০০৯. সূরা আত তওবা
আয়াতঃ ১২৯; রুকুঃ ১৬; মাদানী
ভূমিকা
নামকরণঃ
এ সূরাটি দু'টি নামে পরিচিতঃ আত্ তাওবাহ ও আল বারাআতু।
তাওবা নামকরণের কারণ, এ সূরার এক জায়গায় কতিপয় ঈমানদারের গোনাহ মাফ
করার কথা বলা হয়েছে । আর এর শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করা
হয়েছে বলে একে বারাআত (অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছেদ) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বিসমিল্লাহ না লেখার কারণঃ
এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লেখা হয় না। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন
কারণ বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মতভেদ ঘটেছে। তবে এ প্রসংগে ইমাম রাযীর
বক্তব্যই সঠিক। তিনি লিখেছেন, নবী সা. নিজেই এর শুরুতে
বিসমিল্লাহ লেখাননি, কাজেই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তী
লোকেরাও এ রীতির অনুসরণ অব্যাহত রেখেছেন। পবিত্র কুরআন যে নবী সা. থেকে হুবহু ও
সামান্যতম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেভাবে তিনি দিয়েছিলেন
ঠিক সেভাবেই তাকে সংরক্ষণ করার জন্য যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, এটি
তার আর একটি প্রমাণ।
নাযিলের সময়কাল ও সূরার অংশসমূহঃ
এ সূরাটি তিনটি ভাষণের সমষ্টি । প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম
রুকূর শেষ অবধি চলেছে। এর নাযিলের সময় হচ্ছে ৯ হিজরীর যিলকাদ মাস বা তার কাছাকাছি
সময়। নবী সা. সে বছর হযরত আবু বকরকে রা. আমীরুল হজ্জ নিযুক্ত করে মক্কায় রওয়ানা
করে দিয়েছিলেন। এমন সময় এ ভাষণটি নাযিল হয়। তিনি সংগে সংগেই হযরত আলীকে রা. তার
পিছে পিছে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে হজ্জের সময় সারা আরবের প্রতিনিধিত্বশীল
সমাবেশে তা শুনানো হয় এবং সে অনুযায়ী যে কর্মপদ্ধতি হয়েছিল তা ঘোষনা করা যায়।
দ্বিতীয় ভাষণটি ৬ রুকূর শুরু থেকে ৯ রুকূর শেষ পর্যন্ত চলেছে। এটি ৯ হিজরীর
রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাযিল হয়। সে সময় নবী সা. তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন। এখানে মুমিনদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । আর যারা মুনাফিকী বা
দুর্বল ঈমান অথবা কুড়েমি ও অলসতার কারণে আল্লাহর পথে ধন-প্রাণের ক্ষতি বরদাশত করার
ব্যাপারে টালবাহানা করছিল তাদেরকে কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করা হয়েছে।
তৃতীয় ভাষণটি ১০ রুকু থেকে শুরু হয়ে সুরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। তাবুক যুদ্ধ
থেকে ফিরে আসার পর এ অংশটি নাযিল হয়। এর মধ্যে এমনও অনেকগুলো খণ্ডিত অংশ রয়েছে
যেগুলো ঐ দিনগুলোতে বিভিন্ন পরিবেশে নাযিল হয় এবং পরে নবী সা. আল্লাহর ইংগিতে
সেগুলো সব একত্র করে একই ধারাবাহিক ভাষণের সাথে সংযুক্ত করে দেন। কিন্তু যেহেতু
সেগুলো একই বিষয়বস্তু ও একই ঘটনাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট তাই ভাষণের ধারাবাহিকতা
কোথাও ব্যাহত হতে দেখা যায় না। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী
উচ্চারণ করা হয়েছে। তাবুক যুদ্ধে যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকে ভৎর্সনা ও
তিরস্কার করা হয়েছে। আর যে সাচ্চা ঈমানদার লোকেরা নিজেদের ঈমানের ব্যাপারে
নিষ্ঠাবান ছিলেন ঠিকই কিন্তু আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন
তিরস্কার করার সাথে সাথে তাদের ক্ষমার কথাও ঘোষনা করা হয়েছে।
আয়াতগুলো যে পর্যায়ক্রমিক ধারায় নাযিল হয়েছে তার প্রোক্ষিতে প্রথম ভাষণটি
সবশেষে বসানো উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়বস্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে সেটিই ছিল সবার আগে।
এ জন্য কিতাব আকারে সাজাবার ক্ষেত্রে নবী সা. তাকে প্রথমে রাখেন এবং অন্য ভাষণ
দুটিকে তার পরে রাখেন।
ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
নাযিলের সময়-কাল নির্ধারিত হবার পর এ সূরার ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর একটু দৃষ্টি
দেয়া প্রয়োজন। এ সুরার বিষয়বস্তুর সাথে যে ঘটনা পরম্পরার সম্পর্ক রয়েছে, তার
সূত্রপাত ঘটেছে হোদাইবিয়ার সন্ধি থেকে। হোদাইবিয়া পর্যন্ত ছ' বছরের
অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফলে আরবের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকায় ইসলাম
একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম,
একটি
পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে
পরিণত হয়ে গিয়েছিল। হোদায়বিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এ ধর্ম বা দীন আরো
বেশী নিরাপদ ও নির্ঝঞ্চাট পরিবেশে চারদিকে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে যায়।১ এরপর ঘটনার গতিধারা দু’টি
বড় বড় খাতে প্রবাহিত হয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে ঐ দু’টি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ফলাফল সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটির সম্পর্ক ছিল আরবের সাথে এবং অন্যটির রোম
সাম্রাজ্যের সাথে।
টীকাঃ ১ বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা মায়েদা ও সূরা ফাতাহ এর ভূমিকা।
আরব বিজয়ঃ
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর আরবে ইসলামের প্রচার,
প্রসারের
জন্য এবং ইসলামী শক্তি সুসংহত করার জন্য যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তার ফলে
মাত্র দু'বছরের মধ্যেই ইসলামের প্রভাব বলয় এত বেড়ে যায়
এবং তার শক্তি এতটা পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী হয়ে ওঠে যে, পুরাতন
জাহেলিয়াত তার মোকাবিলায় অসহায় ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে কুরাইশদের অতি উৎসাহী
লোকেরা নিজেদের পরাজয় আসন্ন দেখে আর সংযত থাকতে পারেনি। তারা হোদায়বিয়ার সন্ধি
ভঙ্গ করে। এ সন্ধির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে একটা চূড়ান্ত
যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু এ চুক্তি ভংগের পর নবী সা. তাদেরকে আর গুছিয়ে নেবার
কোন সুযোগ দেননি। তিনি ৮ হিজরীর রমযান মাসে আকম্মিকভাবে মক্কা আক্রমণ করে তা দখল
করে নেন।১ এরপর
প্রাচীন জাহেলী শক্তি, হোনায়েনের ময়দানে তাদের শেষ মরণকামড় দিতে
চেষ্টা করে। সেখানে হাওয়াযিন, সাকীফ, নদর, জুসাম,
এবং
অন্যান্য কতিপয় জাহেলিয়াতপন্থী গোত্র তাদের পূর্ণ শক্তির সমাবেশ ঘটায়। এভাবে তারা
মক্কা বিজয়ের পর যে সংস্কারমূলক বিপ্লবটি পূর্ণতার পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল তার পথ
রোধ করতে চাচ্ছিল । কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা ও ব্যর্থ হয়। হোনায়েন যুদ্ধে তাদের
পরাজয়ের সাথে সাথেই আরবের ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যায়। আর এ ফায়সালা হচ্ছে, আরবকে
এখন দারুল ইসলাম হিসেবেই টিকে থাকতে হবে। এ ঘটনার পর পুরো এক বছর যেতে না যেতেই
আরবের বেশীর ভাগ এলাকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে। এ অবস্থায় জাহেলী ব্যবস্থার
শুধুমাত্র কতিপয় বিচ্ছিন্ন লোক দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। উত্তরে
রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে সে সময় যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল তা ইসলামের এ সম্প্রসারণ ও
বিজয়কে পূর্ণতায় পৌঁছুতে আরো বেশী করে সাহায্য করে। সেখানে নবী সা. যে
দুঃসাহসিকতার সাথে ৩০ হাজারের বিরাট বাহিনী নিয়ে যান এবং রোমীয়রা যেভাবে তাঁর
মুখোমুখি হবার ঝুকি না নিয়ে পিঠটান দিয়ে নিজেদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায় তাতে সারা
আরবে তাঁর ও তাঁর দীনের অপ্রতিরোধ্য প্রতাপ ও অজেয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এর ফলশ্রুতিতে তাবুক থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই তার কাছে একের পর এক প্রতিনিধি দল
আসতে থাকে আরবের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাঁর
বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকার করে।২ এ অবস্থাটিকেই কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ، وَرَأَيْتَ النَّاسَ
يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا.
"যখন আল্লাহর সাহায্য এসে
গেলো ও বিজয় লাভ হলো এবং তুমি দেখলে লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে।"
টীকাঃ ১ সূরা আনফালের ৪৩ টীকা দেখুন।
টীকাঃ ২ মুহাদ্দিসগণ এ প্রসংগে যেসব গোত্র, সরদার, আমীর ও বাদশাহদের প্রতিনিধি দলের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের সংখ্যা ৭০ পর্যন্ত পৌঁছে। এরা আরবের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম সব এলাকা থেকেই এসেছিল।
তাবুক যুদ্ধকালীন অবস্থায় আরবের চিত্র
তাবুক অভিযানঃ
মক্কা বিজয়ের আগেই রোম সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হোদাইবিয়ার
সন্ধির পর নবী সা. ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অংশে যেসব
প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি দল গিয়েছিল উত্তর দিকে সিরিয়া সীমান্তের
লাগোয়া গোত্রগুলোর মধ্য। তাদের বেশীর ভাগ ছিল খৃষ্টান এবং রোম সাম্রাজ্যের
প্রভাবাধীন। তারা “যাতুত তালাহ” (অথবা
যাতু-আতলাহ) নামক স্থানে ১৫ জন মুসলমানকে হত্যা করে। কেবলমাত্র প্রতিনিধি দলের
নেতা হযরত কাব ইবনে উমাইর গিফারী প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। একই সময়ে নবী
সা. বুসরার গবর্ণর শুরাহবিল ইবনে আমরের নামেও দাওয়াত নামা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেও
তাঁর দূত হারেস ইবনে উমাইরকে হত্যা করে। এ সরদারও ছিল খৃষ্টান। এবং সরাসরি রোমের
কাইসারের হুকুমের আনুগত। এসব কারণে নবী সা. ৮ হিজরীর জমাদিউল উলা মাসে তিন হাজার
মুজাহিদদের একটি সেনাবাহিনী সিরিয়া সীমান্তের দিকে পাঠান। ভবিষ্যতে এ এলাকাটি যাতে
মুসলমানদের জন্য নিরাপদ হয়ে যায় এবং এখানকার লোকেরা মুসলমানদেরকে দুর্বল মনে করে
তাদের ওপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করার সাহস না করে,
এই
ছিল তার উদ্দেশ্য । এ সেনাদলটি মা’আন নামক স্থানের কাছে পৌছার পর জানা যায়
শুরাহবীল ইবনে আমর এক লাখ সেনার একটি বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের মোকাবিলায় আসছে।
ওদিকে রোমের কাইসার হিমস নামক স্থানে সশরীরে উপস্থিত। তিনি নিজের ভাই থিয়েডরের
নেতৃত্বে আরো এক লাখের একটি সেনাবাহিনী রওয়ানা করে দেন। কিন্তু এসব আতংকজনক
খবরাখবর পাওয়ার পরও তিন হাজারের এ প্রাণোৎসর্গী ছোট্ট মুজাহিদ বাহিনীটি অগ্রসর
হতেই থাকে। অবশেষে তারা মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখের বিরাট বাহিনীর সাথে
সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ অসম সাহসিকতা দেখানোর ফলে মুসলিম মুজাহিদদের পিষ্ট হয়ে চিঁড়ে
চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সারা আরব দেশ এবং সমগ্র মধ্য প্রাচ্য
বিষ্ময়ে স্বম্ভিত হয়ে দেখলো যে, এক ও তেত্রিশের এ
মোকাবিলায়ও কাফেররা মুসলমানদের ওপর বিজয়ী হতে পারলো না। এ জিনিসটিই সিরিয়া ও তার
সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী আধা স্বাধীন আরব গোত্রগুলোকে এমনকি ইরাকের নিকটবর্তী
এলাকায় বসবাসকারী পারস্য সম্রাটের প্রভাবাধিন নজদী গোত্রগুলোকেও ইসলামের দিকে
আকৃষ্ট করে। তাদের হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করে। বনী সুলাইম (আব্বাস ইবনে
মিরদাস সুলামী ছিলেন তাদের সরদার) আশজা,
গাতফান, যুবইয়ান
ও ফাযারাহ গোত্রের লোকেরা এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করে। এ সময়ই রোম সাম্রাজ্যের
আরবীয় সৈন্য দলের একজন সেনাপতি ফারওয়া ইবনে আমর আলজুযামী মুসলমান হন। তিনি নিজের
ঈমানের এমন অকাট্য প্রমাণ পেশ করেন, যা দেখে আশেপাশের সব এলাকার লোকেরা বিস্ময়ে
হতচকিত হয়ে পড়ে। ফারওয়ার ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে কাইসার তাকে গ্রেফতার করিয়ে নিজের
দরবারে আনেন। তাঁকে দু’টি জিনিসের মধ্যে যে কোন একটি নির্বাচন করার ইখতিয়ার দেন।
তাকে বলেন ইসলাম ত্যাগ করো। তাহলে তোমাকে শুধু মুক্তিই দেয়া হবে না বরং আগের
পদমর্যাদাও বহাল করে দেয়া হবে। অথবা মুসলমান থোকো। কিন্তু এর ফলে তোমাকে
মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তিনি ধীর স্থিরভাবে চিন্তা করে ইসালামকে নির্বাচিত করেন এবং
সত্যের পথে প্রাণ বিসর্জন দেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কাইসার তার সাম্রাজ্যের
বিরুদ্ধে উদ্ভুত এক ভয়াবহ হুমকির স্বরূপ উপলব্ধি করেন, যা
আরবের মাটিতে সৃষ্ট হয়ে তার সাম্রাজ্যের দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল।
পরের বছর কাইসার মুসলমানদের মুতা যুদ্ধের শাস্তি দেবার জন্য সিরিয়া সীমান্তে
সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দেন। তার অধীনে গাসসানী ও অন্যন্য আরব সরদাররা সৈন্য
সমাবেশ করতে থাকে । নবী সা. এ ব্যাপারে বেখবর ছিলেন না। একেবারেই নগণ্য ও তুচ্ছ
যেসব ব্যাপার ইসলামী আন্দোলনের ওপর সামন্যমতও অনুকূল বা প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার
করে থাকে, তার
প্রত্যেকেটি সম্পর্কে তিনি সর্বক্ষণ সচেতন ও সতর্ক থাকতেন। এ প্রস্তুতিগুলোর অর্থ
তিনি সংগে সংগেই বুঝে ফেলেন। কোন প্রকার ইতস্তত না করেই কাইসারের বিশাল বিপুল
শক্তির সাথে তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ফায়সালা করে ফেলেন। এ সময় সামান্যতম ও
দুর্বলতা দেখানো হলে এতদিনকার সমস্ত মেহনত ও কাজ বরবাদ হয়ে যেতো। একদিকে
হোনায়েনে আরবের যে ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষ জাহেলিয়াতের বুকে সর্বশেষ আঘাত হানা
হয়েছিল তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো এবং অন্যদিকে মদীনার যে মুনাফীকরা আবু আমের
রাহেবের মধ্যস্থতায় গাসসানের খ্রীস্টান বাদশাহ এবং স্বয়ং কাইসারের সাথে গোপন
যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছিল। উপরন্তু যারা নিজেদের দুস্কর্মের ওপর দীনদারীর প্রলেপ
লাগাবার জন্য মদীনার সংলগ্ন এলাকায় “মসজিদে দ্বিরার” (ইসলামী মিল্লাতকে
ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে তৈরী মসজিদ) নির্মাণ করেছিল, তারা
পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতো। সামনের দিক থেকে কাইসার আক্রমণ করতে আসছিল। ইরানীদের
পরাজিত করার পর দূরের ও কাছের সব এলাকায় তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও দাপট ছড়িয়ে
পড়েছিল। এ তিনটি ভয়ংকর বিপদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইসলামের অর্জিত বিজয় অকস্মাত
পরাজয়ে রূপান্তিত হয়ে যেতে পারতো। তাই,
যদিও
দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল, আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম, ফসল
পাকার সময় কাছে এসে গিয়েছিল, সওয়ারী ও সাজ,
সরঞ্জামের
ব্যবস্থা করা বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল। অর্থের অভাব ছিল প্রকট এবং দুনিয়ার দু'টি
বৃহত্তম শক্তির একটির মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তবুও আল্লাহর নবী এটাকে সত্যের
দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা করার সময় মনে করে এ অবস্থায়ই যুদ্ধ প্রস্তুতির
সাধারণ ঘোষণা জারি করে দেন। এর আগের সমস্ত যুদ্ধে নবী সা. এর নিয়ম ছিল, শেষ
মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কাউকে বলতেন না কোনদিকে যাবেন এবং কার সাথে মোকাবিলা করতে
হবে। বরং তিনি মদীনা থেকে বের
হবার পরও অভীষ্ট মনযিলের দিকে যাবার সোজা পথ না ধরে তিনি অন্য বাঁকা পথ ধরতেন।
কিন্তু এবার তিনি এ আবরণটুকু ও রাখলেন না। এবার পরিস্কার বলে দিলেন যে, রোমের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং সিরিয়ার দিকে যেতে হবে।
এ সময়টি যে অত্যন্ত নাজুক ছিল তা আরবের সবাই অনুভব করছিল। প্রাচীন জাহেলিয়াতের
প্রেমিকদের মধ্যে যারা তখনো বেঁচে ছিল তাদের জন্য এটি ছিল শেষ আশার আলো। রোম ও
ইসলামের এ সংঘাতের ফলাফল কি দাঁড়ায় সে দিকেই তারা অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবন্ধ করে
রেখেছিল। কারণ তারা নিজেরাও জানতো,
এরপর
আর কোথাও কোন দিক থেকেই আশার সমান্যতম ঝলকও দেখা দেবার কোন সম্ভবনা নেই।
মুনাফিকেরাও এরি পেছনে তাদের শেষ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল । তারা নিজেদের মসজিদে
দ্বিরার বানিয়ে নিয়েছিল। এরপর অপেক্ষা করছিল সিরিয়ার যুদ্ধে ইসলামের ভাগ্য বিপর্যয়
ঘটা মাত্রই তারা দেশের ভেতরে গোমরাহী ও অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এখানেই শেষ
নয়, বরং তারা তাবুকের এ অভিযানকে ব্যর্থ করার জন্য সম্ভাব্য সব
রকমের কৌশলও অবলম্বন করে। এদিকে নিষ্ঠাবান মুসলমানরাও পুরোপুরি অনুভব করতে
পেরেছিলেন, যে আন্দোলনের জন্য বিগত ২২বছর ধরে তারা
প্রাণপাত করে এসেছেন বর্তমানে তার ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হবার সময় এসে পড়েছে। এ
সময় সাহস দেখাবার অর্থ দাঁড়ায়, সারা দুনিয়ার ওপর এ
আন্দোলনের দরজা খুলে যাবে অন্যদিকে এ সময় দুবর্লতা দেখাবার অর্থ দাড়ায় খোদ আরব
দেশেও একে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হবে। কাজেই এ অনুভূতি সহকারে সত্যের নিবেদিত প্রাণ
সিপাহীরা চরম উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যুদ্ধের সাজ
সরঞ্জাম যোগাড় করার ব্যাপারে প্রত্যেকেই নিজের সামর্থের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে
অংশগ্রহণ করেন। হযরত উসমান রা. ও হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. বিপুল অর্থ দান
করেন। হযরত উমর রা. তার সারা জীবনের উপার্জনের অর্ধেক এনে রেখে দেন। হযরত আবু বকর রা.
তার সঞ্চিত সম্পদের সবটাই নবী সা. এর সামনে পেশ করেন। গরীব সাহাবীরা মেহনত মজদুরী
করে যা কামাই করতে পেরেছিলেন তার সবটুকু উৎসর্গ করেন। মেয়েরা নিজেদের গহনা খুলে
নযরানা পেশ করেন। চারদিক থেকে দলে দলে আসতে থাকে প্রাণ উৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবকদের
বাহিনী। তারা আবেদন জানান, বাহন ও অস্ত্র শস্ত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমরা
প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যারা সওয়ারী পেতেন না তারা কাঁদতে থাকতেন। তারা এমনভাবে
নিজেদের আন্তরিকতা মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকতেন যার ফলে রাসূলে পাকের হৃদয়
ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো,এ ঘটনাটি কার্যত মুমিন ও মুনাফিক চিহ্নিতকরার একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়ে
গিয়েছিল । এমনকি এ সময় কোন ব্যক্তি পেছনে থেকে যাওয়ার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, ইসলামের
তার সম্পর্কের দাবী সত্য কিনা সেটাই সন্দেহজনক হয়ে পড়তো। কাজেই তাবুকের পথে
যাওয়ার সময় সফরের মধ্যে যেসব ব্যক্তি পেছনে থেকে যেতো সহাবায়ে কেরাম নবী সা. এর
নিকট তাদের খবর পৌছিয়ে দিতেন। এর জবাবে তিনি সংগে সংগেই স্বতস্ফূর্তভাবে বলে
ফেলতেনঃ
دَعُوهُ، فإِنْ يَكُ فِيهِ خَيْرٌ فَسَيُلْحِقُهُ اللهُ بِكُمْ، وَإِنْ
يَكُ غَيْرَ ذَلِكَ فَقَدْ أَرَاحَكُمُ اللهُ مِنْهُ
“যেতে দাও,
যদি
তার মধ্যে ভালো কিছু থেকে থাকে,তাহলে আল্লাহ তাকে আবার
তোমাদের সাথে মিলিয়ে দেবেন। আর যদি অন্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকে,তাহলে
শোকর করো যে,আল্লাহ তার ভণ্ডামীপূর্ণ সাহচর্য থেকে তোমাদের
বাঁচিয়েছেন”।
৯ হিজরীর রজব মাসে নবী সা. ৩০ হাজারের মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার পথে রওয়ানা
হন। তাঁর সাথে ছিল দশ হাজার সওয়ার। উটের সংখ্যা এত কম ছিল যে, এক
একটি উটের পিঠে কয়েক জন পালাক্রমে সওয়ার হতেন। এর ওপর ছিল আবার গ্রীষ্মের
প্রচণ্ডতা। পানির স্বল্পতা সৃষ্টি করেছিল আরো এক বাড়তি সমস্যা। কিন্তু এ নাজুক
সময়ে মুসলমানরা যে সাচ্চা ও দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেন তার ফল তারা তাবুকে পৌছে পেয়ে
যান। সেখানে পৌছে তারা জানতে পারেন,
কাইসার
ও তার অধিনস্থ সম্মুখ যুদ্ধ অবতীর্ণ হবার পরিবর্তে নিজেদের সেনা বাহিনী সীমান্ত
থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এখন এ সীমান্তে আর কোন দুশমন নেই। কাজেই এখানে যুদ্ধেরও
প্রয়োজন নেই। সীরাত রচয়িতারা এ ঘটনাটিকে সাধারণত এমনভাবে লিখে গেছেন যাতে মনে হবে
যেন সিরিয়া সীমান্তে রোমীয় সৈন্যদের সমাবেশ সম্পর্কে যে খবর রসূলুল্লাহ সা. এর
কাছে পৌছে তা আদতে ভুলই ছিল। অথচ আসল ঘটনা এই যে, কাইসার
সৈন্য সমাবেশ ঠিকই শুরু করেছিল। কিন্তু তার প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই যখন
রসূলুল্লাহ সা. মোকাবিলা করার জন্য পৌছে যান তখন সে সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে
নেয়া ছাড়া আর কোন পথ দেখেনি। মুতার যুদ্ধে এক লাখের সাথে ৩ হাজারের মোকাবিলার যে
দৃশ্য সে দেখেছিল তারপর খোদ নবী করীমের সা. নেতৃত্বে ৩০ হাজারের যে বাহিনী এগিয়ে
আসছিল সেখানে লাখ দুলাখ সৈন্য মাঠে নামিয়ে তার সাথে মোকাবিলা করার হিম্মাত তার
ছিল না।
কাইসারের এভাবে পিছু হটে যাওয়ার ফলে যে নৈতিক বিজয় লাভ হলো, এ
পর্যায়ে নবী সা. তাকে যথেষ্ট মনে করেন। তিনি তাবুক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে
সিরিয়া সীমান্তে প্রবেশ করার পরিবর্তে এ বিজয় থেকে যত দুর সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক
ফায়দা হাসিল করাকেই অগ্রাধিকার দেন্ সে জন্যেই তিনি তাবুকে ২০ দিন অব্স্থান করে
রোম সাম্রাজ্য ও দারুল ইসলামের মধ্যবর্তী এলাকায় যে বহু সংখ্যক ছোট ছোট রাজ্য
এতদিন রোমানদের প্রভাবাধীনে ছিল । সামরিক চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে ইসলামী
সাম্রাজ্যের অনুগত করদ রাজ্যে পরিণত করেন। এভাবে দুমাতুল জানদালের খৃষ্টান শাসক
উকাইদির ইবনে আবদুল মালিক কিনদী,আইলার খৃষ্টান শাসক ইউহান্না
ইবনে রুবাহ এবং অনুরূপ মাকনা, জারবা,
ও
আযরূহের খৃষ্টান শাসকরাও জিযিয়া দিয়ে মদীনার বশ্যতা স্বীকার করে। এর ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যের
সীমানা সরাসরি রোম সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। রোম সম্রাটরা
যেসব আরব গোত্রকে এ পর্যন্ত আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছিল এখন বেশীর ভাগই
রোমানদের মোকাবিলায় মুসলমানদের সহযোগী হয়ে গেল। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সাথে
একটি দীর্ঘ মেয়াদী সংঘর্ষে লিপ্ত হবার আগে ইসলাম সমগ্র আরবের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন
ও বাঁধন মজবুত করে নেবার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়।এটাই হয় এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড়
লাভ। এতদিন পর্যন্ত যারা প্রকাশ্যে মুশরিকদের দলভুক্ত থেকে অথবা মুসলমানদের দলে
যোগদান করে পরদার অন্তরালে মুনাফিক হিসেবে অবস্থান করে প্রাচীন জাহেলিয়াতের
পুনর্বহালের আশায় দিন গুণছিল তাবুকের এ বিনা যুদ্ধে বিজয় লাভের ঘটনা তাদের কোমর
ভেংগে দেয়। এ সর্বশেষ ও চুড়ান্ত হতাশার ফলে তাদের অধিকাংশের জন্য ইসলামের কোলে
আশ্রয় নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর যদি বা তাদের নিজেদের ইসলামের নিয়ামতলাভের
সুযোগ নাও থেকে থাকে, তবে কমপক্ষে তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য
সম্পর্ণরূপে ইসলামের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। এরপর
একটি নামমাত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তাদের শিরক ও জাহেলী কার্যক্রমে অবিচল থাকে ।
কিন্তু তারা এত বেশী হীনবল হয়ে পড়ে যে,
ইসলামের
যে সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য আল্লাহ তাঁর নবীকে পাঠিয়েছিলেন তার পূর্ণতা সাধনের
পথে তারা সামান্যতমও বাধা সৃষ্টি করতে সমর্থ ছিল না।
আলোচ্য বিষয় ও সমস্যাবলীঃ
এ পটভূমি সামনে রেখে আমরা সে সময় যেসব বড় বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং সূরা
তাওবায় যেগুলো আলোচিত হয়েছে, সেগুলো সহজেই চিহ্নিত করতে
পারি। সেগুলো হচ্ছে।
১। এখন যেহেতূ সমগ্র আরবের শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে মুমিনেদের হাতে এসে
গিয়েছিল এবং সমস্ত প্রতিবন্ধক শক্তি নির্জীব ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল,
তাই
আরবদেশকে পূর্নাঙ্গ দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য যে নীতি অবলম্বন করা অপরিহার্য
ছিল তা সুষ্পষ্টভাবে বিবৃত করতে আর বিলম্ব করা চলে না ।তাই নিম্নোক্ত আকারে তা
পেশ করা হয়ঃ
ক) আরব থেকে শিরককে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে হবে। প্রাচীন মুশরিকী ব্যবস্থাকে
পুরোপুরি খতম করে ফেলতে হবে। ইসলামের কেন্দ্র যেন চিরকালের জন্য নির্ভেজাল ইসলামী
কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য কোন অনৈসলামী
উপাদান যেন সেখানকার ইসলামী মেজায ও প্রকৃতিতে অনুপ্রবেশ করতে এবং কোন বিপদের সময়
আভ্যন্তরীন ফিতনার কারণ হতে না পারে। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকদের সাথে সব রকমের সম্পর্ক
ছিন্ন করার এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাতিল করার কথা ঘোষণা করা হয়।
খ) কাবা ঘরের ব্যবস্থাপনা মুমিনদের হাতে এসে যাবার পর, একান্তভাবে
আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য উৎসর্গীত সেই ঘরটিতে আবারো আগের মত মূর্তিপূজা হতে
থাকবে এবং তার পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষতার দায়িত্ব এখনো মুশরিকদের হাতে বহাল থাকবে
এটা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। তাই হুকুম দেয়া হয়ঃ আগামীতে কাবা ঘরের পরিচালনা
ও অভিভাবকত্বের দায়িত্বেও তাওহীদদের হাতেই ন্যস্ত থাকা চাই।আর এ সংগে বায়তুল্লাহর
চতুসীমানর মধ্যে শিরক ও জাহেলিয়াতের যাবতীয় রসম-রেওয়াজ বল প্রয়োগে বন্ধ করে দিতে
হবে। বরং এখন থেকে মুশরিকরা আর এ ঘরের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে পারবে না। তাওহীদদের
মহান অগ্রনী পুরুষ ইবরাহীমের হাতে গড়া এ গৃহটি আর শিরক দ্বারা কলুষিত হতে না পারে
তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
গ) আরবের সাংস্কৃতিক জীবনে জাহেলী রসম-রেওয়াজের যেসব চিহ্ন এখনো অক্ষুন্ন ছিল
নতুন ইসলামী যুগে সেগুলোর প্রচলন থাকা কোনক্রমেই সমিচীন ছিল না। তাই সেগুলো
নিশ্চিহ্ন করার প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে। নাসী (ইচ্ছাকৃতভাবে হারাম মাসকে
হালাল ও হালাল মাসকে হারাম নির্দিষ্ট করে নেয়া) র নিয়মটা ছিল সবচেয়ে খারাপ প্রথা।
তাই তার ওপরে সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। এ আঘাতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের অন্যান্য
নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে মুসলমানদের করনীয় কী। তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
২। আরবের ইসলাম প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম পূর্ণতায় পৌছে যাবার পর সামনে যে দ্বিতীয়
গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টি ছিল সেটি হলো,
আরবের
বাইরে আল্লাহর সত্য দীনের প্রভাব-বলয় বিস্তৃত করা। এ পথে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক
শক্তি ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আরবের কার্যক্রম শেষ হবার পরই তার সাথে সংঘর্ষ
বাধা ছিল অনিবার্য। তাছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাগুলোর সাথেও এমনি ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হওয়া ছিল
স্বাভাবিক। তাই মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া
হয়, আরবের বাইরে যারা সত্য দীনের অনুসারী নয়, তারা
ইসলামী কর্তৃত্বের প্রতি বশ্যত ও আনুগত্যের স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত শক্তি
প্রয়োগ করে তাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসন কর্তৃত্ব খতম করে দাও। অবশ্য আল্লাহর
সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপরটি তাদের ইচ্ছাধীন। তারা চাইলে ইমান আনতে পারে, চাইলে
নাও আনতে পারে। কিন্তু আল্লাহর যমীনে নিজেদের হুকুম জারি করার এবং মানব সমাজের
কর্তৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থা নিজেদের হাতে রেখে মানুষের ওপর এবং তাদের ভবিষ্যত
বংশধরদের ওপর নিজেদের গোমরাহীসমূহ জোরপূর্বক চাপিলে দেবার কোন অধিকার তাদের
নেই। বড় জোর তাদের কে একটুকু স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে যে, তারা
নিজেরা চাইলে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু সে জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদের
জিযিয়া আদায় করে ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের অধীন থাকতে হবে।
৩। মুনাফিক সংক্রন্ত বিষয়টি ছিল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয়। সাময়িক বৃহত্তর
স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তাদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত উপেক্ষাও এড়িয়ে যাবার নীতি
অবলম্বন করা হচ্ছিল। এখন যেহেতু বাইরের বিপদের চাপ কম গিয়েছিল বরং একেবারে ছিলই না
বললে চলে, তাই হুকুম দেয়া হয়, আগামীতে
তাদের সাথে আর নরম ব্যবহার করা যাবে না। প্রকাশ্য সত্য অস্বীকারকারীদের সাথে যেমন
কঠোর ব্যাবহার করা হয় তেমনি কঠোর ব্যবহার গোপন সত্য অস্বীকারকারীদের সাথেও করা
হবে।এ নীতি অনুযায়ী নবী সা. তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পূর্বে সুওয়াইলিমের গৃহে আগুন
লাগান্ সেখানে মুনাফিকদের একটি দল মুসলমানদেরকে যুদ্ধে যোগদান করা থেকে বিরত
রাখার উদ্দেশ্যে প্রচারাভিযান চালাবার জন্য জামায়েত হতো। আবার এ নীতি অনুযায়ী নবী
সা. তাবুক থেকে ফিরে আসার পর সর্বপ্রথম মসজিদে দ্বিরার ভেংগে ফেলার ও জ্বালীয়ে
দেবার হুকুম দেন।
৪। নিষ্ঠাবান মুমিনদের কতকের মধ্যে এখনো পর্যন্ত যে সামান্য কিছু সংকল্পের
দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল তার চিকিৎসারও প্রয়োজন ছিল। কারণ ইসলাম এখন আন্তর্জাতিক
প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চলেছে। যে ক্ষেত্রে মুসলিম আরবেকে
একাকী সারা অমুসলিম দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে সে ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনের জন্য
ঈমানের দুর্বলতার চাইতে বড় কোন আভ্যন্তরীণ বিপদ থাকতে পারে না। তাই তাবুক যুদ্ধের
সময় যারা অলসতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিল অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের তিরস্কার ও
নিন্দা করা হয়। যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের ন্যায়সংগত ওযর ছাড়াই পিছনে থেকে
যাওয়াটাকে একটা মুনাফেকসূলভ আচরণ এবং সাচ্চা ঈমানদার না হওয়ার সুষ্পষ্ট প্রমাণ
হিসেবে গণ্য করা হয়। ভবিষ্যতের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেয়াহয়, আল্লাহর
কালেমাকে বুলন্দ করার সংগ্রাম এবং কুফর ও ইসলামের সংঘাতই হচ্ছে মুমিনদের ঈমানদের দাবী
যাচাই আসল মানদণ্ড । এ সংঘর্ষে যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য ধন-প্রাণ সময় ও শ্রম ব্যয়
করতে ইতস্তত করবে তার ঈমান নির্ভরযোগ্য হবে না। অন্য কোন ধর্মীয় কাজের মাধ্যমে এ
ক্ষেত্রের কোন অভাব পূরণ করা যাবে না।
এসব বিষয়ের প্রতি নজর রেখে সূরা তওবা অধ্যয়ন করলে এর যাবতীয় বিষয় সহজে অনুধাবন
করা সম্ভব হবে।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بَرَاءَةٌ
مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
১। সম্পর্ক
ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো১ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে, যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা
চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে।২
১. এ সূরার ভূমিকায় আমি বলে এসেছি,
৫
রুকূর শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত এ ভাষণটি ৯ হিজরীরতে এমন এক সময় নাযিল হয় যখন নবী সা.
হযরত আবু বকরকে রা. হজ্জের জন্য রওয়ানা করে দিয়েছিলেন্ তার চলে যাওয়ার পর এটি
নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম নবী সা. এর কাছে আবেদন করেনঃ এটি হযরত আবু বকর রা. এর
কাছে পাঠিয়ে দিন, তিনি হজ্জের সময় লোকদের এটি শুনিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি বলেন, এ
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ঘোষণা আমার পক্ষ থেকে আমারই ঘরের একজনের করা উচিত।কাজেই তিনি হযরত আলীকে রা. এ কাজে নিযুক্ত করেন। এ সংগে তাকে নির্দেশ দেন, হাজীদের
সাধারণ সমাবেশে আল্লাহর এ বাণী শুনিয়ে দেবার পর নিম্নলিখিত চারটি কথাও যেন ঘোষণা
করে দেন।
একঃ দীন ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এমন কোন ব্যক্তি
জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
দুইঃ
এ
বছরের পরে আর কোন মূশরিক হজ্জ করতে আসতে পারবে না।
তিনঃ
বাইতুল্লাহর
চারদিকে উলংগ অবস্থায় তাওয়াফ করা নিষিদ্ধ।
চারঃ
যাদের
আল্লাহর রসূলের চুক্তি অক্ষুন্ন আছে অর্থাৎ যারা চুক্তি ভংগ করেনি, চুক্তির
সময়সীমা পর্যন্ত তা পূর্ণ করা হবে।
এ প্রসংগে জানা থাকা দরকার, মক্কা বিজয়ের পর ইসলামী যুগে
প্রথম হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় ৮ হিজরীতে প্রাচীন পদ্ধতিতে। ৯হিজরীতে মুসলমানরা এ দ্বিতীয় হজ্জটি সম্পন্ন করে নিজস্ব
পদ্ধতিতে এবং অন্যদিকে মুশরিকরা করে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। এরপর ১০ হিজরীতে তৃতীয় হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় খালেস ইসলামী
পদ্ধতিতে। এটিই বিখ্যাত বিদায় হজ্জ। নবী সা. প্রথম দু'বছর
হজ্জ করতে যাননি। তৃতীয় বছর শিরকের পুরোপুরি
অবসান ঘটার পর তিনি হজ্জ আদায় করেন।
২. সূরা আনফালের ৫৮ আয়াতে একথা আলোচনা করা হয়েছে যে, কোন
জাতির পক্ষ থেকে যখন তোমাদের খেয়ানত করার তথা অঙ্গীকার ভংগ ও বিশ্বাসঘাতকতা করার
আশংকা দেখা দেয় তখন প্রকাশ্যে তার চুক্তি মুখের ওপর ছুঁড়ে দাও এবং তাকে এ মর্মে
সতর্ক করে দাও যে, এখন তোমাদের সাথে আমাদের আর কোন চুক্তি নেই। এরূপ ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে কোন
চুক্তিবদ্ধ জাতির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম শুরু করে দেয়া মূলত বিশ্বাসঘাতকতারই
নামান্তর। এ নৈতিক বিধি অনুযায়ী
চুক্তি বাতিল করার এ সাধারণ ঘোষণা এমনসব গোত্রের বিরুদ্ধে করা হয়েছে যারা
অংগীকার করা ও চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সমসময় ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে
এবং সুযোগ পেলেই সকল অংগীকার ও চুক্তি শিকেয় তুলে রেখে শত্রুতায় লিপ্ত হতো। সে সময় যেসব গোত্র শিরকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল
তাদের মধ্য থেকে কিনানাহ ও বনী দ্বামরাহ এবং হয়তো আরো এক আধাটি গোত্র ছাড়া
বাদবাকি সকল গোত্রের অবস্থা এ রকমই ছিল।
এ দায়িত্ব মুক্তি ও স্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘোষণার ফলে আরবে শিরক ও মুশরিকদের
অস্তিত্বই যেন কার্যত আইন বিরোধী (Out
of Law) হয়ে
গেলো। এখন আর তাদের জন্য সারাদেশে
কোন আশ্রয়স্থল রইল না।
কারণ দেশের বেশীরভাগ এলাকা ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের আওতাধীন হয়ে গিয়েছিল। এরা নিজেদের জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিল, রোম
ও পারস্যের পক্ষ থেকেই ইসলামী সালতানাত কখন বিপদের সম্মুখীন হবে অথবা নবী সা.কখন
ইন্তেকাল করবেন। তখনই এরা অকস্মাত চুক্তি
ভংগ করে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেবে। কিন্তু আল্লাহ তার ও তার রসূল সা. তাদের প্রতীক্ষিত সময় আসার আগেই তাদের
পরিকল্পনার ছক উল্টে দিলেন এবং তাদের থেকে দায়িত্ব মুক্তির কথা ঘোষণা করে তাদেরকে
তিনটি পথের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করলেন।
একঃ
তাদের
যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হতে হবে এবং ইসলামী শক্তির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে
দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে।
দুইঃ
তাদের
দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
তিনঃ
তাদের
ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের বৃহত্তর অংশ আগেই যে শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন চলে
এসেছে তারই আয়ত্বে নিজেদেরকে ও নিজেদের এলাকাকে সোপর্দ করে দিতে হবে।
এ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রকৃত ও যথার্থ যৌক্তিকতা অনুধাবন করার জন্য
আমাদেরকে পরবর্তীকালে উদ্ভুত ইসলাম বর্জন আন্দোলনের দিকে ফেরাতে হবে।আলোচ্য ঘটনার দেড় বছর পরে নবী সা. ইন্তেকালের
পরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অশুভ তৎপরতা ও গোলযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ফলে
ইসলামের নব নির্মিত প্রাসাদটি আকস্মিকভাবে নড়ে ওঠে। ৯ হিজরীর এ সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণার মাধ্যমে যদি শিরকের
সংগঠিত শক্তিতে খতম করে না দেয়া হতো এবং সারাদেশে ইতিমধ্যে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে
ক্ষমতা প্রধান্য বিস্তার না করতো,
তাহলে
হযরত আবু বকররা. খিলাফত আমলের শুরুতেই মুরতাদ হওয়ার যে হিড়িক লেগে গিয়েছিল তার
চেয়ে অনন্ত দশগুণ বেশী শক্তি নিয়ে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়ে
যেতো। এ অবস্থায় ইসলামের ইতিহাসের
চেহারাই হয়েতো সম্পূর্ণ পাল্টে যেতো।
﴿فَسِيحُوا
فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ
ۙ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ﴾
২। কাজেই
তোমরা দেশের মধ্যে আরো চার মাসকাল চলাফেরা করে নাও৩ এবং জেনে
রেখো তোমরা আল্লাহকে অক্ষম ও শক্তিহীন করতে পারবে না। আর আল্লাহ
সত্য অস্বীকারকারীদের অবশ্যই লাঞ্ছিত করবেন।
৩. এ ঘোষণাটি হয়েছিল ৯ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে। নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা
করার জন্যে এ সময় থেকে ১০ হিজরী ১০ রবিউল সানী পর্যন্ত ৪ মাসের অবকাশ তাদেরকে দেয়া
হয়। তারা যুদ্ধ করতে চাইলে
যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হোক। দেশ ত্যাগ করতে চাইলে এ সময়ের মধ্যে নিজেদের আশ্রয়স্থল খুঁজে নিক। আর যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাহলে স্থির
মস্তিস্কে ভেবে-চিন্তে তা গ্রহণ করুক।
﴿وَأَذَانٌ
مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ
بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ۙ وَرَسُولُهُ ۚ فَإِن تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ
ۖ وَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ
الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ﴾
৩। আল্লাহ ও
তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে বড় হজ্জের৪ দিনে সমস্ত মানুষের প্রতি সাধারণ ঘোষণা
করা হচ্ছেঃ “আল্লাহর মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রসূলও। এখন যদি
তোমরা তাওবা করে নাও তাহলে তো তোমাদেরই জন্য ভাল। আর যদি
মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে খুব ভাল করেই বুঝে নাও, তোমরা আল্লাহকে শক্তি
সামর্থহীন করতে পারবে না। আর হে নবী ! অস্বীকারকারীদের
কঠিন আযাবের সুখবর দিয়ে দাও।
৪. অর্থাৎ ১০ যিলহজ্জ। একে "ইয়াওমুন নহর" বা যবেহ করার দিন বলা হয়।সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ বিদায় হজ্জে ভাষণ দিতে
গিয়ে নবী সা. উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞেস করেনঃ আজকের এ দিনটি কোন দিন? লোকেরা
জবাব দেয়ঃ ইয়াওমুন নহর-আজ যবেহ করার দিন। তিনি বলেনঃ
هذا يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ
অর্থাৎ আজ হজ্জে আকরব তথা বড় হজ্জের দিন। এখানে বড় হজ্জ শব্দটি এসেছে ছোট হজ্জের বিপরিত
শব্দ হিসেবে। আরববাসীরা উমরাহ কে ছোট
হজ্জ বলে থাকে। এর মোকাবিলায় যিলহজ্জের
নির্দিষ্ট দিনগুলোতে যে হজ্জ করা হয় তাকে বলা হয় বড় হজ্জ।
﴿إِلَّا
الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ
يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ
ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾
৪। তবে যেসব
মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তোমাদের সাথে নিজেদের চুক্তি
রক্ষায় কোন ক্রুটি করেনি আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি তাদের ছাড়া। এ ধরনের
লোকদের সাথে তোমরাও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে। কারণ
আল্লাহ তাকওয়া তথা সংযম অবলম্বকারীদেরকে পছন্দ করেন।৫
৫. অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে চুক্তি ভংগ করেনি তোমরা তাদের
সাথে চুক্তি ভংগ করবে, এটা হবে তাকওয়া বিরোধী কাজ।আল্লাহর কাছে তাই প্রিয় ও পছন্দনীয়, যারা
সব অবস্থায় তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।
﴿فَإِذَا
انسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ
وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ ۚ فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا
الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫। অতএব, হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে
গেলে৬ মুশরিকদের
যেখানে পাও হত্যা করো এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং প্রত্যেক ঘাঁটতি তাদের
জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকো। তারপর যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের ছেড়ে দাও।৭ আল্লাহ
ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
৬. পারিভাষিক অর্থে যে মাসগুলোকে হজ্জ ও উমরাহ করার সুবিধার
জন্য হারাম মাস গণ্য করা হয়েছে এখানে সে মাসগুলোর কথা বলা হয়নি। বরং মুশরিকদের যে চর মাসের অবকাশ দেয়া হয়েছিল
সেই চারটি মাসের কথা এখানে বলা হযেছে। যেহেতু এ অবকাশকালিন সময়ে মুশরিকদের ওপর আক্রমণ করা মুসলমানদের জন্য জায়েয
ছিল না তাই এগুলোকে হারাম মাস বলা হয়েছে।
৭. অর্থাৎ কুফর ও শিরক থেকে নিছক তাওবা করে নিলেই ব্যাপাটি
খতম হয়ে যাবে না। বরং তাদের কার্যত নামায
কায়েম করতে ও যাকাত দিতে হবে। এটা না হলে তারা যে কুফরী ত্যাগ করে ইসলামকে অবলম্বন করেছে, একথা
মেনে নেয়া যাবে না। হযরত আব বকর রা. মুরতাদ
হবার ফিতনা দেখা দেবার সময় এ আয়াত থেকেই যুক্তি সংগ্রহ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। নবী সা. এর ইন্তেকালের পর যারা গোলযোগ
সৃষ্টি করেছিল তাদের একটি দল বলতো,
আমরা
ইসলামকে অস্বীকার করি না।
আমরা নামায পড়তে প্রস্তুত কিন্তু যাকাত দেবো না। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণভাবে এ ভেবে বিব্রত হচ্ছিলেন, যে
এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে কেমন করে তরবারি ওঠানো যেতে পারে? কিন্তু
হযরত আবু বকর রা. ও আয়াতটির বরাত দিয়ে বলেলেন,
আমাদের
তো কেবলমাত্র যখন এরা শিরক থেকে তাওবা করবে,
নামায
কায়েম করবে, ও যাকাত দেবে তখনই এদেরকে ছেড়ে দেবার হুকুম
দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন এ তিন শর্তের
মধ্য থেকে একটি শর্ত এরা উড়িয়ে দিচ্ছে তখন আমরা এদের ছেড়ে দেই কেমন করে?
