেকে পরিস্কার হয়ে যায়, কারূন নিজের সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধাচারন করে এমন শত্রু শক্তির
ধামাধরায় পরিণত হয়েছিল, যে বনী ইসরাঈলকে শিকড় শুদ্ধ উপড়ে
ফেলার সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। আর এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার বদৌলতে ফেরাউনের রাষ্ট্রীয়
প্রশানে সে এমন গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছিল যে, হযরত মূসা ফেরাউন ছাড়া আর যে
দু'জন বড় বড় সত্ত্বার কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের দু'জনের একজন ছিল ফেরাউনের মন্ত্রী হামান এবং অন্য জন এ ইসরাঈলী শেঠ। বাকি রাষ্ট্রের অন্য সভাসদ ও কর্মকর্তারা ছিল
অপেক্ষাকৃত নিম্ন পর্যায়ের। কাজেই তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না। কারূনের এ মর্যাদাটিই সূরা আন কাবূতের ৩৯ আয়াতে বর্ণনা করা
হয়েছে।
৯৬. বাইবেলের (গণনা পুস্তকের ১৬ অধ্যায়) তার যে কাহিনী বর্ননা করা হয়েছে সেখানে এ
ব্যক্তির ধন-দৌলতের কোন কথা বলা হয়নি। কিন' ইহুদী বর্ণনা সমূহ থেকে জানা যায়, এ ব্যক্তি অগাধ
ধন-সম্পদের মালিক ছিল, এমনকি তার ধনাগারের চাবিগুলো বহন করার
জন্য তিনশো খচ্চরের প্রয়োজন হতো। (জুয়িশ ইনসাইক্লোপেডিয়া, ৭ খন্ড, ৫৫৬
পৃষ্ঠা) এ বর্ণনাটি যদিও অনেক বেশি
অতিরঞ্জিত তবুও এ থেকে এতটুকু জানা যায় যে, ইসরাঈলী
বর্ণনাবলীর দৃষ্টিতেও কারূন ছিল তৎকালের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি।
﴿وَابْتَغِ
فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ ۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
ۖ وَأَحْسِن كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ
ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ﴾
৭৭) আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা
দিয়ে আখেরাতের ঘর তৈরি করার কথা চিন্তা করো এবং দুনিয়া থেকেও নিজের অংশ ভুলে
যেয়ো না। অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি
অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেস্টা করো না। আল্লাহ
বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।"
﴿قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ
عَلَىٰ عِلْمٍ عِندِي ۚ أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِن قَبْلِهِ
مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا ۚ وَلَا يُسْأَلُ
عَن ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ﴾
৭৮) এতে সে বললো, "এসব কিছু তো আমি যে জ্ঞান
লাভ করেছি তার ভিত্তিতে আমাকে দেয়া হয়েছে।"৯৭ --সে কি এ কথা জানতো না যে, আল্লাহ এর পূর্বে এমন বহু
লোককে ধ্বংস করে দিয়েছেন যারা এর চেয়ে বেশী বাহুবল ও জনবলের অধিকারী ছিল?৯৮ অপরাধীদেরকে
তো তাদের গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় না।৯৯
৯৭. আসল শব্দগুলো হচ্ছেঃ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ عِندِي এর
দু'টি অর্থ হতে
পারে। এক, আমি যা কিছু পেয়েছি নিজের
যোগ্যতার বলে পেয়েছি। এটা কোন অনুগ্রহ নয়।
অধিকার ছাড়াই নিছক দয়া করে কেউ আমাকে এটা দান করেনি। তাই আমাকে এখন এজন্য এভাবে কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার
প্রয়োজন নেই যে, যেসব অযোগ্য লোককে কিছুই দেয়া হয়নি তাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ হিসেবে আমি এর
মধ্য থেকে কিছু দেবো অথবা আমার কাছ থেকে এ সম্পদ যাতে ছিনিয়ে নিয়ে না নেয়া হয়
সেজন্য কিছু দান খয়রাত করে দেবো। এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, আমার মতে আল্লাহ এই যে
সম্পদরাজি আমাকে দিয়েছেন এটি তিনি আমার গুণাবলী সম্পর্কে জেনেই দিয়েছেন। যদি তাঁর দৃষ্টিতে আমি একজন পছন্দনীয় মানুষ না
হতাম, তাহলে তিনি
এসব আমাকে কেন দিলেন? আমার প্রতি তাঁর নিয়ামত বর্ষিত হওয়াটাই
প্রমাণ করে আমি তাঁর প্রিয় পাত্র এবং আমার নীতিপদ্ধতি তিনি পছন্দ করেন।
৯৮. অর্থাৎ এ ব্যক্তি যে নিজেকে বড় পণ্ডিত, জ্ঞানী,গুণী
ও চতুর বলে দাবী করে বেড়াচ্ছে এবং নিজের যোগ্যতার অহংকারে মাটিতে পা ফেলতে না,
সে কি জানে না যে, তার চাইতেও বেশী অর্থ,মর্যাদা, প্রতিপত্তি শক্তি ও শান শওকতের অধিকারী লোক
ইতিপূর্বে দুনিয়ায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আল্লাহ শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ধ্বংস করে
দিয়েছেন? যোগ্যতা ও নৈপূণ্যই যদি পার্থিব উন্নতির রক্ষাকবচ
হয়ে থাকে তাহলে যখন তারা ধ্বংস হয়েছিল তখন তাদের এ যোগ্যতাগুলো কোথায় গিয়েছিল?
