০২৪. সূরা আন নূর
আয়াতঃ ১১৮; রুকুঃ ০৬; মাক্কী
ভূমিকা
নামকরণঃ
পঞ্চম রুকূ’র প্রথম আয়াত اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ থেকে
সূরা নাম গৃহীত হয়েছে।
নাযিলের সময়-কালঃ
এ সূরাটি যে বনীল মুস্তালিক যুদ্ধের সময় নাযিল হয়, এ বিষয়ে সবাই একমত। কুরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে
মিথ্যাচারের ঘটনা প্রসঙ্গে এটি নাযিল হয়। (দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকু’তে এ ঘটনাটি বিস্তৃতভাবে বর্ণিত
হয়েছে। আর সমস্ত নির্ভরযোগ্য
বর্ণনা অনুযায়ী বনীল মুস্তালিক যুদ্ধের সফরের মধ্যে এ ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু এ যুদ্ধটি ৫ হিজরি সনে আহযাব যুদ্ধের
আগে, না ৬
হিজরিতে আহযাব যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয় সে ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা যায়। আসল ঘটনাটি কি? এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের
প্রয়োজন এ জন্য দেখা দিয়েছে যে, পর্দার বিধান কুরআন মজীদের
দু’টি সূরাতেই বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি সূরা হচ্ছে এটি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সূরা আহযাব। আর আহযাব যুদ্ধের সময় সূরা আহযাব নাযিল হয় এ
ব্যাপারে কারোর দ্বিমত নেই। এখন যদি আহযাব যুদ্ধ প্রথমে হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, পর্দার বিধানের সূচনা হয় সূরা
আহযাবে নাযিলকৃত নির্দেশসমূহের মাধ্যমে এবং তাকে পূর্ণতা দান করে এ সূরায় বর্ণিত নির্দেশগুলো। আর যদি বনীল মুস্তালিক যুদ্ধ প্রথমে হয়ে থাকে
তাহলে বিধানের বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সূচনা সূরা নূর থেকে এবং তার পূর্ণতা সূরা
আহযাবে বর্ণিত বিধানের মাধ্যমে বলে মেনে নিতে হয়। এভাবে হিজাব বা পর্দার বিধানে ইসলামী আইন ব্যবস্থার যে
যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে তা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ উদ্দেশ্যে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আগে নাযিলের
সময়কালটি অনুসন্ধান করে বের করে নেয়া জরুরী মনে করি।
ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন বনীল মুস্তালিক যুদ্ধ হিজরী ৫ সনের শাবান মাসে অনুষ্ঠিত
হয় এবং তারপর ঐ বছরেরই যিলকাদ মাসে সংঘটিত হয় আহযাব (বা খন্দক) যুদ্ধ। এর সমর্থনে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে
মিথ্যাচারের ঘটনা প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা রা. থেকে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর
কোন কোনটিতে হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ রা. ও হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের রা. বিবাদের কথা
পাওয়া যায়। আর সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস
অনুযায়ী হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের ইন্তিকাল হয় বনী কুরাইযা যুদ্ধে। আহযাব যুদ্ধের পরপরই এ যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয়। কাজেই ৬ হিজরীতে তাঁর উপস্থিত থাকার কোন
সম্ভাবনাই নেই।
অন্যদিকে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, আহযাব যুদ্ধ ৫ হিজরির শাওয়াল মাসের ঘটনা
এবং বনীল মুস্তালিকের যুদ্ধ হয় ৬ হিজরির শাবান মাসে। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা রা. ও অন্যান্য লোকদের থেকে যে
অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো এর সমর্থন করে। সেগুলো থেকে জানা যায়, মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পূর্বে হিজাব বা
পর্দার বিধান নাযিল হয় আর এ বিধান পাওয়ার যায় সূরা আহযাবে। এ থেকে জানা যায়, সে সময় হযরত যয়নবের রা. সাথে
নবী সা. এর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং এ বিয়ে ৫ হিজরির যিলকদ মাসের ঘটনা। সূরা আহযাবে এ ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া এ হাদীসগুলো থেকে একথাও জানা যায় যে, হযরত যয়নবের রা. বোন হাম্না
বিনতে জাহশ হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ানোয় শুধুমাত্র এজন্য অংশ নিয়েছিলেন
যে, হযরত আয়েশা তাঁর বোনের সতিন ছিলেন। আর একথা সুস্পষ্ট যে, বোনের সতিনের বিরুদ্ধে এ ধরনের
মনোভাব সৃষ্টি হবার জন্য সতিনী সম্পর্ক শুরু হবার পর কিছুকাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার
প্রয়োজন হয়। এসব সাক্ষ্য ইবনে ইসহাকের
বর্ণনাকে শক্তিশালী করে দেয়।
মিথ্যাচারের ঘটনার সময় হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের রা. উপস্থিতির বর্ণনা থাকাটাই এ
বর্ণনাটি মেনে নেবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ ঘটনা প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা রা. থেকে যেসব হাদিস
বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের কথা বলা হয়েছে আবার কোনটিতে বলা
হয়েছে তাঁর পরিবর্তে হযরত উসাইদ ইবনে হুদ্বাইরের রা. কথা, এ জিনিসটিই এ সংকট দূর করে দেয়। আর এ দ্বিতীয় বর্ণনাটি এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা
বর্ণিত অন্যান্য ঘটনাবলীর সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। অন্যথায় নিছক সা’দ ইবনে মু’আযের জীবনকালের সাথে খাপ
খাওয়াবার জন্য যদি বনীল মুস্তালিক যুদ্ধ ও মিথ্যাচারের কাহিনীকে আহযাব ও কুরাইযা
যুদ্ধের আগের ঘটনা বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে তো হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়া ও যয়নবের
রা. বিয়ের ঘটনা তার পূর্বে সংঘটিত হওয়া উচিত ছিল। এ অবস্থায় এ জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচন করা কোনক্রমেই সম্ভব
হয় না। অথচ কুরআন ও অসংখ্য সহীহ
হাদীস উভয়ই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যয়নবের রা. বিয়ে ও হিজাবের হুকুম আহ্যাব ও কুরাইযার পরবর্তী
ঘটনা। এ কারণেই ইবনে হাযম ও ইবনে
কাইয়েম এবং অন্য কতিপয় গবেষক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনাকেই সঠিক গণ্য করেছেন
এবং আমরাও একে সঠিক মনে করি।
ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
এখন অনুসন্ধানের মাধ্যমে একথা প্রমাণিত হবার পর যে, সূরা নূর ৬ হিজরির শেষার্ধে
সূরা আহ্যাবের কয়েক মাস পর নাযিল হয়, যে অবস্থায় এ সূরাটি
নাযিল হয় তার ওপর আমাদের একটু নজর বুলিয়ে নেয়া উচিত। বদর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর আরবে ইসলামী আন্দোলনের যে উত্থান
শুরু হয় খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই তা এত বেশী ব্যাপকতা লাভ করে যার
ফলে মুশরিক, ইহুদী, মুনাফিক ও দোমনা সংশয়ী নির্বিশেষে সবাই একথা
অনুভব করতে থাকে যে, এ নব উত্থিত শক্তিটিকে শুধুমাত্র অস্ত্র
ও সমর শক্তির মাধ্যমে পরাস্ত করা যেতে পারে না। খন্দকের যুদ্ধে তারা এক জোট হয়ে দশ হাজার সেনা নিয়ে মদীনা
আক্রমণ করেছিল। কিন্তু মদীনা উপকণ্ঠে এক
মাস ধরে মাথা কুটবার পর শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চলে যায়। তাদের ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই নবী সা. ঘোষণা
করে দেনঃ
لَنْ تَغْزُوْكُمْ قُرَيشِ بَعْدَ عَامِكُمْ هَذَا
وَلَاكِنَّكُمْ تَغْزُوْنَهُمْ
“এ বছরের পর কুরাইশরা আর তোমাদের ওপর হামলা করবে না বরং তোমরা তাদের ওপর
হামলা করবে।” (ইবনে হিশাম ২৬৬ পৃষ্ঠা)।
রাসূল সা. এর এ উক্তি দ্বারা প্রকারান্তরে একথাই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির অগ্রগতির
ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এবার থেকে ইসলাম আর আত্মরক্ষার নয়
বরং অগ্রগতির লড়াই লড়বে এবং কুফরকে অগ্রগতির পরিবর্তে আত্মরক্ষার লড়াই লড়তে হবে। এটি ছিল অবস্থার একেবারে সঠিক ও বাস্তব
বিশ্লেষণ। প্রতিপক্ষও ভালোভাবে এটা
অনুভব করছিল।
মুসলমানদের সংখ্যা ইসলামের এ উত্তরোত্তর উন্নতির আসল কারণ ছিল না। বদর থেকে খন্দক পর্যন্ত প্রত্যেক যুদ্ধে
কাফেররা তাদের চাইতে বেশী শক্তির সমাবেশ ঘটায়। অন্যদিকে জনসংখ্যার দিক দিয়েও সে সময় মুসলমানরা আরবে বড়
জোর ছিল দশ ভাগের এক ভাগ।
মুসলমানদের উন্নত মানের অস্ত্র-সম্ভারও এ উন্নতির মূল কারণ ছিল না। সব ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র ও যুদ্ধের
সাজ-সরঞ্জামে কাফেরদের পাল্লা ভারী ছিল। অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক দিয়েও তাদের
সাথে মুসলমানদের কোন তুলনাই ছিল না। কাফেরদের কাছে ছিল সমস্ত আরবের আর্থিক উপায়-উপকরণ। অন্যদিকে মুসলমানরা অনাহারে মরছিল। কাফেরদের পেছনে ছিল সমগ্র আরবের মুশরিক সমাজ ও আহলি কিতাব
গোত্রগুলো। অন্যদিকে মুসলমানরা একটি
নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে পুরাতন ব্যবস্থার সকল সমর্থকের
সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। এহেন অবস্থায় যে জিনিসটি মুসলমানদের ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
সেটি ছিল আসলে তাদের চারিত্রিক ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব। ইসলামের সকল শত্রুদলই এটা অনুভব করছিল। একদিকে তারা দেখছিল নবী সা. ও সাহাবায়ে
কেরামের নির্মল নিষ্কলুষ চরিত্র। এ চরিত্রের পবিত্রতা, দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তা মানুষের হৃদয় জয় করে চলছে। অন্যদিকে তারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল ব্যক্তিগত ও
সামষ্টিক নৈতিক পবিত্রতা মুসলমানদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সংহতি সৃষ্টি করে
দিয়েছে এবং এর সামনে মুশরিকদের শিথিল সামাজিক ব্যবস্থাপনা যুদ্ধ ও শান্তি উভয়
অবস্থায়ই পরাজয় বরণ করে চলছে।
নিকৃষ্ট স্বভাবের লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তাদের চোখে যখন অন্যের গুণাবলী
ও নিজেদের দুর্বলতাগুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে এবং তারা এটাও যখন বুঝতে পারে যে,
প্রতিপক্ষের সৎগুণাবলী তাকে এগিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের নিজেদের
দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে প্রতিপক্ষের গুণাবলীর আয়ত্ব করে নেবার চিন্তা জাগে না,
বরং তারা চিন্তা করতে থাকে যেভাবেই হোক নিজেদের অনুরূপ দুর্বলতা তার
মধ্যেও ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর এটা সম্ভব না হলে কমপক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালাতে হবে, যাতে জনগণ বুঝতে পারে যে,
প্রতিপক্ষের যত গুণই থাক, সেই সাথে তাদের কিছু
না কিছু দোষ-ত্রুটিও আছে। এ হীন মানসিকতাই ইসলামের শত্রুদের কর্মতৎপরতার গতি সামরিক কার্যক্রমের দিক
থেকে সরিয়ে নিকৃষ্ট ধরনের নাশকতা ও আভ্যন্তরীণ গোলযোগ সৃষ্টির দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। আর যেহেতু এ কাজটি বাইরের শত্রুদের তুলনায়
মুসলমানদের ভেতরের মুনাফিকরা সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারতো তাই পরিকল্পিতভাবে বা
পরিকল্পনা ছাড়াই স্থিরীকৃত হয় যে, মদীনার মুনাফিকরা ভেতর থেকে গোলমাল পাকাবে এবং ইহুদী ও
মুশরিকরা বাইর থেকে তার ফলে যত বেশি পারে লাভবান হবার চেষ্টা করবে।
৫ হিজরি যিলকদ মাসে ঘটে এ নতুন কৌশলটির প্রথম আত্মপ্রকাশ। এ সময় নবী সা. আরব থেকে পালক পুত্র (অন্যের পুত্রকে নিজের পুত্র বানিয়ে নেয়া এবং
পরিবারের মধ্যে তাকে পুরোপুরি ঔরশজাত সন্তানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা) সংক্রান্ত জাহেলী রীতি
নির্মূল করার জন্য নিজেই নিজের পালক পুত্রের [যায়েদ রা. ইবনে হারেসা] তালাক দেয়া
স্ত্রীকে [যয়নব রা. বিনতে জাহ্শ] বিয়ে করেন। এ সময় মদীনার মুনাফিকরা অপপ্রচারের এক বিরাট তাণ্ডব সৃষ্টি
করে। বাইর থেকে ইহুদী ও
মুশরিকরাও তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে মিথ্যা অপবাদ রটাতে শুরু করে। তারা অদ্ভূত অদ্ভূত সব গল্প তৈরী করে চারদিকে
ছড়িয়ে দিতে থাকে। যেমন, মুহাম্মাদ সা. কিভাবে তাঁর
পালক পুত্রের স্ত্রীকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান (নাউযুবিল্লাহ্) । কিভাবে পুত্র তাঁর প্রেমের খবর পেয়ে যায় এবং
তারপর নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার ওপর থেকে নিজের অধিকার প্রত্যাহার করে; তারপর কিভাবে তিনি নিজের
পুত্রবধূকে বিয়ে করেন। এ গল্পগুলো এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, মুসলমানরাও এগুলোর প্রভাবমুক্ত
থাকতে পারেনি। এ
কারণে মুহাদ্দিস ও মুফাস্সিরদের একটি দল হযরত যয়নব ও যায়েদের সম্পর্কে যে হাদীস
বর্ণনা করেছেন সেগুলো মধ্যে আজো ঐসব মনগড়া গল্পের অংশ পাওয়া যায়। পশ্চিমের প্রাচ্যবিদরা খুব ভালো করে লবণ মরিচ
মাখিয়ে নিজেদের বইতে এসব পরিবেশন করেছেন। অথচ হযরত যয়নব রা. ছিলেন নবী সা. এর আপন ফুফুর (উমাইমাহ
বিনতে আবদুল মুত্তালিব) মেয়ে। তাঁর সমগ্র শৈশব থেকে যৌবনকাল নবী সা. এর চোখের সামনে অতিবাহিত হয়েছিল। তাঁকে ঘটনাক্রমে একদিন দেখে নেয়া এবং
নাউযুবিল্লাহ্ তাঁর প্রেমে পড়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই দেখা দেয় না। আবার এ ঘটনার মাত্র এক বছর আগে নবী সা. নিজেই
চাপ দিয়ে তাঁকে হযরত যায়েদকে রা. বিয়ে করতে বাধ্য করেন। তাঁর ভাই আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহ্শ এ বিয়েতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। হযরত যয়নব রা. নিজেও এতে রাজী ছিলেন না। কারণ কুরাইশদের এক শ্রেষ্ঠ অভিজাত পরিবারের
মেয়ে একজন মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামের পত্নী হওয়াকে স্বভাবতই মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু নবী সা. কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্যে
সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সূচনা নিজের পরিবার থেকে শুরু করার জন্যই হযরত যয়নবকে রা.
এ বিয়েতে রাজী হতে বাধ্য করেন। এসব কথা বন্ধু ও শত্রু সবাই জানতো। আর এ কথাও সবাই জানতো, হযরত যয়নবের বংশীয় আভিজাত্যবোধই তাঁর ও
যায়েদ ইবনে হারেসার মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক স্থায়ী হতে দেয়নি এবং শেষ পর্যন্ত
তালাক হয়ে যায়।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও নির্লজ্জ মিথ্যা অপবাদকারীরা নবী সা. এর ওপর জঘন্য ধরনের
নৈতিক দোষারোপ করে এবং এত ব্যাপক আকারে সেগুলো ছড়ায় যে, আজো পর্যন্ত তাদের এ মিথ্যা
প্রচারণার প্রভাব দেখা যায়।
এরপর দ্বিতীয় হামলা করা হয় বনীল মুস্তালিক যুদ্ধের সময়। প্রথম হামলার চাইতে এটি ছিল বেশী মারাত্মক। বনীল মুস্তালিক গোত্রটি বনী খুযা’আর একটি শাখা
ছিল। তারা বাস করতো লোহিত সাগর
উপকূলে জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে কুদাইদ এলাকায়। যে ঝর্ণাধারাটির আশপাশে এ উপজাতীয় লোকেরা বাস করতো তার নাম
ছিল মরাইসী। এ কারণে হাদীসে এ যুদ্ধটিকে
মুরাইসী’র যুদ্ধও বলা হয়েছে। চিত্রের মাধ্যমে তাদের সঠিক অবস্থানস্থল জানা যেতে পারে।
৬ হিজরির শাবান মাসে নবী সা. খবর পান, তারা মুসলমানদের ওপর হামলার প্রস্তুতি
নিচ্ছে এবং অন্যান্য উপজাতিকেও একত্র করার চেষ্টা করছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি ষড়যন্ত্রটিকে
অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেবার জন্য একটি সেনাদল নিয়ে সেদিকে রওয়ানা হয়ে যান। এ অভিযানে আবুদল্লাহ্ ইবনে উবাইও বিপুল সংখ্যক
মুনাফিকদের নিয়ে তাঁর সহযোগী হয়। ইবনে সা’দের বর্ণনা মতে, এর আগে কোন যুদ্ধেই মুনাফিকরা এত বিপুল সংখ্যায় অংশ নেয়নি। মুরাইসী নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ সা. হঠাৎ
শত্রুদের মুখোমুখি হন।
সামান্য সংঘর্ষের পর যাবতীয় সম্পদ-সরঞ্জাম সহকারে সমগ্র গোত্রটিকে গ্রেফতার করে
নেন। এ অভিযান শেষ হবার পর তখনো
মুরাইসীতেই ইসলামী সেনাদল অবস্থান করছিল এমন সময় একদিন হযরত উমরের রা. একজন
কর্মচারী (জাহ্জাহ ইবনে মাসউদ গিফারী) এবং খাযরাজ গোত্রের একজন সহযোগীর (সিনান
ইবনে ওয়াবর জুহানী) মধ্যে পানি নিয়ে বিরোধ বাধে। একজন আনসারদেরকে ডাকে এবং অন্যজন মুহাজিরদেরকে ডাক দেয়। উভয় পক্ষ থেকে লোকেরা একত্র হয়ে যায় এবং
ব্যাপারটি মিটমাট করে দেয়া হয়। কিন্তু আনসারদের খাযরাজ গোত্রের সাথে সম্পর্কিত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তিলকে
তাল করে দেয়। সে আনসারদেরকে একথা বলে
উত্তেজিত করতে থাকে যে, “এ মুহাজিররা আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে
দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং এ কুরাইশী
কাঙালদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, কুকুরকে লালন পালন করে বড় করো যাতে সে তোমাকেই কামড়ায়। এসব কিছু তোমাদের নিজেদেরই কর্মফল। তোমরা নিজেরাই তাদেরকে ডেকে এনে নিজেদের
এলাকায় জায়গা দিয়েছো এবং এবং নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে তাদেরকে অংশীদার বানিয়েছো। আজ যদি তোমরা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও
তাহলে দেখবে তারা পগার পার হয়ে গেছে।” তারপর সে কসম খেয়ে বলে, “মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা সম্পন্ন
তারা দ্বীন-হীন-লাঞ্ছিতদেরকে বাইরে বের করে দেবে।” (সূরা মুনাফিকুনে আল্লাহ নিজেই তার এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন) তার এসব কথাবার্তার খবর
নবী সা. এর কাছে পৌঁছলে হযরত উমর রা. তাঁকে পরামর্শ দেন, এ ব্যক্তিকে হত্যা করা হোক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ فَكَيْفَ يَا عُمَرُ اِذَا تَحَدَّثُ النَّاسُ
أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ (হে উমর! দুনিয়ার লোকেরা কি বলবে? তারা বলবে, মুহাম্মাদ সা. তাঁর নিজেরই সঙ্গী-সাথীদেরকে হত্যা করছে।) তারপর তিনি তখনই সে স্থান থেকে রওয়ানা হবার
হুকুম দেন এবং দ্বিতীয় দিন দুপুর পর্যন্ত কোথাও থামেননি, যাতে লোকেরা খুব বেশী ক্লান্ত
হয়ে পড়ে এবং কারোর এক জায়গায় বসে গল্পগুজব করার এবং অন্যদের তা শোনার অবকাশঘ না
থাকে। পথে উসাইদ ইবনে হুদ্বাইর রা.