﴿وَإِنْ
أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ
ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْلَمُونَ﴾
৬। আর যদি মুশরিকদের
কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে তোমার কাছে আসতে চায় (যাতে সে আল্লাহর কালাম
শুনতে পারে) তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দাও,৮ তারপর তাকে
তার নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দাও। এরা অজ্ঞ বলেই এটা করা উচিত।
৮. অর্থাৎ যুদ্ধ চলার মাঝখানে যদি কোন শত্রু তোমাদের কাছে
আবেদন করে, আমি ইসলামকে জানতে ও বুঝতে চাই তাহলে তাকে
নিরাপত্তা দান করে নিজেদের কাছে আসতে দেয়া এবং তাকে ইসলাম সম্পর্কে বুঝানো
মুসলমানদের উচিত। তারপর যদি সে ইসলাম গ্রহণ
না করে তাহলে নিজেদের নিরাপত্তায় তাকে আবাস স্থলে পৌছিয়ে দেয়া উচিত এ ধরনের লোক
যারা নিরাপত্তা নিয়ে দারুল ইসলামের আসে, ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে তাদের
"মুস্তামিন" তথা নিরাপত্তা প্রার্থী বলা হয়।
﴿كَيْفَ
يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِندَ اللَّهِ وَعِندَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ
عَاهَدتُّمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۖ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا
لَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾
৭। মুশরিকদের
জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কোন নিরাপত্তার অংগীকার কেমন করে হাতে পারে? তবে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি
সম্পাদন করছিলে মসজিদে হারামের কাছে তাদের কথা স্বতন্ত্র।৯ কাজেই যতক্ষন তারা তোমাদের
জন্য সোজা-সরল থাকে ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য সোজা-সরল থাকো। কারণ
আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে পছন্দ করেন।
৯. অর্থাৎ নবী কিনানাহ,বনী খুযাআহ ও বনী দ্বামরাহ।
﴿كَيْفَ
وَإِن يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لَا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً ۚ يُرْضُونَكُم
بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَىٰ قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ﴾
৮। তবে তাদের
ছাড়া অন্য মুশরিকদের জন্য নিরাপত্তা চুক্তি কেমন করে হতে পারে, যখন তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা তোমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ
লাভ করতে পরলে তোমাদের ব্যাপারে কোন আত্মীয়তার পরোয়া করবে না এবং কোন
অংগীকাররে দায়িত্বও নেবে না। তারা মুখের কথায় তোমাদের
সন্তুষ্ট করে কিন্তু তাদের মন তা অস্বীকার করে।১০ আর তাদের অধিকাংশই ফাসেক।১১
১০. অর্থাৎ বাহ্যত তারা চুক্তির শর্তাবলী নির্ণয় করে কিন্তু
মনে থাকে তাদের চুক্তি ভংগ করার কুমতলব। অভিজ্ঞতা থেকে এর প্রমান পাওয়া যায়। অর্থাৎ দেখা গেছে,
যখনই
তারা কোন চুক্তি করেছে, ভংগ করার জন্যই তা করেছে।
১১. অর্থাৎ তারা এমন,
লোক, যাদের
নৈতিক দায়িত্বের কোন অনুভূতি নেই এবং নৈতিক বিধি-নিধেষ ভঙ্গ করতেও তারা কখনো
কুণ্ঠিত বা শংকিত হয় না।
﴿اشْتَرَوْا
بِآيَاتِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَصَدُّوا عَن سَبِيلِهِ ۚ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا
كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
৯। তারা
আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে সামান্যতম মূল গ্রহণ করে নিয়েছে।১২ তারপর আল্লাহ পথে বাধা হয়ে
দাঁড়িয়েছে।১৩ তারা যা
করতে অভ্যস্ত, তা অত্যন্ত খারাপ কাজ।
১২. অর্থাৎ একদিকে আল্লাহর আয়াত তাদের সৎকাজ করার, সত্য
পথে থাকার ও ন্যায়নিষ্ঠ আইন মেনে চলার আহবান জানাচ্ছিল। এবং অন্য দিকে তাদের সামনে ছিল দুনিয়ার জীবনের মুষ্টিমেয়
কয়েকদিনের সুখ-সুবিধা-আরাম ঐশ্বর্য। প্রবৃত্তির আশা-আকাংখার লাগামহীন আনুগত্যের দ্বারা এগুলো অর্জন করা যায়। তারা এ দুটি জিনিসের মধ্যে তুলনা করে প্রথমটি
বাদ দিয়ে দ্বিতীয় জিনিসট নিজেদের জন্য বেছে নিল।
১৩. অর্থাৎ জালেমরা শুধুমাত্র হেদায়াতের পরবর্তে গোমরাহীকে
নিজেদের জন্য বেছে নিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং আরো অগ্রসর হয়ে তারা যাতে সত্যের
দাওয়াতের কাজ কোনক্রমেই না চলতে পারে এবং কল্যাণ ও সৎবৃত্তির এ আওয়াজ কেউ শুনতে
পায় সে জন্যও অপচেষ্টা চালিয়েছে। বরং তারা চেয়েছে, যে মুখ থেকে ডাক দেয়া হয় সেই মুখই বন্ধ করে
দিতে। মহান আল্লাহ যে সত্যনিষ্ঠ ও
কল্যাণময় জীবন বিধান পৃথিবীতে কায়েম করতে চাচ্ছিলেন তার পথ রোধ করার জন্য তারা
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এ জন্য যারা এ বিধানকে সত্য জেনে এর অনুসারী হয়েছিল দুনিয়ার বুকে তাদের জীবন
যাপনের দুর্বিসহ করে তুলেছিল।
﴿لَا يَرْقُبُونَ
فِي مُؤْمِنٍ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُعْتَدُونَ﴾
১০। কোন
মুমিনের ব্যাপারে তারা না আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষা করে, আর না কোন অঙ্গীকারের ধার
ধারে। আগ্রাসন ও বাড়াবাড়ি সবসময় তাদের পক্ষ
থেকেই হয়ে থাকে।
﴿فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا
الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ۗ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ
لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ﴾
১১। কাজেই যদি
তারা তাওবা করে নেয় এবং নামায কয়েম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দীনী
ভাই। যারা জানে, তাদের জন্য আমার বিধান ষ্পষ্ট
করে বর্ণনা করি।১৪
১৪. এখানে আবার একথা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে নামায পড়া ও
যাকাত দেয়া ছাড়া নিছক তাওবা করে নিলেই তারা তোমাদের দীনী ভাই হয়ে যাবে না।আর এগুলো আদায় করলে তারা তোমাদের দীনী ভাই হবে, একথা
বলার মানে হচ্ছে, এইযে,
এ
শর্তগুলো পূরণকরার ফল কেবল এতটুকুই হবে না যে,
তোমাদের
জন্য তাদের ওপর হাত ওঠানো এবং তাদের ধন-প্রাণ নষ্ট করা হারাম হয়ে যাবে রবং এ সংগে
আরো একটি সুবিধা লাভ করা যাবে। অর্থাৎ এর ফলে ইসলামী সমাজে তারা সমান অধিকার লাভ করবে। সামাজিক, তামাদ্দুনিক ও আইনগত দিক
দিয়ে তারা অন্যান্য সকল মুসলমানের মতই হবে। কোন পার্থক্য ও বিশেষ গুণাবলী তাদের উন্নতির পথে অন্তরায়
সৃষ্টি করতে পারবে না।
﴿وَإِن
نَّكَثُوا أَيْمَانَهُم مِّن بَعْدِ عَهْدِهِمْ وَطَعَنُوا فِي دِينِكُمْ فَقَاتِلُوا
أَئِمَّةَ الْكُفْرِ ۙ إِنَّهُمْ لَا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنتَهُونَ﴾
১২। আর যদি
অঙ্গীকার করার পর তারা নিজেদের কসম ভংগ করে এবং তোমাদের দীনের ওর হামলা চালাতে
থাকে তাহলে কুফরীর পতাকাবাহীদের সাথে যুদ্ধ করো। কারণ
তাদের কসম বিশ্বাসযোগ্য নয়। হয়তো (এরপর তরবারীর ভয়েই) তারা
নিরস্ত হবে।১৫
১৫. পূর্বাপর আলোচনা থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে একথা বুঝা যাচ্ছে যে, কসম, অঙ্গীকার
ও শপথ বলতে কুফরী ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করার অংগীকারের কথাই এখানে বুঝানো হয়েছে। কারণ এদের সাথে এখন আর কোন চুক্তি করার
প্রশ্নই ওঠে না। আগের সমস্ত চুক্তিই তরা ভংগ
করেছে। তাদের অংগীকার ভংগের কারণেই
আল্লাহ ও তার রসূলের পক্ষ তেকে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিষ্কার ঘোষণা
শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। একথাও বলা হয়েছে যে, এ
ধরনের লোকদের সাথে কেমন করে চুক্তি করা যেতে পারে? এ
সাথে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছিল যে, এখন তারা কুফরী ও শিরক ত্যাগ
করে নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে,
একমাত্র
এ নিশ্চয়তা বিধান করলেই তাদের ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এ কারণে এ আয়াতটি মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে
একেবারেই দ্ব্যর্থহীন আদেশ স্বরূপ। আসলে দেড় বছর পরে হযরত আবু বকর সিদ্দীকের রা. খিলাফত আমলে ইসলাম বর্জনের যে
প্রবণতা দেখা দিয়েছিল এখানে সেদিকেই ইংগিত দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে ইতিপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হয়েছিল।অতিরিক্ত ও বিস্তারিত জানার
জন্য পড়ুন আমার বই “ইসলামী আইনে মুরতাদের শাস্তি।”
﴿أَلَا
تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نَّكَثُوا أَيْمَانَهُمْ وَهَمُّوا بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُم
بَدَءُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ أَتَخْشَوْنَهُمْ ۚ فَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ
إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
১৩। তোমরা কি
লড়াই করবে না১৬ এমন লোকদের সাথে যারা
নিজেদের অঙ্গীকার ভংগ করে এসেছে এবং যারা রসূলকে দেশ থেকে বের করে দেবার
দুরভিসন্ধি করেছিল আর বাড়াবাড়ি সুচনা তারাই করেছিল? তোমরা কি তাদেরকে ভয় করো? যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো,তাহলে আল্লাহকে ভয় করাই
তোমাদের জন্য অধিক সমীচীন।
১৬. এখান থেকে ভাষণটি মুসলমানদের দিকে মোড় নিচ্ছে। তাদেরকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং
দীনের ব্যাপারে কোন প্রকার সম্পর্ক,
নিকট
আত্মীয়তা ও বৈষয়িক সুবিধার কথা একটুও বি্বেচনায় না আনার কঠোর নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ভাষণের এ অংশটির সমগ্র প্রাণসত্তা ও মর্ম
অনুধাবন করার জন্য সে সময় যে অবস্থা ও পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল তা আর একবার ভেবে
দেখা দরকার। সন্দেহ,
নেই, ইসলাম
এ সময় দেশের একটি বড় অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আরবে এমন কোন বড় শক্তি তখন ছিল না,
যে
তাকে শক্তি পরিক্ষার আহবান জানাতে পারতো। তবুও এ সময় যে সিদ্ধান্তকর ও চরম বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া
হচ্ছিল স্থুল দৃষ্টি সম্পন্ন লোকেরা তাতে অনেক বিপদের ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছিল।
একঃ সমস্ত মুশরিক গোত্রগুলোকে একই সঙ্গে সকল চুক্তি বাতিল করার
চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেয়া, মুশরিকদের হজ্জ বন্ধ করে দেয়া, কাবার
অভিভাবকের পরিবর্তন এবং জাহেলী রসম রেওয়াজের একেবারেই মুলোৎপাটন-এসবের অর্থ ছিল
একই সংগে সারাদেশে আগুণ জ্বলে ওঠবে এবং মুশরিক ও মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ ও
গোত্রীয় বৈশিষ্ট্যের হেফাজতের জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রবাহিত করতে উদ্ধূদ্ধ
হবে।
দুইঃ হজ্জকে শুধুমাত্র তাওহীদবাদীদের জন্য নির্দিষ্ট করা এবং
মুশরিকদের জন্য কাবা ঘরের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার অর্থ ছিল,
দেশের
জনসংখ্যার যে একটি বিরাট অংশ তখনো মুশরিক ছিল,ধর্মীয় কাজ কর্মে জন্য তাদের
কাবাঘরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু এ নয়, সমকালীন আরবের অর্থনৈতিক জীবনে কাবার গুরুত্ব
ছিল অপরিসীম এবং কাবার ওপর আরবদের অর্থনৈতিক জীবন বিপুলভাবে নির্ভরশীল ছিল। কাজেই এভাবে কাবার দরজা বন্ধ করার কারণে তারা
কাবাঘর থেকে কোন প্রকার অর্থনৈতিক সুবিধাদি লাভ করতে পারবে না।
তিনঃ যারা হোদায়বিয়ার চুক্তি ও মক্কা বিজয়ের পর ঈমান এনেছিলেন
তাদের জন্য এটি ছিল কঠিন পরীক্ষার বিষয়। কারণ তাদের অনেক জ্ঞাতি-ভাই, আত্মীয়-স্বজন
তখনো মুশরিক ছিল।তাদের মধ্যে এমন অনেক লোকও
ছিল পুরাতন ব্যবস্থার বিভিন্ন পদমর্যাদার সাথে যাদের স্বার্থ বিজরিত ছিল।এখন বাহ্যত আরবের মুশরিকদের গোটা সমাজ
ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন করে দেবার যে আয়োজন চলছিল তার মানে ছিল মুসলমানরা নিজেদের
হাতেই নিজেদের বংশ, পরিবার ও কলিজার টুকরাদেরকে ধুলায় মিশিয়ে দেবে
এবং তাদের মান, মর্যাদা,
ও
শতশত বছরের প্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্যসমূহ চিরতরে খতম করে দেবে।
যদিও বাস্তবে এর মধ্যে থেকে কোন একটা বিপদও কার্যত সংঘটিত হয়নি। দায় মুক্তির ঘোষণার পর সারা দেশে যুদ্ধের আগুন
জ্বলে উঠার পরিবর্তে বরং দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুশরিক গোত্র এতদিন নির্লিপ্ত
ছিল তাদের এবং বিভিন্ন আমীর,রইস ও রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি দল মদীনায় আসতে শুরু করলো। তারা নবী সা. এর সামনে ইসলাম গ্রহণ করে
আনুগত্যের শপথ নিতে লাগলো। ইসলাম গ্রহণ করার পর নবী সা. তাদের প্রত্যেককে নিজের পদমর্যাদায় বহাল রাখলেন। কিন্তু এ নতুন নীতি ঘোষণা করার সময় তার এ
ফলাফলকে কেউ আগাম অনুমান করতে পারেনি। তাছাড়া এ ঘোষণার সাথে সাথেই যদি মুসলমানরা শক্তি প্রয়োগ করে তা বস্তাবায়িত
করার জন্য পুরোপুরি তৈরী না হয়ে যেতো, তাহলে সম্ভবত এ ধরনের ফলাফল দেখাই যেতো না। কাজেই এ সময় মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর পথে
জিহাদ করার উদ্দীপনা ও আবেগ সৃষ্টি করা এবং এ নীতি কার্যকর করতে গিয়ে তাদের মনে
যেসব আশংকা দেখা দিয়েছিল সেগুলো দূর করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।এ সংগে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, আল্লাহর
ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য তাদের কোন জিনিসের পরোয়া না করা উচিত। এ বক্তব্যই আলোচ্য ভাষণের মূল প্রতিপদ্য বিষয়।
﴿قَاتِلُوهُمْ
يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ
صُدُورَ قَوْمٍ مُّؤْمِنِينَ﴾
১৪। তাদের
সাথে লড়াই করো,আল্লাহ
তোমাদের হাতে তাদের শাস্তি দেবেন, তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করবেন, তাদের মোকাবিলায় তোমাদের
সাহায্য করবেন এবং অনেক মুমিনের অন্তর শীতল করে দেবেন।
﴿وَيُذْهِبْ غَيْظَ قُلُوبِهِمْ
ۗ وَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
১৫। আর তাদের
অন্তরের জ্বালা জুড়িয়ে দেবেন। এবং যাকে ইচ্ছা তাওবা করার
তাওফীক ও দান করবেন।১৭ আল্লাহ
সবকিছু জানেন এবং তিনি মহাজ্ঞানী।
১৭. এখানে একটি সম্ভবনার দিকে হালকা ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে এটি বাস্তব ঘটনার রূপে
আত্মপ্রকাশ করে। মুসলমানরা মনে করেছিল, এ
ঘোষণার সাথে সাথেই দেশে রক্তের নদী বয়ে যাবে। এ ভুল ধারণা দূর করার জন্য ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের জানিয়ে
দেয়া হয়েছে যে, এ কঠোর নীতি অবলম্বন করার কারণে যেখানে একদিকে
যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে সেখানে লোকদের তাওবার সৌভাগ্য লাভের সম্ভবনাও
রয়েছে। কিন্তু এ ইঙ্গিতকে খুব বেশী
শানিত ও স্পষ্ট করা হয়নি।
কারণ এর ফলে একদিকে মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতি স্তিমিত হয়ে পড়তো এবং অন্যদিকে যে
হুমকিটি মুশরিকদেরকে তাদের অব্স্থানের নাজুকতার কথা ভাবার এবং পরিশেষে তাদের
ইসলামী ব্যাব্স্থার মধ্যে বিলিন হবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে ছিল। তা হালকা, ও নিষ্প্রভ হয়ে যেতো।
﴿أَمْ حَسِبْتُمْ
أَن تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا
مِن دُونِ اللَّهِ وَلَا رَسُولِهِ وَلَا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌ
بِمَا تَعْمَلُونَ﴾
১৬। তোমরা কি
একথা মনে করে রেখেছো যে তোমাদের এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের
মধ্য থেকে কারা (তার পথে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো এবং আল্লাহ,রসূল ও
মুমিনদের ছাড়া কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহণ করলো না?১৮ তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন।
১৮. স্বল্পকাল আগে যারা ইসলাম গ্রহন করেছিল এখানে তাদেরকে
সম্বোধন করা হয়েছে, তাদেরকে বলা হচ্ছে, যতক্ষণ
তোমরা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একথা প্রমাণ করে না দেবে যে, যথার্থই
তোমরা আল্লাহ ও তাঁর দীনকে নিজেদের ধন-প্রাণ ও ভাই-বন্ধুদের তুলনায় বেশী ভালবাসো, ততক্ষণ
তোমাদের সাচ্চা মুমিন বলে গণ্য করা যেতে পারে না।
এ পর্যন্ত বাহ্যত তোমাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যেহেতু
সাচ্চা মুমিন ও প্রথম যুগের দৃঢ়চিত্ত মুসলিমদের প্রাণপণ প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের
মাধ্যমে ইসলাম বিজয় লাভ করছে এবং সারাদেশে ছেয়ে গেছে তাই তোমরাও মুসলমান হয়ে
গেছো।
﴿مَا كَانَ
لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِ
ۚ أُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ﴾
১৭। মুশরিক
যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ দিচ্ছে তখন আল্লাহর মসজিদসমূহের
রক্ষণাবেক্ষণকারী ও খাদেম হওয়া তাদের কাজ নয়।১৯ তাদের
সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে২০ এবং তাদেরকে চিরকাল
জাহান্নামে থাকতে হবে।
১৯. অর্থাৎ এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য যেসব মসজিদ তৈরী করা
হয়েছে সেগুলোর মুতাওয়াল্লী, রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক এমন ধরনের লোক হতে
পারে না যারা আল্লাহর গুণাবলী, অধিকারী ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারের
ক্ষেত্রে অন্যদের শরিক করে। তারপর তারা নিজেরাই যখন তাওহীদের দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে এবং
পরিস্কার বলে দিয়েছে, আমরা নিজেদের ইবাদত বন্দেগী এক আল্লাহর জন্য
নির্দিষ্ট করতে রাযী নই, তখন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য যে ইবাদত
গৃহ তৈরী করা হয়েছে তার মুতাওয়াল্লী হবার অধিকার তারা কোথা থেকে পায়?
এখানে যদিও কথাটা সাধারণভাবেই বলা হয়েছে এবং তাৎপর্যের দিক দিয়েও এটি
সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবুও বিশেষভাবে এখানে এর উল্লেখের উদ্দেশ্য
হচ্ছে,কাবাঘর ও মসজিদে হারামের ওপর থেকে মুশরিকদের
মুতাওয়াল্লীগিরির পাট একেবারে চুকিয়ে দিয়ে সেখানে চিরকালের জন্য তাওহীদবাদীদের
অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠিত করা।
২০. অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে বায়তুল্লাহর যে সামান্য কিছু সেবা
তারা করেছিল তাও বরবাদ হয়ে গেছে। কারণ এ সেবা কাজের সাথে তারা শিরক ও জাহেলী পদ্ধতি মিশিয়ে একাকার করে
ফেলেছিলো। তাদের সেই সামান্য পরিমাণ
ভাল কাজকে নস্যাত করে দিয়েছে, তাদের অনেক বড় আকারের অসৎকাজ।
﴿إِنَّمَا
يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ
وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ۖ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا
مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾
১৮। তারাই হতে
পারে আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক) যারা আল্লাহর ও পরকালকে
মানে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয়
করেনা। তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যে, তারা সঠিক সোজা পথে চলবে।
﴿أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ
وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ
فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ
الظَّالِمِينَ﴾
১৯। তোমরা কি
হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে এমন ব্যক্তিদের
কাজের সমান মনে করে নিয়েছ যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং
সংগ্রাম-সাধনা করেছে আল্লাহর পথে ?২১
২১. অর্থাৎ কোন তীর্থ কেন্দ্রে পূর্বপুরুষদের গদিনশীন হওয়া, তার
রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং এমন কিছু লোকদেখানো ধর্মীয় কাজ করা যার ওপর লোকেরা বৈষয়িক
পর্যায়ে সাধারণত মর্যাদা ও পবিত্রতার ভিত গড়ে তোলে আল্লাহর কাছে এগুলোর কোন
মূল্য ও মর্যাদা নেই।
আল্লাহর পতি ঈমান আনা ও তার পথে কুরবানী ও ত্যাগ স্বীকার করাই যথার্থ মূল্য ও
মর্যাদার অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব গুণের
অধিকারী হয়, সে কোন উচ্চ বংশ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে
সম্পর্কিত না হলেও এবং তার কপালে কোন বিশেষ গুণের তকমা, আটা
না থাকলেও সে-ই যথার্থ মর্যাদাবান ব্যক্তি। কিন্তু যারা এসব গুণের অধিকারী নয়, তারা
নিছক বিরাট সম্মানিত ও বুজর্গ ব্যক্তির সন্তান,দীর্ঘকাল থেকে তাদের পরিবারে গদিনশীনী প্রথা
চলে আসছে এবং বিশেষ সময়ে তারা বেশ ধুমধাম সহকারে কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে
থাকে বলেই কোন প্রকার মর্যাদার অধিকারী হবে না। উপরন্তু এ ধরনের মেকী মৌরুসী অধিকারকে স্বীকৃতি দান করে
পবিত্র স্থানসমূহ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ অযোগ্য ও অপাংক্তেয় লোকদের হাতে
রেখে দেয়াও কোনক্রমেই বৈধ হতে পারে না।
﴿الَّذِينَ
آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ﴾
২০। এ উভয় দল
আল্লাহর কাছে সমান নয়। আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না। আল্লাহর
কাছে তো তারাই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, যারা ঈমান এনেছে এবং তার পথে
ঘর-বাড়ি ছেড়েছে ও ধন-প্রাণ সমর্পন করে জিহাদ করেছে। তারাই
সফলকাম।
﴿يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُم بِرَحْمَةٍ
مِّنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَّهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُّقِيمٌ﴾
২১। তাদের রব
তাদেরকে নিজের রহমত, সন্তোষ ও
এমন জান্নাতের সুখবর দেন, যেখানে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখের সামগ্রী।
﴿خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
ۚ إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾
২২। সেখানে
তারা চিরকাল থাকবে। অবশ্যি আল্লাহর কাছে কাজের
প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে।
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ
عَلَى الْإِيمَانِ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾
২৩। যে
ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে
তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের
মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম।
﴿قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ
وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا
وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ
اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ
بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾
২৪। হে নবী!
বলে দাও, যদি
তোমাদের পিতা, তোমাদের
সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী,তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা
দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ
কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী
প্রিয় হয়, তাহলে
আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর২২ আল্লাহ
ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না।
২২. অর্থাৎ তোমাদের হটিয়ে দিয়ে সেখানে আল্লাহ অন্য কোন দলকে
দীনের নিয়ামত দান করবেন।
তদেরকে দীনের ধারক ও বাহক হবার মর্যাদায় উন্নীত করবেন। এ সংগে মানুষকে সৎপথে পরিচালনা করার নেতৃত্বও তাদের হাতে
সোপর্দ করবেন।
﴿لَقَدْ
نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ ۙ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ ۙ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ
كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا
رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِينَ﴾
২৫। এর আগে
আল্লাহ বহু ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করছেন। এই তো
সেদিন, হুনায়েন
যুদ্ধের দিন (তাঁর সাহায্যের অভাবনীয় রূপ তোমরা দেখছো),২৩ সেদিন তোমাদের মনে তোমাদের
সংখ্যাধিক্যের অহমিকা ছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোন
কাজে আসেনি। আর এত বড় বিশাল পৃথিবীও তোমাদের জন্য
সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল এবং তোমরা পেছনে ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে।
২৩. দায়িত্ব মুক্তি ও সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা সম্বলিত ভয়ংকর
নীতি কার্যকর করার ফলে সারা আরবে সর্বত্র যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠবে এবং তার
মোকিবালা করা অসম্ভব হবে বলে যারা আশংকা করছিল তাদেরকে বলা হচ্চে, এসব
অমুলক ভয়ে ভীত হচ্ছো কেন? এর চাইতেও বেশী কঠিন বিপদের সময় যে আল্লাহ
তোমাদের সাহায্য করেছেন তিনি এখনো তোমাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছেন। এ কাজ যদি তোমাদের শক্তির ওপর নির্ভর করতো
তাহলে এর আর মক্কা সীমানা পার হতে হতো না। আর না হোক,
বদরের
ময়দানে তো খতমই হয়ে যেতো। কিন্তু এর পেছনে তো রয়েছে স্বয়ং আল্লাহর শক্তি। আর অতীতের অভিজ্ঞতাসমূহ তোমার কাছে একথা প্রমাণ করে
দিয়েছে যে, এখনো পর্যন্ত আল্লাহর শক্তিই এর উন্নতি ও
বিকাশ সাধন করে এসেছে।
কাজেই নিশ্চিত বিশ্বাস রাখো, আজো তিনিই একে উন্নতি ও
অগ্রগতি দান করবেন।
এখানে হুনায়েন যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এ যুদ্ধটি ৮ হিজরীর শওয়াল মাসে এ আয়াতগুলো নাযিলের মাত্র
বার তের মাস আগে মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে হুনায়েন উপত্যকায় সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে ছিল ১২ হাজার সৈন্য। এর আগে কোন যুদ্ধে মুসলমানদের এত বিপুল
সংখ্যক সৈন্য জামায়েত হয়নি। অন্যদিকে কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা ছিল এর তুলানায় অনেক কম। কিন্তু এ সত্ত্বেও হাওয়াযিন গোত্রের তীরন্দাজরা যুদ্ধের
মোড় ফিরিয়ে দিল। মুসলিম সেনাদলে মরাত্মক
বিশৃংখলা দেখা দিল। তারা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত
হযে পিছু হটতে লাগলো। এ
সময় শুধুমাত্র নবী সা. এবং মুষ্টিমেয় কতিপয় মরণপণ সাহাবী যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদ
ছিলেন।তাদের অবিচলতার ফলেই
সেনাবাহিনী পুনর্বার সংগঠিত হলো এবং মুসলমানরা বিজয় লাভ করলো। অন্যথায় মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানরা যে
পরিমাণে লাভবান হয়েছিল হুনায়েনে তাদেরকে তার চাইতে অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হতে হতো।
﴿ثُمَّ
أَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنزَلَ جُنُودًا
لَّمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ﴾
২৬। তারপর
আল্লাহ তার প্রশান্তি নাযিল করেন তাঁর রসূলের ওপর ও মুমিনদের ওপর এবং সেনাদল নামান
যাদেরকে তোমরা চোখে দেখতে পাচ্ছিলে না। এবং সত্য
অস্বীকারকারীদের শাস্তি দেন। কারণ যারা সত্য অস্বীকার করে
এটাই তাদের প্রতিফল।
﴿ثُمَّ يَتُوبُ اللَّهُ مِن
بَعْدِ ذَٰلِكَ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
২৭। তারপর
(তোমরা এও দেখছো) এভাবে শাস্তি দেবার পর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাওবার তাওফীকও দান
করেন।২৪ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
২৪. হুনায়েন যুদ্ধে জয়লাভ করার পর নবী সা. বিজিত শত্রুদের সাথে
যে সদয় ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করেন তার ফলে তাদের বেশীরভাগ লোক মুসলমান হয়ে
যায়। এখানে মুসলমানদের যে কথা
বলা উদ্দেশ্যে এ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে তা এই যে, এখন
সারা আরবের সমস্ত মুশরিককে ধ্বংস করা হবে,
এ
কথা তোমরা ভাবলে কেন? না তা নয় বরং আগের অভিজ্ঞতা থেকে তোমাদের আশা
করা উচিত যে, যখন এ লোকদের মনে জাহেলী ব্যবস্থার বিকাশ ও
স্থায়িত্বের আর কোন আশা থাকবে না এবং যেসব সহায়তা ও আনুকূল্যের কারণে এতদিন তারা
জাহেলিয়াতকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে তা সব খতম হয়ে যাবে, তখন
তারা নিজেরাই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেবার জন্য এগিয়ে আসবে।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ
بَعْدَ عَامِهِمْ هَٰذَا ۚ وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللَّهُ
مِن فَضْلِهِ إِن شَاءَ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
২৮। হে
ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র, কাজেই এ বছরের পর তারা যেন আর মসজিদে
হারামের কাছে না আসে।২৫ আর যদি
তোমাদের দারিদ্রের ভয় থাকে, তাহলে আল্লাহ চাইলে তার নিজ অনুগ্রহে
শীঘ্রই তোমাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ
সবকিছু জানেন ও তিনি প্রজ্ঞাময়।
২৫. অর্থাৎ আগামীতে শুধু তাদের হজ্জ ও যিয়ারতই বন্ধ নয় বরং
মসজিদে হারামের সীমানায় তাদের প্রবেশই নিষিদ্ধ। এভাবে শিরক ও জাহেলিয়াতের পুনরাবর্তনের কোন সম্ভাবনাই
থাকবে না।
অপবিত্র, কথাটির মানে এই নয় যে, তারা
নিজেরাই অপবিত্র বা নাপাক। বরং এর মানে হচ্ছে, তাদের
আকীদা,-বিশ্বাস, নৈতিক, চরিত্র, কাজকর্ম এবং তাদের জাহেলী
চালচলন ও সমাজ ব্যবস্থা অপবিত্র। আর এ অপবিত্রতার কারণে হারাম শরীফের চতুসীমায় তাদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া
হয়েছে। ইমাম আবু হানিফার মতে এর
অর্থ শুধু এতটুকুই যে, হজ্জ ও উমরাহ এবং জাহেলী অনুষ্ঠানাদি পালন করার
জন্য তারা হারাম শরীফের সীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম শাফেয়ীর মতে এ হুকুমের অর্থ হচ্ছে,তারা
(যে কোন অব্স্থায়ই) মসজিদে হারামে প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম মালেক বলেন,
শুধু
মসজিদে হারামেই নয়, দুনিয়ার অন্য কোন মসজিদেও তাদের প্রবেশ জায়েজ
নয়। তবে এ শেষোক্ত মতটি সঠিক নয়। কারণ নবী সা. নিজেই তাদের মসজিদে নববীতে আসার
অনুমতি দিয়েছিলেন।
﴿قَاتِلُوا
الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ
مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا
الْكِتَابَ حَتَّىٰ يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَن يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ﴾
২৯। আহলি
কিতাবদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও পরকালের ঈমান আনে না২৬ যা কিছু
আল্লাহ ও তার রসূল গণ্য করেছেন তাকে হারাম করো না২৭ এবং সত্য
দীনকে নিজেদের দীনে পরিণত করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করো যে পর্যন্ত না তারা
নিজের হাতে জিযিয়া দেয় ও পদানত হয়ে থাকে।২৮
২৬. যদিও আহলি কিতাবরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখার
দাবীদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে,না
আখেরাতের প্রতি। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার
অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহ আছে একথা মেনে নেয়া নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে,
মানুষ
আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ ও একমাত্র রব বলে মেনে নেবে এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, অধিকার, ও
ক্ষমতায় নিজেকে বা অন্য কাউকে শরীক করবেনা। কিন্তু খৃস্টান ও ইহুদীরা এ অপরাধে লিপ্ত। পরবর্তী পর্যায়ের আয়াতগুলোতে এ সম্পর্কে
বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই তাদের আল্লাহকে মেনে নেয়ার কথাটা অর্থহীন। একে কোনক্রমেই ঈমান বিল্লাহ বলা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে আখেরাতকে মানার অর্থ মরে যাওয়ার পর
আমাদের আবার উঠানো হবে, শুধু এতটুকু কথার স্বীকৃতি দেয়া নয় বরং এ সংগে
এ কথা মেনে নেয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে,
সেখানে
কোন চেষ্টা তদবীর ও সুপারিশ করা, জরিমানা দেয়া এবং কোন
বুজর্গ ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক ও বন্ধন কোন কাজে লাগবে না। কেউ কারোর পাপের কাফ্ফারা হবে না। আল্লাহর আদালতে ইনসাফ হবে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন এবং মানুষের
ঈমান ও আমল ছাড়া আর কোন জিনিসকে মোটেই মূল্য দেয়া হবে না। এরূপ বিশ্বাস ছাড়া আখেরাতকে মেনে নেয়া অর্থহীন। কিন্তু ইহুদী ও খৃষ্টানরা এ দিক দিয়েই নিজেদের
ঈমান আকিদা নষ্ট করে ফেলেছে। কাজেই তাদের আখেরাতের প্রতি ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।
২৭. অর্থাৎ আল্লাহ তার রসূলের মাধ্যমে যে শরীয়াত নাযিল করেছেন
তাকে নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে না।
২৮. অর্থাৎ তারা ঈমান আনবে ও আল্লাহর সত্য দীনের অনুসারী হয়ে
যাবে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তা নয়। বরং যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ হচ্ছেঃ তাদের কর্তৃত্ব ও
প্রাধান্য খতম হয়ে যাবে।
তারা পৃথীবীতে শাসন ও কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবে না। বরং পৃথিবীতে মানুষের জীবন ব্যব্স্থা লাগাম
এবং মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করা ও তাদের নেতৃত্ব দান করার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সত্যের
অনুসারীদের হাতে থাকবে এবং তারা এ সত্যের অনুসারীদের অধীনে অনুগত জীবন যাপন করবে।
যিম্মীদেরকে ইসলামী শাসনের আওতায় যে নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ দান করা হবে তার
বিনিময়কে জিযিয়া বলা হয়।
তাছাড়া তারা যে হুকুম মেনে চলতে এবং ইসলামী শাসনের আওতাধীনে বসবাস করতে রাজী হয়েছে,
এটা
তার একটি আলামত হিসেবেও চিহ্নিত হবে। নিজের হাতে জিযিয়া দেয় এর অর্থ হচ্ছে,
সহজ,সরল আনুগত্যের ভংগিতে জিযিয়া
আদায় করা। আর পদানত হয়ে থাকে এর অর্থ, পৃথিবীতে
ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের নয় বরং যে মুমিন ও মুসলিমরা আল্লাহর খিলাফত ও
প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করছে তাদের হাতে থাকবে।
প্রথমদিকে ইহুদীও খ্রীষ্টানের কাছ থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নবী সা. নিজে মাজুসীদের
(অগ্নিউপাসক) থেকে জিযিয়া আদায় করে তাদেরকে যিম্মী করেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে আরবের বাইরের সব
জাতির ওপর সাধারণভাবে এ আদেশ প্রয়োগ করেন।
ঊনিশ শতকে মুসলিম মিল্লাতের পতন ও অবনতির যুগে এ জিযিয়া সম্পর্কে মুসলমানদের
পক্ষ থেকে বড় বড় সাফাই পেশ করা হতো। সেই পদাংক অনুসারী কিছু লোক এখনো রয়েছে এবং তারা এখনো এ ব্যাপারে সাফাই
গেয়ে চলেছে। কিন্তু আল্লাহর দীন এসবের
অনেক ঊর্ধে। আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে
যারা বিদ্রোহের ভুমিকায় অবতীর্ণ, তাদোর কাছে কৈফিয়ত দান ও ওযর পেশ করার তার কোন প্রয়োজন
নেই। পরিষ্কার, ও
সোজা কথায়, যারা আল্লাহর দীনকে গ্রহণ করে না এবং নিজেদের
বা অন্যের উদ্ভাবিত ভূল পথে চলে, তারা বড় জোর এতটুকু
স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রাখে যে,
নিজেরা
ভূল পথে চলতে চাইলে চলতে পারে, কিন্তু আল্লাহর যমীনে কোন
একটি জায়গায়ও মানুষের ওপর শাসন চালাবার এবং নিজেদের ভ্রান্তি নীতি অনুযায়ী মানুষের
সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা পরিচালনা করার আদৌ কোন অধিকার তাদের নেই। দুনিয়ার যেখানেই তারা এ জিনিসটি লাভ করবে
সেখানেই বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।তাদেরকে এ অবস্থান থেকে সরিয়ে দিয়ে সৎ ও সত্যনিষ্ঠা জীবন বিধানের অনুগত করার
জন্য প্রচেষ্টা চালানোই হবে মুমিনদের কর্তব্য।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, এ জিযিয়া কিসের বিনিময়ে দেয়? এর
জবার হচ্ছে, ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের আওতাধিনে নিজেদের
গোমরাহীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অমুসলিমদের যে স্বাধীনতা দান করা হয় এটা তারই
মূল্য। আর যে সৎ ও সত্যানিষ্ঠা
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তাদের এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগাবার অনুমতি দেয় এবং তাদের
অধিকার সংরক্ষন করে তার শাসণ ও আইন-শৃংখলা ব্যবস্থা পরিচালনায় এ অর্থ ব্যয়ীত হওয়া
উচিত। এর সবচেয়ে বড় ফায়দা হচ্ছে
এই যে, জিযিয়া আদায় করার সময় প্রতি বছর যিম্মীদের মধ্যে একটা
অনুভুতি জাগতে থাকবে।
প্রতি বছর তারা মনে করতে থাকবে,তারা আল্লাহর পথে যাকাত
দেবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত আর এর পরিবর্তে গোমরাহীও ভ্রষ্টতার ওপর প্রতিষ্টিত
থাকার জন্য তাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। এটা তাদের কত বড় দুর্ভাগ্য। এ দুর্ভাগ্যের কারাগারে তারা বন্দী।
﴿وَقَالَتِ
الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ
ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن
قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾
৩০। ইহুদীরা
বলে, উযাইর
আল্লাহর পুত্র২৯ এবং খৃস্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র।এগুলো
একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা। তাদের
পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে
উচ্চারণ করে থাকে।৩০ আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের
ওপর, তারা কোথা
থেকে ধোকা খাচ্ছে!