আর যদি কারো পার্থিব উন্নতি লাভ অনিবার্যভাবে একথাই প্রমাণ করে যে,
আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তার কর্ম ও গুণাবলী পছন্দ করেন
তাহলে সর্বনাশ হলো কেন?
৯৯. অর্থাৎ অপরাধীরা তো এ দাবীই করে থাকে যে, তারা বড়ই ভালো লোক। তাদের কোন দোষ আছে এ কথা তারা কবেই বা স্বীকার
করে। কিন্তু তাদের শাস্তি তাদের
স্বীকারোক্তির উপর নির্ভর করে না। তাদেরকে যখন পাকড়াও করা হয় একথা জিজ্ঞেস করে পাকড়াও করা হয় না যে, তোমরা কি কি অপরাধ করেছ!
﴿فَخَرَجَ
عَلَىٰ قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ ۖ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا
يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ﴾
৭৯) একদিন সে সম্প্রদায়ের সামনে বের হলো
পূর্ণ জাঁকজমক সহকারে। যারা দুনিয়ার জীবনের ঐশ্বর্যের
জন্য লালায়িত ছিল তারা তাকে দেখে বললো, "আহা! কারূনকে যা দেয়া হয়েছে তা যদি আমরাও
পেতাম! সে তো বড়ই সৌভাগ্যবান।"
﴿وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا
الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِّمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا
يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ﴾
৮০) কিন্তু যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল
তারা বলতে লাগলো,
"তোমাদের ভাবগতিক দেখে আফসোস হয়। আল্লাহর
সওয়াব তার জন্য ভালো যে ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আর এ সম্পদ সবরকারীরা ছাড়া আর
কেউ লাভ করে না।"১০০
১০০. অর্থাৎ এ চরিত্র, চিন্তা পদ্ধতি এবং আল্লাহর পুরস্কার দান
কেবলমাত্র এমন লোকদের মধ্যে নির্ধারিত যাদের মধ্যে এতটা ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা থাকে যার
ফলে তারা হালাল পথে অর্থোপার্জনের জন্য অবিচল সংকল্পবদ্ধ হয়। চাই তাতে তাদের ভাগ্য শুধুমাত্র নুনভাতই জুটুক, কিংবা তারা কোটিপতি হয়ে যাবার সৌভাগ্য
লাভ করুক। সারা দুনিয়ার সুখ ও সুবিধা
অর্জিত হবার সুযোগ দেখা দিলেও তারা হারাম পথের দিকে একটুও ঝুঁকে পড়ে না। এ আয়াতে আল্লাহর পুরস্কার বলতে এমন মর্যাদা
সম্পন্ন রিয্ক বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে প্রচেষ্টা ও
পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে অর্জন করে। আর সবর অর্থ হচ্ছে, নিজের আবেগ-অনুভূতি ও কামনা-বাসনাকে
নিয়ন্ত্রনে রাখা।
লোভ-লালসার মোকাবিলায় ঈমানদারী ও বিশ্বস্ততার ওপর অবিচল থাকা। সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার ফলে যে ক্ষতি হয় অথবা যে লাভ হাত
ছাড়া হয়ে যায় তা বরদাশ্ত করে নেয়া। অবৈধভাবে তদবীর-তাগাদা করে যে লাভ হতে পারে তা
প্রত্যাখ্যান করা। হালাল রোজগার তা যত
সামান্যই হোক না কেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। হারামখোরদের জাকজমক দেখে মনের মধ্যে ঈর্ষা ও কামনা-বাসনার
জ্বালায় অস্থি'র হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করা এবং ঠান্ডা মাথায়
একথা অনুধাবন করা যে, ঈমানদারের জন্য এ চাকচিক্যময় আবর্জনার
তুলনায় এমন নিরাভরণ পবিত্রতাই ভালো যা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে দান করেছেন। "সবরকারীরা ছাড়া আর কেউ এ সম্পদ লাভ করে
না" উক্তিতে উল্লেখিত সম্পদ অর্থ আল্লাহর সওয়াবও হতে পারে এবং এমন পবিত্র
পরিচ্ছন্ন মানসিকতাও হতে পারে যার ভিত্তিতে মানুষ ঈমান ও সৎকর্ম সহকারে অনাহার ও
অভূক্ত থাকাকে বেঈমানীর পথ অবলম্বন করে কোটিপতি হয়ে যাওয়ার চাইতে ভাল মনে করে।
﴿فَخَسَفْنَا
بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِن فِئَةٍ يَنصُرُونَهُ مِن دُونِ اللَّهِ
وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنتَصِرِينَ﴾
৮১) শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ও তার গৃহকে
ভূগর্ভে পুতে ফেললাম। তখন আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে
সাহায্য করতে এগিয়ে আসার মতো সাহায্যকারীদের কোন দল ছিল না এবং সে নিজেও নিজেকে
সাহায্য করতে পারলো না।
﴿وَأَصْبَحَ الَّذِينَ تَمَنَّوْا