বলেন, “হে আল্লাহর
নবী! আজ আপনি নিজের স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে অসময়ে রওয়ানা হবার হুকুম দিয়েছেন?
তিনি জবাব দেন, “তুমি শোননি তোমাদের সাথী কিসব
কথা বলছে?” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “কোন
সাথী?” জবাব দেন, “আবদুল্লাহ্ ইবনে
উবাই।” তিনি বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ব্যক্তির
কথা বাদ দিন।
আপনি যখন মদীনায় আগমন করেন তখন আমরা তাকে নিজেদের বাদশাহ বানাবার ফায়সালা করেই
ফেলেছিলাম এবং তার জন্য মুকুট তৈরী হচ্ছিল। আপনার আগমনের ফলে তার বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। তারই ঝাল সে ঝাড়ছে”।
এ হীন কারসাজির রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। এরই মধ্যে একই সফরে সে আর একটি ভয়াবহ অঘটন ঘটিয়ে বসে। এ এমন পর্যায়ের ছিল যে, নবী সা. এবং তাঁর নিবেদিত
প্রাণ সাহাবীগণ যদি পূর্ণ সংযম ধৈর্যশীলতা এবং জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না
দিতেন তাহলে মদীনার এ নবগঠিত মুসলিম সমাজটিতে ঘটে যেতো মারাত্মক ধরনের গৃহযুদ্ধ। এটি ছিল হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে মিথ্যা
অপবাদের ফিত্না। এ ঘটনার বিবরণ হযরত আয়েশার
মুখেই শুনুন। তাহলে যথার্থ অবস্থা জানা
যাবে। মাঝখানে যেসব বিষয় ব্যাখ্যা
সাপেক্ষ হবে সেগুলো আমি অন্যান্য নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে ব্র্যাকেটের মধ্যে
সন্নিবেশিত করে যেতে থাকবো। এর ফলে হযরত আয়েশার রা. বর্ণনার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে না। তিনি বলেনঃ
“রাসূলুল্লাহ সা. এর নিয়ম ছিল, যখনই তিনি সফরে যেতেন
তখনই স্ত্রীদের মধ্য থেকে কে তাঁর সঙ্গে যাবে তা ঠিক করার জন্য লটারী করতেন।”
(এ
লটারীর ধরনটি প্রচলিত লটারীর মতো ছিলো না। আসলে সকল স্ত্রীর অধিকার সমান ছিল। তাদের একজনকে অন্যজনের প্রাধান্য দেবার কোন
যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল না। এখন যদি নবী সা. নিজেই কাউকে বেছে নিতেন তাহলে স্ত্রীরা
মনে ব্যাথা পেতেন এবং এতে পারস্পরিক রেষারেষি ও বিদ্বেষ সৃষ্টির আশংকা থাকতো। তাই তিনি লটারীর মাধ্যমে এর ফায়সালা করতেন। শরীয়াতে এমন অবস্থার জন্য লটারীর ব্যবস্থা
রাখা হয়েছে। যখন কতিপয় লোকের বৈধ
অধিকার হয় একেবারে সমান সমান এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে অন্যজনের ওপর অগ্রাধিকার
দেবার কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকে না অথচ অধিকার কেবল মাত্র একজনকে দেয়া যেতে পারে।)
বনীল মুস্তালিক যুদ্ধের সময় লটারীতে আমার নাম ওঠে। ফলে আমি তাঁর সাথী হই। ফেরার সময় আমরা যখন মদীনার কাছাকাছি এসে গেছি তখন এক
মনযিলে রাত্রিকালে নবী সা. কাফেলার যাত্রা বিরতি করেন। এদিকে রাত পোহাবার তখনো কিছু সময় বাকি ছিল এমন সময় রওয়ানা
দেবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আমি উঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য যাই। ফিরে আসার সময় অবস্থান স্থলের কাছাকাছি এসে মনে হলো আমার
গলার হারটি ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে। আমি তার খোঁজে লেগে যাই। ইত্যবসরে কাফেলা রওয়ানা হয়ে যায়। নিয়ম ছিল, রওয়ানা হবার সময় আমি নিজের হাওদায় বসে যেতাম এবং চারজন লোক মিলে সেটি
উঠিয়ে উটের পিঠে বসিয়ে দিতো। সে যুগে আমরা মেয়েরা কম খাবার কারণে বড়ই হালকা পাতলা হতাম। আমার হাওদা উঠাবার সময় আমি যে তার মধ্যে নেই
একথা লোকেরা অনুভবই করতে পারেনি। তারা না জেনে খালি হাওদাটি উঠিয়ে উটের পিঠে বসিয়ে দিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। আমি হার নিয়ে ফিরে এসে দেখি সেখানে কেউ নেই। কাজেই নিজের চাদর মুড়ি দিয়ে আমি সেখানেই শুয়ে
পড়ি। মনে মনে ভাবি, সামনের দিকে গিয়ে আমাকে হাওদার
মধ্যে না পেয়ে তারা নিজেরাই খুঁজতে খুঁজতে আবার এখানে চলে আসবে। এ অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল সালামী আমি যেখানে
শুয়ে ছিলাম সেখানে দিয়ে যেতে থাকেন। তিনি আমাকে দেখতেই চিনে ফেলেন। কারণ পর্দার হুকুম নাযিল হবার পূর্বে তিনি আমাকে বহুবার দেখেন। (তিনি ছিলেন একজন বদরী সাহাবী। সকালে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকা ছিল তাঁর
অভ্যাস।
(আবু
দাউদ ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থে এ আলোচনা এসেছে, তাঁর স্ত্রী, নবী সা.
এর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেন যে, তিনি কখনো ফজরের নামায
যথা সময় পড়েন না। তিনি ওজর পেশ করেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এটা আমার পারিবারিক রোগ। সকালে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার এ
দুর্বলতাটি আমি কিছুতেই দূর করতে পারি না। একথায় রসূলূল্লাহ্ সা. বলেনঃ ঠিক আছে, যখনই ঘুম ভাঙবে, সঙ্গে সঙ্গে নামাজ পড়ে নিবে। কোন কোন মুহাদ্দিস তাঁর কাফেলার পেছনে থেকে
যাওয়ার এ কারণ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস এর কারণ বর্ণনা করে বলেন, রাতের অন্ধকারে রওয়ানা হবার
কারণে যদি কারোর কোন জিনিস পেছনে থেকে গিয়ে থাকে তাহলে সকালে তা খুঁজে নিয়ে আসার
দায়িত্ব নবী সা. তাঁর ওপর অর্পণ করেছিলেন।)
তাই তিনিও সেনা শিবিরের কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং এখন ঘুম থেকে উঠে মদীনার
দিকে রওয়ানা দিয়েছিলেন।)
আমাকে দেখে তিনি উট থামিয়ে নেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ
رَاجِعُونَ “রাসূলুল্লাহ সা. এর স্ত্রী এখানে রয়ে গেছেন।” তাঁর এ আওয়াজে আমার চোখ খুলে যায় এবং আমি উঠে সঙ্গে
সঙ্গেই আমার মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে নিই। তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি, সোজা তাঁর উটটি এনে আমার কাছে বসিয়ে দেন
এবং নিজে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাই এবং তিনি উটের রশি ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। দুপুরের কাছাকাছি সময়ে আমরা সেনাবাহিনীর সাথে
যোগ দেই। সে সময় সেনাদল এক জায়গায়
গিয়ে সবেমাত্র যাত্রা বিরতি শুরু করেছে। তখনো তারা টেরই পায়নি আমি পেছনে রয়ে গেছি। এ ঘটনার কুচক্রীরা মিথ্যা অপবাদ রটাতে থাকে
এবং এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল সবার আগে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কিসব কথাবার্তা হচ্ছে সে ব্যাপারে
আমি ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ।
[অন্যান্য হাদীসে বলা হয়েছে, সে সময় সফওয়ানের উটের
পিঠে চড়ে হযরত আয়েশা রা. সেনা শিবিরে এসে পৌঁছেন এবং তিনি এভাবে পেছনে রয়ে
গিয়েছিলেন বলে জানা যায় তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার করে ওঠে, “আল্লাহর কসম, এ মহিলা নিষ্কলংক অবস্থায় আসেনি। নাও, দেখো তোমাদের নবীর স্ত্রী আর একজনের সাথে
রাত কাটিয়েছে এবং সে এখন তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে চলে আসছে।”]
মদীনায় পৌঁছেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং প্রায় এক মাসকাল বিছানায় পড়ে থাকি। শহরে এ মিথ্যা অপবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা. এর কানেও কথা আসতে থাকে। কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না। তবে যে জিনিসটি আমার মনে খচ্খচ্ করতে থাকে তা
হচ্ছে এই যে, অসুস্থ অবস্থায় যে রকম দৃষ্টি দেয়া দরকার রাসূলুল্লাহ সা. এর দৃষ্টি আমার
প্রতি তেমন ছিল না। তিনি ঘরে এলে ঘরের লোকদের জিজ্ঞেস করতেন كيف تيكم (ও কেমন আছে?)
নিজে আমার সাথে কোন কথা বলতেন না। এতে আমার মনে সন্দেহ হতো, নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার ঘটেছে। শেষে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি নিজের মায়ের বাড়িতে
চলে গেলাম যাতে তিনি আমার সেবা শুশ্রূষা ভালোভাবে করতে পারেন।
এক রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য আমি মদীনার বাইরে যাই। সে সময় আমাদের বাড়িঘরে এ ধরনের পায়খানার
ব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমরা পায়খানা করার জন্য
বাইরে জঙ্গলের দিকে যেতাম। আমার সাথে ছিলেন মিস্তাহ ইবনে উসামার মা। তিনি ছিলেন আমার মায়ের খালাত বোন। [অন্য হাদীস থেকে জানা যায়, তাদের সমগ্র পরিবারের ভরণপোষণ
হযরত আবু বকর সিদ্দিকের রা. জিম্মায় ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও মিস্তাহ এমন লোকদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন
যারা হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছিল।] রাস্তায় তার পায় ঠোকর লাগে এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠেনঃ “ধ্বংস হোক মিস্তাহ।” আমি বললাম, “ভালই মা দেখছি আপনি, নিজের পেটের ছেলেকে অভিশাপ দিচ্ছেন, আবার ছেলেও এমন
যে বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।” তিনি বলেন, “মা, তুমি কি তার কথা কিছুই জানো না?” তারপর তিনি গড়গড় করে সব কথা বলে যান। তিনি বলে যেতে থাকেন, মিথ্যা অপবাদদাতারা আমার বিরুদ্ধে কিসব কথা
রটিয়ে বেড়াচ্ছে।
[মুনাফিকরা ছাড়া মুসলমানদের মধ্য থেকেও যারা এ ফিতনায় শামিল হয়ে গিয়েছিল তাদের
মধ্যে মিস্তাহ, ইসলামের প্রখ্যাত কবি হাসসান ইবনে সাবেত ও হযরত যয়নবের রা. বোন হাম্না
বিনতে জাহশের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য।] এ কাহিনী শুনে আমার শরীরের রক্ত যেন শুকিয়ে গেল। যে প্রয়োজন পূরণের জন্য আমি বের হয়েছিলাম তাও
ভুলে গেলাম। সোজা ঘরে চলে এলাম। সারারাত আমার কাঁদতে কাঁদতে কেটে যায়।”
সামনের দিকে এগিয়ে হযরত আয়েশা রা. বলেনঃ “আমি চলে আসার পর রাসূলুল্লাহ সা., আলী রা. ও উসামাহ ইবনে যায়েদকে
রা. ডাকেন। তাদের কাছে পরামর্শ চান। উসামাহ রা. আমার পক্ষে ভালো কথাই বলে। সে বলে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ভালো জিনিস ছাড়া আপনার
স্ত্রীর মধ্যে আমি আর কিছুই দেখিনি। যা কিছু রটানো হচ্ছে সবই মিথ্যা ও বানোয়াট ছাড়া আর কিছুই
নয়।’ আর আলী রা. বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মেয়ের অভাব
নেই। আপনি তাঁর জায়গায় অন্য একটি
মেয়ে বিয়ে করতে পারেন। আর
যদি অনুসন্ধান করতে চান তাহলে সেবিকা বাঁদীকে ডেকে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ
করুন।’ কাজেই সেবিকাকে ডাকা হয়
এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হয়। সে বলে, ‘সে আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আমি
তাঁর মধ্যে এমন কোন খারাপ জিনিস দেখিনি যার ওপর আঙ্গুলি নির্দেশ করা যেতে পারে। তবে এতটুকু দোষ তাঁর আছে যে, আমি আটা ছেনে রেখে কোন কাজে
চলে যাই এবং বলে যাই, বিবি সাহেবা! একটু আটার দিকে খেয়াল
রাখবেন, কিন্তু তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং বকরি এসে আটা খেয়ে ফেলে।’ সেদিনই রাসূলুল্লাহ সা. খুতবায় বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! এক ব্যক্তি
আমার পরিবারের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে আমাকে অশেষ কষ্ট দিচ্ছে! তোমাদের মধ্যে কে
আছে যে, তার আক্রমণ থেকে আমার ইজ্জত বাঁচাতে পারে? আল্লাহর কসম, আমি তো আমার স্ত্রীর মধ্যেও কোন খারাপ
জিনিস দেখিনি এবং সে ব্যক্তির মধ্যেও কোন খারাপ জিনিস দেখিনি যার সম্পর্কে অপবাদ
দেয়া হচ্ছে। সে তো কখনো আমার
অনুপস্থিতিতে আমার বাড়ীতেও আসেনি।’ একথায় উসাইদ ইবনে হুদ্বাইর (কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী সা’দ ইবনে মু’আয)
(সম্ভবত
নামের ক্ষেত্রে এ বিভিন্নতার কারণ এই যে, হযরত আয়েশা রা. নাম উল্লেখ করার পরিবর্তে
আওস সরদার শব্দ ব্যবহার করে থাকবেন। কোন বর্ণনাকারী এ থেকে সা’দ ইবনে মু’আয মনে
করেছেন। কারণ নিজের জীবদ্দশায়
তিনিই ছিলেন আওস গোত্রের সরদার এবং ইতিহাসে আওস সরদার হিসেবে তিনিই বেশী পরিচিত। অথচ আসলে এ ঘটনার সময় তাঁর চাচাত ভাই উসাইদ
ইবনে হুদাইর ছিলেন আওসের সরদার।)
উঠে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি সে আমাদের গোত্রের লোক হয় তাহলে আমরা তাকে হত্যা
করবো আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজদের লোক হয় তাহলে আপনি হুকুম দিন আমরা হুকুম পালন
করার জন্য প্রস্তুত।’ একথা শুনতেই খাযরাজ প্রধান সা’দ ইবনে উবাদাহ রা. দাঁড়িয়ে যান এবং বলতে থাকেন, ‘মিথ্যা বলছো, তোমরা তাকে কখনোই হত্যা করতে পারো না। তোমরা তাকে হত্যা করার কথা শুধু এজন্যই মুখে আনছো যে সে
খাযরাজদের অন্তর্ভুক্ত।
যদি সে তোমাদের গোত্রের লোক হতো তাহলে তোমরা কখনো একথা বলতে না, আমরা তাকে হত্যা করবো।’
(** হযরত
সা’দ ইবনে উবাদাহ যদিও অত্যন্ত সৎ ও মুখলিস মুসলমান ছিলেন, তিনি
নবী সা. এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পোষণ করতেন এবং মদীনায় যাদের সাহায্যে
ইসলাম বিস্তার লাভ করে তাদের মধ্যে তিনিও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তবুও এতসব
সৎ গুণ সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে স্বজাতিপ্রীতি ও জাতীয় স্বার্থবোধ (আর আরবে সে সময়
জাতি বলতে গোত্রই বুঝাতো) ছিল অনেক বেশী। এ কারণে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমরের
পৃষ্ঠপোষকতা করেন,
যেহেতু সে ছিল তার গোত্রের লোক। এ কারণে মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর মুখ থেকে এ
কথা বের হয়ে যায়ঃ الْيَوْمُ يَوْمُ
الْمَلْحَمَةِ ، الْيَوْمَ تُسْتَحَلُّ الحرمه (আজ হত্যা ও রক্ত প্রবাহের দিন। আজ এখানে হারামকে হালাল করা হবে।) এর ফলে ক্রোধ প্রকাশ করে রাসূলুল্লাহ সা.
তাঁর কাছ থেকে সেনাবাহিনীর ঝাণ্ডা ফিরিয়ে নেন। আবার এ কারণেই তিনি রাসূলুল্লাহর সা.
