০৩০. সূরা আর রূম
আয়াতঃ ৬০; রুকুঃ ০৬; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
প্রথম আয়াতের غُلِبَتِ
الرُّومُ থেকে সূরার নামকরণ করা
হয়েছে।
নাযিলের
সময়কালঃ
শুরতেই যে ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা থেকে নাযিলের সময় কাল চূড়ান্তভাবে
নির্ধারিত হয়ে যায়। এখানে বলা হয়েছে যে,”নিকটবর্তী দেশে রোমীয়রা পরাজিত হয়েছে।”সে
সময় আরবের সন্নিহিত রোম অধিকৃত এলাকা ছিল জর্দান, সিরিয়া ও
ফিলিস্তীন। এসব এলাকায় রোমানদের ওপর ইরানীদের বিজয় ৬১৫ খৃষ্টাব্দে পূর্ণতা লাভ
করেছিল। এ থেকে পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে বলা যেতে পারে যে, এ
সূরাটি সে বছরই নাযিল হয় এবং হাবশায় হিজরাতও এ বছরই অনুষ্ঠিত হয়।
ঐতিহাসিক
পটভূমিঃ
এ সূরার প্রথম দিকের আয়াতগুলোতে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা কুরআন মজীদের
আল্লাহর কালাম এবং মুহাম্মদ সা. এর সত্য রসূল হবার সুস্পষ্ট প্রমাণগুলোর অন্যতম।
এটি অনুধাবন করার জন্য এ আয়াতগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটু
বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
নবী সা. এর নবুওয়াত লাভের ৮ বছর আগের একটি ঘটনা। রোমের কায়সার মরিসের (Mauric)
বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ হয়। ফোকাস (phocas) নামক এক ব্যক্তি রাজ সিংহাসন
দখল করে। সে প্রথমে কায়সারের চোখের সামনে তাঁর পাঁচ পুত্রকে হত্যা করায় তাঁরপর
নিজে কায়সারকে হত্যা করে পিতা ও পুত্রদের কর্তিত মস্তকগুলো কনস্ট্যান্টিনোপলে
প্রকাশ্য রাজপথে টাঙিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পর সে কায়সারের স্ত্রী ও তাঁর তিন
কন্যাকেও হত্যা করে। এ ঘটনার ফলে ইরানের বাদশাহ খসরু পারভেজ রোম আক্রমণ করার
চমৎকার নৈতিক ওজুহাত খুঁজে পান। কায়সার মরিস ছিলেন তাঁর অনুগ্রাহক। তাঁর সহায়তায়
পারভেজ ইরানের সিংহাসন দখল করেন। তাই তিনি তাকে নিজের পিতা বলতেন। এ কারণে তিনি
ঘোষণা করেন, বিশ্বাসঘাতক
ফোকাস আমার পিতৃতুল্য ব্যক্তি ও তাঁর সন্তানদের প্রতি যে জুলুম করেছে আমি তাঁর
প্রতিশোধ নেবো। ৬০৩ খৃষ্টাব্দে তিনি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং
কয়েক বছরের মধ্যে ফোকাসের সেনাবাহিনীর একের পর এক পরাজিত করে একদিকে এশিয়া মাইনরের
এডেসার (বর্তমান উরফা) এবং অন্যদিকে সিরিয়ার হালব ও আন্তাকিয়ায় পৌঁছে যান। রোমের
রাজ পরিষদ যখন দেখলো ফোকাস দেশ রক্ষা করতে পারছে না তখন তারা আফ্রিকার গবর্ণরের
সাহায্য চাইলো। গবর্ণর তাঁর পুত্র হিরাক্লিয়াসকে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী সহকারে
কনস্ট্যান্টিনোপলে পাঠান। তার সেখানে পৌঁছে যাবার সাথে সাথেই ফোকাসকে পদচ্যুত করা
হয়। তাঁর পরিবর্তে হিরাক্লিয়াসকে কায়সার পদে অভিষিক্ত করা হয়। তিনি ক্ষমতাসীন হয়েই
ফোকাসের সাথে একই ব্যবহার করেন যা সে ইতিপূর্বে মরিসের সাথে করেছিল। এটি ছিল ৬১০
খৃষ্টাব্দের ঘটনা এবং এ বছর নবী সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত লাভ করেন।
খসরু পারভেজ যে নৈতিক বাহানাবাজির ভিত্তিতে যুদ্ধ করেছিলেন। ফোকাসের পদচ্যুতি
ও তাঁর হত্যার পর তা খতম হয়ে গিয়েছিল। যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাত ফোকাসের থেকে তাঁর
জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করাই তাঁর উদ্দেশ্যে থাকতো তাহলে তাঁর নিহত হবার পর নতুন
কায়সারের সাথে পারভেজের সন্ধি করে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি এরপরও যুদ্ধ জারি রাখেন। বরং এরপর তিনি এ
যুদ্ধকে অগ্নি উপাসক ও খৃষ্টবাদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধের রূপ দেন। খৃষ্টানদের যেসব
সম্প্রদায়কে ধর্মচ্যুত ও নাস্তিক গণ করে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় গীর্জা বছরের
পর বছর ধরে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল (অর্থাৎ নাস্তুরী, ইয়াকূবী
ইত্যাদি) তারাও আক্রমণকারী অগ্নি উপাসকদের প্রতি সর্বাত্মক সহানুভূতি দেখাতে থাকে।
এদিকে ইহুদীরাও অগ্নি উপাসকদেরকে সমর্থন দেয়। এমন কি খসরু পারভেজের সেনাবাহিনীতে
অংশ গ্রহণকারী ইহুদী সৈন্যদের সংখ্যা ২৬ হাজারে পৌঁছে যায়।
হিরাক্লিয়াস এসে এ বাঁধা ভাঙ্গা স্রোত রোধ করতে পারেন নি। সিংহাসনে আরোহণের
পরপরই পূর্বদেশ থেকে প্রথম যে খবরটি তাঁর কাছে পৌঁছে সেটি ছিল ইরানীদের হাতে
আন্তাকিয়ার পতন। তাঁরপর ৬১৩ খৃষ্টাব্দে তারা দামেশক দখল করে। ৬১৪ খৃষ্টাব্দে
বায়তুল মাকদিস দখল করে ইরানীরা সমগ্র খৃষ্টান জগতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ৯০
হাজার খৃষ্টানকে এই শহরে হত্যা করা হয়। তাদের সবচেয়ে পবিত্র আল কিয়ামাহ গীর্জা (Holy sepulchre) ধ্বংস
করে দেয়া হয়। আসল ক্রুশ দণ্ডটি, যে সম্পর্কে খৃষ্টানদের
বিশ্বাস হযরত মসীহকে তাতেই শূলীবিদ্ধ করা হয়েছিল,
ইরানীরা
ছিনিয়ে নিয়ে মাদায়েন পৌঁছিয়ে দেয়। আর্যবিশপ যাকারিয়াকেও পাকড়াও করা হয় এবং শহরের
সমস্ত বড় বড় গীর্জা তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। খসরু পারভেজ বিজয়ের নেশায় যেভাবে
পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তা বায়তুল মাকদিস থেকে হিরাক্লিয়াসকে তিনি যে পত্রটি লিখেছিলেন
তা থেকে আন্দাজ করা যায়। তাতে তিনি বলেনঃ
“সকল খোদার বড় খোদা, সমগ্র
পৃথিবীর অধিকারী খসরুর পক্ষ থেকে তাঁর নীচ ও মূর্খ অজ্ঞ বান্দা হিরাক্লিয়াসের নামে
“তুমি বলে থাকো, তোমার
খোদার প্রতি তোমার আস্থা আছে। তোমার খোদা আমার হাত থেকে জেরুশালেম রক্ষা করলেন না
কেন?”
এ বিজয়ের পর এক বছরের মধ্যে ইরানী সেনাদল জর্দান, ফিলিস্তীন
ও সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ দখল করে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা মিসর পর্যন্ত বিস্তৃত
করে। এটা এমন এক সময় ছিল যখন মক্কা মু’ আযযামায় এর চাইতে আরো অনেক বেশি
গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ চলছিল। এখানে মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বাধীনে
তাওহীদের পতাকাবাহীরা কুরাইশ সরদারদের নেতৃত্বে শিরকের পতাকাবাহীদের সাথে যুদ্ধরত
ছিল। এ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে,
৬১৫
খৃষ্টাব্দে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে স্বদেশ ত্যাগ করে হাবশার খৃষ্টান রাজ্যে (রোম
সাম্রাজ্যের মিত্র দেশ) আশ্রয় নিতে হয়। এ সময় রোম সাম্রাজ্যে ইরানের বিজয় অভিযানের
কথা ছিল সবার মুখেমুখে, মক্কার মুশরিকরা এসব কথায় আহলাদে আটখানা হয়ে
উঠেছিল। তারা মুসলমানদের বলতো, দেখো, ইরানের
অগ্নি উপাসকরা বিজয় লাভ করেছে এবং অহী ও নবুওয়াত অনুসারী খৃষ্টানরা একের পর এক
পরাজিত হয়ে চলছে। অনুরূপভাবে আমরা আরবের মূর্তিপূজারীরাও তোমাদেরকে এবং তোমাদের
দ্বীনকে ধ্বংস করে ছাড়বো।
এ অবস্থায় কুরআন মাজীদের এ সূরাটি নাযিল হয় এবং এখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়ঃ “নিকটবর্তী
দেশে রোমানরা পরাজিত হয়েছে কিন্তু এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যেই আবার তারা বিজয়ী
হবে।”এর মধ্যে একটির পরিবর্তে দুটি ভবিষদ্বাণী করা হয়েছে। একটি হচ্ছে,
রোমানরা
জয়লাভ করবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মুসলমানরাও একই সময় বিজয় লাভ
করবে। আপাতদৃষ্টিতে এ দুটি ভবিষদ্বাণীর কোন একটিরও কয়েক বছরের মধ্যে সত্যে পরিণত
হবার কোন দূরতম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না। একদিকে ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলমান।
তারা মক্কায় নির্যাতিত হয়ে চলছিল। এ ভবিষদ্বাণীর পরও আট বছর পর্যন্ত কোন দিক থেকে
তাদের বিজয় লাভের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে রোমের পরাজয়ের বহর দিনের
দিন বেড়েই চলছিল। ৬১৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র মিশর পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে
এসেছিল। অগ্নি উপাসক সেনাদল ত্রিপোলির সন্নিকটে পৌঁছে তাদের পতাকা গেড়ে দিয়েছিল। এশিয়া মাইনরে ইরানী সেনাদল রোমানদের বিতাড়িত ও
বিধ্বস্ত করতে করতে বসফোরাস প্রণালীতে পৌঁছে গিয়েছিল। ৬১৭ সালে তারা
কনস্ট্যান্টিনোপলের সামনে খিলকদুন (chalcedon: বর্তমানে
কাযীকোই) দখল করে নিয়েছিল। কায়সার খসরুর কাছে দূত পাঠিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও দীনতা
সহকারে আবেদন করলেন, আমি যে কোন মূল্যে সন্ধি করতে প্রস্তুত।কিন্তু
তিনি জবাব দিলেনঃ “এখন আমি কায়সারকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবো না যতক্ষণ না
তিনি শৃঙ্খলিত অবস্থায় আমার সামনে হাজির হন এবং তাঁর শূলী বিদ্ধ ঈশ্বরকে ত্যাগ করে
অগ্নি খোদার উপাসনা করেন।”অবশেষে কায়সার এমনই পরাজিত মনোভাব সম্পন্ন হয়ে পড়লেন যে, তিনি
কনস্ট্যান্টিনোপল ত্যাগ করে কার্থেজে (carthage:বর্তমান
টিউনিস) চলে যাবার পরিকল্পনা করলেন। মোটকথা ইংরেজ ঐতিহাসিক গীবনের বক্তব্য অনুযায়ী
কুরআন মাজীদের এ ভবিষদ্বাণীর পরও সাত আট বছর পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিল যার ফলে
রোমানরা ইরানীদের ওপর বিজয় লাভ করবে এ ধরনের কোন কথা কোন ব্যক্তি কল্পনাও করতে
পারতো না। বরং বিজয় তো দূরের কথা তখন
সামনের দিকে এ সাম্রাজ্য আর টিকে থাকবে এ আশাও কারো ছিল না।
কুরআন মাজীদের এ আয়াত নাযিল হলে মক্কার কাফেররা এ নিয়ে খুবই ঠাণ্ডা বিদ্রুপ
করতে থাকে। উবাই ইবনে খালফ হযরত আবু বকরের রা. সাথে বাজী রাখে। সে বলে, যদি
তিন বছরের মধ্যে রোমানরা জয়লাভ করে তাহলে আমি তোমাকে দশটা উট দেবো অন্যথায় তুমি
আমাকে দশটা উট দেবে। নবী সা. এর বাজীর কথা জানতে পেরে বলেন, কুরআনে
বলা হয়েছে فِي بِضْعِ
سِنِينَ আর
আরবী ভাষায় بِضْعِ শব্দ বললে দশের
কম বুঝায়। কাজেই দশ বছরের শর্ত রাখো এবং উটের সংখ্যা দশ থেকে বাড়িয়ে একশো করে দাও।
তাই হযরত আবু বকর রা. উবাইর সাথে আবার কথা বলেন এবং নতুনভাবে শর্ত লাগানো হয় যে, দশ
বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের যার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সে অন্যপক্ষকে একশোটি উট
দেবে।
৬২২ সালে একদিকে নবী সা. হিজরাত করে মদীনা তাইয়েবায় চলে যান অন্যদিকে কায়সার
হিরাক্লিয়াস নীরবে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে বের হয়ে কৃষ্ণসাগরের পথে ত্রাবিজুনের
দিকে রওয়ানা দেন। সেখানে গিয়ে তিনি পেছন দিক থেকে ইরানের ওপর আক্রমণ করার
প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য কায়সার গীর্জার কাছে
অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। ফলে খৃষ্টীয় গীর্জার প্রধান বিশপ সারজিয়াস (sergius) খৃষ্টবাদকে
মাজুসীবাদের (অগ্নিপূজা) হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গীর্জাসমূহে ভক্তদের নজরানা
বাবদ প্রদত্ত অর্থ সম্পদ সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেন। হিরাক্লিয়াস ৬২৩ খৃষ্টাব্দে
আর্মেনিয়া থেকে নিজের আক্রমণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বছর ৬২৪ সালে তিনি আজারবাইজানে
প্রবেশ করে জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান আরমিয়াহ (clorumia) ধ্বংস
করেন এবং ইরানীদের সর্ববৃহৎ অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন। আল্লাহর মহিমা দেখুন, এই
বছরেই মুসলমানরা বদর নামক স্থানে মুশরিকরা মোকাবিলায় প্রথম চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।
এভাবে সূরা রূমে উল্লেখিত দু’ টি ভবিষ্যদ্বাণীর দশ বছরের সময়সীমা শেষ হবার আগেই
একই সঙ্গে সত্য প্রমাণিত হয়।
এরপর রোমান সৈন্যরা অনবরত ইরানীদেরকে পর্যুদস্ত করে যেতেই থাকে। ৬২৭
খৃষ্টাব্দে নিনেভার যুদ্ধে তারা পারস্য সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। এরপর
পারস্য সম্রাটদের আবাসস্থল বিধ্বস্ত করে। হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদল সামনের দিকে এগিয়ে
যেতে থাকে এবং তারা তদানীন্তন ইরানের রাজধানী তায়াসফুনের (ctesiphon) দোরগোড়ায়
পৌঁছে যায়। ৬২৮ সালে খসরু পারভেজের পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তাকে
বন্ধী করা হয়। তাঁর চোখের সামনে তাঁর ১৮ জন পুত্র সন্তানকে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন
পরে কারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি নিজেও মৃত্যুবরণ হত্যা করা হয়।এ বছরই হুদাইবিয়ার
চুক্তি সম্পাদিত হয়, যাকে কুরআন মহা বিজয় নামে আখ্যায়িত করেছে এবং এ
বছরই খসরুর পুত্র দ্বিতীয় কুবাদ সমস্ত রোম অধিকৃত এলাকার ওপর থেকে অধিকার ত্যাগ
করে এবং আসল ক্রুশ ফিরিয়ে দিয়ে রোমের সাথে সন্ধি করে। ৬২৯ সালে “পবিত্র ক্রুশ”কে
স্বস্থানে স্থাপন করার জন্য কায়সার নিজে”বায়তুল মাকদিস”যান এবং এ বছরই নবী সা.