مَكَانَهُ بِالْأَمْسِ يَقُولُونَ وَيْكَأَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ
مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ ۖ لَوْلَا أَن مَّنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا لَخَسَفَ بِنَا
ۖ وَيْكَأَنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُونَ﴾
৮২) যারা আগের দিন তার মতো মর্যাদালাভের আকাংখা
পোষণ করছিল তারা বলতে লাগলো, "আফসোস, আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য
থেকে যাকে ইচ্ছা তার রিযিক প্রসারিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সীমিত রিযিক দেন।১০১ যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি
অনুগ্রহ না করতেন, তাহলে
আমাদেরও ভূগর্ভে পুতে ফেলতেন। আফসোস, আমাদের মনে ছিল না, কাফেররা সফলকাম হয় না"১০২
১০১. অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক প্রসারিত বা সংকুচিত করা
যেটাই ঘটুক না কেন তা ঘটে তাঁর ইচ্ছাক্রমেই । এ ইচ্ছার মধ্যে তাঁর ভিন্নতর উদ্দেশ্য সক্রিয় থাকে। কাউকে বেশী রিযিক দেবার অর্থ নিশ্চিত ভাবে এ
নয় যে, আল্লাহ তার
প্রতি খুবই সন্তুষ্ট তাই তাকে পুরষ্কার দিচ্ছেন। অনেক সময় কোন ব্যক্তি হয় আল্লাহর কাছে বড়ই ঘৃণিত ও অভিশপ্ত
কিন্তু তিনি তাকে বিপুল পরিমাণ ধন-দৌলত দিয়ে যেতে থাকেন। এমনকি এ ধন শেষ পর্যন্ত তার উপর আল্লাহর কঠিন আযাব নিয়ে
আসে। পক্ষান্তরে যদি কারো রিযিক
সংকুচিত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তার এ অর্থ হয় না যে, আল্লাহ তার
প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। অধিকাংশ সৎলোক আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক
অভাব অনটনের মধ্যে থাকে।
অনেক সময় দেখা যায় এ অভাব অনটন তাঁদের জন্য আল্লাহর রহমতে পরিণত হয়েছে। এ সত্যটি না বোঝার ফলে যারা আসলে আল্লাহর
গযবের অধিকারী হয় তাদের সমৃদ্ধিকে মানুষ ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে।
১০২. "অর্থাৎ আমাদের এ ভুল ধারনা ছিল যে, পার্থিব সমৃদ্ধি ও ধনাঢ্যতাই
সফলতা। এ কারনে আমরা মনে করে
বসেছিলাম কারূন বড়ই সাফল্য অর্জন করে চলছে। কিন্তু এখন বুঝলাম, আসল সাফল্য অন্য কোন জিনিসের নাম এবং তা
কাফেরদের ভাগ্যে জোটে না। কারূনের ঘটনার এ শিক্ষনীয় দিকটি কেবলমাত্র কুরআনেই বর্নিত হয়েছে। বাইবেলে ও তালমূদে এর কোন উল্লেখ নেই। তবে এ দু'টি কিতাবে যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তা থেকে
জানা যায়, বনী ইসরাঈল যখন মিশর থেকে বের হয় তখন এ ব্যক্তিও
নিজের দলবল সহ তাদের সাথে বের হয়। তারপর সে হযরত মূসা ও হারূনের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র করে। আড়াইশ' লোক এ ষড়যন্ত্রে তার সাথে শরীক ছিল। শেষ পর্যন্ত তার উপর আল্লাহর গযব নাযিল হয় এবং
সে নিজ গৃহ ও ধন-সম্পদসহ মাটির মধ্যে প্রোথিত হয়ে যায়।"
﴿تِلْكَ
الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ
وَلَا فَسَادًا ۚ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ﴾
৮৩) সে আখেরাতের১০৩ গৃহ তো আমি তাদের জন্য
নির্দিষ্ট করে দেবো যারা পৃথিবীতে নিজেদের বড়াই চায় না১০৪ এবং চায় না বিপর্যয় সৃষ্টি
করতে।১০৫ আর শুভ পরিণাম রয়েছে মুত্তাকীদের জন্যই।১০৬
১০৩. এখানে জান্নাতের কথা বলা হয়েছে, যা প্রকৃত সাফল্যের স্থান
হিসেবে চিহ্নিত।
১০৪. অর্থাৎ, যারা আল্লাহর যমীনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশী
নয়। যারা বিদ্রোহী, স্বৈরাচারী ও দাম্ভিক হয়ে নয়
বরং বান্দা হয়ে থাকে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজেদের বান্দা করে রাখার চেষ্টা করে
না।
১০৫. 'ফাসাদ' বা বিপর্যয় হচ্ছে মানব জীবন ব্যবস্থার এমন
একটি বিকৃতি যা সত্য বিচ্যুত হবার ফলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। আল্লাহর বন্দেগী এবং তাঁর আইন কানুনের
আনুগত্যের সীমানা অতিক্রম করে মানুষ যা কিছুই করে সবই হয় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই
বিপর্যয়। এর একটি অংশ হচ্ছে এমন