ইন্তিকালের পর সাকীফায়ে বনি সায়েদায় খিলাফত আনসারদের হক বলে দাবি করেন। আর যখন তাঁর কথা অগ্রাহ্য করে আনসার ও
মুহাজির সবাই সম্মিলিতভাবে হযরত আবু বকরের রা. হাতে বাইআত করেন তখন তিনি একাই
বাই’আত করতে অস্বীকার করেন। আমৃত্যু তিনি কুরাইশী খলীফায় খিলাফত স্বীকার করেননি। (দেখুন আল ইসাবাহ লিইবনে হাজার এবং আল
ইসতিআব লিইবনে আবদিল বার এবং সা’দ ইবনে উবাদাহ অধ্যায়, পৃষ্টা ১০-১১)
উসাইদ ইবনে হুদাইর জবাব দেন, ‘তুমি মুনাফিক, তাই মুনাফিকদের প্রতি
সমর্থন জানাচ্ছো।’
একথায় মসজিদে নববীতে একটি হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়। অথচ রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরে বসে ছিলেন। মসজিদের মধ্যেই আওস ও খাযরাজের লড়াই বেধে
যাবার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে শান্ত করেন এবং তারপর তিনি
মিম্বার থেকে নেমে আসেন।”
হযরত আয়েশার রা. অবশিষ্ট কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ আমি এতদসংক্রান্ত আয়াতের
ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণনা করবো যেখানে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁর ত্রুটি মুক্তির কথা
ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে আমি যা কিছু বলতে চাই
তা হচ্ছে এই যে, আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই এ অপবাদ রটিয়ে একই গুলীতে কয়েকটি পাখি শিকার করার
প্রচেষ্টা চালায়।
একদিকে সে রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকর সিদ্দীকের রা. ইজ্জতের ওপর হামলা চালায়
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের উন্নততর নৈতিক মর্যাদা ও চারিত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ
করার চেষ্টা করে। তৃতীয় সে এর মাধ্যমে এমন
একটি অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে যে, যদি ইসলাম তার অনুসারীদের জীবন ও চরিত্র
সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে না ফেলে থাকতো তাহলে মুহাজির ও আনসার এবং স্বয়ং আনসারদেরই
দু’টি গোত্র পরস্পর লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যেতো।
বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় বিষয়ঃ
এ ছিল সে সময়কার পরিস্থিতি। এর মধ্যে প্রথম হামলার সময় সূরা আহযাবের শেষ ৬টি রুকু’ নাযিল হয় এবং দ্বিতীয়
হামলার সময় নাযিল হয় সূরা নূর। এ পটভূমি সামনে রেখে এ দু’টি সূরা পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করলে এ বিধানগুলোর
মধ্যে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিহিত রয়েছে তা ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়।
মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে এমন এক ময়দানে পরাজিত করতে চাচ্ছিল যেটা ছিল তাদের
প্রাধান্যের আসল ক্ষেত্র।
আল্লাহ তাদের চরিত্র হননমূলক অপবাদ রটনার অভিযানের বিরুদ্ধে একটি ক্রুদ্ধ ভাষণ
দেবার বা মুসলমানদেরকে পাল্টা আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে মুসলমানদেরকে এ
শিক্ষা দেবার প্রতি তাঁর সার্বিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন যে, তোমাদের নৈতিক অঙ্গনে যেখানে
যেখানে শূন্যতা রয়েছে সেগুলো পূর্ণ কর এবং এ অঙ্গনকে আরো বেশী শক্তিশালী করো। একটু আগেই দেখা গেছে যয়নবের রা. বিয়ের সময়
মুনাফিক ও কাফেররা কী হাঙ্গামাটাই না সৃষ্টি করেছিল। অথচ সূরা আহ্যাব বের করে পড়লে দেখা যাবে সেখানে ঠিক সে
হাঙ্গামার যুগেই সামাজিক সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত নির্দেশগুলো দেয়া হয়ঃ
একঃ নবী করীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণকে হুকুম দেয়া হয়ঃ নিজেদের
গৃহমধ্যে মর্যাদা সহকারে বসে থাকো, সাজসজ্জা করে বাইরে বের হয়ো না এবং ভিন
পুরুষদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে বিনম্র স্বরে কথা বলো না, যাতে কোন ব্যক্তি কোন অবাঞ্ছিত আশা পোষণ না করে বসে। (৩২ ও ৩৩ আয়াত)
দুইঃ নবী করীমের সা. গৃহে ভিন পুরুষদের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ
বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নির্দেশ দেয়া হয়, তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইতে হলে
পর্দার আড়াল থেকে চাইতে হবে। (৫৩ আয়াত)
তিনঃ গায়ের মাহ্রাম পুরুষ ও মাহ্রাম আত্মীয়দের মধ্যে পার্থক্য
সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হুকুম দেয়া হয়েছে নবীর সা. পবিত্র স্ত্রীদের কেবলমাত্র
মাহ্রাম আত্মীয়রাই স্বাধীনভাবে তাঁর গৃহে যাতায়াত করতে পারবেন। (৫৫ আয়াত)
চারঃ মুসলমানদেরকে বলে দেয়া হয়, নবীর স্ত্রীগণ তোমাদের মা এবং
একজন মুসলমানের জন্য তাঁরা চিরতরে ঠিক তার আপন মায়ের মতই হারাম । তাই তাঁদের সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলমানের নিয়ত
একদম পাক-পবিত্র থাকতে হবে । (৫৩ ও ৫৪ আয়াত)
পাঁচঃ মুসলমানদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, নবীকে কষ্ট দেয়া দুনিয়ায় ও
আখেরাতে আল্লাহর লানত ও লাঞ্ছনাকর আযাবের কারণ হবে এবং এভাবে কোন মুসলমানের
ইজ্জতের ওপর আক্রমণ করা এবং তার ভিত্তিতে তার ওপর অযথা দোষারোপ করাও কঠিন গোনাহের
শামিল। (৫৭ ও ৫৮ আয়াত)
ছয়ঃ সকল মুসলমান মেয়েকে হুকুম দেয়া হয়েছে, যখনই বাইরে বের হবার প্রয়োজন
হবে, চাদর দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে এবং ঘোমটা টেনে বের হতে
হবে। (৫৯ আয়াত)
তারপর যখন হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের ঘটনায় মদীনার সমাজে একটি
হাংগামা সৃষ্টি হয়ে যায় তখন নৈতিকতা, সামাজিকতা ও আইনের এমন সব বিধান ও নিদের্শ
সহকারে সূরা নূর নাযিল করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল প্রথমতঃ মুসলিম সমাজকে অনাচারের
উৎপাদন ও তার বিস্তার থেকে সংরক্ষিত রাখতে হবে এবং যদি তা উৎপন্ন হয়েই যায় তাহলে
তার যথাযথ প্রতিকার ও প্রতিরোধ এবং সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে । এ সূরায় এ বিধান ও নিদের্শগুলো যে ধারাবাহিকতা
সহকারে নাযিল হয়েছে এখানে আমি সেভাবেই তাদের সংক্ষিপ্তসার সন্নিবেশ করছি । এ দ্বারা কুরআন যথার্থ মনঃস্তাত্ত্বিক
পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনের সংশোধন ও সংগঠনের জন্য কি ধরনের আইনগত, নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ও
কৌশল অবলম্বন করার বিধান দেয়, তা পাঠক অনুমান করতে পারবেনঃ
(১) যিনা, ইতিপূর্বে যাকে সামাজিক অপরাধ গণ্য করা হয়েছিল (সূরা নিসাঃ ১৫ ও ১৬ আয়াত)
এখন তাকে ফৌজদারী অপরাধ গণ্য করে তার শাস্তি হিসেবে একশত বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা
হয়।
(২) ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীকে সামাজিকভাবে বয়কট করার হুকুম দেয়া হয় এবং তাদের সাথে
বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে মু’মিনদেরকে নিষেধ করা হয়।
(৩) যে ব্যক্তি অন্যের ওপর যিনার অপবাদ দেয় এবং তারপর প্রমাণস্বরূপ সাক্ষী পেশ
করতে পারে না তার শাস্তি হিসেবে ৮০ ঘা বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা হয়।
(৪) স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয় তাহলে তার জন্য “লি’আন”-এর রীতি
প্রবর্তন করা হয়।
(৫) হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে মুনাফিকদের মিথ্যা অপবাদ খণ্ডন করে এ নির্দেশ দেয়া
হয় যে, যে কোন ভদ্র
মহিলা বা ভদ্র লোকের বিরুদ্ধে যে কোন অপবাদ দেয়া হোক, তা চোখ
বুঁজে মেনে নিয়ো না এবং তা ছড়াতেও থেকো না। এ ধরনের গুজব যদি রটে যেতে থাকে তাহলে মুখে মুখে তাকে
ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য না করে তাকে দাবিয়ে দেয়া এবং তার পথ রোধ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে নীতিগতভাবে একটি কথা বুঝিয়ে দেয়া
হয়েছে যে, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির পবিত্র-পরিচ্ছন্ন নারীর সাথেই বিবাহিত হওয়া
উচিত। নষ্টা ও ভ্রষ্টা নারীর
আচার-আচরণের সাথে সে দু’দিনও খাপ খাইয়ে চলতে পারবে না। পবিত্র-পরিচ্ছন্ন নারীর ব্যাপারেও একই কথা। তার আত্মা পবিত্র-পরিচ্ছন্ন পুরুষের সাথেই খাপ
খাওয়াতে পারে, নষ্ট ও ভ্রষ্ট পুরুষের সাথে নয়। এখন যদি তোমরা রাসূলকে সা. একজন পবিত্র বরং পবিত্রতম
ব্যক্তি বলে জেনে থাকো তাহলে কেমন করে একথা তোমাদের বোধগম্য হলো যে, একজন ভ্রষ্টা নারী তার প্রিয়তম
জীবন সঙ্গিনী হতে পারতো? যে নারী কার্যত ব্যভিচারে পর্যন্ত
লিপ্ত হয়ে যায় তার সাধারণ চালচলন কিভাবে এমন পর্যায়ের হতে পারে যে, রসূলের মতো পবিত্র ব্যক্তিত্ব তার সাথে এভাবে সংসার জীবন যাপন করেন। কাজেই একজন নীচ ও স্বার্থান্ধ লোক একটি বাজে
অপবাদ কারোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেই তা গ্রহণযোগ্য তো হয়ই না, উপরন্তু তার প্রতি মনোযোগ দেয়া
এবং তাকে সম্ভব মনে করাও উচিত নয়। আগে চোখ মেলে দেখতে হবে। অপবাদ কে লাগাচ্ছে এবং কার প্রতি লাগাচ্ছে?
(৬) যারা আজেবাজে খবর ও খারাপ গুজব রটায় এবং মুসলিম সমাজে নৈতিকতা বিরোধী ও অশ্লীল
কার্যকলাপের প্রচলন করার প্রচেষ্টা চালায় তাদের ব্যাপারে বলা হয় যে, তাদেরকে উৎসাহিত করা যাবে না
বরং তারা শাস্তি লাভের যোগ্য।
(৭) মুসলিম সমাজে পারস্পরিক সুধারণার ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্কের ভিত গড়ে উঠতে হবে, এটিকে একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে
নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় যতক্ষণ পর্যন্ত পাপ করার কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না ততক্ষণ
প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্দোষ ও নিরপরাধ মনে করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির নির্দোষ হবার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত
তাকে দোষী মনে করতে হবে, এটা ঠিক নয়।
(৮) লোকদেরকে সাধারণভাবে নির্দেশ দেয়া যে, একজন অন্যজনের গৃহে নিঃসংকোচে প্রবেশ করো
না বরং অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করো।
(৯) নারী ও পুরুষদেরকে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। পরস্পরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে ও
উঁকিঝুঁকি মারতে এবং আড়চোখে দেখতে নিষেধ করা হয়।
(১০) মেয়েদের হুকুম দেয়া হয়, নিজেদের গৃহে মাথা ও বুক ঢেকে রাখো।
(১১) মেয়েদের নিজেদের মাহ্রাম আত্মীয় ও গৃহপরিচারকদের ছাড়া আর কারো সামনে সাজগোজ
করে না আসার হুকুম দেয়া হয়।
(১২) তাদেরকে এ হুকুমও দেয়া হয় যে, বাইরে বের হলে শুধু যে কেবল নিজেদের
সাজসজ্জা লুকিয়ে বের হবে তাই না বরং এমন অলংকার পরিধান করেও বাইরে বের হওয়া যাবে
না যেগুলো বাজতে থাকে।
(১৩) সমাজে মেয়েদের ও পুরুষদের বিয়ে না করে আইবুড়ো ও আইবুড়ী হয়ে বসে থাকাকে অপছন্দ
করা হয়। হকুম দেয়া হয়, অবিবাহিতদের বিয়ে দেয়া হোক। এমনকি বাঁদী ও গোলামদেরকেও অবিবাহিত রেখে দেয়া
যাবে না। কারণ কৌমার্য ও কুমারিত্ব
অশ্লীলতা ও চারিত্রিক অনাচারের প্ররোচনাও দেয়, আবার মানুষকে অশ্লীলতার সহজ শিকারে পরিণত
করে। অবিবাহিত ব্যক্তি আর কিছু
না হলেও খারাপ খবর শোনার এবং তা ছড়াবার ব্যাপারে আগ্রহ নিতে থাকে ।
(১৪) বাঁদী ও গোলাম স্বাধীন করার জন্য “মুকাতাব”-এর পথ বের করা হয়। (মুক্তিপণ দিয়ে স্বাধীন হওয়া) মালিকরা ছাড়া
অন্যদেরকেও মুকাতাব বাঁদী ও গোলামদেরকে আর্থিক সাহায্য করার হুকুম দেয়া হয়।
(১৫) বাঁদীদেরকে অর্থোপার্জনের কাজে খাটানো নিষিদ্ধ করা হয়। আরবে বাঁদীদের মাধ্যমেই এ পেশাটি জিইয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। এ কারণে একে নিষিদ্ধ করার ফলে আসলে
পতিতাবৃত্তি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
(১৬) পারিবারিক জীবনে গৃহ পরিচারক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকদের জন্য নিয়ম করা হয় যে, তারা একান্ত ব্যক্তিগত সময়গুলোয়
(অর্থাৎ সকাল, দুপুর ও রাতে) গৃহের কোন পুরুষ ও মেয়ের কামরায়
আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়তে পারবে না। নিজের সন্তানদের মধ্যেও অনুমতি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করার
অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
(১৭) বুড়ীদেরকে অনুমতি দেয়া হয়, তারা যদি স্বগৃহে মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে রেখে দেয় তাহলে তাতে
ক্ষতি নেই। কিন্তু “তাবাররুজ” (নিজেকে
দেখাবার জন্য সাজসজ্জা করা) থেকে দূরে থাকার হুকুম দেয়া হয়। তাছাড়া তাদেরকে নসিহত করা হয়েছে, বার্ধক্যাবস্থায়ও তারা যদি
মাথায় কাপড় দিয়ে থাকে তাহলে ভালো।
(১৮) অন্ধ, খঞ্জ, পঙ্গু ও রুগ্নকে এ সুবিধা প্রদান করা হয় যে,
তারা বিনা অনুমতিতে কোথাও থেকে কোন খাদ্যবস্তু খেয়ে নিলে তাকে চুরি
ও আত্মসাতের আওতায় ফেলা হবে না। এজন্য তাদেরকে পাকড়াও করা হবে না।
(১৯) নিকটাত্মীয় ও অন্তরঙ্গ বন্ধুদেরকে অনুমতি দেয়া হয় যে, তারা বিনা অনুমতিতে পরস্পরের
বাড়িতে খেতে পারে এবং এটা এমন পর্যায়ের যেমন তারা নিজেদের বাড়িতে খেতে পারে। এভাবে সমাজের লোকদেরকে পরস্পরের কাছাকাছি করে
দেয়া হয়েছে। তাদের পরস্পরের মধ্যে
স্নেহ-ভালোবাসা-মায়া-মমতা বেড়ে যাবে এবং পারস্পরিক আন্তরিকতার সম্পর্ক এমন সব
ছিদ্র বন্ধ করে দেবে যেগুলোর মাধ্যমে কোন কুচক্রী তাদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি
করতে পারতো।
এসব নির্দেশের সাথে সাথে মুনাফিক ও মু’মিনদের এমনসব সুস্পষ্ট আলামত বর্ণনা করা
হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান সমাজে আন্তরিকতা সম্পন্ন মু’মিন কে এবং
মুনাফিক কে তা জানতে পারে। অন্যদিকে মুসলমানদেরকে দলগত শৃংখলা ও সংগঠনকে আরো শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। এজন্য আরো কতিপয় নিয়ম-কানুন তৈরী করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, কাফের ও মুনাফিকরা যে শক্তির
সাথে টক্কর দিতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ফিত্না-ফাসাদ সৃষ্টি করে চলছিল তাকে আরো বেশী
শক্তিশালী করা।
এ সমগ্র আলোচনায় একটি জিনিস পরিষ্কার দেখার মতো। অর্থাৎ বাজে ও লজ্জাকর হামলার জবাবে যে ধরনের তিক্ততার
সৃষ্টি হয়ে থাকে সমগ্র সূরা নূরে তার ছিটেফোঁটাও নেই। একদিকে যে অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হয় তা দেখুন এবং
অন্যদিকে সূরার বিষয়বস্তু ও বাকরীতি দেখুন। এ ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে কেমন ঠাণ্ডা মাথায় আইন
প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংস্কারমূলক বিধান দেয়া
হচ্ছে। জ্ঞানগর্ভ নির্দেশ দেয়া
হচ্ছে। সর্বোপরি শিক্ষা ও উপদেশ
দানের হক আয়াত করা হচ্ছে। এ
থেকে শুধুমাত্র এ শিক্ষাই পাওয়া যায় না যে, ফিত্নার মোকাবিলায় কঠিন থেকে কঠিনতর
উত্তেজক পরিস্থিতিতে আমাদের কেমন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে উদার হৃদয়ে বুদ্ধিমত্তা
সহকারে এগিয়ে যেতে হবে বরং এ থেকে এ বিষয়েরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এ বাণী মুহাম্মাদ সা. এর নিজের রচনা নয়, এটা এমন এক
সত্ত্বার অবতীর্ণ বাণী যিনি অনেক উচ্চ স্থান থেকে মানুষের অবস্থা ও জীবনাচার
প্রত্যক্ষ করছেন এবং নিজ সত্ত্বায় এসব অবস্থা ও জীবনাচারের প্রভাবমুক্ত থেকে
নির্জলা পথনির্দেশনা ও বিধান দানের দায়িত্ব পালন করছেন। যদি এটা নবী সা. এর নিজের বাণী হতো তাহলে তাঁর
চরম উদার দৃষ্টি সত্ত্বেও নিজের ইজ্জত আব্রুর ওপর জঘন্য আক্রমণের ধারা বিবরণী শুনে
একজন সৎ ও ভদ্র লোকের আবেগ অনুভূতিতে অনিবার্যভাবে যে স্বাভাবিক উত্তেজনার সৃষ্টি
হয়ে যায় তার কিছু না কিছু প্রভাব অবশ্যই এর মধ্যে পাওয়া যেতো।
তরজমা ও তাফসীর
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿سُورَةٌ
أَنزَلْنَاهَا وَفَرَضْنَاهَا وَأَنزَلْنَا فِيهَا آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لَّعَلَّكُمْ
تَذَكَّرُونَ﴾
১। এটি একটি
সূরা, আমি এটি
নাযিল করেছি এবং একে ফরয করে দিয়েছি আর এর মধ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশসমূহ নাযিল করেছি,১ হয়তো তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে।
১. এসব বাক্যাংশের মধ্যে “আমি”র ওপর জোর দেয়া
হয়েছে। অর্থাৎ আর কেউ এটি নাযিল
করেনি বরং “আমিই” নাযিল করেছি। তাই কোন শক্তিহীন উপদেশকের বাণীর মতো একে হালকা জিনিস মনে করে বসো না। ভালো করে জেনে রাখো, এমন এক সত্ত্বা এটি নাযিল
করেছেন যার মুঠোর মধ্যে রয়েছে তোমাদের প্রাণ ও কিসমত এবং তোমরা মরেও যার পাকড়াও
থেকে বাঁচতে পারবে না।
দ্বিতীয় বাক্যাংশে বলা হয়েছে, এ সূরায় যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলো “সুপারিশ” পর্যায়ের জিনিস
নয়। তোমার ইচ্ছা হলে মেনে নিলে
অন্যথায় যা ইচ্ছা তাই করতে থাকলে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং এটি হচ্ছে অকাট্য ও চূড়ান্ত বিধান। এ বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। যদি তুমি মু’মিন ও মুসলিম হয়ে থাকো, তাহলে এ বিধান অনুযায়ী কাজ করা
তোমার জন্য ফরয।
তৃতীয় বাক্যাংশে বলা হয়েছে, এ সূরায় যেসব নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট নির্দেশনামা। এগুলো সম্পর্কে তোমরা এ ওজর পেশ করতে পারবে না
যে, অমুক কথাটি
বুঝতে পারিনি কাজেই সেটিকে কেমন করে কার্যকর করতাম?