কাযা উমরাহ আদায় করার জন্য হিজরাতের পর প্রথম বার মক্কা মু’আযযমায় প্রবেশ করেন।
এরপর কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী যে,
পুরোপুরি
সত্য ছিল এ ব্যাপারে কারো সামান্যতম সন্দেহের অবকাশই ছিল না। আরবের বিপুল সংখ্যক
মুশরিক এর প্রতি ঈমান আনে। উবাই ইবনে খালফের উত্তরাধিকারীদের পরাজয় মেনে নিয়ে হযরত
আবু বকরকে রা. বাজীর একশো উট দিয়ে দিতে হয়। তিনি সেগুলো নিয়ে নবী সা. এর খেদমতে
হাজির হন। নবী সা. হুকুম দেন, এগুলো সাদকা করে দাও। কারণ বাজী যখন ধরা হয় তখন শরীয়াতে
জুয়া হারাম হবার হুকুম নাযিল হয়নি।কিন্তু এখন তা হারাম হবার হুকুম এসে গিয়েছিল।
তাই যুদ্ধের মাধ্যমে বশ্যতা স্বীকারকারী কাফেরদের থেকে বাজীর অর্থ নিয়ে নেয়ার
অনুমতি তো দিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু এই সঙ্গে হুকুম দেয়া হয়, তা
নিজে ভোগ না করে সাদকা করে দিতে হবে।
বিষয়বস্তু
ও মূল বক্তব্যঃ
এ সূরায় বক্তব্য এভাবে শুরু করা হয়েছে,
আজ
রোমানরা পরাজিত হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্ববাসী মনে করছে এ সাম্রাজ্যের পতন
আসন্ন।কিন্তু কয়েক বছর অতিবাহিত হতে না হতেই সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং আজ যে
পরাজিত সেদিন সে বিজয়ী হয়ে যাবে।
এ ভুমিকা থেকে একথা প্রকাশিত হয়েছে যে,
মানুষ
নিজের বাহ্য দৃষ্টির কারণে শুধুমাত্র তাই দেখে যা তাঁর চোখের সামনে থাকে।কিন্তু এ
বাহ্যিক পর্দার পেছনে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। এ বাহ্যদৃষ্টি
যখন দুনিয়ার সামান্য সামান্য ব্যাপারে বিভ্রান্তি ও
ভ্রান্ত অনুমানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যখন শুধুমাত্র “আগামীকাল কি হবে” এতটুকু কথা
না জানার কারণে মানুষ ভুল হিসেব করে বসে তখন সামগ্রিকভাবে সমগ্র জীবনের ব্যাপারে
ইহকালীন বাহ্যিক জীবনের ওপর নির্ভরশীল এবং এরি ভিত্তিতে নিজের সমগ্র জীবন পুঁজিকে
বাজী রাখা মস্ত বড় ভুল, তাতে
সন্দেহ নেই।
এভাবে রোম ইরানের বিষয় থেকে ভাষণ আখেরাতের বিষয়ের দিকে মোড় নিয়েছে এবং ক্রমাগত
তিন রুকু পর্যন্ত বিভিন্নভাবে একথা বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আখেরাতের
জীবন সম্ভব, যুক্তিসঙ্গত এবং এর প্রয়োজনও আছে। মানুষের জীবন
ব্যবস্থাকে সুস্থ ও সুন্দর করে রাখার স্বার্থেও তাঁর জন্য আখেরাতে বিশ্বাস করে
বর্তমান জীবনের কর্মসূচী নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় বাহ্যদৃষ্টির ওপর নির্ভর করে
কর্মসূচী গ্রহণ করার যে পরিণাম হয়ে থাকে তাই হতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে আখেরাতের পক্ষে যুক্তি পেশ করতে গিয়ে বিশ্ব-জগতের যেসব নিদর্শনকে
সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে সেগুলো তাওহীদেরও প্রমাণ পেশ করে। তাই চতুর্থ
রুকুর শুরু থেকে তাওহীদের সত্য ও শিরককে মিথ্যা প্রমাণ করাই ভাষণের লক্ষ হয়ে
দাঁড়ায় এবং বলা হয়, মানুষের
জন্য পুরোপুরি এক নিষ্ঠ হয়ে এক আল্লাহর বন্দেগী করা ছাড়া আর কোন প্রাকৃতিক ধর্ম
নেই। শিরক বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির বিরোধী। তাই যেখানেই মানুষ এ ভ্রষ্টতাঁর
পথ অবলম্বন করেছে সেখানেই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে আবার সেই মহা বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে
যা সে সময় দুনিয়ার দুটি সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হয়ে
গিয়েছিল। বলা হয়েছে, এ বিপর্যয়ও শিরকের অন্যতম ফল এবং মানব জাতির
অতীত ইতিহাসে যতগুলো জাতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তারা সবাই ছিল মুশরিক।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে উপমার মাধ্যমে লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে, যেমন
মৃত পতিত যমীন আল্লাহ প্রেরিত বৃষ্টির স্পর্শে সহসা জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং জীবন ও
ফসলের ভাণ্ডার উদগীরণ করতে থাকে, ঠিক তেমনি আল্লাহ প্রেরিত
অহী ও নবুওয়াতও মৃত পতিত মানবতাঁর পক্ষে রহমতের বারিধারা স্বরূপ এবং নাযিল হওয়া
তাঁর জন্য জীবন, বৃদ্ধি,
বিকাশ
এবং কল্যাণের উৎসের কারণ হয়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে আরবের এ অনুর্বর ভূমি
আল্লাহর রহমতে শস্য শ্যামল হয়ে উঠবে এবং সমস্ত কল্যাণ হবে তোমাদের নিজেদেরই জন্য।
আর এর সদ্ব্যবহার না করলে নিজেদেরই ক্ষতি করবে। তাঁরপর অনুশোচনা করেও কোন লাভ হবে
না এবং ক্ষতিপূরণ করার কোন সুযোগই পাবে না।
﴿بِسْمِ اللَّهِ
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿الم﴾
﴿غُلِبَتِ الرُّومُ﴾
২) রোমানরা নিকটবর্তী দেশে পরাজিত হয়েছে
এবং নিজেদের এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যে তারা বিজয় লাভ করবে।১
১. ইবনে আব্বাস রা. এবং অন্যান্য সাহাবী ও তাবেঈগণের বর্ণনা
থেকে জানা যায়, রোম ও ইরানের এ যুদ্ধে মুসলমানদের সহানুভূতি
ছিল রোমের পক্ষে এবং মক্কার কাফেরদের সহানুভূতি ছিল ইরানের পক্ষে। এর কয়েকটি কারণ ছিল। এক, ইরানীরা
এ যুদ্ধকে খৃষ্টবাদ অগ্নি পূজার মতবাদের যুদ্ধের রূপ দিয়েছিল। তারা দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে অতিক্রম করে একে
অগ্নি পূজার মতবাদ বিস্তারের মাধ্যমে পরিণত করছিল। বায়তুল মাকদিস জয়ের পর খসরু পারভেজ রোমের
কায়সারের কাছে যে পত্র লিখেছিলেন তাতে পরিষ্কারভাবে নিজের বিজয়কে তিনি অগ্নি
উপাসনাবাদের সত্যতাঁর প্রমাণ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। নীতিগতভাবে অগ্নি উপাসনাবাদের সাথে মক্কার
মুশরিকদের ধর্মের মিল ছিল। কারণ, তারাও ছিল তাওহীদ
অস্বীকারকারী। তারা দুই খোদকে মানতো এবং
আগুনের পূজা করতো। তাই মুশরিকরা ছিল তাদের
প্রতি সহানুভূতিশীল।
তাদের মোকাবিলায় খৃষ্টানরা যতই শিরকে লিপ্ত হয়ে যাক না কেন তবুও তারা তাওহীদকে
ধর্মের মূল ভিত্তি বলে স্বীকার করতো। তারা আখেরাতে বিশ্বাস করতো এবং অহী ও রিসালাতকে হিদায়েতের
উৎস বলে মানতে। তাই তাদের ধর্ম তাঁর আসল
প্রকৃতির দিক থেকে মুসলমানদের ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল।এ জন্য মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি
সহানুভূতিশীল ছিল এবং তাদের ওপর মুশরিক জাতির বিজয়কে তারা অপছন্দ করতো। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, এক
নবীর আগমনের পূর্বে পূর্ববর্তী নবীকে যারা মানতো নীতিগতভাবে তারা মুসলমানের সংজ্ঞারই
আওতাভুক্ত হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত পরবর্তী আগমনকারী নবীর দাওয়াত তাদের কাছে না
পৌঁছে এবং তারা তা অস্বীকার না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুসলমানদের মধ্যেই গণ্য
হতে থাকে। (দেখুন, সূরা
কাসাসঃ ৭৩ টীকা) সে সময় নবী সা. এর নবুওয়াত লাভের পর মাত্র পাঁচ-ছয় বছর অতিবাহিত
হয়েছিল। তাঁর দাওয়াত তখনো বাইরে
পৌঁছে নি। তাই মুসলমানরা খৃষ্টানদেরকে
কাফেরদের মধ্যে গণ্য করতো না। তবে ইহুদীরা তাদের দৃষ্টিতে ছিল কাফের। কারণ তারা ঈসা আ. এর
নবুওয়াত অস্বীকার করতো।
তৃতীয় কারণ ছিল, ইসলামের
সূচনায় খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাথে সহানুভূতি পূর্ণ ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন সূরা কাসাসের ৫২ থেকে
৫৫ এবং সূরা মায়েদার ৮২ থেকে ৮৫ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। বরং তাদের মধ্য থেকে বহু লোক খোলা মন নিয়ে
সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করছিল। তাঁরপর হাবশায় হিজরাতের সময় খৃষ্টান বাদশাহ মুসলমানদেরকে
আশ্রয় দেন এবং তাদের ফেরত পাঠাবার জন্য মক্কায় কাফেরদের দাবী প্রত্যাখান করেন। এরও দাবি ছিল মুসলমানরা
অগ্নি পূজারীদের মোকাবিলায় খৃষ্টানদের কল্যাণকামী হোক।
﴿فِي
أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ﴾
৩) ক্ষমতা ও কতৃত্ব আগেও আল্লাহরই ছিল। পরেও
তাঁরই থাকবে।২
২. অর্থাৎ পূর্বে যখন ইরানীরা জয়লাভ করে তখন নাউযুবিল্লাহ
তাঁর অর্থ এটা ছিল না যে, বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহ তাদের মোকাবিলায়
পরাজিত হয়ে গেছেন এবং পরে যখন রোমীয় জয়লাভ করবে তখন এর অর্থ এ হবে না যে, আল্লাহ
তাঁর হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাবেন। সর্ব অবস্থায় শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্যই
নির্ধারিত। পূর্বে যে বিজয় লাভ করে
তাকে আল্লাহই বিজয় দান করেন এবং পরে যে জয়লাভ করবে সেও আল্লাহরই হুকুমে জয়লাভ করবে। তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বে
কেউ নিজের শক্তির জোরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে না। তিনি যাকে উঠান সে-ই ওঠে এবং যাকে নামিয়ে দেন
সে-ই নেমে যায়।
﴿فِي
بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِن قَبْلُ وَمِن بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ
يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ﴾
৪) আর সেদিনটি হবে এমন দিন যেদিন আল্লাহ
প্রদত্ত বিজয়ে মুসলমানরা আনন্দে উৎফুল্ল হবে।৩
৩. ইবনে আব্বাস রা. আবু সাঈদ খুদরী রা.,
সুফিয়ান
সওরী রা., সুদ্দী প্রমুখ মনীষীগণ বর্ণনা করেন,
ইরানীদের
ওপর রোমীয়রা এবং বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের ওপর মুসলমানরা একই সময় বিজয় লাভ করেন। এ জন্য মুসলমানরা দ্বিগুণ
আনন্দিত হয়। ইরান ও রোমের ইতিহাস থেকেও
একথাই প্রমাণিত হয়। ৬২৪ সালে বদরের যুদ্ধ হয়। এ বছরই রোমের কায়সার অগ্নি
উপাসনাবাদের প্রবর্তক জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান ধ্বংস করেন এবং ইরানের সবচেয়ে বড়
অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন।
﴿بِنَصْرِ
اللَّهِ ۚ يَنصُرُ مَن يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ﴾
৫) আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং
তিনি পরাক্রমশালী ও মেহেরবান।
﴿وَعْدَ اللَّهِ ۖ لَا
يُخْلِفُ اللَّهُ وَعْدَهُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৬) আল্লাহ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আল্লাহ কখনো নিজের
প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধাচরণ করেন না। কিন্তু
অধিকাংশ লোক জানে না।
﴿يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا
مِّنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ﴾
৭) লোকেরা দুনিয়ায় কেবল বাহ্যিক দিকটাই
জানে এবং আখেরাত থেকে তারা নিজেরাই গাফেল।৪
৪. অর্থাৎ যদিও আখেরাতের প্রমাণ পেশ করার মত বহু সাক্ষ্য ও
নিদর্শন রয়েছে এবং সেগুলো থেকে গাফিল হবার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। তবুও এরা নিজেরাই গাফিল
থেকেছে। অন্য কথায় এটা তাদের
নিজেদের ত্রুটি। দুনিয়ার জীবনের এই বাহ্যিক
পর্দার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে তারা বসে রয়েছে। এর পিছনে যা কিছু আসছে সে সম্পর্কে তারা কিছুই
জানেনা। নয় তো আল্লাহর পক্ষ থেকে
তাদেরকে জানাবার ব্যাপারে কোন প্রকার ত্রুটি করা হয়নি।
﴿أَوَلَمْ
يَتَفَكَّرُوا فِي أَنفُسِهِم ۗ مَّا خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُّسَمًّى ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ
النَّاسِ بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ لَكَافِرُونَ﴾
৮) তারা কি কখনো নিজেদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা
করেনি?৫ আল্লাহ
পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলী এবং তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে সবকিছু সঠিক উদ্দেশ্যে এবং
একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন।৬ কিন্তু
অনেকেই তাদের রবের সাক্ষাতে বিশ্বাস করে না।৭
৫. আখেরাতের পক্ষে একটি স্বতন্ত্র যুক্তি। এর অর্থ হচ্ছে যদি এরা
বাইরে কোথাও দৃষ্টি দেবার পূর্বে নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতো
তাহলে নিজেদের মধ্যেই এমন সব যুক্তি পেয়ে যেতো যা বর্তমান জীবনের পরে আর একটি
জীবনের প্রয়োজনের সত্যতাঁর প্রমাণ করতো। মানুষের এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে পৃথিবীর
অন্যান্য জিনিস থেকে আলাদা করেঃ
একঃ পৃথিবী ও তাঁর পরিবেশের অসংখ্য জিনিস তাঁর বশীভূত করে দেয়া হয়েছে এবং
সেগুলো ব্যবহার করার ব্যাপক ক্ষমতা তাকে দান করা হয়েছে।
দুইঃ নিজের জীবনের পথ বেছে নেবার জন্য তাকে স্বাধীন ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। ঈমান ও কুফরী,
আনুগত্য
ও বিদ্রোহ এবং সুকৃতি ও দুষ্কৃতির পথের মধ্য থেকে যে কোন পথেই নিজের ইচ্ছামত সে
চলতে পারে। সত্য ও মিথ্যা এবং সঠিক ও
বেঠিক যে কোন পথই সে অবলম্বন করতে পারে। প্রত্যেকটি পথে চলার সুযোগ তাকে দেয়া হয়েছে এবং এ চলার জন্য
সে আল্লাহর সরবরাহকৃত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে পারে তা আল্লাহর আনুগত্যের বা তাঁর
নাফরমানির যে কোন পথই হোক না কেন।
তিনঃ তাঁর মধ্যে জন্মগতভাবে নৈতিকতাঁর অনুভূতি রেখে দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে সে ইচ্ছাকৃত
কাজ ও অনিচ্ছাকৃত কাজের মধ্যে ফারাক করে,
ইচ্ছাকৃত
কাজকে সৎকাজ ও অসৎকাজ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং স্বতস্ফুর্তভাবে এই মত অবলম্বন করে
যে, সৎকাজ পুরস্কার লাভের এবং অসৎকাজ শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া
উচিত।
মানুষের নিজের সত্তার মধ্যে এই যে তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় এগুলো একথাই
প্রমাণ করে যে, এমন কোন সময় আসা উচিত যখন মানুষের সমস্ত কাজের
জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তাকে
দুনিয়ায় যা কিছু দেয়া হয়েছিল তা ব্যবহার করার ক্ষমতাকে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে?
যখন
দেখা যাবে, নিজের নির্বাচনের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে সে
সঠিক পথ অবলম্বন করেছে, না ভুল পথ?যখন তাঁর ঐচ্ছিক কার্যাবলী যাচাই করা হবে
এবং সৎকাজে পুরস্কার ও অসৎকাজে শাস্তি দেয়া হবে। একথা সুনিশ্চিত যে, মানুষের
জীবনের কার্যাবলী শেষ হবার এবং তাঁর কর্মদপ্তর বন্ধ হয়ে যাবার পরই এ সময়টি আসতে
পারে, তাঁর আগে আসতে পারে না। আর এ সময়টি অবশ্যই এমন সময় আসা উচিত যখন এক
ব্যক্তি বা একটি বা জাতির নিজের কার্যাবলীর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে যেসব প্রভাব
বিস্তার করে যায় উক্ত ব্যক্তি বা জাতির মৃত্যুতে তাঁর ধারাবাহিকতা খতম হয়ে যায় না। তাঁর রেখে যাওয়া ভালো বা
মন্দ প্রভাবও তো তাঁর আমলনামায় লিখিত হওয়া উচিত। এ প্রভাবগুলো যে পর্যন্ত না পুরোপুরি প্রকাশ
হয়ে যায় সে পর্যন্ত ইনসাফ অনুযায়ী পুরোপুরি হিসেব-নিকেশ করা এবং পুরোপুরি পুরস্কার
বা শাস্তি দেয়া কেমন করে সম্ভব? এভাবে মানুষের নিজের অস্তিত্ব একথার সাক্ষ্য পেশ করে এবং
পৃথিবীতে মানুষকে যে মর্যাদা দান করা হয়েছে তা স্বতস্ফুর্তভাবে এ দাবী করে যে, দুনিয়ার
বর্তমান জীবনের পরে আর একটি জীবন এমন হতে হবে যেখানে আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনসাফ
সহকারে মানুষের জীবনের সমস্ত কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ করা হবে এবং প্রত্যেক
ব্যক্তিকে তাঁর কৃতকর্ম অনুসারে প্রতিদান দেয়া হবে।
৬. এ বাক্যে আখেরাতের সপক্ষে আরো দুটি যুক্তি পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মানুষ
যদি নিজের অস্তিত্বের বাইরে বিশ্ব ব্যবস্থাকে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে তাহলে
দুটি সত্য সুস্পষ্টভাবে তাঁর দৃষ্টিগোচর হবেঃ
একঃ এ বিশ্ব-জাহানকে যথার্থ সত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা কোন শিশুর খেলা নয়। নিছক মন ভুলাবার জন্য নিজের
খেয়ালখুশি মতো সে উল্টা পাল্টা ধরনের যে কোন রকমের একটা ঘর তৈরি করেনি যা তৈরি করা
ও ভেঙ্গে ফেলা দুটোই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং এটি একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা। এর প্রতিটি অণূ ও পরমাণূ এ
কথারই সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, একে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও
বিচক্ষণতা সহকারে তৈরি করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে একটি আইন সক্রিয় রয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসই
উদ্দেশ্যমুখি। মানুষের সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি,
অর্থ
ব্যবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান একথারই সাক্ষ্যবহ। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের পেছনে সক্রিয় নিয়ম-নীতি
উদ্ভাবন করে এবং প্রত্যেকটি বস্তু যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তা অনুসন্ধান করেই
মানুষ এখানে এ সবকিছু তৈরি করতে পেরেছে। অন্যথায় যদি একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যহীন খেলনার
মধ্যে একটি পুতুলের মতো তাকে রেখে দেয়া হতো,
তাহলে
কোন প্রকার বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা কল্পনাই করা যেতে না। এখন যে জ্ঞানবান সত্তা এহেন
প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্যমুখিতা সহকারে এ দুনিয়া তৈরি করেছেন এবং এর মধ্যে মানুষের মতো
একটি সৃষ্টিকে সর্ব পর্যায়ের বৃদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক শক্তি,
ক্ষমতা
ও ইখতিয়ার, স্বাধীন
নির্বাচন ক্ষমতা ও নৈতিক অনুভূতি দিয়ে নিজের দুনিয়ার অসংখ্য সাজ-সরজ্ঞাম তাঁর হাতে
সঁপে দিয়েছেন, তিনি মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি করেছেন একথা
কেমন করে তোমাদের বোধগম্য হলোঃ তোমরা কি দুনিয়ার ভাঙ্গা ও গড়া,
সুকৃতি
ও দুষ্কৃতি, জুলুম
ও ইনসাফ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের যাবতীয় কাজ কারবার করার পর এমনিই মরে মাটিতে মিশে
যাবে এবং তোমাদের কোন ভালো বা মন্দ কাজের কোন ফলাফল দেখা যাবে না?
তোমরা
কি নিজেদের এক একটি কাজের মাধ্যমে তোমাদের ও তোমাদের মতো হাজার হাজার মানুষের
জীবনের ওপর এবং দুনিয়ার অসংখ্য জিনিসের ওপর বহুতর শুভ ও অশুভ প্রভাব বিস্তার করে
চলে যাবে এবং তোমাদের মৃত্যুর পর পরই এই সমগ্র কর্মদপ্তরকে এমনি গুটিয়ে নদীতে
নিক্ষেপ করে দেয়া হবে?
এ বিশ্ব ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণ করার পর দ্বিতীয় সত্যটি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে
সেটি হচ্ছে, এখানে কোন জিনিসই চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের একটি
নির্ধারিত জীবনকাল রয়েছে।
সেখানে পৌঁছে যাবার পর তা শেষ হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যাপারেও একথাই সত্য। এখানে যতগুলো শক্তিই কাজ
করছে তারা সবই সীমাবদ্ধ।
একটি সময় পর্যন্ত তারা কাজ করছে। কোন এক সময় তারা অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং এ ব্যবস্থাটি
খতম হয়ে যাবে। প্রাচীনকালে যেসব দার্শনিক
ও বিজ্ঞানী দুনিয়াকে আদি ও চিরন্তন বলে প্রচার করতো তাদের বক্তব্যও তবুও তো
সর্বব্যাপী অজ্ঞতা ও মূর্খতাঁর দরুন কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করতো কিন্তু দীর্ঘকাল
ব্যাপী নাস্তিক্যবাদী ও আল্লাহ বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্ব-জগতের নশ্বরতা ও অবিনশ্বরতা
নিয়ে যে বিতর্ক চলে আসছিল, আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় চূড়ান্তভাবেই সে ক্ষেত্রে
নিজের ভোটটি আল্লাহ বিশ্বাসীদের পক্ষে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই বর্তমানে নাস্তিক্যবাদীদের পক্ষে বুদ্ধি
ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নাম নিয়ে এ দাবী উত্থাপন করার কোন অবকাশই নেই যে, এ
দুনিয়া চিরকাল আছে, চিরকাল থাকবে এবং কিয়ামত কোনদিন আসবে না। পুরাতন বস্তুবাদীতার যাবতীয়
ভিত্তি এ চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে,
বস্তুর
বিনাশ নেই,কেবলমাত্র রূপান্তর ঘটতে পারে। তখনকার চিন্তা ছিল,
প্রত্যেক
পরিবর্তনের পর বস্তু বস্তুই থেকে যায় এবং তাঁর পরিমাণ কোন কম বেশি হয় না। এরই ভিত্তিতে এ সিন্ধান্ত
শোনানো হতো যে, এ বস্তুজগতের কোন আদি অন্ত নেই।কিন্তু বর্তমানে আনবিক শক্তি
(Atomic
Energy)আবিষ্কারের ফলে এ সমগ্র চিন্তার ধারাই উলটে গেছে। এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে
যে, শক্তি বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে এবং বস্তু আবার শক্তিরূপে
আত্নপ্রকাশ করে, এমন কি শেষ পর্যন্ত তাঁর আকৃতিও থাকে না। ভৌতিক অবস্থানও থাকে না। এখন তাপের গতির দ্বিতীয় আইন
(second
law of thermo-Dynamics) একথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ
বস্তুজগত না অনাদি হতে পারে, না অনন্ত। অবশ্যই এক সময় এর শুরু এবং এক সময় শেষ হতে হবে। তাই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে
বর্তমানে কিয়ামত অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর একথা সুস্পষ্ট যে,
বিজ্ঞান
যদি আত্মসমর্পন করে তবে দর্শন কিসের ভিত্তিতে কিয়ামত অস্বীকার করবে?
৭. অর্থাৎ মৃত্যুর পর নিজের রবের সামনে হাজির হতে হবে, একথা
বিশ্বাস করে না।
﴿أَوَلَمْ
يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن
قَبْلِهِمْ ۚ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَأَثَارُوا الْأَرْضَ
وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا وَجَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ
ۖ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾
৯) আর এরা কি কখনো পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? তাহলে এদের পূর্বে যারা
অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের পরিণাম এরা দেখতে পেতো।৮ তারা এদের
চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল, তারা জমি কর্ষণ করেছিল খুব ভালো করে৯ এবং এত
বেশি আবাদ করেছিল যতটা এরা করেনি।১০ তাদের কাছে
তাদের রাসূল আসে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী নিয়ে।১১ তাঁরপর
আল্লাহ তাদের প্রতি জুলূমকারী ছিলেন না কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম
করছিল।১২
৮. আখেরাতের পক্ষে এটি একটি ঐতিহাসিক যুক্তি। এর অর্থ হচ্ছে,
কেবল
দুনিয়ার দু'চারজন লোকই তো আখেরাত অস্বীকার করেনি বরং মানব
ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। বরং অনেক জাতির সমস্ত লোকই
আখেরাত অস্বীকার করেছে অথবা তা থেকে গাফিল হয়ে গেছে কিংবা মৃত্যু পরের জীবন
সম্পর্কে এমন মিথ্যা বিশ্বাস উদ্ভাবন করে নিয়েছে যার ফলে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস
অর্থহীন হয়ে গেছে। তারপর ইতিহাসের ধারাবাহিক
অভিজ্ঞতা একথা জানিয়ে দিয়েছে যে, যেভাবেই আখেরাত অস্বীকার করা
হোক না কেন, তাঁর অনিবার্য ফল স্বরূপ মানুষের নৈতিক চরিত্র
নষ্ট হয়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে দায়িত্বহীন
মনে করে লাগামহীন ও স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত হয়েছে। তারা জুলুম, বিপর্যয়, ফাসেকী
ও অশ্লীল আচরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ জিনিসটির বদৌলতে জাতিসমূহ একের পর এক ধ্বংস
হতে থেকেছে। হাজার বছরের ইতিহাসে মানব
বংশ একের পর এক যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তা কি একথা প্রমাণ করে না যে, আখেরাত
একটি সত্য, যা অস্বীকার করা মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মকছাড়া
আর কিছুই নয়। মানুষ অভিজ্ঞতা ও
পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বস্তুকে সবসময় মাটির দিকে নেমে আসতে দেখেছে বলেই সে ভারী
জিনিসের আকর্ষণ স্বীকার করে। সে বিষ খেয়েছে সে-ই মারা পড়েছে, এ
জন্যই মানুষ বিষকে বিষ বলে মানে। অনুরূপভাবে আখেরাত অস্বীকার যখন চিরকাল মানুষের নৈতিক
বিকৃতির কারণ প্রমাণিত হয়েছে তখন এ অভিজ্ঞতা কি এ শিক্ষা দেবার জন্য যথেষ্ঠ নয় যে, আখেরাত
একটি জাজ্বল্যমান সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে দুনিয়ার জীবন যাপন করা ভুল?