২৯. উযাইর বলা হয়েছে "আযরা"কে (EZRA) ইহুদীরা তাঁকে নিজেদের ধর্মের মুজাদ্দিদ বা পুনরুজ্জীবনকারি বলে মানে।তিনি খ্রীষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ের
লোক ছিলেন বলে মনে করা হয়।ইসরাঈলী বর্ণনা অনুযায়ী হযরত সুলাইমান আ. এর পরে বনী ইসরাঈলের ওপর যে কঠিন
দুর্যোগ নেমে আসে তার ফলে শুধু যে তাওরাত দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল, তা
নয়, বরং বেবিলনের বন্দী জীবন যাপন ইসরাঈলী জনগণকে তাদের শরীয়াত
ঐতিহ্য, এবং জাতিয় ভাষা ইবরানীর সাথে পর্যন্ত অপরিচিত
করে দিয়েছিল। অবশেষে এ উযাইর বা আযরা
বাইবেলের আদি পুস্তক সংকলন করেন। তিনি শরীয়াতকে পুনরুজ্জীবিত করেন্ এ কারণেই বনী ইসরাঈল তাকে অত্যাধিক ভক্তি
করে। এ ভক্তি এতদূর বেড়ে যায় যে, কোন
কোন দল তাকে আল্লাহর পুত্র পর্যন্ত বানিয়ে দেয়। এখানে কুরআন মজীদের বক্তব্য এ নয় যে, সমস্ত
ইহুদী জাতি একজোট হয়ে আযরাকে আল্লাহর পুত্র বানিয়েছে। বরং কুরআন বলতে চায় ইহুদীদের আল্লাহ সম্পর্কিত বিশ্বাসের
এত বেশী গলদ দেখা দেয় যে, আযরাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করার মতো লোকও
তাদের সমাজে পয়দা হয়ে যায়।
৩০. অর্থাৎ মিসর, গ্রীস, রোম, ইরান, এবং অন্যান্য দেশে যেসব জাতি আগেই পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাদে পৌরিনিক ধ্যান-ধারনা ও অলিক চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে তারাও তেমনি ধরনের ভ্রষ্ট আকীদা-বিশ্বাস তৈরী করে নিতো। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আল মায়েদাহ ১০১ টীকা)
﴿اتَّخَذُوا
أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ
ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
৩১। তারা
আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে।৩১ এবং এভাবে
মারয়াম পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদের মা’বুদ ছাড়া আর
কারোর বন্দেগী কারার হুকুম দেয়া হয়নি, এমন এক মাবুদ যিনি ছাড়া ইবাদত লাভের
যোগ্যতা সম্পন্ন আর কেউ নেই। তারা যেসব মুশরিকী কথা বলে
তা থেকে তিনি পাক পবিত্র।
৩১. হাদীসে বলা হয়েছে হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী সা. এর কাছে এসে
ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খৃস্টান। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তিনি নবী সা. কে কয়েকটি
প্রশ্ন করেন।এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের
এ আয়াতটিতে আমাদের বিরুদ্ধে উলামা ও দরবেশদেরকে খোদা বানিয়ে নেবার যে দোষারূপ
করা হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য কি? জবাবে তিনি বলেন, তারা
যেগুলোকে হারাম বলতো তোমরা সেগুলোকে হারাম বলে মেনে নিতে এবং তারা যেগুলোকে
হালাল বলতো তোমরা সেগুলোকে হালাল বলে মেনে নিতে, একথা
কি সত্য নয়? জবাবে হযরত আদী বলেন,
হাঁ, একথা
তো ঠিক, আমরা অবশ্যি এমনটি করতাম। রসূলুল্লাহ সা.বলেন,
বস, এটিই
তো হচ্ছে তোমাদে প্রভু বানিয়ে নেয়া। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর
কিতাবের সনদ ছাড়াই যারা মানব জীবনের জন্য জায়েয ও নাজায়েযের সীমানা নির্ধারণ করে
তারা আসলে নিজেদের ধারণা মতে নিজেরাই আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদায়
সমাসীন হয়। আর যারা শরীয়াতের বিধি
রচনার এ অধিকার তাদের জন্য স্বীকার করে নেয় তারা তাদেরকে কার্যত প্রভুতে পরিণত করে।
কাউকে আল্লাহর পুত্রে পরিণত করা এবং কাউকে শরীয়ত রচনার অধিকার দেয়া সংক্রান্ত
অভিযোগ দু'টি পেশ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, তাদের
আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী মিথ্যা। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাদের আল্লাহর সম্পর্কিত ধারণা এতই
ভ্রান্ত যে, তার কারণে তাদের আল্লাহকে মানা, না
মানা সমান হয়ে গেছে।
﴿يُرِيدُونَ
أَن يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَن يُتِمَّ
نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ﴾
৩২। তারা চায়
তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে। কিন্তু
আল্লাহ তার আলোকে পূর্ণতা দান না করে ক্ষান্ত হবেন না, তা কাফেরদের কাছে যতই
অপ্রীতিকর হোক না কেন।
﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ
بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾
৩৩। আল্লাহই
তার রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দীনের
ওপর বিজয়ী করেন,৩২ মুশরিকরা
একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।
৩২. কুরআনের মূল আয়াতে "আদদীন" শব্দ ব্যববহার করা
হয়েছে। আমি এর অনুবাদে বলেছি, সকল
প্রকার দীন ইতিপূর্বে যেমন বলে এসেছি,
এ
দীন শব্দটি আরবী ভাষায় এমন একটি জীবন ব্যবস্থা বা জীবন পদ্ধতি অর্থে ব্যবহৃত হয়
যার প্রতিষ্ঠাতাকে সনদ ও অনুসরণযোগ্য বলে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করতে হয়। কাজেই এ আয়াতে রসূল পাঠাবার উদ্দেশ্য বর্ণনা
করে বলা হয়েছে দীন জাতীয় বা দীনের শ্রেনীভুক্ত অন্য কথায় জীবন বিধান পদবাচ্য সমস্ত
পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ওপর জয়ী করবেন। অন্য কথায় রসূলের কখনো এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি যে, তিনি যে জীবন ব্যব্স্থা নিয়ে এসেছেন তা অন্যান্য জীবন ব্যবস্থার
কাছে পরাজিত হয়ে ও সেগুলোর পদানত থেকে তাদের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করার মধ্যে
নিজেকে সীমাবদ্ধ ও সংকোচিত করে রাখবে। রবং তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতির প্রতিনিধি হয়ে আসেন এবং নিজের
মনিবের সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থাকে বিজয়ী দেখতে চান। দুনিয়ায় যদি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে তাহলে
তাকে আল্লাহর ব্যবস্থার আওতাধিনেই তার দেয়া সুযোগ-সুবিধা হাত পেতে নিয়ে বেঁচে
থাকতে হবে। যেমন জিযিয়া আদায় করার
মাধ্যমে যিম্মিরা নিজেদের অধীনতার জীবন মেনে নেয়। (দেখুন আয যুমার ৩টীকা,আল মুমিন ৪৩ টীকা, আশ
শূরা ২০ টীকা)
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ
أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ
الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ
أَلِيمٍ﴾
৩৪। হে
ঈমানদারগণ! এ আহলে কিতাবদের অধিকাংশ আলেম ও দরবেশের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়
পদ্ধতিতে খায়, এবং
তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে।৩৩ যারা সোনা
রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রনাময় আযাবের
সুখবর দাও।
৩৩. অর্থাৎ এ জালেমরা শুধু ফতোয়া বিক্রি করে, ঘুষ
খেয়ে এবং নজরানা লুটে নিয়েই ক্ষন্ত হয় না। এ সংগে তারা এমন সব ধর্মীয় নিয়ম-কানুন ও রসম-রেওয়াজ উদ্ভাবন
ও প্রবর্তন করে যেগুলোর সাহায্যে লোকেরা তাদের কাছ থেকে নিজেদের পরকালীন মুক্তি
কিনে নেয়। তাদের উদর পূর্তি না করলে
লোকের জীবন-মরণ বিয়ে-শাদী এবং আনন্দও বিষাদ কোন অবস্থাই অতিবাহিত হতে পারে না। তারা এদেরকে নিজেদের ভাগ্য ভংগা-গড়ার একচ্ছত্র
ক্ষমতার অধিকারী মনে করে।
উপরন্তু নিজেরদের এমনসব স্বার্থ উদ্ধারের মতলব তারা আল্লাহর বান্দাদেরকে
গোমরাহীতে লিপ্ত করে রাখে। যখনই কোন সত্যের দাওয়াত সমাজের সংশোধনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে তখনই সবার আগে
এরাই নিজেদের জ্ঞানীসূলভ প্রতারণা ও ধান্দাবাজীর অস্ত্র ব্যবহার করে তার পথ রোধ
করে দাঁড়ায়।
﴿يَوْمَ
يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ
وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ﴾
৩৫। একদিন
আসবে যখন এ সোনা ও রূপাকে জাহান্নামের আগুণে উত্তপ্ত করা হবে, অতপর তারই সাহায্যে তাদের
কপালে, পার্শ্বদেশে
ও পিঠে দাগ দেয়া হবে-এ সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। নাও, এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের
স্বাদ গ্রহণ কর।
﴿إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ
عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا
فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ ۚ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ
كَافَّةً ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ﴾
৩৬। আসলে যখন
আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই আল্লাহর লিখন ও গণনায় মাসের সংখ্যা
বারো চলে আসছে।৩৪ এর মধ্যে চারটি হারাম মাস। এটিই সঠিক
বিধান। কাজেই এ চার মাসের নিজেদের ওপর জুলুম
করো না।৩৫ আর মুশরিকদের সাথে সবাই মিলে
লড়াই করো যেমন তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করে।৩৬ এবং জেনে
রাখো আল্লাহ মুক্তাকীদের সাথেই আছেন।
৩৪. অর্থাৎ যখন আল্লাহ চাঁদ, সূর্য
ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই এ হিসাবও চলে আসছে যে, প্রতি
মাসে প্রথমার চাঁদ একবারই উঠে। এ হিসাবে এক বছরে ১২ মাস হয়। একথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, আরবের লোকেরা 'নাসী'র
কারণে১৩ বা ১৪ মাসে বছর বানিয়ে ফেলতো। যে হারাম মাসকে তারা হালাল করে নিয়েছে তাকে এভাবে বছরের পঞ্জিকায় জায়গা দেবার
ব্যবস্থা করতো। সামনের দিকেও এ বিষয়টির
আরো ব্যাখ্যা করা হবে।
৩৫. অর্থাৎ যেসব উপযোগিতা ও কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে এ
মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম করা হয়েছে সেগুলোকে নষ্ট করো না। এবং এ দিনগুলোতে শান্তি ভংগ করে বিশৃংখলা
ছড়িয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। চারটি হারাম মাস বলতে যিলকদ্দ,
যিল
হজ্জ ও মহররম মাসে হজ্জের জন্যে এবং উমরাহের জন্য রজব মাস।
৩৬. অর্থাৎ মুশরিকরা যদি উল্লেখিত মাসগুলোতে লড়াই থেকে বিরত না
হয় তাহলে তারা যেমন একমত ও একজোট হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, তোমরাও
তেমনি একমত ও একজোট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়ো। সূরা আল বাকারার ১৯৪ আয়াতটির এর ব্যাখ্যা পেশ করেছে।
﴿إِنَّمَا
النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ ۖ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ
عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِّيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا
مَا حَرَّمَ اللَّهُ ۚ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي
الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾
৩৭। “নাসী”
(মাসকে পিছিয়ে দেয়া) তো কুফরীর মধ্যে আরো একটি কুফরী কর্ম, যার সাহায্যে এ কাফেদের কে
ভ্রষ্টতায় লিপ্ত করা হয়ে থাকে। কোন বছর একটি মাসকে হালাল
করে নেয় এবং কোন বছর তাকে আবার হারাম করে নেয়, যাতে আল্লাহর হারাম মাসের
সংখ্যাও পুরা করতে পারে এবং আল্লাহর হারাম করাকেও হালাল করতে পারে।৩৭ তাদের
খারাপ কাজগুলোকে তাদের জন্য শোভনীয় করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ
সত্য-অস্বীকারকারীদেরকে হেদায়াত দান করেন না।
৩৭. আরবের 'নাসী' ছিল
দু ধরনের। এক নাসীর প্রেক্ষিতে
আরববাসীরা যুদ্ধ বিগ্রহ,লুট-তরাজ ও হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য কোন হারাম মাসকে হালাল গণ্য
করতো এবং তার বদলে কোন হালাল মাসকে হারাম গণ্য করে হারাম মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ
করতো। আর দ্বিতীয় ধরনের নাসীর
প্রেক্ষিতে তারা চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষ সদৃশ করার জন্য তাতে কাবীসা নামে একটা মাস
বাড়িয়ে দিতো। তাদের উদ্দেশ্যে হতো, এভাবে
হজ্জ সবসময় একই মওসুমে অনুষ্ঠিত হতে থাকবে। ফলে চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী বিভিন্ন মওসুমে হজ্জ অনুষ্ঠিত
হবার ফলে তাদের যে কষ্ট করতে হতো তা থেকে তারা রেহাই পাবে। এভাবে ৩৩ বছর ধরে হজ্জ তার আসল সময়ে অনুষ্ঠিত না হয়ে অন্য
তারিখে অনুষ্ঠিত হতো এবং শুধুমাত্র ৩৪ বছরের মাথায় একবার যিল হজ্জ মাসের ৯-১০
তারিখে অনুষ্ঠিত হতো।
নবী সা. বিদায় হজ্জের সময় তার প্রদত্ত খুতবায় একথাটিই ছিলেনঃ
إنَّ الزَّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ
كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّه السَّماواتِ والأَرْضَ
"এ বছর হজ্জের সময় ঘুরতে
ঘুরতে ঠিক তার প্রকৃত হিসেব অনুযায়ী আসল তারিখে এসে গেছে।"
এ আযাতে 'নাসী'কে নিষিদ্ধ ও হারাম গণ্য করে
আরবের মুর্খ লোকদের উল্লেখিত দুটি উদ্দেশ্য ও স্বার্থন্বেষণকেই বাতিল করে দেয়া
হয়েছে। প্রথম উদ্দেশ্যটি তো একটি
সুষ্পষ্ট গুনাহ ছিল। এ
ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। এর অর্থ তো এটাই ছিল, আল্লাহর হারাম করা জিনিসকে হালালও করে নেয়া হবে
আবার কৌশল করে আইন মেনে চলার একটি বহিকাঠামোও তৈরী করে রেখে দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ
ও কল্যাণ ভিত্তিক মনে হলেও আসলে এটাও ছিল আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম
বিদ্রোহ। মহান আল্লাহ তার আরোপিত
ফরযগুলোর জন্য সৌরবর্ষের হিসেবের পরিবর্তে চান্দ্রবর্ষের হিসাব অবলম্বন করেছেন
যেসব গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে তিনি এসব করেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে, তার
বান্দা কালের সকল প্রকার আবর্তনের ম্ধ্যে সব রকমের অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে তার
হুকুম আহকাম মেনে চলতে অভ্যস্ত হবে।যেমন রমযান,কখনো আসে গরমকালে, কখনো
বর্ষাকালে আবার কখনো শীতকালে। ঈমানদাররা এসব পরিবর্তিত অবস্থায় রোযা রেখে অনুগত থাকার প্রমাণও পেশ করে এবং
এ সংগে সর্বোত্তম নৈতিক প্রশিক্ষণও লাভ করে। অনুরূপভাবে হজ্জও চান্দ্রমাসের হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন
মওসুমে আসে। এসব মওসুমের ভালো-মন্দ সব
ধরনের অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সফর করে বান্দা আল্লাহর
পরীক্ষায় পুরোপুরি উতরে যায় এবং বন্দেগীর ক্ষেত্রে পরিপক্কতা অর্জন করে। এখন যদি এক দল লোক নিজেদের সফর, ব্যবসা-বাণিজ্য
ও মেলা-পার্বনের সুবিধার্থে চিরদিনের জন্য অনুকূল মওসুমে হজ্জের প্রচলন করে, তাহলে
সেটা হবে এরূপ যেন মুসলমানরা কোন সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নিলযে, আগামী
থেকে রমযান মাসকে ডিসেম্বর বা জানুয়ারীর সাথে মিলিয়ে দেয়া হবে। এর পরিষ্কার মানে দাঁড়ায়, বান্দারা
আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেরাই স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে। এ জিনিসটিরই নাম কুফরী। এছাড়াও একটি বিশ্বজনীন দীন ও জীবন ব্যবস্থা, যা
সমগ্র মানব জাতির জন্য এসেছে তা কেন সৌরমাসকে রোযা ও হজ্জের জন্য নির্ধারিত করবে? যে
মাসটিই নির্ধারিত হবে সেটিই পৃথিবীর সব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য সমান সুবিধাজনক
মওসুম হবে না। কোথাও তা পড়বে গরম কালে, কোথাও
পড়তে, শীতকালে, কোথাও তখন হবে বর্ষাকাল, কোথাও
হবে খরার মওসুম কোথাও তখন ফসল কাটার কাজ চলবে আবার কোথাও চলবে বীজ বপন করার কাজ।
এ সংগে একথাও মনে রাখতে হবে যে,
৯হিজরীর
হজ্জের সময় 'নাসী'বাতিল করার এ ঘোষনা দেয়া
হয়েছিল। পরের বছর ১০ হিজরীতে
চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী ঠিক নির্ধারিত তারিখেই হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সঠিক তারিখেই হজ্জ
অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ
إِلَى الْأَرْضِ ۚ أَرَضِيتُم بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ ۚ فَمَا مَتَاعُ
الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ﴾
৩৮। হে
ঈমানদারগণ!৩৮ তোমাদের
কী হলো, যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, অমনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে
থাকলে? তোমরা কি
আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে
রেখো, দুনিয়ার
জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে।৩৯
৩৮. তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালে যে ভাষণটি নাযিল হয়েছিল
এখান থেকে সেটিই শুরু হচ্ছে।
৩৯. এর দুটো অর্থ হতে পারে।
একঃ
আখেরাতের
অনন্ত জীবন ও সেখানকার সীমা-সংখ্যাহীন সাজ সরঞ্জাম দেখার পর তোমরা জানতে পারবে, দুনিয়ার
সামান্য জীবনকালে সুঐশ্বর্য ভোগের যে বড় বড় সম্ভবনা তোমাদের করায়ত্ব ছিল এবং যে
সর্বাধিক পরিমানে বিলাস সামগ্রী তোমরা লাভ করতে পেরেছিলে তা আখেরাতের সেই সীমাহীন
সম্ভবনা এবং সেই অন্তহীন নিয়ামতে পরিপূর্ণ সুবিশাল রাজ্যের তুলনায় কিছুই নয়। তখন তোমরা নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টি ও
অদূরদর্শিতার জন্য এ মর্মে আফসোস করতে থাকবে,
যে, আমরা
হাজার বুঝানো সত্ত্বেও দুনিয়ার তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী লাভের মোহে তোমরা কেন
নিজেদেরকে এ চিরন্তন ও বিপুল পরিমাণ লাভ থেকে বঞ্চিত রাখলে।
দুইঃ
দুনিয়ার
জীবনের সামগ্রি আখেরাতে কোন কাজে লাগবে না। এখানে যতই ঐশ্বর্য সম্পদ ও সাজ-সরঞ্জাম তোমরা সংগ্রহ করো
না কেন, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথেই সব কিছু
থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হবে। মৃত্যুর পরপারে যে জগত রয়েছে এখানকার কোন জিনিসই সেখানে তোমাদের সাথে
স্থানাস্তরিত হবে না।
এখানকার জিনিসের যে অংশটুকু তোমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কুরবানী করেছো
এবং যে জিনিসকে ভালবাসার ওপর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর দীনের প্রতি ভালোবাসাকে
প্রাধান্য দিয়েছো একমাত্র সেই অংশই তোমরা সেখানে পেতে পারো।
﴿إِلَّا
تَنفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا
تَضُرُّوهُ شَيْئًا ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৩৯। তোমরা
যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন৪০ এবং
তোমাদের জায়গায় আর একটি দলকে ওঠাবেন,৪১ আর তোমরা আল্লাহর কোন ক্ষতি
করতে পারবে না। তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
৪০. এ থেকেই শরীয়াতের এ বিধি জানা যায় যে, যতক্ষণ
পর্যন্ত কোন সাধারণ ঘোষণা (যুদ্ধ করার জন্য সর্বসাধারণ মুসলমানদেরকে আহবান
জানানো) না দেয়া হবে কিংবা কোন এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসীকে বা মূলসমানদের কোন
দলকে জিহাদের জন্য বের হবার হুকুম দেয়া না হবে ততক্ষণ তো জিহাদ ফরযে কিফায়াই থাকে। অর্থাৎ যদি কিছু লোক জিহাদ করতে থাকে তাহলে
বাদবাকি লোকদের ওপর থেকে ঐ ফরয রহিত হয়ে যাবে। কিন্তু যখন মুসলমানদের শাসকের পক্ষ থেকে মুসলমানদেরকে
সর্বাত্মক জিহাদের জন্য আহবান জানানো হবে অথবা কোন বিশেষ দলকে বা বিশেষ এলাকার
অধিবাসীদেরকে ডাকা হবে তখন যাদেরকে ডাকা হয়েছে তাদের ওপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে
যাবেএমনকি যে ব্যক্তি কোন যথার্থ অসুবিধা বা ওযর ছাড়া জিহাদে অংশগ্রহণ করবে না
তার ঈমানই গ্রহণযোগ্য হবে না।
৪১. অর্থাৎ আল্লাহর কাজ তোমাদের উপর নির্ভরশিল নয়। তোমরা করলে তা হবে এবং তোমরা না করলে তা হবে
না এমন নয়। আসলেআল্লাহ যে তোমাদের তাঁর
দীনের খেদমতের সুযোগ দিচ্ছেন, এটা তাঁর মেহেরবানী ও
অনুগ্রহ। যদি তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার
কারণে এ সুযোগ হারাও, তাহলে তিনি অন্য কোন জাতিকে এ সুযোগ দেবেন এবং
তোমরা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
﴿إِلَّا
تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ
إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا
ۖ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ
كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَىٰ ۗ وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا ۗ وَاللَّهُ
عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
৪০। তোমরা
যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই। আল্লাহ
তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের
মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা
দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।৪২ সে সময়
আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল
পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নীচু করে দেন। আর
আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই।আল্লাহ পরাক্রমশালী ও
প্রজ্ঞাময়।
৪২. মক্কার কাফেররা যখন নবী সা. কে হত্যা করার চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিল, এটা সে সময়ের কথা। যে রাতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে
রাতেই তিনি মক্কা থেকে বের হয়ে মদীনার দিকে হিজরত করেছিলেন। ইতিপূর্বে দুজন চারজন করে যেতে যেতে মুসলমানদের বেশীর ভাগ
মদীনায় পৌছে গিয়েছিল।
মক্কায় কেবলমাত্র তারাই থেকে গিয়েছিল যারা ছিল একেবারেই অসহায় অথবা যাদের ঈমানের
মধ্যে মোনাফেকীর মিশ্রণ ছিল এবং তাদের ওপর কোন প্রকারে ভরসা করা যেতে পারতো না। এ অবস্থায় যখন তিনি জানতে পারলেন,তাকে
হত্যা করার সিন্ধান্ত হয়ে গেছে, তখন তিনি শুধুমাত্র একজন
সাথী হযরত আবু বকরকেরা. সংগে নিয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে পড়লেন। নিশ্চয়ই তার পেছনে ধাওয়া করা হবে, এ
ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি মদিনার পথ ছেড়ে (যা ছিল উত্তরের দিকে) দক্ষিণের পথ
অবলম্বন করলেন।এখানে তিন দিন সাওর নামক
পর্বত গুহায় আত্মগোপন করে থাকলেন। তাঁর রক্ত পিপাসু দুশমনেরা তাঁকে চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মক্কার আশপাশের উপত্যকগুলোর কোন জায়গা
খুঁজতে তারা বাকী রাখেনি।
এভাবে তাদের কয়েকজন খুঁজতে খুঁজতে যে গিরি গুহায় তিনি লুকিয়েছিলেন তার মুখে পৌছে
গেলো। হযরত আবু বরকরা. ভীষণ ভয়
পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, দুশমনদের
একজন যদি একটু ভিতরে ঢুকে উকি দেয়,
তাহলে
তাদের দেখে ফেলবে।কিন্তু নবী সা.একটুও বিচলিত
না হয়ে হযরত আবু বকরসা. কে এ বলে সান্তনা দিলেন, "চিন্তিত হয়ো না, মন খারাপ করো না, আল্লাহ
আমাদের সাথে আছেন"।
﴿انفِرُوا
خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
৪১।-বের হও, হালকা, কিংবা ভারী যাই হওনা কেন, এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে
নিজের ধন-প্রাণ দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়
যদি তোমরা জানতে।৪৩
৪৩. এখানে হালকা ও ভারী শব্দ দুটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর অর্থ হচ্ছে,
বের
হবার হুকুম যখন হয়ে গেছে তখন তোমাদের বের হয়ে পড়তে হবে। স্বেচ্চায় ও সাগ্রহে হোক বা অনিচ্ছায়-অনাগ্রহে,সচ্ছলতায়
ও সমৃদ্ধির মধ্যে হোক বা দারিদ্রের মধ্যে,
বিপুল
পরিমাণ সাজসরঞ্জাম থাক বা একাবারে নিঃসম্বল অবস্থায় হোক,অনুকূল অবস্থা হোক বা প্রতিকূল
অবস্থা, যৌবন ও সুস্বাস্থের অধিকরী হও, বা
বৃদ্ধ দুর্বল হও, সর্বাবস্থায় বের হতে হবে।
﴿لَوْ كَانَ
عَرَضًا قَرِيبًا وَسَفَرًا قَاصِدًا لَّاتَّبَعُوكَ وَلَٰكِن بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ
الشُّقَّةُ ۚ وَسَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَوِ اسْتَطَعْنَا لَخَرَجْنَا مَعَكُمْ يُهْلِكُونَ
أَنفُسَهُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ﴾
৪২। হে নবী!
যদি সহজ লাভের সম্ভবনা থাকতো এবং সফর হালকা হতো, তাহলে তারা নিশ্চয়ই তোমার
পেছনে চলতে উদ্যত হতো। কিন্তু তাদের জন্য তো এ পথ
বড়ই কঠিন হয়ে গেছে।৪৪ এখন তারা
আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে বলবে, যদি আমরা চলতে পারতাম তাহলে অবশ্যি
তোমাদের সাথে চলতাম। তারা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে
ঠেলে দিচ্ছে। আল্লাহ ভালো করেই জানেন তারা মিথ্যাবাদী।
৪৪. অর্থাৎ মোকাবিলা রোমের মতো বড় শক্তির সাথে। একদিকে প্রচন্ড গ্রীষ্মের মওসুম এসে গেছে এবং
দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। তার ওপর নতুন বছরের বহু প্রত্যাশিত ফসল কাটার সময় এসে গেছে। এসব কারণে তাবুকের সফর তাদের কাছে বড়ই কঠিন ও
চড়ামূল্যের বলে মনে হচ্ছিল।
﴿عَفَا
اللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَتَعْلَمَ
الْكَاذِبِينَ﴾
৪৩। হে নবী!
আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন, তুমি তাদের অব্যাহতি দিলে কেন? (তোমরা নিজের তাদের অব্যাহতি
না দেয়া উচিত ছিল) এভাবে তুমি জানতে পারতে কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যুক।৪৫
৪৫. কোন কোন মুনাফিক বানোয়াট ওযর পেশ করে নবী সা. এর কাছে
যুদ্ধে যাওয়া থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল। তিনিও নিজের স্বভাবগত কোমলতা ও উদারতার ভিত্তিতে তারা যে নিছক ভাওতাবাজী
করেছে, তা জান সত্ত্বেও তাদের অব্যাহতি দিয়েছিলেন।কিন্তু আল্লাহ এটা পছন্দ করেননি। এ ধরনের উদার নীতি সংগত নয় বলে তাকে সতর্ক করে
দিয়েছিলেন।অব্যাহতি দেবার কারণে এ
মুনাফিকরা নিজেদের মুনাফীকী ও প্রতারণামূলক কার্যকলাপ গোপন করার সুযোগ পেয়ে
গেলো। যদি তাদের অব্যহতি না দেয়া
হতো এবং তারপর তারা ঘরে বসে থাকতো তাহলে তখন তাদের মিথ্যা ঈমানের দাবী
সর্বসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়তো।
﴿لَا يَسْتَأْذِنُكَ
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ
وَأَنفُسِهِمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ﴾
৪৪। যারা
আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, তারা কখনো তোমার কাছে তাদের ধনও প্রাণ
দিয়ে জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন জানাবে না। আল্লাহ
মুত্তাকীদের খুব ভাল করে জানেন।
﴿إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ
الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ
فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ﴾
৪৫। এমন আবেদন
তো একমাত্র তারাই করে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে না, যাদের মনে রয়েছে সন্দেহ এবং এ
সন্দেহের দোলায় তারা দোদুল্যমান।৪৬
৪৬. এ থেকে জানা যায়,
ইসলাম
ও কুফরীর দ্বন্ধ একটি মাপকাঠি স্বরূপ।এর মাধ্যমে খাঁটি মুমিন ও নকল ঈমানের দাবীদারের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।এ দ্বন্ধ ও সংঘাতে যে ব্যক্তি মনপ্রাণ দিয়ে
ইসলামকে সমর্থন করে এবং নিজের সমস্ত শক্তি সামর্থ ও উপায় উপকরণ তাকে বিজয়ী করার সংগ্রামে
নিয়োজিত করে এবং এ পথে কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয় না, সেই
সাচ্চা মুমিন। পক্ষান্তরে এ দ্বন্দ্ব ও
সংঘাতে যে ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করতে ইতস্তত করে এবং কুফরের শির উচু
হবার বিপদ সামনে দেখেও ইসলামের বিজয়ের জন্য জান-মালের কুরবানী করতে কুণ্ঠিত হয়, তার
মনোভাব ও কার্যকলাপ এ সত্যটিকে সুষ্পষ্ট করে দেয়, যে
তার অন্তরে ঈমান নেই।
﴿وَلَوْ
أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَٰكِن كَرِهَ اللَّهُ انبِعَاثَهُمْ
فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ﴾
৪৬। যদি সত্যি
সত্যিই তাদের বের হবার ইচ্ছা থাকতো তাহলে তারা সে জন্য কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ
করতো। কিন্তু তাদের অংশগ্রহণ আল্লাহ কাছে
পছন্দনীয় ছিল না।৪৭ তাই তিনি তাদের শিথিল করে
দিলেন এবং বলে দেয়া হলোঃ বসে থাকো, যারা বসে আছে তাদের সাথে।
৪৭. অর্থাৎ মনের তাগিদ ছাড়া অনিচ্ছায় যুদ্ধযাত্রা আল্লাহর কাছে
পছন্দনীয় ছিল না।কারণ তাদের মধ্যে যখন জিহাদে
অংশগ্রহণ করার প্রেরণা ও সংকল্প অনুপস্থিত ছিল এবং ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রাণপাত
করার কোন ইচ্চাই তাদের ছিল না তখন শুধুমাত্র মুসলমানদের সামনে লজ্জিত হবার ভয়ে
অসন্তুষ্ট মনে অথবা কোন অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে তারা জোরেশোরে এগিয়ে আসতো এবং
এটা সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতো। পরবর্তী আয়াতে বিষয়টি পরিস্কার করে বলা হয়েছে।
﴿لَوْ خَرَجُوا
فِيكُم مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ
الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ﴾
৪৭। যদি তারা
তোমাদের সাথে বের হতো তাহলে তোমাদের মধ্যে অনিষ্ট ছাড়া আর কিছুই বাড়াতো না। তারা
ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে প্রচেষ্টা চালাতো। আর
তোমাদের লোকদের অবস্থা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এখনো এমন লোক আছে যারা
তাদের কথা আড়ি পেতে শোনে। আল্লাহ এ জালেমদের খুব ভাল
করেই চেনেন।
﴿لَقَدِ ابْتَغَوُا الْفِتْنَةَ
مِن قَبْلُ وَقَلَّبُوا لَكَ الْأُمُورَ حَتَّىٰ جَاءَ الْحَقُّ وَظَهَرَ أَمْرُ اللَّهِ
وَهُمْ كَارِهُونَ﴾
৪৮। এর আগেও এরা
ফিতনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এবং তোমাদের ব্যর্থ করার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন
ধরনের কৌশল খাটিয়েছে। এ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত
তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সত্য এসে গেছে এবং আল্লাহ উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
﴿وَمِنْهُم مَّن يَقُولُ ائْذَن
لِّي وَلَا تَفْتِنِّي ۚ أَلَا فِي الْفِتْنَةِ سَقَطُوا ۗ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ
بِالْكَافِرِينَ﴾
৪৯। তাদের
মধ্যে এমন লোকও আছে, যে বলে আমাকে অব্যাহতি দিন এবং আমাকে পাপের ঝুঁকির মধ্যে
ফেলবেন না।৪৮ শুনে রাখো, এরা তো ঝুঁকির মধ্যেই পড়ে
আছে৪৯ এবং
জাহান্নাম এ কাফেরদের ঘিরে রেখেছে।৫০
৪৮. যেসব মুনাফিক মিথ্যা বানিয়ে পিছনে থেকে যাবার অনুমতি
চাচ্ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এতই বেপরোয়া ছিল যে, আল্লাহর
পথ থেকে পেছনে সরে যাবার জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক ধরনের বাহানাবাজীর আশ্রয় নিতো। জাদ্দ ইবনে কায়েস নামক তাদের একজনের সম্পর্কে
হাদীসে বলা হয়েছেঃ সে নবী সা. এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলো, আমি
একজন সৌন্দর্য পিপাসু লোক আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার এ দুর্বলতা জানে যে,
মেয়েদের
ব্যাপারে আমি সবর করতে পারি না। আমার ভয় হয়, রোমান মেয়েদের দেখে আমার পদস্খলন না হয়ে যায়। কাজেই আপনি আমাকে ঝুকির মধ্যে ঠেলে দেবেন না। এবং এ অক্ষমতার কারণে আমাকে এ জিহাদে অংশগ্রহণ
করা থেকে রেহাই দিন।
৪৯. অর্থাৎ তারা তো ফিতনা বা পাপের ঝুঁকি থেকে রেহাই পাওয়ার
দুহাই দিচ্ছে কিন্তু আসলে তারা আকন্ঠ্ ডুবে আছে মুনাফিকী, মিথ্যাচার
ও রিয়াকারীর মত জঘন্য পাপের মধ্যে। নিজেদের ধারণা মতে তারা মনে করেছে,
ছোট
ছোট ফিতনার সম্ভবনার ব্যাপারে ভয় ও পেরেশানি প্রকাশ করে তারা নিজেদের বড় ধরনের
মুত্তাকী হবার প্রামাণ পেশ করে যাচ্ছে। অথচ কুফর ও ইসলামের চুড়ান্ত ও সিদ্ধান্তকর সংঘর্ষকালে ইসলামের পক্ষ সমর্থনে
ইতস্তত করে তারা আরো বড় পাপ এবং আরো বড় ফিতনার মধ্যে নিজেদের ফেলে দিচ্ছে যার
চাইতে বড় কোন ফিতনার কথা কল্পনাই করা যায় না।
৫০. অর্থাৎ তাকওয়ার এ প্রদর্শনী তাদের জাহান্নাম থেকে দূরে
সরিয়ে রাখেনি। বরং মুনাফিকী লানতই তাদেরকে
জাহান্নামের করাল গ্রাসে নিক্ষেপ করেছে।
﴿إِن تُصِبْكَ
حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ ۖ وَإِن تُصِبْكَ مُصِيبَةٌ يَقُولُوا قَدْ أَخَذْنَا أَمْرَنَا
مِن قَبْلُ وَيَتَوَلَّوا وَّهُمْ فَرِحُونَ﴾
৫০। তোমরা
ভাল কিছু হলে তা তাদের কষ্ট দেয় এবং তোমার ওপর কোন বিপদ এলে তারা খুশী মনে সরে
পড়ে এবং বলতে থাকে, “ভালই হয়েছে, আমরা আগে ভাগেই আমাদের
ব্যাপার সেরে নিয়েছি”।
﴿قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا
مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾
৫১। তাদের বলে
দাও, “আল্লাহ
আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোন (ভাল বা মন্দ) কিছুই
আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক
এবং ঈমানদরদের তাঁর ওপরই ভরসা করা উচিত”।৫১
৫১. এখানে দুনিয়াপূজারী ও আল্লাহ বিশ্বাসী মানসিকতার পার্থক্য
সুস্পষ্ট করে তূলে ধারা হয়েছে। দুনিয়া পূজারী নিজের প্রবৃত্তির আকাংখা পূর্ণ করার জন্য সবকিছু করে। কোন বৈষয়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ওপরই তার
প্রবৃত্তির সুখ ও আনন্দ নির্ভর করে।এ উদ্দেশ্য লাভে সক্ষম হলেই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আর উদ্দেশ্য লাভে ব্যার্থ হলে সে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। তারপর বস্তুগত কার্যকারণই প্রায় তার সমস্ত
সহায় অবলম্বনের কাজ করে।
সেগুলো অনুকূল হলে তা মনোবল বেড়ে যেতে থাকে। আর প্রতিকূল হলে সে হিম্মত হারাতে থাকে। অন্যদিকে আল্লাহে বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহকে
সন্তুষ্ট করার জন্যই সবকিছু করে। এ কাজে সে নিজের শক্তি বা বস্তুগত উপায়-উপকরণের ওপর ভরসা করে না বরং সে
পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহর সত্তার ওপর। সত্যের পথে কাজ করতে গিয়ে সে বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে অথবা
সাফল্যের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করলে,
উভয়
অবস্থায় সে মনে করে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হচ্ছে। বিপদ আপদ তার মনোবল ভাংতে পারে না। আবার সাফল্যও তাকে অহংকারে লিপ্ত করতে পারে না। কারণ,
প্রথমত
সে উভয়কে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বলে মনে করে। সব অবস্থায় সে আল্লাহর সৃষ্ট এ পরীক্ষায় নিরাপদে উত্তীর্ণ
হতে চায়। দ্বিতীয়ত তার সামনে কোন
বৈষয়িক উদ্দেশ্য থাকে না এবং তার মাধ্যমে সে নিজের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার করে
না। তার সামনে থাকে আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের একটি মাত্র উদ্দেশ্য। বৈষয়িক সাফল্য লাভ করা বা না করার মাধ্যমে তার এ উদ্দেশ্যের নিকটবর্তী হওয়া
বা দূরে অবস্থান করার ব্যাপাটি পরিমাপ করা যায় না।বরং আল্লাহর পথে জান ও মাল উৎসর্গ করার যে দায়িত্ব তার ওপর
অর্পিত হয়েছিল তা সে কতদূর পালন করেছে। তার ভিত্তিতেই তার পরিমাপ করা যায়। যদি এ দায়িত্ব সে পালন করে থাকে তাহলে দুনিয়ায় সে
সম্পূর্ণরূপে হেরে গেলেও তার পূর্ণ আস্থা থাকে যে, সে
যে আল্লাহর জন্য ধন-প্রাণ উৎসর্গ করেছে তিনি তার প্রতিদান নষ্ট করে দেবেন না।তারপর বৈষয়িক কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের আশায় সে
বসে থাকে না। সেগুলোর অনুকূল ও প্রতিকূল
হওয়া তাকে আনন্দিত ও নিরানন্দ করে না। সে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখে। তিনিই কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণ রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক। কাজেই তার ওপর ভরসা করে সে প্রতিকূল অবস্থায়ও
এমন হিম্মত ও দৃঢ় সংকল্প সহকারে কাজ করে যায় যে, দুনিয়া
পূজারীরা একমাত্র অনুকূল অবস্থায়ই সেভাবে কাজ করতে পারে।তাই মহান আল্লাহ বলেন ঐসব দুনিয়া পুজারী মুনাফিকদের বলে দাও, আমাদের
ব্যাপারটা তোমাদের থেকে মূলগতভাবে ভিন্ন। তোমাদের আনন্দ ও নিরানন্দের রীতি-পদ্ধতি আমাদের থেকে
আলাদা। তোমাদের নিশ্চিন্ততা ও
অস্থিরতার উৎস এক, আমাদের অন্য।
﴿قُلْ هَلْ
تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ ۖ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ
أَن يُصِيبَكُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِّنْ عِندِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا ۖ فَتَرَبَّصُوا
إِنَّا مَعَكُم مُّتَرَبِّصُونَ﴾
৫২। তাদের বলে
দাও, “তোমরা
আমাদের ব্যাপারে যে জিনিসের অপেক্ষায় আছো তা দুটি ভালর একটি ছাড়া আর কি?৫২ অন্যদিকে আমরা তোমাদের
ব্যাপারে যে জিনিসের অপেক্ষায় আছি তা হচ্চে এই যে আল্লাহ হয় নিজেই তোমাদের শাস্তি
দেবেন, না হয়
আমাদের হাত দিয়ে দেয়াবেন? তাহলে এখন তোমরা অপেক্ষা করোএবং আমরা ও তোমাদের সাথে
অপেক্ষায় থাকছি”।
৫২. মুনাফিকরা তাদের অভাস অনুযায়ী এ সময়ও কুফর ও ইসলামের
সংঘাতে অংশ না নিয়ে নিজেরা চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেছিল।এ সংঘাতের পরিণামে রসূল ও তার সাহাবীরা বিজয়ীর
বেশে ফিরে আসেন, না
রোমীদের সামরিক শক্তির সাথে সংঘর্ষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান, দূরে
বসে তারা তা দেখতে চাচ্ছিল। এখানে তাদের প্রত্যাশার জবাব দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছে, দুটি ফলাফলের মধ্যে তোমরা একটির প্রকাশের অপেক্ষা
করছো। অথচ ঈমানদারদের জন্য উভয়
ফলাফলই যথার্থ ভাল ও কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিজয়ী হলে,
এটা
যে তাদের জন্য ভাল একথা সবার জানা। কিন্তু নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের পথে প্রাণ দান করে যদি তারা মাটিতে বিলীন
হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়াবাসীরা তাদের চরম ব্যর্থ বলে মনে
করলেও প্রকৃতপক্ষে এটিও আর এক রকমের সাফল্য। কারণ মুমিন একটি দেশ জয় করলো কি করলো না অথবা কোন সরকার
প্রতিষ্ঠিত করলো কি না, এটা তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি নয়। বরং মুমিন তার আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার
জন্য নিজের মন, মস্তিস্ক,দেহ ও প্রাণের সমুদয় শক্তি নিয়োজিত করেছে
কিনা, এটাই তার মাপকাঠি। এ কাজ যদি সে করে থাকে তাহলে দুনিয়ার বিচারে তার ফলাফল
শূণ্য হলেও আসলে সে সফলকাম।
﴿قُلْ أَنفِقُوا
طَوْعًا أَوْ كَرْهًا لَّن يُتَقَبَّلَ مِنكُمْ ۖ إِنَّكُمْ كُنتُمْ قَوْمًا فَاسِقِينَ﴾
৫৩। তাদের বলে
দাও, “তোমরা নিজেদের
ধন-সম্পদ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ব্যয় কর অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যয় কর,৫৩ তা গৃহীত হবে না। কারণ
তোমরা ফাসেক গোষ্ঠী”।
৫৩. কোন কোন মুনাফিক এমনও ছিল, যারা
নিজেদেরকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে যদিও প্রস্তুত ছিল না, তবে
তারা এ জিহাদ ও এ প্রচেষ্টা-সাধনা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থেকে মুসলমানদের
দৃষ্টিতে নিজেদের সমস্ত মর্যাদা খুইয়ে ফেলতে এবং নিজেদের মুনাফিকীকে সর্বসমক্ষে
প্রকাশ করে দিতেও চাচ্ছিল না। তাই তারা বলছিল,বর্তমানে আমরা যদিও অক্ষমতার কারণে যুদ্ধ থেকে
অব্যাহতি চাচ্ছি। কিন্তু যুদ্ধের জন্য অর্থ সাহায্য করতে আমরা
প্রস্তুত।
﴿وَمَا
مَنَعَهُمْ أَن تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ
وَبِرَسُولِهِ وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ
إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَ﴾
৫৪। তাদের
দেয়া সম্পদ গৃহীত না হবার এ ছাড়া আর কোন কারন নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের
সাথে কুফরী করেছে, নামাযের
জন্য যখন আসে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলে তা করে
অনিচ্ছাকৃতভাবে।
﴿فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ
وَلَا أَوْلَادُهُمْ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِي الْحَيَاةِ
الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ﴾
৫৫। তাদের
ধন-দৌলত ও সন্তানের আধিক্য দেখে তোমরা প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ
চান, এ জিনিসগুলোর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে তাদের শাস্তি দিতে।৫৪ আর তারা যদি প্রাণও দিয়ে দেয়, তাহলে তখন তারা থাকবে সত্য
অস্বীকার করার অবস্থায়।৫৫
৫৪. অর্থাৎ এ ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতির মায়ার ডোরে আবদ্ধ
হয়ে তারা সে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করেছে,
সে
জন্য মুসলিম সমাজে তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। এতদিনকার আরবীয় সমাজে তাদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-মর্যাদা, নেতৃত্ব
ও কর্তৃত্ব ছিল নব্য ইসলামী সামাজ ব্যবস্থায় তা সম্পূর্ণ মাটিতে মিশে যাবে। যেসব নগন্য দাস ও দাস পুত্ররা এবং মামুলী কৃষক
ও রাখালরা ঈমানী নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রমাণ পেশ করেছে,এ নতুন সমাজে তারা হবে
মর্যাদাশীল অন্যদিকে বংশানুক্রমিক সমাজনেতা ও সমাজপতিরা নিজেদের দুনিয়া প্রীতির
কারণে মর্যাদাহীন হয়ে পড়বে।
হযরত উমরের রা. মসজলিসে একবার একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটি ছিল এ অবস্থার একটি চমকপ্রদ চিত্র। সুহাইল ইবনে আমর ও হারেস ইবনে হিশামের মতো বড়
বড় কুরাইশী সরদাররা হযরত উমরের রা. সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে আনসার ও মুহিজিরদের মধ্যে থেকে মামুলী
পর্যায়ের কোন লোক হলেও হযরত উমর রা.তাকে ডেকে নিজের কাছে বসাচ্ছিলেন এবং এ
সমাজপতিদের সরে তার জন্য জায়গা করে দিতে বলেছিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে সমাজপতিরা সরতে সরতে একেবারে মজলিসের
কিনারে গিয়ে পৌছলেন।বাইরে
বের হয়ে এসে হারেস ইবনে হিশাম নিজের সাথীদের বললেন, তোমরা
দেখলে তো আজ আমাদের সাথে কি ব্যবহার করা হলো?