যে মহান ঘোষণার পরে আইনগত বিধান শুরু হয়ে যায় এই হচ্ছে তার ভূমিকা (Preamble)। সূরা নূরের বিধানগুলো মহান আল্লাহ কত গুরুত্ব সহকারে পেশ
করছেন এ ভূমিকার বর্ণনাভঙ্গী নিজেই তা জানিয়ে দিচ্ছে। আইন-বিধান সম্বলিত অন্য কোন সূরার ভূমিকা এত বেশী জোরদার
নয়।
﴿الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي
فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا
رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
২।
ব্যভিচারিনী ও ব্যভিচারী উভয়ের প্রত্যেককে এক শত বেত্রাঘাত করো।২ আর আল্লাহর দীনের ব্যাপারে
তাদের প্রতি কোন মমত্ববোধ ও করুণা যেন তোমাদের মধ্যে না জাগে যদি তোমরা আল্লাহ ও
শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনো।৩ আর তাদেরকে
শাস্তি দেবার সময় মু’মিনদের একটি দল যেন উপস্থিত থাকে।৪
২. এ বিষয়টির অনেকগুলো আইনগত, নৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক ব্যাখ্যা
সাপেক্ষ রয়ে গেছে।
সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা ছাড়া বর্তমান যুগে এক ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এ শরীয়াতী
বিধান অনুধাবন করা কঠিন।
তাই নিচে আমি এর বিভিন্ন দিকের ওপর ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করবোঃ
একঃ যিনা বা ব্যভিচারের যে সাধারণ অর্থটি প্রত্যেক ব্যক্তি
জানে সেটি হচ্ছে এই যে, ‘একটি পুরুষ একটি স্ত্রীলোক নিজেদের মধ্যে কোন বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক ছাড়াই
পরস্পর যৌন মিলন করে।’ এ কাজটির নৈতিকভাবে খারাপ হওয়া অথবা ধর্মীয় দিক দিয়ে পাপ হওয়া কিংবা সামাজিক
দিক দিয়ে দূষণীয় ও আপত্তিকর হওয়া এমন একটি জিনিস যে ব্যাপারে প্রাচীনতম যুগ থেকে
নিয়ে আজ পর্যন্ত সকল মানব সমাজ ঐকমত্য পোষণ করে আসছে। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কয়েকজন লোক যারা নিজেদের
বুদ্ধিবৃত্তিকে নিজেদের প্রবৃত্তি তোষণ নীতির অধীন করে দিয়েছে অথবা যারা নিজেদের
উন্মত্ত মস্তিষ্কের অভিনব খেয়ালকে দার্শনিক তত্ত্ব মনে করে নিয়েছে তারা ছাড়া আর
কেউই আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে মতবিরোধ প্রকাশ করেনি। এ বিশ্বজনীন ঐকমত্যের কারণ হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রকৃতি নিজেই যিনা
হারাম হওয়ার দাবী জানায়। মানবজাতির অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব এবং মানবিক সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা উভয়ই
এ বিষয়টির ওপর নির্ভর করে যে, নারী ও পুরুষ শুধুমাত্র আনন্দ উপভোগের জন্য মিলিত হবার এবং
তারপর আলাদা হয়ে যাবার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী হবে না বরং প্রত্যেকটি জোড়ার
পারস্পরিক সম্পর্ক এমন একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার ও চুক্তির
ভিত্তিতে গড়ে উঠবে যা সমাজের সবাই জানবে এবং সবার কাছে হবে পরিচিত এবং এ সঙ্গে
সমাজ তার নিশ্চয়তাও দেবে। এ অঙ্গীকার ও চুক্তি ছাড়া মানুষের বংশধারা এক দিনের জন্যও চলতে পারে না। কারণ মানব শিশু নিজের জীবন ও নিজের বিকাশের
জন্য বছরের পর বছরের সহানুভূতিশীল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা-প্রশিক্ষণের মুখাপেক্ষী
হয়। যে পুরুষটি এ শিশুর দুনিয়ায়
অস্তিত্ব লাভের কারণ হয়েছে যতক্ষণ না সে নারীর সাথে এ সহযোগিতা করবে ততক্ষণ কোন
নারী একাকী এ বোঝা বহন করার জন্য কখনো তৈরী হতে পারে না। অনুরূপভাবে এ চুক্তি ছাড়া মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতিও টিকে
থাকতে পারে না। কারণ সভ্যতা-সংস্কৃতির
জন্মই তো একটি পুরুষ ও একটি নারীর সহাবস্থান করার, গৃহ ও পরিবারের অস্তিত্ব দান করার
এবং তারপর পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। যদি নারী ও পুরুষ গৃহ ও পরিবার গঠন না করে
নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য স্বাধীনভাবে সহাবস্থান করতে থাকে তাহলে সমস্ত মানুষ
বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।
সমাজ জীবনের ভিত্তি চূর্ণ ও বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির এ ইমারত
যে ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে তার অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এসব কারণে নারী ও পুরুষের যে স্বাধীন সম্পর্ক কোন সুপরিচিত
ও সর্বসম্মত বিশ্বস্ততার চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় তা মূলত মানবিক প্রকৃতির
বিরোধী। এসব কারণেই প্রতি যুগে
মানুষ একে মারাত্মক দোষ, বড় ধরনের অসদাচার ও ধর্মীয় পরিভাষায় একটি কঠিন গোনাহ মনে করে এসেছে এবং
এসব কারণেই প্রতি যুগে মানব সমাজ বিয়ের প্রচলন ও প্রসারের সাথে সাথে যিনা ও
ব্যভিচারের পথ বন্ধ করার জন্য কোন না কোনভাবে অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এ প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত্রে
বিভিন্ন আইন-কানুন এবং নৈতিক, তামাদ্দুনিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য ছিল। জাতি ও সমাজের জন্য যিনার ক্ষতিকর হবার চেতনা
কোথাও কম এবং কোথাও বেশী, কোথাও সুস্পষ্ট আবার কোথাও অন্যান্য সমস্যার সাথে জড়িয়ে অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
দুইঃ যিনার হারাম হবার ব্যাপারে একমত হবার পর যে বিষয়ে মতবিরোধ
হয়েছে সেটি হচ্ছে, এর অপরাধ অর্থাৎ আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য হবার ব্যাপারটি। এখান থেকে ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম ও আইনের
বিরোধ শুরু হয়। যেসব সমাজ মানব প্রকৃতির
কাছাকাছি থেকেছে তারা সবসময় যিনা অর্থাৎ নারী ও পুরুষের অবৈধ সম্পর্ককে একটি অপরাধ
হিসেবে দেখে এসেছে এবং এজন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ধারা যতই সমাজকে খারাপ করে চলেছে এ
অপরাধ সম্পর্কে ততই মনোভাব কোমল হয়ে চলেছে।
এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যে শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয় এবং অত্যন্ত ব্যাপকভাবে
প্রদর্শন করা হয় সেটি ছিলঃ “নিছক যিনা” (Fornication) এবং “পর নারীর সাথে যিনা” (Adultery)
এর মধ্যে পার্থক্য করে প্রথমটিকে সামান্য ভুল এবং কেবলমাত্র
শেষোক্তটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হয়।
নিছক যিনার যে সংজ্ঞা বিভিন্ন আইনে পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, “কোন অবিবাহিত বা বিবাহিত পুরুষ
এমন কোন মেয়ের সাথে সঙ্গম করে যে অন্য কোন পুরুষের স্ত্রী নয়।” এ সংজ্ঞায় মূলত পুরুষের নয় বরং নারীর অবস্থার
ওপর নির্ভর করা হয়েছে।
নারী যদি স্বামীহীনা হয় তাহলে তার সাথে সঙ্গম নিছক যিনা হবে। এক্ষেত্রে সঙ্গমকারী পুরুষের স্ত্রী থাক বা না থাক। তাতে কিছু আসে যায় না। প্রাচীন মিসর, ব্যাবিলন, আসিরীয়া ও
ভারতের আইনে এর শাস্তি ছিল খুবই হালকা পরিমাণের। গ্রীস ও রোমও এ পদ্ধতিই অবলম্বন করে। পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদীরাও এ থেকে প্রভাবিত হয়। বাইবেলে একে শুধুমাত্র এমন একটি অন্যায় বলা
হয়েছে যার ফলে পুরুষকে কেবলমাত্র অর্থদণ্ডই দিতে হয়। যাত্রা পুস্তকে এ সম্পর্কে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তার
শব্দাবলী নিম্নরূপঃ
“আর কেহ যদি অবাগদত্তা কুমারীকে ভুলাইয়া তাহার সহিত শয়ন করে, তবে সে অবশ্য কন্যাপণ দিয়া তাহাকে বিবাহ করিবে। যদি সেই ব্যক্তির সহিত আপন কন্যার বিবাহ দিতে
পিতা নিতান্ত অসম্মত হয়, তবে কন্যাপণের ব্যবস্থানুসারে তাহাকে রৌপ্য দিতে হইবে।” (২২: ১৬-১৭)
“দ্বিতীয় বিবরণে” এ হুকুমটি কিছুটা অন্য শব্দাবলীর সাহায্যে বর্ণনা করা
হয়েছে এবং তারপর বলা হয়েছে, পুরুষের কাছ থেকে পঞ্চাশ শেকল
(প্রায় ২০ তোলা) পরিমাণ রৌপ্য কন্যার পিতাকে জরিমানা দেবে। (২২: ২৮-২৯) তবে কোন ব্যক্তি যদি পুরোহিতের
মেয়ের সাথে যিনা করে তাহলে তার জন্য ইহুদী আইনে রয়েছে ফাঁসি এবং মেয়েকে জীবিত
অগ্নিদগ্ধ করার ব্যবস্থা। (Everyman’s Talmud, P 319-20)
এ চিন্তাটি হিন্দু চিন্তার সাথে কত বেশী সামঞ্জস্যশীল তা অনুমান করার জন্য মনু
সংহিতার সাথে একবার মিলিয়ে দেখুন। সেখানে বলা হয়েছেঃ
“যে ব্যক্তি নিজের জাতের কুমারী মেয়ের সাথে তার সম্মতিক্রমে যিনা করে সে
কোন শাস্তি লাভের যোগ্য নয়। মেয়ের বাপ রাজী থাকলে সে বিনিময় দিয়ে তাকে বিয়ে করে নেবে। তবে মেয়ে যদি উচ্চ বর্ণের হয় এবং পুরুষ হয়
নিম্নবর্ণের, তাহলে মেয়েকে গৃহ থেকে বের করে দেয়া উচিত এবং পুরুষের অঙ্গচ্ছেদের শাস্তি
দিতে হবে।” (৮: ৩৬৫-৩৬৬) আর মেয়ে
ব্রাহ্মণ হলে এ শাস্তি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করার শাস্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। (৩৭৭ শ্লোক)।
আসলে এ সমস্ত আইনে পরস্ত্রীর সাথে যিনা করাই ছিল বড় অপরাধ। অর্থাৎ যখন কোন (বিবাহিত বা অবিবাহিত) ব্যক্তি
এমন কোন মেয়ের সাথে সঙ্গম করে যে অন্য কোন ব্যক্তির স্ত্রী। এ কর্মটির অপরাধ হবার ভিত্তি এ ছিল না যে, একটি পুরুষ একটি নারী যিনা
করেছে। বরং তারা দু’জন মিলে তৃতীয়
এক ব্যক্তিকে এমন একটি শিশু লালন-পালন করার বিপদে ফেলে দিয়েছে যেটি তার নয়, এটিই ছিল এর ভিত্তি। অর্থাৎ যিনা নয় বরং বংশধারা মিশ্রণের আশঙ্কা
এবং একের সন্তানকে অন্যের অর্থে প্রতিপালন করা ও তার উত্তরাধিকার হওয়াই ছিল
অপরাধের মূল ভিত্তি। এ
কারণে পুরুষ ও নারী উভয়েই অপরাধী সাব্যস্ত হতো। মিসরীয়দের সামজে এর শাস্তি ছিল পুরুষটিকে লাঠি দিয়ে
ভালোমতো পিটাতে হবে এবং মেয়েটির নাক কেটে দিতে হবে। প্রায় এ একই ধরণের শাস্তির প্রচলন ছিল ব্যাবিলন, আসিরীয়া ও প্রাচীন ইরানেও। হিন্দুদের মধ্যে নারীর শাস্তির ছিল, তার ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো
এবং পুরুষের শাস্তি ছিল, তাকে উত্তপ্ত লোহার পালংকে শুইয়ে
দিয়া চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হতো। গ্রীস ও রোমে প্রথম দিকে একজন পুরুষের অধিকার ছিল যদি সে
নিজের স্ত্রীর সাথে কাউকে যিনা করতে দেখে তাহলে তাকে হত্যা করতে পারতো অথবা ইচ্ছা
করলে তার কাছ থেকে অর্থদণ্ড নিতে পারতো। তারপর প্রথম খৃস্টপূর্বাব্দে সীজার আগষ্টিস এ আইন জারি
করেন যে, পুরুষের সম্পত্তির অর্ধাংশ বাজেয়াপ্ত করে তাকে দেশান্তর করে দিতে হবে এবং
নারীর অর্ধেক মোহরানা বাতিল এবং এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাকেও দেশের
কোন দূরবর্তী এলাকায় পাঠিয়ে দিতে হবে। কনষ্টান্টিন এ আইনটি পরিবর্তিত করে নারী ও পুরুষ উভয়ের
জন্য মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেন। লিও (Leo)
ও মারসিয়ানের (Mercian) যুগে এ শাস্তিকে
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। তারপর সীজার জাষ্টিনীন এ শাস্তিটি আরো হাল্কা করে এ নিয়ম
জারি করেন যে, মেয়েটিকে বেত্রাঘাত করার পর কোন সন্ন্যাসীর আশ্রমে দিয়ে আসতে হবে এবং তার
স্বামীকে এ অধিকার দেয়া হয় যে, সে চাইলে দু’বছর পর তাকে
সেখান থেকে বের করে আনতে পারে অন্যথায় সারা জীবন সেখানে ফেলে রাখতে পারে।
ইহুদী আইনে পরস্ত্রীর সাথে যিনা সম্পর্কে যে বিধান পাওয়া যায় তা হচ্ছে
নিম্নরূপঃ
“আর মূল্য দ্বারা কিংবা অন্যরূপে মুক্ত হয় নাই, এমন
যে বাগদত্তা দাসী, তাহার সহিত যদি কেহ সঙ্গম করে, তবে তাহারা দণ্ডনীয় হইবে; তাহাদের প্রাণদণ্ড হইবে না,
কেননা সে মুক্ত নহে।” (লেবীয় পুস্তক ১৯: ১৭)
“আর যে ব্যক্তি পরের ভার্যার সহিত ব্যভিচার করে, যে
ব্যক্তি প্রতিবাসীর ভার্যার সহিত ব্যভিচার করে, সেই
ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী, উভয়ের প্রাণদণ্ড অবশ্যই হইবে।” (লেবীয় পুস্তক ২০: ১০)
“কোন পুরুষ যদি পরস্ত্রীর সহিত শয়নকালে ধরা পড়ে, তবে
পরস্ত্রীর সহিত শয়নকারী সেই পুরুষ ও সেই স্ত্রী উভয়ে হত হইবে।” (দ্বিতীয় বিবরণ ২২: ২২)
“যদি কেহ পুরুষের প্রতি বাগদত্তা কোন কুমারীকে নগর মধ্যে পাইয়া তাহার সহিত
শয়ন করে, তবে তোমরা সেই দুইজনকে বাহির করিয়া নগরদ্বারের
নিকটে আনিয়া প্রস্তরাঘাতে বধ করিবে, সেই কন্যাকে বধ করিবে,
কেননা, নগরের মধ্যে থাকিলেও সে চিৎকার করে নাই
এবং সেই পুরুষকে বধ করিবে, কেননা, সে
আপন প্রতিবেশীর স্ত্রীকে মানভ্রষ্টা করিয়াছেঃ এইরূপে তুমি আপনার মধ্য হইতে দুষ্টাচার
লোপ করিবে। কিন্তু যদি কোন পুরুষ
বাগদত্তা কন্যাকে মাঠে পাইয়া বলপূর্বক তাহার সহিত শয়ন করে, তবে তাহার সহিত শয়নকারী সেই
পুরুষ মাত্র হত হইবে, কিন্তু কন্যার প্রতি তুমি কিছুই করিবে
না।” (দ্বিতীয় বিবরণ ২২: ২৩-২৬)
কিন্তু হযরত ঈসা আ. এর যুগের বহু পূর্বে ইহুদী উলামা, ফকীহ, শাসক
ও জনতা সবাই এ আইন কার্যত রহিত করে দিয়েছিল। যদিও এ আইন বাইবেলে লিখিত ছিল এবং একই আল্লাহর হুকুম মনে
করা হতো কিন্তু কেউ এর কার্যত প্রচলনের পক্ষপাতি ছিল না। এমনকি এ হুকুমটি কখনো জারি করা হয়েছিল এমন কোন নজিরও
ইহুদীদের ইতিহাসে পাওয়া যেতো না। হযরত ঈসা আ. যখন সত্যের দাওয়াত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং ইহুদী আলেমগণ দেখেন এ
বন্যা প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থাই কার্যকর হচ্ছে না তখন তারা একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তারা এক ব্যভিচারিণীকে তাঁর কাছে ধরে আনেন এবং
বলেন, এর ফায়সালা
করে দিন। (যোহন ৮:১-১১) এ থেকে তাদের
উদ্দেশ্য ছিল হযরত ঈসাকে কুয়া বা খাদ দু’টোর মধ্য থেকে কোন একটিতে লাফিয়ে পড়তে
বাধ্য করা। যদি তিনি পাথর মেরে হত্যা
(রজম) ছাড়া অন্য কোন শাস্তি নির্ধারণ করেন, তাহলে একথা বলে তাঁর দুর্নাম রটানো হবে যে,
দেখো ইনি একজন অভিনব পয়গম্বর এসেছেন, দুনিয়ার
ভয়ে আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে ফেলেছেন। আর যদি ‘রজম’ করার হুকুম দেন, তাহলে একদিকে রোমীয় আইনের সাথে
তাঁর সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়া হবে আর অন্যদিকে জাতিকে বলা হবে, এ
পয়গম্বর সাহেবকে মেনে নাও, দেখে নাও একবার তাওরাতের পুরো
শরীয়াত তোমাদের পিঠে ও জীবনের ওপর নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু হযরত ঈসা আ. একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে তাদের কৌশল
তাদের মাথার ওপর ছুঁড়ে মারেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে নিজে পাক-পবিত্র-ব্যভিচারমুক্ত সে এগিয়ে এসে এর ওপর
পাথর নিক্ষেপ করো। এ
কথা শুনতেই ফকীহদের পুরো জমায়েত ফাঁকা হয়ে যায়। প্রত্যেকে মুখ লুকিয়ে কেটে পড়েন এবং আল্লাহর শরীয়াতের
বাহকদের নৈতিক অবস্থা একেবারেই নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে। তারপর যখন মেয়েটি একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তখন তিনি তাকে নসীহত
করেন এবং তাওবা পড়িয়ে বিদায় করে দেন। কারণ তিনি বিচারক ছিলেন না। কাজেই তার মামলার ফায়সালা তিনি করতে পারতেন না। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন সাক্ষীও উপস্থাপিত হয়নি। সর্বোপরি আল্লাহর আইন জারি করার জন্য কোন
ইসলামী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
হযরত ঈসার এ ঘটনা এবং বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁর আরো কতিপয় বিক্ষিপ্ত বাণী
থেকে ভুল যুক্তি সংগ্রহ করে ঈসায়ীরা যিনার অপরাধ সম্পর্কে অন্য একটি ধারণা তৈরী
করে নিয়েছে। তাদের মতে অবিবাহিত পুরুষ
যদি অবিবাহিত মেয়ের সাথে যিনা করে তাহলে এটা যিনা তো হবে ঠিকই কিন্তু শাস্তিযোগ্য
অপরাধ হবে না। আর যদি এ কর্মের পুরুষ বা
নারী যে কোন এক পক্ষ বিবাহিত হয় অথবা উভয় পক্ষই হয় বিবাহিত, তাহলে এটা অপরাধ হিসেবে
বিবেচিত হবে।
কিন্তু একে অপরাধে পরিণত করে “চুক্তিভঙ্গ”, নিছক যিনা নয়। তাদের মতে যে ব্যক্তিই বিবাহিত হবার পরও যিনা করে সে
গীর্জায় পাদ্রির সামনে নিজের স্ত্রী বা স্বামীর সাথে যে বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার ও
চুক্তি করেছিল তা ভঙ্গ করে ফেলেছে তাই সে অপরাধী। কিন্তু এ অপরাধের এছাড়া আর কোন শাস্তি নেই যে, যিনাকারী পুরুষের স্ত্রী তার
স্বামীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি লাভ করতে পারবে
এবং যিনাকারী স্ত্রীর স্বামী একদিকে নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী করে
বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি লাভ করতে পারবে এবং অন্য দিকে যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে
খারাপ করেছে তার কাছ থেকে অর্থদণ্ড লাভ করার অধিকার রাখে। খৃস্টীয় আইন বিবাহিত ব্যভিচারী ও