৯. মূল শব্দ হচ্ছে أثار الأرض' কৃষিকাজ
করার জন্য লাঙ্গল দেয়া অর্থেও এ শব্দের ব্যবহার হতে পারে আবার মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভ
থেকে পানি উঠানো, খাল খনন এবং খনিজ পদার্থ ইত্যাদি বের করাও হয়।
১০. যারা নিছক বস্তুগত উন্নতিকে একটি জাতির সৎ হবার আলামত মনে
করে এখানে তাদের যুক্তির জবাব রয়েছে। তারা বলে যারা পৃথিবীর উপায়-উপকরণকে এত বিপুল পরিমাণে
ব্যবহার (Exploit) করেছে
তারা দুনিয়ার বিরাট উন্নয়নমূলক কাজ করেছে এবং একটি মহিমান্বিত সভ্যতাঁর জন্ম
দিয়েছে। কাজেই মহান আল্লাহ তাদেরকে
জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত করবেন এটা কেমন করে সম্ভব! কুরআন এর জবাব এভাবে দিয়েছে”এমন
উন্নয়নমূলক কাজ”পূর্বেও বহু জাতি বিরাট আকারে করেছে। তাঁরপর কি তোমরা দেখনি সে জাতিগুলো তাদের
নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি সহকারে ধূলায় মিশে গেছে এবং তাদের”উন্নয়নের”আকাশচুম্বি
প্রাসাদ ভুলুণ্ঠিত হয়েছে? যে
আল্লাহর আইন ইহজগতে সত্যের প্রতি বিশ্বাস ও সৎ চারিত্রিক গুণাবলী ছাড়া নিছক
বস্তুগত নির্মাণের এরূপ মূল্য দিয়েছে সে একই আল্লাহর আইন কি কারণে পারলৌকিক জগতে
তাকে জাহান্নামে স্থান দেবে না?
১১. অর্থাৎ এমন নিদর্শনাবলী নিয়ে যা তাদেরকে সত্য নবী হবার
নিশ্চয়তা দেবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। এখানকার পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপট নবীদের আগমনের কথা
উল্লেখ করার অর্থ হচ্ছে এই যে, একদিকে মানুষের নিজের
অস্তিত্বের মধ্যে, এর বাইরে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থায় এবং
মানুষের ইতিহাসের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় আখেরাতের সাক্ষ্য বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে একের পর এক নবীগণ
এসেছেন। তাদের সাথে তাদের নবুওয়াত
সত্য হবার সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া যেতো এবং যথার্থই আখেরাতের আগমন সম্পর্কে তারা
মানুষকে সতর্কও করতেন।
১২. অর্থাৎ এরপর এ জাতিগুলো যে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে তা
তাদের ওপর আল্লাহর জুলুম ছিল না বরং তা ছিল তাদের নিজেদের জুলুম। এসব জুলুম তারা নিজেরাই
নিজেদের ওপর করেছিল। যে
ব্যক্তি বা দল নিজে সঠিক চিন্তা করে না এবং অন্যের বুঝিয়ে দেবার পরও সঠিক নীতি
অবলম্বন করে না সে নিজেই নিজের অশুভ পরিণামের জন্য দায়ী হয়। এ জন্য আল্লাহকে দোষারোপ করা যেতে পারে না। আল্লাহ নিজের কিতাব ও
নবীগণের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের জ্ঞানের সত্যতা যাচাই করতে পারে। এ পথনির্দেশনা এবং উপকরণাদি
থেকে আল্লাহ যদি মানুষকে বঞ্চিত করে থাকতেন এবং সে অবস্থায় মানুষকে ভুল পথে যাবার
ফল পেতে হতো তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিরুদ্ধে জুলুমের দোষারোপ করার অবকাশ সৃষ্টি
হতে পারতো।
﴿ثُمَّ
كَانَ عَاقِبَةَ الَّذِينَ أَسَاءُوا السُّوأَىٰ أَن كَذَّبُوا بِآيَاتِ اللَّهِ
وَكَانُوا بِهَا يَسْتَهْزِئُونَ﴾
১০) শেষ পর্যন্ত যারা অসৎকাজ করেছিল তাদের
পরিণাম হয়েছিল বড়ই অশুভ, কারণ তারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলেছিল এবং তারা সেগুলোকে
বিদ্রুপ করতো।
﴿اللَّهُ يَبْدَأُ
الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
১১) আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা করেন, তাঁরপর তিনিই তাঁর
পুনরাবৃত্তি করবেন।১৩ তাঁরপর
তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে।
১৩. কথাটি দাবীর ভঙ্গিতে বলা হলেও দাবীর স্বপক্ষে যুক্তিও এর
মধ্যে রয়ে গেছে। সুস্পষ্ট বুদ্ধিবৃত্তি
একথার সাক্ষ্য দিয়ে থাকে যে, সৃষ্টির সূচনা করা যার পক্ষে
সম্ভবপর তাঁর পক্ষে একই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করা আরো ভালোভাবেই সম্ভবপর। সৃষ্টির সূচনা তো একটি
বাস্তব সত্য, বিষয়টি সবার সামনেই রয়েছে। কাফের ও মুশরিকরাও এটাকে আল্লাহর কাজ বলে
স্বীকার করে। এরপর যে আল্লাহ এ সৃষ্টির
সূচনা করেন তিনি এর পুনরাবৃত্তি করতে পারেন না,
তাদের
এ চিন্তা একেবারেই অর্থহীন ও অযৌক্তিক।
﴿وَيَوْمَ
تَقُومُ السَّاعَةُ يُبْلِسُ الْمُجْرِمُونَ﴾
১২) আর যখন সে সময়টি১৪ সমাগত হবে, সেদিন অপরাধী বিস্ময়ে বিমূঢ়
হয়ে যাবে।১৫
১৪. অর্থাৎ আল্লাহর দিকে ফিরে যাবার এবং তাঁর সামনে উপস্থিত
হবার সময়।
১৫. মূল শব্দ হচ্ছে ابلاس এর অর্থ হচ্ছে চরম হতাশা ও
দুঃখ-বেদনার কারণে কোন ব্যক্তির একেবারে হতবাক ও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। আশার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে
গিয়েছে দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে যাওয়া এবং কোন যুক্তি ও সমর্থন না পাওয়ার কারণে
রুদ্ধশ্বাস হওয়া। এ শব্দটি যখন অপরাধীর জন্য
ব্যবহার করা হয় তখন মনের পাতায় তাঁর যে ছবি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে এই যে, এক
ব্যক্তিকে অপরাধ করার সময় হাতে নাতে পাকড়াও করা হয়েছে। সে পালাবার কোন পথ পাচ্ছে না এবং নিজের সাফাই
গাইবার জন্য কোন জিনিস পেশ করে বের হয়ে আসার আশাও রাখে না। তাই তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ এবং চরম হতাশা ও মনমরা
অবস্থায় সে অবাক বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত একথাটাও উপলব্ধি করতে হবে যে,
এখানে
অপরাধী বলতে কেবল দুনিয়ায় যারা হত্যা, চুরি,
ডাকাতি
ও এ ধরনের অন্যান্য অপরাধ করে তাদের কথা বলা হয়নি বরং এমন সব লোকের কথা এখানে বলা
হয়েছে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে,
তাঁর
রসূলদের শিক্ষা ও পথনির্দেশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে এবং আখেরাতে জবাবদিহি করার
কথা অস্বীকার করে অথবা সে ব্যাপারে নির্বিকার থেকে এবং দুনিয়ায় আল্লাহর পরিবর্তে
অন্যদের অথবা নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করতে থেকেছে। এ মূল ভ্রষ্টতার সাথে সাধারণ্যে অপরাধ বলা হয়ে
থাকে এমন কাজ তারা করলেও বা না করলেও কিছু আসে যায় না। এ ছাড়াও এমনসব লোকও এর অন্তরভুক্ত হয়ে থাকে
যারা আল্লাহকে মেনে নিয়ে তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনে আখেরাতকে স্বীকার করে নিয়ে
তাঁরপর আবার জেনে বুঝে নিজেদের রবের নাফরমানী করেছে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত
পর্যন্ত নিজেদের বিদ্রোহীনীতিতে অবিচল থেকেছে। এরা নিজেদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীতে
আখেরাতের জগতে হঠাৎ করে জেগে উঠবে এবং দেখবে,
সত্যিই
তো এখানে সেই পরবর্তী জীবন শুরু হয়ে গেছে,
যা
অস্বীকার করে অথবা যাকে উপেক্ষা করে তারা দুনিয়ার কাজ করতো। তখন তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদের
ওপর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যাবে يبلس المجرمون বাক্যংশে যার ছবি অংকন করা হয়েছে।
﴿وَلَمْ
يَكُن لَّهُم مِّن شُرَكَائِهِمْ شُفَعَاءُ وَكَانُوا بِشُرَكَائِهِمْ كَافِرِينَ﴾
১৩) তাদের বানানো শরীকদের মধ্য থেকে কেউ
তাদের সুপারিশ করবে না১৬ এবং তারা
নিজেদের শরীকদের অস্বীকার করবে।১৭
১৬. তিন ধরনের সত্তার ওপর শরীক শব্দটির প্রয়োগ হয়। এক, ফেরেশতা, নবী,
আউলিয়া,
শহীদ
ও পুণ্যবান লোক। মুশরিকরা বিভিন্ন যুগে
এদেরকে আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতাঁর অধিকারী গণ্য করে এদের সামনে বন্দেগী ও পূজার
যাবতীয় অনুষ্ঠান পালন করতো। কিয়ামতের দিন তারা পরিষ্কার বলে দেবে,
এসব
কিছু করেছো তোমরা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বরং আমাদের শিক্ষা ও পথনির্দেশের
সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করে। তাই তোমাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোমাদের শাফাআতের জন্য মহান
আল্লাহর দরবারে আমরা কিছূ আবেদন নিবেদন করবো,
এ
আশা আমাদের ব্যাপারে করো না। দুই, এমন সব জিনিস যেগুলোর চেতনা
নেই অথবা প্রাণ নেই।
যেমনঃ চাঁদ, সূর্য,
তারকা, গাছ, পাথর
ও পশু ইত্যাদি। মুশরিকরা তাদেরকে খোদায় পরিণত করে, এদের
পূজা-উপাসনা করে এবং এদের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করে।কিন্তু এই জড় ও নির্জীব জিনিসগুলো একথা জানতেই
পারে না যে, আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষ এসব নজরানা তাদের জন্য
উৎসর্গ করছে। একথা সুস্পষ্ট যে, এদের
মধ্যে একজনও তাদের সুপারিশের জন্য সামনে অগ্রসর হবে না। তিন,
এমন
সব বড় বড় অপরাধী যারা নিজেরাই চেষ্টা করে,
ধোঁকা
ও প্রতারণার পথ অবলম্বন করে, মিথ্যার জাল ছড়িয়ে দিয়ে অথবা
শক্তি প্রয়োগ করে দুনিয়ায় আল্লাহর বান্দাদের থেকে নিজেদের বন্দেগী ও পূজা আদায় করে
নিয়েছে। যেমন শয়তান, ভণ্ড
ও ধর্মীয় নেতা এবং জালেম ও স্বৈরাচারী শাসনকর্তা ইত্যাদি। এরা সবাই সেখানে বিপদের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িতে থাকবে। নিজেদের এ ভক্তবৃন্দের
সুপারিশের সামনে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা বরং তারা নিজেদের আমলনামার বোঝা হালকা
করার চেষ্টা করতে থাকবে।
হাশরের ময়দানে তারা একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকবে যে, এদের
অপরাধের জন্য এরা নিজেরাই দায়ী এবং এদের পথভ্রষ্টতাঁর জন্য আমাদের দুর্ভোগ পোহানো
উচিত নয়। এভাবে মুশরিকরা সেখানে কোন
দিক থেকে কোন প্রকার শাফাআত লাভ করতে সক্ষম হবে না।
১৭. অর্থাৎ সে সময় মুশরিকরা একথা স্বীকার করবে যে, তাদেরকে
আল্লাহর শরীক করে তারা ভুল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্য থেকে কারো আল্লাহর সার্বভৌম
কর্তৃত্বে কোন অংশ নেই, এ
সত্যটি তখন তাদের সামনে উন্মেচিত হয়ে যাবে। তাই দুনিয়ায় আজ তারা যে শিরকের ওপর টিকে থাকার জন্য চাপ
দিচ্ছে আখেরাতে তাকেই অস্বীকার করবে।
﴿وَيَوْمَ
تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَتَفَرَّقُونَ﴾
১৪) যেদিন সেই সময়টি সমাগত হবে সেদিন
(সমস্ত মানুষ) পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যাবে।১৮
১৮. অর্থাৎ দুনিয়ায় আজ জাতি, বংশ,
গোত্র, স্বদেশ, ভাষা, পরিবার
এবং অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট যতগুলো দলীয় বিভক্তি রয়েছে এসবই সেদিন
ভেঙ্গে পড়বে। নির্ভেজাল আকীদা-বিশ্বাস ও
নৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে নতুন করে এখন ভিন্নতর দল গঠিত হবে। একদিকে সমগ্র মানব জাতির
পূর্বের ও পরের সমগ্র প্রজন্মের মধ্য থেকে মুমিন ও সৎ লোকদেরকে ছেঁটে আলাদা করে
নেয়া হবে এবং তাদের সবাই হবে একটি দলভুক্ত। অন্যদিকে এক ধরনের ভ্রান্ত মতবাদ ও বিশ্বাস পোষণকারী এবং
এক এক ধরনের অপরাধজীবী মানুষদেরকে সেই বিশাল জনসমুদ্র থেকে ছাঁটাই বাছাই করে আলাদা
করে নেয়া হবে এবং তাদের পৃথক পৃথক দল সৃষ্টি হয়ে যাবে। অন্য কথায় এভাবে বলা যায়, ইসলাম
যেসব জিনিসকে এ দুনিয়ায় বিভেদ অথবা ঐক্যের ভিত্তি গণ্য করে এবং যেগুলোকে জাহেলিয়াত
পন্থীরা এখানে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে,
আখেরাতে
তাঁরই ভিত্তিতে বিভেদও হবে আবার ঐক্যও।
ইসলাম বলে, মানুষদেরকে
পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার এবং পরস্পরের সাথে জুড়ে দেবার আসল জিনিস হচ্ছে তাঁর
আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্র। যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর নির্দেশের ওপর তাদের জীবন
ব্যবস্থার ভিত গড়ে তোলে তারা সবাই একই দলভূক্ত। তাদের সম্পর্ক বিভিন্ন বংশ ও দেশের সাথেও হতে
পারে। অন্যদিকে কুফরী ও ফাসেকীর
পথ অবলম্বনকারীরা অন্য একটি দলভুক্ত। তাদের সম্পর্ক যে কোন বংশ ও দেশের সাথেও হতে পারে। এদের উভয়ের জাতীয়তা এক হতে
পারে না। এরা দুনিয়ায় সম্মিলিতভাবে
একক জীবনপথ নির্মাণ করে তাঁর ওপর একসাথে চলতে পারে না। ওদিকে আখেরাতেও তাদের পরিণাম একই রকম হতে পারে
না। দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত
তাদের পথ ও মনযিল পরস্পর থেকে আলাদা হয়। পক্ষান্তরে জাহেলিয়াতপন্থীরা প্রত্যেক যুগে এ ব্যাপারে জোর
দিতে থেকেছে এবং আজো তারা এ ব্যাপারে অবিচল যে,
বংশ, দেশ
ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষের দলবদ্ধ হওয়া উচিত। যাদের মধ্যে এ ভিত্তিগুলোর ব্যাপারে একাত্মতা রয়েছে তাদের
ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এক জাতিতে পরিণত হয়ে এমনি ধরনের
অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া উচিত এবং জাতীয়তাবাদের এমন একটি জীবন
ব্যবস্থা থাকা উচিত যেখানে তাওহীদ, শিরক ও নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসীরা সবাই একসাথে
চলতে পারে। এটিই ছিল আবু জেহেল, আবু
লাহাব ও কুরাইশ সরদারদের চিন্তাধারা। তারা বারবার মুহাম্মদ সা. এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছিল যে, এ
ব্যক্তি এসে আমাদের জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কুরআন মাজীদ এখানে সতর্ক বাণী
উচ্চারণ করছে যে, এ দুনিয়ার মিথ্যার ভি্ত্তিতে তোমরা এই যেসব দল
গঠন করেছো এগুলো সবই শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পড়বে। ইসলাম দুনিয়ার এ জীবনে যে বিশ্বাস জীবনাদর্শ ও
নৈতিক চরিত্রের ভিত্তিতে পার্থক্য সৃষ্টি করতে চায় মানব জাতির মধ্যে তারি ভিত্তিতে
স্থায়ী পার্থক্য গড়ে উঠবে। যাদের গন্তব্য এক নয় তাদের জীবনের পথই বা কেমন করে এক হতে
পারে।
﴿فَأَمَّا
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِي رَوْضَةٍ يُحْبَرُونَ﴾
১৫) যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা
একটি বাগানে১৯ আনন্দে
থাকবে।২০
১৯. 'একটি বাগান'
একথাটি
এখানে বাগানের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা
হয়েছে। আরবী ভাষার মতো আমাদের
ভাষায়ও একটি পরিচিত বর্ণনাভঙ্গী রয়েছে। কোন ব্যক্তি কাউকে কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে বলে এবং
এই সঙ্গে একথাও বলে, যদি তুমি একাজটি করে দাও তাহলে আমি তোমাকে একটি
জিনিস দেবো। এখানে একটি জিনিসের অর্থ এ
হয় না যে, সংখ্যার দিক দিয়ে তা একটিই হবে। বরং এর উদ্দেশ্য হয়, এর
পুরস্কারস্বরূপ তোমাকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস দেবো, যা
পেয়ে তুমি আনন্দে উৎফুল্ল হবে।
২০. এখানে يحبرون শব্দ
ব্যবহার করা হয়েছে। আনন্দ, স্বাদ, আড়ম্বর, জাঁকজমক
ও মর্যাদার ধারণা এর অর্থের অন্তরভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে অত্যন্ত মর্যাদা সহকারে রাখা
হবে, আনন্দে ও আরাম-আয়েশে থাকবে এবং সব রকম ভোগে পরিতৃপ্ত হবে।
﴿وَأَمَّا
الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآخِرَةِ فَأُولَٰئِكَ
فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ﴾
১৬) আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার
নিদর্শনাবলী ও পরলোকের সাক্ষাতকারকে মিথ্যা বলেছে২১ তাদেরকে
আযাবে হাজির রাখা হবে।
২১. একথাটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য যে, ঈমানের
সাথে সৎকাজের কথা বলা হয়েছে, যার ফলে মানুষ মহান মর্যাদা
সম্পন্ন পরিণামফল ভোগ করবে।কিন্তু কুফরীর অশুভ পরিণাম বর্ণনা প্রসঙ্গে অসৎকাজের কোন
বর্ণনা দেয়া হয়নি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে
প্রকাশিত হয় যে, মানুষের পরিণাম নষ্ট করার জন্য কুফরীই যথেষ্ঠ। অসৎকাজের সাথে তাঁর শামিল
হওয়ায় বা না হওয়ায় কিছু যায় আসে না।
﴿فَسُبْحَانَ
اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ﴾
১৭) কাজেই২২ আল্লাহর
মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো২৩ যখন
তোমাদের সন্ধ্যা হয় এবং যখন তোমাদের সকাল হয়।
২২. এখানে”কাজেই”শব্দটি এ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে, যখন
তোমরা জানতে পারলে ঈমান ও সৎকাজের এহেন পরিণাম হবে এবং কুফরী ও মিথ্যা আরোপের এহেন
পরিণাম হবে তখন তোমাদের এ ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। তাছাড়া”কাজেই”শব্দটির এ অর্থও হয় যে, মুশরিক
ও কাফেররা পরকালীন জীবনকে অসম্ভব গণ্য করে আল্লাহকে মূলত অক্ষম ও অপারগ ঘোষণা করছে। কাজেই এর মোকাবিলায় তুমি
আল্লাহর প্রশংসা করো, তাঁর মহিমা প্রচার করো এবং এ দুর্বলতা থেকে
তিনি মুক্ত একথা ঘোষণা করে দাও। এখানে নবী সা. কে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাঁর মাধ্যমে
সম্বোধন করা হয়েছে সমগ্র মুমিন সমাজকে।
২৩. আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে এই যে, মুশরিকরা
নিজেদের শিরক ও আখেরাত অস্বীকারের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি যেসব দোষ-ত্রুটি ও
দুর্বলতা আরোপ করে থাকে সেই অনন্য মহামহিম সত্ত্বাকে তা থেকে পাক-পবিত্র ঘোষণা করা
এবং একথা প্রকাশ করা। এ
ঘোষণা ও প্রকাশের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে নামায। এরি ভিত্তিতে ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদাহ, ইবনে
যায়েদ ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন,
এখানে”তাসবীহ
পাঠ”তথা মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করার অর্থ নামায পড়া। এ তাফসীরের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ কুরআনের
এ আয়াতের মধ্যেই রয়ে গেছে অর্থাৎ এখানে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য কয়েকটি
বিশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। একথা সুস্পষ্ট,
আল্লাহ
সমস্ত দোষ-ত্রুটিমুক্ত -এ আকীদা পোষণ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে
এ জন্য আবার সকাল-সাঁঝে এবং দুপুরে(জোহর) ও রাতের (ঈশা) নামাযের সময় নির্ধারণের
প্রশ্নই উঠতো না। কারণ এ আকীদা তো মুসলমানদের
সবসময়ই পোষণ করতে হবে।
এভাবে যদি শুধুমাত্র মুখেই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলেও
এ সময়গুলো নির্ধারণ করার কোন অর্থ হয় না। কারণ মুসলমানকে তো সবসময় এ আকীদা প্রকাশ করতে হবে। এভাবে যদি নিছক কণ্ঠের
মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্রতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলেও এসময়গুলো নির্ধারণ
করা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
কারণ মুসলমানকে তো সর্বক্ষণ একথা প্রকাশ করতে হবে। তাই সময় নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে আল্লাহর গুণ ও
মহিমা প্রচার করার হুকুম নিসন্দেহে তাঁর একটি বিশেষ কার্যকর কাঠামোর প্রতিই ইঙ্গিত
করে। আর এ কার্যকর কাঠামোটি
নামায ছাড়া আর কিছুই নয়।
﴿وَلَهُ
الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ﴾
১৮) আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই
প্রশংসা এবং (তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমাদের কাছে
এসে যায় যোহরের সময়।২৪
২৪. এ আয়াতে চারটি সময়ের প্রতি ইশারা করা হয়েছেঃ ফজর,
মাগরিব, আসর
ও যোহর। এ ছাড়াও নামাযের ওয়াক্ত
সম্পর্কে কুরআন মজিদে আরো যেসব ইশারা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ
﴿أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ
إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ
قُرْآنَ الْفَجْرِ﴾
''নাম কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের
অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরের সময় কুরআন পাঠ করো।” (বনী ইসরাঈল ৭৮)
﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ
وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ﴾
"আর নামায কায়েম করো দিনের
দুই মাথায় এবং রাতের কিছু অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর।” (হুদ,
১১৪
আয়াত)
﴿وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ
الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ۖ وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ
فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ﴾
"আর তোমার রবের প্রশংসা
সহকারে তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো সূর্য উদিত হবার আগে এবং তাঁর অস্ত যাবার
আগে। আর রাতের কিছু সময়ও আল্লাহর
মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তভাগেও।” (ত্বাহা,
১৩০
আয়াত)
এর মধ্যে থেকে প্রথম আয়াতটি বলছেঃ নামাযের সময়সীমা হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়ার পর
থেকে ঈশা পর্যন্ত এবং এরপর হচ্ছে ফজরের সময়। দ্বিতীয় আয়াতে দিনের দুই প্রান্ত অর্থ ফজর ও মাগরিবের সময়
এবং কিছু রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পরের সময়টি হচ্ছে ঈশার ওয়াক্ত। তৃতীয় আয়াতে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে অর্থ
ফজরের সময় এবং অস্তমিত হওয়ার পূর্বে অর্থ আসরের সময়। রাতের সময়ের মধ্যে মাগরিব ও ঈশা উভয়ই
অন্তরভুক্ত। আর দিনের প্রান্ত হচ্ছে
তিনটিঃ এক, সকাল। দুই, সূর্য ঢলে পড়া এবং তিন, মাগরিব। এভাবে সারা দুনিয়ার
মুসলমানরা আজ যে পাঁচটি সময়ে নামায পড়ে থাকে কুরআন মাজীদ বিভিন্ন স্থানে সে
সময়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছে।কিন্তু একথা স্পষ্ট শুধুমাত্র এ আয়াতগুলো পাঠ করে কোন
ব্যক্তিও নামাযের সময় নির্ধারণ করতে পারতো না। মহান আল্লাহর নিযুক্ত কুরআনের শিক্ষক
মুহাম্মাদ সা. নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে এ ব্যাপারে তাদেরকে পথনির্দেশনা না দিলে
তাদের পক্ষে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া সম্ভবপর ছিল না।
এখানে একটু থেমে হাদীস অস্বীকারকারীদের ধৃষ্ঠতাঁর কথা ভাবুন। তারা”নামায পড়া”কে বিদ্রুপ
করে এবং বলে, মুসলমানরা বর্তমানে যে নামায পড়ছে এটা আদতে সে
জিনিসই নয় কুরআনে যার হুকুম দেয়া হয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে,
কুরআন
তো নামায কায়েম করার হুকুম দেয় এবং তাঁর অর্থ নামায পড়া নয় বরং”রবুবিয়াতের
ব্যবস্থা”কায়েম করা।
এখন তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করুন, রবুবিয়াতের এ অভিনব
ব্যবস্থাটি কোন ধরনের যাকে সূর্য উদিত হবার পূর্বেই কায়েম করা যেতে পারে অথবা আবার
সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে কিছু রাত অতিবাহিত হওয়া পর্যন্তও কায়েম করা যায়?