ধরনের বিপর্যয়, যা হারাম পথে ধন আহরণ এবং হারাম পথে তা ব্যয় করার ফলে সৃষ্টি হয়।
১০৬. অর্থাৎ, তাদের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে
দূরে থাকে।
﴿مَن جَاءَ
بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِّنْهَا ۖ وَمَن جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى
الَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّئَاتِ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
৮৪) যে কেউ ভাল কাজ নিয়ে আসবে তার জন্য
রয়েছে তার চেয়ে ভাল ফল এবং যে কেউ খারাপ কাজ নিয়ে আসে তার জানা উচিৎ যে, অসৎ কর্মশীলরা যেমন কাজ করতো
তেমনটিই প্রতিদান পাবে।
﴿إِنَّ الَّذِي فَرَضَ عَلَيْكَ
الْقُرْآنَ لَرَادُّكَ إِلَىٰ مَعَادٍ ۚ قُل رَّبِّي أَعْلَمُ مَن جَاءَ بِالْهُدَىٰ
وَمَنْ هُوَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
৮৫) হে নবী! নিশ্চিত জেনো, যিনি এ কুরআন তোমার ওপর
ন্যস্ত করেছেন১০৭ তিনি তোমাকে একটি উত্তম
পরিণতিতে পৌঁছিয়ে দেবেন।১০৮ তাদেরকে বলে দাও, "আমার রব ভালো করেই জানেন কে
হিদায়াত নিয়ে এসেছে এবং কে প্রকাশ্য গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে।"
১০৭. অর্থাৎ, এই কুরআনকে আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌঁছাবার, তাদেরকে এর শিক্ষা দান করার এবং এর পথ নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ব সংস্কার
করার দায়িত্ব তোমার প্রতি অর্পণ করেছেন।
১০৮. আসল শব্দ لَرَادُّكَ إِلَىٰ مَعَادٍ অর্থাৎ তোমাকে একটি মা'আদের দিকে পৌঁছিয়ে দেবেন। মা'আদ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এমন স্থান যেদিকে
মানুষকে ফিরে যেতে হবে। এ শব্দটিকে অনির্দিষ্টবাচক হিসেবে ব্যবহার করার কারনে এর দ্বারা আপনা আপনি এ
অর্থ বুঝানো হয় যে, এ স্থানটি বড়ই মহিমন্বিত ও মর্যাদা সম্পন্ন। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ করেছেন জান্নাত। কিন্তু একে শুধুমাত্র জান্নাতের মধ্যে
সীমাবদ্ধ করে দেয়ার কোন যুক্তিসংগত কারন নেই। আল্লাহ শব্দটিকে যেমন ব্যপক অর্থে বর্ণনা করেছেন তেমনি
ব্যাপক অর্থে একে ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়। এর ফলে এ প্রতিশ্রুতি দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের মধ্যে
সংশ্লিষ্ট হয়ে যাবে।
আয়াতের পূর্ববর্তী আলোচনাও এ কথাই দাবী করে যে, একে কেবলমাত্র আখেরাতেই নয় বরং দুনিয়াতেও
নবী সা.কে বিরাট শান শওকত এবং মাহাত্ন্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করার প্রতিশ্রুতি মনে
করা হোক। মক্কার কাফেরদের যে উক্তি
নিয়ে ৫৭ আয়াত থেকে এ পর্যন্ত লাগাতার আলোচনা চলছে তাতে তারা বলেছিল, হে মুহাম্মদ! সা. তুমি নিজের সাথে আমাদেরকেও নিয়ে ডুবাতে চাও। যদি আমরা তোমার সাথে সহযোগিতা করি এবং এ ধর্ম
গ্রহন করে নিই, তাহলে আরবের সরযমীনে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এর জবাবে আল্লাহ তাঁর নবীকে বললেন, হে নবী! যে আল্লাহ এ কুরআনের
পতাকা বহন করার দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পণ করেছেন তিনি তোমাকে ধ্বংস করে দেবেন না। বরং তিনি তোমাকে এমন উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত
করতে চান যার কল্পনাও আজ এরা করতে পারে না। আর প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মাত্র কয়েক বছর পর নবী করীম সা. কে এ দুনিয়ার এদেরই চোখের সামনে সমগ্র আরব দেশে এমন
নিরংকুশ কর্তৃত্ব দান করলেন যে, তাঁকে বাধাদানকারী কোন শক্তিই সেখানে টিকতে পারল না এবং তাঁর
দীন ছাড়া অন্য কোন দীনের জন্য সেখানে কোন অবকাশই থাকল না। আরবের ইতিহাসে এর আগে সমগ্র আরব উপদ্বীপে কোন
এক ব্যক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যের এ ধরনের কোন নজীর সৃষ্টি হয়নি, যার ফলে সারা দেশে তার কোন
প্রতিদ্বন্দী থাকেনি, তার হুকুমের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার
ক্ষমতা কেউ রাখেনি এবং লোকেরা কেবল রাজনৈতিকভাবেই তার দলভূক্ত হয়নি বরং সমস্ত
দীনকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সেই এক ব্যক্তি সবাইকে তার দীনের অনুসারীও করে নিয়েছে।
কোন কোন মুফাসসির এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সূরা কাসাসের এ আয়াতটি মক্কা
থেকে মদীনায় হিজরত করার সময় পথে নাযিল হয়েছিল। তাঁদের মতে এতে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন
যে, তিনি আবার
তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু প্রথমত এর শব্দাবলীর মধ্যে "মা'আদ" কে "মক্কা"
অর্থে গ্রহন করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত বিষয়বস্তু ও আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য-প্রমানের দিক
দিয়ে বিচার করলে এ সূরাটি হচ্ছে হাব্শায় হিজরাতের নিকটবর্তী সময়ের এবং এ কথা বুঝা
যাচ্ছে না যে, কয়েক বছর পর মদীনায় হিজরাতের সময় পথে যদি এ আয়াতটি নাযিল হয়ে থাকে তাহলে
কোন্ সম্পর্কের ভিত্তিতে এখানে এ ধারাবাহিক আলোচনার মধ্যে একে এনে বসিয়ে দেয়া
হয়েছে। তৃতীয়ত এ প্রেক্ষাপটে
মক্কার দিকে নবী করীমের সা. ফিরে যাবার
আলোচনা একেবারেই বেমানান ঠেকে। আয়াতের এ অর্থ গ্রহন করা হলে এটা মক্কার কাফেরদের কথার জবাব হবে না বরং তাদের
ওজরকে শক্তিশালী করা হবে। এর
অর্থ হবে, অবশ্যই হে মক্কাবাসীরা! তোমরা ঠিকই বলছো, মুহাম্মদ সা.
কে এ শহর থেকে বের করে দেয়া হবে কিন্তু
তিনি স্থায়ীভাবে নির্বাসিত হবেন না বরং শেষ পর্যন্ত আমি তাকে আবার এখানে ফিরিয়ে
আনবো। এ হাদীসটি যদিও বুখারী, নাসাঈ, ইবনে
জারীর ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগন ইবনে আব্বাস রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন কিন্তু আসলে এটি
ইবনে আব্বাসের নিজস্ব অভিমত। এটি সরাসরি রাসূল সা. এর বক্তব্য সম্বলিত কোন মারফূ হাদীস নয় যে, একে মেনে নিতেই হবে।
﴿وَمَا
كُنتَ تَرْجُو أَن يُلْقَىٰ إِلَيْكَ الْكِتَابُ إِلَّا رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ ۖ فَلَا
تَكُونَنَّ ظَهِيرًا لِّلْكَافِرِينَ﴾
৮৬) তুমি মোটেই আশা করোনি যে, তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করা
হবে। এতো নিছক তোমার রবের মেহেবানী (তোমার
প্রতি অবতীর্ন হয়েছে)১০৯ কাজেই তুমি কাফেরদের সাহায্যকারী হয়ো না।১১০
১০৯. এ কথাটি মুহাম্মদ সা. নবুওয়াতের প্রমান স্বরূপ পেশ করা
হচ্ছে ।মূসা আ. এ কথা মোটেই জানতেন
না যে, তাঁকে নবী
করা হচ্ছে এবং বিরাট দায়িত্ব সম্পাদনে নিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি কখনো কল্পনায়ও এ ইচ্ছা বা আশা পোষণ করা
তো দূরের কথা কখনো এ বিষয়টি কামনাও করেননি। হঠাৎ পথ চলার সময় তাকে ডেকে নেয়া হয় এবং নবীর দায়িত্ব
চাপিয়ে দিয়ে তার থেকে বিস্ময়কর কাজ নেয়া হয়, যার সাথে তার পূর্ববর্তী জীবনের কাজের কোন
সাদৃশ্যই ছিল না।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে মুহাম্মদ সা. এর সাথেও। মক্কার লোকেরা নিজেরাই জানতো,হেরা গিরিগৃহা থেকে যেদিন তিনি
নবুওয়াতের পয়গাম নিয়ে নেমে আসেন তার মাত্র একদিন আগে পর্যন্ত তার জীবন কি ছিল,তিনি কি কাজ করতেন, কেমন কথাবার্তা বলতেন, তাঁর কথাবার্তার বিষয়বস্তু কি হতো, কোন বিষয়ে তাঁর
আগ্রহ ছিল এবং তাঁর তৎপরতা ছিলো কোন ধরনের। তাঁর এ সমগ্র জীবন অবশ্যই সত্যতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে পরিপূর্ণ ভদ্রতা, শালীনতা, শান্তিপ্রিয়তা, প্রতিশ্রুতি পালন, অধিকার প্রদান ও জনসেবার ভাবধারা অসাধারণ উজ্জ্বল্যে দেদীপ্যমান ছিল। কিন্তু সেখানে এমন কোন জিনিস ছিল না যার
ভিত্তিতে কেউ এ কথা কল্পনাও করতে পারে যে, এ সদাচারী লোকটি আগামীকাল নবুওয়াতের দাবী
নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
তাঁর সাথে যারা নিকটতম সম্পর্ক রাখতো এবং তাঁর আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ও
বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে একজনও এ কথা বলতে পারেনি যে, তিনি
পূর্ব থেকেই নবী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হেরা গিরিগূহার সেই বৈপ্লবিক মূহুর্তের পরে অকস্মাত যেসব