ব্যভিচারীনিকে এ শাস্তিই দিয়ে থাকে। আর সর্বনাশের ব্যাপার হচ্ছে, এ শাস্তি দুধারী তলোয়ারের মতো। যদি কোন স্ত্রী তার বিশ্বাসঘাতক স্বামীর বিরুদ্ধে
“অবিশ্বস্ততার” দাবী করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি হাসিল করে নেয়, তাহলে তো সে সেই বিশ্বাসঘাতক
স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে কিন্তু খৃস্টীয় আইন অনুযায়ী এরপর আর সে জীবনভর
দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। আর যে পুরুষটি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী এনে বিবাহ বিচ্ছেদ
করেছিল তার অবস্থাও তাই হবে। কারণ খৃস্টীয় আইন তাকেও দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দেয় না। এ যেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে যে সারা জীবন
যোগী হিসেবে থাকতে চাইবে নিজের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর বিরুদ্ধে খৃস্টীয় আদালতে
তার অবিশ্বস্ততার মামলা ঠুকে দিলেই চলবে।
বর্তমান যুগের পাশ্চাত্য আইন-কানুন এসব বিচিত্র চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ মুসলিম দেশও আজ এসব আইনের ধারা অনুসরণ
করে চলছে। এ পাশ্চাত্য আইনের দৃষ্টিতে
যিনা করা একটি দোষ, নৈতিক চরিত্রহীনতা বা পাপ যাই কিছু হোক না কেন, মোটকথা
এটা কোন অপরাধ নয়। একে যদি কোন জিনিস অপরাধে পরিণত করতে পারে তাহলে তা হচ্ছে এমন ধরনের বল
প্রয়োগ যার সাহায্যে দ্বিতীয় পক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন ক্রিয়া করা হয়। আর কোন বিবাহিত পুরুষের যিনা করার ব্যাপারটা
হচ্ছে, তা যদি
অভিযোগের কারণ হয়ে থাকে তাহলে তার স্ত্রীর জন্য। সে চাইলে তার প্রমাণ দিয়ে তালাক হাসিল করতে পারে। আর যিনার অপরাধী যদি হয় বিবাহিত নারী, তাহলে তার স্বামীর কেবল তার
বিরুদ্ধে নয় বরং যিনাকারী পুরুষের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দেখা দেয় এবং উভয়ের বিরুদ্ধে
মামলা করে সে স্ত্রী থেকে তালাক এবং যিনাকারী পুরুষ থেকে অর্থদণ্ড নিতে পারে।
তিনঃ এসব চিন্তার বিপরীতে ইসলামী আইন স্বয়ং যিনাকেই একটি
শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে এবং বিবাহিত হবার পরও যিনা করলে তার দৃষ্টিতে তা
অপরাধের মাত্রা আরো বেশী বাড়িয়ে দেয়। এটা এজন্য নয় যে, অপরাধী কারোর সাথে “চুক্তিভঙ্গ” অথবা অন্য কারো বিছানায় হস্তক্ষেপ করেছে। বরং এজন্য যে, তার নিজের প্রবৃত্তির কামনা
পূরণ করার জন্য একটি বৈধ মাধ্যম ছিল এবং এরপরও সে অবৈধ মাধ্যম অবলম্বন করেছে। ইসলামী আইন যিনাকে যে দৃষ্টিতে দেখে তা হচ্ছে
এই যে, এটি এমন
একটি কর্ম যাকে স্বাধীনভাবে করার সুযোগ দেয়া হলে একদিকে মানব বংশধারা এবং
অন্যদিকে তার সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ হয়ে যাবে। বংশধারার স্থায়িত্ব ও সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা উভয়ের
জন্য নারী ও পুরুষের সম্পর্ক শুধুমাত্র আইন অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকা অপরিহার্য। আর
তার সাথে সাথে যদি অবাধ যৌন সম্পর্কেরও খোলাখুলি অবকাশ থাকে তাহলে তাকে সীমাবদ্ধ
রাখা সম্ভব নয়। কারণ গৃহ ও পরিবারের
দায়িত্বের বোঝা বহন করা ছাড়া যেখানে লোকদের প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ করার সুযোগ
থাকে সেখানে তাদের থেকে আশা করা যেতে পারে না যে, সেসব প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ
করার জন্য তারা আবার এত বড় দায়িত্বের বোঝা বহন করতে উদ্যত হবে। এটা ঠিক বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের স্বাধীনতা
থাকার পর রেল গাড়িতে বসার জন্য টিকিটের শর্ত অর্থহীন হয়ে যাওয়ার মতো। টিকিটের শর্ত যদি অপরিহার্য হয়ে থাকে তাহলে
তাকে কার্যকর করার জন্য বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। তারপর যদি কোন ব্যক্তি পয়সা না থাকার কারণে
বিনা টিকিটে সফর করে তাহলে সে অপেক্ষাকৃত কম পর্যায়ের অপরাধী হবে এবং ধনাঢ্য হবার
পরও এ অপরাধ করলে তার অপরাধ আরো কঠিন হয়ে যায়।
চারঃ ইসলাম মানব সমাজকে যিনার আশঙ্কা থেকে বাঁচাবার জন্য
শুধুমাত্র দণ্ডবিধি আইনের অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না বরং তার জন্য ব্যাপক আকারে
সংস্কার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে। আর এ দণ্ডবিধি আইনকে নির্ধারণ করেছে নিছক একটি শেষ উপায়
হিসেবে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, লোকেরা এ অপরাধ করে যেতেই
থাকুক এবং তাদেরকে বেত্রাঘাত করার জন্য দিনরাত তাদের ওপর নজর রাখা হোক। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন এ অপরাধ না করে এবং
কাউকে শাস্তি দেবার সুযোগই না পাওয়া যায়। সে সবার আগে মানুষের প্রবৃত্তির সংশোধন করে। তার মনের মধ্যে বসিয়ে দেয় অদৃশ্য জ্ঞানের
অধিকারী এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহর ভয়। তার মধ্যে আখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। মরেও মানুষ এ হাত থেকে বাঁচতে পারে না। তার মধ্যে আল্লাহর আইনের আনুগত্য করার প্রেরণা সৃষ্টি করে। এটি হচ্ছে ঈমানের অপরিহার্য দাবী। আর তারপর বারবার তাকে এ মর্মে সতর্ক করে যে, যিনা ও সতীত্বহীনতা এমন বড় বড়
গোনাহর অন্তর্ভুক্ত যেগুলো সম্পর্কে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সমগ্র কুরআনে বারবার এ বিষয়বস্তু সামনে আসতে
থাকে। তারপর ইসলাম মানুষের জন্য
বিয়ের যাবতীয় সম্ভাব্য সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এক স্ত্রীতে তৃপ্ত না হলে চারটি পর্যন্ত বৈধ স্ত্রী রাখার
সুযোগ করে দেয়। স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল না
হলে স্বামীর জন্য তালাক ও স্ত্রীর ‘খুলা’র সুযোগ করে দেয়। আর অমিলের সময় পারিবারিক সালিশ থেকে শুরু করে সরকারী
আদালতে পর্যন্ত আপীল করার পথ খুলে দেয়, এ ফলে দু’জনের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যেতে পারে
আর নয়তো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের বন্ধন মুক্ত হয়ে নিজেদের ইচ্ছা মতো অন্য কোথাও
বিয়ে করতে পারে।
এসব বিষয় সূরা বাকারাহ, সূরা নিসা ও সূরা তালাকে দেখা যেতে পারে। আর এ সূরা নূরেও দেখা যাবে পুরুষ ও নারীকে বিয়ে না করে বসে
থাকাকে অপছন্দ করা হয়েছে এবং এ ধরনের লোকদের বিয়ে করিয়ে দেবার এমনকি গোলাম ও
বাঁদীদেরকেও অবিবাহিত করে না রাখার জন্য পরিষ্কার হুকুম দেয়া হয়েছে।
তারপর ইসলাম সমাজ থেকে এমন সব কার্যকারণ নির্মূল করে দেয় যেগুলো যিনার আগ্রহ ও
তার উদ্যোগ সৃষ্টি করে এবং তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে পারে। যিনার শাস্তি বর্ণনা করার এক বছর আগে সূরা
আহযাবে মেয়েদেরকে গৃহ থেকে বের হতে হলে চাদর মুড়ি দিয়ে এবং ঘোমটা টেনে বের হবার
হুকুম দেয়া হয়েছিল। মুসলমান মেয়েদের জন্য যে
নবীর গৃহ ছিল আদর্শ গৃহ সেখানে বসবাসকারী মহিলাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, নিজেদের গৃহ মধ্যে মর্যাদা ও
প্রশান্তি সহকারে বসে থাকো, নিজেদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার
প্রদর্শনী করে বেড়িও না এবং বাইরের পুরুষরা তোমাদের থেকে কোন জিনিস নিলে যেন
পর্দার আড়াল থেকে নেয়। দেখতে দেখতে এ আদর্শ সমস্ত মু’মিন মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কাছে জাহেলী যুগের নির্লজ্জ মহিলারা নয়
বরং নবীর সা. স্ত্রী ও কন্যাগণই ছিলেন অনুসরণযোগ্য। অনুরূপভাবে ফৌজদারী আইনের শাস্তি নির্ধারণ করার আগে নারী ও
পুরুষের অবাধ মিশ্রিত সামাজিকতা বন্ধ করা হয়, নারীদের সাজসজ্জা করে বাইরে বের হওয়া বন্ধ
করা হয় এবং যে সমস্ত কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণ যিনার সুযোগ-সুবিধা তৈরী করে দেয়
সেগুলোর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসবের পরে যখন যিনার ফৌজদারী তথা অপরাধমূলক শাস্তি নির্ধারণ করা হয় তখন দেখা
যায় এর সাথে সাথে এ সূরা নূরেই অশ্লীলতার সম্প্রসারণেও বাধা দেয়া হচ্ছে। পতিতাবৃত্তিকে (Prostitution) আইনগতভাবে বন্ধ
করা হচ্ছে। নারী ও পুরুষদের বিরুদ্ধে
বিনা প্রমাণে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া এবং তার আলোচনা করার জন্যও কঠোর শাস্তির বিধান
দেয়া হচ্ছে। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত করার
হুকুম দিয়ে চোখকে প্রহরাধীন রাখা হচ্ছে, যাতে দৃষ্টি বিনিময় সৌন্দর্যের প্রতি
আকর্ষণ সৃষ্টি এবং সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ কামচর্চায় পৌঁছতে না পারে। এ সঙ্গে নারীদেরকে নিজেদের ঘরে মাহ্রাম ও
গায়ের মাহ্রাম আত্মীয়দের মধ্যে পার্থক্য করার এবং গায়ের মাহ্রামদের সামনে সেজেগুজে
না আসার হুকুম দেয়া হচ্ছে। এ থেকে যে সংস্কার পরিকল্পনার একটি অংশ হিসেবে যিনার আইনগত শাস্তি নির্ধারণ
করা হয়েছে তার সমগ্র অবয়বটি অনুধাবন করা যেতে পারে। ভিতর-বাইরের যাবতীয় সংশোধন ব্যবস্থা অবলম্বন করা সত্ত্বেও
যেসব দুষ্ট প্রকৃতির লোক প্রকাশ্য বৈধ সুযোগ বাদ দিয়ে অবৈধ পথ অবলম্বন করে নিজেদের
প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ করার ওপর জোর দেয় তাদেরকে চরম শাস্তি দেবার এবং একজন
ব্যভিচারীকে শাস্তি দিয়ে সমাজের এ ধরনের প্রবৃত্তির অধিকারী বহু সংখ্যক লোকের
মানসিক অপারেশন করার জন্য এ শাস্তি। এ শাস্তি নিছক একজন অপরাধীর শাস্তির নয় বরং এটি একটি কার্যকর ঘোষণা যে, মুসলিম সমাজ ব্যভিচারীদের অবাধ
বিচরণস্থল নয় এবং এটি স্বাদ আস্বাদনকারী পুরুষ ও নারীদের নৈতিক বাঁধনমুক্ত হয়ে
যথেচ্ছা আমোদ ফুর্তি করার জায়গাও নয়। এ দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি ইসলামের এ সংস্কার পরিকল্পনা
অনুধাবন করতে চাইলে সহজে অনুভব করেন যে, এ সমগ্র পরিকল্পনার একটি অংশকেও তার নিজের
জায়গা থেকে সরানো যেতে পারে না এবং এর মধ্যে কোন কম-বেশীও করা যেতে পারে না। এর মধ্যে রদবদল করার চিন্তা করতে পারে এমন
একজন অজ্ঞ-নাদান, যে একে অনুধাবন করার যোগ্যতা ছাড়াই এর সংশোধনকারী ও সংস্কারক হয়ে বসেছে
অথবা মহাজ্ঞানী আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে এ পরিকল্পনাটি দিয়েছেন তা পরিবর্তন করাই যার
আসল নিয়ত এমন একজন বিপর্যয় সৃষ্টিকারীই এ চিন্তা করতে পারে।
পাঁচঃ তৃতীয় হিজরীতেই তো যিনাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা
হয়েছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত এটি
একটি আইনগত অপরাধ ছিল না।
রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও বিচার বিভাগ এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতো না। বরং তখন এটি ছিল একটি “সামাজিক” বা
“পারিবারিক” অপরাধ। পরিবারের লোকদেরই এর
বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ইখতিয়ার ছিল। হুকুম ছিল, যদি চার জন সাক্ষী এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে,
তারা একটি পুরুষ ও একটি মেয়েকে যিনা করতে দেখেছে তাহলে তাদের
দু’জনকে মারধর করতে হবে এবং মেয়েটিকে গৃহবন্দী করতে হবে। এ সঙ্গে এ ইশারাও করে দেয়া হয়েছিল যে, “পরবর্তী হুকুম” না দেয়া
পর্যন্ত হুকুমটি জারি থাকবে। আসল আইন পরে আসছে।
(দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নিসা, ১৫ ও ১৬ আয়াত এবং এ সঙ্গে টীকাও) এর
আড়াই তিন বছর পর সূরা নূরের এ আয়াত নাযিল হয়। কাজেই এটি আগের হুকুম রহিত করে যিনাকে একটি রাষ্ট্রের
হস্তক্ষেপ যোগ্য (Cognizable
Offence) আইনগত অপরাধ গণ্য করে।
ছয়ঃ এ আয়াতে যিনার যে শাস্তি নির্ধারণ করা হয় তা আসলে “নিছক
যিনা”র শাস্তি, বিবাহিতের যিনার শাস্তি নয়। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে এ বিবাহিতের যিনা কঠিনতর অপরাধ। একথা কুরআনের একটি ইশারা থেকে জানা যায় যে, সে এখানে এমন একটি যিনার
শাস্তি বর্ণনা করছে যার উভয় পক্ষ অবিবাহিত। সূরা নিসায় ইতিপূর্বে বলা হয়ঃ
وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ
نِسَائِكُمْ...............................أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ
سَبِيلًا
“তোমাদের নারীদের মধ্য থেকে যারা ব্যভিচারের অপরাধ করবে তাদের ওপর তোমাদের
নিজেদের মধ্য থেকে চার জনের সাক্ষ্য নাও। আর যদি তারা সাক্ষ্য দিয়ে দেয় তাহলে এরপর তাদেরকে (অপরাধী
নারীদেরকে) ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখে দাও, যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু এসে যায় অথবা
আল্লাহ তাদের জন্য বের করে দেন কোন পথ।” (১৫ আয়াত)
এরপর কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বলা হয়ঃ
وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ
مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِنْ مَا
مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ فَتَيَاتِكُمُ
الْمُؤْمِنَاتِ....................فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ
فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মু’মিনদের মধ্য থেকে স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার
ক্ষমতা রাখে না, তারা তোমাদের মু’মিন বাঁদীদেরকে বিয়ে করবে। .......... তারপর যদি (ঐ বাঁদীরা) বিবাহিত হয়ে
যাবার পর ব্যভিচার করে, তাহলে তাদের শাস্তি (এ ধরনের অপরাধে) স্বাধীন নারীদের তুলনায় অর্ধেক দিতে
হবে। (২৫ আয়াত)
এর মধ্যে প্রথম আয়াতে আশা দেয়া হয়েছে যে, ব্যভিচারিণীদের জন্য, যাদেরকে আপাততঃ বন্দী করার হুকুম দেয়া হচ্ছে, আল্লাহ
পরে কোন পথ বের করে দেবেন। এ থেকে জানা যায়, সূরা নিসার ওপরে উল্লেখিত আয়াতে যে ওয়াদা করা হয়েছিল এ দ্বিতীয় হুকুমটির
মাধ্যমে সে ওয়াদা পূরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে বিবাহিতা বাঁদীর যিনার শাস্তি বর্ণনা করা
হয়েছে। এখানে একই আয়াতে এবং একই
বর্ণনাধারায় দু’বার “মুহ্সানাত” তথা স্বাধীন নারী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আর উভয়
জায়গায়ই এর অর্থ একই, একথা অবশ্য মানতেই হবে। এবার শুরুর দিকের বাক্যাংশ দেখুন, সেখানে বলা হচ্ছে, যারা
“মুহ্সানাতদের” বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে না। অবশ্যই এখানে “মুহ্সানাত” মানে বিবাহিতা নারী হতে পারে না
বরং এর মানে হতে পারে, একটি স্বাধীন পরিবারের অবিবাহিতা নারী। তারপর শেষের বাক্যাংশে বলা হচ্ছে, বাঁদী বিবাহিতা হবার পর যদি
যিনা করে, তাহলে এ অপরাধে মুহ্সানাতের যে শাস্তি হওয়া উচিত
তার শাস্তি হবে তার অর্ধেক। পরবর্তী আলোচনা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, প্রথম বাক্যাংশে “মুহ্সানাত”
অর্থ যা ছিল এ বাক্যাংশেও তার অর্থ সে একই অর্থাৎ বিবাহিতা নয় বরং স্বাধীন পরিবারে
লালিত-পালিত অবিবাহিতা নারী। এভাবে সূরা নিসার এ দু’টি আয়াতে একত্র হয়ে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে যে, সেখানে অবিবাহিতাদের যিনার
শাস্তির কথা বর্ণনার যে ওয়াদা করা হয়েছিল সূরা নূরের এ হুকুমটি সে কথাই বর্ণনা
করছে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য
দেখুন, তাফহীমুল
কুরআন, সূরা নিসা, ৪৬ টীকা)
সাতঃ বিবাহিতের যিনার শাস্তি কি, একথা কুরআন মজীদ থেকে নয় বরং
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত, নবী সা. কেবল মুখেই এর শাস্তি রজম
(প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু) বর্ণনা করেননি বরং কার্যত বহু সংখ্যক মোকদ্দমায় তিনি এ
শাস্তি জারিও করেন। তাঁর পরে চার খোলাফায়ে রাশেদীনও নিজ নিজ যুগে এ শাস্তি জারি করেন এবং আইনগত
শাস্তি হিসেবে বারবার এরই ঘোষণা দেন। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ ছিলেন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। কোন এক ব্যক্তিরও এমন একটি উক্তি পাওয়া যায় না যা থেকে
একথা প্রমাণ হতে পারে যে, প্রথম যুগে এর প্রমাণিত শরয়ী’ হুকুম হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল। তাঁদের পরে সকল যুগের ও দেশের ইসলামী ফকীহগণ
এর একটি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত হবার ব্যাপারে একমত ছিলেন। কারণ এর নির্ভুলতার সপক্ষে এত বিপুলসংখ্যক ও
শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে যার উপস্থিতিতে কোন তত্ত্বজ্ঞানী একথা অস্বীকার করতে পারেন
না। উম্মতে মুসলিমার সমগ্র
ইতিহাসে খারেজী ও কোন কোন মুতাজিলী ছাড়া কেউই একথা অস্বীকার করেননি। খারেজী ও মুতাজিলাদের অস্বীকৃতির কারণ এটা নয়
যে, তারা নবী সা.