সুহাইল
ইবনে আমর বললেন, এতে উমরের কোন দোষ নেই। দোষ আমাদের। কারণ আমাদের যখন এ দীনের দিকে ডাকা হয়েছিল তখন আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম এবং
এ লোকেরা দৌড়ে এসেছিল।
তারপর এ দু সমাজপতি দ্বিতীয়বার হযরত উমরের কাছে হাযির হলেন। এবার তারা বললেন,
আজ
আমরা আপনার আচরণ দেখলাম।
আমরা জানি, আমাদের ত্রুটির কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু এখন এর প্রতিবিধানের কোন উপায় আছে কি? হযরত
উমররা. মুখে কোন জবাব দিলেন না। তিনি শুধু রোম সীমান্তের দিকে ইশারা করলেন। মানে, তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, এখন
জিহাদের ময়দানে জান-মাল উৎসর্গ করো,
তাহলে
হয়তো তোমরা নিজেদের হারানো মর্যাদা আবার ফিরে পাবে।
৫৫. অর্থাৎ এতসব লাঞ্ছনা-গাঞ্জনার মধ্যেও তাদের জন্য আরো বড়
বিপদ হবে এই যে, তারা নিজেদের মধ্যে যে মুনাফিকী চরিত্র
বৈশিষ্ট্য লালন করছে তার বদৌলতে মরার আগ পর্যন্ত তারা সত্যিকার ঈমানলাভের সৌভাগ্য
থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং নিজেদের পার্থিব সুখ-সুবিধা ধ্বংস করার পর দুনিয়া থেকেএমন
অবস্থায় বিদায় নেবে যে, তাদের আখেরাত হবে এর চাইতেও অনেক বেশী খারাপ।
﴿وَيَحْلِفُونَ
بِاللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنكُمْ وَمَا هُم مِّنكُمْ وَلَٰكِنَّهُمْ قَوْمٌ يَفْرَقُونَ﴾
৫৬। তারা
আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে বলে, আমরা তোমাদেরই লোক। অথচ তারা
মোটেই তোমাদের অন্তরভুক্ত নয়। আসলে তারা এমন একদল লোক
যারা তোমাদের ভয় করে।
﴿لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَأً
أَوْ مَغَارَاتٍ أَوْ مُدَّخَلًا لَّوَلَّوْا إِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ﴾
৫৭। যদি তারা
কোন আশ্রয় পেয়ে যায় অথবা কোন গিরি-গুহা কিংবা ভিতরে প্রবেশ করার মত কোন জায়গা, তাহলে দৌড়ে গিয়ে সেখানে
লুকিয়ে থাকবে।৫৬
৫৬. মদীনার এ মুনাফিকদের বেশীরভাগই ধনী ও বয়স্ক। ইবনে কাসির তার আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে
তাদের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে শুধুমাত্র একজন যুবকের নাম পাওয়া যায়। তাদের একজনও গরীব নয়। এরা মদীনায় বিপুল-ভূ-সম্পত্তি ও চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিরাট
কারবারের মালিক ছিল।
সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বহুদর্শিতা এদের সুযোগ-সন্ধানী ও সুবিধাবাদী বানিয়ে দিয়েছিল। ইসলাম যখন মদীনায় পৌছলো এবং জনবসতির একটি বড়
অংশ পূর্ণ আন্তরিকতা ও ঈমানী জোশের সাথে ইসলাম গ্রহন করলো তখন এ শ্রেনীটি পড়লো
উভয় সংকটে।তারা দেখলো এ নতুন দীন
একদিকে তাদের নিজেদের গোত্রের অধিকাংশ বরং তাদের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত ঈমানের
নেশায় মাতিয়ে তুলেছে।
তাদের বিপরীত সারিতে দাঁড়িয়ে তারা যদি এখন কুফরী ও অস্বীকারের ঝাণ্ডা উত্তোলিত
করে রাখে, তাহলে তাদের নেতৃত্ব-সরদারী, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-সম্মান,সুনাম-সুখ্যাতি, সব্কিছুই
হারিয়ে যাবে। এমনকি তাদের নিজেদের
পারিবারিক পরিমণ্ডলেই তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনার আশংকা দেখা দেবে। অন্যদিকেএ দীনের সাথে সহযোগিতা করার অর্থ হবে, তাদেরকে
সমগ্র আরবের এমনকি চারপাশের সমস্ত জাতি-গোত্র ও রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি
নিতে প্রস্তুত থাকা।
সত্য ও ন্যায় যে আসলেই একটি মূল্যবান জিনিস তার প্রেমসুধা পান করে যে মানুষ সব
রকমের বিপদ আপদ মাথা পেতে নিতে পারে,
এমনকি
প্রয়োজনে নিজের জান-মালও পর্যন্ত কুরবানী করতে পারে। পার্থিব স্বার্থে মোহ ও প্রবৃত্তির গোলামীতে আকণ্ঠ ডুবে
থাকার কারণে সে কথা উপলব্ধি করার যোগ্যতা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়কে শুধুমাত্র স্বার্থ
ও সুবিধাবাদের দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তাই ঈমানের দাবী করার মধ্যই তারা নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ
সংরক্ষণের সবচেয়ে অনুকূল ও উপযোগী পথ খুঁজে পেয়েছিল। কারণ তারা এভাবে একদিকে নিজেদের জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে
নিজেদের বাহ্যিক মান-সম্ভ্রম, সহায়-সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য
যথাযথ ভাবে টিকিয়ে রাখতে পারবে।অন্যদিকে মুমিন হওয়াটাও তাদের এড়িয়ে যাওয়া দরকার, যাতে
আন্তরিকতার পথ অবলম্বন করার ফলে অনিবার্যভাবে যেসব বিপদ আপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে
হয়, তার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। তাদের এ মানসিক অবস্থাকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আসলে
তারা তোমাদের সাথে নেই।
বরং ক্ষতির ভয় তাদের কে জবরদস্তি তোমাদের সাথে বেধে দিয়েছে। যে জিনিসটি তাদের নিজেদের কে মুসলমানদের মধ্যে গণ করাতে
বাধ্য করেছে তা হচ্ছে এই ভীতি যে, মদীনায় থাকা অবস্থায় যদি
তারা প্রকাশ্যে অমুসলিম হয়ে বাস করতে থাকে তহলে তাদের সমস্ত মর্যাদা ও প্রতিপত্তি
খতম হয়ে যাবে এমনকি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাথেও তাদের সম্পর্কেচ্ছেদ ঘটবে। আর যদি তারা মদীনা ত্যাগ করে তাহলে নিজেদের
সম্পদ-সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করতে হবে। আবার কুফরীর প্রতিও তাদের এতটা আন্তরিকতা ছিল না যে, তার
জন্য তারা এসব ক্ষতি বরদাশত করতে পারতো। এ উভয় সংকটে পড়ে তারা বাধ্য হয়ে মদীনায় থেকে গিয়েছে। মন না চাইলেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামায পড়তো। এবং যাকাতকে জরিমানা ভেবে হলেও অগত্যা আদায়
করতো। নয়তো প্রতিদান জিহাদ, প্রতিদান
কোন না কোন ভয়াবহ দুশমনের সাথে পাঞ্জা কষাকষি এবং প্রতিদান জান-ও মাল কুরবানীর
যে বিপদ ঘাড়ে চেপে আছে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা এত বেশী অস্থির যে, যদি
তারা সাধারণ কোন সুড়াংগ তথা কোন গর্তও দেখতে পেতো এবং সেখানে গেলে নিরাপদ আশ্রয়
লাভের সম্ভবনা থাকতো তাহলে দৌড়ে গিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়তো।
﴿وَمِنْهُم
مَّن يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِن لَّمْ يُعْطَوْا
مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ﴾
৫৮। হে নবী!
তাদের কেউ কেউ সাদকাহ বন্টনের ব্যাপারে তোমার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাচ্ছে। এ সম্পদ
থেকে যদি তাদের কিছু দেয়া হয় তাহলে তারা খুশী হয়ে যায়, আর না দেয়া হলে বিগড়ে যেতে
থাকে।৫৭
৫৭. এ প্রথমবার আরবে একটি নির্দিষ্ট পরমাণের বেশী ধন-সম্পদের
অধিকারী লোকদের উপর যথারীতি যাকাত ধার্য করা হয়েছিল।তাদের কৃষি উৎপাদন,গবাদিপশু ও ব্যবসায় পন্য এবং খনিজ দ্রব্য ও
সোনা রূপার সঞ্চয় থেকে আড়াই ভাগ,৫ভাগ,১০ভাগ,ও ২০ ভাগ আদায় করা হতো। একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে এসব যাকাতের সম্পদ সংগ্রহ করা হতো
এবং একটি কেন্দ্রে জমা করে বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে খরচ করা হতো। এভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নবী সা. এর কাছে এত বিপুল
পরিমাণ অর্থ-সম্পদ সংগৃহীত হয়ে আসতো এবং তার হাত দিয়ে তা লোকদের মধ্যে বিতরণ করা
হতো,যা ইতিপূর্বে আরবের লোকেরা কখনো এক জন লোকের হাতে একই
সংগে সংগৃহিত হতে এবং তার হাত দিয়ে খরচ হতে দেখেনি। এ সম্পদ দেখে দুনিয়া পূজারী মুনাফিকদের জিভ দিয়ে লালা
ঝরতো। তারা চাইতো, এ
প্রবহমান নদী থেকে তারা যেন আশ মিটিয়ে পানি পান করতে পারে। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম।এখানে যিনি পানি পান করাচ্ছিলেন তিনি নিজের
জন্য এবং নিজের সংশ্লিষ্টেদের জন্য এ নদীর প্রতি বিন্দু পানি হারাম করে দিয়েছিলেন। কেউ আশা করতে পারে না,
তার
হাতের পানির পেয়ালা হকদার ছাড়া আর কারোর ঠোঁট স্পর্শ করতে পারে। এ কারণেই নবী সা. এর সদকা বিতরণের অবস্থা দেখে
মুনাফিকরা চাপা আক্রোশে গুমরে মরছিল। বন্টনের সময় তারা নানা অভিযোগে, তাকে অভিযুক্ত করতো। তাদের আসল অভিযোগ ছিল এ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ
আমাদের দেয়া হচ্ছে না।
কিন্তু এ আসল অভিযোগ গোপন করে তারা এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করতো যে, ইনসাফের
সাথে সম্পদ বন্টন করা হচ্ছে না এবং এ ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে।
﴿وَلَوْ
أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا
اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللَّهِ رَاغِبُونَ﴾
৫৯। কতই না
ভাল হতো, আল্লাহ ও
তার রসূল যা কিছুই তাদের দিয়েছিলেন তাতে যদি তারা সন্তুষ্ট থাকতো।৫৮ এবং বলতো, “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ঠ। তিনি
নিজের অনুগ্রহ থেকে আমাদের আরো অনেক কিছু দেবেন এবং তাঁর রসূলও আমাদের প্রতি
অনুগ্রহ করবেন।৫৯ আমরা আল্লাহরই প্রতি দৃষ্টি
নিবদ্ধ করে রেখেছি”।৬০
৫৮. অর্থাৎ গনীমাতের মাল থেকে যা কিছু নবী সা. তাদের দেন, তাই
নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকতো। অন্যদিকে আল্লাহর অনুগ্রহে তারা যা কিছু উপার্জন করে এবং অর্থ উপার্জনের
আল্লাহ প্রদত্ত উপকরণের মাধ্যমে যে ধরনের সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির তারা লাভ করছে তাকেই
নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করতো।
৫৯. অর্থাৎ যাকাত ছাড়াও অন্য যে সমস্ত ধন-সম্পদ রাষ্ট্রীয়
কোষাগারে আসবে তা থেকে নিজ নিজ প্রাপ্য অনুযায়ী আমরা অংশ লাভ করতে থাকবো,যেমন
ইতিপূর্বে করে এসেছি।
৬০. অর্থাৎ দুনিয়া ও তার তুচ্ছ সম্পদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি
নেই। বরং আমাদের দৃষ্টি রয়েছে
আল্লাহ ও তাঁর অনুগ্রহের ওপর। তাঁরই সন্তুষ্টি আমরা চাই। আমাদের সমস্ত আশা আকাংখা তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। তিনি যা দেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।
﴿إِنَّمَا
الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ
قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ
ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
৬০। এ
সাদকাগুলো তো আসলে ফকীর৬১ মিসকীনদের৬২ জন্য। আর যারা
সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত৬৩ এবং যাদের জন্য মন জয় করা
প্রয়োজন তাদের জন্য।৬৪ তাছাড়া দাস
মুক্ত করার,৬৫ ঋণগ্রস্ততের
সাহায্য করার,৬৬ আল্লাহর
পথে৬৭ এবং
মুসাফিরদের উপকারে৬৮ ব্যয় করার জন্য। এটা
আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহর সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ।
৬১. ফকির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে
নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের মুখাপেক্ষী। কোন শারীরিক ত্রুটি বা বার্ধ্যক্যজনিত করণে কেউ স্থায়ীভাবে
অন্যের সাহয্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে অথবা কোন সাময়িক কারণে আপাতত কোন ব্যক্তি
অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সহায়তা পেলে আবার নিজের পায়ে
দাঁড়াতে পারে,এ পর্যায়ের সব ধরনের অভাবী লোকের জন্য
সাধারণভাবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এতীম শিশু,বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার, এবং
এমন সব লোক যারা সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
৬২. মিসকীন শব্দের মধ্যে দীনতা, দুর্ভাগ্য
পীড়িত অভাব, অসহায়তা,ও লাঞ্ছনা অর্থ নিহিত রয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে সাধারণ অভাবীদের চাইতে
যাদের অবস্থা বেশী খারপ তারাই মিসকীন। নবী সা. এ শব্দটির ব্যাখ্যা করে বিশেষ করে এমন সব লোকদেরকে সাহায্যলাভের
অধিকারি গণ্য করেছেন,যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারেনি, ফলে
অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু তাদের পদমর্যাদা সচেতনতা কারোর সামনে তাদের হাত
পাতার অনুমতি দেয় না।আবার
তাদের বাহ্যিক অবস্থাও এমন নয় যে, কেউ তাদেরকে দেখে অভাবী মনে
করবে এবং সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিবে।হাদীসে এভাবে এর ব্যখ্যা করা হয়েছেঃ
المسكين الذي لا يجد غِنًى يغنيه، ولا يُفطن له
فيُتصدق عليه، ولا يقوم فيسأل الناس
"যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন
অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং
যে নিজে দাঁড়িয়ে কারোর কাছে সাহায্যও চায় না,
সে-ই
মিসকীন" অর্থাৎ সে একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র গরীব মানুষ।
৬৩. অর্থাৎ যারা সাদকা আদায় করা, আদায়
করা ধন-সম্পদ সংরক্ষণ করা, সে সবের হিসেব-নিকেশ করা, খাতাপত্রে
লেখা এবং লোকদের মধ্যে বন্টন করার কাজে সরকারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত থাকে।ফকীর বা মিসকীন না হলেও এসব লোকের বেতন
সর্বাবস্থায় সাদকার খাত থেকে দেয়া হবে।এখানে উচ্চারিত এ শব্দগুলো এবং এ সুরার ১০৩ আয়াতের শব্দাবলী خُذْ مِنْ أَمْوَٰلِهِمْ صَدَقَةً (তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদাকা উসূল করো) একথাই
প্রমাণ করে, যে,
যাকাত
আদায় ও বণ্টন ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তরভুক্ত।
এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য, নবী সা. খোদ নিজের ও নিজের বংশের (বনী হাশেম) ওপর
যাকাতের মাল হারাম ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই তিনি নিজে সবসময় বিনা পারিশ্রমিকে যাকাত আদায় ও বন্টনের কাজ করেন।বনী হাশেমদের অন্য লোকদের জন্যও তিনি এ নীতি
নির্ধারণ করে যান। তিনি বলে যান, তারা
যদি বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করে তাহলে এটা তাদের জন্য ধৈর্য।আর পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ বিভাগের কোন কাজ করলে তা তাদের
জন্য বৈধ নয়। তার বংশের কোন লোক যদি
সাহেব নেসাব (অর্থাৎ কমপক্ষে যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দেয়া ফরয) হয়, তাহলে
তার ওপর যাকাত দেয়া ফরয হবে। কিন্তু যদি সে গরীব, অভাবী, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফির হয়ে থাকে,
তাহলে
তার জন্য যাকাত নেয়া হারাম হবে। তবে বনী হাশেমদের নিজেদের যাকাত বনি হাশেমরা নিতে পারবে কিনা এবং ব্যাপারে
মতবিরোধ আছে। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, নিতে
পারে।কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ তাও না
জায়েজ বলে মত প্রকাশ করেন।
৬৪. মন জয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার যে হুকুম এখানে
দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্চে, যারা ইসলামের বিরোধীতায়
ব্যাপকভাবে তৎপর এবং অর্থ দিয়ে যাদের শত্রুতার তীব্রতা ও উগ্রতা হ্রাস করা যেতে
পারে অথবা যারা কাফেরদের শিবিরে অবস্থান করেছে ঠিকই কিন্তু অর্থের সাহায্যে সেখান
থেকে ভাগিয়ে এনে মুসলমানদের দলে ভিড়িয়ে দিলে তারা মুসলমানদের সাহায্যকারী হতে পারে
কিংবা যারা সবেমাত্র ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং তাদের পূর্বেকার শত্রুতা বা দুর্বলতাগুলো
দেখে আশংকা জাগে যে, অর্থ দিয়ে তাদের বশীভূত না করলে তারা আবার
কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, এ ধরনের লোকেদেরকে স্থায়ীভাবে বৃত্তি দিয়ে বা
সাময়িকভাবে এককালীন দানের মাধ্যমে ইসলামের সমর্থক ও সাহায্যকারী অথবা বাধ্য ও
অনুগত কিংবা কমপক্ষে এমন শত্রুতে পরিণত করা যায়, যারা
কোন প্রকার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। এ খাতে গনীমাতের মাল ও অন্যান্য উপায়ে অর্জিত অর্থ থেকেও
ব্যয় করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন হলে যাকাতের তহবিল থেকেও ব্যয় করা যায়। এ ধরনের লোকদের জন্য, ফকীর, মিসকিন
বা মুসাফির হবার শর্ত নেই। বরং ধনীও বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদের যাকাত দেয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, নবী সা. এর আমলে তালীফে কলব, তথা
মন জয় করার উদ্দেশ্যে বহু লোককে বৃত্তি দেয়া এবং এককালীন দান করা হতো। কিন্তু তার পরেও এ খাতটি অপরিবর্তিতও অব্যাহত
রয়েছে কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম আবু হানিফা রাহি. ও তার সহযোগীদের মতে, হযরত
আবু বকররা. ও হযরত উমরেররা. আমল থেকে এ খাতটি রহিত হয়ে গেছে।কাজেই এখন তালীফে কলবের জন্য কাউকে কিছু দেয়া জায়েজ নয়। ইমাম শাফেয়ীর রাহি. মতে তালীফে কলবের
উদ্দেশ্যে ফাসেক মুসলমানদেরকে যাকাত তহবিল থেকে দেয়া যেতে পারে কিন্তু কাফেরদের
দেয়া যেতে পারে না। অন্যান্য কতিপয় ফকীহের মতে, মুআল্লাফাতুল
কুলুব, (যাদের
মন জয় করা ইস্পিত হয়) এর খাত আজো অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজন দেখা দিলে এ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।
হানাফীগণ এ প্রসঙ্গে প্রমাণ উপস্থাপন করে বলেন, নবী
সা. এর ইন্তিকালের পর উয়ইনা ইবনে হিসন ও আকরা ইবনে হাবেস হযরত আবু বকরের রা. কাছে
আসে এবং তাঁর কাছে একটি জমি চায়।তিনি তাদেরকে জমিটির একটি দানপত্র লিখে দেন। তারা এ দানপত্রকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য অন্যন্য
প্রধান সাহাবীগণের সাক্ষও এতে সন্নিবেশ করতে চায়।সে মতে অনেক সাক্ষ সংগৃহিত হয়ে যায়। কিন্তু তারা যখন হযরত উমরের রা. কাছে সাক্ষ নিতে যায় তখন
তিনি দনপত্রটি পড়ে তাদের সামনেই সেটি ছিড়ে ফেলেন। তিনি তাদেরকে বলেন,
অবশ্যি
তালীফে কলব করার জন্য নবী সা.তোমাদের দান করতেন। কিন্তু তখন ছিল ইসলামের দুর্বলতার যুগ। আর এখন আল্লাহ ইসলামকে তোমাদের মতো, লোকদের
প্রতি নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এ ঘটনার পর তারা হযরত আবু বকরের রা. এর কাছে এসে অভিযোগ
করে এবং তাকে টিটকারী দিয়ে বলেঃ খলীফা কি আপনি, না উমর?
কিন্তু
হযরত আবু বকর নিজেও এর কোন প্রতিবাদ করেননি। কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের একজনও হযরত উমরের এ মতের সাথে
দ্বিমত প্রকাশ করেননি। এ
থেকে হানাফিগণ এ মর্মে প্রমাণ পেশ করেছেন,
যখন
মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি তারা অর্জন করেছে তখন
যে কারণে প্রথম দিকে মুআল্লাফাতুল কুলূবের অংশ রাখা হয় তা আর বর্তমান রইলো না। এ কারণে সাহাবীগণের ইজমার মাধ্যমে এ অংশটি
চিরকালের জন্য বাতিল হয়ে গেছে।
ইমাম শাফিয়ী রাহি. এ প্রসঙ্গে প্রমাণ পেশ করে বলেন, তালীফে
কলব, এর জন্য যাকাতের মাল দেবার ব্যাপারটা নবী সা. এর কর্মকাণ্ড
থেকে প্রমাণিত নয়। হাদীসে আমরা যতগুলো ঘটনা
পাই তা থেকে একথাই জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ সা. তালীফে কলবের
জন্য কাফেরদেরকে যা কিছু দেবার তা গনীমাতের মাল থেকেই দিয়েছেন, যাকাতের
মাল থেকে দেননি।
আমাদের মতে প্রকৃত সত্য হচ্ছে,
মুআল্লাফাতুল
কুলুবের অংশ কিয়ামত পর্যন্ত বাতিল হবার কোন প্রমাণ নেই। হযরত উমররা. যা কিছু বলেছেন তা নিসন্দেহে পুরোপুরি সঠিক
ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র যদি তালীফে
কলবের জন্য অর্থ-ব্যয় করার প্রয়োজন নেই মনেকরে, তাহলেও
এ খাতে কিছু ব্যয় করতেই হবে এমন কোন ফরয তার ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। কিন্তু কখনো প্রয়োজন দেখা দিলে যাতে ব্যয়
করা যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ যে অবকাশ রেখেছেন তা অবশ্যি অক্ষুন্ন থাকা উচিত। হযরত উমর ও সাহাবাযে কেরামের যে বিষয়ে মতৈক্য
হয়েছিল তা ছিল মূলত এই যে, তাদের আমলে যে অবস্থা ছিল তাতে তালীফে কলবের
জন্য কাউকে কিছু দেবার প্রয়েজন তারা অনুভব করতেন না। কাজেই কোন গুরুত্বপূর্ণ দীনী স্বার্থ তথা প্রয়োজন ও
কল্যাণের খাতিরে কুরআনে যে খাতটি রাখা হয়েছিল,
সাহাবীগণের
মতৈক্য তাকে খতম করে দিয়েছে বলে সিন্ধান্তে আসার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই।
অন্যদিকে ইমাম শাফেয়ীর অভিমতটি অবশ্যি এতটুকু পর্যন্ত তো সঠিক মনে হয় যে, সরকারের
কাছে যখন অন্যান্য খাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ-সম্পদ মওজুদ থাকে তখন তালীফে কলবের
খাতে তার যাকাতের অর্থ-সম্পদ ব্যয় না করা উচিত। কিন্তু যখন যাকাতের অর্থ-সম্পদ থেকে এ খাতে সাহায্য নেবার
প্রয়োজন দেখা দেবে তখন তা ফাসেকদের জন্য ব্যয় করা যাবে, কাফেরদের
জন্য ব্যয় করা যাবে না, এ ধরনের পার্থক্য কারার কোন কারণই সেখানে নেই। কারণ কুরাআনে মুআল্লাফাতুল কূলুবের যে অংশ
রাখা হয়েছে, তা
তাদের ঈমানের দাবীর কারণে নয়। বরং এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম নিজের প্রয়োজনে তাদের তালীফে কলব তথা মন
জয় করতে চায়। আর শুধুমাত্র অর্থের
সাহায্যেই এ ধরনের লোকদের মন জয় করা যেতে পারে। এ প্রয়োজন ও এ গুণ-বৈশিষ্ট্য যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই
মুসলমানদের সরকার কুরআনের বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার অধিকার
রাখে। নবী সা. এ খাত থেকে
কাফেরদের কিছুই দেননি। এর
কারণ তার কাছে অন্য খাতে অর্থ ছিল। নয়তো এ খাত থেকে কাফেরদেরকে দেয়া যদি অবৈধ হতো তাহলে তিনি একথা সুষ্পষ্ট
করে বলে দিতেন।
৬৫. দাসদেরকে দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ
ব্যয় করা দু'ভাবে হতে পারে।
একঃ
যে
দাস তার মালিকের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছে যে,
সে
একটা বিশেষ পরিমাণ অর্থ আদায় করলে মালিক তাকে দাসত্ব মুক্ত করে দেবে। তাকে দাসত্ব মুক্তির এ মূল্য আদায় করতে যাকাত
থেকে সাহায্য করা যায়।
দুইঃ
যাকাতের
অর্থে দাস কিনে তাকে মুক্ত করে দেয়া। এর মধ্যে প্রথমটির ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত।কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থাটিকে হযরত আলীরা. সাঈদ ইবনে জুবাইর, লাইস,সাওরী, ইবরাহীম
নাখয়ী, শাবী, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন,
হানাফী, ও
শাফেয়ীগণ নাজায়েজ গণ্য করেন্ অন্যদিকে ইবনে আব্বাস রা. হাসান বসরী, মালেক, আহমদ, ও
আবু সাওর একে জায়েয মনে করেন।
৬৬. অর্থাৎ এমন ধরনের ঋণগ্রস্ত, যারা
নিজেদের সমস্ত ঋণ আদায় করে দিলে তাদের কাছে নেসাবের চাইতে কম পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট
থাকে। তারা অর্থ উপার্জনকরী হোক
বা বেকার, আবার সাধারণ্যে তাদের ফকীর মনে করা হোক বা ধনী। উভয় অবস্থায় যাকাতের খাত থেকে তাদেরকে সাহায্য
করা যেতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক
ফকীহ এ মত পোষণ করেছেন যে, অসৎকাজে ও অমিতব্যয়িতা করে যারা নিজেদের টাকা
পয়সা উড়িয়ে দিয়ে ঋনের ভারে ডুবে মরছে,
তাওবা
না করা পর্যন্ত তাদের সাহায্য করা যাবে না।
৬৭. আল্লাহর পথে শব্দ দুটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব সৎকাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এমন সমস্ত কাজই
এর অন্তরভুক্ত। এ কারণে কেউ কেউ এমত পোষণ
করেছেন যে, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে যাকাতের অর্থ যে কোন
সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথম যুগের ইমামগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে মত পোষণ
করেছে সেটিই যথার্থ সত্য।
তাদের মতে এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মূল
উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেসব লোক এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম রত থাকে, তারা
নিজেরা সচ্ছল ও অবস্থাসম্পন্ন হলেও এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার
জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদের সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র
ও সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপ ভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমস্ত সময়
ও শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার
জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।
এখানে আর একটি কথা অনুধাবন করতে হবে। প্রথম যুগের ইমামগণের বক্তব্য সাধারণত এ ক্ষেত্রে গাযওয়া
শব্দ ব্যবহার করা হয়ছে। এ
শব্দটি যুদ্ধের সামর্থক।
তাই লোকেরা মনে করে যাকাতের ব্যয় খাতে ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথের যে খাত
রাখা হয়েছে তা শুধু যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু আসলে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ যুদ্ধ বিগ্রহের চাইতে
আরো ব্যাপকতর জিনিসের নাম। কুফরের বাণীকে অবদমিত এবং আল্লাহর বাণিকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করা আর আল্লাহর
দীনকে একটি জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত ও প্রচারের প্রথমিক
পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা ও কাজ করা হয়, তা
সবই এ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর আওতাভুক্ত।
৬৮. মুসাফির তার নিজের গৃহে ধনী হলেও সফরের মধ্যে সে যদি
সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তাহলে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে। এখানে কোন কোন ফকীহ শর্ত আরোপ করেছেন, অসৎকাজ
করা যার সফরের উদ্দেশ্য নয় কেবল মাত্র সেই ব্যক্তিই এ আয়াতের প্রেক্ষিতে
সাহায্যলাভের অধিকারী হবে। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও এ ধরনের কোন শর্ত নেই। অন্যদিকে দীনের মৌলিক শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি,যে ব্যক্তি অভাবী ও সাহায্য
লাভের মুখাপেক্ষী তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তার পাপচার বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত
নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে গোনাহগার
ও অসৎ চরিত্রের লোকদেরকে বিপদে সাহায্য করলে এবং ভাল ও উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে
তাদের চরিত্র সংশোধন করার প্রচেষ্টা চালালে তা তাদের চরিত্র সংশোধনের সবচেয়ে বড়
উপায় হতে পারে।
﴿وَمِنْهُمُ
الَّذِينَ يُؤْذُونَ النَّبِيَّ وَيَقُولُونَ هُوَ أُذُنٌ ۚ قُلْ أُذُنُ خَيْرٍ لَّكُمْ
يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَيُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِينَ وَرَحْمَةٌ لِّلَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ
ۚ وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
৬১। তাদের
মধ্যে কিছু লোক আছে যারা নিজেদের কথা দ্বারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে এ ব্যক্তি
অতিশয় কর্ণপাতকারী।৬৯ বলে দাও, “সে এরূপ করে কেবল তোমাদের
ভালোর জন্যই।৭০ সে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে
এবং ঈমানদারদেরকে বিশ্বাস করে।৭১ তোমাদের
মধ্য থেকে যারা ঈমানদার তাদের জন্য সে পরিপূর্ণ রহমত।আর যারা
আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি”।
৬৯. মুনাফিকরা নবী সা. এর বিরুদ্ধে যেসব দোষারোপ করতো তার
মধ্যে একটি ছিল এই যে, তিনি সবার কথা শুনতেন এবং প্রত্যেককে তার নিজের
কথা বলার সুযোগ দিতেন।তাদের
দৃষ্টিতে এ গুণটি ছিল দোষ। তারা বলতো, তিনি কান পাতলা লোক। যার ইচ্ছা হয়,
সেই
তার কাছে পৌছে যায়, যেভাবে ইচ্ছা তার কান ভরে দেয় এবং তিনি তার কথা
মেনে নেন। এ ব্যাপারটির তারা খুব বেশী
করে চর্চা করতো। এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এই
যে, সাচ্চা ঈমানদাররা এসব মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র,
এদের
শয়তানী কাজকারবার ও বিরোধিতাপূর্ণ কথাবার্তার রিপোর্ট নবী সা. এর কাছে পৌছে দিতেন। এতে এ মুনাফিকরা গোস্বা হয়ে বলতো, আপনি
আমাদের মতো, সম্মানিত ভদ্রলোকদের বিরুদ্ধে যে কোন কাংগাল-ভিখারীর
দেয়া খবরে বিশ্বাসী করে বসেন।
৭০. এ দোষারূপের জবাবে একটি ব্যপক অর্থবোধক কথা বলা হয়েছে। এর দুটো দিক রয়েছে।
একঃ
তিনি
বিপর্যয়, বিকৃতি ও দুষ্কৃতির কথা শোনার মতো লোক নন।বরং তিনি শুধুমাত্র এমনসব কথায় কান দেন
যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মঙ্গল ও সুকৃতি এবং উম্মতের কল্যাণ ও দীনের কল্যাণের জন্য
যেগুলোতে কান দেয়া শুভ ফলদায়ক।
দুইঃ
তার
এমন ধরনের হওয়া তোমাদের জন্যই কল্যাণকর। যদি তিনি প্রত্যেকের কথা না শুনতেন এবং ধৈর্য ও সংযমের
সাথে কাজ না করতেন, তাহলে তোমরা ঈমানের যে মিথ্যা দাবী করে থাকো, শুভেচ্ছার, যেসব
লোক দেখানো বুলি, আওড়ে যাও এবং আল্লাহর পথ থেকে সটকান দেয়ার জন্য
যেসব ঠুনকো ওযর পেশ করে থাকো, সেগুলো ধৈর্যসহকারে শুনার
পরিবর্তে তিনি তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। তার ফলে এ মদীনা শহরে জীবনধারণ করা তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে
পড়তো। কাজেই তার এ গুণটি তোমাদের
জন্য খারাপ নয় বরং ভাল।
৭১. অর্থাৎ তিনি প্রত্যেকের কথা বিশ্বাস করেন, তোমাদের
এ ধারণা ভূল।তিনি যদিও সবার কথাই শোনেন, কিন্তু
বিশ্বাস করেন একমাত্র যথার্থ ও সাচ্চা মুমিনদের কথা। তোমাদের যেসব শয়তানী ও দৃষ্কৃতির খবর তার কাছে পৌছে গেছে
এবং যেগুলো তিনি বিশ্বাস করে ফেলেছেন, সেগুলো দুস্কৃতিকারী চোগলখোরদের সরবরাহ করা
নয় বরং সৎ ঈমানদার লোকেরাই সেগুলো সরবরাহ করেছে এবং সেগুলো নির্ভরযোগ্য।
﴿يَحْلِفُونَ
بِاللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَن يُرْضُوهُ إِن كَانُوا
مُؤْمِنِينَ﴾
৬২। তারা
তোমাদের সন্তুষ্ট করার জন্য তোমাদের সামনে কসম খায়। অথচ যদি
তার মুমিন হয়ে থাকে তাহলে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সন্তুষ্ট করার কথা চিন্তা
করবে, কারণ তারাই
এর বেশী হকদার।
﴿أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّهُ
مَن يُحَادِدِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَأَنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدًا فِيهَا ۚ
ذَٰلِكَ الْخِزْيُ الْعَظِيمُ﴾
৬৩। তারা কি
জানে না, যারা
আল্লাহ ও তার রসূলের মোকাবিলা করে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন,তার মধ্য তারা
চিরকাল থাকবে। এটি একটি বিরাট লাঞ্ছনার
ব্যাপার।
﴿يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ
أَن تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُم بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ ۚ قُلِ اسْتَهْزِئُوا
إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَّا تَحْذَرُونَ﴾
৬৪। এ
মুনাফিকরা ভয় করেছে, মুসলমানদের
ওপর এমন একটি সূরা না নাযিল হয়ে যায়, যা তাদের মনের গোপন কথাপ্রকাশ করে দেবে।৭২ হে নবী!
তাদের বলে দাও, “বেশ ঠাট্রা করতেই থাকো, তবে তোমরা যে জিনিসটির
প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয় করছো আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন”।
৭২. তারা নবী সা. এর নবুওয়াতে সঠিক অর্থে বিশ্বাসী ছিল না। কিন্তু বিগত আট নয় বছরের অভিজ্ঞতায় তারা
বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিল যে, তার কাছে নিশ্চয়ই এমন কোন
না কোন অতি প্রাকৃতিক তথ্য-মাধ্যম আছে,
যার
সাহায্যে তিনি তাদের গোপন কথা জানতে পারেন এবং এভাবে অনেক সময় কুরআনে (যাকে তারা
রসূলের নিজের রচনা বলে মনে করতো) তাদের মুনাফিকী ও চক্রান্তসমূহ প্রকাশ করে দেন।
﴿وَلَئِن
سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ ۚ قُلْ أَبِاللَّهِ
وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ﴾
৬৫। যদি তাদের
জিজ্ঞেস করো, তোমারা কি
কথা বলছিলে?তাহলে তারা
ঝটপট বলে দেবে, আমরা তো
হাসি-তামাসা ও পরিহাস করছিলাম।৭৩ তাদের বলো, তোমাদের হাসি-তামাসা কি
আল্লাহ, তাঁর আয়াত
ও তাঁর রসূলের সাথে ছিল?