আর
কোন ধরনের রবুবিয়াত ব্যবস্থা বিশেষ করে জুমার দিন কায়েম করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে?
﴿إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ
الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ﴾
আর বিশেষ ধরনের এমন কি রবুবিয়াত ব্যবস্থা আছে যা কায়েম করার জন্য মানুষ যখন
অগ্রসর হয় তখন প্রথমে মুখমণ্ডল ও কনুই পর্যন্ত হাত ধুয়ে ফেলে গাঁট পর্যন্ত আর এই
সাথে মাথাও মসেহ করে নেয়, অন্যথায় তাকে কায়েম করা যেতে পারে না?
﴿إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ
فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ﴾
আর রবুবিয়াত ব্যবস্থার মধ্যে এমন কি বিশেষত্ব আছে, যার
ফলে যদি মানুষ নাপাকির অবস্থায় থাকে,
তাহলে
যতক্ষণ গোসল না করে নেয় ততক্ষণ তাকে কায়েম করতে পারে না?
﴿لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنتُمْ
سُكَارَىٰ حَتَّىٰ تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي
سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغْتَسِلُوا﴾
আর এটাই বা কেমন ব্যাপার, যদি কোন পুরুষ কোন নারীর
সাথে মিলন করে এবং সেখানে পানি না পাওয়া যায় তাহলে এ অদ্ভুত রবুবিয়াত ব্যবস্থাকে
কায়েম করার জন্য পাক-পবিত্র মাটিতে হাত ঘসে নিয়ে সেই হাত মুখমণ্ডলের ওপর ঘসতে হবে?
﴿أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ
تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ﴾
আর এ কেমন ধরনের অদ্ভুত রবুবিয়াত ব্যবস্থা যে, যদি
কখনো সফর করতে হয় তাহলে মানুষ তাকে পুরোপুরি কায়েম করার পরিবর্তে অর্ধেকটাই কায়েম
করে?
﴿وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ
عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ﴾
আর এটা কোন ধরনের কৌতুকপ্রদ ব্যাপার যে,
যদি
মুসলিম সেনাদল শত্রুর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলে
সেনাদলের অর্ধেক সিপাহী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে”রবুবিয়াত ব্যবস্থা”কায়েম
করতে থাকবে এবং বাকি অর্ধেক ময়দানে শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকবে?
তাঁরপর
যখন প্রথম দলটি ইমামের পেছনে রবুবিয়াত ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে একটি সিজদা করে
নেবে তখন উঠে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য চলে যাবে এবং দ্বিতীয় দলটি তাদের
জায়গায় এসে ইমামের পেছনে”রবুবিয়াত ব্যবস্থা”কায়েম করতে থাকবে?
﴿وَإِذَا كُنتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ
الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِّنْهُم مَّعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ
فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِن وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَىٰ
لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ﴾
কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো একথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছে যে নামায কায়েম করার
অর্থ হচ্ছে এমন ধরনের নামায কায়েম করা যা সারা দুনিয়ার মুসলমানরা পড়ে থাকে।কিন্তু হাদীস
অস্বীকারকারীদের অবস্থা হচ্ছে এই যে,
তারা
নিজেরা পরিবর্তিত না হয়ে ইসলামকে পরিবর্তিত করার জন্য চাপ দিয়ে চলছে। আসলে যতক্ষণ কোন ব্যক্তি
মহান আল্লাহর মোকাবিলায় একেবারেই শংকাহীন ও নির্লজ্জ না হয়ে যায় ততক্ষণ সে তাঁর
বাণীর সাথে এ বিদ্রুপাত্মক আচরণ করতে পারে না,
যা
এরা করছে। অথবা এমন এক ব্যক্তি
কুরআনের সাথে এ তামাশা করতে পারে যে নিজের মনে কুরআনকে আল্লাহর কালাম বলে স্বীকৃতি
দেয় না এবং নিছক ধোঁকা দেবার জন্য কুরআন কুরআন বলে চিৎকার করে মুসলমানদেরকে গোমরাহ
করতে চায়। (এ প্রসঙ্গে সামনের দিকে ৫০
টীকাও দেখে নিন।)
﴿يُخْرِجُ
الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَيُحْيِي
الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ وَكَذَٰلِكَ تُخْرَجُونَ﴾
১৯) তিনি জীবিত থেকে মৃত্যুকে বের করেন
এবং মৃত থেকে জীবিত কে বের করে আনেন এবং ভূমিকে তাঁর মৃত্যুর পর জীবন দান করেন।২৫ অনুরূপভাবে
তোমাদেরও (মৃত অবস্থা থেকে) বের করে নিয়ে যাওয়া হবে।
২৫. অর্থাৎ যে আল্লাহ প্রতিমূহুর্তে তোমাদের সামনে একাজ করছেন
তিনি মানুষের মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে অক্ষম হতে পারেন কেমন করে?
তিনি
সবসময় জীবিত মানুষ ও জন্ম-জানোয়ারদের মধ্য থেকে বর্জ্য পদার্থ (waste Matter) বের
করছেন যেগুলোর মধ্যে জীবনের সামান্যতম গন্ধ নেই। তিনি প্রতি মুহূর্তে নিষ্প্রাণ বস্তুর (Dead Matter) মধ্যে
জীবন সঞ্চার করে অসংখ্য পশু, উদ্ভিদ ও মানুষ সৃষ্টি করে
চলছেন। অথচ যেসব উপাদান থেকে এ
জীবন্ত সত্তাগুলোর শরীর গঠিত হচ্ছে তাদের মধ্যে সামান্যতমও জীবনের চিহ্ন নেই। তিনি প্রতি মুহূর্তে
তোমাদের এ দৃশ্য দেখিয়ে চলছেন যে, অনুর্বর,অনুন্নত, অনাবাদি
পতিত জমিতে বৃষ্টির পানি পড়ার সাথে সাথেই সহসা সেখানে প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনের
বিপুল সমারোহ দেখা যায়। এ
সবকিছু দেখার পরও যদি কোন ব্যক্তি মনে করে সৃষ্টির এ কারখানা পরিচালনাকারী আল্লাহ
মানুষের মৃত্যুর পর তাকে পুনরায় জীবিত করতে অক্ষম, তাহলে
আসলে তাঁর বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর বাইরের চোখ দুটি যে বাহ্যিক দৃশ্যাবলী দেখে থাকে, তাঁর
বুদ্ধির চোখ তাঁর মধ্যে দৃশ্যমান উজ্জ্বল সত্য দেখতে পায় না।
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ إِذَا أَنتُم بَشَرٌ تَنتَشِرُونَ﴾
২০) তাঁর২৬ নিদর্শনাবলীর
মধ্যে রয়েছে, তিনি
তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তাঁরপর সহসা তোমরা হলে মানুষ, (পৃথিবীর বুকে) ছড়িয়ে পড়ছো।২৭
২৬. মনে রাখতে হবে এখান থেকে রুকুর শেষ অবধি মহান আল্লাহর যেসব
নিদর্শন বর্ণনা করা হচ্ছে, সেগুলো তো একদিকে বক্তব্য পরম্পরার সাথে
সম্পর্ক রেখে পরকালীন জীবনের সম্ভাবনা ও অস্তিত্বশীলতাঁর কথা প্রমাণ করে এবং
অন্যদিকে এ নিদর্শনগুলোই প্রমাণ করে যে,
এ
বিশ্ব-জাহান ইলাহ বিহীন নয় বরং এর ইলাহও বহু নয় বরং এক ও একক ইলাহই এর স্রষ্টা, পরিচালক, মালিক
ও শাসক। তিনি ছাড়া মানুষের আর কোন
মাবুদ হওয়া উচিত নয়।
অনুরূপভাবে এ রুকুটি বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্বের ও পরের উভয় ভাষণের সাথে সম্পৃক্ত।
২৭. অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি রহস্য এ ছাড়া আর কি যে, কয়েকটি
নিষ্প্রাণ উপাদানের সমাহার, যেগুলো এ পৃথিবীর বুকে পাওয়া যায়। যেমন কিছু কার্বন, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম
এবং এ ধরনের আরো কিছু উপাদান। এগুলোর রাসায়নিক সংযোগের মাধ্যমে মানুষ নামক একটি বিস্ময়কর
সত্ত্বা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে আবেগ, অনুভূতি, চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি
ও চিন্তা-কল্পনার এমন সব অদ্ভূত শক্তি যাদের কোন একটির উৎসও তাঁর মৌলিক
উপাদানগুলোর মধ্যে খূঁজে পাওয়া যেতে পারে না। তাঁরপর শুধু এতটুকুই নয় যে, হঠাৎ
একজন মানুষ এমনি ধরনের এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে বরং তাঁর মধ্যে এমন
সব অদ্ভুত প্রজনন শক্তিও সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে যার বদৌলতে কোটি কোটি মানুষ সে একই
কাঠামো এবং যোগ্যতাঁর অধিকারী হয়ে অসংখ্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং
সীমাসংখ্যাহীন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ধারক হিসেবে বের হয়ে আসছে। তোমার বুদ্ধি কি এ সাক্ষ্য
দেয়, এ চূড়ান্ত জ্ঞানময় সৃষ্টি কোন জ্ঞানী স্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম
ছাড়াই আপনা আপনিই অস্তিত্বশীল হয়েছে? তুমি কি সজ্ঞানে ও সচেতন অবস্থায় একথা বলতে
পারো, মানুষ সৃষ্টির মতো মহত্তম পরিকল্পনা,তাকে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে
প্রয়োগ করা এবং পৃথিবী ও আকাশের সংখ্যাব্যতীত শক্তিকে মানব জীবন গঠনের উপযোগী করে
দেয়া, এগুলো কি বহু ইলাহর চিন্তা ও ব্যবস্থাপনার ফল
হতে পারে? আর
তোমরা যখন মনে করতে থাকো, যে আল্লাহ মানুষকে নিরেট অনস্তিত্ব থেকে
অস্তিত্ব দান করেছেন তিনি সেই মানুষকে মৃত্যু দান করার পর পুনরায় জীবিত করতে
পারবেন না, তখন তোমাদের মস্তিষ্ক কি সঠিক অবস্থায় থাকে?
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا
وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ
يَتَفَكَّرُونَ﴾
২১) আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই
জাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রীগণকে,২৮ যাতে তোমরা
তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো২৯ এবং
তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।৩০ অবশ্যই এর
মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে।
২৮. অর্থাৎ স্রষ্টার প্রজ্ঞার পূর্ণতা হচ্ছে এই যে, তিনি
মানুষকে শুধুমাত্র একটি জাতি (sexes) সৃষ্টি করেননি বরং তাকে দুটি জাতির আকারে
সৃষ্টি করেছেন। মানবিকতাঁর দিক দিয়ে তারা
একই পর্যায়ভুক্ত। তাদের সৃষ্টির মূল ফরমুলাও
এক।কিন্তু তারা উভয়ই পরস্পর
থেকে ভিন্ন শারীরিক আকৃতি, মানসিক ও আত্মিক গুণাবলী এবং আবেগ-অনুভূতি ও
উদ্যোগ নিয়ে জন্মলাভ করে।
আবার তাদের মধ্যে এমন বিস্ময়কর সম্বন্ধ ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে যার ফলে
তারা প্রত্যেকে পুরোপুরি অন্যের জোড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকের শরীর এবং প্রবৃত্তি ও উদ্যোগসমূহ
অন্যের শারীরিক ও প্রবৃত্তির দাবীসমূহের পরিপূর্ণ জবাব। এ ছাড়াও সেই প্রাজ্ঞ স্রষ্টা ও উভয় জাতির
লোকদেরকে সৃষ্টির সূচনা থেকেই বরাবর ও আনুপাতিক হারে সৃষ্টি করে চলবেন। আজ পর্যন্ত কখনো দুনিয়ার
কোন জাতির মধ্যে বা কোন এলাকায় কেবলমাত্র পুত্র সন্তানই জন্মলাভ করে চলছে এমন কথাও
শোনা যায় নি। এটা এমন একটা জিনিস যার
মধ্যে কোন মানুষের হস্তক্ষেপ বা বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগের সামান্যতম অবকাশই নেই। মানুষ এ ব্যাপারে
সামান্যতমও প্রভাব বিস্তার করতে পারে না যে,
মেয়েরা
অনবরত এমনি মেয়েলী বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মলাভ করতে থাকবে এবং ছেলেরা অনবরত এমন
পুরুষালী বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মলাভ করতে থাকবে যা তাদের পরস্পরকে যথার্থ জোড়ায় পরিণত
করবে। আর নারী ও পুরুষের জন্ম
এমনি ধারাবাহিকভাবে একটি আনুপাতিক হারে হয়ে যেতে থাকবে,
এ
ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করার কোন মাধ্যম তাঁর নেই। হাজার হাজার বছর থেকে কোটি কোটি মানুষের
জন্মলাভ এ কৌশল ও ব্যবস্থার এমনই সুসামঞ্জস্য পদ্ধতিতে কার্যকর থাকা কখনো নিছক
আকস্মিক ঘটনা হতে পারে না আবার বহু ইলাহর সম্মিলিত ব্যবস্থাপনার ফলও এটা নয়। এ জিনিসটি সুস্পষ্টভাবে
একথা প্রমাণ করে যে, একজন বিজ্ঞানী আর শুধুমাত্র একজন মহা বিজ্ঞানী
স্রষ্টাই তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান ও শক্তির মাধ্যমে শুরুতে পুরুষ ও নারীর একটি
সর্বাধিক উপযোগী ডিজাইন তৈরি করেন। তাঁরপর তিনি এ ডিজাইন অনুযায়ী অসংখ্য পুরুষ ও অসংখ্য নারীর
তাদের পৃথক ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য সহকারে সারা দুনিয়ায় একটি আনুপাতিক হারে জন্মলাভ
করার ব্যবস্থা করেন।
২৯. অর্থাৎ এটা কোন অপরিকল্পিত ব্যবস্থা নয়। বরং স্রষ্টা নিজেই
পরিকল্পিতভাবে এ ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে পুরুষ তাঁর প্রাকৃতিক দাবী নারীর কাছে
এবং নারী তাঁর প্রাকৃতিক চাহিদা পুরুষের কাছে লাভ করবে এবং তারা উভয়ে পরস্পরের
সাথে সম্পর্কিত থেকেই প্রশান্তি ও সুখ লাভ করবে। এ বিজ্ঞানময় ব্যবস্থাপনাকে স্রষ্টা একদিকে
মানব বংশধারা অব্যাহত থাকার এবং অন্যদিকে মানবিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অস্তিত্ব দান
করার মাধ্যমে পরিণত করেছেন। যদি এ দুটি জাতিকে নিছক দুটি পৃথক ডিজাইনে তৈরি করা হতো
এবং তাদের মধ্যে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি না করা হতো,
যা
তাদের পারস্পরিক সংযোগ ও সম্পর্ক ছাড়া প্রশান্তিতে পরিণত হতে পারতো না, তাহলে
সম্ভবত ছাগল ভেড়ার মতো মানুষের বংশধারাও এগিয়ে যেতো কিন্তু তাদের সাহায্যে কোন
সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব লাভ করার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না। স্রষ্টা নিজের জ্ঞান ও
প্রজ্ঞার সাহায্যে পুরুষ ও নারীর জন্য এমন পরস্পরের চাহিদা, তৃষ্ণা
ও অস্থিরতাঁর অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছেন যার ফলে তারা উভয়ে মিলে একসাথে না থাকলে
শান্তি ও সুখ লাভ করতে পারে না। সমগ্র প্রাণীজগতের বিপরীতে মানব জাতির মধ্যে এটিই হচ্ছে
সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ। এ শান্তির অন্বেষায় তাদেরকে একত্রে ঘর বাঁধতে
বাধ্য করে। এরি বদৌলতে পরিবার ও গোত্র
অস্তিত্ব লাভ করে। এর ফলে মানুষের জীবনে
সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে। এ
বিকাশে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা অবশ্যই সহায়ক হয়েছে।কিন্তু তা তাঁর আসল উদ্যোক্তা নয়। আসল উদ্যোক্তা হচ্ছে এ
অস্থিরতা, যাকে পুরুষ ও নারীর অস্তিত্বের মধ্যে সংস্থাপিত
করে তাদেরকে 'ঘর'
বাঁধতে
বাধ্য করা হয়েছে। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ
কথা ভাবতে পারেন যে, এ
বিপুল প্রজ্ঞা প্রকৃতির অন্ধ শক্তিসমূহ থেকে হঠাৎ এমনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে?
অথবা
বহু সংখ্যক ইলাহ কি এমনি ধরনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারতো, যার
ফলে তারা এ গভীর জ্ঞানময় উদ্দেশ্য সামনে রেখে হাজার হাজার বছর থেকে অনবরত অসংখ্য
পুরুষ ও নারীকে এ বিশেষ অস্থিরতা সহকারে সৃষ্টি করে যেতে থাকতো?