থেকে এর প্রমাণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। বরং তারা একে কুরআন বিরোধী গণ্য করতেন। অথচ এটি ছিল তাঁদের নিজেদের কুরআন অনুধাবনের
ত্রুটি। তাঁরা বলতেন, কুরআন الزَّانِي وَالزَّانِيَةُ এর একচ্ছত্র শর্তহীন শব্দ ব্যবহার করে এর
শাস্তি বর্ণনা করে একশ’ বেত্রাঘাত। কাজেই কুরআনের দৃষ্টিতে সকল প্রকার ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর শাস্তি এটিই এবং
এ থেকে বিবাহিত ব্যভিচারীকে পৃথক করে তার জন্য কোন ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা করা
আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তাঁরা এ কথা চিন্তা করেননি যে, কুরআনের শব্দাবলীর যে আইনগত
গুরুত্ব রয়েছে সে একই গুরুত্বের অধিকারী হচ্ছে তাদের উদ্ধৃত নবী সা. এর ব্যাখ্যাও। তবে এখানে শর্ত শুধু হচ্ছে এই যে, এ ব্যাখ্যা যে তাঁরই একথা
প্রমাণিত হতে হবে।
কুরআন এ ধরনের ব্যাপক ও একচ্ছত্র অর্থবোধক শব্দের মাধ্যমে السَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ তথা পুরুষ চোর ও মেয়ে চোরের শাস্তি হিসেবে
হাত কাটার বিধান দিয়েছেন। এ
বিধানকেও যদি নবী সা. এর প্রমাণিত ব্যাখ্যাসমূহের নিয়ন্ত্রণাধীন না করা হয় তাহলে
এর শব্দাবলীর ব্যাপকতার দাবী হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তি সামান্য একটু সুঁই বা কুল
চুরি করলেও তাকে চোর আখ্যা দিয়ে তার হাতটি একেবারে কাঁধের কাছ থেকে কেটে দেয়া হবে। অন্যদিকে লাখ লাখ টাকা চুরি করার পরও যদি এক
ব্যক্তি পাকড়াও হয়ে বলে, আমি নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছি এবং ভবিষ্যতে আমি আর চুরি করবো না,
চুরি থেকে আমি তাওবা করে নিলাম তাহলে এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যি ছেড়ে
দিতে হবে। কারণ কুরআন বলছেঃ
فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ
فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ
“যে ব্যক্তি জুলুম করার পরে তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে নেন।” (মায়েদাহ, ৩৯)
এভাবে কুরআন শুধুমাত্র দুধ-মা ও বোনকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছে, দুধ-কন্যাকে বিয়ে এ যুক্তির
প্রেক্ষিতে কুরআন বিরোধী হওয়া উচিত। কুরআন কেবলমাত্র দুই বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করা নিষেধ করেছে। খালা-ভাগনী এবং ফুফী–ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে
করাকে যে ব্যক্তি হারাম বলে তার বিরুদ্ধে কুরআন বিরোধী হুকুম দিচ্ছে বলে অভিযোগ
আনতে হবে। কুরআন সৎ-মেয়েকে বিয়ে করা
শুধুমাত্র তখনই হারাম করে যখন সে তার সৎ-পিতার ঘরে প্রতিপালিত হয়। শর্তহীন ও একচ্ছত্রভাবে এর হারাম হওয়ার বিষয়টি
কুরআন বিরোধী গণ্য হওয়া উচিত। কুরআন শুধুমাত্র এমন অবস্থায় ‘রেহেন’ রাখার অনুমতি দেয় যখন মানুষ বিদেশে
সফররত থাকে এবং ঋণ সংক্রান্ত দলিলপত্র লেখার লোক পাওয়া না যায়। দেশে অবস্থানকালে এবং দলিলপত্র লেখার লোক
পাওয়া গেলে এ অবস্থায় রেহেন রাখার বৈধতা কুরআন বিরোধী হওয়া উচিত। কুরআন সাধারণ ও ব্যাপক অর্থবোধক শব্দের
মাধ্যমে হুকুম দেয়ঃ وَأَشْهِدُوا إِذَا
تَبَايَعْتُمْ (অর্থাৎ পরস্পরের মধ্যে কেনাবেচা করার সময়
সাক্ষী রাখো)।
এ প্রেক্ষিতে আমাদের হাটে-বাজারে-দোকানে দিনরাত বিনা সাক্ষী প্রমাণে যেসব
কেনাবেচা হচ্ছে সেসবই অবৈধ হওয়া উচিত। এখানে গুটিকয় মাত্র দৃষ্টান্ত পেশ করলাম। এগুলোর ওপর চোখ বুলালে রজম তথা প্রস্তরাঘাতে
মৃত্যুদণ্ডকে যারা কুরআন বিরোধী বলেন, তাদের যুক্তির গলদ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। শরীয়াতী ব্যবস্থায় নবীর দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর হুকুম
পৌঁছিয়ে দেবার পর আমাদের জানাবেন তার অর্থ কি, তা কার্যকর
করার পদ্ধতি কি, কোন্ কোন্ বিষয়ে তা প্রযোজ্য হবে এবং
কোন্ কোন্ বিষয়ে প্রযোজ্য হবে না। ইসলামী শরীয়াতে নবীর এ মর্যাদা অনস্বীকার্য। নবীর এ মর্যাদা ও পদাধিকার অস্বীকার করা
শুধুমাত্র দীনের মূলনীতিরই অস্বীকার নয় বরং এর ফলে অগণিত বাস্তব ত্রুটিও দেখা দেয়।
আটঃ যিনার আইনগত সংজ্ঞা নির্দেশের ক্ষেত্রে ফকীহগণের মধ্যে
মতবিরোধ রয়েছে। হানাফীগণ এর সংজ্ঞা বর্ণনা
করে বলেন, কোন পুরুষের এমন কোন নারীর সাথে সম্মুখ দ্বার দিয়ে সঙ্গম করা যে তার
বিয়ে করা স্ত্রী বা মালিকানাধীন বাঁদী নয় এবং যাকে বিবাহিতা স্ত্রী বা মালিকানাধীন
বাঁদী মনে করে সঙ্গম করেছে বলে সন্দেহ পোষণ করার কোন যুক্তিসংগত কারণও যেখানে
নেই।” এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে
পশ্চাদ্বারে সঙ্গম, লূতের সম্প্রদায়ের কর্ম, পশুর সাথে সঙ্গম ইত্যাদির
ওপর যিনার অর্থ প্রযোজ্য হয় না। শুধুমাত্র যখন শরীয়াতে সুস্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট অধিকার ছাড়া নারীর সাথে
সম্মুখদ্বার দিয়ে সঙ্গম করা হয় তখনই তা যিনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিপরীতপক্ষে শাফেঈগণ এর সংজ্ঞা এভাবে বর্ণনা
করেন, “লজ্জাস্থানকে
এমন লজ্জাস্থানে প্রবেশ করানো যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে হারাম কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে
যেদিকে আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।” আর মালেকীদের মতে এর সংজ্ঞা হচ্ছে, “শরীয়াত নির্ধারিত সুস্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট
অধিকার ছাড়া সম্মুখদ্বার বা পশ্চাদ্বার দিয়ে পুরুষ বা নারীর সাথে সঙ্গম করা” এ
দু’টি সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে লূতের জাতির কর্মও যিনার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে, এ দু’টি সংজ্ঞাই যিনা শব্দের
পরিচিত ব্যাখ্যার বাইরে পড়ে। কুরআন সবসময় শব্দকে তার পরিচিত ও সাধারণের জন্য সহজবোধ্য অর্থে ব্যবহার করে
থাকে। তবে কখনো আবার সে কোন
শব্দকে তার বিশেষ পরিভাষায় পরিণত করে এবং এ অবস্থায় সে নিজেই তার বিশেষ অর্থ
প্রকাশ করে। এখানে যিনা শব্দটিকে কোন
বিশেষ অর্থে ব্যবহার করার কোন লক্ষণ নেই। কাজেই একে পরিচিত অর্থেই গ্রহণ করা হবে। আর এ অর্থটি নারীর সাথে স্বাভাবিক কিন্তু অবৈধ
সম্পর্ক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যৌন কামনা চরিতার্থ করার অন্যান্য উপায় ও অবস্থা পর্যন্ত এটি বিস্তৃত নয়। এছাড়া একথাও সবার জানা যে, লূতের জাতির কুকর্ম তথা
সমকামের শাস্তির ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। এ কর্মটিকেও যদি ইসলামী পরিভাষার দৃষ্টিতে
যিনার মধ্যে শামিল করা হতো, তাহলে একথা সুস্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে মতবিরোধের কোন
অবকাশই থাকতো না।
নয়ঃ আইনগতভাবে একটি যিনা কর্মকে শাস্তিযোগ্য গণ্য করার জন্য
কেবলমাত্র পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ প্রবেশ করানোটাই যথেষ্ট, সম্পূর্ণ প্রবেশ বা ক্রিয়া
সম্পন্ন হওয়া এজন্য জরুরী নয়। পক্ষান্তরে যদি পুরুষাঙ্গ প্রবেশ না করে, তাহলে নিছক এক বিছানায় দু’জনকে পাওয়া অথবা
জড়াজড়ি করতে দেখা কিংবা উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া কাউকে যিনাকারী গণ্য করার জন্য যথেষ্ট
নয়। আবার কোন দু’জন নারী
পুরুষকে এ অবস্থায় পেলে তাদের ডাক্তারী পরীক্ষা করার মাধ্যমে যিনার প্রমাণ পেশ করে
তাদের বিরুদ্ধে যিনার শাস্তি প্রয়োগ করার কথাও ইসলামী শরীয়াত বলে না। যাদেরকে এ ধরনের অশ্লীল কাজে লিপ্ত পাওয়া যাবে
তাদেরকে নিছক এমন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে, যার ফায়সালা করবেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
আদালতের বিচারপতি নিজেই অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের মজলিসে শূরা তাদের জন্য কোন শাস্তি
নির্ধারণ করবেন। এ
শাস্তি বেত্রাঘাতের আকারে হলে তা দশ ঘা’র বেশী হবে না। কারণ হাদীসে পরিষ্কার বলা হয়েছেঃ
لَا يُجْلَدُ فَوْقَ عَشْرِ جَلَدَاتٍ إِلَّا فِي
حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ
“আল্লাহ নির্ধারিত শাস্তি ছাড়া অন্য যে কোন অপরাধে দশ বেত্রাঘাতের বেশী
শাস্তি দিয়ো না।”
(বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)
আর যদি কোন ব্যক্তি পাকড়াও হয়নি বরং নিজেই লজ্জিত হয়ে এ ধরনের কোন অপরাধের কথা
স্বীকার করে, তাহলে তার জন্য শুধুমাত্র তাওবা করার নির্দেশ দেয়াই যথেষ্ট। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বললেনঃ
“নগরের বাইরে আমি একটা নারীর সাথে সঙ্গম ছাড়া সবকিছু করে ফেলেছি। এখন জনাব আপনি আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিন।” হযরত উমর রা. বললেনঃ “আল্লাহ যখন গোপন করে
দিয়েছিলেন তখন তুমিও গোপন থাকতে দিতে।” নবী সা. সবকিছু শোনার পর নীরব থাকলেন এবং সে ব্যক্তি চলে গেলেন। তারপর তিনি তাকে ফিরিয়ে আনলেন এবং এ আয়াতটি
পড়লেনঃ
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ
وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ
“নামায কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে এবং কিছু রাত অতিক্রান্ত হবার পর। অবশ্যই সৎকাজ অসৎকাজগুলোকে দূর করে দেয়।” (হূদ, ১১৪)
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি শুধু তারই জন্য” নবী সা. বললেন, “না, সবার জন্য।” (মুসলিম, তিরমিযী, আবুদ দাউদ, নাসায়ী) শুধু এতটুকুই নয়, কোন ব্যক্তি অপরাধের
বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে না দিয়ে যদি নিজের অপরাধী হবার স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এ অবস্থায় অনুসন্ধান চালিয়ে সে কি অপরাধ করেছে তা জানতে চাওয়াটাও
শরীয়াত বৈধ করেনি।
নবী সা. এর খিদমতে এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি দণ্ড লাভের অধিকারী
হয়ে গেছি, আমাকে শাস্তি দিন।” কিন্তু তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন না, তুমি কোন্ দণ্ড লাভের অধিকারী
হয়েছো? তারপর নামায শেষ হবার পর ঐ ব্যক্তি আবার উঠে বললেন,
“আমি অপরাধী, আমাকে শাস্তি দিন।” রাসূললুল্লাহ সা. বললেন, “তুমি কি এখনই আমাদের সাথে
নামায পড়নি?” জবাব দিলেন “জি হ্যাঁ”। বললেন, “ব্যস, তাহলে আল্লাহ
তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন।” (বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ)।
দশঃ কোন ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য কেবলমাত্র সে যিনা
করেছে এতটুকু যথেষ্ট নয়।
বরং এজন্য অপরাধীর মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে। নিছক যিনার ক্ষেত্রে এ শর্তগুলো এক ধরনের এবং বিবাহিতের
যিনার ক্ষেত্রে এগুলো আবার ভিন্ন ধরনের।
নিছক যিনার ক্ষেত্রে এ শর্তগুলো হচ্ছে, অপরাধী হবে জ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্ক। যদি কোন বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগল বা শিশু এ কর্ম করে
তাহলে তার ওপর যিনার শাস্তি প্রযুক্ত হবে না।
বিবাহিতের যিনার জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন হবার সাথে সাথে আরো
কয়েকটি শর্তও রয়েছে।
নিচে আমি এগুলো বর্ণনা করছিঃ
প্রথম শর্ত হচ্ছে, অপরাধীকে স্বাধীন হতে হবে। এ শর্তটির ব্যাপারে সবাই একমত। কারণ কুরআন নিজেই ইঙ্গিত করছে, গোলামকে রজমের শাস্তি দেয়া
যাবে না। একটু আগেই একথা আলোচনা
হয়েছে যে, বাঁদী যদি বিয়ের পর যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে তাকে অবিবাহিতা স্বাধীন নারীর
তুলনায় অর্ধেক শাস্তি দেয়া উচিত। ফকীহগণ স্বীকার করেছেন কুরআনের এ বিধানটিই গোলামের ওপরও
প্রযুক্ত হবে।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, অপরাধীকে যথারীতি বিবাহিত হতে হবে। এ শর্তটির ব্যাপারেও সবাই একমত। আর এ শর্তটির প্রেক্ষিতে যে ব্যক্তি নিজের বাঁদীর সাথে যৌন
সম্পর্ক করেছে অথবা যার বিয়ে হয়েছে কোন গর্হিত পদ্ধতিতে, তাকে বিবাহিত গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ সে যদি যিনা করে তাহলে তাকে রজম নয় বরং
বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে।
তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে, তার নিছক বিয়েই যথেষ্ট নয় বরং বিয়ের পর সঠিক অর্থে স্বামী-স্ত্রীর নিভৃত
মিলনও হতে হবে।
নিছক বিবাহ অনুষ্ঠান কোন পুরুষকে বিবাহিত এবং কোন নারীকে বিবাহিতা করে না যার ফলে
যিনা করার কারণে তাদেরকে রজম করা যেতে পারে। এ শর্তটির ব্যাপারেও অধিকাংশ ফকীহ একমত। তবে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (র) এর
মধ্যে আরো এতটুকু সংযোজন করেন যে, একজন পুরুষ ও নারীকে কেবলমাত্র তখনই বিবাহিত গণ্য করা হবে যখন
বিয়ে ও নিভৃত মিলনের সময় স্বামী স্ত্রী উভয়ই স্বাধীন, প্রাপ্ত
বয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন হবে। এ অতিরিক্ত শর্তের ফলে যেটুকু পার্থক্য দেখা দেয় তা হচ্ছে এই যে, যদি একটি পুরুষের বিয়ে একটি
বাঁদী, উন্মাদ বা অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের সাথে হয় তাহলে এ
অবস্থায় সে নিজের স্ত্রীর সাথে নিভৃত মিলনের স্বাদ গ্রহণ করলেও এরপর যদি সে যিনায়
লিপ্ত হয় তাহলে রজমের শাস্তি লাভের অধিকারী হবে না। নারীর ব্যাপারেও এ একই কথা। সে তার গোলাম, উন্মাদ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক স্বামীর সাথে যৌন
মিলনের স্বাদ গ্রহণ করলেও এর পরে যদি সে যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে রজমের শাস্তি লাভের
অধিকারী হবে না।
ভেবে দেখলে বুঝা যাবে, এই দু’জন বিচক্ষণ প্রতিভাবান ইমামের এই বর্ধিত শর্তটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থ শর্তটি হচ্ছে, অপরাধীকে মুসলমান হতে হবে। এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম আহমাদও
শর্তটি মানেন না।
তাঁদের মতে অসুমলিমও যদি বিয়ে করার পর যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে তাকে রজম করা হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেক এ বিষয়ে
একমত যে, একমাত্র মুসলমানকেই বিয়ে করার পর যিনায় লিপ্ত হলে রজমের শাস্তি দেয়া যেতে
পারে। এর যেসব যুক্তি তাঁরা
দেখিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে সঙ্গত ও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হচ্ছে, এক ব্যক্তিকে প্রস্তরাঘাতে
মৃত্যুর মতো ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে এই যে, সে পূর্ণ “বিবাহিতা” অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও যিনা থেকে বিরত হয় না। বিবাহিত মানে হচ্ছে “নৈতিক দূর্গ পরিবেষ্টিত।” আর তিনটি প্রাচীর এ পরিবেষ্টনকে পূর্ণতা দান
করে। প্রথম প্রাচীর হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান
আনতে হবে। আখেরাতের জবাবদিহির প্রতি
বিশ্বাস রাখতে হবে এবং আল্লাহর শরীয়াতকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয় প্রাচীর হচ্ছে, তাকে সমাজের স্বাধীন ব্যক্তি হতে হবে। সে কারোর গোলাম হবে না। কারণ মালিকের বিধি-নিষেধ মেনে নিয়ে নিজের কামনা পূর্ণ করতে
গিয়ে তাকে বৈধ উপায় অবলম্বনে বাধা পেতে হয় এবং এর ফলে অক্ষমতা তাকে গোনাহে লিপ্ত
করতে পারে। কোন পরিবারও তার চরিত্র ও
মান-সম্মান রক্ষায় সাহায্যকারী হয় না। আর তৃতীয় প্রাচীর হচ্ছে, তার বিয়ে হয়ে গেছে এবং নিজের কামনা পূর্ণ করার বৈধ উপায় তার
করায়ত্ত্ব আছে। এ
তিনটি প্রাচীরের অস্তিত্ব যখন বিদ্যমান থাকে তখনই “দূর্গ পরিবেষ্টন” পূর্ণতা লাভ
করে এবং তখনই যে ব্যক্তি অবৈধ যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য এ ধরনের তিন তিনটি
প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে সে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু বরণের যোগ্য গণ্য হতে পারে। কিন্তু যেখানে প্রথম ও সবচেয়ে বড় প্রাচীর
অর্থাৎ পরকাল ও আল্লাহর আইনের প্রতি বিশ্বাসই উপস্থিত নেই সেখানে নিশ্চিতভাবেই
দূর্গ পরিবেষ্টন পূর্ণতা করেনি এবং এ কারণে চরিত্রহীনতার অপরাধ এমন মারাত্মক
পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি যা তাকে চরম শাস্তির অধিকারী করে। ইসহাক ইবনে রাহাওয়াহ তাঁর মুসনাদে এবং দারুকুত্নী তাঁর
সুনান গ্রন্থে ইবনে উমরের রা. যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন সেটি এ যুক্তিকে সমর্থন
করে। হাদীসটিতে বলা হয়েছে مَنْ أَشْرَكَ بِاللهِ فَلَيْسَ بِمُحْصَنٍ “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ক
করেছে সে ‘মুহসিন’ নয়।” যদিও এ হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. নবী সা. এর উক্তির পুনরাবৃত্তি
করেছেন, না নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে কিন্তু এ দুর্বলতা সত্ত্বেও মূল
অর্থের দিক দিয়ে এর বিষয়বস্তু অত্যন্ত শক্তিশালী। এর জবাবে ইহুদীদের একটি মোকদ্দমা থেকে যুক্তি পেশ করা হয়
যাতে নবী সা. রজম করার বিধান প্রয়োগ করেছিলেন, তাহলে আমি বলবো, এ
যুক্তি সঠিক নয়।
কারণ ঐ মোকদ্দমা সম্পর্কিত সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস একত্র করলে পরিষ্কার জানা যায়
যে, সেখানে নবী সা.