বিষয়বস্তু, সমস্যাবলী ও প্রসঙ্গ সম্পর্কে তার বক্তব্য বিবৃতি ও ভাষণ দান শুরু হয়ে যায়
ইতিপূর্বে কেউ তার কন্ঠ থেকে কখনো তার একটি বর্ণও শোনেনি। কুরআনের আকারে অকস্মাত তাঁর মুখ থেকে যে বিশেষ
ভাষা, শব্দ ও
পরিভাষা লোকেরা শুনতে থাকে ইতিপূর্বে কখনো তারা তা শোনেনি। ইতিপূর্বে কখনো তিনি কোথাও বক্তৃতা ও
ওয়াজ-নসিহত করতে দাঁড়াননি। কখনো দাওয়াত দিতে ও আন্দোলনের বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেননি। বরং কখনো তাঁর কোন কর্মতৎপরতা থেকে এ ধারণাই জন্মাতে
পারেনি যে, তিনি সামাজিক সমস্যা সমাধান অথবা ধর্মীয় সংশোধন কিংবা নৈতিক ও চারিত্রিক
সংস্কার সাধনের জন্য কোন কাজ শুরু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এ বৈপ্লবিক মুহুর্তে সমাগত হবার একদিন আগেও
তাঁর জীবন ছিল একজন ব্যবসায়ীর জীবন। সাদামাটা ও বৈধপথে রুজি-রোজগার করা, নিজের সন্তান পরিজনদের সাথে হাসিখুশির
জীবন-যাপন করা, অতিথি আপ্যায়ন করা, দুঃখী-দরিদ্র
জনদের সাহায্য সেবা করা এবং আত্নীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার আর কখনো কখনো ইবাদত
করার জন্য একান্তে বসে যাওয়া-এই ছিল তার স্বাভাবিক জীবন। এ ধরনের একজন লোকের হঠাৎ একদিন বিশ্ব কাঁপানো
বাগ্মীতা নিয়ে ময়দানে নেমে আসা, একটি বিপ্লবাত্মক দাওয়াতের কাজ শুরু করে দেয়া, একটি অভিনব সাহিত্য সৃষ্টি করা এবং একটি স্বতন্ত্র জীবন দর্শন চিন্তোধারা
ও নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধান নিয়ে সামনে এগিয়ে আসা, এতবড় একটি
পরিবর্তন, যা মানবিক মনস্তত্বের দৃষ্টিতে কোন প্রকার
কৃত্রিমতা, প্রস্তুতি ও ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কখনোই
আত্নপ্রকাশ করতে পারে না। কারণ এ ধরনের প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি অবশ্যই পর্যায়ক্রমিক
ক্রমোন্নতির স্তর অতিক্রম করে এবং যাদের মধ্যে মানুষ রাত্রি-দিন জীবন-যাপন করে এ
পর্যায় ও স্তর কখনো তাদের চোখের আড়ালে থাকতে পারে না। নবী সা. এর জীবন যদি এ পর্যায়গুলো অতিক্রম করে থাকতো তাহলে
মক্কার হাজার হাজার লোক বলতো, আমরা না আগেই বলেছিলাম এ ব্যক্তি একদিন কোন বড় আকারের দাবী
করে বসবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মক্কার কাফেররা তাঁর বিরুদ্ধে
সব ধরনের অভিযোগ আনলেও এ অভিযোগটি তাদের একজনও উত্থাপন করেননি।
তারপর তিনি নিজেও নবুওয়াতের প্রত্যাশী ছিলেন না। অথবা তা কামনা করতেন না এবং সেজন্য অপেক্ষাও করছিলেন না। বরং সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে অবস্মাত তিনি এ
বিষয়টির মুখোমুখি হলেন।
বিভিন্ন হাদীসে অহীর সূত্রপাতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে যে ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে তা
থেকে এর প্রমান পাওয়া যায়। জিব্রীলের
সাথে প্রথম সাক্ষাত এবং সূরা আলাকের প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর তিনি হেরা
গূহা থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গৃহে পৌঁছেছিলেন। গৃহের লোকদের বলেছিলেন, "আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও।" কিছুক্ষণ পরে ভীতির অবস্থা কিছুটা দূর হয়ে গেলে নিজের জীবন সঙ্গীনিকে
সব অবস্থা খুলে বললেন। এ
প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন,
"আমি নিজের প্রাণের ভয় করছি।" স্ত্রী সংগে সংগেই জবাব দিলেন, "মোটেই না, আল্লাহ আপনাকে কখনো কষ্ট দেবেন না। আপনি আত্নীয়দের হক আদায় করেন। অসহায়কে সাহায্য করেন। অভাবী দরিদ্রকে সহায়তা দেন। অতিথি আপ্যায়ন করেন। প্রত্যেক ভাল কাজে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।" তারপর তিনি তাঁকে নিয়ে নিজের চাচাতো ভাই
ও আহলে কিতাবদের একজন অভিজ্ঞ আলেম ও সদাচারী ব্যক্তি ওয়ারাকাহ ইবনে নওফালের কাছে
গেলন। তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনা
শোনার পর ওয়ারাকাহ বললেন,
"আপনার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন সেই একই আসমানী দূত বা
নামূস (বিশেষ কাজে নিযুক্ত নির্দিষ্ট ফেরেশতা) যিনি মূসার আ. কাছে এসেছিলেন। হায়! যদি আমি যুবক হতাম এবং সে সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম
যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে বহিস্কার করবে।" তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "এরা কি আমাকে বের করে
দেবে?" জবাব দিলেন, "হ্যাঁ
আজ পর্যন্ত এক ব্যক্তিও এমন অতিক্রান্ত হননি, যিনি এ ধরনের
বাণী বহন করে এনেছেন, এবং লোকেরা তাঁর দুশমনে পরিণত হয়নি।
এ সমগ্র ঘটনাটি এমন একটি অবস্থার ছবি তুলে ধরে, যা একজন সরল মানুষ একটি
অপ্রত্যাশিত ও চরম স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তার জীবনে দেখা দিতে পারে। যদি নবী সা. প্রথম থেকেই নবী হবার চিন্তা
করতেন, নিজের
সম্পর্কে চিন্তা করতেন যে, তাঁর মতো মানুষের নবী হওয়া উচিত
এবং কবে কোন ফেরেশতা তাঁর কাছে পয়গাম নিয়ে আসবে তারই প্রতীক্ষায় ধ্যান সাধনা করে
নিজের মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন, তাহলে হেরা গূহার ঘটনাটি
সংঘটিত হবার সাথে সাথেই তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন এবং বলিষ্ঠ মনোবল নিয়ে
বিরাট দাবী সহকারে পাহাড় থেকে নামতেন, তারপর সোজা নিজের
সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে পৌঁছে নিজের নবুওয়াতের ঘোষনা দিতেন। কিন্তু এখানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা
পরিদৃষ্ট হয়। তিনি যা কিছু দেখেন তাতে
বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে পৌঁছেন। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। মনটা একটু শান্ত হলে চুপি চুপি স্ত্রীকে বলেন, আজ গুহার নিসংগতায় এ ধরনের
একটি ঘটনা ঘটে গেছে। জানি না কি হবে।
আমার প্রান নিরাপদ নয় মনে হচ্ছে। নবুওয়াত প্রার্থীর অবস্থা থেকে এ অবস্থা কত ভিন্নতর।
তারপর স্বামীর জীবন, তার অবস্থা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে জানতে পারে?
যদি তিনি পূর্বাহ্নেই এ অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকতেন যে, তাঁর স্বামী হচ্ছেন নবুওয়াতের প্রার্থী, তিনি
সার্বক্ষণ ফেরেশতাদের আগমনের প্রতীক্ষা করছেন,তাহলে তার জবাব
কখনো হযরত খাদিজার রা. জবাবের অনুরূপ হতো না। বরং তিনি বলতেনঃ হে স্বামী! ভয় পাও কেন? দীর্ঘদিন থেকে যে জিনিসের
প্রত্যাশী ছিলে তা পেয়ে গেছো। চলো, এবার পীর গীরির দোকান পাঠ সাজাও। আমি মানত, নাজরানা ইত্যাদি সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি
স্বামীর জীবনের যে চেহারা দেখেছিলেন তার ভিত্তিতে একথা বুঝতে তার এক মুহুর্তও দেরী
হয়নি যে,এমন সৎ, ত্যাগী ও নির্লোভ ব্যক্তির কাছে শয়তান আসতে
পারে না, আল্লাহ তাঁকে কোন বড় পরীক্ষার সম্মুখীনও করতে পারেন
না বরং তিনি যা কিছু দেখেছেন তা নির্জালা সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়ারকাহ ইবনে নওফালের ব্যাপারে একই কথা। তিনি কোন বাইরের লোক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নবী করীম সা. এর ভ্রাতৃসমাজের অন্তরভূক্ত এবং নিকটতম
আত্মীয়তার প্রেক্ষিতে তাঁর শ্যালক। তারপর একজন ঈসায়ী আলেম হবার ফলে নবুওয়াত, কিতাব ও অহীকে কৃত্রিমতা বানোয়াট থেকে
বাছাই করার ক্ষমতা রাখতেন। বয়সে অনেক বড় হবার কারণে নবীর সা. শৈশব থেকে সে সময় পর্যন্ত সমগ্র জীবন তার সামনে
ছিল। তিনিও তাঁর মুখ থেকে হেরা
গূহার সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক শোনার পর সংগে সংগেই বলে ওঠেন, এ আগমনকারী নিশ্চিতভাবেই সেই
একই ফেরেশতা হবেন যিনি হযরত মূসার আ. কাছে
অহী নিয়ে আসতেন।
কারণ হযরত মুসা আ. সাথে যা ঘটেছিল এখানেও
সেই একই ঘটনা ঘটেছে।
অর্থাৎ একজন অত্যন্ত পবিত্র পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী সহজ সরল মানুষ, মাথায় কোন প্রকার পূর্ব চিন্তা
বা পরিকল্পনা নেই, নবুওয়াতের চিন্তায় ডুবে থাকা তো দূরের কথা
তা অর্জন করার কল্পনাও কোনদিন তাঁর মনে জাগেনি এবং অকস্মাত তিনি পূর্ণ সচেতন
অবস্থায় প্রকাশ্যে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এ জিনিসটি তাঁকে দুই আর দু'ইয়ের চারের মতো নির্দ্ধিধায়