৭৩. তাবুকের যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা প্রায়ই তাদের আসরগুলোয় বসে
নবী সা. ও মুসলমানদের নিয়ে হাসি-তামাসা ও বিদ্রুপ করতো। এভাবে তারা যাদেরকে সদুদ্দেশ্যে জিহাদ করতে প্রস্তুত দেখাতো
নিজেদের বিদ্রুপ পরিহাসের মাধ্যমে তাদেরকে হিম্মাতহারা করার চেষ্টা করতো। হাদীসে এ ধরনের লোকদের বহু উক্তি উদ্ধৃত
হয়েছে। যেমন এক মাহফিলে কয়েক জন
মুনাফিক বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের একজন বললো, আরে এ রোমানদেরকেও কি তোমরা আরবদের মতো মনে
করেছো? কালকে দেখে নিও এ যেসব বীর বাহাদুর লড়তে এসেছেন
এদের সবাইকে রশি দিয়ে বেধে রাখা হবে। দ্বিতীয় জন বললো, মজা হবে তখন যখন একশটি করে চাবুক মারার নির্দেশ
দেয়া হবে। আরেক মুনাফিক নবী সা. কে
যুদ্ধ প্রস্তুতিতে বিপুলভাবে কর্মতৎপর দেখে নিজের ইয়ার বন্ধুদের বললোঃ “উনাকে দেখো উনি রোমও সিরিয়ার
দুর্গ জয় করতে চলেছেন।”
﴿لَا تَعْتَذِرُوا
قَدْ كَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ ۚ إِن نَّعْفُ عَن طَائِفَةٍ مِّنكُمْ نُعَذِّبْ
طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ﴾
৬৬। এখন আর
ওযর পেশ করো না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফরী করেছো, যদি আমরা তোমাদের একটি দলকে
মাফও করে দেই তাহলে আরেকটি দলকে তো আমরা অবশ্যি শাস্তি দেবো। কারণ তারা
অপারাধী।৭৪
৭৪. অর্থাৎ বুদ্ধি সম্পন্ন ভাঁড়দেরকে তো তাবুও মাফ করে দেয়া
যেতে পারে।কারণ তারা হয়েতো এ ধরনের
কথা শুধু এ জন্য বলে যাচ্ছে যে, তাদের কাছে দুনিয়ার কোন
জিনিসেরই কোন গুরুত্ব নেই। সব কিছুতেই তারা হালকা নজরে দেখে। কিন্তু যারা জেনে-বুঝে নিজেদের ঈমানের দাবী সত্ত্বেও শুধুমাত্র রসূলকে এবং
তিনি যে দীন এনেছেন তাকে হাস্যসম্পদ মনে করার কারণেই একথা বলে থাকে এবং যাদের
বিদ্রুপের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানদারদের হিম্মাত ও সাহস যেন নিস্তেজ হয়ে যায় এবং
তারা যেন পূর্ণ শক্তিতে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে না পারে। এরূপ অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত যারা তাদেরকে তো কোনক্রমেই
ক্ষমা করা যেতে পারে না।
কারণ তারা ভাঁড় নয়, তারা অপরাধী।
﴿الْمُنَافِقُونَ
وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ
عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ ۚ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ ۗ إِنَّ
الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
৬৭। মুনাফিক
পুরুষ ও নারী পরষ্পরের দোসর। খারাপ কাজের হুকুম দেয়, ভাল কাজের নিষেধ করে এবং
কল্যাণ থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে রাখে।৭৫ তারা
আল্লাহকে ভূলে গেছে,ফলে আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন।
৭৫. সমস্ত মুনাফিকের এটা সাধারণ বৈশিষ্ট। তারা সবাই খারাপ কাজের ব্যাপারে আগ্রহী এবং ভাল কাজের
প্রতি তাদের প্রচণ্ড অনিহা ও শত্রুতা। কোন ব্যক্তি খারাপ কাজ করতে চাইলে তারা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।তাকে পরামর্শ দেয়। তার মনে সাহস যোগায়। তাকে সাহায্য-সহায়তা দান করে। তার জন্য সুপারিশ পেশ করে। তার প্রশংসা করে। মোটকথা তার জন্য নিজেদের সব কিছুই তারা ওয়াকফ করে দেয়। মনেপ্রাণে তারা তার ঐ খারাপ কাজে শরীক হয়। অন্যদেরকে ও তাতে অংশগ্রহণ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। আর যে ব্যক্তি খারাপ কাজ করে এরা তার সাহস
বাড়াতে থাকে। তাদের প্রতিটি অংগ ভাংগী ও
নড়াচড়া থেকে একথা প্রকাশ হতে থাকে যে,
এ
অসৎকাজটির বিস্তার ঘটলে তাদের হৃদয়ে কিছুটা প্রশান্তি অনুভুত হতে থাকে। এবং তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। অন্যদিকে কোন ভাল কাজ হতে থাকলে তার খবর শুনে
তারা মনে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। একথার কল্পনা করতেই তাদের মন বিষিয়ে ওঠে।এ সম্পর্কিত কোন প্রস্তাবও তারা শুনতে পারে না। এর দিকে কাউকে এগিয়ে যেতে দেখলে তারা অস্থির
হয়ে পড়ে। সম্ভাব্য সকল পদ্ধতিতে তার
পথে বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম না হলে যাতে সে এ কাজে সফলকাম না হতে পারে এ জন্য তারা
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। তাছাড়া ভাল কাজে অর্থ ব্যয় করার জন্য তাদের হাত কখনো এগিয়ে আসে না,
এটাও
তাদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তারা কৃপণ হোক বা দানশীল সর্বাবস্থায় এটা দেখা যায়। তাদের অর্থ সিন্দুকে জমা থাকে, আর
নয়তো হারাম পথে আসে হারাম পথে ব্যয় হয়। অসৎকাজের ব্যাপারে তারা যেন নিজেদের যুগের কারূন (অর্থাৎ
দেদার অর্থ ব্যয় করতে পারংগম) সৎকাজের ব্যাপারে তারা চরম দরিদ্র।
﴿وَعَدَ
اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ
فِيهَا ۚ هِيَ حَسْبُهُمْ ۚ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ﴾
৬৮।
নিশ্চিতভাবেই এ মুনাফিকরাই ফাসেক। এ মুনাফিক
পুরুষ ও নারী এবং কাফেরদের জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুণের ওয়াদা করেছেন। তার মধ্যে
তারা চিরকাল থাকবে। সেটিই তাদের জন্য উপযুক্ত। আল্লাহর
অভিশাপ তাদের ওপর এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব।
﴿كَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ
كَانُوا أَشَدَّ مِنكُمْ قُوَّةً وَأَكْثَرَ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا فَاسْتَمْتَعُوا
بِخَلَاقِهِمْ فَاسْتَمْتَعْتُم بِخَلَاقِكُمْ كَمَا اسْتَمْتَعَ الَّذِينَ مِن قَبْلِكُم
بِخَلَاقِهِمْ وَخُضْتُمْ كَالَّذِي خَاضُوا ۚ أُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي
الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ﴾
৬৯। তোমাদের৭৬ আচরণ
তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতোই। তারা ছিল তোমাদের চাইতে
বেশী শক্তিশালী এবং তোমাদের চাইতে বেশী সম্পদ ও সন্তানের মালিক। তারপর
তারা দুনিয়ায় নিজেদের অংশের স্বাদ উপভোগ করেছে এবং তোমরাও একইভাবে নিজেদের অংশের স্বাদ
উপভোগ করেছো। যেমন তারা করেছিল এবং তারা যেমন অনর্থক
বিতর্কে লিপ্ত ছিল তেমনি বিতর্কে তোমরাও লিপ্ত রয়েছো। কাজেই
তাদের পরিণতি হয়েছে এই যে, দুনিয়ায় ও আখেরাতে তাদের সমস্ত কাজকর্ম পণ্ড হয়ে গেছে এবং
তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
৭৬. মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা প্রথম পুরুষে করতে করতে হঠাৎ
এখান থেকে আবার তাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করা শুরু হয়েছে।
﴿أَلَمْ
يَأْتِهِمْ نَبَأُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَقَوْمِ
إِبْرَاهِيمَ وَأَصْحَابِ مَدْيَنَ وَالْمُؤْتَفِكَاتِ ۚ أَتَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ
ۖ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾
৭০। তাদের৭৭ কাছে কি
তাদের পূর্ববর্তীদের ইতিহাস পৌছেনি? নূহের জাতির, আদ, সামূদ, ও ইবরাহীমের জাতির,মাদইয়ানের অধিবাসীদের এবং যে
জনবসতিগুলো উল্টে দেয়া হয়েছিল সেগুলোর?৭৮ তাদের রসূলগণ সুষ্পষ্ট
নিশানীসহ তাদের কাছে এসেছিলেন। এরপর তাদের ওপর জুলুম করা
আল্লাহর কাজ ছিল না বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিলেন।৭৯
৭৭. এখান থেকে আবার তাদের আলোচনা শুরু হয়েছে প্রথম পুরুষে।
৭৮. লূত জাতির জনবসতিগুলোর প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।
৭৯. অর্থাৎ তাদের সাথে আল্লাহর কোন শত্রুতা ছিল এবং তিনি
তাদেরকে ধ্বংস করতে চাচ্ছিলেন বলে তারা ধ্বংস হয়নি। বরং প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই এমন ধরনের জীবনযাপন প্রণালী
পছন্দ করে নিয়েছিল যা তাদেরকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাদের চিন্তা-ভাবনা করারও সামলে নেবার
পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন।
তাদেরকে উপদেশ দেবার ও পরিচালনা করার জন্য রসূল পাঠিয়েছিলেন।রসূলদের মাধ্যমে ভুল পথে অবলম্বন করার অনিষ্টকর ফলাফল
সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং কোন প্রকার রাখ ঢাক না করে অত্যন্ত
সুষ্পষ্ট ভাবে তাদেরকে সাফল্য ও ধ্বংসের পথ বাতলে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা অবস্থার সংশোধনের কোন একটি সুযোগেরও
সদ্ব্যবহার করলো না এবং ধ্বংসের পথে চলার ওপর অবিচল থাকলো তখন তাদের অনিবার্য
পরিণতির সম্মুখীন হতেই হলো। তাদের ওপর এ জুলুম আল্লাহ করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল।
﴿وَالْمُؤْمِنُونَ
وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ
عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ
وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
৭১। মুমিন
পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরষ্পরের বন্ধু ও সহযোগী। এরা ভাল
কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবংআল্লাহ ও তাঁর
রসূলের আনুগত্র করে।৮০ এরা এমন
লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবেই। অবশ্যি
আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালি এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।
৮০. মুনাফিকরা যেমন একটি জাতি বা দল তেমনি মুমিনরাও একটি
স্বতন্ত্র দল।যদিও উভয় দলই প্রকাশ্যে
ঈমানের স্বীকৃতি দেয়া এবং বাহ্যত ইসলামের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশ নেয়।কিন্তু তবুও উভয়ের স্বভাব-প্রকৃতি,
আচর,-আচরণ,অভ্যাস, চিন্তা-পদ্ধতি
ও কর্মধারা পরষ্পরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেখানে কেবল মুখে ঈমানের দাবী কিন্তু অন্তরে সত্যিকার
ঈমানের ছিঁটেফোটা ও নেই সেখানে জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ড তার প্রতিটি পদক্ষেপের
মাধ্যমে ঈমানের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। বাইরে লেবেল আটা রয়েছে,
মিশক(মৃগনাভি)
বলে। কিন্তু লেবেলের নীচে যা কিচু
আছে তা অন্যদিকে ঈমান যেখানে তার মূল তাৎপর্য সহকারে বিরাজিত সেখানে মিশক, তার
নিজের চেহারা আকৃতিতে নিজের খোশবু-সুরভিতে এবং নিজের বৈশিষ্ট-গুণাবলীতে সব
ব্যাপারেই ও সব পরীক্ষাতেই নিজের মিশক,
হবার
কথা সাড়ম্বরে প্রকাশ করে যাচ্ছে। ইসলাম ও ঈমানদের পরিচিত নামই বাহ্যত উভয় দলকে এক উম্মতের অন্তরভুক্ত করে
রেখেছে।নয়তো আসলে মুনাফিক
মুসলমানের নৈতিক বৃত্তি ও স্বভাব প্রকৃতি সত্যিকার ও সাচ্চা ঈমানদার মুসলমান থেকে
সম্পূর্ণ আলাদা। এ কারণে মুনাফিকী স্বভাবের
অধিকারী পুরুষ ও নারীরা একটা পৃথক দলে পরিণত হয়ে গেছে।আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে যাওয়া, অসৎকাজে
আগ্রহী হওয়া, নেকীর কাছ থেকে দূরে থাকা এবং সৎকাজের সাথে
অসহযোগিতা করার সাধারণ বৈশিস্টগুলো তাদেরকে পরষ্পরের সাথে যুথিবদ্ধ করেছে এবং
মুমিনদের সাথে কার্যত সম্পর্কহীন করে দিয়েছে। অন্যদিকে সাচ্চা মুমিন পুরুষ ও নারীরা একটি পৃথক দলে পরিণত
হয়েছে। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির
সাধারণ বৈশিষ্ট হচ্ছে, তারা নেকীর কাজে আগ্রহী এবং গুনাহের কাজের
প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।
আল্লাহর স্মরণ তাদের জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনের অন্তরভুক্ত। আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার জন্য তাদের অন্তর ও হাত
সারাক্ষণ উন্মুক্ত থাকে।
আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য তাদের জীবনাচরণের অন্তরভুক্ত। এ সাধারণ নৈতিক বৃত্তি ও জীবন যাপন পদ্ধতি তাদেরকে
পরষ্পরের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে এবং মুনাফিকদের দল থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
﴿وَعَدَ
اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِّنَ
اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾
৭২। এ মুমিন
পুরুষ ও নারীকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে তিনি এমন বাগান দান
করবেন যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহমান হবে এবং তারা তার মধ্যে চিরকাল বাস করবে। এসব চির
সবুজ বাগানে তাদের জন্য থাকবে বাসগৃহ এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ
করবে। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ
جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ ۚ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ
ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ﴾
৭৩। হে নবী!৮১ পূর্ণ
শক্তি দিয়ে কাফের ও মুনাফিক উভয়ের মোকাবিল করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হও।৮২ শেষ
পর্যন্ত তাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থান স্থল।
৮১. তাবুক যুদ্ধের পর যে ভাষণটি নাযিল হয়েছিল এখান থেকে সেই
তৃতীয় ভাষণটি শুরু হচ্ছে।
৮২. এ পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যকলাপের ব্যাপারে বেশীর ভাগ
ক্ষেত্রে উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। এর দুটি কারণ ছিল।
একঃ
তখনো
পর্যন্ত মুসলমানদের হাত এত বেশী শক্তিশালী হতে পারেনি, যে, বাইরের
শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে তারা ভেতরের শত্রুদের সাথেও লড়াই করতে
পারতো।
দুইঃ
যারা
সন্দেহ-সংশয়ে ডুবে ছিল ঈমান ও প্রত্যয় লাভ করার জন্য তাদেকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়াই
ছিল উদ্দেশ্য। এ দুটি কারণ এখন আর বর্তমান
ছিল না। মুসলিম শক্তি এখন সমগ্র আরব
ভুখণ্ডকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে নিয়েছিল এবং আরবের বাইরের শক্তিগুলোর সাথে
সংঘাতের সিলসিলা শুরু হতে যাচ্ছিল। এ কারণে ঘরের এ শত্রুদের মাথা গুড়ো করে দেয়া এখন সম্ভবও ছিল এবং অপরিহার্যও
হয়ে পড়েছিল। তাহলে তারা আর বিদেশী
শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশে আভ্যন্তরীণ বিপদ সৃষ্টি করতেপারতো না। তাছাড়া তাদেরকে ৯ বছর সময় দেয়া হয়েছিল
চিন্তা-ভাবনা করার, বুঝার এবং আল্লাহরসত্য দীনকে যাচাই-পর্যালোচনা
করার জন্য। তাদের মধ্যে যথার্থকল্যাণ
লাভের কোন আকাংখা থাকলে তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতো। এরপর তাদেরকে আরো বেশী সুযোগ সুবিধা দেয়ার
মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও এবার জিহাদ শুরু করে দিতে হবেএবং এদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত যে
উদার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে তার অবসান ঘটিয়ে কঠোর নীতি অবলম্ব করতে হবে।
তাই বলে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ও কঠোর নীতি অবলম্বন করার মানে তাদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়।
আসলে এর অর্থ হচ্ছে, তাদের মুনাফিকী মনোভাব ও কর্মনীতিকে এ পর্যন্ত
যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং যে কারণে তারা মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে থেকেছে, সাধারণ
মুসলমানরা তাদেরকে নিজেদের সমাজেরই একটি অংশ মেনে করেছে এবং তারা ইসলামী দল ও
সংঘঠনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ও ইসলামী সমাজে মুনাফিকীর বিষ ছড়াবার যে সুযোগ
পেয়েছে তা এখন ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। এখন যে ব্যক্তিই মুসলমানদের অন্তরভুক্ত হয়ে
মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করবে এবং যার কার্যধারা থেকে একথাও প্রকাশ হবে, যে
সে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুনিমদের অন্তরঙ্গ বন্ধু নয়, সর্বসমক্ষে
তার মুখোশ খুলে দিতে হবে। এবং নিন্দা করতে হবে। মুসলিম সমাজে তার মর্যাদা ও আস্থা লাভের সকল প্রকার সুযোগ খতম করে দিতে হবে।তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।দলীয় পরামর্শের ক্ষেত্রে থেকে তাকে দূরে রাখতে হবে। আদালতে তার সাক্ষ অনির্ভরযোগ্য গণ্য করতে হবে। বড় বড় পদ ও মর্যাদার দরজা তার জন্য বন্ধ করে
দিতে হবে। সভা-সমিতিতে তাকে গুরুত্ব
দেবে না। প্রত্যেক মুসলমান তার সাথে
এমন আচরণ করবে যাতে সে নিজে অনুভব করতে পারে যে, সমগ্র
মুসলিম সমাজে কোথাও তার কোন মর্যাদা ও গুরুত্ব নেই এবং কারো অন্তরে তার জন্য
এতটুকু সম্ভ্রমবোধও নেই।
তারপর তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন সুষ্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে
তার অপরাধ লুকানো যাবে না এবং তাকে ক্ষমা করা ও যাবে না। বরং সর্বসমক্ষে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দামা চালাতে হবে এবং
তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এ পর্যায়ে মুসলমানদেরকে এ নির্দেশটি দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়া ইসলামী সমাজকে অবনতি ও পতনের
আভ্যন্তরীণ কার্যকারণ থেকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো না।যে জামায়াত ও সংগঠন তার নিজের মধ্যে মুনাফিক ও বিশ্বাসঘাতকদেরকে
লালন করে এবং যেখানে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা হয়,
তার
নৈতিক অধপতন এবং সবশেষে পূর্ণ ধ্বংস ছাড়া গত্যন্তর নেই। মুনাফিকী প্লেগের মতো একটি মহামারী।আর মুনাফিক হচ্ছে এমন একটি ইদুর যে এ মহামারীর জীবাণু বহন
করে বেড়ায়।তাকে জনবসতির মধ্যে
স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়ার অর্থ গোটা জনবসতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে
দেয়া। মুসলমানদের সমাজে একজন
মুনাফিকদের মর্যাদা ও সম্ভ্রম লাভ করার অর্থ হলো হাজার হাজার মানুষকে
বিশ্বাসঘাতকতা ও মুনাফিকী করতে দুঃসাহস যোগানো।এতে সাধারণ্যে এ ধারণা বিস্তার লাভ করে যে, এ
সমাজে মার্যাদা লাভ করার জন্য আন্তরিকতা, সদিচ্ছা,
ও
সাচ্চা ঈমানদারীর কোন প্রয়োজন নেই।বরং মিথ্যা ঈমানদের প্রদর্শনীয় সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ অবলম্বন করেও
এখানে মানুষ ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠতে পারে। একথাটিই রসূলুল্লাহ সা. তার একটি সংক্ষিপ্ত জ্ঞনগর্ভ
বক্তব্যের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
مَن وقَّر صاحبَ بِدْعةٍ فقد أعان على
هَدْمِ الإسلامِ
"যে ব্যক্তি কোন
বিদআতপন্থীকে সম্মান করলো সে আসলে ইসলামের ইমারত ভেংগে ফেলতে সাহায্য করলো"।
﴿يَحْلِفُونَ
بِاللَّهِ مَا قَالُوا وَلَقَدْ قَالُوا كَلِمَةَ الْكُفْرِ وَكَفَرُوا بَعْدَ إِسْلَامِهِمْ
وَهَمُّوا بِمَا لَمْ يَنَالُوا ۚ وَمَا نَقَمُوا إِلَّا أَنْ أَغْنَاهُمُ اللَّهُ
وَرَسُولُهُ مِن فَضْلِهِ ۚ فَإِن يَتُوبُوا يَكُ خَيْرًا لَّهُمْ ۖ وَإِن يَتَوَلَّوْا
يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ عَذَابًا أَلِيمًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَمَا لَهُمْ
فِي الْأَرْضِ مِن وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ﴾
৭৪। তারা
আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে বলে, আমরা ও কথা বলিনি।অথচ তারা
নিশ্চয়ই সেই কুফরীর কথাটা বলেছে।৮৩ তারা ইসলাম
গ্রহনের পর কুফরী অবলম্বন করেছে। তারা
এমনসব কিছু করার সংকল্প করেছিল যা করতে পারেনি।৮৪ আল্লাহ ও
তাঁর রসূল নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিয়েছেন বলেই তাদের এত ক্রোধ ও
আক্রোশ !৮৫ এখন যদি
তারা নিজেদের এহন আচরণ থেকে বিরত হয়, তাহলে তাদের জন্যই ভাল। আর যদি
বিরত না হয়, তাহলে
আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন,এবং পৃথিবীতে তাদের পক্ষ
অবলম্বনকারী ও সাহায্যকারী কেউ থাকবে না।
৮৩. এখানে যে কথার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে সেটি কি ছিল? সে
সম্পর্কে কোন নিশ্চিত তথ্য আমাদের কাছে পৌছেনি। তবে হাদীসে বেশ কিছু কুফরী কথাবার্তার উল্লেখ করা হয়েছে যা
মুনাফিকরা বলাবলী করতো।
যেমন এক মুনাফিকের ব্যাপারে বলা হয়েছেঃ
সে তার আত্মীদের মধ্য থেকে একজন মুসলিম যুবকের সাথে কথা বলার সময় বললোঃ যদি এ
ব্যক্তি (অর্থাৎ নবী সা.) যা বলেছেন তা সব সত্য হয় তাহলে আমরা সবাই গাধার চেয়ে ও
অধম। আর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
তাবুকের সফরে এক জায়গায় নবী সা. এর উটনী হারিয়ে যায়। মুসলমানরা সেটি খুঁজে বেড়াতে থাকে। মুনাফিকদের একটি দল এ ব্যাপারটি নিয়ে নিজেদের মজলিসে খুব
হাসাহাসি করতে থাকে।
তারা বলতে থাকে, "ইনি তো আকাশের খবর খুব
শুনিয়ে থাকেন কিন্তু নিজের উটনীর এখন কোথায় সে খবরতো তার জানা নেই"।
৮৪. তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা যেসব ষড়যন্ত্র করেছিল এখানে
সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। এর
মধ্যে ষড়যন্ত্রটির মুহাদ্দিসগণ নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছেন। তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিম সেনাদল যখন এমন একটি পাহাড়ী
রাস্তার কাছে পৌছুল তখন কয়েক জন মুনাফিক নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিল যে, রাতে
উঁচু গিরিপথ দিয়ে চলার সময় নবী সা. কে তারা পার্শ্ববর্তী গভীর খাদের মধ্যে ঠেলে
ফেলে দেবে। নবী সা. একথা জানতে পারলেন। তিনি সমগ্র সেনাদলকে গিরিপথ এড়িয়ে উপত্যকার
সমতল ভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন এবং নিজে শুধুমাত্র আম্মার ইবনে
ইয়াসার রা. ও হুযাইফা ইবনে ইয়ামনকে সা. নিয়ে গিরিপথের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকেলেন। পথিমধ্যে জানতে পারলেন, দশ
বারোজন মুনাফিক মুখোশ পরে পিছনে পিছনে আসছে। এ অবস্থা দেখে হযরত হুযাইফা রা. তাদের দিকে ছুটলেন,
যাতে
তিনি যাতে তিনি তাদের উটগুলোকে আঘাত করে ফিরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তারা,
দূর
থেকেই হযরত হুযাইফাকে আসতে দেকে ভয় পেয়ে গেলো এবং ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সংগে সংগেই
পালিয়ে গেলো।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে ষড়যন্ত্রটের কথা বর্ণিত হয়েছে সেটি হচ্ছেঃ নবী সা. ও
তার বিশ্বস্ত সাথীরা রোমানদের সাথে লড়াই করে নিরাপদে ফিরে আসবেন,এটা মুনাফিকরা আশা করেনি। তাই তারা ঠিক করে নিয়েছিল যে যখনই ওদিকে কোন
দুর্ঘটানা ঘটে যাবে তখনই তারা মদীনায় আবদুল্লাহ ইববে উবাই এর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে
দেবে।
৮৫. রসূলুল্লাহ সা. এর হিজরতের পূর্বে মদীনা ছিল আরবের মফস্বল
এলাকার ছোট শহরগুলোর মত একটি মামুলী শহর। আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটিও অর্থ সম্পদ ও মর্যাদা-প্রতিপত্তির
দিক দিয়ে কোন উঁচু পর্যায়ের ছিল না। কিন্তু রসূলুল্লাহর সা. সেখানে আগমনের পর আনসাররা যখন তার সাথে সহযোগিতা করে
নিজেদের বিপদের মুখে ঠেলে দিল। তখন মাত্র আট নয় বছরের মধ্যে এ মাঝারী ধরনের মফস্বল শহরটি সারা আরবের
রাজধানীতে পরিণত হলো। আর
সেই আওস ও খাযরাজের কৃষকরাই হয়ে গেলেন রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও পরিচালক। চতুরদিকে থেকে বিজয়, গনীমাতের
মাল ও ব্যবসায় বাণিজ্যের মুনাফা লব্ধ সম্পদ এ কেন্দ্রিয় শহরটির ওপর বৃষ্টি ধারার
মতো বর্ষিত হতে থাকলো। এ
অবস্থাটিকে সামনে রেখে আল্লাহ তাদেরকে এ বলে লজ্জা দিচ্ছেন যে, আমার
এ নবীর বদৌলতে তোমাদের ওপর এসব নিয়ামত বর্ষণ করা হচ্ছে,এটাই
কি তার দোষ এবং এ জন্যই কি তার প্রতি তোমাদের এ ক্রোধ?
﴿وَمِنْهُم
مَّنْ عَاهَدَ اللَّهَ لَئِنْ آتَانَا مِن فَضْلِهِ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ
مِنَ الصَّالِحِينَ﴾
৭৫। তাদের
মধ্যে এমনও কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর কাছে অংগীকার করেছিল, যদি তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের
ধন্য করেন তাহলে আমরা দান করবো এবং সৎ হয়ে যাবো।
﴿فَلَمَّا آتَاهُم مِّن فَضْلِهِ
بَخِلُوا بِهِ وَتَوَلَّوا وَّهُم مُّعْرِضُونَ﴾
৭৬। কিন্তু
যখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে বিত্তশালী করে দিলেন তখন তারা কার্পণ্য করতে
লাগলো এবং নিজেদের অংগীকার থেকে এমনভাবে পিছটান দিল যে, তার কোন পরোয়াই তাদের রইল
না।৮৬
৮৬. উপরের আয়াতে মুনাফিকদের যে অকৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্ন আচরণের
নিন্দা করা হয়েছিল তার আর একটি প্রমাণ তাদের নিজেদেরই জীবন থেকে পেশ করে এখানে
সুষ্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, আসলে এরা দাগী অপরাধী। এদের নৈতিক বিধানে কৃতজ্ঞতা, অনুগ্রহের
স্বীকৃতি, ও অংগীকার পালন ইত্যাদি গুণাবলীর নামগন্ধও
পাওয়া যায় না।
﴿فَأَعْقَبَهُمْ
نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا
وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ﴾
৭৭। ফলে তারা
আল্লাহর সাথে এই যে অংগীকার ভংগ করলো এবং এই যে, মিথ্যা বলতে থাকলো, এ কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে
মুনাফিকী বদ্ধমূল করে দিলেন, তার দরাবারে তাদের উপস্থিতির দিন পর্যন্ত
তা তাদের পিছু ছাড়বে না।
﴿أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ
اللَّهَ يَعْلَمُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَاهُمْ وَأَنَّ اللَّهَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ﴾
৭৮। তারা কি
জানে না, আল্লাহ
তাদের গোপন কথাও গোপন সলা-পরামর্শ পর্যন্ত জানেন এবং তিনি সমস্ত অদৃশ্য বিষয়ও
পুরোপুরি অবগত?
﴿الَّذِينَ يَلْمِزُونَ الْمُطَّوِّعِينَ
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ
فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ ۙ سَخِرَ اللَّهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
৭৯। (তিনি
এমনসব কৃপণ ধণীদেরকে ভাল করেই জানেন) যারা ঈমানদেরদের সন্তোষ ও আগ্রহ সহকারে
আর্থিক ত্যাগ স্বীকারের প্রতি দোষ ও অপবাদ আরোপ করে এবং যাদের কাছে (আল্লাহর পথে
দান করার জন্য) নিজেরা কষ্ট সহ্য করে যা কিছু দান করে তাছাড়া আর কিছুই নেই, তাদেরকে বিদ্রুপ করে।৮৭ আল্লাহ এ
বিদ্রুপকারীদেরকে বিদ্রুপ করেন। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ
শাস্তি।
৮৭. তাবুক যুদ্ধের সময় যখন নবী সা. চাঁদার জন্য আবেদন জানালেন
তখন বড় বড় ধনশালী মুনাফিকরা হাত গুটিয়ে বসে রইলো। কিন্তু যখন নিষ্ঠাবান ঈমানদাররা সামনে এগিয়ে এসে চাঁদা
দিতে লাগলেন তখন ঐ মুনাফিকরা তাদেরকে বিদ্রুপ করতে লাগলো। কোন সামর্থবান মুসলামন নিজের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনুযায়ী বা
তার চেয়ে বেশী অর্থ পেশ করলে তারা তাদের অপবাদ দিতো যে, তারা
লোক দেখাবার ও সুনাম কুড়াবার জন্য এ পরিমাণ দান করছে। আর যদি কোন গরীব মুসলমান নিজের ও নিজের স্ত্রী ও ছেলে
মেয়েদের অভুক্ত রেখে সামান্য পরিমান টাকাকড়ি নিয়ে আসতো, অথবা
সারা রাত মেহনত মজদুরী করে সামান্য কিছু খেজুর উপার্জন করে তাই এনে রসূলের সা.
সামনে হাযির করতো, তাহলে এ মুনাফিকরা তাদেরকে এ বলে ঠাট্রা করতো, সাবাশ, এবার
এক ফড়িং এর ঠ্যাং পাওয়া গেল। এ দিয়ে রোমের দূর্গ জয় করা যাবে"।
﴿اسْتَغْفِرْ
لَهُمْ أَوْ لَا تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِن تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّةً فَلَن
يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۗ وَاللَّهُ
لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾
৮০। হে নবী!
তুমি এ ধরনের লোকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো, তুমি যদি এদের জন্য সত্তর
বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তাহলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না।কারণ তারা
আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে। আর আল্লাহ
ফাসেকদেরকে মুক্তির পথ দেখান না।
﴿فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ
خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَالُوا لَا تَنفِرُوا فِي الْحَرِّ ۗ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ
أَشَدُّ حَرًّا ۚ لَّوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ﴾
৮১। যাদেরকে
পিছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল তারা আল্লাহর রসূলের সাথে সহযোগিতা না
করারও ঘরে বসে থাকার জন্যে আনন্দিত হলো এবং তারা নিজেদের ধন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর
পথে জিহাদ করতে অপছন্দ করলো। তারা লোকদেরকে বললো, “এ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বের
হয়ো না”। তাদেরকে বলে দাও,জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও
বেশী গরম, হায়! যদি তাদের সেই চেতনা থাকতো!
﴿فَلْيَضْحَكُوا قَلِيلًا
وَلْيَبْكُوا كَثِيرًا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾
৮২। এখন তাদের
কম হাসা ও বেশী কাঁদা উচিত। কারণ তারা যে গুনাহ উপার্জন
করেছে তার প্রতিদান এ ধরনেরই হয়ে থাকে (যে, সে জন্য তাদের কাঁদা উচিত।)
﴿فَإِن رَّجَعَكَ اللَّهُ
إِلَىٰ طَائِفَةٍ مِّنْهُمْ فَاسْتَأْذَنُوكَ لِلْخُرُوجِ فَقُل لَّن تَخْرُجُوا مَعِيَ
أَبَدًا وَلَن تُقَاتِلُوا مَعِيَ عَدُوًّا ۖ إِنَّكُمْ رَضِيتُم بِالْقُعُودِ أَوَّلَ
مَرَّةٍ فَاقْعُدُوا مَعَ الْخَالِفِينَ﴾
৮৩। যদি
আল্লাহ তাদের মধ্যে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আগামীতে তাদের মধ্য থেকে কোন দল
জিহাদ করার জন্য তোমার কাছে অনুমতি চায় তাহলে পরিষ্কার বলে দেবে, “এখন আর তোমরা কখখনো আমরা
সাথে যেতে পারবে না এবং আমার সংগী হয়ে কোন দুশমনের সাথে লড়াইও করতে পারবে না। তোমরা
তো প্রথমে বসে থাকাই পছন্দ করেছিলে, তাহলে এখন যারা ঘরে বসে আছে তাদের সাথে
তোমারাও বসে থাকো”।
﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ
مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ ۖ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ
وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ﴾
৮৪। আর
আগামীতে তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা গেলে তার জানাযার নামাযও তুমি কখ্খনো পড়বে না। এবং কখনো
তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। কারণ তারা আল্লাহ ও তার
রসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে ফাসেক অবস্থায়।৮৮
৮৮. তাবুক থেকে ফিরে আসার পর বেশী দিন যেতে না যেতেই মুনাফীক
নেতা আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেলো। তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। তিনি নবী সা. এর খেদমতে হাযির হয়ে কাফনে
ব্যবহারের জন্য তাঁর কোর্তা চাইলেন। তিনি অত্যন্ত উদার হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে কোর্তা দিয়ে দিলেন। তারপর আবদুল্লাহ তাঁকেই জানাযার নামায পড়াবার
জন্য অনুরোধ করলেন।
তিনি এ জন্যও তৈরী হয়ে গেলেন। হযরত উমর রা. বারবার এ মর্মে আবেদন জানাতে লাগলেন-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি
এমন ব্যক্তির জানাযার নামায পড়াবেন যে অমুক অমুক কাজ করেছে? কিন্তু
তিনি তার এ সমস্ত কথা শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন। তার অন্তরে শত্রু মিত্র সবার প্রতি যে করূনার ধারা
প্রবাহিত ছিল তারি কারণে তিনি ইসলামের এ নিকৃষ্টতম শত্রুর মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর
দরবারে দোয়া করতেও ইতস্তত করলেন না। শেষে যখন, তিনি জানাযার নামায পড়াবার হুকুমে তাকে নামায
পড়াবার জন্য দাঁড়িয়েই গেলেন, তখন এ আয়াতটি নাযিল হলো। এবং সরাসরি আল্লাহর হুকুমে তাঁকে জানাযা
পড়ানো থেকে বিরত রাখা হলো। কারণ এ সময় মুনাফিকদের ব্যাপারে স্থায়ী নীতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, যে, মুসলমানদের
সমাজে আর মুনাফিকদেরকে কোন প্রকারে শিকড় গেড়ে বসার সুযোগ দেয়া যাবে না এবং এমন
কোন কাজ করা যাবে না যাতে এ দলটির সাহস বেড়ে যায়।
এ থেকে শরীয়াতের এ বিষয়টি স্থিরকৃত হয়েছে যে,ফাসেক,
অশ্লীল
ও নৈতিকতা বিরোধী কাজকর্মের লিপ্ত ব্যক্তি এবং ফাসেক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির
জানাযার নামায মুসলমানদের ইমাম ও নেতৃস্থানীয় লোকদের পড়ানো উচিত নয়। তাতে শরীক হওয়াও উচিত নয়। এ আয়াতগুলো নাযিল হবার পর নবী সা. নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে
কোন জানাযার শরীক হবার জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে
জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, সে
কেমন ছিল। যদি জানতে পারতেন সে অসৎ
চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা
যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পারো।
﴿وَلَا
تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُعَذِّبَهُم
بِهَا فِي الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ﴾
৮৫। তাদের
ধনাঢ়্যতা ও তাদের অধিক সংখ্যক সন্তান সন্তুতি তোমাকে যেন প্রতারিত না করে। আল্লাহ
তো তাদেরকে এ ধন ও সম্পদের সাহায্যে এ দুনিয়ায়ই সাজা দেবার সংকল্প করে ফেলেছেন
এবং কাফের থাকা অবস্থায় তাদের মৃত্যু হোক-এটাই চেয়েছেন।
﴿وَإِذَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ
أَنْ آمِنُوا بِاللَّهِ وَجَاهِدُوا مَعَ رَسُولِهِ اسْتَأْذَنَكَ أُولُو الطَّوْلِ
مِنْهُمْ وَقَالُوا ذَرْنَا نَكُن مَّعَ الْقَاعِدِينَ﴾
৮৬। আল্লাহকে
মেনে চলো এবং তাঁর রসূলের সহযোগী হয়ে জিহাদ করো, এ মর্মে যখনই কোন সূরা নাযিল
হয়েছে তোমরা দেখেছো, তাদের মধ্যে যারা সমার্থবান ছিল তারাই তোমাদের কাছে আবেদন
জানিয়েছে, জিহাদে অংশগ্রহন করা থেকে তাদেরকে রেহাই দেয়া হোক। এবং তারা
বলেছে, আমাদের
ছেড়ে দাও। যারা বসে আছে তাদের সাথে আমরা বসে থাকবো।
﴿رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ
الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ﴾
৮৭। তারা
গৃহবাসীনি মেয়েদের সাথে শামিল হয়ে ঘরে থাকতে চেয়েছে এবং তাদের দিলে মোহর মেরে
দেয়া হয়েছে। তাই তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।৮৯
৮৯. অর্থাৎ যদিও এটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার ছিল যে, স্বাস্থ্যবান, বলিষ্ঠ, সুঠামদেহী
ও সামর্থবান লোকেরা ঈমানদের দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও কাজের সময মাঠে ময়দানে বের
হবার পরিবর্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে বসে থাকবে এবং মেয়েদের দলে শামিল হবে, তবুও
যেহেতু এ লোকেরা জেনে বুঝে নিজেদের জন্য এ পথটি পছন্দ করে নিয়েছেল তাই প্রাকৃতিক
আইন অনুযায়ী তাদের থেকে এমন সব পবিত্র অনুভূতি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে যেগুলোর
উপস্থিতিতে মানুষ এ ধরনের ঘৃন্য আচরণ করতে লজ্জাবোধ করে।
﴿لَٰكِنِ
الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ
وَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
৮৮। অন্যদিকে
রসূল ও তার ঈমানদার সাথীরা নিজেদের জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছে। সমস্ত
কল্যাণ এখন তাদের জন্য এবং তারাই সফলকাম হবে।
﴿أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ جَنَّاتٍ
تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾
৮৯। আল্লাহ
তাদের জন্য এমন বাগান তৈরী করে রেখেছেন। যার
নিম্নদেশে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হচ্ছে। তার মধ্যে
তারা থাকবে চিরকাল। এটাই মহা সাফল্য।
﴿وَجَاءَ الْمُعَذِّرُونَ
مِنَ الْأَعْرَابِ لِيُؤْذَنَ لَهُمْ وَقَعَدَ الَّذِينَ كَذَبُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ
ۚ سَيُصِيبُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
৯০। গ্রামীণ
আরবের৯০ মধ্যে
থেকেও অনেক লোক এলো। তারা ওযর পেশ করলো, যাতে তাদেরকেও পিছনে থেকে
যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। যারা আল্লাহ ও তার রসূলের
সাথে ঈমানের মিথ্যা অংগীকার করেছিল তারাই এভাবে বসে রইল। এ গ্রামীণ
আরবদের মধ্য থেকে যারাই কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে৯১ শীঘ্রই
তারা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।
৯০. গ্রামীণ আরব মানে আশেপাশে বসবাসকারী পল্লী ও মরুবাসী আরবরা। এদেরকে সাধারণভাবে বেদুঈন বা বাদ্দু বলা হয়।
৯১. মুনাফিক সূলভ তথা ভণ্ডামীপূর্ণ ঈমানের প্রকাশ, যার
ভেতরে নেই সত্যের যথার্থ স্বীকৃতি,
আত্মসমর্পণ,
নিষ্ঠা,
আন্তরিকতা, ও
আনুগত্য, এবং যার বাহ্যিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও মানুষ
আল্লাহ ও তার দীনের তুলনায় নিজের স্বার্থ এবং পার্থিব মোহ ও আশা-আকাংখাকে প্রিয়তর
মনে করে। এ ধরনের ঈমান প্রকৃতপক্ষে
কুফরী ও অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।দুনিয়ার এ ধরনের লোকদেরকে কাফের গণ্য না করা এবং তাদের সাথে মুসলমানের মতো
ব্যবহার করা হলেও আল্লাহর দরবারে তাদের সাথে অবাধ্য অস্বীকারকারী ও বিদ্রোহীদের
মতো,আচরণ করা হবে। এ পার্থিব জীবনে মুসলিম সমাজের ভিত্তি যে আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ বিধানের
ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র ও তার বিচারক আইন প্রয়োগ করেন তার প্রেক্ষিতে মুনাফিকীকে
কুফরী বা কুফরী সদৃশ কেবল তখনই বলা যেতে পারে যখন অস্বীকৃতি, বিদ্রোহ
বিশ্বসঘাতকতা ও অবিশ্বস্ততার প্রকাশ সুষ্পষ্টভাবে হবে। তাই মুনাফিকীর এমন অনেক ধরন ও অবস্থা থেকে যায় শরীয়াতের
বিচারে যেগুলোকে কুফরী নামে অভিহিত করা যায় না। কিন্তু শরীয়াতের বিচারে কোন মুনাফিকের কুফরীর অভিযোগ
থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অর্থ এ নয় যে,
আল্লাহর
বিচারেও সে এ অভিযোগ এর শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে।
﴿لَّيْسَ
عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَى الْمَرْضَىٰ وَلَا عَلَى الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا
يُنفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ
مِن سَبِيلٍ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৯১। দুর্বল ও
রুগ্ন লোকেরা এবং যেসব লোক জিহাদে শরীক হবার জন্য পাথেয় পায় না, তারা যদি পিছনে থেকে যায়
তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই, যখন তারা আন্তরিকতভাবে আল্লাহ ও রসূলের
প্রতি বিশ্বস্ত।৯২ এ ধরনের সৎকর্মশীলদের
বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন অবকাশই নেই। আল্লাহ
ক্ষমাশীল ও করূণাময়।
৯২. এ থেকে জানা যায় যারা বাহ্যত অক্ষম, তাদের
জন্য ও নিছক শারীরিক দুর্বলতা, রুগ্নতা,বা
নিছক অপরাগাত দায়িত্ব থেকে অব্যহতি লাভের জন্য নয়। বরং তাদের অক্ষমাতগুলো কেবলমাত্র তখনই দায়িত্ব থেকে
অব্যহতি লাভের কারণ হতে পারে যখন তারা হবে আল্লাহ ও তার রসূলের সত্যিকার বিশ্বস্ত
ও অনুগত্য। অন্যথায় কোন ব্যক্তির
মধ্যে যদি বিশ্বস্ততা না থাকে তাহলে তাকে শুধুমাত্র এ জন্য মাফ করা যেতে পারে না
যে, কর্তব্য পালনের সময় সে রোগগ্রস্ত বা অপরাগ ছিল। আল্লাহ শুধু বাইরের অবস্থাই দেখন না। তাই যেসব লোক অসুস্থতার ডাক্তারী সার্টিফিকেট
অথবা বার্ধক্য ও শারীরিক ত্রুটির ওযর পেশ করবে তাদেরকে আল্লাহর দরবারেও তদ্রূপ
অক্ষম গণ্য করা হবে এবং তাদেরকে আর কোন প্রকার জিজ্ঞেসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে না,
একথা
ঠিক নয়। তিনি তো তাদের প্রত্যেক
ব্যক্তির মন-মানসিকতা বিশ্লেষণ করবেন,
তার
সমগ্র গোপন ও আপাতদৃষ্ট আচরণ নিরীক্ষণ করবেন এবং তাদের অক্ষমতা কোন বিশ্বস্ত
বান্দার অক্ষমতার পর্যায়ভুক্ত ছিল না,
বিদ্রোহীর
পর্যায়ভুক্ত তা যাচাই করবেন্ কেউ কেউ এমন আছে যে, কর্তব্যের
ডাক শুনে লাখো লাখো, শুকরিয়া আদায় করে এবং মনে মনে বলে, বড়
ভালো সময়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। নয়তো কোনক্রমেই এ বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতো না এবং অনর্থক আমাকে
গঞ্জনা ভুগতে হতো। আবার অন্য একজন এ একই ডাক
শুনে অস্থির না হয়ে উঠে বলে হায় কেমন এক সময আমি অসুখে পড়লাম। যখন মাঠে ময়দানে নেমে কাজ করার সময় তখন কিনা আমি বিছানায়
শুয়ে শুয়ে অযথা সময় নষ্ট করছি। একজন নিজের রোগকে কর্তব্যের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাহানা হিসেবে
ব্যবহার তো করছিলই এ সংগে সে অন্যদেরকে ও এ কর্তব্য পালনে বাধা দেবার চেষ্টা
করলো। অন্যজন বাধ্য হয়ে
রোগাশয্যায় পড়ে থাকলেও বারবার নিজের ভাই-বেরাদার,
আত্মীয়
স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জিহাদ করতে উদ্ধুদ্ধ করে চলছিল এবং নিজের সেবা ও
শুশ্রূষাকারীদেরকেও বলে চলছিল, আমাকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ
করে দিয়ে যাও। অষুধ ও পথ্যের ব্যবস্থা
কোন না কোনভাবে হয়ে যাবেই। আমার একজনের জন্য আল্লাহর সত্য দীনের সেবায় নিবেদিত মূল্যবান সময়টি তোমরা