এ
তো একজন জ্ঞানীর এবং মাত্র একজন জ্ঞানীরই প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট নিদর্শন। কেবলমাত্র বুদ্ধিভ্রষ্ট
ব্যক্তিই এটি দেখতে অস্বীকার করতে পারে।
৩০. ভালোবাসা বলতে এখানে কামশক্তি ভালোবাসার (sexual love) কথা
বলা হয়েছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে এটি
আকর্ষণের প্রাথমিক উদ্যোক্তায় পরিণত হয়। তাঁরপর তাদেরকে পরস্পরের সাথে সংলগ্ন করে রাখে। আর 'রহমত' তথা
দয়া মানে হচ্ছে এমন একটি আত্মিক সম্পর্ক, যা স্বামী-স্ত্রীর জীবনে পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ
করে। এর বদৌলতে তারা দু'জনে
দু'জনার কল্যাণকাংখী, দু'জনের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং
উভয়ের সুখে দুঃখে শরীক হয়ে যায়। এমনকি এমন এক সময় আসে যখন কামসিক্ত ভালোবাসা পিছনে পড়ে
থাকে এবং বার্ধক্যে এ জীবনসাথী যৌবনকালের চাইতে অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে পরস্পরের
জন্য দয়া, স্নেহ ও মমতাঁর পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকে। মানুষের মধ্যে শুরুতেই যে
অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তাকে সাহায্য করার জন্য স্রষ্টা মানুষের মধ্যে এ দুটি
ইতিবাচক শক্তি সৃষ্টি করে দেন। এ অস্থিরতা তো শুধুমাত্র শান্তির প্রত্যাশী এবং এর সন্ধানে
সে নারী ও পুরুষকে পরস্পরের দিকে নিয়ে যায়। এরপর এ দুটি শক্তি অগ্রসর হয়ে তাদের মধ্যে স্থায়ী
বন্ধুত্বের এমন একটি সম্পর্ক জুড়ে দেয় যা দুটি পৃথক পরিবেশে লালিত আগন্তুকদেরকে
একসাথে মিলিয়ে গভীরভাবে সংযুক্ত করে দেয়।এ সংযোগের ফলে সারা জীবনে তারা মাঝ দরিয়ায় নিজেদের নৌকা
একসাথে চালাতে থাকে।
একথা সুস্পষ্ট, কোটি
কোটি মানুষ তাদের জীবনে এই যে ভালোবাসা ও দয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করছে এগুলো কোন নিরেট
বস্তুনয়। এগুলোকে ওজন ও পরিমাপ করা
যেতে পারে না। মানুষের শারীরিক গঠনে যেসব
উপাদানের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে তাদের মধ্যে কোথাও এদের উৎস চিহ্নিত করা যেতে পারে না। কোন ল্যাবরেটরীতেও এদের
জন্ম ও বিকাশ সাধনের কারণসমূহ অনুসন্ধান করা যেতে পারে না। এ ছাড়া এর আর কোন ব্যাখ্যাই করা যেতে পারে না
যে, একজন প্রাজ্ঞ স্রষ্টা স্বেচ্ছাকৃতভাবে একটি উদ্দেশ্য সামনে
রেখে পূর্ণ সামঞ্জস্য সহকারে মানুষের মধ্যে তা সংস্থাপন করে দিয়েছেন।
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ
وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ﴾
২২) আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে
আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি৩১ এবং
তোমাদের ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য।৩২ অবশ্যই
তাঁর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য।
৩১. অর্থাৎ তাদের অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করা, একটি
অপরিবর্তনীয় নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং অসংখ্য শক্তির পরম সামঞ্জস্য ও
ভারসাম্য সহকারে কাজ করা -এগুলো নিজের অভ্যন্তরে এ বিষয়ের এমন বহু নিদর্শন রাখে যা
থেকে জানা যায় যে, এ সমগ্র বিশ্ব-জাহানকে মাত্র একজন স্রষ্টাই
অস্তিত্ব দান করেছেন এবং তিনিই এ বিশাল ব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। একদিকে যদি একথা চিন্তা করা
যায় যে, এ প্রাথমিক শক্তি (Energy) কোথা
থেকে এসে বস্তুর আকার ধারণ করেছে? বস্তুর এ বিভিন্ন উপাদান কেমন করে গঠিত হয়েছে এ
উপাদানগুলোকে এহেন বৈজ্ঞানিক কৌশলে সংমিশ্রিত করে বিস্ময়কর সামঞ্জস্য সহকারে এ
অত্যদ্ভূত বিশ্বব্যবস্থা গঠিত হয়েছে কেমন করে? এখন কোটি কোটি বছর ধরে একটি মহাপরাক্রমশালী
প্রাকৃতিক আইনের আওতাধীনে এ ব্যবস্থাটি কিভাবে চলছে?
এ
অবস্থায় প্রত্যেক নিরপেক্ষ বুদ্ধিবৃত্তি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছবে যে, এসব
কিছু একজন সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানীর প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছাড়া নিছক ঘটনাক্রমে বা অকস্মাৎ
ঘটতে পারে না। আবার অন্যদিকে যদি দেখা যায়
যে, পৃথিবী থেকে নিয়ে বিশ্ব-জাহানের দূরবর্তী নক্ষত্রগুলো
পর্যন্ত সবাই একই ধরনের উপাদানে গঠিত এবং একই প্রাকৃতিক আইনের নিয়ন্ত্রণে তারা
চলছে, তাহলে হঠকারিতামুক্ত প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিই নিসন্দেহে একথা
স্বীকার করবে যে, এ সবকিছু বহু ইলাহর কর্মকুশলতা নয় বরং একজন
ইলাহ এ সমগ্র বিশ্ব-জাহানে স্রষ্টা ও প্রতিপালক।
৩২. অর্থাৎ যদিও তোমাদের বাকশক্তি সমান নয়, মুখ
ও জিহ্বার গঠনেও কোন ফারাক নেই এবং মস্তিষ্কের গঠনাকৃতিও একই রূপ তবুও পৃথিবীর
বিভিন্ন অংশে তোমাদের ভাষা বিভিন্ন হয়ে গেছে। তাঁরপর একই ভাষায় যারা কথা বলে তাদের বিভিন্ন
শহর ও জনপদের ভাষাও আলাদা। আবার আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেক
ব্যক্তির বলার রীতি, শব্দের উচ্চারণ এবং আলাপ-আলোচনার পদ্ধতি আলাদা। অনুরূপভাবে তোমাদের সৃষ্টি
উপাদান এবং তোমাদের গঠন প্রক্রিয়া একই।কিন্তু তোমাদের বর্ণ এত বেশি বিভিন্ন যে, একেক
জাতির কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু একই বাপ-মায়ের দুটি সন্তানের বর্ণও একই হয় না। এখানে নমুনা হিসেবে
কেবলমাত্র দুটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।কিন্তু এ দিক থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে দেখুন,
দুনিয়ায়
সকল দিকেই আপনি এত বেশি বৈচিত্র্য (varaity)দেখতে
পাবেন যে, তাদের সবগুলোকে একত্র করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ, পশু, উদ্ভিদ
এবং অন্যান্য সমস্ত জিনিসের যে কোন একটি শ্রেণীকে নেয়া হোক,
দেখা
যাবে তাদের প্রতিটি এককের মধ্যে মৌলিক একাত্মতা সত্ত্বেও অসংখ্য বিভিন্নতা বিরাজ
করছে। এমন কি কোন এক শ্রেণীর একটি
এককও অন্য একটি এককের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল নয়। এমন কি একটি গাছের দুটি পাতাঁর মধ্যেও পূর্ণ
সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। এ
জিনিসটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে,
এ
দুনিয়ায় এমন কোন কারখানা নেই যেখানে স্বয়ংক্রিয় মেশিনপত্র চলছে এবং বিপুল উৎপাদনের
(Massproduction) পদ্ধতিতে
সব রকমের জিনিসের এক একটি ছাঁচ থেকে ঢালাই হয়ে একই ধরনের জিনিস বের হয়ে আসছে। বরং এখানে একজন জবরদস্ত
কারিগর কাজ করছেন যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে পূর্ণ ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগ সহকারে
একটি নতুন ডিজাইনে, নতুন নকশায় ও কারুকাজে, নতুন
সৌষ্ঠবে এবং নতুন গুণাবলী সহকারে তৈরি করেন। তাঁর তৈরি করা প্রত্যেকটি জিনিস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের
অধিকারী। তাঁর উদ্ভাবন ক্ষমতা সবসময়
সব জিনিসের একটি নতুন মডেল বের করে চলেছে। তাঁর শিল্পকারিতা একটি ডিজাইনকে দ্বিতীয়বার সামনে নিয়ে
আসাকে নিজের পূর্ণতাঁর জন্য অবমাননাকর মনে করে। যে ব্যক্তিই যে বিস্ময়কর দৃশ্য চোখ মেলে দেখবে
সে কখনো এ ধরনের মূর্খতা সুলভ ধারণা পোষণ করতে পারে না যে, এ
বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা একবার এ কারখানাটি চালিয়ে দিয়ে তাঁরপর নিজে কোথাও গিয়ে
ঘুমাচ্ছেন, তিনি যে প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন এবং
নিজের সৃষ্ট প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর ব্যক্তিগত দৃষ্টি দিচ্ছেন, এতো
একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ مَنَامُكُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُم مِّن فَضْلِهِ ۚ
إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَسْمَعُونَ﴾
২৩) আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে
তোমাদের রাতে ও দিনে ঘুমানো এবং তোমাদের তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করা।৩৩ অবশ্যই এর
মধ্যে রয়েছে বহু নিদর্শন এমনসব লোকদের জন্য যারা (গভীর মনোযোগ সহকারে) শোনে।
৩৩. অনুগ্রহ সন্ধান করা অর্থ জীবিকার জন্য সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা
চালানো। মানুষ যদিও সাধারণত রাতের
বেলা ঘুমায় এবং দিনের বেলায় জীবিকার জন্য চেষ্টা-মেহনত করে তবুও শতকরা একশো ভাগ লোক
এমনটি করে না। বরং বহুলোক দিনের বেলায়
ঘুমায় এবং রাতে জীবিকা উপার্জনের জন্য মেহনত করে। তাই রাত দিনকে একসাথে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ
দুটি সময়ে তোমরা ঘুমাও এবং নিজেদের জীবিকা উপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকো।
এটিও এমন ধরনের নিদর্শনাবলীর অন্যতম যেগুলো থেকে একজন মহাজ্ঞানী স্রষ্টার
ব্যবস্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়। বরং এ ছাড়াও এ জিনিসটি এও চিহ্নিত করে যে, তিনি
নিছক স্রষ্টা নন বরং নিজের সৃষ্টির প্রতি তিনি বড়ই করুণাশীল ও স্নেহময় এবং তাঁর
প্রয়োজন ও কল্যাণের জন্য তাঁর চেয়ে বেশি তিনি চিন্তা করেন। মানুষ দুনিয়ায় অনবরত পরিশ্রম করতে পারে না। বরং প্রত্যেকবার কয়েক ঘন্টা
মেহনত করার শক্তি পাবে। এ
উদ্দেশ্যে মহাজ্ঞানী ও করুণাময় ও স্রষ্টা মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র ক্লান্তির
অনুভূতি এবং কেবলমাত্র বিশ্রামের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি বরং ' নিদ্রার
এমন একটি জবরদস্ত চাহিদা তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে রেখে দিয়েছেন যার ফলে তাঁর ইচ্ছা
ছাড়াই এমন কি তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও আপনা আপনিই কয়েক ঘন্টার জাগরণ ও মেহনতের পর
তা তাকে পাকড়াও করে, কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিতে তাকে বাধ্য করে এবং
প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে আপনা আপনিই তাকে ত্যাগ করে। এ নিদ্রার স্বরূপ ও অবস্থা এবং এর মৌল
কারণগুলো আজো মানুষ অনুধাবন করতে পারেনি। এটি অবশ্যই জন্মগতভাবে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী
হয়ে থাকে, এটা একথার সাক্ষ পেশ করার জন্য যথেষ্ট যে, এটি
কোন আকষ্মিক ঘটনা নয় বরং কোন মহাজ্ঞানী সত্তা একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুসারে এ
ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এর
মধ্যে একটি বিরাট জ্ঞান, কল্যাণ ও উদ্দেশ্যমুখীতা পরিষ্কার সক্রিয় দেখা
যায়। এ ছাড়াও এ নিদ্রা একথারও
সাক্ষবহ যে, যিনি মানুষের মধ্যে এ বাধ্যতামূলক উদ্যোগ রেখে
দিয়েছেন তিনি নিজেই মানুষের জন্য তাঁর চেয়ে বেশি কল্যাণকামী। অন্যথায় মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে নিদ্রার বিরোধিতা
করে এবং জোরপূর্বক জেগে থেকে এবং অনবরত কাজ করে কেবল নিজের কর্মশক্তিই নয় জীবনী
শক্তিও ক্ষয় করে।
তাঁরপর জীবিকার অন্বেষণের জন্য”আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান”শব্দাবলীর ব্যবহার করার
মাধ্যমে নিদর্শনাবলীর অন্য একটি ধারাবাহিকতাঁর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যদি পৃথিবী ও আকাশের বিপুল
ও অগণিত শক্তি সম্ভারকে জীবিকার কার্যকারণ ও উপায় উপকরণ সৃষ্টি করার কাজে না
লাগিয়ে দেয়া হতো এবং পৃথিবীতে মানুষের জন্য জীবিকার অসংখ্য উপায়-উপকরণ সৃষ্টি না
করা হতো, তাহলে মানুষ এ জীবিকার সন্ধানইবা কোথায় করতে
পারতো। শুধুমাত্র এতটুকুই নয় বরং
জীবিকার এ অনুসন্ধান এবং তা উপার্জন এমন অবস্থায়ও সম্ভব হতো না যদি এ কাজের জন্য
মানুষকে সর্বাধিক উপযোগী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা না দান করা
হতো, কাজেই মানুষের মধ্যে জীবিকা অন্বেষণের যোগ্যতা এবং তাঁর
অস্তিত্বের বাইরে জীবিকার উপকরণাদি বিদ্যমান থাকা পরিষ্কারভাবে একজন দয়াশীল ও
মর্যাদাবান সত্তার অস্তিত্বের সন্ধান দেয়। বুদ্ধিবৃত্তি অসুস্থ না হলে কখনো কেউ এ ধারণা করতে পারতো
না যে, এ সবকিছু অকস্মাৎ হয়ে গেছে অথবা এসব বহু ইলাহর ইলাহিত্বের
ফল কিংবা কোন নির্দয় অন্ধশক্তি এ অনুগ্রহ ও দানের উৎস।
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ يُرِيكُمُ الْبَرْقَ خَوْفًا وَطَمَعًا وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ
مَاءً فَيُحْيِي بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ
لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴾
২৪) আর তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্তরভুক্ত
হচ্ছে, তিনি
তোমাদের দেখান বিদ্যুৎচমক ভীতি ও লোভ সহকারে।৩৪ আর আকাশে
থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তাঁরপর এর মাধ্যমে জমিকে তাঁর মৃত্যুর পর জীবন দান করেন।৩৫ অবশ্যই এর
মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন লোকদের জন্য যারা বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে।
৩৪. অর্থাৎ তাঁর মেঘ গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক থেকে তো একদিকে আশা
হয় বৃষ্টি হবে এবং মাঠ শস্যে ভরে যাবে।কিন্তু সাথে সাথে এ ভয়ও জাগে যে, কোথাও
বিজলী পড়ে বা অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে বানের তোড়ে সবকিছু ভাসিয়ে না নিয়ে যায়।
৩৫. এ জিনিসটি একদিকে মৃত্যু পরের জীবনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ
করে এবং অন্যদিকে এ জিনিসটিই একথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ
আছেন এবং এক আল্লাহই পৃথিবী ও আকাশের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। জমি থেকে যা উৎপন্ন হয় তাঁর ওপর নির্ভর করে
পৃথিবীর অসংখ্য সৃষ্টির খাদ্য। এ উৎপাদন নির্ভর করে জমির উর্বরতা ও শস্য উৎপাদন ক্ষমতাঁর
ওপর। আবার এ উৎপাদন ক্ষমতা
নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের ওপর। সরাসরি জমির ওপর এ বৃষ্টিপাত হতে পারে। অথবা পানির বিশাল ভাণ্ডার
জমির উপরিভাগে স্থান লাভ করতে পারে। কিংবা ভূগর্ভস্থ ঝরণা ও কূপের রূপলাভ করতে পারে। অথবা পাহাড়ের ওপর বরফের
আকারে জমাট বদ্ধ হয়ে নদ-নদীর সাহায্যে প্রবাহিত হতে পারে। তাঁরপর এ বৃষ্টিপাত আবার নির্ভর করে সূর্যের
উত্তাপ, মওসুম পরিবর্তন,
মহাশূন্যের
তাপমাত্রা ও শৈত্য, বাতাসের আবর্তন এবং এমন বিদ্যুতের ওপর যা
মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করে। এই সঙ্গে বৃষ্টির পানির
মধ্যে এক ধরনের প্রাকৃতিক লবণাক্ততাঁরও সৃষ্টি করে দেয়। পৃথিবী থেকে নিয়ে আকাশ পর্যন্ত এসব বিভিন্ন
জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া, তাঁরপর
এসবের অসংখ্য ও বিচিত্র ধরনের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনের জন্য সুস্পষ্টভাবে উপযোগী হওয়া
এবং হাজার হাজার লাখো লাখো বছর পর্যন্ত এদের পূর্ণ একাত্মতা সহকারে অনবরত
সহযোগিতাঁর ভূমিকা পালন করে যেতে থাকা,
এ
সবকিছু কি নিছক ঘটনাক্রমিক হতে পারে? এ সবকিছু কি একজন স্রষ্টার জ্ঞানবত্তা, তাঁর
সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াই হয়ে গেছে?
এ
সবকিছু কি একথার প্রমাণ নয় যে, পৃথিবী,
সূর্য,
বাতাস, পানি, উত্তাপ
ও শৈত্য এবং পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টির স্রষ্টা ও রব একজনই?