নিশ্চতভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে দেয় যে, এখানে কোন
প্রবৃত্তির প্ররোচনা বা শয়তানী ছল চাতুরী নেই। বরং এ সত্যাশ্রয়ী মানুষটি নিজের কোন প্রকার ইচ্ছা-আকাংখা
ছাড়াই যা কিছু দেখেছেন তা আসলে প্রকৃত সত্যদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।
এটি মুহাম্মদ সা. এর নবুওয়াতের এমন একটি সুস্পষ্ট ও জ্বাজ্জ্বল্যমান প্রমান যে, একজন সত্যপ্রিয় মানুষের পক্ষে
তা প্রমান করা কঠিন। তাই কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এ জিনিসটিকে নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা
হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুসে বলা
হয়েছেঃ
قُل لَّوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُم
بِهِ ۖ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِّن قَبْلِهِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
"হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যদি আল্লাহ এটা না চাইতেন, তাহলে আমি কখনো এ কুরআন তোমাদের শুনাতাম না বরং এর খবরও তোমাদের দিতাম না। ইতিপূর্বে আমি তোমাদের মধ্যে আমার জীবনের
দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছি, তোমরা কি এতটুকু কথাও বোঝো না?" (ইউনুসঃ ১৬
আয়াত)
আর সূরা আশ্-শূরায় বলা হয়েছেঃ
مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِن
جَعَلْنَاهُ نُورًا نَّهْدِي بِهِ مَن نَّشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا
"হে নবী! তুমি তো জানতেও না কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমি এ অহীকে একটি আলোয় পরিণত করে
দিয়েছি। যার সাহায্যে আমি নিজের
বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চাই তাকে পথ দেখাই।" (আশ্-শূরাঃ ৫২ আয়াত)
[আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুআন, সূরা
ইউনুস ২১, আনকাবুত ৮৮-৯২ এবং শূরা ৮৪ টীকা।]
১১০. অর্থাৎ আল্লাহ যখন না চাইতেই তোমাদের এ নিয়ামত দান করেছেন
তখন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, তোমাদের সমস্ত শক্তি ও শ্রম এর পতাকা বহন করার এবং এর প্রচার ও প্রসারের
কাজে ব্যয় করবে এ কাজে ত্রুটি ও গাফলতি করার মানে হবে তোমরা সত্যের পরিবর্তে সত্য
অস্বীকারকারীদেরকে সাহায্য করেছো। এর অর্থ এ নয়, নাউযুবিল্লাহ নবী সা.এর এ ধরনের কোন ভুলের
আশংকা ছিল। বরং এভাবে আল্লাহ কাফেরদেরকে
শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের নবীকে এ হিদায়াত দান করছেন যে, এদের শোরগোল ও বিরোধিতা
সত্ত্বেও তুমি নিজের কাজ করে যাও এবং তোমার এ দাওয়াতের ফলে সত্যের দুশমনরা তাদের
জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবার যেসব আশংকা প্রকাশ করে তার পরোয়া করার কোন প্রয়োজন নেই।
﴿وَلَا
يَصُدُّنَّكَ عَنْ آيَاتِ اللَّهِ بَعْدَ إِذْ أُنزِلَتْ إِلَيْكَ ۖ وَادْعُ إِلَىٰ
رَبِّكَ ۖ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
৮৭) আর এমনটি যেন কখনো না হয় যে, আল্লাহর আয়াত যখন তোমার প্রতি
অবতীর্ণ হয় তখন কাফেররা তোমাকে তা থেকে বিরত রাখে।১১১ নিজের রবের দিকে দাওয়াত দাও
এবং কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না
১১১. অর্থাৎ, সেগুলোর প্রচার ও প্রসার থেকে এবং সে অনুযায়ী কাজ করা থেকে।
﴿وَلَا
تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۘ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ
إِلَّا وَجْهَهُ ۚ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
৮৮) এবং আল্লাহর সাথে অন্য মাবুদদেরকে
ডেকো না। তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। সব জিনিসই
ধ্বংস হবে কেবলমাত্র তাঁর সত্ত্বা ছাড়া। শাসন
কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই১১২ এবং তাঁরই দিকে তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে।
১১২. এ অর্থও হতে পারে, শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই জন্য অর্থাৎ, একমাত্র তিনিই তার অধিকার রাখেন।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।