নষ্ট করো না। একজন অসুস্থতার অজুহাতে ঘরে
বসে থেকে যুদ্ধের সারাটা সময় মানুষের মন ভাংগারবার, দুঃসংবাদ
ছড়াবার, যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এবং
মুজাহিদের অনুপস্থিতিতে তাদের পারিবারিক কাজ করে। অন্যজন নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হবার সৌভাগ্য থেকে
বঞ্চিত হতে দেখে জেহাদের ঘরোয়া অংগনকে (Home
front) মজবুত
রাখার জন্য নিজের সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালায়। বাহ্যত এরা দুজনই অক্ষম। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এ দুই ধরনের অক্ষমরা কখনো সমান
হতে পারে না। আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন
তাহলে কেবল এ দ্বিমত জনকেই ক্ষমা করবেন।আর প্রথমে ব্যক্তি নিজের অক্ষমতা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকা ও
নাফরমানীরর অপারাধে অভিযুক্ত হবে।
﴿وَلَا
عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ
عَلَيْهِ تَوَلَّوا وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا
مَا يُنفِقُونَ﴾
৯২।
অনুরূপভাবে তাদের বিরুদ্ধে ও অভিযোগের কোন সুযোগ নেই যারা নিজেরা এসে তোমার
কাছে আবেদন করেছিল, তাদের জন্য
বাহনের ব্যবস্থা করতে কিন্তু তুমি বলেছিলে আমি তোমাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করতে
পারছি না। তখন তারা বাধ্য হয়ে ফিরে গিয়েছিল। তখন তাদের
অবস্থা এ ছিল যে, তাদের চোখে দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল এবং নিজেদের অর্থ
ব্যয়ে জিহাদে শরীক হতে অসমর্থ হবার দরূন তাদের মনে বড়ই কষ্ট ছিল।৯৩
৯৩. যারা দীনের খেদমত করার জন্য সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে তারা
যদি কোন সত্যিকার অক্ষমতার কারণে অথবা উপায়-উপকরণ বা মাধ্যম যোগাড় না হওয়ার দরুণ
কার্যত খেদমত করতে না পারে তাহলে মনে ঠিক তেমনি কষ্ট পায় যেমন কোন বৈষয়িক
স্বার্থন্বেষী ব্যক্তির রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেলে অথবা কোন বড় আকারের লাভের
সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে মনে কষ্ট হয়,
তারা
বাস্তবে কোন খেদমত না করলেও আল্লাহর কাছে খেদমতাকারী হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ তারা হাত পা চালিয়ে কোন কাজ করতে পারিনি
ঠিকই কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে তারা সর্বক্ষণ কাজের মাধ্যেই থাকে। এ কারণে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে এক জায়গায়
নবী সা. তার সংগী-সাথীদেরকে সম্বোধন করে বলেন,
إن بالمدينة أقوامًا ما سرتم مسيرًا ولا
قطعتم واديًا إلا كانوا معكم
মদীনায় কিছু লোক আছে যারা প্রতিটি উপত্যকা অতিক্রমকালে এবং প্রতিটি যাত্রার
সময় তোমাদের সাথে থেকেছে।
সাহবীগণ আবাক হয়ে বলেন, মদীনায় অবস্থান করেই,
বলেন, হ্যাঁ
মদীনায় অবস্থান করেই।
কারণ অক্ষমতা তাদেরকে আটকে রেখেছিল নয়তো,
তারা
নিজেরা থেকে যাবার লোক ছিল না।
﴿إِنَّمَا
السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ وَهُمْ أَغْنِيَاءُ ۚ رَضُوا بِأَن يَكُونُوا
مَعَ الْخَوَالِفِ وَطَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৯৩। অবশ্যি
অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে যারা বিত্তশালী হবার পরও জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে তোমার
কাছে অব্যাহতি চাচ্ছে। তারা পুরবাসিনীদের সাথে
থাকাই পছন্দ করেছে। আল্লাহ তাদের দিলে মোহর মেরে
দিয়েছেন তাই তারা এখন কিছুই জানে না।(যে
আল্লাহর কাজে তাদের এহেন কর্মনীতি গ্রহণের ফল কী দাঁড়াবে।)
﴿يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ
إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ ۚ قُل لَّا تَعْتَذِرُوا لَن نُّؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا
اللَّهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ ۚ وَسَيَرَى اللَّهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ
إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
৯৪। তোমরা
যখন ফিরে তাদের কাছে পৌছবে তখন তারা নানা ধরনের ওযর পেশ করতে থাকবে। কিন্তু
তুমি পরিষ্কার বলে দেবে, “বাহানাবাজী করো না, আমরা তোমাদের কোন কথাই
বিশ্বাস করবো না। তোমাদের অবস্থা আল্লাহ আমাদের জানিয়ে
দিয়েছেন। এখন আল্লাহ ও তার রসূল তোমাদের
কার্যকলাপ লক্ষ করবেন। তারপর তোমাদেরকে তারই দিকে
ফিরিয়ে দেয়া হবে। যিনি প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছুই জানেন এবং
তোমরা কি কাজ করছিলে তা তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন”।
﴿سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ
لَكُمْ إِذَا انقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ
ۖ إِنَّهُمْ رِجْسٌ ۖ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾
৯৫। তোমরা
ফিরে এলে তারা তোমাদের সামনে কসম খাবে, যাতে তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা করো। ঠিক আছে,তোমরা অবশ্যি তাদেরকে
উপেক্ষা করো।৯৪ কারণ তারা অপবিত্র এবং তাদের
আসল আবাস জাহান্নাম। তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ
এটি তাদের ভাগ্যে জুটবে।
৯৪. প্রথম বাক্যে উপেক্ষা করার অর্থ হচ্ছে, এড়িয়ে
যাওয়া আর দ্বিতীয় বাক্যে এর অর্থ হচ্ছে,
সম্পর্ক
ছিন্ন করা। অর্থাৎ তারা চায় যেন তাদের
ব্যাপারে বেশী মাথা না ঘামাও এবং অনুসন্ধান না চালাও। কিন্তু তোমাদের পক্ষেও এটাই উত্তম যে, তাদের
সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না। এবং মনে করে নেবে যে, তোমরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছোএবং তারাও
তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
﴿يَحْلِفُونَ
لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ ۖ فَإِن تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَرْضَىٰ
عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ﴾
৯৬। তারা
তোমাদের সামনে কসম খাবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হও। অথচ
তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হলেও আল্লাহ কখনো এহেন ফাসেকদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।
﴿الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا
وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا حُدُودَ مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ
ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
৯৭। এ বেদুইন
আরবরা কুফরী ও মুনাফিকীতে বেশী কঠোর এবং আল্লাহ তার রসূলের প্রতি যে দীন নাযিল
করেছেন তার সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভবনা বেশী।৯৫ আল্লাহ
সবকিছু জানেন, তিনি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।
৯৫. আমরা আগেই বলে এসেছি,
বেদুঈন
আরব বলতে এখানে গ্রামীণ ও মরুবাসীদের কথা বলা হয়েছে। এরা মদীনার আশপাশে বসবাস করতো।মদীনায় একটি মজবুত ও সংগঠিত শক্তির উত্থান ঘটতে দেখে এরা
প্রথমে শংকিত হয়। তারপর ইসলাম ও কুফরের
সংঘাতকালে বেশ কিছুকাল তারা সুযোগ সন্ধানী নীতি অবলম্বন করতে থাকে।এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হেজায ও নজদের
একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এবং তার মোকিবালায় বিরোধী গোত্রগুলোর শক্তি
ভেংগে পড়তে থাকলে তারা ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করাকেই সে সময় নিজেদের জন্য
সুবিধাজনক ও নিরাপদ মনে করে। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ইসলামকে যথার্থ আল্লাহর সত্য দীন মনে করে
সাচ্চা দিলে ঈমান আনে এবং আন্তরিকতার সাথে তার দাবীসমূহ পূর্ণ করতে উদ্যোগী হয়। অধিকাংশ বেদুঈনের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ঈমান ও
আকিদার ব্যাপার নয় বরং নিছক স্বার্থ, সুবিধা ও কৌশলের ব্যাপার ছিল। তারা চাচ্ছিল,ক্ষমতাসীন দলের সদস্যপদ লাভ
করার ফলে সেসব সুবিধা ভোগ করা যায় শুধু সেগুলোই তাদের ভাগে এসে যাক। কিন্তু ইসলাম তাদের ওপর যেসব নৈতিক বিধি-নিষেধ
আরোপ করেছিল ইসলাম গ্রহণ করার পরপরই তাদের ওপর নামায পড়ার ও রোযা করার যে বিধান
আরোপিত হতো, যথারীতি তহশীলদার নিযুক্ত করে তাদের খেজুর
বাগান ও শষ্যগোল থেকে যে যাকাত উসূল করা হতো,
তাদের
জাতীয় ইতিহাসে এ প্রথম বারের মতো তাদেরকে যে আইন-শৃংখলার রশিতে শক্তভাবে বাধা
হয়েছিল এবং লুটতরাজের যুদ্ধের জন্য নয় বরং খালেস আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য দিনের
পর দিন তাদের কাছে থেকে যে জানমালের কুরবানী চাওয়া হচ্ছিল-এসব জিনিস তাদের কাছে
ছিল অতিশয় অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর এবং এগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য
তারা নানা ধরনের চালবাজী ও টালবাহানার আশ্রয় নিতো। সত্য কি এবং তাদের ও সমস্ত মানুষের যথার্থ কল্যাণ কিসে, তা
নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। তারা শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, নিজেদের
আয়েশ-আরাম, নিজেদের জমি,উট, ছাগল, ভেড়া
এবং নিজেদের তাবুর চারপাশের জগত নিয়ে মাথা ঘামাতো। এ উর্ধের কোন জিনিসের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। অবশ্য পীর-ফকীরদের কাছে যেমন নযরানা পেশ করা
হয়, এবং তার বিনিময়ে তারা আয় বৃদ্ধি, বিপদ
থেকে নিস্কৃতি এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য ঝাড়ফূঁক করেন, তাবীজ
দেনও তাদের জন্য দোয়া করেন ঠিক তেমনি ধরনের কোন কাল্পনিক জিনিসের প্রতি
ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণের প্রবণতা হয়তো তাদের ছিল। কিন্তু এমন কোন ঈমান ও আকীদার জন্য তারা তৈরী ছিলো না, যা
তাদের সমগ্র তামাদ্দুনিক ও সামাজিক জীবনকে একটি নৈতিক ও আইনগত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধে ফেলবে এবং এ সংগে একটি বিশ্বজনীন সংস্কার কার্যক্রমের জন্য তাদের কাছে জান
মালের কুরবানীরও দাবী জানাবে।
তাদের এ অবস্থাটিকেই এখনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, নগরবাসীদের
তুলনায় এ গ্রামীন ও মরুবাসী লোকেরাই বেশী মুনাফিকী ও ভণ্ডলীর আচরণ অবলম্বন করে
থাকে এবং সত্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা এদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। আবার এর কারণও বলে দেয়া হয়েছে যে, নগরবাসীরা
তো জ্ঞানীগুণী ও সত্যানুসারী লোকদের সাহচর্যে এসে দীন ও তার বিধি বিধান সম্পর্কে
কিছু না কিছু জ্ঞান লাভ করতেও পারে কিন্তু এ বেদুইনরা যেহেতু সারাটা জীবন নিরেট
খাদ্যন্বেষী জীবন নিরেট খাদ্যন্বেষী জীব-জানোয়ারের মতো দিন রাত কেবল রুজী
রোজগারের ধান্দায় লেগে থাকে এবং পশু জীবনের প্রয়োজনের চাইতে উন্নত পর্যায়ের কোন
জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেবার সময়ই তাদের থাকে না,
তাই
ইসলাম ও তার বিধি বিধান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ থাকার সম্ভাবনা বেশী।
এখানে এ বাস্তব সত্যটির প্রতি ইংগিত করাও অপ্রাসংগিক হবে না যে, এ
আয়াতগুলো নাযিলের প্রায় দুবছর পর হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতের প্রাথমিক যুগে
মুরতাদ হওয়ার ও যাকাত বর্জনের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আলোচ্য আয়াতগুলোতে বর্ণিত
ও কারনটি তার অন্যতম ছিল।
﴿وَمِنَ
الْأَعْرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ
ۚ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
৯৮। এ
গ্রামীণদের মধ্যে এমন এমন লোকও রয়েছে যারা আল্লাহর পথে কিছু ব্যয় করলে তাকে
নিজেদের ওপর জোরপূর্বক চাপানো অর্থদণ্ড মনে করে৯৬ এবং
তোমাদের ব্যাপারে কালের আবর্তনের প্রতীক্ষা করছে (অর্থাৎ তোমরা কোন বিপদের মুখে
পড়লে যে শাসন ব্যবস্থার আনুগত্যের শৃংখল তোমরা তাদের গলায় বেঁধে দিয়েছ তা তারা
গলা থেকে নামিয়ে ফেলবে।) অথচ মন্দের আবর্তন তাদের
ওপরই চেপে বসেছে। আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
৯৬. এর অর্থ হচ্ছে তাদের থেকে যে যাকাত আদায় করা হয় তারা তাকে
একটা জরিমান মনে করে।
মুসাফিরদের আহার করাবার ও মেহমানদারীর যে দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, তা
তাদের কাছে অসহনীয় বোঝা মনে হয়। আর যদি কোন যুদ্ধ উপলক্ষে তারা কোন চাঁদা দেয় তাহলে আন্তরিকভাবে আবেগ
আপ্লুত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দেয় না। বরং নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিজেদের
বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য দিয়ে থাকে।
﴿وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَن يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَاتٍ عِندَ اللَّهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُولِ ۚ أَلَا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَّهُمْ ۚ سَيُدْخِلُهُمُ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৯৯। আবার এ
গ্রামীণদের মধ্য থেকে কিছু লোক এমনও আছে যারা আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান
রাখে এবং যা কিছু খরচ করে তাকে আল্লাহর দরবারে নৈকট্য লাভের এবং রাসূলের কাছ থেকে
রহমতের দোয়া লাভের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। হাঁ, অবশ্যি তা তাদের জন্য
নৈকট্যলাভের উপায় এবং আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে রহমতের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। অবশ্যি
আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
﴿وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ
مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ
اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ
خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾
১০০। মুহাজির ও
আনসারদের মধ্যে থেকে যারা সবার আগে ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী
হয়েছে এবং যারা পরে নিষ্ঠা সহকারে তাদের অনুসরণ করছে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট
হয়েছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহ
তাদের জন্য এমন বাগান তৈরী করে রেখেছেন যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে এবং
তারা তার মধ্যে থাকবে চিরকাল। এটাই মহা সাফল্য।
﴿وَمِمَّنْ حَوْلَكُم مِّنَ
الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ ۖ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ ۖ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ
لَا تَعْلَمُهُمْ ۖ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ ۚ سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ
إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٍ﴾
১০১। তোমাদের
আশেপাশে যেসব বেদুইন থাকে তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক মুনাফিক।
অনুরূপভাবে মদীনাবাসীদের মধ্যেও রয়েছে এমন কিছু মুনাফিক, যারা মুনাফিকীতে পাকাপোক্ত
হয়ে গেছে। তোমরা তাদেরকে চিন না, আমি চিনি তাদেরকে।৯৭ শীঘ্রই আমি
তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দেবো।৯৮ তারপর আরো
বেশী বড় শাস্তির জন্য তাদেরকে ফিরিয়া আনা হবে।
৯৭. অর্থাৎ নিজেদের মুনাফিকী গোপন করার ব্যাপারে তারা এতই
দক্ষতা অর্জন করেছে যে, নবী সা.নিজেও তার অসাধারণ অন্তরদৃষ্টি, বুদ্ধিমত্তা, ও
বিচক্ষণতা, সত্ত্বেও তাদেরকে চিনতে পারতেন না।
৯৮. দ্বিগুণ শাস্তি মানে,
হচ্ছে, একদিকে
যে দুনিয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে তারা ঈমান ও আন্তরিকতার পরিবর্তে মুনাফিকী, ভণ্ডামী, ও
বিশ্বাসঘাতকতার নীতি অবলম্বন করছে তা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং তারা ধন-সম্পদ,মর্যাদাও প্রতিপত্তি লাভের
পরিবর্তে বরং শোচনীয় অমর্যাদা,
লাঞ্ছনা, ও
ব্যর্থতার শিকার হবে।
অন্যদিকে তারা যে সত্যের দাওয়াতকে ব্যর্থ ও অসফল দেখতে এবং নিজেদের চালবাজীর
মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিতে চায় তা তাদের ইচ্ছা,
ও
প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাদের চোখের সামনে উন্নতি ও বিকাশ লাভ করতে থাকবে।
﴿وَآخَرُونَ
اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ
أَن يَتُوبَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
১০২। আরো কিছু
লোক আছে, যারা
নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের
কাজকর্ম মিশ্র ধরনের কিছু ভাল, কিছু মন্দ। অসম্ভব নয়, আল্লাহ তাদের প্রতি আবার
মেহেরবান হয়ে যাবেন। কারণ, তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
﴿خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ
صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ
سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
১০৩। হে নবী!
তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করো, (নেকীর পথে) তাদেরকে এগিয়ে দাও
এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করো। তোমার
দোয়া তাদের সান্তনার কারণ হবে। আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
﴿أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ
اللَّهَ هُوَ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَأْخُذُ الصَّدَقَاتِ وَأَنَّ
اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾
১০৪। তারা কি
জানে না, আল্লাহই
তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, তাদের দান-খয়রাত গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ
বড়ই ক্ষমাশীল, ও করুণাময়?
﴿وَقُلِ اعْمَلُوا فَسَيَرَى
اللَّهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ ۖ وَسَتُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ
الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
১০৫। আর হে
নবী! তাদেরকে বলে দও, তোমরা কাজ করতে থাকো। আল্লাহ
তার রসূল ও মুমিনরা তোমাদের কাজের ধারা এখন কেমন থাকে তা দেখবেন।৯৯ তারপর
তোমাদের তার দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে যিনি প্রকাশ্যে ও গোপনে সবকিছু জানেন এবং
তোমরা কি করতে তা তিনি তোমাদের বলে দেবেন।১০০
৯৯. এখানে মিথ্যা ঈমানের দাবীদার ও গোনাহগার মুমিনের পার্থক্য, পরিষ্কারভাবে
তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তি ঈমানের দাবী করে,কিন্তু
আসলে আল্লাহ, তাঁর রসূলও মুমিনের জামায়াতের ব্যাপারে আন্তরিক
নয়, তার এ আন্তরিকতাহীনতার প্রমাণ যদি তার কার্যকলাপের মাধ্যমে
পাওয়া যায়, তাহলে তার সাথে কঠোর ব্যবহার করা হবে। আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য সে কোন সম্পদ পেশ
করলে তা প্রত্যাখান করা হবে। সে মারা গেলে কোন মুসলমান তার জানাযার নামায পড়বে না। এবং তার গোনাহ মাফের জন্য দোয়াও করবে না, সে
তার বাপ বা ভাই হলেও।
অন্যদিকে যে ব্যক্তি সত্যিকার মুমিন কিন্তু এ সত্ত্বেও সে এমন কিছু কাজ করে বসেছে
যা তার আন্তরিকাতাহীনতার প্রমাণ করে,
এ
ক্ষেত্রে সে যদি নিজের ভূল স্বীকার করে নেয় তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া হবে। তার সদকা,
দান-খয়রাত
গ্রহণ করা হবে এবং তার ওপর রহমত নাযিলের জন্য দোয়াও করা হবে। এখন কোন ব্যক্তির আন্তরিকতাবিহীন কার্যকলাপের পরও তাকে
নিছক একজন গোনাহগার মুমিন গণ্য করতে হলে তাকে তিনটি মানদণ্ডে যাচাই করতে হবে। আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত এ মানদণ্ডগুলোর নিম্নরূপঃ
একঃ নিজের ভুলের জন্য সে খোঁড়া অজুহাত ও মনগড়া ব্যাখ্যা পেশ
করবে না। বরং যে ভুল হয়ে গেছে সহজ
সরলভাবে তা মেনে নেবে।
দুইঃ তার আগের কার্যকলাপ দেখা হবে। সে আন্তরিকতাহীনতার দাগী ও অপরাধী কিনা তা যাচাই করা হবে। যদি আহে সে ইসলামের জামায়াতের এক সৎ ও নিষ্ঠাবান
ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে এবং তার জীবনের সমস্ত কার্যকলাপে আন্তরিক সেবা, ত্যাগ, কুরবানী
ও ভালো কাজে অগ্রবর্তী থাকার বেকর্ড থেকে থাকে, তাহলে
ধরে নেয়া হবে, যে বর্তমানে যে ভুল সে করেছে তা ঈমান ও
আন্তরিকতাহীনতার ফল নয় বরং তা নিছক সাময়িক সৃষ্ট একটি দুর্বলতা বা পদস্খলন ছাড়া আর
কিছুই নয়।
তিনঃ তার ভবিষ্যত কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা হবে। দেখতে হবে,
তার
ভুলের স্বীকৃতি কি নিছক মৌখিক না তার মধ্যে লজ্জার গভীর অনুভূতি রয়েছে। যদি নিজের ভুল সংশোধনের জন্য তাকে অস্থির ও
উৎকণ্ঠিত দেখা যায় এবং তার প্রতিটি কথা থেকে এ কথা প্রকাশ হয় যে, তার
জীবনে যে ঈমানী ক্রটির চিত্র ভেসে উঠেছিল তাকে মুছে ফেলার ও তা সংশোধন করার জন্য
সে প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,
তাহলে
সে যথাথই লজ্জিত হয়েছে বলে মনে করা হবে,
এ
লজ্জা ও অনুশোচনাই হবে তার ঈমান ও আন্তরিকতার প্রমাণ।
মুহাদ্দিসগণ এ আয়াতগুলো নাযিলের পটভুমী হিসেবে যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তা থেকে
এ বিষয়বস্তুটি আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তারা বলেন,
এ
আয়াতগুলো আবু লুবাবাহ ইবনে আবদুল মুনযির ও তার ছজন সাথীর প্রসংগে নাযিল হয়েছিল।হিজরতের আগে আকাবার বাইআতের সময় যারা ইসলাম
গ্রহণ করেছিলেন আবু লুবাবাহ ছিলেন তাদের একজন। বদর, ওহোদ ও অন্যান্য যুদ্ধে
তিনি বারবার অংশ গ্রহন করেন। কিন্তু তাবুক যুদ্ধের সময মানসিক দুর্বলতার তার ওপর প্রধান্য বিস্তার করে এবং
কোন প্রকার শরয়ী ওযর ছাড়াই তিনি ঘরে বসে থাকেন। তার অন্য সাথীরাও ছিলেন তারই মতো আন্তরিকতা সম্পন্ন। তারাও এ একই প্রকার দুর্বলতার শিকার হন। নবী সা. যখন তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন এবং
যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও তার রসূলের মতামত কি তা তারা
জানতে পারলেন তখন তারা ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলেন। কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদের আগেই তারা নিজেদেরকে একটি খুটির
সাথে বেধে নেন এবং বলেন, আমাদের মাফ না করে দেয়া পর্যন্ত আমাদের জন্য
আহার নিদ্রা হারাম। এ অবস্থায় আমাদের প্রাণ
বায়ূ বের হয়ে গেলেও আমরা তার পরোয়া করবো না। কয়েক দিন পর্যন্ত এভাবেই তারা বাধা অবস্থায় অনাহার
অনিদ্রায় কাটান। এমনকি একদিন তারা বেহুশ হয়ে
পড়ে যান। শেষে তাদের জানানো হলো, আল্লাহ
ও তার রসূল তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। তারা নবী সা.কে বলেন, ঘরের যে আরাম আয়েশ আমাদের ফরয থেকে গাফেল করে
দিয়েছিল তা এবং নিজেদের সমস্ত ধন সম্পদ আমরা আল্লাহর পথে দান করে দেবো, এটাও
আমাদের তাওবার অন্তরভুক্ত। কিন্তু নবী সা. বলেন, সমস্ত ধন-সম্পদ দান করে দেবার দরকার নেই, শুদুমাত্র
এক তৃতীয়াংশই যথেষ্ট।
তদনুসারে তখনই তারা সেগুলো আল্লাহর পথে ওয়াকফ করে দেন। এ ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার জানা যায়,
কোন
ধরনের দুর্বলতা আল্লাহ মাফ করেন। উল্লেখিত মহান সাহাবীগণ এ ধরনের আন্তরিকতাহীন আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। বরং তাদের বিগত জীবনের কার্যকলাট তাদের ঈমানী
নিষ্ঠা, আন্তরিকাতা ও দৃঢ়তার দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ছিল। এবারেও রসূল সা. এর নিকট তাদের কেউ মিথ্যা
অজুহাত পেশ করেননি। বরং নিজেদের ভুলকে নিজেরাই
অকপটে ভুল হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তারা ভুলের স্বীকারোক্তি সহকারে নিজেদের কার্য ধারার মাধ্যমে একথা প্রমাণ
করে দিয়েছের যে, তারা যথাথই লজ্জিত হয়েছেন এবং নিজেদের গোনাহ
মাফ করাবার জন্য অত্যন্ত অস্থির ও উদ্ধিগ্ন।
এখানে আলোচ্য আয়াতটিতে আর একটি মুল্যবান কথা বলা হয়েছে। সে কথাটি হচ্ছে,
গোনাহ
মাফের জন্য মুখ ও অন্তর দিয়ে তাওবা করার সাথে সাথে বাস্তাব কাজের মাধ্যমেও তাওবা
করতে হবে। আর আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ
দান করা হচ্ছে বাস্তব তাওবার একটি পদ্ধতি। এভাবে নফসের মধ্যে যে দুষিত ময়লা আবর্জনা লালিত হচ্ছিল এবং
যার কারণে মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়েছিল তা দূর হয়ে যায় এবং ভালো ও কল্যাণের দিকে
ফিরে যাবার যোগ্যতা বেড়ে যায়। গোনাহ করার পর তা স্বীকার করার ব্যাপাটি এমন যেমন এক ব্যক্তি গর্তের মধ্যে
পড়ে যায় এবং নিজের পড়ে যাওয়াটা সে অনুভব করতে পারে। তারপর নিজের গোনাহের ওপর তার লজ্জিত হওয়াটা এ অর্থ বহন
করে যে, এ গর্তকে সে নিজের অবস্থানের জন্য বড়ই খারাপ
জায়গা মনে করে এবং এ জন্য ভীষণ কষ্ট অনুভব করতে থাকে। এরপর সাদকা, দান-খয়রাত
এবং অন্যান্য সৎকাজের মাধ্যমে এর ক্ষতি পূরণ করার প্রচেষ্টা চালানোর অর্থ এ দাঁড়ায়
যে, সে গর্ত থেকে বের হয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছে এবং হাত-পা ছুঁড়ছে।
১০০. এর অর্থ হচ্ছে,
চুড়ান্ত
পর্যায়ে প্রতিটি বিষয় সম্পূর্ণরূপে স্বয়ং আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। আর আল্লাহ এমন এক সত্তা যার কাছে কোন কিছু
গোপন থাকতে পারে না। এ
জন্য কোন ব্যক্তি দুনিয়ায় তার ভন্ডামী ও মুনাফিকী গোপন করতে সক্ষমও হয় এবং মানুষ
যেসব মানদণ্ডে কারোর ঈমান ও আন্তরিকতা পরখ করতে পারে সেসবগুলোতে পুরোপুরি
উত্তির্ণ হলেও একথা মনে করা উচিত নয়,
যে
সে মুনাফিকীর শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে গেছে।
﴿وَآخَرُونَ
مُرْجَوْنَ لِأَمْرِ اللَّهِ إِمَّا يُعَذِّبُهُمْ وَإِمَّا يَتُوبُ عَلَيْهِمْ ۗ وَاللَّهُ
عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
১০৬। অপর কিছু
লোকের ব্যাপার এখনো আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় আছে, তিনি চাইলে তাদেরকে শাস্তি
দেবেন, আবার চাইলে
তাদের প্রতি নতুন করে অনুগ্রহ করবেন। আল্লাহ
সবকিছু জানেন তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।১০১
১০১. এদের ব্যাপরটি ছিল সন্দেহপূর্ণ। এদেরকে না মুনাফিক বলে চিহ্নিত করা যেতো আর না বলা যেতো
গোনাহগার মুমিন। এ দুটি জিনিসের কোনটিরই
আলামত তখনো তাদের মধ্যে পুরোপিরি ফুটে উঠেনি। তাই আল্লাহ তাদের ব্যাপারটি মুলতবী রাখেন। মুলতবী রাখার অর্থ এই নয় যে, আসলে
আল্লাহর কাছেও তাদের ব্যাপারটি সন্দেহপূর্ণ ছিল। রবং এর অর্থ এই যে,
কোন
ব্যক্তি বা দলের ব্যাপারে মুসলমানদের নিজেদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারনে অতিমাত্রায়
তাড়াহুড়া করা চাই না।
যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন ধরনের আলামতের মাধ্যমে তার অবস্থান সুষ্পষ্ট হয়ে যায়, যা
অদৃশ্য জ্ঞান দিয়ে নয় বরং যুক্তি ও অনুভুতি দিয়ে পরখ করা যেতে পারে, ততক্ষণ
অপেক্ষা করা উচিত।
﴿وَالَّذِينَ
اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا
لِّمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِن قَبْلُ ۚ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا
إِلَّا الْحُسْنَىٰ ۖ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ﴾
১০৭। আরো কিছু
লোক আছে, যারা একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে (সত্যের দাওয়াতকে)
ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে, (আল্লাহর বন্দেগী করার
পরিবর্তে) কুফরী কারার জন্য মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং (এ
বাহ্যিক ইবাদতগাহকে) এমন এক ব্যক্তির জন্য গোপন ঘাটি বানাবার উদ্দেশ্যে যে
ইতিপূর্বে আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তারা
অবশ্যি কসম খেয়ে বলবে, ভালো ছাড়া আর কোন ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। কিন্তু
আল্লাহ সাক্ষী, তারা একেবারেই মিথ্যেবাদী।
﴿لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا
ۚ لَّمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَىٰ مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ
فِيهِ ۚ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُوا ۚ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ﴾
১০৮। তুমি
কখনো সেই ঘরে দাঁড়াবে না। যে মসজিদে প্রথম দিন থেকে
তাকওয়ার ভিত্তেতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল সেই মসজিদটি দাঁড়ানোরই (ইবাদতের জন্য)
তোমার পক্ষে অধিকতর সমীচীন। সেখানে এমন লোক আছে যারা
পাক-পবিত্র থাকা পছন্দ করে এবং আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালবাসেন।১০২
১০২. নবী সা. মদীনায় আগমনের আগে খাযরাজ গোত্রে আবু আমের নামে
এক ব্যক্তি ছিল। জাহেলী যুগে সে খৃষ্টান
রাহেবের (সাধু) মর্যাদা লাভ করেছিল। তাকে আহলে কিতাবদের আলেমদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তি গণ্য করা হতো।অন্যদিকে সাধুগিরির কারণে পণ্ডতি সুলভ মর্যাদার
পাশাপাশি তার দরবেশীর প্রভাবও মদীনা ও আশেপাশের এলাকার অশিক্ষিত আরব সমাজে প্রতিষ্ঠিত
হয়ে গিয়েছিল। নবী সা. যখন মদীনায় পৌছলেন
তখন সেখানে বিরাজ করছিল আবু আমেরের ধর্মীয় ও আধ্যত্মিক কতৃত্বের রমরমা অবস্থা। কিন্তু এ জ্ঞান,বিদ্যাবত্তা ও দরবেশী তার মধ্যে
সত্যানুসন্ধিৎসা ও সত্যকে চেনার মতো ক্ষমতা সৃষ্টি করার পরিবর্তে উল্টো তার জন্য
একটি বিরাট অন্তরাল সৃষ্টি করলো। আর এ অন্তরাল সৃষ্টির ফলে রসূলের আগমণের পর সে নিজে ঈমানের
নিয়ামত থেকে শুধু বঞ্চিতই রইল না। বরং রসূলকে নিজের ধর্মীয় পৌরহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বি এবং নিজের দরবেশী ও সাধু
বৃত্তিক কর্মকাণ্ডের শত্রু মনে করে তার ও তার সমুদয় কার্যক্রমের বিরোধিতায নেমে
পড়লো। প্রথম দুবছর তার আশা ছিল
কুরাইশী কাফেরদের শক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হবে। কিন্তু বদরের যুদ্ধে কুরাইশরা চরমভাবে পরাজিত
হলো। এ অবস্থায় সে আর নীরব থাকতে
পারলো না। সেই বছরই সে মদীনা থেকে বের
হয়ে পড়লো। সে কুরাইশ ও অন্যান্য
গোত্রের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করলো। যেসব কুচক্রীর চক্রান্ত ও যোগসাজশে ওহোদ যুদ্ধ বাধে, তাদের
মধ্যে এ আবু আমেরও অন্যমত। বলা হয়ে থাকে, ওহোদের যুদ্ধের ময়দানে সে অনেকগুলো গর্ত
খুঁড়েছিল। এরই একটির মধ্যে পড়ে গিয়ে
নবী সা. আহত হয়েছিলেন।
তারপর আহযাব যুদ্ধের সময় চারদিকে থেকে যে সেনাবাহী মদীনার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল
তাকে আক্রমণে উস্কে দেয়ার ব্যাপারেও তার অগ্রনী ভুমিকা ছিল। এরপর হুনাইন যুদ্ধ পর্যন্ত আরব মুশরিকও মুসলমানদের মধ্যে
যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সবগুলোতেই এ ঈসায়ী দরবেশ ইসলামের বিরুদ্ধে মুশরিক শক্তির
সক্রিয় সহয়ক ছিল। শেষ পর্যন্ত আরবের কোন
শক্তি ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে পারবে বলে তার আর আশা রইল না। কাজেই সে আরব দেশ ত্যাগ করে রোমে চলে যায় এবং
আরব থেকে যে "বিপদ" মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে সে কাইসাকে (সীজার)
অবহিত করে। এ সময়ই মদীনায় খবর পৌছে যে, কাইসার
আরব আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এরই প্রতিবিধান করার জন্য নবী সা. কে তাবুক
অভিযান করতে হয়।
ঈসায়ী রাহেব আবু আমেরের এ ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় তার সাথে শরীক ছিল মদীনার
মুনাফিক গোষ্ঠির একটি দল। আবু আমেরকে তার ধর্মীয় প্রভাব ব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে রোমের কাইসার ও
উত্তরাঞ্চলের খৃষ্টান আরব রাজ্যগুলোর সামরিক সাহায্য লাভ করতেও এ মুনাঠিকরা তাকে
পরামর্শ দেয় ও মদদ যোগায়। যখন সে রুমের পথে রওয়ানা হচ্ছিল তখন তার ও এ মুনাফিকদের মধ্যে একটি চুক্তি
সম্পাদিত হলো। এ চুক্তি অনুযায়ী স্থির
হলো, যে মদীনায় তারা নিজেদের একটি পৃথক মসজিদ তৈরী করে নেবে। এভাবে সাধারণ মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়ে
মুনাফিক মুসলমানদের এমন একটি স্বতন্ত্র জোট গড়ে উঠবে যা ধর্মীয় আলখেল্লায় আবৃত
থাকবে। তার প্রতি সহজে কোন প্রকার
সন্দেহ করা যাবে না।
সেখানে শুধু যে, মুনাফিকরাই সংঘটিত হবে এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা
নির্ধারনের জন্য পরামর্শ করবে তা নয়।বরং আবু আমেরের কাছ থেকে যেসব এজেন্ট খবর ও নির্দেশ নিয়ে আসবে তারাও সন্দেহের
উর্ধে থেকে নিরীহ ফকীর ও মুসাফিরের বেশে এ মসজিদে অবস্থান করতে থাকবে। এ ন্যাক্করজনক ষড়যন্ত্রটির ভিত্তিতেই এ মসজিদ
নির্মিত হয়েছিল এবং এরি কথা এ আয়াতে বলা হয়েছে।
মদীনায় এ সময় দুটি মসজিদ ছিল। একটি মসজিদে কুবা।
এটি ছিল নগর উপকণ্ঠে।
অন্যটি ছিল মসজিদে নববী।
শহরের অভ্যন্তরে ছিল এর অবস্থান। এ দুটি মসজিদ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় একটি মসজিদ নির্মাণ করার কোন
প্রয়োজনই ছিল না। আর এটা কোন যুক্তিহীন
ধর্মীয় আবেগের যুগ ছিল না যে, প্রয়োজন থাকুক ব না থাকুক
মসজিদ নামে নিছক একটি ইমারত তৈরী করে দিলেই তখন নেকীর কাজ বলে মনে করা হবে।বরং একটি নতুন মসজিদ তৈরী করার অর্থই ছিল
মুসলমানদের জামায়াতের মধ্যে অনর্থক বিভেদ সৃষ্টি করা। একটি সত্যনিষ্ঠা ইসলামী ব্যবস্থা কোনক্রমেই এটা বরদাশত
করতে পারে না। তাই তারা নিজেদের পৃথক
মসজিত তৈরী কারার আগে তার প্রয়োজনের বৈধতা,
প্রমাণ
করতে বাধ্য ছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা নবী সা.
এর সামনে এ নতুন নির্মাণ কাজের প্রয়োজন পেশ করে। এ প্রসঙ্গে তারা বলে,
বৃষ্টি
বাদলের জন্য এবং শীতের রাতে সাধারণ লোকদের বিশেষ করে উল্লেখিত দুটি মসজিদ থেকে
দুরে অবস্থানকারী বৃদ্ধ, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের প্রতিদিন পাঁচবার
মসজিদে হাজিরা দেয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই আমরা শুধুমাত্র নামাযীদের সুবিধার্থে এ নতুন মসজিদটি
নির্মাণ করতে চাই।
মুখেএ পবিত্র ও কল্যাণমূসক বাসনার কথা উচ্চারণ করে যখন এ "দ্বিরার", (ক্ষতিকর)
মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হলো তখন এ দুর্বৃত্তরা নবী সা. এর দরবারে হাযির হলো
এবং সেখানে একবার নামায পরিয়ে মসজিদটির উদ্বোধন করার জন্য তার কাছে আবেদন জানালো। কিন্তু আমি এখন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত
আছি এবং শীঘ্রই আমাকে একটি বড় অভিযানে বের হতে হবে, সেখান
থেকে ফিরে এসে দেখা যাবে, একথা বলে তিনি তাদের আবেদন এড়িয়ে গেলেন। এরপর তিনি তাবুক রওয়ানা হয়ে গেলেন এবং তার
রওয়ানা হওয়ার পর এ মুনাফিকরা এ মসজিদে নিজেদের জোট গড়ে তূলতে এবং ষড়যন্ত্র পাকাতে
লাগলো।
এমন কি তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল,
ওদিকে
রোমানদের হাতে মুসলমানদের মুলোৎপাটনের সাথে সাথেই এদিকে এরা আবদুল্লাহ ইবনে
উবাইয়ের মাথায় রাজ মূকূট পরিয়ে দেবে। কিন্তু তবুকের যা ঘটলো তাতে তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়লো। ফেরার পথে নবী সা. যখন মদীনার নিকটবর্তী
"যী আওয়ান" নামক স্থানে পৌছলেন তখন এ আয়াত নাযিল হলো। তিনি তখনই কয়েকজন লোককে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদেরকে দায়িত্ব দিলেন,তার মদীনায় পৌছার আগেই যেন তারা
দ্বিরার মসজিদটি ভেংগে ধুলিস্মাত করে দেয়।
﴿أَفَمَنْ
أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَىٰ تَقْوَىٰ مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ أَم مَّنْ أَسَّسَ
بُنْيَانَهُ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ ۗ وَاللَّهُ
لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
১০৯। তাহলে
তুমি কি মনে করো, যে ব্যক্তি আল্লাহ ভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপর নিজের
ইমারতের ভীত্তি স্থাপন করলো সে ভাল, না যে ব্যক্তি তার ইমারতের ভিত উঠালো
একটি পতাকার স্থিতিহীন ফাঁপা প্রাণ্তের ওপর১০৩ এবং তা
তাকে নিয়ে সোজা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়লো? এ ধরনের জালেমদের কে আল্লাহ
কখনো সোজা পথ দেখান না।১০৪
১০৩. এখানে কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে,جرف (জুরুফ)। আরবী ভাষায় সাগর বা নদীর এমন কিনারাকে জুরুফ বলা হয়
স্রোতের টানে যার তলা থেকে মাটি সরে গেছে এবং ওপরের অংশ কোন বুনিয়াদ ও নির্ভর
ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে। যারা আল্লাহকে ভয় না করা
এবং তার সন্তুষ্টির পরোয়া না করার ওপর নিজেদের কার্যক্রমের ভিত গড়ে তোলে, তাদের
জীবন গঠনকে এখানে এমন একটি ইমারতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যা এমনি ধরনের একটি অন্তসরাশূন্য অস্থিতিশীল সাগর কিনারে
নির্মাণ করা হয়েছে। এটি একটি নজীরবিহীন উপমা। এর চাইতে সুন্দরভাবে এ অবস্থার আর কোন চিত্র,
আকা
সম্ভব নয়। এর সমগ্র অন্তর্নিহিত
তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে বুঝে নিতে হবে যে,
দুনিয়ার
জীবনের যে উপরিভাগের ওপর মুমিন, মুনাফিক কাফের, সৎকর্মশীল, দূষ্কৃতকারী
তথা সমস্ত মানুষ কাজ করে, তা মাটির উপরিভাগের স্তরের মতো যার ওপর
দুনিয়ার সমস্ত ইমারত নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এ স্তরের মধ্যে কোন স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা নেই। বরং এর নীচে নিরেট জমি বিদ্যমান থাকার ওপরই এর
স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। যে
স্তরের নীচের মাটির কোন জিনিসের যেমন নদীর পানির তোড়ে ভেসে গেছে তার ওপর যদি
কোন মানুষ (যে মাটির প্রকৃত অবস্থা জানে না) বাহ্যিক অবস্থায় প্রতারিত হয়ে নিজের
গৃহ নির্মাণ করে তাহলে তা তার গৃহসহ ধ্বসে পড়বে এবং সে কেবল নিজেই ধ্বংস হবে না। বরং এ অস্থিতিশীল ভিতের ওপর নির্ভর করে নিজের
জীবনের যা কিছু পূঁজিপাট্রা সে সংশ্লিষ্ট গৃহের মধ্যে জমা করেছিল সবই এ সাথে ধ্বংস
হয়ে যাবে। দুনিয়ার জীবনের এ বাহ্যিক
স্তরটরও এ উপমাটির সাথে হুবহু মিল রয়েছে। এ স্তরটির ওপরই আমরা সবাই আমাদের জীবনের যাবতীয়
কার্যক্রমের ইমারত নির্মাণ করি। অথচ এর নিজের কোন স্থিতি ও স্থায়িত্ব নেই। বরং আল্লাহর ভয় তার সামনে জবাবদিহির অনুভুতি এবং তার ইচ্ছা
ও মর্জি মতো চলার শক্ত ও নিরেট পাথর খণ্ড তার নীচে বসানো থাকে,
এরি
ওপর তার মজবুতী ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। যে অজ্ঞ ও অপরিণামদর্শী মানুষ নিছক দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক
দিকের ওপর ভরসা করে আল্লাহর ভয়ে ভীত না হয়ে এবং তার সন্তোষ লাভের পরোয়া না করে
দুনিয়ায় কাজ করে যায় সে আসলে নিজের জীবন গঠনের বুনিয়াদ নীচে থেকেই অন্তসার শুণ্য
করে দেয়। তার শেষ পরিণতি এ ছাড়া আর
কিছুই নয়, যে ভিত্তিহীন যে উপরি স্তরের ওপর সে তার সারা
জীবনের সঞ্চয় জমা করেছে।
একদিকে অকস্মাৎ তা ধ্বসে পড়বে এবং তাকে তার জীবনের সমস্ত সম্পদসহ ধ্বংস ও বরবাদ
করে দেবে।
১০৪. সোজা পথ অর্থাৎ যে পথে মানুষ সফলকাম হয় এবং যে পথে অগ্রসর
হয়ে সে যথার্থ সাফল্যের মনযিলে পৌছে যায়।
﴿لَا يَزَالُ
بُنْيَانُهُمُ الَّذِي بَنَوْا رِيبَةً فِي قُلُوبِهِمْ إِلَّا أَن تَقَطَّعَ قُلُوبُهُمْ
ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
১১০। তারা এই
যে ইমারত নির্মাণ করেছে এটা সবসময় তাদের মনে সন্দেহের কারণ হয়ে থাকবে (যার বের হয়ে
যাওয়ার আর কোন উপায়ই এখন নেই) যে পর্যন্ত না তাদের অন্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।১০৫ আল্লাহ
অত্যন্ত সচেতন,জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।
১০৫. অর্থাৎ তারা মুনাফিক সূলভ ধোঁকা ও প্রতারণার বিরাট অপরাধ
করে নিজেদের অন্তরকে চিরকালের জন্য ইমানী যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করেছে। বেঈমানী ও নাফরমানীর রোগ তাদের অন্তরের
অন্তস্থলে অনুপ্রবেশ করেছে। যতদিন তাদের এ অন্তর থাকবে ততদিন এ রোগ ও সেখানে অবস্থান করবে। আল্লাহর হুকুম অমান্য করার জন্য যে ব্যক্তি
প্রকাশ্যে মন্দির নির্মাণ করে অথবা তার দীনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যরিকড ও
ঘাটি তৈরী করে তার হেদায়াত ও কোন না কোন সময় সম্ভব। কারণ তার মধ্যে ষ্পষ্টবাদিতা, আন্তরিকতা
ও নৈতিক সাহসের সুক্ষতার উপাদন মৌলীকভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। আর এ উপাদান সত্য ও ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার জন্য ঠিক
তেমনিভাবে কাজে লেগে যেমন মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার জন্য কাজে লাগে।কিন্তু যে কাপুরুষ, মিথ্যুক
ও প্রতারক আল্লাহর নাফরমাণী ও হুকুম অমান্য করার জন্য মসজিদে নির্মাণ করে এবং
আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আল্লাহর পরস্তির প্রতারণামূলক পোশাক
পরিধান করে, মুনাফিকীর ঘুণে তার চরিত্র কুরে কুরে খেয়ে
ফেলেছে। আন্তরিকতার সাথে ঈমানের
বোঝা বহন করার ক্ষমতা সে কোথা থেকে পাবে?