﴿وَمِنْ
آيَاتِهِ أَن تَقُومَ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِهِ ۚ ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ
دَعْوَةً مِّنَ الْأَرْضِ إِذَا أَنتُمْ تَخْرُجُونَ﴾
২৫) আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আকাশ ও পৃথিবী তাঁর হুকুমে
প্রতিষ্ঠিত আছে।৩৬ তাঁরপর
যখনই তিনি পৃথিবী থেকে তোমাদের আহ্বান জানিয়েছেন তখনই একটি মাত্র আহ্বানেই সহসা
তোমরা বের হয়ে আসবে।৩৭
৩৬. অর্থাৎ তাঁর হুকুমে একবার অস্তিত্ব লাভ করেছে শুধু এতটুকু
নয় বরং তাদের সবসময় প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং তাদের মধ্যে একটি বিশাল নির্মাণ কারখানায়
প্রতিনিয়ত সচল থাকাও তাঁরই হুকুমের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও যদি তাঁর হুকুম তাদেরকে
প্রতিষ্ঠিত না রাখে, তাহলে এ সমগ্র ব্যবস্থা এক নিমিষেই ওলট পালট
হয়ে যাবে।
৩৭. অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা ও পরিচালকের পক্ষে তোমাদেরকে
পুনর্বার জীবিত করে উঠিয়ে নিয়ে আসা তেমন কোন বড় কাজ নয়। এ জন্য তাকে কোন বড় রকমের প্রস্তুতি নিতে হবে
না। বরং তাঁর মাত্র একটি
আহ্বানেই সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলো মানুষ দুনিয়ায় জন্মলাভ
করেছে এবং ভবিষ্যতে জন্ম নেবে তারা সবাই একসাথে পৃথিবীর সকল দিক থেকে বের হয়ে আসতে
থাকবে।
﴿وَلَهُ
مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ كُلٌّ لَّهُ قَانِتُونَ﴾
২৬) আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছুই
আছে সবই তাঁর বান্দা, সবাই তাঁর হুকুমের তাবেদার।
﴿وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ
الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ ۚ وَلَهُ الْمَثَلُ
الْأَعْلَىٰ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
২৭) তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন, তাঁরপর তিনিই আবার তাঁর
পুনরাবর্তন করবেন এবং এটি তাঁর জন্য সহজতর।৩৮ আকাশসমূহ ও
পৃথিবীতে তাঁর গুণাবলীর শ্রেষ্ঠ মর্যাদা সম্পন্ন এবং তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।
৩৮. প্রথমবার সৃষ্টি করাটা যদি তাঁর জন্যে কঠিন না হয়ে থাকে,
তাহলে
তোমরা কেমন করে ধারণা করতে পারলে যে,
দ্বিতীয়বার
সৃষ্টি করা তাঁর জন্য কঠিন হবে? প্রথমবারের সৃষ্টির মধ্যে তো তোমরা সশরীরেই উপস্থিত আছো। তাই এটা যে কঠিন নয় তা তো
সুস্পষ্ট। এখন এটি একটি সহজ বুদ্ধির ব্যাপার
যে, একবার যিনি কোন একটি জিনিস তৈরি করেন সে জিনিসটি পুনর্বার
তৈরি করা তাঁর জন্য তুলনামূলকভাবে আরো অনেক বেশি সহজ হওয়ার কথা।
﴿ضَرَبَ
لَكُم مَّثَلًا مِّنْ أَنفُسِكُمْ ۖ هَل لَّكُم مِّن مَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُم
مِّن شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنتُمْ فِيهِ سَوَاءٌ تَخَافُونَهُمْ
كَخِيفَتِكُمْ أَنفُسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴾
২৮) তিনি নিজেই তোমাদের জন্য৩৯ তোমাদের
আপন সত্তা থেকে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তোমাদের
যেসব গোলাম তোমাদের মালিকানাধীন আছে তাদের মধ্যে কি এমন কিছু গোলাম আছে যারা আমার
দেয়া ধন-সম্পদে তোমাদের সাথে সমান অংশীদার এবং তোমরা তাদেরকে এমন ভয় করো যেমন
পরস্পরের মধ্যে সমকক্ষদেরকে ভয় করে থাকে?৪০ -যারা বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে
তাদের জন্য আমি এভাবে আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করি।
৩৯. এ পর্যন্ত তওহীদ ও আখিরাতের বর্ণনা মিলেমিশে চলছিল। এর মধ্যে যেসব নিদর্শনের
দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে তওহীদের প্রমাণও রয়েছে এবং এ
প্রমাণগুলেঅ আখেরাতের আগমন যে অসম্ভব নয় সে কথা প্রমাণ করে। এরপর সামনের দিকে নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে
আলোচনা আসছে।
৪০. পৃথিবী ও আকাশ এবং তাদের মধ্যকার যাবতীয় জিনিসের স্রষ্টা ও
মালিক হচ্ছেন আল্লাহ, মুশরিকরা একথা স্বীকার করার পর তাঁর সৃষ্টির
মধ্য থেকে কাউকে আল্লাহর সার্বভৌম সত্ত্বার গুণাবলী ও ক্ষমতাঁর অংশীদার গণ্য করতো। তাদের কাছে প্রার্থনা করতো
তাদের সামনে মানত ও নাযরানা পেশ করতো এবং বন্দেগী ও পূজার অনুষ্ঠান করতো। এসব বানোয়াট শরীকদের ব্যাপারে তাদের মূল আকীদার
সন্ধান পাওয়া যায় তাদের কা'বা ঘর তাওয়াফ করার সময় পঠিত”তালবীয়াহ”থেকে। এসময় তারা বলতোঃ
لبيك اللهم لبيك لا شريك لك إلا شريكا هو لك تملكه
وماملك
“আমি হাজির আছি, হে
আমার আল্লাহ আমি হাজির আছি। তোমার কোন শরীক নেই তোমার নিজের শরীক ছাড়া। তুমি তাঁরও মালিক এবং যা
কিছু তাঁর মালিকানায় আছে তাঁরও মালিক তুমি।”( তাবারানীঃ ইবনে আব্বাস বর্ণিত)
এ আয়াতটিতে মহান আল্লাহ এ শিরকটিই খণ্ডন করছেন। এখানে দৃষ্টান্তটির অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ
প্রদত্ত সম্পদে কখনো আল্লাহরই সৃষ্টি যে মানুষ ঘটনাক্রমে তোমার দাসত্ব বন্ধনে
আবদ্ধ হয়ে গেছে তোমার অংশীদার গণ্য হতে পারে না।কিন্তু তোমরা অদ্ভূত ধান্দাবাজী শুরু করেছো, আল্লাহর
সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সৃষ্টিকে নির্দ্ধিধায় তাঁর সাথে তাঁর সার্বভৌম
কর্তৃত্বে শরীক গণ্য করছো। এ ধরনের নির্বোধ জনোচিত কথাগুলো চিন্তা করার সময় তোমাদের
বুদ্ধি-জ্ঞান কি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায়? (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল
কুরআন সূরা আন নাহলঃ ৬২ টীকা।)
﴿بَلِ
اتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَهْوَاءَهُم بِغَيْرِ عِلْمٍ ۖ فَمَن يَهْدِي مَنْ
أَضَلَّ اللَّهُ ۖ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ﴾
২৯) কিন্তু এ জালেমরা না জেনে বুঝে
নিজেদের চিন্তা-ধারণার পেছনে ছুটে চলছে। এখন
আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেছেন কে তাকে পথ দেখাতে পারে?৪১ এ ধরনের
লোকদের কোন সাহায্যকারী হতে পারে না।
৪১. অর্থাৎ যখন কোন ব্যক্তি সহজ-সরল বুদ্ধির কথা নিজেও চিন্তা
করে না এবং অন্যের বুঝাবার পরও বুঝতে চায় না তখন তাঁর বুদ্ধির ওপর আল্লাহর লানত
বর্ষিত হয়। এরপর এমন প্রত্যেকটি জিনিস, যা
কোন নিষ্ঠাবান ও বিবেকবান ব্যক্তিকে সত্যকথা পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করে, তা
এ হঠকারী মূর্খতাপ্রিয় ব্যক্তিকে আরো বেশি গোমরাহীতে লিপ্ত করতে থাকে। এ অবস্থাটিকেই প্রকাশ করা
হয়েছে”পথ ভ্রষ্টতা”শব্দের মাধ্যমে। সত্যপ্রিয় মানুষ যখন আল্লাহর কাছে সঠিক পথনির্দেশ লাভের
সুযোগ চায় তখন আল্লাহ তাঁর সত্য আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তাঁর জন্য বেশি করে সঠিক
পথনির্দেশের কার্যকারণসমূহ সৃষ্টি করে দেন। আর গোমরাহী প্রিয় মানুষ যখন গোমরাহীর ওপর টিকে থাকার জন্য
জোর দিতে থাকে তখন আল্লাহ তাঁর জন্য আবার এমন সব কার্যকারণ সৃষ্টি করে যেতে থাকেন
যা তাকে বিপথগামী করে দিনের পর দিন সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
﴿فَأَقِمْ
وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ
عَلَيْهَا ۚ لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৩০) কাজেই৪২ (হে নবী এবং নবীর অনুসারীবৃন্দ)
একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারা এ দীনের৪৩ দিকে স্থির
নিবদ্ধ করে দাও।৪৪ আল্লাহ
মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও।৪৫ আল্লাহ
তৈরি সৃষ্টি কাঠামো পরিবর্তন করা যেতে পারে না।৪৬ এটিই
পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন।৪৭ কিন্তু
অধিকাংশ লোক জানে না।
৪২. এখানে”কাজেই”শব্দটি যে অর্থে ব্যবহুত হয়েছে তা হচ্ছে,
সত্য
যখন তোমাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং তোমরা যখন জানতে পেরেছো এ বিশ্ব -জাহানের
ও মানুষের স্রষ্টা, মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন শাসনকর্তা এক
আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয় তখন এরপর অপরিহার্য ভাবে তোমাদের কার্যধারা এ ধরনের হওয়া
উচিত।
৪৩. কুরআন”দ্বীন”শব্দটিকে যে বিশেষ অর্থে পেশ করছে”দ্বীন”শব্দটি
এখানে সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বন্দেগী,
ইবাদাত
ও আনুগত্য লাভের অধিকার একমাত্র লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। এতে আল্লাহর সার্বভৌম
কর্তৃত্ব, গুণাবলী
ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে তাঁর সাথে সামান্যতমও শরীক করা যায় না। এখানে মানুষ নিজের ইচ্ছা ও
আগ্রহ সহকারে একথা মেনে নেয় যে, সে তাঁর সমস্ত জীবনে আল্লাহর
পথনির্দেশ এবং তাঁর আইন মেনে চলবে।
৪৪. “একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারা এদিকে স্থির নিবদ্ধ করো”অর্থাৎ
এরপর আবার অন্যদিকে ফিরো না। জীবনের জন্য এ পথটি গ্রহণ করে নেবার পর অন্য কোন পথের দিকে
দৃষ্টি ও দেয়া যাবে না।
তাঁরপর তোমাদের চিন্তা-ভাবনা হবে মুসলমানের মতো এবং তোমাদের পছন্দ অপছন্দও হবে
মুসলমানদের মতো। তোমাদের মূল্যবোধ ও মানদণ্ড
হবে তাই যা ইসলাম তোমাদের দেয়। তোমাদের স্বভাব -চরিত্র এবং জীবন ও কার্যক্রমের ছাঁচ
ইসলামের চাহিদা অনুযায়ী হবে। ইসলাম যে পথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনধারা চালাবার বিধান
দিয়েছে তোমাদের সে পথেই নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালিত করতে হবে।
৪৫. অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতিকে এ প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে
যে, এক আল্লাহ ছাড়া তাদের আর কোন স্রষ্টা,
রব, মাবুদ
ও আনুগত্য গ্রহণকারী নেই। এ
প্রকৃতির ওপর তোমাদের প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া উচিত। যদি স্বেচ্ছাচারীভাবে চলার নীতি অবলম্বন করো
তাহলে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর যদি অন্যের বন্দেগীর শিকল নিজের গলায় পরে নাও তাহলেও
নিজের প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করবে। এ বিষয়টি নবী সা. বহু হাদীসে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ
ما مِن مَوْلُودٍ إلَّا يُولَدُ علَى الفِطْرَةِ،
فأبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أوْ يُنَصِّرَانِهِ، أوْ يُمَجِّسَانِهِ، كما تُنْتَجُ
البَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ، هلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِن جَدْعَاءَ
“মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভকারী প্রত্যেকটি শিশু
আসলে মানবিক প্রকৃতির ওপরই জন্ম লাভ করে। তাঁরপর তাঁর মা-বাপই তাকে পরবর্তীকালে ইহুদী, খৃষ্টান
ও অগ্নিপূজারী হিসেবে গড়ে তোলে।"
এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন প্রত্যেকটি পশুর পেট থেকে পুরোপুরি নিখুঁত
ও সুস্থ পশুই বের হয়ে আসে। কোন একটা বাচ্চাও কান কাটা অবস্থায় বের হয়ে আসে না। পরে মুশরিকরা নিজেদের
জাহিলী কুসংস্কারের কারণে তাঁর কান কেটে দেয়।
মুসনাদে আহমাদ ও নাসায়ীতে আর একটি হাদীস আছে, তাতে
বলা হয়েছেঃ এক যুদ্ধে মুসলমানরা শত্রুদের শিশু সন্তানদেরকেও হত্যা করে। নবী সা. এর কাছে এ খবর পৌঁছে
যায়। তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং
বলেনঃ
ما بال أقوام جاوزهم القتل اليوم حتى قتلوا الذرية
“লোকদের কি হয়ে গেছে, আজ
তারা সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং শিশুদেরকেও হত্যা করেছে?”
একজন জিজ্ঞেস করলো, এরা কি মুশরিকদের সন্তান ছিল না। জবাবে তিনি বলেনঃ
إنَّ خيارَكُم أبناءُ المشرِكينَ
"তোমাদের সর্বোত্ততম লোকেরা
তো মুশরিকদেরই আওলাদ।”তাঁরপর
বলেনঃ
كلُّ نَسَمَةٍ تُولَدُ على الفِطْرَةِ حتى
يُعْرِبَ عَنْها لسانُها فَأَبَوَاها يُهَوِّدَانِها و يُنَصِّرَانِها
“প্রত্যেক প্রাণসত্তা প্রকৃতির ওপর জন্ম নেয়, এমনকি
যখন কথা বলতে শেখে তখন তাঁর বাপ-মা তাকে ইহুদী খৃষ্টানে পরিণত করে।"
অন্য একটি হাদীসে ইমাম আহমাদ রা. ঈযায ইবনে হিমার আল মুজাশি'য়ী
থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
তাতে বলা হয়েছে, একদিন নবী সা. নিজের ভাষণের মাঝখানে বলেনঃ
إنَّ ربِّي يقولُ إني
خلقتُ عبادي حنفاءَ كُلَّهُمْ، وإنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ فَاضْلتهُمْ عن
دِينِهِمْ فحرَّمتْ عليهم ما أحللتُ لهم وأمرتهم أن يشركوا بي ما لم أُنزِّل به
سلطانًا
“আমার রব বলেন, আমার
সমস্ত বান্দাদেরকে আমি একনিষ্ঠ সত্যপথাশ্রয়ী করে সৃষ্টি করেছিলাম, তাঁরপর
শয়তানরা এসে তাদেরকে দ্বীন থেকে বিপথগামী করে এবং তাদের জন্য আমি যা কিছু হালাল
করে দিয়েছিলাম সেগুলোকে হারাম করে নেয় এবং তাদেরকে হুকুম দেয়, আমার
সাথে এ জিনিসগুলোকে শরীক গণ্য করো, যেগুলোকে শরীক করার জন্য আমি কোন প্রমাণ
অবতীর্ণ করিনি।”
৪৬. অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে নিজের বান্দায় পরিণত করেছেন। কেউ চাইলেও এ কাঠামোয় কোন
পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। মানুষ বান্দা থেকে অ-বান্দা হতে পারে না এবং আল্লাহ ছাড়া
অন্য কাউকে ইলাহ বানিয়ে নিলেও প্রকৃতপক্ষে সে মানুষের ইলাহ হতে পারে না। মানুষ নিজের জন্য যতগুলো
উপাস্য তৈরি করে নিক না কেন, মানুষ যে, এক
আল্লাহ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় এ বাস্তব সত্যটি অকাট্য ও অবিচল রয়ে গেছে। মানুষ নিজের মূর্খতা ও
অজ্ঞতাঁর কারণে যাকে ইচ্ছা আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতাঁর ধারক গণ্য করতে পারে এবং
যাকে চায় তাকে নিজের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার মালিক মনে করতে পারে।কিন্তু প্রকৃত ও বাস্তব সত্য এটিই যে, সার্বভৌম
কর্তৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। কেউ তাঁর মতো ক্ষমতাঁর অধিকারী নয় এবং মানুষের
ভাগ্য ভাঙা-গড়ার শক্তিও আল্লাহ ছাড়া কারো নেই।
এ আয়াতটির আর একটি অনুবাদ এও হতে পারেঃ”আল্লাহর তৈরি কাঠামোয় পরিবর্তন করা
যাবে না।”অর্থাৎ আল্লাহ যে প্রকৃতির
ওপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাকে বিকৃত করা ও ভেঙ্গে ফেলা উচিত নয়।
৪৭. অর্থাৎ শান্ত সমাহিত ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতির ওপর
প্রতিষ্ঠিত থাকাই সঠিক ও সহজ পথ।
﴿مُنِيبِينَ
إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ
الْمُشْرِكِينَ﴾
৩১) (প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও একথার ওপর)
আল্লাহ অভিমুখী হয়ে৪৮ এবং তাকে
ভয় করো,৪৯ আর নামায
কায়েম করো৫০ এবং এমন
মুশরিকদের অন্তরভুক্ত হয়ে যেয়ো না,
৪৮. আল্লাহ অভিমুখী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, যে
ব্যক্তিই স্বেচ্ছাচারীতাঁর নীতি অবলম্বন করে নিজের প্রকৃত মালিক থেকে মুখ ফিরিয়ে
নিয়েছে অথবা যে ব্যক্তিই অন্যের বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে নিজের রবের প্রতি
বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাঁর এ নীতি পরিহার করতে হবে এবং প্রকৃতপক্ষে যে আল্লাহর
বান্দা হিসেবে সে জন্মলাভ করেছে সেই এক আল্লাহর বন্দেগীর দিকে তাকে ফিরে যেতে হবে।
৪৯. অর্থাৎ তোমাদের মনে এ ভয় জাগরুক থাকতে হবে যে, যদি
আল্লাহর জন্মগত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও তোমরা তাঁর মোকাবিলায় স্বাধীনতাঁর নীতি
অবলম্বন করে থাকো, অথবা তাঁর পরিবর্তে অন্য কারো বন্দেগী করে থাকো, তাহলে
এ বিশ্বাসঘাতকতা ও নিমকহারামির জন্য তোমাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই তোমাদের এমন নীতি ও
মনোভাব থেকে দূরে থাকা উচিত যা তোমাদের জন্য আল্লাহর আযাব ভোগ করাকে অবধারিত করে
তোলে।
৫০. আল্লাহর দিকে ফেরা এবং তাঁর গযবের ভয় করা -এ দুটিই মানসিক
কর্ম। এ মানসিক অবস্থাটির প্রকাশ
এবং এর সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্যভাবে এমন কোন দৈহিক কর্মের প্রয়োজন যার
মাধ্যমে বাইরেও প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে ওমুক ব্যক্তি যথার্থই এ ও লা-শারীক আল্লাহর
বন্দেগীর দিকে ফিরে এসেছে। মানুষের নিজের মনের মধ্যেও এ আল্লাহ ভীতির দিকে ফিরে আসার
অবস্থাটি একটি কার্যকর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনবরত বিকাশ লাভ করতে থাকে। তাই মহান আল্লাহ এই মানসিক
পরিবর্তনের হুকুম দেবার পর সাথে সাথেই এ দৈহিক কর্ম অর্থাৎ নামায কায়েম করার হুকুম
দেন। মানুষের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত
কোন চিন্তা নিছক চিন্তার পর্যায়েই থাকে ততক্ষণ তাঁর মধ্যে দৃঢ়তা ও স্থায়ীত্ব
সৃষ্টি হয় না। এ চিন্তা ভাটা পড়ে যাওয়ার
চিন্তা থাকে এবং এ চিন্তার পরিবর্তন আসারও সম্ভাবনা থাকে।কিন্তু সে সেই অনুযায়ী কাজ করতে থাকে তখন তাঁর
মধ্যে এ চিন্তা শিকড় গেড়ে বসে যেতে থাকে এবং যতই সে তদনুযায়ী কাজ করতে থাকে ততই তা
শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তা বেড়ে যেতে পেতে থাকে। এমন কি এ আকীদা ও চিন্তা পরিবর্তিত হওয়া এবং এতে ভাটা পড়ে
যাওয়া ক্রমেই দুস্কর হয়ে যেতে থাকে। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে আল্লাহ অভিমুখী হওয়া এবং আল্লাহ
ভীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রতিদিন নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার চাইতে বেশি
কার্যকর আর কোন কাজ নেই।
কারণ অন্য যে কোন কাজই হোক না কেন তা বিলম্বে আসে অথবা নামায এমন একটি কাজ যা
নিয়মিতভাবে কয়েক ঘন্টা পরপর একটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে মানুষকে স্থায়ীভাবে পালন করতে
হয়। কুরআন ঈমান ও ইসলামের
পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ মানুষকে দিয়েছে তা যাতে সে ভুলে না যায় এ জন্য বারবার তাঁর
পুনরাবৃত্তি করতে হয়।
তাছাড়া মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কারা বিদ্রোহের নীতি পরিহার করে রবের প্রতি
আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করেছে, কাফের ও মু'মিনদের
কাছে একথা এ জন্য প্রকাশ হওয়া দরকার যে,
এর
ফলে একটি সমাজ ও দল গঠিত হতে পরে। তারা আল্লাহর পথে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করতে পারে। ঈমান ও ইসলামের সাথে যখনই
তাদের দলের কোন ব্যক্তির সম্পর্ক ঢিলা হয়ে যেতে থাকে তখনই কোন আলামত সংগে সংগেই
সমগ্র মুমিন সমাজকে তাঁর অবস্থা জানিয়ে দেয়। কাফেরদের কাছে এর প্রকাশ হওয়া এ জন্য প্রয়োজন যে, এর
ফলে তাদের হৃদয় অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতি তাঁর নিজের শ্রেণী মানুষদেরকে আসল
ইলাহ রব্বুল আলামীনের দিকে বার বার ফিরে আসতে দেখে জেগে উঠবে এবং যতক্ষণ তারা জাগবে
না ততক্ষণ আল্লাহর অনুগতদের কর্ম তৎপরতা দেখে তাদের মধ্যে ভীতি ও আতংক সৃষ্টি হতে
থাকবে। এদু'টি
উদ্দেশ্যর জন্যেও নামাজ কায়েম করাই হবে সব চেয়ে বেশি উপযোগী মাধ্যম।
এ প্রসংগে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে নামায কায়েম করার এ হুকুমটি মক্কা মু' আয্যমায়
এমন এক যুগে দেয়া হয় যখন মষ্টিমেয় কয়েক জন মুসলমানের ক্ষুদ্র দলটি কুরাইশ বংশীয়
কাফেরদের জুলমও নিপীনের যাঁতাকলে নিষ্পেপিত হচ্ছিল এবং এরপরও ন' বছর
পর্যন্ত এ নিষ্পেষণের ধারা অব্যাহত ছিল।সে সময় দূরের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্রের নাম নিশানা ছিল না। যদি ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া
নামায অর্থহীন হয়ে থাকে,যেমন কতিপয় নাদান মনে করে থাকেন,অথবা
ইকামাতে সালাত অর্থ আদতে নামায কায়েম করা না থাকে বরং”রবুবিয়াত ব্যবস্থা”পরিচালনা
হয়ে থাকে, যেমন
হাদীস অস্বীকারকারীরা দাবী করে থাকেন,তাহলে এ অবস্থায় কুরআন মজীদের এ ধরনের হুকুম
দেয়ার অর্থ কী? আর এ হুকুম আসার পর ৯ বছর র্পযন্ত নবী সা. ও
মুসলমানরা এ হুকুমটি কিভাবে পালন করতে থাকেন?