তাদের ওপর ইসলামের প্রচলিত আইন (Law of the Land) নয়,
তাদের নিজেদের ধর্মীয় আইন (Personal law) প্রয়োগ
করেছিলেন। বুখারী ও মুসলিম একযোগে এ
হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, যখন এ মোকদ্দমা রসূলের কাছে আনা হলো তখন তিনি ইহুদীদের জিজ্ঞেস করলেনঃ مَا تَجِدُونَ فِي التَّوْرَاةِ
مِنْ شَأْنِ الرَّجْمِ يَا مَا تَجِدُونَ فِي كِتَابِكُمْ অর্থাৎ “তোমাদের নিজেদের কিতাব তাওরাতে এর কি
বিধান প্রদত্ত হয়েছে? ”
তারপর যখন একথা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, তাদের
সমাজে রজমের বিধান আছে তখন তিনি বললেনঃ فَإِنِّى أَحْكُمُ بِمَا فِى
التَّوْرَاةِ “আমি সেই ফায়সালা দিচ্ছি যা
তাওরাতে আছে।”
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি এ মোকদ্দমার ফায়সালা দিতে গিয়ে বলেনঃ اللَّهُمَّ إِنِّى أَوَّلُ
مَنْ أَحْيَا أَمْرَكَ إِذْ أَمَاتُوهُ “হে আল্লাহ! আমি প্রথম ব্যক্তি যে তোমার
হুকুমকে জীবিত করেছে যখন তারা তাকে মেরে ফেলেছিল।” (মুসলিম, আবু দাউদ, আহমাদ)
এগারঃ যিনাকারীকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য তার নিজের ইচ্ছায়
কাজটি করাও জরুরী। জোর জবরদস্তি যদি কাউকে এ
কাজ করতে বাধ্য করা হয়ে থাকে তাহলে সে অপরাধীও নয় এবং শাস্তিরও যোগ্য নয়। এ ব্যাপারে কেবল শরীয়াতের এ সাধারণ নিয়মই
প্রযোজ্য হয় না যে, “বলপূর্বক কাউকে দিয়ে কোন কাজ করানো হলে তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে সে
মুক্ত থাকে” বরং এ সূরায়ই সামনের দিকে গিয়ে কুরআন এমন মেয়েদের ক্ষমার কথা ঘোষণা
করছে যাদেরকে যিনা করতে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে
যে, বলপূর্বক
যিনা করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যে বল প্রয়োগ করে যিনা করেছে তাকেই শাস্তি দেয়া
হয়েছে এবং যার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছিল তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তিরমিযী ও আবু দাউদের বর্ণনা হচ্ছে জনৈকা
মহিলা অন্ধকারের মধ্যে নামাযের জন্য বের হন। পথে এক ব্যক্তি তাকে পাকড়াও করে বলপূর্বক তার সতীত্ব হরণ
করে। তার চিৎকারে লোকেরা দৌড়ে
এসে যিনাকারীকে ধরে ফেলে।
নবী সা. তাকে রজম করান এবং মহিলাটিকে মুক্তি দেন। বুখারীর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, হযরত উমরের রা. খিলাফতকালে এক
ব্যক্তি একটি মেয়ের সাথে জোরপূর্বক যিনা করে। তিনি লোকটিকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন এবং মেয়েটিকে ছেড়ে
দেন। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে
নারীদের ব্যাপারে আইনের ক্ষেত্রে ঐকমত্য রয়েছে কিন্তু মতবিরোধ দেখা দিয়েছে পুরুষের
ক্ষেত্রে। এ ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম হাসান ইবনে সালেহ বলেন, পুরুষকেও
যদি যিনা করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া হবে। ইমাম যুফার বলেন, তাকে মাফ করা হবে না। কারণ সে অঙ্গ সঞ্চালন না করলে এ কর্মটি সংঘটিত
হওয়াই সম্ভব নয় এবং তার অঙ্গ সঞ্চালনই একথা প্রমাণ করে যে, তার নিজের যৌন কামনা এ কর্মের
উদ্যোক্তা হয়েছিল।
ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি সরকার বা তার কোন প্রশাসক কোন ব্যক্তিকে যিনা করতে বাধ্য করে থাকে
তাহলে যিনাকারীকে শাস্তি দেয়া হবে না। কারণ যখন সরকারই অপরাধ করতে বাধ্য করছে তখন তার শাস্তি
দেবার অধিকার থাকে না।
কিন্তু যদি সরকার ছাড়া অন্য কেউ বাধ্য করে থাকে তাহলে যিনাকারীকে শাস্তি দেয়া হবে। কারণ নিজের যৌন কামনা ছাড়া অবশ্যই সে যিনা
করতে পারে না এবং যৌন কামনা জোরপূর্বক সৃষ্টি করা যেতে পারে না। এ তিনটি বক্তব্যের মধ্যে প্রথম বক্তব্যটিই
সবচেয়ে বেশী সঠিক। এর যুক্তি হচ্ছে, অঙ্গ সঞ্চালন যৌন কামনার
প্রমাণ হতে পারে কিন্তু সম্মতি ও মানসিক আকাঙ্ক্ষার অপরিহার্য প্রমাণ নয়। মনে করুন, কোন জালেম এক শরীফ ব্যক্তিকে জোর পূর্বক
গ্রেফতার করে বন্দি করে এবং তার সাথে একটি সুন্দরী মেয়েকেও উলঙ্গ করে একই কামরায়
আটকে রাখে। ঐ মেয়ের সাথে যিনায় লিপ্ত
না হওয়া পর্যন্ত সে তাকে মুক্তি দেয় না। এ অবস্থায় যদি তারা দু’জন যিনায় লিপ্ত হয়ে যায় এবং ঐ জালেম
ঘটনার চার জন্য সাক্ষীসহ তাদেরকে আদালতে হাযির করে, তাহলে তাদের বাস্তব অবস্থায়
উপেক্ষা করে তাদরেকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দান অথবা বেত্রাঘাত করার শাস্তি কি
ন্যায়সঙ্গত হবে? এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়া যুক্তি ও
বাস্তবতা--- উভয়ের নিরিখেই সম্ভব যাতে যৌন কামনার উদ্রেক ঘটতে পারে কিন্তু মানুষের
নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ তার সহযোগী হয় না। যদি কোন ব্যক্তিকে বন্দী করে কারাগারে আবদ্ধ রেখে তাকে পান
করার জন্য শরাব ছাড়া আর কিছুই দেয়া না হয় এবং এ অবস্থায় সে শরাব পান করে, তাহলে নিছক এ যুক্তিতে কি তাকে
শাস্তি দেয়া যেতে পারে যে, তার জন্য তো অবশ্যই বাধ্যবাধকতার
অবস্থা ছিল ঠিকই কিন্তু নিজের ইচ্ছা ছাড়া তো গলার মধ্য দিয়ে শরাবের তরল পদার্থ সে
নীচের দিকে নামাতে পারতো না? অপরাধ ঘটার জন্য কেবলমাত্র
ইচ্ছা থাকা যথেষ্ট নয় বরং এজন্য স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োজন। যে ব্যক্তিকে জবরদস্তি এমন এক অবস্থার
মুখোমুখি করানো হয় যার ফলে সে অপরাধ করার সংকল্প করতে বাধ্য হয়, সে কোন কোন অবস্থায় তো
একেবারেই অপরাধী হয় না এবং কোন কোন অবস্থায় তার অপরাধ অতি সামান্যই হয়ে থাকে।
বারোঃ ইসলামী আইন সরকার ছাড়া আর কাউকেই যিনাকারী ও যিনাকারীর
বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয় না। সে আদালত ছাড়া আর কাউকেই তাদেরকে শাস্তি দেবার অধিকার দেয়
না। আলোচ্য আয়াতে “তাদেরকে
বেত্রাঘাত করো” শব্দাবলীর মাধ্যমে জনগণকে নয় বরং রাষ্ট্রীয় শাসকবৃন্দ ও
বিচারপতিগণকে সম্বোধন করা হয়েছে, এ ব্যাপারে উম্মতের সকল ফকীহ একমত। তবে গোলামদের ক্ষেত্রে মতবিরোধ রয়েছে। তার প্রভু এ ব্যাপারে তাকে শাস্তি দিতে পারে
কিনা এ প্রশ্নে সবাই একমত নয়। হানাফী মাযহাবের সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, প্রভু গোলামকে শাস্তি দিতে
পারে না। শাফেঈ ইমামগণ বলেন, তাদের সে ক্ষমতা আছে। আর মালেকীগণ বলেন, চুরির অপরাধে প্রভু গোলামদের
হাত কাটার অধিকার রাখে না কিন্তু যিনা, সতীসাধ্বী নারীর
বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও শরাব পানের শাস্তি দিতে পারে।
তেরোঃ ইসলামী আইন যিনার শাস্তিকে রাষ্ট্রীয় আইনের একটি অংশ গণ্য
করে। তাই মুসলিম অমুসলিম
নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ওপর এ আইন জারি হবে। এ ব্যাপারে একমাত্র ইমাম মালেক ছাড়া সম্ভবত ইমামদের মধ্য
থেকে আর কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেননি। রজমের শাস্তি অমুসলিমদের ওপর প্রয়োগ করার প্রশ্নে ইমাম আবু হানীফার যে
মতবিরোধ তার ভিত্তি এ নয় যে, এটি রাষ্ট্রীয় আইন নয়। বরং এ মত বিরোধের ভিত্তি হচ্ছে এই যে, তাঁর মতে রজমের শর্তাবলীর
মধ্যে যিনাকারীর “পূর্ণ বিবাহিত” হওয়া হচ্ছে অন্যতম শর্ত। আর পূর্ণ বিবাহিত হওয়া ইসলাম ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি অমুসলিম যিনাকারীকে রজমের শাস্তির
আওতা বহির্ভূত গণ্য করেন, বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেকের মতে এ হুকুমটি মুসলমানদের জন্য প্রদান করা হয়েছে,
কাফেরদের জন্য নয়। তাই তিনি যিনার দণ্ডবিধিকে মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের (Personal Law) একটি অংশ গণ্য
করেন। আর অন্য দেশ থেকে দারুল
ইসলামে অনুমতি নিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীর ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম শাফেঈ বলেন, সে যদি দারুল ইসলামে যিনায়
লিপ্ত হয়, তাহলে তার ওপর যিনার দণ্ডবিধি জারি করা হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ বলেন, আমরা তার ওপর যিনার দণ্ডবিধি
জারি করতে পারি না।
চৌদ্দঃ কোন ব্যক্তি নিজের অপরাধ নিজ মুখে স্বীকার করবে অথবা কারোর
যিনার কথা যারা জানতে পারে তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শাসকের কাছে অবশ্যই তা পৌঁছাবে, ইসলামী আইন এটা অপরিহার্য গণ্য
করে না। তবে শাসকরা যখন এ অপরাধের
কথা জানতে পারেন তখন আর সেখানে ক্ষমার কোন অবকাশ থাকে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে নবী সা. বলেছেনঃ
مَنْ اَتَى شَيْئًا مِنْ هَذِهِ الْقَاذُوْرَاتِ فَلْيَسْتَتِرْ
بِسِتْرِ اللهِ فَاِن اَبْدَى لَنَا صَفْحَتَهُ اَقِمْنَا عَلَيْهِ كِتَابَ اللهِ
(احكام القران- للجصاص)
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই এসব নোংরা অপরাধগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিতে
লিপ্ত হয়ে যায়, সে যেন আল্লাহর পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে
রাখে। কিন্তু সে যদি আমাদের সামনে
পর্দা উঠায়, তাহলে আমরা তার ওপর আল্লাহর কিতাবের আইন প্রয়োগ করেই ছাড়বো”। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস)
আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, মাঈয ইবনে মালেক আস্লামী অপরাধে জড়িত হয়ে পড়লে হায্যাল ইবনে
নু’আইম তাঁকে বলেন, নবী সা. এর কাছে গিয়ে নিজের অপরাধ
স্বীকার করো।
তাই তিনি গিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিজের অপরাধ বর্ণনা করেন। এর ফলে তিনি একদিকে তাকে রজমের শাস্তি দেন এবং
অন্য দিকে হায্যালকে বলেন, لَوْ سَتَرْتَهُ بِثَوْبِكَ
كَانَ خَيْرًا لَكَ “যদি তুমি তার ওপর পর্দা ফেলে দিতে, তাহলে তোমার জন্য
বেশী ভালো হতো।”
আবু দাউদ ও নাসায়ীতে অন্য একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে নবী সা. বলেনঃ
تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى
مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَبَ
“শাস্তিযোগ্য অপরাধকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমা করে দাও। কিন্তু যে অপরাধের ব্যাপারটি আমার কাছে পৌঁছে
যাবে তার শাস্তি বিধান করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।”
পনেরঃ ইসলামী আইনে এ অপরাধটি পারস্পরিক আপসের মাধ্যমে ফায়সালা করে
নেবার ব্যাপারও নয়। হাদীসের প্রায় সবক’টি
কিতাবে এ ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে যে, একটি ছেলে এক ব্যক্তির কাছে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতো। সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করে বসে। ছেলেটির বাপ একশ ছাগল ও একটি বাঁদি দিয়ে ঐ
ব্যক্তিকে রাজি করিয়ে নেয়। কিন্তু এ মামলাটি যখন নবী সা. এর কাছে আসে তখন তিনি বলেন, أَمَّا غَنَمُكَ وَجَارِيَتُكَ فَرَدٌّ عَلَيْكَ “তোমার ছাগল ও তোমার বাঁদি তুমিই ফিরিয়ে নিয়ে
যাও।” তারপর তিনি যিনাকারী ও
যিনাকারীনী উভয়ের ওপর শরীয়াতের দণ্ডবিধি জারি করেন। এ থেকে কেবল এতটুকুই জানা যায় না যে, এ অপরাধে আপসে রাজি করিয়ে
নেবার কোন অবকাশ নেই। বরং একথাও জানা যায় যে, ইসলামী আইন অর্থদণ্ডের আকারে সতীত্বের বিনিময় দান করা যেতে
পারে না। ইজ্জতের মূল্য প্রদান করার
এ ধরনের জঘন্য ভাবধারা পাশ্চাত্য আইনেরই বৈশিষ্ট্য।
ষোলঃ কোন ব্যক্তির যিনার করার কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলে ইসলামী
রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবে না। অপরাধের প্রমাণ ছাড়া কারোর ব্যভিচার সংক্রান্ত খবর একাধিক
উপায়ে শাসকদের কাছে এসে পৌঁছালেও তারা কোনক্রমেই তার ওপর শরীয়াতের দণ্ডবিধি জারি
করতে পারেন না। মদীনায় একটি মেয়ে ছিল। তার সম্পর্কে বলা হতো, সে ছিল প্রকাশ্য চরিত্রহীনা। বুখারী একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ كَانَتْ تُظْهِرُ فِي الْإِسْلَامِ السُّوءَ “সে ইসলামে অসতীপনার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল।” অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ كَانَتْ قَدْ أَعْلَنَتْ فِي الْإِسْلَامِ “সে ইসলামে প্রকাশ্য অসদাচার করছিল।” আবার ইবনে মাজার একটা হাদীসে বলা হয়েছেঃ فَقَدْ ظَهَرَ فِيهَا الرِّيبَةُ فِى مَنْطِقِهَا وَهَيْئَتِهَا
وَمَنْ يَدْخُلُ عَلَيْهَا “মেয়েটির কথায় ও স্বভাব চরিত্রে এবং তার কাছে
যারা যাওয়া আসা করতো তাদের থেকে সুস্পষ্ট সন্দেহ জেগে উঠেছিল।”
কিন্তু যেহেতু তার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের প্রমাণ ছিল না তাই তাকে কোন শাস্তি
দেয়া হয়নি। অথচ তার সম্পর্কে নবী সা.
এর পবিত্র মুখ থেকেও এ কথা বের হয়ে গিয়েছিল যে, لَوْ كُنْتُ رَاجِمًا أَحَدًا بِغَيْرِ بَيِّنَةٍ لَرَجَمْتُهَا “যদি আমি কাউকে প্রমাণ ছাড়া রজম করতাম তাহলে
ঐ মেয়েটিকে নিশ্চয়ই রজম করতাম।”
সতেরঃ যিনার অপরাধের প্রথম সম্ভাব্য প্রমাণ হচ্ছে এই যে, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ হচ্ছে নিম্নরূপঃ
(ক) কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করে, যিনার জন্য কমপক্ষে চারজন চাক্ষুষ সাক্ষীর
প্রয়োজন। সূরা নিসার ১৫ আয়াতে একথা
বলা হয়েছে। সামনের দিকে এ সূরা নূরেই
দু’জায়গায় একথা আসছে।
সাক্ষী ছাড়া কাযী স্বচক্ষে এ অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও কেবলমাত্র নিজের জ্ঞানের
ভিত্তিতে এ ফায়সালা দিতে পারেন না।
(খ) সাক্ষী হতে হবে এমন সব লোক, ইসলামের সাক্ষ্য আইনের দৃষ্টিতে যারা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত
হয়। যেমন, ইতিপূর্বে কোন মামলায় তারা
মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী প্রমাণিত হয়নি। তারা খেয়ানতকারী নয়। ইতিপূর্বে তারা কখনো শাস্তি পায়নি। অপরাধীর সাথে যাদের কোন শত্রুতা প্রমাণিত হয়নি ইত্যাদি। মোটকথা অনির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে
রজম করা বা কারোর পিঠে বেত্রাঘাত করা যেতে পারে না।
(গ) সাক্ষীদের একথার সাক্ষ্য দিতে হবে যে, তারা অভিযুক্ত নারী ও পুরুষকে সঙ্গমরত
অবস্থায় চাক্ষুষ দেখেছে অর্থাৎ كالْمِيلُ فِي الْمُكْحُلَةِ وَالرِّشَاءُ فِى الْبِئْرِ (এমনভাবে যেমন সুর্মাদানীর মধ্যে
সুর্মা তোলার শলাকা এবং কুয়ার মধ্যে রশি)।
(ঘ) সাক্ষীদের কবে, কখন, কোথায়, কাকে, কার সাথে যিনা করতে দেখেছে এ ব্যাপারে একমত হতে হবে। এ মৌলিক বিষয়গুলোতে মতবিরোধ ঘটলে তাদের
সাক্ষ্য বাতিল হয়ে যাবে।
সাক্ষ্য সম্পর্কিত এ শর্তগুলো স্বতঃই একথা প্রকাশ করছে যে, গোয়েন্দাবৃত্তি করে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে খবর বের করা এবং প্রতিদিন লোকদের পিঠে বেত্রাঘাত করা ইসলামী আইনের
উদ্দেশ্য নয়।
বরং সে এমন অবস্থায় এ ধরনের কঠিন শাস্তি দেয় যখন সব ধরনের সংশোধন ও প্রতিরোধমূলক
ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও ইসলামী সমাজে কোন নারী ও পুরুষ এমন নির্লজ্জ আচরণে
অভ্যস্ত হয়ে ওঠে যে, চার চারজন লোক তাদের অপরাধমূলক তৎপরতা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়।
আঠারঃ স্ত্রীলোকের যখন কোন জানা ও পরিচিত স্বামী বা বাঁদীর
অনুরূপ কোন মনিব থাকে না তখন নিছক তার গর্ভবতী হওয়াটাই তার বিরুদ্ধে যিনা প্রমাণের
জন্য যথেষ্ট পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। হযরত উমরের রা. মতে এ সাক্ষ্য যথেষ্ট। মালেকীগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে, নিছক গর্ভধারণ এতটা মজবুত
পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য নয় যার ভিত্তিতে কাউকে রজম বা কারোর পিঠে একশত বেত্রাঘাত
করা যেতে পারে। এত
বড় শাস্তির জন্য সাক্ষীর উপস্থিতি অথবা অপরাধের স্বীকৃতি অপরিহার্য। ইসলামী আইনের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, সন্দেহ শাস্তির নয় বরং ক্ষমার
উদ্দীপক হবে।
নবী সা. বলেনঃ ادْفَعُوا الْحُدُودَ مَا
وَجَدْتُمْ لَهُا مَدْفَعًا “শাস্তিসমূহ এড়িয়ে চলো যতদূর
সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকে।” (ইবনে মাজাহ) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
ادْرَءُوا الْحُدُودَ عَنِ الْمُسْلِمِينَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
فَإِنْ كَانَ لَهُ مَخْرَجٌ فَخَلُّوا سَبِيلَهُ فَإِنَّ الإِمَامَ أَنْ يُخْطِئَ فِى
الْعَفْة خَيْرٌ مِنْ أَنْ يُخْطِئَ فِى الْعُقُوبَةِ
“মুসলমানদের থেকে যতদূর সম্ভব শাস্তি দূরে রাখো। যদি কোন অপরাধীকে শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেবার
কোন পথ পাওয়া যায় তাহলে তাকে ছেড়ে দাও। কারণ শাসকের ক্ষমা করে দেবার ব্যাপারে ভুল করা তার শাস্তি দেবার ব্যাপারে ভুল
করার চেয়ে ভালো।” (তিরমিযী)
এ নিয়ম অনুযায়ী গর্ভবর্তী হওয়া সন্দেহের জন্য যতই শক্তিশালী ভিত্তি হোক না কেন
তা কোনক্রমেই যিনার নিশ্চিত প্রমাণ নয়। কারণ কোন পুরুষের সাথে সঙ্গম ছাড়াও কোন মেয়ের গর্ভাশয়ে কোন পুরুষের শুক্রের
কোন অংশ পৌঁছে যাওয়ার এক লাখ ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনাও আছে এবং এর ফলে সে গর্ভবতীও
হয়ে যেতে পারে। এতটুকু হালকা সন্দেহও
অপরাধিনীকে ভয়াবহ শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য যথেষ্ট হতে হবে।
উনিশঃ যিনার সাক্ষীদের মধ্যে যদি পার্থক্য দেখা দেয় অথবা অন্য কোন
কারণে তাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত না হয় তাহলে মিথ্যা অপবাদ দেবার
কারণে সাক্ষীরা কি শাস্তি পাবে এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। ফকীহদের একটি দল বলেন, এ অবস্থায় তারা মিথ্যা অপবাদদানকারী গণ্য
হবে এবং তাদেরকে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে। অন্য দলটি বলেন, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না। কারণ তারা সাক্ষী হিসেবে এসেছে, বাদী হিসেবে আসেনি। যদি এভাবে সাক্ষীদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে যিনার সাক্ষ্য দেবার
দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। চারজন সাক্ষীর মধ্য থেকে কেউ বিগড়ে যাবে কিনা এ ব্যাপারে যখন কেউই নিশ্চিত নয়
তখন শাস্তির ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সাক্ষ্য দেবার জন্য এগিয়ে আসবে, কে এমন দায়ে ঠেকেছে? আমার মতে এ দ্বিতীয় মতটিই যুক্তিসঙ্গত। কারণ সন্দেহের ফলে অপরাধীর মতো সাক্ষীদেরও লাভবান হওয়া
উচিত। যদি তাদের সাক্ষ্যের
দুর্বলতা বিবাদীকে যিনার ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে তার সাক্ষীদেরকে মিথ্যা
অপবাদের ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্যও যথেষ্ট না হওয়া উচিত। তবে যদি তাদের মিথ্যুক হওয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে
প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই তারা এ শাস্তি পাবে। প্রথম মতের সমর্থনে দু’টি বড় বড় যুক্তি প্রদান করা হয়ে
থাকে। একটি হচ্ছে, কুরআন যিনার মিথ্যা অপবাদকে
শাস্তিযোগ্য গণ্য করে। কিন্তু এ যুক্তিটি সঠিক নয়। কারণ কুরআন নিজেই মিথ্যা অপবাদদানকারী ( (قاذف) ও সাক্ষীর ( (شاهد) ) মধ্যে পার্থক্য করে। আর আদালত সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট মনে করেনি, শুধুমাত্র এ কারণেই সাক্ষী
মিথ্যা অপবাদদাতা গণ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, মুগীরাহ ইবনে শু’বার রা.