﴿إِنَّ
اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ
الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ وَعْدًا
عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ ۚ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ
مِنَ اللَّهِ ۚ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ
هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾
১১১। প্রকৃত
ব্যাপার এই যে, আল্লাহ
মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।১০৬ তারা
আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের
প্রতি তাওরাত,ইনজীল ও কুরআনে(জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর
জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ।১০৭ আর আল্লাহর
চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে
কেনা-বেচা করছো সে জন্য আনন্দ করো। এটিই
সবচেয়ে বড় সাফল্য।
১০৬. আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ঈমানের যে ব্যাপারটা স্থিরকৃত হয়
তাকে কেনাবেচা বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে,
ঈমান
শুধুমাত্র একটা অতি প্রাকৃতিক আকীদা-বিশ্বাস নয়। বরং এটা একটি চুক্তি। এ চুক্তির প্রেক্ষিতে বান্দা তার নিজের প্রাণ ও নিজের
ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেয়। আর এর বিনিময়ে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ওয়াদা কবুল করে নেয় যে, মরার
পর পরবর্তী জীবনে তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু অনুধাবন করার
জন্য সর্বপ্রথম কেনা-বেচার তাৎপর্য ও স্বরূপ কি তা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।
নিরেট সত্যের আলোকে বিচার করলে বলা যায় মানুষের ধন-প্রাণের মালিক হচ্ছেন
আল্লাহ। কারণ তিনিই তার কাছে যা
কিছু আছে সব জিনিসের স্রষ্টা। সে যা কিছু ভোগ ও ব্যবহার করেছে তাও তিনিই তাকে দিয়েছেন। কাজেই এদিক দিয়ে তো কেনাবেচার কোন প্রশ্নেই
ওঠে না। মানুষের এমন কিছু নেই, যা
সে বিক্রি করবে। আবার কোন জিনিস আল্লাহর
মালিকানার বাইরেও নেই, যা তিনি কিনবেন।কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন একটি জিনিস আছে,যা আল্লাহ পুরোপুরি মানুষের
হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে তার ইখতিয়ার অর্থাৎ নিজের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও স্বাধীন
ইচ্ছাশক্তি (Free will and freedom of
choice)। এ ইখতিয়ারের কারণে অবশ্যি
প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মানুষ এ মর্মে স্বাধীনতা লাভ করে যে, সে
চাইলে প্রকৃত সত্যকে মেনে নিতে পারে এবং চাইলে তা অস্বীকার করতে পারে। অন্য কথায় এ ইখতিয়ারের মানে এ নয় যে মানুষ
প্রকৃত পক্ষে তার নিজের প্রাণের নিজের বুদ্ধিবৃত্তি ও শারীরিক শক্তির এবং দুনিয়ায়
সে যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেছে,
তার
মালিক হয়ে গেছে। এ সংগে এ জিনিসগুলো সে
যেভাবে চাইবে সেভাবে ব্যবহার করার অধিকার লাভ করেছে, একথাও
ঠিক নয়। বরং এর অর্থ কেবল এতটুকুই
যে, তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে,
আল্লাহর
পক্ষে থেকে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি ছাড়াই সে নিজেরই নিজের সত্তার ও নিজের
প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর আল্লাহর মালিকানা ইচ্ছা করলে স্বীকার করতে পারে আবার ইচ্ছা
করলে নিজেই নিজের মালিক হয়ে যেতে পারে এবং নিজেই একথা মনে করতে পারে যে, সে
আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে নিজের ইখতিয়ার তথা স্বাধীন কর্মক্ষমতার সীমানার মধ্যে
নিজের ইচ্ছামত কাজ করার অধিকার রাখে। এখানেই কেনা-বেচার প্রশ্নটা দেখা দেয়। আসলে এ কেনা-বেচা এ অর্থে নয় যে, মানুষের
একটি জিনিস আল্লাহ কিনতে চান, বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে,
যে
জিনিসটি আল্লাহর মালিকানাধীন যাকে তিনি আমানত হিসেবে মানুষের হাতে সোপর্দ করেছেন
এবং যে ব্যাপারে বিশ্বস্ত থাকার বা অবিশ্বস্ত হবার স্বাধীনতা তিনি মানুষেকে দিয়ে
রেখেছেন সে ব্যাপারে তিনি মানুষের দাবী করেন,
আমার
জিনিসকে তুমি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে (বাধ্য হয়ে নাও)। এ সংগে খেয়ানত করার যে স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছি তা তুমি
নিজেই প্রত্যাহার করো।
এভাবে যদি তুমি দুনিয়ার বর্তমান অস্থায়ী জীবনে নিজের
স্বাধীনতাকে (যা তোমার অর্জিত নয় বরং আমার দেয়া) আমার হাতে বিক্রি করে দাও তাহলে
আমি পরবর্তী চিরন্তন জীবনে এর মূল্য জান্নাতের আকারে তোমাকে দান করবো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কেনা-বেচার এ চুক্তি
সম্পাদন করে সে মুমিন।
ঈমান আসলে এ কেনা-বেচার আর এক নাম। আর যে ব্যক্তি এটা অস্বীকার করবে অথবা অঙ্গীকার করার পরও এমন আচরণ করবে যা
কেবলমাত্র কেনা-বেচা না করার অবস্থায় করা যেতে পারে সে কাফের। আসলে এ কেনা-বেচাকে পাস কাটিয়ে চলার পরিভাষিক নাম কুফরী।কেনা-বেচার এ তাৎপর্য ও স্বরূপটি অনুধাবন করার
পর এবার তার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা যাকঃ
একঃ এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মানুষকে দুটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাকে
স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবার পর সে মালিকাকে মালিক মনে করার এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও
বিদ্রোহের পর্যায়ের নেমে না আসার মতো সৎ আচরণ করে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে,
নিজের
প্রভু ও মালিক আল্লাহর কাছ থেকে আজ নগদ যে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, না
বরং মরার পর পরকালীন জীবনে যে মূল্য আদায় করার ওয়াদা তার পক্ষ থেকে করা হয়েছে তার
বিনিময়ে নিজের আজকের স্বাধীনতা ও তার যাবতীয় স্বাদ বিক্রি করতে স্বেচ্ছায় ও
সাগ্রহে রাজী হয়ে যাবার মত আস্থা তার প্রতি আছে কিনা।
দুইঃ যে ফিকাহর আইনের ভিত্তিতে দুনিয়ার ইসলামী সমাজ গঠিত হয় তার দৃষ্টিতে ঈমান
শুধুমাত্র কতিপয় বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। এ স্বীকৃতির পর নিজের স্বীকৃতি ও অংগীকারের ক্ষেত্রে
মিথ্যুক হবার সুষ্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত শরীয়াতের কোন বিচারক কাউকে অমুমিন
বা ইসলামী মিল্লাত বহির্ভুত ঘোষণা করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য ঈমানের তাৎপর্য় ও স্বরূপ
হচ্ছে, বান্দা তার চিন্তা ও কর্ম উভয়ের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ক্ষমতা
আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দিবে এবং নিজের মালিকানার দাবী পুরোপুরি তার সপক্ষে
প্রত্যাহার করবে। কাজেই যদি কোন ব্যক্তি
ইসলামের কালেমার স্বীকৃতি দেয় এবং নামায-রোযা ইত্যাদির বিধানও মেনে চলে, কিন্তু
নিজেকে নিজের দেহ ও প্রাণের নিজের মন,
মস্তিস্ক
ও শারীরিক শক্তির নিজের ধন-সম্পদ,উপায়, উপকরণ ইত্যাদির এবং নিজের
অধিকার ও নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত জিনিসের মালিক মনে করে এবং সেগুলোকে নিজের ইচ্ছামত
ব্যবহার করার স্বাধীনতা নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখে, তাহলে
হয়তো দুনিয়ায় তাকে মুমিন মনে করা হবে কিন্তু আল্লাহর কাছে সে অবশ্যী অমুমিন
হিসেবে গণ্য হবে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে
কেনা-বেচার ব্যাপারে ইমানের আসল তাৎপর্য ও স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সে আল্লাহর সাথে আদতে কোন কেনা-বেচার
কাজই করেননি। যেখানে আল্লাহ চান সেখানে
ধন প্রাণ নিয়োগ না করা এবং যেখানে তিনি চান না সেখানে ধন প্রাণ নিয়োগ ও ব্যবহার
করা-এ দুটি কার্যধারাই চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেয় যে, ইমানের
দাবীদার ব্যক্তি তার ধন প্রাণ আল্লাহর হাতে বিক্রি করেইনি অথবা বিক্রির চুক্তি
করার পরও সে বিক্রি করা জিনিসকে যথারীতি নিজের মনে করেছে।
তিনঃ ঈমানের এ তাৎপর্য ও স্বরূপ ইসলামী জীবনাচরণকে কাফেরী জীবনাচরণ থেকে শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে মুসলিম ব্যক্তি সঠিক অর্থে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে সে
জীবনের সকল বিভাগে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে কাজ করে। তার আচরণে কোথাও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভংগীর
প্রকাশ ঘটতে পারে না।
তবে কোন সময় সাময়িকভাবে সে গাফলতির শিকার হতে পারে এবং আল্লাহর সাথে নিজের কেনা-বেচার
চুক্তির কথা ভূলে গিয়ে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা অবলম্বন করাও তার পক্ষে
সম্ভব। এটা অবশ্যি ভিন্ন ব্যাপার। অনুরূপভাবে ঈমানদারদের সমন্বায়ে গঠিত কোন দল
বা সমাজ সমষ্টিগতভাবেও আল্লাহর ইচ্ছা ও তার শরয়ী আইনের বিধিনিষেধমুক্ত হয়ে কোন
নীতি পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় নীতি, তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক
পদ্ধতিএবং কোন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক আচরণ অবলম্বন করতে পারে
না। কোন সাময়িক গাফলতির কারণে
যদি সেটা অবলম্বন করেও থাকে তাহলে যখনই সে এ ব্যাপারে জানতে পারবে তখনই স্বাধীন ও
স্বৈরাচারী আচরণ ত্যাগ করে পুনরায় বন্দেগীর আচরণ করতে থাকবে। আল্লাহর আনুগত্য মুক্ত হয়ে কাজ করা এবং নিজের ও নিজের সাথে
সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নিজে নিজেই কি করবো না করবো, সিদ্ধান্ত
নেয়া অবশ্যি একটি কুফরী জীবনাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের জীবন যাপন পদ্ধতি এ রকম তারা মুসলমান নামে আখ্যায়িত
হোক বা অমুসলিম নামে তাতে কিছু যায় আসে না।
চারঃ এ কেনা-বেচার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর যে ইচ্ছার আনুগত্য মানুষের জণ্য
অপরিহার্য হয় তা মানুষের নিজের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত নয় বরং আল্লাহ নিজে যেমন
ব্যক্ত করেন তেমন। নিজে নিজেই কোন জিনিসকে
আল্লাহর ইচ্ছা বলে ধরে নেয়া এবং তার আনুগত্য করতে থাকা মূলত আল্লাহর ইচ্ছা নয় বরং
নিজেরই ইচ্ছার আনুগত্য করার শামিল। এটি এ কেনাবেচার চুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধী। যে ব্যক্তি ও দল আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর হেদায়াত থেকে নিজের
সমগ্র জীবনের কর্মসুচী গ্রহণ করেছে একমাত্র তাকেই আল্লাহর সাথে কৃত নিজের
কেনা-বেচার চুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হবে।
এ হচ্ছে এ কেনা-বেচার অন্তনিহিত বিষয়। এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর এ কেনা-বেচার ক্ষেত্রে বর্তমান
পার্থিব জীবনের অবসানের পর মূল্য (অর্থাৎ জান্নাত।) দেবার কথা বলা হয়েছে কেন তাও আপনা আপনিই বুঝে আসে। বিক্রেতা নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে
বিক্রি করে দেবে কেবলমাত্র এ অংগীকারের বিনিময়েই যে জান্নাত পাওয়া যাবে তা নয়। বরং বিক্রেতা নিজের পার্থিব জীবনে এ বিক্রি
করা জিনিসের ওপর নিজের স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রত্যাহার করবে এবং
আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের রক্ষক হয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করবে। এরূপ বাস্তব ও সক্রিয় তৎপরতার বিনিময়েই
জান্নাত প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারে। সুতরাং বিক্রেতার পার্থিব জীবনকাল ও শেষ হবার পর যখন প্রমাণিত হবে যে, কেনা-বেচার
চুক্তি করার পর সে নিজের পার্থিব জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তির শর্তসমূহ
পুরোপুরি মেনে চলেছে একমাত্র তখনই এ বিক্রি সম্পূর্ণ হবে। এর আগে পর্যন্ত ইনসাফের দৃষ্টিতে সে মূল্য পাওয়ার অধিকারী
হতে পারে না।
এ বিষয়গুলো পরিষ্কার ভাবে বুঝে নেবার সাথে সাথে এ বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কোন
প্রেক্ষাপটে এ বিষয়বস্তুটির অবতারণা হয়েছে তাও জেনে নেয়া উচিত। ওপর থেকে যে ধারাবাহিক ভাষণ চলে আসছিল তাতে
এমন সব লোকের কথা ছিল যারা ঈমান আনার অংগীকার করেছিল ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার কঠিন
সময় সমুপস্থিত হলে তাদের অনেকে গাফলতির কারণে,
অনেকে
আন্তরিকতার অভাবে এবং অনেকে চূড়ান্ত মুনাফিকীর পথ অবলম্বন করার ফলে আল্লাহর ও তার
দীনের জন্য নিজের সময় ধন সম্পদ স্বার্থ ও প্রাণ দিতে ইতস্তত করেছিল। কাজেই এ বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেনীর আচরণের
সমালোচনা করার পর এখন তাদেরকে পরিষ্কার বলে দেয়া হচ্ছে, তোমরা
যে ঈমান গ্রহণ করার অংগীকার করেছো তা নিছক আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব মেনে নেবার
নাম নয়। বরং একমাত্র আল্লাহই যে
তোমাদের জান ও তোমাদের ধন-সম্পদের মালিক ও অকাট্য ও নিগূঢ় তত্ত্ব মেনে নেয়া ও এর
স্বীকৃতি দেয়ার নামই ঈমান। কাজেই এ অংগীকার করার পর যদি তোমরা এ প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হুকুমে
কুরবানী করতে ইতস্তত করো এবং অন্যদিকে নিজের দৈহিক ও আত্মিক শক্তিসমূহ এবং নিজের
উপায়-উপকরণ সমূহ আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকো তাহলে এ থেকে একথাই
প্রমাণিত হবে যে, তোমাদের অংগীকার মিথ্যা। সাচ্চা ঈমানদার একামাত্র তারাই যারা যথার্থই নিজেদের
জান-মাল আল্লাহর হাতে বিকিয়ে দিয়েছে এবং তাকেই এ সবের মালিক মনে করেছে। তিনি এগুলো যেখানে ব্যয় করার নির্দেশ দেন
সেখানে নির্দ্বিধায় এগুলো ব্যয় করে এবং যেখানে তিনি নিষেধ করেন সেখানে দেহ ও
আত্মার সামান্যতম শক্তিও এবং আর্থিক উপকরণের নগন্যতম অংশও ব্যয় করতে রাজী হয় না।
১০৭. এ ব্যাপারে অনেকগুলো আপত্তি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে যে ওয়াদার কথা বলা হয়েছে তা তাওরাত ও
ইনজীলে নেই। কিন্তু ইনজীলের ব্যাপারে এ
ধরনের কথা বলার কোন ভিত্তি নেই। বর্তমানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে ইনজীলসমূহ পাওয়া যায় সেগুলোর হযরত ঈসা আ.
এর এমন অনেকগুলো উক্তি পাওয়া যায় যেগুলো এ আয়াতের সমর্থক। যেমনঃ
ধন্য যাহারা ধার্মিকতার জন্য তাড়িত হইয়াছে,
কারণ
স্বার্গরাজ্য তাহাদেরই।
(মথি ৫:১০)
যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করে, সে তাহা হারাইবে, এবং
যে কেহ আমার নিমিত্ত আপন প্রাণ হারায়,সে তাহা রক্ষা করিবে। (মথি ১০:৩৯)
আর যে কোন ব্যক্তি আমার নামের জন্য বাটী কি ভ্রাতা, কি
ভাগীনি কি পিতা ও মাতা, কি
সন্তান,কি ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়াছে,
সে
তাহার শতগুণ পাইবে এবং অনন্ত জীবনের অধিকারী হইবে। (মথি ১৯:২৯)
তবে তাওরাত বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যায় তাতে অবশ্যি এ বিষয়বস্তুটি পাওয়া
যায় না। শুধু এটি কেন, সেখানে
তো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, শেষ বিচারের দিন ও পরকালীন পুরস্কার ও শাস্তির
ধারণাই অনুপস্থিত। অথচ এ আকীদা সবসময় আল্লাহর
সত্য দীনের অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসেবেই বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বর্তমান তাওরাতে এ বিষয়টির অস্তিত্ব না থাকার ফলে এ
সিদ্ধান্ত গ্রহন করাও ঠিক নয় যে, যথার্থই তাওরাতের এ অস্তিত্ব
ছিল না।আসলে ইহুদীরা তাদের অবনতির
যুগে এতই বস্তুবাদী ও দুনিয়াবী সমৃদ্ধির মোহে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের
কাছে নিয়ামত ও পুরস্কার এ দুনিয়ায় লাভ করা ছাড়া তার আর কোন অর্থই ছিলো না। এ কারণে আল্লাহর কিতাবে বন্দেগী ও আনুগত্যের
বিনিময়ে তাদেরকে যেসব পুরস্কার দেবার ওয়াদা করা হয়েছিল সে সবকে তারা দুনিয়ার এ
মাটিতেই নামিয়ে এনেছিল এবং জান্নাতের প্রতিটি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্টকে তারা তাদের
আকাংখিত ফিলিস্তিনের ওপর প্রয়োগ করেছিল। তাওরাতের বিভিন্ন স্থানে আমরা এ ধরনের বিষয়বস্তু দেখতে পাই। যেমনঃ
হে ইস্রায়েল শুন, আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভূ একই সদাপ্রভু, তুমি
তোমার সমস্ত হৃদয়, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া
আপন ঈশ্বর সদাপ্রভূকে প্রেম করিবে। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬: ৪,৫)
আরো দেখিঃ
তিনি কি তোমার পিতা নহেন, যিনি তোমাকে লাভ করিলেন। তিনিই তোমার নির্মাতা ও স্থিতিকর্তা। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৬)
কিন্তু আল্লাহর সাথে এ সম্পর্কের যে পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তোমরা
এমন একটি দেশের মালিক হয়ে যাবে যেখানে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হচ্ছে অর্থাৎ
ফিলিস্তিন। এর আসল কারণ হচ্ছে, তাওরাত
বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে তা প্রথমত সম্পূর্ণ নয়, তাছাড়া
নির্ভেজাল আল্লাহর বাণী সম্বলিত ও নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহর বানীর সাথে অনেক ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য ও সংযোজিত করে
দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ইহুদীদের জাতীয়
ঐতিহ্য, বংশপ্রীতি, কুসংষ্কার আশা-আকাংখা ভূল ধারণাও ফিকাহভিত্তিক
ইজতিহাদের একটি বিরাট অংশ একই ভাষণ ও বানী পরষ্পরার মধ্যে এমন ভাবে মিশ্রিত হয়ে
গেছে যে, অধিকাংশ স্থানে আল্লাহর আসল কালামকে তার মধ্যে
থেকে পৃথক করে বের করে নিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। (এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন সূরা আলে ইমরানের ২ টীকা।)
﴿التَّائِبُونَ
الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ
بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ ۗ
وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ﴾
১১২। আল্লাহর
দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী১০৮ তার ইবাদতকারী, তার প্রশংসা বানী উচ্চারণকারী, তার জন্য যমীনে বিচরণকারী১০৯ তার সামনে
রুকূ ও সিজদাকারী, সৎকাজের
আদেশকারী, অসৎকাজ থেকে বিরতকারী, এবং আল্লাহর সীমারেখা
সংরক্ষণকারী১১০ (সেই সব মুমিন হয়ে থাকে যারা আল্লাহর সাথে
কেনাবেচার সওদা করে) আর হে নবী! এ মুমিনদেরকে সুখবর দাও!
১০৮. মূল আয়াতে
التَّائِبُونَ (আত্ তা-য়েবুন) শব্দ ব্যবহার
করা হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ করলে
দাঁড়ায় তাওবাকারী। কিন্তু যে বর্ণনা রীতিতে ও
শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাওবা
করা ঈমানদারদের স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অন্তরভুক্ত। তাই এর সঠিক অর্থ হচ্ছে তারা কেবলমাত্র একবার তাওবা করে না
বরং সবসময় তাওবা করতে থাকে। আর তাওবার আসল অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা। কাজেই এ শব্দটির মূল প্রাণ সত্তা প্রকাশ কারার জন্য আমি এর
ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ এভাবে করেছি তারা আল্লাহর দিকে বারবার ফিরে আসে। মুমিন যদিও তার পূর্ণ চেতনা ও সংকল্প সহকারে
আল্লাহ সাথে নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ কেনা-বেচার কারবার করে কিন্তু যেহেতু বাইরের
অবস্থার প্রেক্ষিতে এটাই অনুভূত হয় যে,
প্রাণ
তার নিজের এবং ধন ও তার নিজের আর তাছাড়া এ প্রাণ ও ধনের আসল মালিক মহান আল্লাহ। কোন অনুভূত সত্তা নন বরং একটি যুক্তিগ্রাহ্য
সত্তা। তাই মুমিনের জীবনের বারবার
এমন সময় আসতে থাকে যখন সে সাময়িকভাবে আল্লাহর সাথে করা তার কেনা-বেচার চুক্তি ভুলে
যায়। এ অবস্থায় এ চুক্তি থেকে
গাফেল হয়ে সে কোন লাগামহীন কার্যকলাপ করে বসে। কিন্তু একজন প্রকৃত ও যথার্থ মুমিনের বৈশিষ্ট এই যে, এ
সমায়িক ভুলে যাওয়ার হাত থেকে যখনই সে রেহাই পায়, তখনই
নিজের গাফলতির পর্দা ছিড়ে সে বেরিয়ে আসে এবং অনুভব করতে থাকে যে, অবচেতনভাবে
সে নিজের অংগীকারের বিরুদ্ধাচারণ করে ফেলেছে তখনই সে লজ্জা অনুভব করে, তীব্র
অনুশোচন সহকারে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে ক্ষমা চায় এবং নিজের অংগীকারকে
পুনরায় তরতাজা করে নেয়। এ
বারবার তাওবা করা, বারবার আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং প্রত্যেকটি
পদস্খলনের পর বিশ্বস্ততার পথে ফিরে আসাই ঈমানের স্থিতি ও স্থায়িত্বের প্রতীক। নয়তো যেসব মানবিক দুবর্লতা সহকারে মানুষকে
সৃষ্টি করা হয়েছে সেগুলোর উপস্থিতিতে তার পক্ষে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, সে
আল্লাহর হাতে একবার ধন-প্রাণ বিক্রি করার পর চিরকাল পূর্ণ সচেতন অবস্থায় এ
কেনা-বেচার দাবী পূরণ করতে থাকবে এবং কখনো গাফলতি ও বিস্মৃতির শিকার হবে না। তাই মহান আল্লাহ মুমিনের এ সংজ্ঞা বর্ণনা করেন
না যে, বন্দেগীর পথে এসে কখনো যার পা পিছলে যায় না সে মুমিন। বরং বার বার পা পিছলে যাবার পরও প্রতিবারই সে
একই পথে ফিরে আসে, এটিকেই
আল্লাহ মুমিনের প্রশংসনীয় গুণ হিসেবে গণ্য করেছেন। আর এটিই হচ্ছে মানুষের আয়ত্বের ভেতরের শ্রেষ্ঠতম গুণ।
আবার এ প্রসংগে মুমিনের গুণাবলীর মধ্যে সবার আগে তাওবার কথা বলার আর একটি
উপযোগিতাও রয়েছে। আগে থেকে যে ধারাবাহিক
বক্তব্য চলে আসছে তাতে এমনসব লোকের উদ্দেশ্যে কথা বলা হয়েছে যাদের থেকে ঈমান
বিরোধী কার্যকলাপের প্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই তাদেরকে ঈমানের তাৎপর্য ও তার মৌলিক দাবী জানিয়ে দেবার পর এবার নির্দেশ
দেয়া হচ্ছে যে, মুমিনের যে অপরিহার্য গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে
তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান গুণ হচ্ছেঃ যখনই বন্দেগীর পথ থেকে তাদের পা পিছলে যায়
তারা যেন সংগে সংগেই আবার সেদিকে ফিরে আসে। নিজেদের সত্য বিচ্যুতির ওপর যেন অবিচল হয়ে দাড়িয়ে না থাকে
এবং পিছনের দিকে বেশী দূরে চলে না যায়।
১০৯. মূল ইবারতে السَّائِحُونَ (আস সায়েহুন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ করেছেন الصائمون (আস
সা-য়েমুন) অর্থাৎ যারা রোযা রাখে। কিন্তু السَّائِحُونَ আস সায়েহুনা বা বিচরণকারীকে
রোযাদার অর্থে ব্যবহার করলে সেটা হবে তার রূপক ও পরোক্ষ অর্থ। এর প্রকৃত ও প্রত্যক্ষ অর্থ এটা নয়। আর যে হাদীসে বলা হয়েছে,
নবী
সা. নিজেই এ শব্দটির এ অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন সেটিকে নবীর সা. ওপর প্রয়োগ করা ঠিক
নয়। তাই আমরা একে এর প্রকৃত
অর্থে গ্রহণ করাকেই বেশী সঠিক মনে করি। কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় ইসফাক শব্দটি সরল ও সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে,
এর
মানে হয় ব্যয় করা এবং এর উদ্দেশ্য আল্লাহর পথে ব্যয় করা। ঠিক তেমনি এখানে বিচরণ করা
মানেও নিছক ঘোরাফেরা করা নয়। বরং এমন উদ্দেশ্যে যমীনে চলাফেরা করা, যা পবিত্র
ও উন্নত এবং যার মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। যেমন দীন প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্যে জিহাদ করা, কুফর শাসিত
এলাকা থেকে হিজরত করা, দীনের দাওয়াত দেয়া, মানুষের
চরিত্র সংশোধন করা, পরিচ্ছন্ন ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জন করা, আল্লাহর
নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণ করা এবং হালাল জীবিকা উপার্জন করা। এ গুণটিকে এখানে বিশেষভাবে
মুমিনদের গুণের অন্তরভুক্ত করা হয়েছে এ জন্য যে, যারা
ঈমানের দাবী করা সত্ত্বেও জিহাদের আহবানে ঘর থেকে বেব হয়নি তাদেরকে একথা জানিয়ে দেয়া
যে, সত্যিকার মুমিন ঈমানের দাবী করার পর নিজের জায়গায় আরামে বসে
থাকতে পারে না। বরং সে আল্লাহর দীন গ্রহণ করার পর তার উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অবিচলভাবে
দাঁড়িয়ে যায় এবং তার দাবী পূরণ করার জন্য সারা পৃথিবীব্যাপী অবিরাম প্রচেষ্টা ও
সংগ্রাম চালাতে থাকে ।
১১০. অর্থাৎ মহান আল্লাহ আকীদা-বিশ্বাস,ইবাদত-বন্দেগী, নৈতিক
চরিত্র, সামাজিকতা, তামাদ্দুন অর্থনীতি-রাজনীতি আইন-আদালত,
এবং
যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারে যে সীমারেখা নির্ধারণ করেছেন তারা তা পুরোপুরি মেনে চলে। নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কর্মকাণ্ড এ
সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ রাখে। কখনো এ সীমা অতিক্রম করে ইচ্ছামতো কাজ করতে থাকে না। আবার কখনো আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মনগড়া আইনের বা মানুষের
তৈরী ভিন্নতর আইনকে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে না।এ ছাড়াও আল্লাহর সীমারেখাগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং
এগুলো লংঘন করতে দেয়া যাবে না। কাজেই সাচ্চা ঈমানদারকের সংজ্ঞা কেবল এতটুকুই নয় যে, তারা
নিজেরা আল্লাহর সীমা মেনে চলে বরং তাদের অতিরিক্ত গুণাবলী হচ্ছে এই যে, তারা
দুনিয়ায় আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে, সেগুলোর
রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং সেগুলো অটুট রাখার জন্য নিজেরদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
﴿مَا كَانَ
لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَن يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا
أُولِي قُرْبَىٰ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ﴾
১১৩। নবী ও
যারা ঈমান এনেছে তাদের পক্ষে মুশরিকদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা, সংগত নয়, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন হলেই
বা কি এসে যায়, যখন একথা
সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামেরই উপযুক্ত।১১১
১১১. কোন ব্যক্তির জন্য ক্ষমার আবেদন জানানোর অনিবার্য অর্থ
হচ্ছে এই যে, আমরা তার প্রতি সহানুভূমিশীল এবং তাকে ভালবাসি। আমরা তার দোষকে ক্ষমাযোগ্য মনে করি। যারা বিশ্বস্তদের অন্তরভুক্ত এবং শুধুমাত্র
গোনাহগার তাদের ক্ষেত্রে এ দুটো কথাই ঠিক। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তার
প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়া তাকে ভালবাসা ও তার অপরাধকে ক্ষমাযোগ্য মনে করা শুধু যে
নীতিগতভাবে ভুল তাই নয় বরং এর ফলে আমাদের নিজেদের বিশ্বস্ততা ও সন্দেহযুক্ত হয়ে
পড়ে। আর যদি শুধুমাত্র আমাদের
আত্মীয় বলে আমরা তাকে মাফ করে দিতে চাই তাহলে এর মানে হবে, আমাদের
কাছে আত্মীয়তার সম্পর্ক আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ততার দাবীর তুলনায় অনেক বেশী
মূল্যবান। আল্লাহ ও তার দীনের প্রতি
আমাদের ভালবাসা নির্ভেজাল ও শর্তহীন নয়। আল্লাহদ্রোহীদের সাথে আমরা যে সম্পর্কে জুড়ে রেখেছি তার
ফলে আমরা চাচ্ছি, আল্লাহ নিজেও যেন এ সম্পর্ক গ্রহণ করেন এবং
আমাদের আত্মীয়কে যেন অবশ্যই ক্ষমা করে দেন,
যদিও
এ একই অপরাধ করার কারণে অন্যান্য অপরাধীদেরকে তিনি জাহান্নামের শাস্তি দিয়ে থাকেন। বন্তুত এ সমস্ত কথাই ভুল আন্তরিকতা ও
বিশ্বস্ততার বিরোধী এবং সেই একনিষ্ঠ ঈমানের পরিপন্থী যার দাবী হচ্ছে, আল্লাহ
ও তার দীনের প্রতি আমাদের ভালবাসা নির্ভেজাল হতে হবে,আল্লাহর বন্ধু হবে আমাদের বন্ধু
এবং তার শত্রু হবে আমাদের শত্রু। এ কারণে মহান আল্লাহ এ কথা বলেননি যে, তোমারা
মুশরিকদের জন্য মগফিরাতের দোয়া করো না। বরং তিনি বলেছেন তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা তোমাদের
পক্ষে শোভা পায় না।
অর্থাৎ আমার মানা করায় যদি তোমরা বিরত থাকো তাহলে তো এর তেমন কোন গুরুত্ব থাকে
না। মূলত তোমাদের মধ্যে
আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার অনুভূতি এত বেশী তীব্র হওয়া উচিত যার ফলে আমার বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ ঘোষণাকারীদের সাথে সহানুভূতির সম্পর্ক রাখা এবং তাদের অপরাধকে ক্ষমাযোগ্য
মনে করা তোমাদের নিজেদের কাছেই অশোভন ঠেকে।
এখানে আরো এতটুকু বুঝে নিতে হবে যে,
আল্লাহদ্রোহীদের
প্রতি যে সহানুভূতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা কেবলমাত্র এমন পর্যায়ের সহানুভূতি যা
দীনের ব্যাপরে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মানবিক মহানুভূতি এবং পার্থিব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা
ও রক্ত সম্পর্ক এবং স্নেহ-সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার এসব নিষিদ্ধ নয় বরং প্রশংসনীয়। আত্মীয় কাফের হোক বা মুমিন,
তার
সামাজিক অধিকার অবশ্যি প্রদান করতে হবে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সকল অবস্থায় সাহায্য দিতে হবে। অভাবীকে যে কোন সময় সহায়তা দন করতে হবে। রুগ্ন ও আহতের সেবা ও তাদের প্রতি সহানুভূতি
প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন ত্রুটি দেখানো যাবে না। ইয়াতীমের মাথায় অবশ্যি স্নেহের হত বুলাতে হবে। এসব ব্যাপারে কখনো মুসলিম ও অমুসলিমের
বাচবিচার করা চলবে না।
﴿وَمَا
كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ
فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ۚ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ
لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ﴾
১১৪। ইবরাহীম
তার বাপের জন্য যে মাগফিরাতের দোয়া করেছিল তা তো সেই ওয়াদার কারণে ছিল যা সে তার
বাপের সাথে করেছিল১১২ কিন্তু যখন তার কাছে একথা
পরিস্কার হয়ে গেছে যে, তার বাপ আল্লাহর দুশমন তখন সে তার প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে। যথার্থই
ইবরাহীম কোমল হৃদয়, আল্লাহভীরু
ও ধৈর্যশীল ছিল।১১৩
১১২. হযরত ইবরাহীম তার মুশরিক পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার
সময় যে কথা বলেছিলেন সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ
سَلَامٌ عَلَيْكَ ۖ سَأَسْتَغْفِرُ
لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا
আপনার প্রতি সালাম, আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে দোয়া করবো যেন
তিনি আপনাকে মাফ করে দেন।
তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান। (মারয়ামঃ ৪৭)
তিনি আরো বলেছিলেনঃ
لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ
اللَّهِ مِن شَيْءٍ
আমি আপনার জন্য অবশি ক্ষমা চাইবো। তবে আপনাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। (আল মুমতাহিনাঃ ৪)
উপরক্ত ওয়াদার ভিত্তিতে তিনি নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করেছিলেনঃ
وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ
الضَّالِّينَ، وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ، يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ
وَلَا بَنُونَ، إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
আর আমার পিতাকে মাফ করে দাও, তিনি পথভ্রষ্টদের অন্তরভুক্ত
ছিলেন। আর যেদিন সকল মানুষকে
উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না। যেদিন ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি কারোর কোন কাজে লাগবে
না। একমাত্র সেই নাজাত পাবে,
যে
আল্লাহর সামনে হাযির হবে বিদ্রোহমুক্ত হৃদয় নিয়ে। (আশ শুআরাঃ ৮৬-৮৯)
এ দোয়া তো প্রথমত অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত ভাষায় করা হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেরই হযরত ইবরাহীম চিন্তা করলেন
যে, তিনি যে ব্যক্তির জন্য দোয়া করেছেন সে তো ছিল প্রকাশ্য
আল্লাহদ্রোহী এবং আল্লাহর দীনের ঘোরতর শত্রু তখন তিনি এ থেকে বিরত হলেন এবং একজন
যথার্থ বিশ্বস্ত মুমিনের মত বিদ্রোহীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো থেকে পরিষ্কারভাবে
সরে দাঁড়লেন। অথচ এ বিদ্রোহী ছিল তার
পিতা,যে এক সময়
স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন পালন করেছিল।
১১৩. মূলে اواه (আওওয়াহুন) ও حليم (হালীমুন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আওওয়াহুন মানে হচ্ছে, যে
অনেক বেশী হা-হুতাশ করে, কান্নাকাটি করে, ভয়
পায় ও আক্ষেপ করে। আর হালীম এমন ব্যক্তিকে বলা
হয়, যে
নিজের মেজায সংযত রাখে, রাগে,
শত্রুতায়
ও বিরোধিতায় বেসামাল আচরণ করে না এবং অন্যদিকে ভালবাসায়, বন্ধুত্বের
ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে যায় না।এখানে এ শব্দ দুটি দ্বিবিধ অর্থ প্রকাশ করছে। হযরত ইবরাহীম আ. তার পিতার জন্য মাগফিরাতের
দোয়া করেছেন। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত
সংবেদনশীল হৃদয় বৃত্তির অধিকারী। তার পিতা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হবে,
একথা
ভেবে তিনি কেঁপে উঠেছিলেন। আবার তিনি ছিলেন "হালিম"-সংযমী ও ধৈর্যশীল। তার পিতা ইসলামের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বাধা দেবার
জন্য তার ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিল তা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে পিতার জন্য
দোয়া বের হয়ে গিয়েছিল।
তারপর তিনি দেখলেন, তাঁর
পিতা আল্লাহর দুশমন,তাই তিনি তার থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিলেন। কারণ তিনি আল্লাহকে ভয় করতেন এবং কারোর প্রতি ভালোবাসায়
সীমা অতিক্রম করতেন না।
﴿وَمَا
كَانَ اللَّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُم مَّا
يَتَّقُونَ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
১১৫। লোকদেরকে
হেদায়াত দান করার পর আবার গোমরাহীতে লিপ্ত করা আল্লাহর রীতি নয়, যতক্ষন না তিনি তাদেরকে কোন
জিনিস থেকে সংযত হয়ে চলতে হবে তা পরিস্কার করে জানিয়ে দেন।১১৪ আসলে
আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিসের জ্ঞান রাখেন।
১১৪. অর্থাৎ লোকদের কোন চিন্তা কার্যধারা ও পদ্ধতি থেকে
বাঁচতে হবে তা আল্লাহ আগেই বলে দেন। তারপর যখন তারা তা থেকে বিরত হয় না এবং ভুল চিন্তা ও কাজে লিপ্ত হয়ে তার ওপর
অবিচল থাকে তখন আল্লাহও তাদের হেদায়াত করার ও সঠিক পথনির্দেশনা দেয়া থেকে বিরত হন
এবং যে ভুল পথে তারা যেতে চায় তার ওপর তাদেরকে ঠেলে দেন।
এ বক্তব্যটি থেকে একটি মূলনীতি অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় হেদায়াত দেয়া ও গোমরাহ
করাকে তার নিজের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো এ মূলনীতিটির মাধ্যমে ভালভাবে বুঝে
যেতে পারে। আল্লাহর হেদায়াত দেয়ার মানে
হচ্ছে, তিনি নিজের নবী ও কিতাসমূহের সাহায্যে লোকদের সামনে সঠিক
চিন্তা ও কর্মধারা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তারপর যারা স্বেচ্ছায় এ পথে চলতে উদ্যোগী হয় তাদের চলার
সুযোগ ও সামর্থ দান করেন। আর আল্লাহর গোমরাহীতে লিপ্ত করার মানে হচ্ছে তিনি যে সঠিক চিন্তা ও
কর্মপদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন যদি তার বিপরিত পথে চলার জন্য কেউ জোর প্রচেষ্ঠা চালায়
এবং সোজা পথে চলতে না চায় তাহলে আল্লাহ জোর করে তাকে সত্য পথ দেখান না এবং
সত্যের দিকে চালিত ও করেন না বরং যেদিকে সে নিজে যেতে চায় সেদিকে যাবার সুযোগ ও
সামর্থ তাকে দান করেন।
আলোচ্য ভাষণটি একথাটি কোন প্রসংগে বর্ণনা করা হয়েছে,আগের
ও পরের ভাষণগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলে তা সহজেই বুঝা যেতে পারে। এটা এক ধরনের সতর্কবাণী। একে অত্যন্ত সংগতভাবে আগের বর্ণনার সমাপ্তি হিসাবেও গণ্য
করা যেতে পারে। আবার পরে যে আলোচনা আসছে
তার ভুমিকা ও বলা যেতে পারে।
﴿إِنَّ
اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ يُحْيِي وَيُمِيتُ ۚ وَمَا لَكُم
مِّن دُونِ اللَّهِ مِن وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ﴾
১১৬। আর এও
সত্য, আসমান ও
যমীনের রাজত্ব আল্লাহর নিয়ন্ত্রনাধীন, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই ইখতিয়ারভুক্ত এবং
তোমাদের এমন কোন সহায় ও সাহায্যকারী নেই যে তোমাদেরকে তাঁর হাত থেকে বাঁচাতে
পারে।
﴿لَّقَد تَّابَ اللَّهُ عَلَى
النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ
مِن بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِّنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ ۚ
إِنَّهُ بِهِمْ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾
১১৭। আল্লাহ
নবীকে মাফ করে দিয়েছেন এবং অত্যন্ত কঠিন সময়ে যে মুহাজির ও আনসারগণ নবীর সাথে
সহযোগীতা করেন তাদেরকেও মাফ করে দিয়েছেন।১১৫ যদিও তাদের
মধ্যে থেকে কিছু লোকের দিল বক্রতার দিকে আকৃষ্ট হতে যাচ্ছিল১১৬ (কিন্তু তারা এ বক্রতার
অনুগামী না হয়ে নবীর সহযোগী হয়েছেন। ফলে)
আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন।১১৭ নিসন্দেহে
এ লোকদের প্রতি তিনি স্নেহশীল ও মেহেরবান।
১১৫. অর্থাৎ তাবুক যুদ্ধে নবী সা. ও সাহাবায়ে কেরামের যেসব
ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল তাদের উৎকৃষ্ট মানের কার্যকলাপের বদৌলতে আল্লাহ
সেগুলো মাফ করে দিয়েছেন।
নবী সা. এর কাজে যে ত্রুটি হয়েছিল আগেই ৪৩ আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পিছনে থেকে
যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল তাদেরকে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন।
১১৬. অর্থাৎ কোন কোন আন্তরিকতা সম্পন্ন সাহাবাও এ কঠিন সময়ে
যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে কোন না কোন ভাবে ইতস্তত করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাদের দিলে ঈমান ছিল এবং তারা আন্তরিকভাবে
আল্লাহর সত্য দীনকে ভালবাসতেন তাই শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের দুর্বলতার ওপর বিজয়ী
হতে পেরেছিলেন।
১১৭. অর্থাৎ তাদের মনে ভ্রান্তি নীতির প্রতি ও ঝোঁক কেন সৃষ্টি
হয়েছিল সে জন্য আল্লাহ এখন আর তাদেরকে পাকড়াও করবেন না। কারণ মানুষ নিজেই যে দুর্বলতার সংশোধন করে নেয় আল্লাহ সে
জন্য কোন কৈফিয়ত তলব করেন না।
﴿وَعَلَى
الثَّلَاثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُوا حَتَّىٰ إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا
رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَن لَّا مَلْجَأَ مِنَ اللَّهِ
إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ
الرَّحِيمُ﴾
১১৮। আর কে
তিনজনের ব্যাপার মূলতবী করে দেয়া হয়েছিল তাদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়ছেন১১৮ পৃথিবী তার
সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেলো, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের
জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য
আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে
তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। অবশ্যি
আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।১১৯
১১৮. নবী সা. যখন তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে এলেন তখন যারা পিছনে
অর্থাৎ মদীনায় থেকে গিয়েছিল। তারা ওযর পেশ করার জন্য হাজির হলো। তাদের মধ্যে ৮০ জনেরও বেশী ছিল মুনাফিক। মুনাফিরা মিথ্যা ওযর পেশ করেছিল এবং
রসূলুল্লাহ সা. তা মেনে নিচ্ছিলেন্। তারপর এলো এ তিন জন মুমিনের পালা। তারা পরিষ্কারভাবে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। নবী সা. তাদের তিনজনের ব্যাপারে ফায়সালা
মুলতবী রাখলেন।
তিনি সাধারণ মুসলমানদের হুকুম দিলেন,
আল্লাহর
নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন প্রকার সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ বিষয়টির ফায়সালা করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়। (এখানে একথাটি অবশ্যি) সামনে রাখতে হবে যে, ৯৯
টীকায় যে সাতজন সাহাবীর আলোচনা এসেছে তাদের ব্যাপারটি কিন্তু এদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা তো জবাবদিহির আগেই নিজেরাই নিজেদের
শাস্তি দিয়েছিলেন।
১১৯. এ তিন জন সাহাবী ছিলেন কাব ইবনে মালেক,হিলাল ইবনে উমাইয়াহ এবং মুরারাহ
ইবনে রুবাই। আগেই বলেছি, এরা
তিনজন ছিলেন সাচ্চা মুমিন। এর আগে তারা বহুবার নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। শেষের দুজন তো বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহন
করেছিলেন। কাজেই তাদের ঈমানী সত্যতা
সব রকমের সংশয়-সন্দেহের উর্ধে ছিল। আর প্রথম জন যদিও বদরী সাহাবী ছিলেন না কিন্তু বদর ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধে নবী সা.
এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের জন্য তার এমন ত্যাগ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম-সাধনা সত্ত্বেও এমন এক নাজুক
সময়ে যখন যুদ্ধ করার শক্তি ও সমর্থের অধিকারী প্রত্যেক মুমিনকে যুদ্ধ করার জন্য
এগিয়ে আসার হুকুম দেয়া হয়েছিল তখন তারা যে অলসতা ও গাফলতির পরিচয় দিয়েছিলেন সে
জন্য তাদেরকে কঠোরভাবে পাকড়াও করা হয়েছিল। নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে মুসলমানদের প্রতি কড়া নির্দেশ
জারি করেন কেউ এদের সাথে সালাম কালাম করতে পারবে না। ৪০ দিন পরে তাদের স্ত্রীদেরকে ও তাদের থেকে আলাদা বসবাস
করার কঠোর আদেশ দেয়া হলো। আসলে এ আয়াতে তাদের অবস্থার যে ছবি আঁকা হয়েছে মদীনার জনবসতিতে তাদের অবস্থা
ঠিক তাই হয়ে গিয়েছিল।
শেষে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারটি যখন ৫০ দিনে এসে ঠেকালো তখন ক্ষমার এ
ঘোষণা নাযিল হলো।
এ তিন জনের মধ্য থেকে হযরত কাব ইবনে মালেক অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে নিজের ঘটনা
বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনা বড়ই শিক্ষাপ্রদ। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় তার ছেলে আবদুল্লাহ তাকে হাত ধরে নিয়ে
চলাফেরা করতেন। আবদুল্লাহকে তিনি নিজেই এ
ঘটনা এভাবে শুনানঃ
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নবী সা. যখনই মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহন
করার আবেদন জানাতেন তখনই আমি মনে মনে সংকল্প করে নিতাম যে, যুদ্ধে
যাবার প্রস্তুতি নেবো।
কিন্তু ফিরে এসে আমাকে অলসতায় পেয়ে বসতো এবং আমি বলতাম,
এখনই
এতো তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা দেবার সময় যখন আসবে তখন তৈরী হতে কতটুকু
সময়ই বা লাগবে।এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে
যেতে থাকলো। তারপর একদিন সেনাবাহিনীর
রওয়ানা দেবার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরী ছিলাম না। আমি মনে মনে বললাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি
এক দুদিন পরে পথে তাদের সাথে যোগ দেবো। কিন্তু তখনো একই অলসতা আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে সময় পার হয়ে গেলো।
এ সময় যখন আমি মদীনায় থেকে গিয়েছিলাম আমার মন ক্রমেই বিষিয়ে উঠিছিল। কারণ আমি দেখছিলাম যাদের সাথে এ শহরে আমি
রয়েছি তার হয়, মুনাফিক, নয়তো দুর্বল, বৃদ্ধ
ও অক্ষম লোক, যাদেরকে আল্লাহ অব্যহতি দিয়েছেন।
নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে যথারীতি মসজিদে প্রবেশ করে দু'রাকাত
নফল নামায পড়লেন। তারপর তিনি লোকদের সাথে
সাক্ষাত করার জন্য বসলেন।মুনাফিকরা
এ মজলিসে এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের ওযর পেশ করতে লাগলো। এদের সংখা ছিল ৮০ এর চাইতেও বেশী। রসূলূল্লাহ সা. তাদের প্রত্যেকের বনোয়াট ও
সাজানো কথা শুনলেন।
তাদের লোক দেখানো ওযর মেনে নিলেন এবং তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে
দিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন। তারপর আমার পালা এলো। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আসুন!
আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম,
আল্লাহর
কসম! যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাযির হতাম তাহলে অবশ্যি কোন না কোন কথা
বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম। কথা বানিয়ে বলার কৌশল আমিও জানি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস,যদি এখন কোন মিথ্যা ওযর পেশ
করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার
নারাজ করে দেবেন।
তবে যদি আমি সত্য বলি তাহলে আপনি নারাজ হয়ে গেলেও আমি আশা রাখি আল্লাহ আমার জন্য
ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন। আসলে পেশ করার মতো, কোন ওযরই আমার নেই। যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম। একথা শুনে রসূলুল্লাহ সা.বললেন,
এ
ব্যক্তি সত্য কথা বলেছে।
ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কোন
ফায়সালা না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো। আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। এখানে সবাই আমার পিছনে লাগলো। তারা আমাকে এ বলে তিরস্কার করতে লাগলো যে, তুমি
ও কোন মিথ্যা ওযর পেশ করলে না কেন এসব কথা শুনে আবার রসূলের কাছে গিয়ে কিছু
বানোয়াট ওযর পেশ করার জন্য আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু যখন শুনলাম আরো দুজন সৎলোক (মুরারাহ ইবনে রুবাই ও
হেলাল ইবনে উমাইয়াহ) আমার মতো একই সত্য কথা বলেছেন তখন আমি মানসিক প্রশান্তি
অনুভব করলাম এবং আমার সত্য কথার ওপর অটল থাকলাম।
এরপর নবী সা. সাধারণ হুকুম জারি করলেন,
আমাদের
তিন জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। অন্য দুজন তো ঘরের মধ্যে বসে রইলো কিন্তু আমি বাইরে বের হতাম, জামায়াতে
নামায পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হয়তো,
এ
দেশটি একদম বদলে গেছে।
আমি যেন এখানে একজন অপরিচিত আগুন্তুক। এ জনপদের কেউ আমাকে জানে না, চেনা না। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যথারীতি নবী সা. কে
সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তার
ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু শুধু অপেক্ষা করাই সার হতো। তার নজর আমার ওপর কিভাবে পড়ছে তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে
তার প্রতি তাকাতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে, যতক্ষণ
আমি নামায পড়তাম ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন এবং যেই আমি নামায শেষ করতাম অমনি
আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন।একদিন ঘাবড়ে গিয়ে আমার চাচাত ভাই ও ছেলে বেলার বন্ধু আবু কাতাদার কাছে গেলাম। তার বাগানের পাঁচিলের ওপর উঠে তাকে সালাম
দিলাম। কিন্তু আল্লাহর সেই
বান্দাটি আমার সালামের জবাবও দিলো না। আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আমি
কি আল্লাহ ও তার রসূলকে ভালবাসি না?
সে
নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
সে
নীরব রইলো। তৃতীয়বার যখন আমি কসম দিয়ে
তাকে এ প্রশ্ন করলাম তখন সে শুদুমাত্র এতটুকু বললোঃ আল্লাহ ও তার রসূলই ভাল জানেন। একথায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি পাঁচিল থেকে নেমে এলাম। এ সময় আমি একদিন বাজার দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সিরিয়ার নাবতী বংশীয় এক লোকের সাথে
দেয়া হলো। সে রেশমে মোড়া গাসসান
রাজার একটি পত্র আমার হাতে দিল। আমি পত্রটি খুলে পড়লাম। তাতে
লেখা ছিল, আমরা শুনেছি, তোমার
নেতা তোমার ওপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগ্যন্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো। আমি বললাম, এ
দেখি আর এক আপদ! তখনই চিঠিটাকে চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।
চল্লিশটা দিন এভাবে কেটে যাবার পর রসূলুল্লাহ সা. কাছে থেকে তার দুত এই হুকুম
নিয়ে এলেন, যে
নিজের স্ত্রী থেকে ও আলাদা হয়ে যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে কি তালাক দিয়ে দিবো? জবাব
এলো, না,
তালাক
নয়। শুধু আলাদা থাকো। কাজেই আমি স্ত্রীকে বলে দিলাম, তুমি
বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ এ ব্যাপারে কোন সিন্ধান্ত দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা
করতে থাকো।
এভাবে উনপঞ্চাশ দিন পার হয়ে পঞ্চাশ দিন পড়লো। সেদিন সকালে নামাযের পরে আমি নিজের ঘরের ছাদের ওপর বসে
ছিলাম। নিজের জীবনের প্রতি আমার
ধিক্কার জাগছিল হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে বললোঃ কাব ইবনে মালিককে অভিনন্দন। একথা শুনেই আমি সিজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার
ক্ষমার ঘোষনা জারি হয়েছে। এরপর লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। তারা প্রত্যেকে পাল্লা দিয়ে আমাকে মুবারকবাদ দিচ্ছিল। তারা বলছিল তোমার তওবা কবুল হয়েছে। আমি উঠে সোজা মসজিদে নববীর দিকে গেলাম। দেখলাম,
নবী
সা. এর চেহারা আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম।
তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ ! আজকের দিনটি তোমার
জীবনের সর্বোত্তম দিন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ
থেকে? বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং এ সংগে
তিনি সংশ্লিষ্ট আয়াত শুনিয়ে দিলেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সদকা করে দিতে
চাই।এটাও আমার তাওবার অংশ বিশেষ। বললেনঃ কিছু রেখে দাও, এটাই
তোমার জন্য ভাল। এ বক্তব্য অনুযায়ী আমি
নিজের খয়বরের সম্পত্তির অংশটুকু রেখে দিলাম। বাদবাকি সব সাদকা করে দিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে অংগীকার করলাম, যে
সত্যকথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তার ওপর আমি সারা জীবন
প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে
বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি এবং আশা করি আল্লাহ
আগামীতেও তা থেকে আমাকে বাঁচাবেন।
এ ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। প্রত্যেক মুমিনের মনে তা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিত।
এ থেকে প্রথম যে শিক্ষাটি পাওয়া যায়,
তা
হচ্ছে, কুফর ও ইসলামের সংঘাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক। এ সংঘাতে কুফরের সাথে সহযোগিতা করা তো দূরের
কথা, যে
ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অসৎ উদদেশ্যে নয়, সৎ
উদ্দেশ্যে এবং সারা জীবনও নয় বরং কোন এক সময় ভূল করে বসে, তারও
সারা জীবনের ইবাদত-বন্দেগী ও দীনদারী ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এমনকি এমন উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকও পাকড়াও হওয়ার হাত
থেকে রক্ষা পেতে পারে না যে, বদর ওহোদ আহযাব ও হুনাইনের
ভয়াবহ যুদ্ধ ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিল এবং যার ঈমান ও আন্তরিকতার
মধ্যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিলো না।
দ্বিতীয় শিক্ষাটিও এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হচ্ছে দ্বায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করা কোন
মামুলি ব্যাপার নয়। বরং অনেক সময় শুধুমাত্র
গড়িমসি করতে করতে মানুষ এমন কোন ভুল করে বসে যা বড় বড় গোনাহের অন্তরভূক্ত। তখন একথা বলে সে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। সে অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজটি করেনি।
নবী সা. এর নেতৃত্বে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল। এ ঘটনা খুবই চমৎকারভাবে তার প্রাণসত্তা উন্মোচন করে দেয়। একদিকে রয়েছে মুনাফিদের দল। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সবার কাছে সুষ্পষ্ট ছিল। এরপরও তাদের বাহ্যিক ওযরসমূহ শোনা হয় এবং
সেগুলোর সত্যাসত্য এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ তাদের কাছ থেকে তো আন্তরিকতার আশাই করা হয়নি কোন দিন। কাজেই এখন আন্তরিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ
তোলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে রয়েছেন একজন পরীক্ষিত মুমিন। তার উৎসর্গীত প্রাণ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কারো মনে কোন
প্রকার সন্দেহের অবকাশই নেই। তিনি মিথ্যা ও বলেন না। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের ভুল স্বীকার করে নেন। কিন্তু তার ওপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। এ ক্রোধের কারণ এ নয় যে, তার
মুমিন হবার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বরং এর কারণ হচ্ছে,
মুমিন
হওয়া সত্ত্বেও সে মুনাফিক সুলভ কাজ করলো কেন?
আসলে
এভাবে তাকে একথাই বলা হচ্ছে, যে, তোমরাই
পৃথিবীর সার বস্তু। তোমাদের থেকে যদি মৃত্তিকা
উর্বরতা লাভ করতে না পারে তাহলে উর্বরতা কোথা থেকে আসবে?তারপর
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পুরো ঘটনায় নেতা যেভাবে শাস্তি দিচ্ছেন এবং
ভক্ত যেভাবে তা মাথা পেতে নিচ্ছেন আর এ সাথে সমগ্র দলটি যেভাবে এ শাস্তি কার্যকর
করছে তার প্রত্যেকটি দিকই তুলনা বিহীন। এ ক্ষেত্রে কে বেশী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তা স্থির করাই কঠিন। নেতা অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে ক্রোধ বা ঘৃণার লেশমাত্র নেই। বরং গভীর স্নেহ ও প্রীতি সহকারে তিনি শাস্তি
দিচ্ছেন। ক্রুদ্ধ পিতার ন্যায় তার
দৃষ্টি একদিকে অনল বর্ষণ করে চলেছে ঠিকই কিন্তু অন্য দিকে আবার তাকে প্রতি
মুহূর্তে একথা জনিয়ে দিচ্ছে যে, তোমার সাথে কোন শত্রুতা
নেই বরং তোমার ভুলের কারণে আমার অন্তরটা ব্যাথায় টনটন করছে। তুমি নিজের ভুল শুধরে নিলে তোমাকে এ বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য
আমি ব্যগভাবে অপেক্ষা করছি। ভক্ত শাস্তির তীব্রতায় অস্থির হয়ে পড়ছে।কিন্তু তার পদযুগল আনুগত্যের রাজপথ থেকে এক চুল পরিমানও
টলছে না। সে আত্মম্ভরিতা ও জাহেলী
দাম্ভিকতারও শিকার হচ্ছে না এবং প্রকাশ্যে অহংকার করে বেড়ানোর তো দূরের কথা, এমনকি
নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে মনের গভীরে সামান্যতম অভিযোগও সৃষ্টি হতে দিচ্ছে না। বরং নেতার প্রতি ভালবাসায় তার মন আরো ভরে
উঠেছে। শাস্তির পুরো পঞ্চাশ দিন
তার দৃষ্টি সবচেয়ে বেশী অধীর হয়ে যে জিনিসটি খুজে বেড়িয়েছে, সেটি
হচ্ছে, নেতার চোখে তার প্রতি আগের সেই মমত্বপূর্ণ দৃষ্টি বহাল আছে
কিনা, যা তার সমস্ত আশা আকাংখার শেষ আশ্রয় স্থল। সে যেন একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। আকাশের এক কিনারে যে ছোট্র এক টুকরো মেঘ
দেখা যাচ্ছে। সেটিই তার সমস্ত আশার
একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু।
তারপর দলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে,
তার
অভুতপূর্ব শৃংখলা বিরাজিত যে, নেতার মুখ থেকে বয়কটের
নির্দেশ উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই অপরাধীর ওপর থেকে দলের সমস্ত লোক দৃষ্টি ফিরিয়ে
নিয়েছে। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা
গোপনেও কোন নিকটতম আত্মীয় এবং সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুও তার সাথে কথা বলছে না। স্ত্রীও তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দোহাই দিয়ে সে জিজ্ঞেস করছে, আমার
আন্তরিকতায় কি তোমাদের কোন সন্দেহ জেগেছে?
কিন্তু
যারা দীর্ঘকাল তাকে আন্তরিক দেখে আসছিল তারা পরিস্কার বলে দিচ্ছেঃ আমাদের কাছ থেকে
নয়, আল্লাহ ও তার রসূলের কাছ থেকে নিজের আন্তরিকতার সনদ নাও। অন্যদিকে দলের নৈতিক প্রাণসত্তা এত বেশী উন্নত
ও পবিত্র যে, এক ব্যক্তির উচু মাথা নীচু হবার সাথে সাথেই
নিন্দুকদের কোন দল তার নিন্দায় সোচ্চার হয়ে উঠে না। বরং শাস্তির এ পুরো সময়টায় দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের এ
সাজাপ্রাপ্ত ভাইয়ের বিপদে মর্মবেদনা অনুভব করে এবং পুনরায় তাকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে
ধরার জন্য ব্যকুল থাকে।
ক্ষমার কথা ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা অতি দ্রুত তার কাছে পৌছে তার সাথে
সাক্ষাত করার এবং তাকে সুসংবাদ দেবার জন্য দৌড়াতে থাকে। কুরআন যে ধরনের সত্যনিষ্ঠা দল দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়
এটি হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে একথাটি সুষ্পষ্ট হয়ে
যায় যে, এ সাহাবীগণ আল্লাহর দরবার থেকে যে ক্ষমা লাভ
করেছিলেন এবং সেই ক্ষমার কথা বর্ণনা করার ভাষায় মধ্যে যে স্নেহ ও করুণা ধারা
প্রবাহিত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে তাদের আন্তরিকতা। পঞ্চাশ দিনের কঠোর শাস্তি ভোগকালে তারা এ আন্তরিকতার
প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ভূল করার পর যদি তারা
অংহকার করতেন, নিজেদের নেতার অসন্তোষের জাবাবে ক্রোধ ও
ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতেন, শাস্তিলাভের ফলে এমনই বিক্ষুদ্ধ হতেন যেমন
স্বার্থবাদী লোকদের আত্মভিমানে আঘাত লাগলে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। সামাজিক বয়কটকালে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে
রাজি। কিন্তু নিজের আত্মভিমানকে
আহত করতে রাজি নই-এ নীতি অবলম্বন করতেন এবং যদি এ সমগ্র শাস্তিকালে দলের মধ্যে
অসন্তোষ ছড়িয়ে বেড়াতেন এবং অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুদ্ধ লোকদের খুঁজে বের করে এক সাথে
মিলিয়ে জোটবদ্ধ করতেন, তাহলে তাদের ক্ষমা করা তো দূরের কথা বরং
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দল থেকে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হতো এবং এ
শাস্তির মেয়াদ শেষ হবার পর তাদের যোগ্য শাস্তিই তাদেরকে দেয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো, যাও
তোমরা নিজেদের অহম পূজায় লিপ্ত থাকো। সত্যের কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রামে অংশ নেবার সৌভাগ্য তোমাদের আর কখনো হবে
না।
কিন্তু এ কঠিন পরীক্ষায় ঐ তিনজন সাহাবী এ পথ অবলম্বন করেননি, যদিও
এ পথটি তাদের জন্য খোলা ছিল। তারা বরঞ্চ আমাদের আলোচিত পূর্বোক্ত পথ অবলম্বন করেছিলেন। এ পথ অবলম্বন করে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন
যে, আল্লাহর আনুগত্যের নীতি তাদের হৃদয় থেকে পূজা ও বন্দনা করার
মতো সকল মূর্তি অপসারিত করেছে। নিজেদের সমগ্র ব্যক্তি সত্তাকে তারা আল্লাহর পথে সাধনা করার জন্য নিয়োজিত
করে দিয়েছে।নিজেদের ফিরে যাবার
নৌকাগুলোকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দিয়ে ইসলামী জামায়াতে প্রবেশ করেছিলেন যে, পেছনে
ফিরে যেতে চাইলেও আর ফেরার কোন জায়গা ছিল না। এখানেই মার খাবেন এবং এখানেই মরবেন। অন্য কোথাও কোন বৃহত্তম সম্মান ও মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা
পেলেও এখানকার লাঞ্ছনা ত্যাগ করে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে যাবেন না। এরপর তাদেরকে উঠিয়ে বূকে জড়িয়ে না ধরে আর কী
করা যেতো? এ কারণেই আল্লাহ তাদের ক্ষমার কথা বলেছেন
অত্যন্ত স্নেহমাখা ভাষায়।
তিনি বলেছেনঃ আমি তাদের দিকে ফিরলাম যাতে তারা আমার দিকে ফিরে আসে। এ কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে এমন একটি অবস্থার ছবি
আঁকা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, প্রভু আগে এ বান্দাদের দিক
থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা পালিয়ে না গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তারই দোরগাড়ায় বসে পড়লো তখন
তাদের বিশ্বস্ততার চিত্র দেখে প্রভু নিজে আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রেমের আবেগে অধীর হয়ে তাকে দরজা থেকে উঠিয়ে
নিয়ে যাবার জন্য তিনি নিজেই বের হয়ে এলেন।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ﴾
১১৯। হে
ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সহযোগি হও।
﴿مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ
وَمَنْ حَوْلَهُم مِّنَ الْأَعْرَابِ أَن يَتَخَلَّفُوا عَن رَّسُولِ اللَّهِ وَلَا
يَرْغَبُوا بِأَنفُسِهِمْ عَن نَّفْسِهِ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ
وَلَا نَصَبٌ وَلَا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ
الْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَّيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِ عَمَلٌ
صَالِحٌ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ﴾
১২০। মদীনাবাসী
ও তাদের আশপাশে বেদুইনদের জন্য আল্লাহর রসূলকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকা এবং তার
ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে নিজেদের জীবনের চিন্তায় মশগুল হয়ে যাওয়া কোনক্রমেই সমীচীন
ছিল না। কারণ আল্লাহর পথে তারা যখনই
ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও শারীরিক কষ্ট ভোগ করবে, যখনই এমন পথ অবলম্বন করবে যা
সত্য অমান্যকারীদের কাছে অসহনীয় এবং যখনই কোন দুশমনের ওপর (সত্যের প্রতি দুশমনির)
প্রতিশোধ নেবে তৎক্ষনাৎ তার বদলে তাদের জন্য একটি সৎকাজ লেখা হবেই। এর
ব্যতিক্রম কখনো হবে না। অবশ্যি আল্লাহর দরবারে সৎ
কর্মশীলদের পরিশ্রম বিফল যায় না।
﴿وَلَا يُنفِقُونَ نَفَقَةً
صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً وَلَا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ
اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
১২১।
অনুরূপভাবে তারা যখনই (আল্লাহর পথে) কম বা বেশী কিছু সম্পদ ব্যয় করবে এবং (সংগ্রাম
সাধনায়) যখনই কোন উপত্যকা অতিক্রম করবে, অমনি তা তাদের নামে লেখা হয়ে
যাবে, যাতে
আল্লাহ তাদেরকে তাদের এ ভাল কাজের পুরস্কার দান করেন।
﴿وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ
لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا
فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ﴾
১২২। আর
মুমিনদের সবার এক সাথে বের হয়ে পড়ার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু
তাদের জনবসতির প্রত্যেক অংশের কিছু লোক বেরিয়ে এলে ভাল হতো। তারা দীন
সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজের এলাকার লোকদের কে সতর্ক করতো, যাতে তারা (অমুসলমানী আচরণ
থেকে) বিরত থাকতো, এমনটি হলো
না কেন?১২০
১২০. এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৯৭ আয়াতটি সামনে
রাখতে হবে। তাতে বলা হয়েছেঃ
"মরুচারী আরবরা কূফরী ও
মুনাফিকীতে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং আল্লাহ তার রসূলের প্রতি যে দীন নাযিল করেছেন তা
সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভবনা অপেক্ষাকৃত বেশী"।
সেখানে শুধু এতটুকু বলেই শেষ করা হয়েছিল যে, দারুল
ইসলামের গ্রামীণ এলাকার বেশীরভাগ জনবসতি মুনাফিকী রোগে আক্রান্ত। কারণ এসব লোক অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে আছে। জ্ঞানের কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ না থাকা এবং
জ্ঞনবানদের সাহচর্যে না পাওয়ার ফলে এরা আল্লাহর দীনের সীমারেখা জানে না। আর এখানে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ
জনবসতিকে এ অবস্থায় থাকতে দেয়া যাবে না। বরং তাদের অজ্ঞতা দূর এবং তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি
করার জন্য এখন যথাযথ ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এ জন্য গ্রামীণ এলাকার সমস্ত আরব অধিবাসীদের নিজেদের
ঘরবাড়ি ছেড়ে মদীনায় জামায়েত হবার এবং এখানে বসে জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন নেই। বরং এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে, প্রত্যেক
গ্রাম, পল্লী ও গোত্র থেকে কয়েকজন করে লোক বের হবে। তারা জ্ঞানের কেন্দ্রগুলো যেমন মদীনা ও মক্কা
এবং এ ধরনের অন্যান্য জায়গায় আসবে। এখানে এসে তারা দীনের জ্ঞান আহরণ করবে। এখান থেকে তারা নিজেদের জনবসতিতে ফিরে যাবে এবং সাধারণ
মানুষের মধ্যে দীনী চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে তৎপর হবে।
এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও মজবুত করার জন্য সঠিক সময়ে
এ নির্দেশটি দেয়া হয়েছিল।
শুরুতে ইসলাম যখন আরবে ছিল একেবারেই নতুন এবং একটি চরম প্রতিকূল পরিবেশে ধীরে ধীরে
ছড়িয়ে পড়ছিল তখন এ ধরনের নির্দেশের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন যে ব্যক্তি ইসলাম কে পুরোপুরি বুঝে নিতো এবং সব
দিকে দিয়ে তাকে যাচাই করে নিশ্চিত হতে পারতো একমাত্র সে ই ইসলাম গ্রহণ করতে। কিন্তু যখন এ আন্দোলন সাফল্যের পর্যায়ে
প্রবেশ করলো এবংপৃথিবীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন দলে দলে লোকেরা
ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো এবং এলাকার পর এলাকা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে
থাকলো। এ সময় খুব কম লোকই ইসলামের
যাবতীয় চাহিদাও দাবী অনুধাবন কররে ভালভাবে জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করতো। বেশীর ভাগ লোকই নিছক অচেতনভাবে,সময়ের
স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। নতুন মুসলিম জনবসতির এ দ্রুত বিস্তার বাহ্যত ইসলামের শক্তিমত্তার কারণ ছিল। কেননা ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের জনবসতি ইসলামী
ব্যবস্থার কোন কাজে লাগেছিল না বরং তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। কারণ তাদের ইসলামী চেতনা ছিল না এবং এ ব্যবস্থার নৈতিক
দাবী পূরণ করতেও তারা প্রস্তুত ছিল না।বস্তুত তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এ ক্ষতি সুষ্পষ্ট আকারে সামনে এসে
গিয়েছিল। তাই সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ
নির্দেশ দিলেন, ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির কাজ যে গতিতে চলছে
তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাকে শক্তিশালী ও মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে ব্যবস্থাটি হচ্ছে, প্রত্যেক
এলাকার লোকদের মধ্য থেকে কিছু লোককে নিয়ে শিক্ষা ও অনুশীলন দান করতে হবে, তারপর
তারা প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও অনুশীলনের
দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে সমগ্র মুসলিম
জনবসতিতে ইসলামের চেতনা ও আল্লাহর বিধানের সীমারেখা সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে।
এ প্রসংগে এতটুকু কথা অবশ্যি অনুধাবন করতে হবে যে, এ
আয়াতে যে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করার হুকুম দেয়া হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য সাধারণ
মানুষকে নিছক সাক্ষরতা সম্পন্ন করা এবং এদের মধ্যে বইপত্র পড়ার মতো যোগ্যতা
সৃষ্টি করা ছিল না। বরং লোকদের মধ্যে দীনের
বোধ ও জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে অমুসলিম সুলভ জীবনধারা থেকে রক্ষা করা, সতর্ক
ও সজ্ঞান করে তোলা এর আসল উদ্দেশ্য হিসেবে সুষ্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। এটিই মুসলমানদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ নিজেই চিরকালের জন্য এ উদ্দেশ্য
নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
প্রত্যেকটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হবে। দেখতে হবে এ উদ্দেশ্য সে কতটুকু পূরণ করতে
সক্ষম। এর অর্থ এ নয় যে, ইসলাম
লোকদেরকে লেখা-পড়া শেখাতে, বই
পড়তে সক্ষম করতে তুলতে ও পার্থিব জ্ঞান দান করতে চায় না।বরং এর অর্থ হচ্ছে,
ইসলাম
লোকদের মধ্যে এমন শিক্ষা বিস্তার করতে চায় যা ওপরে বর্ণিত শিক্ষালাভের জন্য
সুষ্পষ্টভাবে নির্ধারিত আসল উদ্দেশ্যের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নয়তো প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার যুগের
আইনষ্টাইন ও ফ্রয়েড হয়ে যায় কিন্তু দীনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা শূন্যের কোঠায়
অবস্থান করে এবং অমুসলিম সূলভ জীবনধারায় বিভ্রান্ত হতে থাকে তাহলে ইসলাম এ ধরনের
শিক্ষার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে।
এ আয়াতে উল্লেখিত لِّيَتَفَقَّهُوا
فِي الدِّينِ (লিয়াতাফাক্কাহু ফিদ্দীন) বাক্যাংশটির ফলে
পরবর্তীকালে লোকদের মধ্যে আশ্চর্য ধরনের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা বরং তাদের ধর্মীয়
জীবনধারার ওপর এর বিষয়ময় প্রভাব দীর্ঘকাল থেকে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ "তাফাক্কুহ্ ফিদ্ দীন" কে
শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিলেন।এর অর্থ হচ্ছেঃ দীন অনুধাবন করা বা বুঝা,
দীনের
ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা, তার
প্রকৃতি ও প্রাণশক্তির সাথে পরিচিত হওয়া এবং এমন যোগ্যতার অধিকারী হওয়া যার ফলে
চিন্তা ও কর্মের সকল দিক ও জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে কোন চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি
ইসলামের প্রাণশক্তির অনুসারী ত মানুষ জানতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে যে আইন সম্পর্কিত জ্ঞান পারিভাষিক
অর্থে ফিকহ নামে পরিচিত হয় এবং যা ধীরে ধীরে ইসলামী জীবনের নিছক বাহ্যিক কাঠামোর
(প্রাণশক্তির মোকাবিলায়) বিস্তারিত জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, লোকেরা
শাব্দিক অভিন্নতার কারণে তাকেই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষার চরম ও পরম লক্ষ
মনে করে বসেছে। অথচ সেটিই সম্পূর্ণ
উদ্দেশ্য ও লক্ষ নয়।
বরং তা ছিল উদ্দেশ্য ও লক্ষের একটি অংশ মাত্র। এ বিরাট ভুল ধারণার ফলে দীন ও তার অনুসারীদের যে ক্ষতি
হয়েছে তা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে হলে একটি বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমরা এ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার
জন্য সংক্ষেপে শুধুমাত্র এতটুকু ইংগিত করছি যে,
মুসলমানদের
ধর্মীয় শিক্ষাকে যে জিনিসটি দীনী প্রাণশক্তি বিহীন করে নিছক দীনী কাঠামো ও দীনী
আকৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এবং অবশেষে যার বদৌলতে
মুসলমানদের জীবনে একটি নিছক প্রাণহীন বাহ্যিকতা দীনদারীর শেষ মনযিলে পরিণত হয়েছে
তা বহুলাংশে এ ভূল ধারণারই ফল।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا
فِيكُمْ غِلْظَةً ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ﴾
১২৩। হে
ঈমানদারগণ! সত্য অস্বীকারকারীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ
করো।১২১ তারা যেন তোমাদের মধ্যে
কঠোরতা দেখতে পায়।১২২ জেনে রাখো
আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।১২৩
১২১. মূল আয়াতে যে শব্দ সংযোজিত হয়েছে তার বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, দারুল
ইসলামের যে অংশ ইসলামের শত্রুদের এলাকার যে অংশের সাথে মিশে আছে তার বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করার প্রাথমিক দায়িত্ব ঐ অংশের মুসলমানদের ওপর আরোপিত। কিন্তু পরে যা বলা হয়েছে তার সাথে-এ আয়াতটিকে মিলিয়ে পড়লে
জানা যাবে, এখানে কাফের বলতে এমন সব মুনফিককে বুঝানো
হয়েছে যাদের সত্য অস্বীকার করার বিষয়টি পুরোপুরি স্ষ্পষ্ট হয়ে সামনে এসে গিয়েছিল। এবং যাদের ইসলামী সামজের মধ্যে মিশে একাকার
হয়ে থাকার কারণে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছিল। ১০ রুকূর শুরুতেও এ ভাষণটি আরম্ভ করার সময় প্রথম কথার
সূচনা এভাবেই করা হয়েছিলঃ এবার এ ঘরের শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য যথারীতি জিহাদ
শুরু করে দিতে হবে। এখানে ভাষণ শেষ করার সময়
তাকীদ সহকারে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এভাবে মুসলমানরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করবে। যে আত্মীয়তা এবং বংশগত ও সামাজিক সম্পর্কের
কারণে তারা মুনাফিকদের সাথে সম্পর্ক জুড়ে ছিল এরপর আর তারা তাদের সাথে ঐ সম্পর্কের
পরোয়া করবে না। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে
জিহাদ করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। আর এখানে তার চেয়ে কড়া "কিতাল" শব্দ (সশস্ত্র যুদ্ধ করে হত্যা করা)
ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, তাদেরকে
পুরোপুরি উৎখাত করে দও, তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে যেন কোন
প্রকার ত্রুটি না থাকে।
সেখানে কাফের ও মুনাফিক দুটো আলাদা শব্দ বলা হয়েছিল। আর এখানে শুধুমাত্র কাফের শব্দের ওপরই নির্ভর করা হয়েছে। কারণ তাদের সত্য অস্বীকৃতি সুস্পষ্টভাবে
প্রমাণিত হয়েছিল।কাজেই ঈমানের বাহ্যিক
স্বীকৃতির অন্তরালে আত্মগোপন করে তা যে কোন প্রকার সুবিধা আদায় করতে না পারে
একথাটি ব্যক্ত করাই এর উদ্দেশ্য।
১২২. অর্থাৎ এ পর্যন্ত তাদের সাথে যে নরম ব্যবহার করা হয়েছে তার
এখন পরিসমপ্তি হওয়া উচিত। দশ
রুকূর শুরুতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে واغلظ عليهم তাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করো।
১২৩. এ সতর্ক বাণীর দুটি অর্থ হয়। দুটো অর্থই এখানে সমানভাবে প্রযোজ্য।
একঃ
এ
সত্য অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে যদি তোমরা নিজেদের ব্যক্তিগত,
পারিবারিক
ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরোয়া করো তাহলে এটা হবে তাকওয়া বিরোধী। কারণ মুত্তাকী হওয়া এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে
মানসিক সম্পর্ক রাখা-এ দুটো বিষয় পরষ্পর বিরোধী। কাজেই আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে এ ধরনের সম্পর্ক থেকে দূরে
থাকতে হবে।
দুইঃ
এ
কঠোরতা ও যুদ্ধ করার যে হুকুম দেয়া হচ্ছে, এর
অর্থ এ নয় যে, তাদের প্রতি কঠোর হবার ব্যাপারে নৈতিকতা ও
মানবিকতার সমস্ত সীমারেখা ভেংগে ফেলতে হবে। সমস্ত কাজে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা অটুট রাখার দায়িত্ব
অবশ্যি মানুষের ওপর বর্তায়। মানুষ যদি তা পরিত্যাগ করে তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে, আল্লাহও
তাকে পরিত্যাগ করবে।
﴿وَإِذَا
مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَٰذِهِ إِيمَانًا
ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ﴾
১২৪। যখন কোন
নতুন সূরা নাযিল হয় তখন তাদের কেউ কেউ (ঠাট্রা করে মুসলমানদের) জিজ্ঞেস করে, বলো, এর ফলে তোমাদের কার ঈমান বেড়ে
গেছে? (এর জবাব
হচ্ছে) যারা ঈমান এনেছে (প্রত্যেকটি অবতীর্ণ সুরা) যথার্থই ঈমান বাড়িয়েই দিয়েছে
এবং তারা এর ফলে আনন্দিত।
﴿وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم
مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَىٰ رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ﴾
১২৫। তবে যাদের
অন্তরে (মুনাফিকী) রোগ বাসা বেঁধেছিল তাদের পূর্ব কলুষতার ওপর (প্রত্যেকটি নতুন
সূরা) আরো একটি কলুষতা বাড়িয়ে দিয়েছে১২৪ এবং তারা
মৃত্যু পর্যন্ত কুফরীতে লিপ্ত রয়েছে।
১২৪. ঈমান, কুফরী, ও মুনাফিকীর মধ্যে কম-বেশী
হওয়ার অর্থ কি? এর আলোচনা দেখুন সূরা আনফালের ২ টীকায়।
﴿أَوَلَا
يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ فِي كُلِّ عَامٍ مَّرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لَا
يَتُوبُونَ وَلَا هُمْ يَذَّكَّرُونَ﴾
১২৬। এরা কি
দেখে না, প্রতি বছর
এদেরকে দুএকটি পরীক্ষার মুখোমুখি করা হয়?১২৫ কিন্তু এরপরও এরা তাওবাও করে
না কোন শিক্ষাও গ্রহণ করে না।
১২৫. অর্থাৎ এমন কোন বছর অতিবাহিত হয় না যখন তাদের ঈমানের দাবী
এক দুবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না এবং এভাবে তার অন্তসারশূন্যতা প্রকাশ হয়ে যায় না। কখনো কুরআনে এমন কোন হুকুম আসে যার মাধ্যমে
তাদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির আশা আকাংখার ওপর কোন নতুন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। কখনো দীনের এমন কোন দাবী সামনে এসে যায় যার
ফলে তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। কখনো এমন কোন আভ্যন্তরীণ, সংকট সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে তারা নিজেদের পার্থিব সম্পর্ক
এবং নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোত্রীয় স্বার্থের মোকাবিলায়
আল্লাহর ও তার রসূলের দীনকে কি পরিমাণ ভালবাসে তার পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য হয়। কখনো এমন কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয় যার মাধ্যমে
তারা যে দীনের ওপর ঈমান আনার দাবী করছে তার জন্য ধন, প্রাণ,
সময়
ও শ্রম ব্যয় করতে তারা কতটুকু আগ্রহী তার পরীক্ষা হয়ে যায়। এ ধরনের সকল অবস্থায় কেবল তাদের মিথ্যা অংগীকারের মধ্যে যে
মুনাফিকীর আবর্জনা চাপা পড়ে আছে তা শুধু উন্মুক্ত হয়ে সামনে চলে আসে না বরং যখন
তারা ঈমানদের দাবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পালাতে থাকে তখন তাদের ভেতরের ময়লা
আবর্জনা আগের চাইতে আরো বেশী বেড়ে যায়।
﴿وَإِذَا
مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ نَّظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ هَلْ يَرَاكُم مِّنْ أَحَدٍ
ثُمَّ انصَرَفُوا ۚ صَرَفَ اللَّهُ قُلُوبَهُم بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَفْقَهُونَ﴾
১২৭। যখন কোন
সূরা নাযিল হয়, এরা চোখের
ইশারায় একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের কেউ দেখতে পায়নি তো? তারপর চুপে চুপে সরে পড়ে।১২৬ আল্লাহ
তাদের মন বিমুখ করে দিয়েছেন কারণ তারা এমন একদল লোক যাদের বোধশক্তি নেই।১২৭
১২৬. নিয়ম ছিল, কোন সূরা নাযিল হওয়ার সাথে
সাথেই নবী সা. মুসলমানদের সম্মেলন আহবান করতেন তারপর সাধারণ সভায় ভাষণের আকারে
সূরাটি পড়ে শুনাতেন। এ
ধরনের মহফিলে ঈমানদাররা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে ভাষণ শুনতেন এবং তার মধ্যে ডুবে
যেতেন। কিন্তু মুনাফিকদের ওপর এর
ভিন্নতর প্রভাব পড়তো।
হাযির হওয়ার হুকুম ছিল বলে তার হাযির হয়ে যেতো। তাছাড়া মাহফিলে শরীক না হলে তাদের মুনাফিকী প্রকাশ হয়ে
যাবে, একথা মনে করেও তারা সম্মেলনে হাযির হতো। কিন্তু এ ভাষণের ব্যাপারে তাদের মনে কোন
আগ্রহ জাগতো না। অত্যন্ত অনীহা ও বিরক্তি
সহকারে তারা সেখানে বসে থাকতো। নিজেদের উপস্থিতি গণ্য করাবার পর তাদের চিন্তা হতো, কিভাবে
দ্রুত এখান থেকে পালাবে।
তাদের এ অবস্থার চিত্র এখানে আঁকা হয়েছে।
১২৭. অর্থাৎ এ নির্বোধরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থ বুঝে না। নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে তারা গাফেল এবং
নিজেদের ভালর কথা চিন্তা করে না। তারা যে এ কুরআন ও এ পয়গম্বরের মাধ্যমে কত বড় নিয়ামত লাভ করেছে তার কোন
অনুভূতিই তাদের নেই।
নিজেদের সংকীর্ণ জগত এবং এর নিতান্ত নিম্ন পর্যায়ের কার্যকলাপের মধ্যে তারা কুয়ার
ব্যাঙের মতো ডুবে আছে।
যার ফলে যে মহা জ্ঞান ও অতি উন্নত পর্যায়ের পথনির্দেশনার বদৌলতে তারা আরবের এ মরু
প্রান্তরের সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছান্ন গর্ত থেকে বের হয়ে সমগ্র বিশ্ব মানবতার নেতা ও
সর্বাধিনায়কে পরিণত হতে পারে এবং শুধুমাত্র এ নশ্বর দুনিয়াতেরই নয় বরং পরবর্তী
অনন্তকালীণ অবিনশ্বর জীবনেও চিরন্তন সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়, সেই
জ্ঞান ও শিক্ষার মূল্য ও মর্যাদা তারা বুঝতে পারে না। এ অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে আল্লাহ
লাভবান হবার সুযোগ থেকে তাদেরকে বঞ্ঝিত করেছেন। যখন কল্যাণ ও সাফল্য এবং শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের এ সম্পদ
বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে এবং সৌভাগ্যবানরা দুহাতে তা লুটতে থাকে তখন এ
দুর্ভাগাদের মন অন্য কোন দিকে বাধা পড়ে। এবং এ অবসরে কত বড় মহামূল্যবান সম্পদ থেকে যে তারা বঞ্চিত
হয়ে গেছে তা তারা ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারে না।
﴿لَقَدْ
جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم
بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾
১২৮। দেখো, তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের
মধ্য থেকে একজন রসূল। তোমাদের ক্ষতির সম্মুখীন
হওয়া তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের কল্যাণকামী। মুমিনদের
প্রতি সে স্নেহশীল ও করুণাসিক্ত।
﴿فَإِن تَوَلَّوْا فَقُلْ
حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ
الْعَظِيمِ﴾
১২৯।-এখন যদি
তারা তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট
তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আমি তার ওপরই ভরসা করেছি এবং
তিনি মহা আরশের অধিপতি”।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।