﴿مِنَ
الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ
فَرِحُونَ﴾
৩২) যারা নিজেদের আলাদা আলাদা দীন তৈরি
করে নিয়েছে আর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রত্যেক
দলের কাছে যা আছে তাতেই তারা মশগুল হয়ে আছে।৫১
৫১. ওপরে যে প্রাকৃতিক দীনের কথা বলা হয়েছে মানব জাতির আসল
দীনই হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক দীন, এখানে এদিকেই ইশারা করা
হয়েছে। এ দীন মুশরিকী ধর্ম থেকে
ক্রম-বিবর্তনের মাধ্যমে তাওহীদ পর্যন্ত পৌঁছে নি। যেমন আন্দাজ অনুমানের মাধ্যমে একটি ধর্মীয়
দর্শন রচনাকারীরা মনে করে থাকেন। বরং দুনিয়ায় যতগুলো ধর্ম পাওয়া যায় এ সবেরই উৎপত্তি হয়েছে
এ আসল দীনের মধ্যে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে। এ বিকৃতি আসার কারণ হলো এই যে, বিভিন্ন
ব্যক্তি প্রাকৃতিক সত্যের ওপর নিজেদের নতুন নতুন কথা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের জন্য এক
একটি আলাদা ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই মূল সত্যের পরিবর্তে এ বর্ধিত জিনিসেরই
ভক্ত অনুরক্ত হয়ে গেছে।
যার ফলে তারা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র ফিরকায় পরিণত হয়েছে। এখন সঠিক পথনির্দেশনা লাভ
করতে চাইলে যে প্রকৃত সত্য ছিল দীনের মূল ভিত্তি,
প্রত্যেক
ব্যক্তিকেই সেদিকে ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের যাবতীয় বর্ধিত অংশ থেকে এবং তাদের
ভক্ত-অনুরক্তদের দল থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একেবারেই আলাদা হয়ে যেতে হবে। তাদের সাথে তারা যে সম্পর্ক
সূত্রই কায়েম রাখবে সেটিই তাদের দীনের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ
হবে।
﴿وَإِذَا
مَسَّ النَّاسَ ضُرٌّ دَعَوْا رَبَّهُم مُّنِيبِينَ إِلَيْهِ ثُمَّ إِذَا
أَذَاقَهُم مِّنْهُ رَحْمَةً إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُم بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ﴾
৩৩) লোকদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন তারা কোন কষ্ট পায় তখন
নিজেদের রবের দিকে ফিরে তাকে ডাকতে থাকে৫২ তাঁরপর যখন
তিনি নিজের দয়ার কিছু স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান তখন সহসা তাদের মধ্য থেকে কিছু
লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়,৫৩
৫২. তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে যে তাওহীদের প্রমাণ রয়ে গেছে
একথাটিই তাঁর সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেসব সহায়কের ভিত্তিতে আশার প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল যখনই
সেগুলো ভেঙে পড়তে থাকে তখনি তাদের অন্তর ভেতর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বলে
চিৎকার করতে থাকে যে, বিশ্ব-জাহানের মালিকই আসল শাসন কর্তৃত্বের
অধিকারী এবং তাঁরই সাহায্যে তারা নিজেদের ধ্বংসরোধ ও ক্ষতিপূরণ করতে পারে।
৫৩. অর্থাৎ অন্যান্য উপাস্যদেরকে মানত ও নযরানা পেশ করার কাজ
শুরু হয়ে যায়। এই সঙ্গে একথাও বলা হতে
থাকে যে, ওমুক হযরতের বদৌলতে এবং ওমুক মাজারের অনুগ্রেহে
এ বিপদ সরে গেছে।
﴿لِيَكْفُرُوا
بِمَا آتَيْنَاهُمْ ۚ فَتَمَتَّعُوا فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾
৩৪) যাতে আমার অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়। বেশ, ভোগ করে নাও, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।
﴿أَمْ أَنزَلْنَا
عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا فَهُوَ يَتَكَلَّمُ بِمَا كَانُوا بِهِ يُشْرِكُونَ﴾
৩৫) আমি কি তাদের কাছে কোন প্রমাণপত্র ও
দলীল অবতীর্ণ করেছি, যা তাদের
শিরকের সত্যতাঁর সাক্ষ্য দেয়।৫৪
৫৪. অর্থাৎ কোন যুক্তির ভিত্তিতে তারা একথা জানতে পারলো যে, আপদ-বিপদ
থেকে আল্লাহ রক্ষা করেন না বরং এসব বানোয়াট উপাস্যরা রক্ষা করে থাকে? বুদ্ধিবৃত্তি
কি এর সাক্ষ্য দেয়? অথবা আল্লাহর এমন কোন কিতাব আছে কি যার মধ্যে
তিনি বলেছেন,আমি আমার সাবর্ভৌম কর্তত্ব অমুক অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দিয়েছি, এখন
থেকে তারাই তোমাদের সমস্ত কাজ করে দেবে?
﴿وَإِذَا
أَذَقْنَا النَّاسَ رَحْمَةً فَرِحُوا بِهَا ۖ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ بِمَا
قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ إِذَا هُمْ يَقْنَطُونَ﴾
৩৬) যখন লোকদের দয়ার স্বাদ আস্বাদন করাই
তখন তারা তাতে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং যখন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে তাদের
ওপর কোন বিপদ এসে পড়ে তখন সহসা তারা হতাশ হয়ে যেতে থাকে।৫৫
৫৫. ওপরের আয়াতে মানুষের মূর্খতা ও অজ্ঞতা,
এবং
তাঁর অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে পাকড়াও করা হয়েছিল। এ মানুষের হীন প্রবৃত্তি ও
তাঁর সংকীর্ণমনতাঁর জন্য তাকে পাকড়াও করা হয়েছে। এ হীনচেতা কাপুরুষটি যখন দুনিয়ায় কিছু ধন-সম্পদ,
শক্তি
ও মর্যাদা লাভ করে এবং দেখে তাঁর কাজ খুব ভালোভাবে চলছে তখন এ সবকিছু যে মহান
আল্লাহর দান, একথা আর তাঁর একদম মনে থাকে না। তখন সে মনে করতে থাকে তাঁর
মধ্যে এমন অসাধারণ কিছু আছে যার ফলে সে এমন কিছু লাভ করেছে যা থেকে অন্যেরা বঞ্চিত
হয়েছে। এ বিভ্রান্তির মধ্যে অহংকার
ও আত্মগরিমার নেশায় সে এমনই বিভোর হয়ে যায় যার ফলে সে আল্লাহ ও সৃষ্টি কাউকেও
ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না।কিন্তু যখনই সৌভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে
হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং দুর্ভাগ্যের একটিমাত্র আঘাতই তাঁর হৃদয়াবৃত্তি ভেঙ্গে
চুরমার করে দেয়। তখন এমন একটি অবস্থার
সৃষ্টি হয় যে, হীনতম কাজ করতেও সে কুণ্ঠিত হয় না, এমন
কি শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যাও করে বসে।
﴿أَوَلَمْ
يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ۚ إِنَّ فِي
ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
৩৭) এরা কি দেখে না আল্লাহই যাকে চান তাঁর
রিযিক সম্প্রসারিত করেন এবং সংকীর্ণ করেন (যাকে চান?) অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে বহু
নিদর্শনাবলী এমন লোকদের জন্য যারা ঈমান আনে।৫৬
৫৬. অর্থাৎ মানুষের নৈতিক চরিত্রের ওপর কুফর ও শিরক কি প্রভাব
বিস্তার করতে পারে এবং এর বিপরীত পক্ষে আল্লাহর প্রতি ঈমানের নৈতিক পরিণাম কি,
মুমিনরা
এ থেকে সে শিক্ষা লাভ করতে পারে। যে ব্যক্তিই নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং
তাকেই রিযিকের সমুদয় ভাণ্ডারের মালিক মনে করে,
সে
কখনো আল্লাহকে ভুলে থাকা লোকদের মতো সংকীর্ণ হৃদয়বৃত্তির পরিচয় দিতে পারে না। সে প্রসারিত রিযিক লাভ করলে
অহংকারে মত্ত হয় না।
বরং আল্লাহর শোকর আদায় করে, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মমতা ও ঔদার্যপূণ্য
ব্যবহার করে এবং আল্লাহর সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করে না। সংকীণ জীবিকা লাভ করুক বা
অনাহারে থাকুক সর্বাবস্থায় সে সবর করে, কখনো বিশ্বস্ততা,
আমানতদারী
ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয় না এবং শেষ সময় পর্যন্ত আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের আশায়
বসে থাকে। কোন নাস্তিক বা মুশরিক এ
নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে না।
﴿فَآتِ
ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ
لِّلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
৩৮) কাজেই (হে মুমিন!) আত্মীয়দেরকে তাদের অধিকার
দাও এবং মিসকীন ও মুসাফির কে (দাও তাদের অধিকার)।৫৭ এ পদ্ধতি
এমন লোকদের জন্য ভালো যারা চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তারাই সফলকাম হবে।৫৮
৫৭. আত্মীয়-স্বজন,
মিসকিন
ও মুসাফিরদেরকে দান করার কথা বলা হয়নি। বরং বলা হচ্ছে,
এ
তাঁর অধিকার এবং অধিকার মনে করেই তোমাদের এটা দেয়া উচিত। এ অধিকার দিতে গিয়ে তোমার মনে এ ধারণা না
জন্মে যে, তাঁর প্রতি তুমি অনুগ্রহ করছো এবং তুমি কোন
মহান দানশীল সত্ত্বা আর সে কোন একটি সামান্য ও নগণ্য সৃষ্টি, তোমার
অনুগ্রহের কণা ভক্ষণ করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। বরং একথা ভালোভাবে তোমার মনে গেঁথে যাওয়া উচিত
যে, সম্পদের আসল মালিক যদি তোমাকে বেশি এবং অন্য বান্দাদেরকে কম
দিয়ে থাকেন, তাহলে
এ বর্ধিত সম্পদ হচ্ছে এমন সব লোকের অধিকার যাদেরকে তোমার আওতাধীনে তোমাকে পরীক্ষা
করার জন্য দেয়া হয়েছে।
তুমি তাদেরকে এ অধিকার দান করছো কি করছো না এটা তোমার মালিক দেখতে চান।
আল্লাহর এ ভাষণ এবং এর আসল প্রাণসত্ত্বা সম্পর্কে যে ব্যক্তিই চিন্তা-ভাবনা
করবে সে একথা অনুভব না করে থাকতে পারে না যে,
কুরআন
মজীদ মানুষের জন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির যে পথ নির্ধারণ করে সে জন্য একটি
মুক্ত সমাজ ও মুক্ত অর্থনীতি যেখানে মানুষের মালিকানা অধিকার খতম করে দেয়া হয়,
রাষ্ট্র
সমস্ত উৎপাদন ও উপকরণের একচ্ছত্র মালিক হয়ে যায় এবং ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জীবিকা
বণ্টনের যাবতীয় ব্যবস্থা সরকারী কর্মকর্তাদের করায়ত্ব থাকে। এমন কি কোন ব্যক্তি অধিকার চিহ্নিত করার পরও
তা তাকে দিতে পারে না এবং অন্য ব্যক্তি কারো থেকে কিছু গ্রহণ করে তাঁর জন্য নিজের
মনের মধ্যে কোন শুভেচ্ছার অনুভূতি লালন করতে পারে না। এভাবে নির্ভেজাল কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক ও
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আজকাল আমাদের দেশে”কুরআনী রবুবীয়াত ব্যবস্থা"র গালভরা
নাম দিয়ে জবরদস্তি কুরআনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এটা কুরআনের নিজস্ব পরিকল্পনার সম্পূর্ণ
বিপরীত। কারণ এর মধ্যে ব্যক্তিগত
নৈতিক বৃত্তির বিকাশ ও উন্মেষ এবং ব্যক্তি চরিত্র গঠন ও উন্নয়নের দুয়ার পুরোপুরি
বন্ধ হয়ে যায়। কুরআনের পরিকল্পনা এমন
জায়গায় কার্যকর হতে পারে যেখানে ব্যক্তিরা সম্পদের কিছু উপায়-উপকরণের মালিক হয়, সেগুলো
স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে এবং এরপর স্বেচ্ছায় ও স্বাগ্রহে আল্লাহ ও
তাঁর বান্দাদের অধিকার আন্তরিকতা সহকারে প্রদান করে। এ ধরনের সমাজে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি লোকের
মধ্যে একদিকে সহানুভূতি, দয়া-মায়া, মমতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সত্যনিষ্ঠ
ও সত্য পালন করার উন্নতর গুণাবলী সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং অন্যদিকে যেসব
লোকের সাথে সদাচার করা হয় তাদের মনে সদাচারীদের জন্য শুভেচ্ছা ও অনুগৃহীত হবার
মনোভাব এবং অনুগ্রহের বিনিময়ে অনুগ্রহ করার পবিত্র অনুভূতি বিকাশ লাভ করে। শেষ পর্যন্ত এমন একটি আদর্শ
ও মহৎ পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে যায় যেখানে অন্যায়ের পথ রুদ্ধ হওয়া এবং ন্যায়ের পথ
উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া কোন স্বৈরাচারী শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয় না বরং লোকেরা নিজেদের
আত্মিক শুদ্ধতা ও সদিচ্ছাবশেই এ দায়িত্ব মাথা পেতে নেয়।
৫৮. এর দ্বারা একথা বুঝানো হচ্ছে না যে, কেবলমাত্র
মিসকীন, মুসাফির ও আত্মীয়-স্বজনদের অধিকার দিয়ে দিলেই সাফল্য লাভ
করা যাবে এবং এ ছাড়া সাফল্য লাভ করার জন্য আর কোন জিনিসের প্রয়োজন নেই। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যেসব
লোক এ অধিকারগুলো জানে না এবং এ অধিকারগুলো প্রদান করে না তারা সাফল্য লাভ করবে না। বরং সাফল্য লাভ করবে এমনসব
লোক যারা একান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অধিকার গুলো জানে এবং এগুলো
প্রদান করে।
﴿وَمَا
آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ
اللَّهِ ۖ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ
هُمُ الْمُضْعِفُونَ﴾
৩৯) যে সূদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে
মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর
কাছে তা বাড়ে না।৫৯ আর যে
যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকো, তা প্রদানকারী আসলে নিজের
সম্পদ বৃদ্ধি করে।৬০
৫৯. সুদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপনসূচক এটিই প্রথম আয়াত। এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা
বলা হয়েছে যে, তোমরা তো একথা মনে করে সুদ দিয়ে থাকো যে, যাকে
আমি এ অতিরিক্ত সম্পদ দিচ্ছি তাঁর ধন-দৌলত বেড়ে যাবে।কিন্তু আসলে আল্লাহর কাছে সুদের মাধ্যমে ধন-দৌলত
বৃদ্ধি হয় না বরং যাকাতের মাধ্যমে বৃদ্ধি হয়। সামনের দিকে এগিয়ে যখন মদিনা তাইয়েবায় সুদ
হারাম হবার হুকুম নাযিল করা হয তখন সেখানে অতিরিক্ত একথা বলা হয়, ﴿يَمْحَقُ اللَّهُ
الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ﴾ ”আল্লাহ সুদকে ক্ষতিগ্রস্ত
করেন এবং সাদকাকে বিকশিত করেন।”(পরবর্তী বিধানের জন্য দেখুন সূরা আলে ইমরানঃ ১৩০ আয়াত এবং আল বাকারাহঃ ২৭৫ আয়াত থেকে ২৮১ আয়াত।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ দু'দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন। একদল বলেন, এখানে
রিবা শব্দের এমন সুদের কথা বলা হয়নি যাকে শরীয়াতের দৃষ্টিতে হারাম করা হয়েছে বরং
এমন ধরনের দান, তোহফা ও হাদিয়াকে সুদ বলা হয়েছে যা গ্রহীতা
পরবর্তীকালে ফেরত দেবার সময় তা বর্ধিত আকারে ফেরত দেবে, এরূপ
সংকল্প সহকারে দেয়া হয়।
অথবা একথা মনে করে দেয়া হয় যে, তা দাতাঁর কোন ভাল কাজে
লাগবে অথবা তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করা দাতাঁর নিজের জন্য ভালো হবে। এটি ইবনে আব্বাস রা., মুজাহিদ
রা., দ্বাহহাক রা.,
কাতাদাহ, ইকরামাহ, মুহাম্মদ
ইবনে কা'ব আল কুরাযী ও শা'বীর
উক্তি। আর সম্ভবত তারা এ ব্যাখ্যা
এ জন্য করেছেন যে, আয়াতে এ কর্মের ফল হিসেবে কেবলমাত্র এতটুকু বলা
হয়েছে যে, আল্লাহর কাছে ব্যাপারটি তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট
হতো তাহলে ইতিবাচকভাবে বলা হতো, আল্লাহর দরবারে তাকে কঠিন
শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
দ্বিতীয় দলটি বলেন, না,
শরীয়াত
যে রিবাকে হারাম গণ্য করেছে এখানে তাঁর কথাই বলা হয়েছে। এ মত প্রকাশ করেছেন হযরত হাসান বাসরী ও সুদ্দী
এবং আল্লামা আলূসীর মতে আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এটিই। কারণ আরবী ভাষায় রিবা শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত
হয়। মুফাসসির নিশাপুরীও এ
ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেছেন।
আমার মতে এ দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই সঠিক। কারণ পরিচিত অর্থ পরিত্যাগ করার জন্য ওপরে প্রথম ব্যাখ্যার
স্বপক্ষে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা যথেষ্ঠ নয়। সূরা রুম যে সময় নাযিল হয় সে সময় কুরআন মজীদ
সুদ হারাম হওয়ার কথা ঘোষণা করেনি। তাঁর কয়েক বছর পর একথা ঘোষিত হয়। এ জন্য সে পূর্ব থেকেই মন-মানসিকতা তৈরি করার
কাজে লিপ্ত হয়। মদের ব্যাপারেও পূর্বে
শুধুমাত্র এতটুকু বলা হয়েছিল যে, এটা পবিত্র রিযিক নয় (আন
নাহল,৬৭ আয়াত)
তাঁরপর বলা হয়, এর ক্ষতি এর লাভের চেয়ে বেশি। ( আল বাকারাহ,২১৯) এরপর হুকুম দেয়া হয়, নেশাগ্রস্ত
অবস্থায় নামাযের ধারে কাছে যেয়ো না। (আন নিসা,৪৩) তাঁরপর এটিকে পুরোপুরি হারাম করার ঘোষণা দেয়া হয়। অনুরূপভাবে এখানে সুদের
ব্যাপারেও কেবলমাত্র এতটুকু বলেই থেমে যাওয়া হয়েছে যে, এটা
এমন জিনিস নয় যার মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি বরং সম্পদ প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি হয় যাকাতের
মাধ্যমে। এরপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদকে
নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে (আল ইমরান,
১৩০)
এবং সবশেষে সুদকেই চূড়ান্তভাবে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে (আল বাকারাহ,২৭৫)
৬০. এ বুদ্ধির কোন সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। যে ধরনের ঐকান্তিক সংকল্প, গভীর
ত্যাগের অনুভূতি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষা সহকারে কোন ব্যক্তি
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করবে অনুরূপভাবেই আল্লাহ তাকে বেশি বেশি প্রতিদানও দেবেন। তাই একটি সহীহ হাদীসে বলা
হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি খেজুরও দান করে তাহলে
আল্লাহ তাকে বাড়িয়ে ওহোদ পাহাড়ের সমান করে দেন।
﴿اللَّهُ
الَّذِي خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ۖ هَلْ
مِن شُرَكَائِكُم مَّن يَفْعَلُ مِن ذَٰلِكُم مِّن شَيْءٍ ۚ سُبْحَانَهُ
وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
৪০) আল্লাহই৬১ তোমাদের
সৃষ্টি করেছেন, তাঁরপর
তোমাদের রিযিক দিয়েছেন।৬২ তাঁরপর
তিনি তো তোমাদের মৃত্যু দান করেন, এরপর তিনি তোমাদের জীবিত করবেন। তোমাদের
বানানো শরীকদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে এ কাজও করে?৬৩ পাক-পবিত্র
তিনি এবং এরা যে শিরক করে তাঁর বহু উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান।
৬১. এখান থেকে আবার মুশরিকদের বোঝাবার জন্য বক্তব্যের ধারা
তাওহীদ ও আখেরাতের বিষয়বস্তুর দিকে ফিরে এসেছে।
৬২. অর্থাৎ পৃথিবীতে তোমাদের রিযিকের জন্য যাবতীয় উপায়-উপকরণ
সরবরাহ করেছেন এবং এমন ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে রিযিকের আবর্তনের মাধ্যমে
প্রত্যেকে কিছু না কিছু অংশ পেয়ে যায়।
৬৩. অর্থাৎ তোমাদের তৈরি করা উপাস্যদের মধ্যে কেউ কি
সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা? জীবন
ও মৃত্যু দান করা কি কারো ক্ষমতাঁর আওতাভুক্ত আছে?
অথবা
মরার পর সে আবার কাউকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখে?
তাহলে
তাদের কাজ কি? তোমরা
তাদেরকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছো কেন?
﴿ظَهَرَ
الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ
لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾
৪১) মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে
বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো
যায়, হয়তো তারা
বিরত হবে।৬৪
৬৪. এখানে আবার রোম ও ইরানের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছিল এবং যার
আগুন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।”লোকদের স্বহস্তের উপার্জন”বাক্যাংশের
অর্থ হচ্ছে, ফাসেকী, অশ্লীলতা,
জুলুম
ও নিপীড়নের এমন একটি ধারা যা শিরক ও নাস্তিক্যবাদের আকীদা-বিশ্বাস অবলম্বন ও
আখেরাতকে উপেক্ষা করার ফলে অনিবার্যভাবে মানবিক নৈতিক গুণাবলী ও চরিত্রের মধ্যে
সৃষ্টি হয়ে থাকে।”হয়তো তারা বিরত হবে”এর অর্থ
হচ্ছে, আখেরাতে শাস্তি লাভ করার পূর্বে আল্লাহ এ দুনিয়ায় মানুষের
সমস্ত নয় বরং কিছু খারাপ কাজের ফল এজন্য ভোগ করান যে, এর
ফলে সে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করবে এবং নিজের চিন্তাধারার ভ্রান্তি অনুধাবন করে
নবীগণ সবসময় মানুষের সামনে যে সঠিক বিশ্বাস উপস্থাপন করে এসেছেন এবং যা গ্রহণ না
করলে মানুষের কর্মধারাকে সঠিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার দ্বিতীয় কোন পথ নেই
সেদিকে ফিরে আসবে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন
স্থানে, এ বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন দেখুন, আত
তাওবা, ১২৬; আর রা'আদ, ২১ ; আস
সাজদাহ, ২১ এবং আত তূর,
৪৭
আয়াত।
﴿قُلْ
سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ ۚ
كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ﴾
৪২) (হে নবী!) তাদেরকে বলে দাও, পৃথিবীর বুকে পরিভ্রমণ করে
দেখো পূর্ববর্তী লোকদের পরিণাম কি হয়েছে! তাদের অধিকাংশই মুশরিক ছিল।৬৫
৬৫. অর্থাৎ রোম ও ইরানের ধ্বংসকর যুদ্ধ আজ কোন নতুন দুর্ঘটনা
নয়। বড় বড় জাতিসমূহের ধ্বংসের
কাহিনী অতীত ইতিহাসের বিরাট অংশ জুড়ে আছে। আর যে দোষগুলো সেসব জাতির ধ্বংসের মূলে কাজ করেছে সেগুলোর
মূলে ছিল এ শিরক এবং আজ এ শিরক থেকে দূরে থাকার জন্য তোমাদের বলা হচ্ছে।
﴿فَأَقِمْ
وَجْهَكَ لِلدِّينِ الْقَيِّمِ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ يَوْمٌ لَّا مَرَدَّ لَهُ
مِنَ اللَّهِ ۖ يَوْمَئِذٍ يَصَّدَّعُونَ﴾
৪৩) কাজেই (হে নবী!) এই সত্য দীনে নিজের
চেহারাকে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করো আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দিনের হটে যাওয়ার কোন পথ
নেই তাঁর আগমনের পূর্বে,৬৬ সেদিন
লোকেরা বিভক্ত হয়ে পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
৬৬. অর্থাৎ আল্লাহ নিজে যাকে হটাবেন না এবং তিনি কারো জন্য এমন
কোন করার অবকাশও রাখেননি যার ফলে তা হটে যেতে পারে।
﴿مَن
كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُ ۖ وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِأَنفُسِهِمْ
يَمْهَدُونَ﴾
৪৪) যে কুফরী করেছে তাঁর কুফরীর শাস্তি
সেই ভোগ করবে।৬৭ আর যারা
সৎকাজ করেছে তারা নিজেদেরই জন্য সাফল্যের পথ পরিষ্কার করছে,
৬৭. এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। একজন কাফের নিজের কুফরীর কারণে যেসব ক্ষতির
সম্মুখীন হতে পারে এ বাক্যের মধ্যে তাঁর সবগুলোরই সমাবেশ ঘটেছে। ক্ষতিকারক বস্তুর অন্য কোন
বিস্তারিত তালিকাই এতটা ব্যাপক হতে পারে না।
﴿لِيَجْزِيَ
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِن فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ
الْكَافِرِينَ﴾
৪৫) যাতে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে
তাদেরকে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে পুরষ্কৃত করেন। অবশ্যই
তিনি কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না।
﴿وَمِنْ آيَاتِهِ أَن
يُرْسِلَ الرِّيَاحَ مُبَشِّرَاتٍ وَلِيُذِيقَكُم مِّن رَّحْمَتِهِ وَلِتَجْرِيَ
الْفُلْكُ بِأَمْرِهِ وَلِتَبْتَغُوا مِن فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
৪৬) তাঁর নিদর্শনাবলীর একটি হচ্ছে এই যে, তিনি বাতাস পাঠান সুসংবাদ দান
করার জন্য৬৮ এবং
তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ আপ্লুত করার জন্য। আর এ
উদ্দেশ্যে যে যাতে নৌযানগুলো তাঁর হুকুমে চলে৬৯ এবং তোমরা
তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করো৭০ আর তাঁর
প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
৬৮. অর্থাৎ অনুগ্রহের বারিধারা বর্ষণের সুসংবাদ দেবার জন্য।
৬৯. এটি জাহাজ চলাচলে সহায়তা দানকারী অন্য এক ধরনের বাতাসের
আলোচনা। প্রাচীনকালে বাতাসের
সহায়তাঁরয় চলাচলকারী নৌযান ও জাহাজসমূহের সফর তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুকূল বাতাসের
ওপরই নির্ভরশীল ছিল।
প্রতিকূল বাতাস তাদের জন্য ছিল ধ্বংসের সূচনা। তাই বৃষ্টি বহনকারী বাতাসের পর ঐ বাতাসের
উল্লেখ করা হয়েছে একটি বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে।
৭০. অর্থাৎ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে সফর করো।
﴿وَلَقَدْ
أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ رُسُلًا إِلَىٰ قَوْمِهِمْ فَجَاءُوهُم بِالْبَيِّنَاتِ
فَانتَقَمْنَا مِنَ الَّذِينَ أَجْرَمُوا ۖ وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ
الْمُؤْمِنِينَ﴾
৪৭) আমি তোমার পূর্বে রসূলদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের
কাছে পাঠাই এবং তারা তাদের কাছে আসে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী নিয়ে।৭১ তারপর যারা
অপরাধ করে৭২ তাদের থেকে
আমি প্রতিশোধ নিই আর মুমিনদেরকে সাহায্য করা ছিল আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
৭১. অর্থাৎ এক ধরনের নির্দেশাবলী তো বিশ্ব-প্রকৃতির সর্বত্র
ছড়িয়ে রয়েছে। মানুষের জীবনের দৈনন্দিন
কাজে কর্মে প্রায় সর্বত্রই সেগুলোর সাথে মানুষের সংযোগ ঘটে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা। ওপরের আয়াতে এ সম্পর্কে
আলোচনা করা হয়েছে। অন্য এক ধরনের নিদর্শনাবলী
আল্লাহর নবীগণ মু'জিযা,
আল্লাহর
বাণী, নিজেদের অসাধারণ পবিত্র চরিত্র এবং মানব সমাজে নিজেদের
জীবনদায়ী প্রভাবের আকারে নিয়ে এসেছেন। এ দু'ধরনের নিদর্শন আসলে একটি
সত্যের প্রতিই ইঙ্গিত করে। তা হচ্ছে, নবীগণ যে তাওহীদের যে শিক্ষা
দিচ্ছেন তাই সঠিক। তাঁর মধ্যে প্রত্যেকটি
নিদর্শনই অন্যটির সমর্থক।
বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী নবীগণের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করে এবং নবীগণ যেসব
নিদর্শন এনেছেন সেগুলো বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী যে সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে
সেগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়।
৭২. অর্থাৎ এ দুটি নিদর্শন থেকে চোখ বন্ধ করে তাওহীদ অস্বীকার
করার ওপর অবিচল থাকে এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহই করে যেতে থাকে।
﴿اللَّهُ
الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَيَبْسُطُهُ فِي السَّمَاءِ
كَيْفَ يَشَاءُ وَيَجْعَلُهُ كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ ۖ
فَإِذَا أَصَابَ بِهِ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ﴾
৪৮) আল্লাহই বাতাস পাঠান ফলে তা মেঘ উঠায়, তাঁরপর তিনি এ মেঘমালাকে
আকাশে ছড়িয়ে দেন যেভাবেই চান সেভাবে এবং তাদেরকে খণ্ড-বিখণ্ড করেন, তাঁরপর তুমি দেখো বারিবিন্দু
মেঘমালা থেকে নির্গত হয়েই চলছে। এ বারিধারা যখন তিনি নিজের
বান্দাদের মধ্যে থেকে যার ওপর চান বর্ষণ করেন তখন তারা আনন্দোৎফুল্ল হয়।
﴿وَإِن كَانُوا مِن
قَبْلِ أَن يُنَزَّلَ عَلَيْهِم مِّن قَبْلِهِ لَمُبْلِسِينَ﴾
৪৯) অথচ তাঁর অবতরণের পূর্বে তারা হতাশ
হয়ে যাচ্ছিল।
﴿فَانظُرْ إِلَىٰ آثَارِ
رَحْمَتِ اللَّهِ كَيْفَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ
لَمُحْيِي الْمَوْتَىٰ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৫০) আল্লাহর অনুগ্রহের ফলগুলো দেখো, মৃত পতিত ভূমিকে তিনি কিভাবে
জীবিত করেন,৭৩ অবশ্যই
তিনি মৃতদেরকে জীবন দান করেন এবং তিনি প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
৭৩. এখানে যেভাবে একের পর এক নবুওয়াত ও বৃষ্টির আলোচনা করা
হয়েছে তা থেকে এ সত্যটির প্রতি একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, নবীর
আগমনও মানুষের নৈতিক জীবনের জন্য ঠিক তেমনি অনুগ্রহস্বরূপ যেমন বৃষ্টির আগমন তাঁর
বৈষয়িক জীবনের জন্য অনুগ্রহ হয়ে দেখা দেয়। আকাশ থেকে বারিধারা নেমে আসার ফলে যেমন মৃত পতিত জমি
অকস্মাৎ জীবিত হয়ে ওঠে এবং তাঁর চতুর্দিকে শস্য শ্যামলিমায় ভরে যায়, ঠিক
তেমনি আসমানী ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ফলে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাঁর বিরাণ দুনিয়া সজীব
হয়ে ওঠে এবং সেখানে শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও প্রশংসিত আচার আচরণের উদ্যানগুলো পত্র-পুষ্পে
সুশোভিত হতে থাকে। এটা কাফেরদের দুর্ভাগ্যের
ব্যাপার যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এ নিয়ামত যখনই তাদের কাছে
আসে, তারা
তা অস্বীকার করে এবং তাকে নিজেদের জন্য রহমতের সুসংবাদ মনে করার পরিবর্তে মৃত্যুর
বারতা মনে করতে থাকে।
﴿وَلَئِنْ
أَرْسَلْنَا رِيحًا فَرَأَوْهُ مُصْفَرًّا لَّظَلُّوا مِن بَعْدِهِ يَكْفُرُونَ﴾
৫১) আর আমি যদি এমন একটি বাতাস পাঠাই যার
প্রভাবে তারা দেখে তাদের শস্য পীতবর্ণ ধারণ করেছে৭৪ তাহলে তো
তারা কুফরী করতে থাকে।৭৫
৭৪. অর্থাৎ রহমতের বারিধারার পরে যখন শস্যক্ষেত সবুজ শ্যামল
হয়ে ওঠে তখন যদি এমন কোন কঠিন শৈত্য বা উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ চলে, যার
ফলে পাকা শস্য একেবারে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
৭৫. অর্থাৎ তখন তারা আল্লাহর কুৎসা গাইতে এবং তাকে দোষারোপ
করতে থাকে এই বলে যে, আমাদের ওপর এ কেমন বিপদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ যখন আল্লাহ তাদের ওপর
তাঁর অনুগ্রহধারা বর্ষণ করে চলছিলেন তখন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে তাঁর
অমর্যাদা করেছিল। এখানে আবার এ বিষয়বস্তুর
প্রতি একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে,
যখন
আল্লাহর রসূল তাঁর পক্ষ থেকে রহমতের পয়গাম নিয়ে আসেন তখন লোকেরা তাঁর কথা মেনে নেয়
না এবং সেই নিয়ামত প্রত্যাখ্যান করে। তাঁরপর যখন তাদের কুফরীর কারণে জালেম ও স্বৈরাচারী
একনায়কদেরকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেন এবং তারা জুলুম-নিপীড়নের যাঁতাকলে তাদেরকে পিষ্ট
করতে এবং মানবতাঁর নিকুচি করতে থাকে তখন তারাই আল্লাহকে গালি দিতে থাকে এবং তিনি এ
কেমন জুলুমে পরিপূর্ণ দুনিয়া তৈরি করেছেন বলে দোষারোপও করতে থাকে।
﴿فَإِنَّكَ
لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَىٰ وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا
مُدْبِرِينَ﴾
৫২) (হে নবী!) তুমি মৃতদেরকে শুনাতে পারো
না,৭৬ এমন
বধিরদেরকেও নিজের আহ্বান শুনাতে পারো না যারা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে৭৭
৭৬. এখানে এমনসব লোককে মৃত বলা হয়েছে। যাদের বিবেক মরে গেছে, যাদের
মধ্যে নৈতিক জীবনের ছিটেফোটাও নেই এবং যাদের আপন প্রবৃত্তির দাসত্ব,
জিদ
ও একগুয়েমি সেই মানবীয় গুণপনার অবসান ঘটিয়েছে যা মানুষকে হক কথা বুঝার ও গ্রহণ করার
যোগ্য করে তোলে।
৭৭. বধির হচ্ছে এমনসব লোক যারা নিজেদের মনের দুয়ার এমনভাবে
অর্গলবদ্ধ করেছে যে, সবকিছু শুনেও তারা কিছুই শুনে না। তাঁরপর এ ধরনের লোকেরা যখন
এমন প্রচেষ্টাও চালায় যাতে সত্যের আহ্বানের ধ্বনি তাদের কানে পৌঁছতেই না পারে এবং
আহ্বায়কদের চেহারা দেখতেই দূরে-সরে যেতে থাকে তখন আর কে তাদেরকে শুনাবে এবং কী-ই
বা শুনাবে?
﴿وَمَا
أَنتَ بِهَادِ الْعُمْيِ عَن ضَلَالَتِهِمْ ۖ إِن تُسْمِعُ إِلَّا مَن يُؤْمِنُ
بِآيَاتِنَا فَهُم مُّسْلِمُونَ﴾
৫৩) এবং অন্ধদেরকেও তাদের ভ্রষ্টতা থেকে
বের করে সঠিক পথ দেখাতে পারো না।৭৮ তুমি তো
একমাত্র তাদেরকেই শুনাতে পারো যারা আমার আয়াতের প্রতি ঈমান আনে এবং আনুগত্যের শির
নত করে।
৭৮. অর্থাৎ অন্ধদের হাত ধরে তাদেরকে সারা জীবন সঠিক পথে চালানো
তো নবীর কাজ নয়। তিনি তো কেবল সঠিক পথ
দেখিয়ে দিতে পারেন।কিন্তু যাদের দেখার চোখ অন্ধ
হয়ে গেছে এবং নবী তাদেরকে যে পথ দেখাতে চাচ্ছেন তা যারা দেখতেই পায় না তাদেরকে পথ
দেখানোর ক্ষমতা নবীর নেই।
﴿اللَّهُ
الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ
جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۖ وَهُوَ
الْعَلِيمُ الْقَدِيرُ﴾
৫৪) আল্লাহই দুর্বল অবস্থা থেকে তোমাদের
সৃষ্টি করেন তাঁরপর এ দুর্বলতাঁর পরে তোমাদের শক্তি দান করেন, এ শক্তির পরে তোমাদেরকে আবার
দুর্বল ও বৃদ্ধ করে দেন, তিনি যা চান সৃষ্টি করেন।৭৯ আর তিনি
সবকিছু জানেন, সব জিনিসের
ওপর তিনি শক্তিশালী।
৭৯. অর্থাৎ শৈশব,
যৌবন
ও বার্ধক্য। এসব অবস্থা তাঁরই সৃষ্ট। তিনি যাকে চান দুর্বল করে
সৃষ্টি করেন, যাকে চান তাকে শক্তিশালী করেন, যাকে
চান তাকে শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করতে দেন না,
যাকে
চান তাকে যৌবনে মৃত্যু দান করেন, যাকে চান তাকে দীর্ঘ বয়স দান
করার পরও সুস্থ সবল রাখেন, যাকে চান তাকে গৌরবান্বিত যৌবনকালের পরে
বার্ধক্যে এমন কষ্টকর পরিণতির দান করেন যার ফলে দুনিয়াবাসী শিক্ষালাভ করে, এসবই
তাঁর ইচ্ছা। মানুষ নিজের জায়গায় বসে যতই
অহংকারে মত্ত হয়ে উঠুক না কেন আল্লাহর শক্তির শৃঙ্খলে সে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে
বাঁধা যে, আল্লাহ তাকে যে অবস্থায়ই রাখুন না কেন তাঁর
মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা তাঁর পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়।
﴿وَيَوْمَ
تَقُومُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُونَ مَا لَبِثُوا غَيْرَ سَاعَةٍ ۚ
كَذَٰلِكَ كَانُوا يُؤْفَكُونَ﴾
৫৫) আর যখন সেই সময় শুরু হবে,৮০ যখন
অপরাধীরা কসম খেয়ে খেয়ে বলবে, আমরা তো মুহূর্তকালের বেশি
অবস্থান করিনি।৮১ এভাবে তারা
দুনিয়ার জীবনে প্রতারিত হতো।৮২
৮০. অর্থাৎ কিয়ামত যার আসার খবর দেয়া হচ্ছে।
৮১. অর্থাৎ মৃত্যুকাল থেকে কিয়ামতের এই সময় পর্যন্ত। এ দুটি সময়ের মধ্যে দশ বিশ
হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তারা মনে করবে তারা যেন এই মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে
ঘুমিয়েছিল এবং এখন অকস্মাৎ একটি দুর্ঘটনা তাদেরকে জাগিয়ে দিয়েছে।
৮২. অর্থাৎ দুনিয়াতেও তারা এমনিই ভূল আন্দাজ-অনুমান করতো। সেখানেও সত্য অনুধাবন করতে
পারতো না। এ জন্যই বলে বেড়াতো কোন
কিয়ামত টিয়ামত হবে না, মরার পরে আর কোন জীবন নেই এবং কোন আল্লাহর
সামনে হাজির হয়ে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না।
﴿وَقَالَ
الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَالْإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ اللَّهِ
إِلَىٰ يَوْمِ الْبَعْثِ ۖ فَهَٰذَا يَوْمُ الْبَعْثِ وَلَٰكِنَّكُمْ كُنتُمْ لَا
تَعْلَمُونَ﴾
৫৬) কিন্তু যাদেরকে ঈমান ও জ্ঞানের সম্পদ
দান করা হয়েছিল তারা বলবে, তোমরা তো আল্লাহর লিখিত বিধানে হাশরের দিন পর্যন্ত অবস্থান
করেছো, কাজেই এটিই
সেই হাশরের দিন কিন্তু তোমরা জানতে না।
﴿فَيَوْمَئِذٍ لَّا
يَنفَعُ الَّذِينَ ظَلَمُوا مَعْذِرَتُهُمْ وَلَا هُمْ يُسْتَعْتَبُونَ﴾
৫৭) কাজেই সেদিন জালেমদের কোন ওজর-আপত্তি
কাজে লাগবে না এবং তাদেরকে ক্ষমা চাইতেও বলা হবে না।৮৩
৮৩. এর অন্য অনুবাদ এও হতে পারে যে, তাদের
কাছে চাওয়া হবে না যে, তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করো”কারণ তাওবা, ঈমান
ও সৎকাজের দিকে ফিরে আসার সকল সুযোগই তারা হারিয়ে বসবে এবং পরীক্ষার সময় পার হয়ে
গিয়ে এখনি ফল প্রকাশের সময় সমাগত হবে।
﴿وَلَقَدْ
ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ ۚ وَلَئِن جِئْتَهُم
بِآيَةٍ لَّيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ أَنتُمْ إِلَّا مُبْطِلُونَ﴾
৫৮) আমি এ কুরআনে বিভিন্নভাবে লোকদেরকে
বুঝিয়েছি। তুমি যে কোন নিদর্শনই আনো না কেন, অবিশ্বাসীরা একথাই বলবে, তোমরা মিথ্যাশ্রয়ী।
﴿كَذَٰلِكَ يَطْبَعُ
اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৫৯) এভাবে যারা জ্ঞানহীন তাদের অন্তরে
আল্লাহ মোহর মেরে দেন।
﴿فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ
اللَّهِ حَقٌّ ۖ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِينَ لَا يُوقِنُونَ﴾
৬০) কাজেই ( হে নবী!) সবর করো, অবশ্যই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি
সত্য৮৪ এবং যারা
বিশ্বাস করে না তারা যেন কখনোই তোমাকে গুরুত্বহীন মনে না করে।৮৫
৮৪. ওপরের ৪৭ নং আয়াতে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেদিকেই
ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে মহান আল্লাহ নিজের এ
নিয়ম বর্ণনা করেছেন যে, যারাই আল্লাহর রসূলদের নিয়ে আসা এসব সুস্পষ্ট
নিদর্শনের মোকাবিলা করেছে মিথ্যাচার,
হাসি-তামাসা
ও হঠকারিতাঁর মাধ্যমে আল্লাহ অবশ্যই এ ধরনের অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন।
فَانتَقَمْنَا مِنَ
الَّذِينَ أَجْرَمُوا আর আল্লাহ মুমিনদের সাহায্য করবেন এটা তাঁর ওপর মু'মিনদের
অধিকার وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ
৮৫. অর্থাৎ শত্রুরা যেন তোমাদের এতই দুর্বল না পায় যে, তাদের হৈ চৈ ও শোরগোলে তোমরা
দমিত হবে অথবা তাদের মিথ্যাচার ও দোষারোপ করার অভিযান দেখে তোমরা ভীত হয়ে যাও
কিংবা হাসি-তামাসা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ হয়ে তোমরা হিম্মত হারিয়ে ফেলো অথবা
তাদের হুমকি-ধমকি ও শক্তির প্রকাশে এবং জুলুম নির্যাতনে তোমরা ভীত হয়ে যাও কিংবা
তাদের ফেলা লালসার টোপে তোমরা আটকা পড়ে যাও অথবা জাতীয় স্বার্থের নামে তারা
তোমাদের কাছে যে আবেদন জানাচ্ছে তাঁর ভিত্তিতে তোমরা তাদের সাথে সমঝোতা করে নিতে
উদ্যত হও৷ এর পরিবর্তে তারা তোমাকে নিজেদের উদ্দেশ্য সচেতনতায় এত বেশি সতর্ক এবং
নিজেদের বিশ্বাস ও ঈমানে এত বেশি পাকাপোক্ত এবং এ সংকল্পে এত বেশি দৃঢ়চেতা এবং
নিজেদের চরিত্রে এতবেশি মজবুত পাবে যে, কোন ভয়ে তোমাদের ভীত
করা যাবে না, কোন মূল্যে তোমাদের কেনা যাবে না, কোন প্রতারণার জালে তোমাদের আবদ্ধ করা যাবে না, কোন
ক্ষতি, কষ্ট বা বিপদে ফেলে তোমাদেরকে পথ থেকে সরানো যাবে না
এবং দীনের ব্যাপারে কোন প্রকার আপোষ বা লেনদেনের কারবারও তোমাদের সাথে করা যেতে
পারে না৷ "অবিশ্বাসীরা যেন তোমাকে গুরুত্বহীন মনে না করে"-আল্লাহর এ
ছোট্ট একটি বাণীর আলংকারিক বাক্য-বিন্যাসের মধ্যেই এ সমস্ত বিষয়বস্তুলুকিয়ে রাখা
হয়েছে৷ আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে যেমন শক্তিশালী ও গুরুত্ববহ দেখতে চাচ্ছিলেন তিনি
ঠিক তেমনটি হতে পেরেছিলেন কিনা এখন ইতিহাসই তা প্রমাণ করবে৷ তাঁর সাথে যে ব্যক্তিই
যে ময়দানে শক্তি পরীক্ষা করেছে সেই ময়দানেই সে হেরে গেছে৷ শেষ পর্যন্ত এ মহান
ব্যক্তিত্ব এমন বিপ্লব সৃষ্টি করেন যার পথরোধ করার জন্য আরবের কাফের ও মুশরিক সমাজ
তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ ও সমস্ত কলা-কৌশল প্রয়োগ করেও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে৷
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।