মোকদ্দমায় হযরত উমর রা. আবু বাক্রাহ ও তাঁর দু’সহযোগী সাক্ষীদেরকে মিথ্যা
অপবাদদানের শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ মোকদ্দমার বিস্তারিত বিবরণ দেখলে বুঝা যায়, যেসব মোকদ্দমায় অপরাধ প্রমাণ
করার জন্য সাক্ষ্য অকিঞ্চিৎ প্রমাণিত হয় সে ধরনের প্রত্যেকটি মোকদ্দমার ওপর এ
নজিরটি প্রযোজ্য নয়। মোকদ্দমাটির বিবরণ হচ্ছেঃ বসরার গভর্নর মুগীরাহ ইবনে শু’বার সাথে আবু
বাক্রাহর সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ ছিল। উভয়ের গৃহের অবস্থান ছিল একই পথের পাশে মুখোমুখি। একদিন হঠাৎ দম্কা বাতাসের ঝটকায় উভয়ের গৃহের জানালা খুলে
যায়। আবু বাক্রাহ নিজের জানালা
বন্ধ করতে ওঠেন। তাঁর দৃষ্টি পড়ে সামনের
কামরায়। তিনি হযরত মুগীরাহকে
সঙ্গমরত দেখেন। আবু বাক্রাহর কাছে বসেছিলেন
তার তিন বন্ধু (নাফে’ ইবনে কলাদাহ, যিয়াদ ও শিব্ল ইবনে মা’বাদ)। তিনি বলেন, এসো, দেখো এবং
মুগীরাহ কি করছে তার সাক্ষী থাকো। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেন, এ মেয়েটি কে? আবু
বাক্রাহ বলেন, উম্মে জামীল। পরদিন এ সম্পর্কে হযরত উমরের রা. কাছে অভিযোগনামা পাঠানো
হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই হযরত
মুগীরাহকে সাসপেণ্ড করে হযরত আবু মুসা আশ্আরীকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠিয়ে
দেন এবং অভিযুক্তকে সাক্ষীসহ মদীনায় ডেকে আনেন। খলীফার সামনে পেশ হবার পর আবু বাক্রাহ ও দু’জন সাক্ষী বলেন, আমরা মুগীরাহকে উম্মে জামীলের
সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখেছি। কিন্তু যিয়াদ বলেন, মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা যায়নি এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না সে উম্মে
জামীল ছিল। মুগীরাহ ইবনে শু’বা জেরার
মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন, যেদিক থেকে তারা তাঁদেরকে দেখেছিল সেদিক থেকে তাদের পক্ষে মেয়েটিকে ভালো
করে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি এটাও প্রমাণ করে দেন যে, তাঁর স্ত্রীর ও উম্মে জামীলের মধ্যে
চেহারাগত সাদৃশ্য রয়েছে। ঘটনার পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় যে, হযরত উমরের রা. শাসনামলে একটি
প্রদেশের গভর্নরের পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না যে, তিনি যে
সরকারী গৃহে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন, সেখানে অন্য একটি
মেয়েকে ডেকে এনে যিনা করবেন। এ কারণে মুগীরাহ তার নিজের ঘরে নিজের স্ত্রীর পরিবর্তে উম্মে জামীলের সাথে
সহবাস করছে, আবু বাকরাহ ও তার সাথীদের এ কথা মনে করা একটি নিতান্ত অবাস্তব কু-ধারণা
ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারনেই হযরত উমর রা. কেবলমাত্র অভিযুক্তকেই অভিযোগ মুক্ত করে ক্ষান্ত হননি
বরং আবু বাক্রাহ, নাফে ও শিবলকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তিও প্রদান করেন। এ মামলাটির বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে এ
ফায়সালা করা হয়েছিল। এ
থেকে এরূপ বিধি প্রণয়ন করা যায় না যে, যখনই সাক্ষ্যের মাধ্যমে যিনার অপরাধ
প্রমাণিত হবে না তখনই সাক্ষীদেরকে অবশ্যই মারধর করতে হবে। (মোকদ্দমার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন
আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী, ২য় খণ্ড, ৮৮-৮৯ পৃষ্ঠা)।
বিশঃ সাক্ষ্য ছাড়া আর যে জিনিসটির মাধ্যমে যিনার অপরাধ প্রমাণিত
হতে পারে সেটি হচ্ছে অপরাধীর নিজের স্বীকারোক্তি। যিনার কাজ করা হয়েছে বলে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ
স্বীকারোক্তির শব্দাবলী উচ্চারিত হতে হবে। অর্থাৎ তাকে স্বীকার করতে হবে যে, তার জন্য হারাম ছিল এমন একটি
নারীর সাথে সে كالْمِيلُ فِي الْمُكْحُلَةِ (সুর্মাদানীর মধ্যে সুর্মা
শলাকার মতো) যিনার কাজ করেছে। আদালতেরও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে যে, অপরাধী কোন প্রকার বাইরের চাপ
ছাড়াই সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সজ্ঞানে ও সচেতন অবস্থায় এ স্বীকৃতি
দিচ্ছে। কোন কোন ফকীহ বলেন, একটি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয়
বরং অপরাধীর চার বার আলাদা আলাদাভাবে স্বীকারোক্তি দেয়া উচিত। ( এটি ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী লাইলা, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ ও হাসান ইবনে
সালেহর অভিমত) আবার কেউ কেউ বলেন একটি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট। (এটি ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, উসমানুল বাত্তা ও হাসান বাসরী প্রমূখ ফকীহগণের অভিমত) তারপর এমন অবস্থায়ও
যখন অন্য কোন প্রমাণ ছাড়াই কেবলমাত্র অপরাধীর নিজেরই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে
ফায়সালা করা হয়েছে তখন যদি ঠিক শাস্তির মাঝামাঝি সময়েও অপরাধী নিজের স্বীকারোক্তি
থেকে সরে আসে তাহলে ও তার শাস্তি মুলতবী করে দেয়া উচিত, এমনকি
যদি বুঝা যায় যে, মারের কষ্ট সইতে না পেরে সে নিজের
স্বীকারোক্তি থেকে ফিরে আসছে, তাহলেও তার শাস্তি মুলতবি
হওয়া উচিত। হাদীসে যিনার মামলা
সংক্রান্ত যেসব নজির পাওয়া যায় সেগুলো এ সমস্ত আইনের উৎস। সবচেয়ে বড় মামলাটি হচ্ছে মা’ঈয ইবনে মালিক আসলামীর। বিভিন্ন সাহাবী থেকে অসংখ্য বর্ণনাকারী এটি
উদ্ধৃত করেছেন। প্রায় সবক’টি হাদীসের
কিতাবে এ বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। মা’ঈয ছিল আসলাম গোত্রের একটি এতিম সন্তান। সে হযরত হায্যাল ইবনে নু’আইমের গৃহে লালিত-পালিত হয়। সেখানে এক মুক্তিপ্রাপ্তা বাঁদীর সাথে যিনা
করে বসে। হযরত হায্যাল তাকে বলেন, নবী সা. এর কাছে গিয়ে নিজের এ
গোনাহের কথা বলো।
হয়তো তিনি তোমরা মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে দেবেন। মা’ঈয মসজিদে নববীতে গিয়ে নবী সা. কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে
পবিত্র করে দিন, আমি যিনা করেছি। তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তারপর বলেন, وَيْحَكَ ارْجِعْ فَاسْتَغْفِرِ اللهَ، وَتُبْ إِلَيْهِ “আরে, চলে যাও, আর আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইসতিগফার করো।” কিন্তু ছেলেটি আবার সামনে এসে একই কথা বলে এবং এবারও তিনি
মুখ ফিরিয়ে নেন। ছেলেটি আবার সে কথাই বলে
এবং তিনি আবার মুখ ফিরিয়ে নেন। এ অবস্থায় হযরত আবু বকর রা. তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, দেখো, যদি
তুমি চতুর্থবার স্বীকারোক্তি করো তাহলে রাসূলুল্লাহ সা. তোমাকে রজম করে দেবেন। কিন্তু সে মানেনি এবং আবার তার কথার
পুনরাবৃত্তি করে। এবার নবী সা. তার দিকে
ফেরেন এবং তাকে বলেন, لَعَلَّكَ قَبَّلْتَ أَوْ
غَمَزْتَ أَوْ نَظَرْتَ “সম্ভবত তুমি চুমো খেয়েছো বা জড়াজড়ি করেছো অথবা কু-নজর দিয়েছো।” (এবং তুমি মনে করেছো এতেই বুঝি যিনা করা হয়ে
গেছে) সে বলে, না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে এক বিছানায়
শুয়েছো? ” জবাব দেয়, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে সহবাস
করেছো?” জবাব দেয়, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে সংগম করেছো?”
জবাব দেয়, হ্যাঁ। তারপর তিনি এমন শব্দ উচ্চারণ করেন যা আরবী ভাষায় সঙ্গম
করার সুস্পষ্ট প্রতিশব্দ হিসেবে বলা হয়ে থাকে এবং তাকে অশ্লীল মনে করা হয়ে থাকে। এ ধরনের শব্দ নবী সা. এর মুখে এর আগে কেউ
শোনেনি এবং পরেও আর কখনো শোনা যায়নি। যদি এক ব্যক্তির প্রাণনাশের প্রশ্ন না হতো তাহলে তাঁর
মুবারক কন্ঠে কখনো এ ধরনের শব্দ উচ্চারিত হতে পারতো না। কিন্তু এর জবাবেও সে হ্যাঁ বলে দেয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন,
حَتَّى غَابَ ذَلِكَ مِنْكَ فِى ذَلِكَ مِنْهَا
(এমন কি তোমার সেই অঙ্গ তার সেই অঙ্গের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল?)
সে বলে, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করেন,
كَمَا يَغِيبُ الْمِرْوَدُ فِى الْمُكْحُلَةِ وَالرِّشَاءُ
فِى الْبِئْرِ
(সেটা কি এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যেমন সুর্মাদানীতে সুর্মা শলাকা এবং
কুয়ার মধ্যে রশি?) সে বলে, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “যিনা কাকে বলে তুমি কি জানো?
” সে বলে, “জি হ্যাঁ।” আমি তার সাথে হারাম পদ্ধতিতে এমন কাজ করেছি
যা স্বামী হালাল পদ্ধতিতে নিজের স্ত্রীর সাথে করে থাকে।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার কি বিয়ে হয়েছিল? ” জবাব দেয়, “জি হ্যাঁ।” জিজ্ঞেস করেন, “তুমি তো মদ পান করনি? ” জবাব দেয়, না। এক ব্যক্তি উঠে তার মুখ শুঁকে দেখেন এবং তার কথা সত্যতার
সাক্ষ্য দেন। তারপর তিনি তার মহল্লার
লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, এ ছেলেটি পাগল নয় তো? মহল্লার লোকেরা বলে, আমরা তার বুদ্ধির মধ্যে কোন বিকৃতি দেখিনি। তিনি হায্যালকে বলেন,
لَوْ سَتَرْتَهُ بِثَوْبِكَ كَانَ خَيْرًا لَكَ
“যদি তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে তাহলে তোমার জন্য ভালো হতো।” তারপর তিনি মা’ঈযকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড
দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাকে নগরীর বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথরের আঘাতে মেরে ফেলা হয়। যখন পাথর পড়তে শুরু হয় তখন মা’ঈয দৌড়ে পালাতে থাকে এবং
বলতে থাকে “লোকেরা! আমাকে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমার গোত্রের লোকেরা আমাকে মেরে ফেলার
ব্যবস্থা করেছে। তারা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে
তারা বলেছিল, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে হত্যা করবেন না।” কিন্তু যারা পাথর মারছিল তারা তাকে মেরেই ফেলে। পরে যখন নবীকে সা. এ খবর জানানো হয় তখন তিনি
লোকেদের বলেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন? তাকে আমার কাছে আনতে। হয়তো সে তাওবা করতো এবং আল্লাহ তার তাওবা
কবুল করে নিতেন।”
দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে গামেদীয়ার। গামেদীয়া ছিল গামেদ গোত্রের (জুহাইনীয়া গোত্রের একটি শাখা) একটি মেয়ে। সে এসেও চারবার স্বীকারোক্তি করে যে, সে যিনা করেছে এবং অবৈধ
গর্ভধারণ করেছে।
নবী সা. তাকেও প্রথম স্বীকারোক্তির সময় বলেনঃ وَيْحَكَ ارْجِعْى فَاسْتَغْفِرِى اللهَ، وَتُوبْى إِلَيْهِ (আরে চলে যাও, আল্লাহর
কাছে ক্ষমা চাও এবং তাওবা করো।) কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে মা’ঈযের মতো এড়িয়ে যেতে চান? আমি যিনার মাধ্যমে গর্ভবতী হয়েছি।” এখানে যেহেতু স্বীকারোক্তির সাথে গর্ভধারণের ব্যাপারটিও
ছিল, তাই তিনি
তাকে মা’ঈযের মতো বিস্তারিত জেরার সম্মুখীন করেননি। তিনি বলেন, “ঠিক আছে, যদি
একান্তই না শুনতে চাও, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে এসো।” সন্তান জন্মের পর সে শিশুটিকে কোলে নিয়ে এসে
বলে, এবার আমাকে
পবিত্র করে দিন।
তিনি বলেন, “যাও, একে দুধ পান করাও এবং শিশু দুধ ছাড়ার পরে এসো।” তারপর সে শিশুর দুধ ছাড়ার পরে আসে এবং সাথে
এক টুকরা রুটিও নিয়ে আসে।
শিশুকে রুটির টুকরা খাইয়ে রাসূলুল্লাহকে সা. দেখান এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন তো এ
দুধ ছেড়ে দিয়েছে এবং দেখুন রুটিও খেতে শুরু করেছে। তখন তিনি শিশুটিকে লালন-পালন করার জন্য এক ব্যক্তির হাতে
সোপর্দ করেন এবং তাকে রজম করার হুকুম দেন।
এ দু’টি ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে চারটি স্বীকারোক্তির কথা বলা হয়েছে। আর আবু দাউদে হযরত বুরাইদার বর্ণনায় বলা হয়েছে
যে, সাহাবায়ে
কেরামগণ সাধারণভাবে মনে করতেন যদি মা’ঈয ও গামেদীয়া চারবার করে স্বীকারোক্তি না
করতো তাহলে তাদেরকে রজম করা হতো না। তবে তৃতীয় ঘটনাটিতে (যার উল্লেখ আমি ওপরে পনের নম্বরে
করেছি) শুধুমাত্র এ শব্দগুলো পাওয়া যায় যে, “যাও তার স্ত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। যদি সে স্বীকার করে তাহলে একে রজম করো।” এখানে চারবার স্বীকারোক্তির কথা বলা হয়নি। এ থেকেই ফকীহগণের একটি দল একটি স্বীকারোক্তি
যথেষ্ট বলে মত প্রকাশ করেছেন।
একুশঃ ওপরে আমি যে তিনটি মামলার নজির পেশ করেছি তা থেকে প্রমাণ হয়
যে, স্বেচ্ছায়
আত্মসমর্পণকারী অপরাধীকে সে কার সাথে যিনা করেছে সে কথা জিজ্ঞেস করা হবে না। কারণ এভাবে এক জনের পরিবর্তে দু’জনকে শাস্তি
দিতে হবে। আর শরীয়াত লোকদেরকে শাস্তি
দেবার জন্য উদগ্রীব নয়।
তবে অপরাধী নিজেই যদি বলে যে, এ কর্মের অপর পক্ষ অমুক জন, তাহলে তাকে
জিজ্ঞেস করা হবে।
যদি সেও স্বীকারোক্তি করে তাহলে তাকেও শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু যদি সে অস্বীকার করে তাহলে কেবলমাত্র স্বেচ্ছায়
স্বীকারোক্তিকারী অপরাধীই শরীয়াতের শাস্তির যোগ্য হবে। এ দ্বিতীয় অবস্থায় (অর্থাৎ যখন দ্বিতীয় পক্ষ তার সাথে যিনা
করার কথা স্বীকার করে না) তাকে যিনার না মিথ্যা অপবাদের ((قذف)) শাস্তি দেয়া হবে, এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ
রয়েছে। ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর
মতে তার জন্য যিনার শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যাবে । কারণ সে এ অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আওযা’ঈর মতে তাকে মিথ্যা অপবাদের
শাস্তি দেয়া হবে। কারণ দ্বিতীয় পক্ষের
অস্বীকৃতি তার যিনার অপরাধকে সন্দেহযুক্ত করে দিয়েছে। তবে তার মিথ্যা অপবাদের অপরাধ অবশ্যই প্রমাণিত হয়ে গেছে। অন্য দিকে ইমাম মুহাম্মাদের ফতওয়া (ইমাম
শাফে’ঈর একটি উক্তিও এ সমর্থনে পাওয়া যায়) হচ্ছে এই যে, তাকে যিনার শাস্তিও দিতে হবে
এবং মিথ্যা অপবাদের শাস্তিও। কারণ নিজের যিনার অপরাধের স্বীকারোক্তি সে নিজেই করেছে এবং দ্বিতীয় পক্ষের
বিরুদ্ধে নিজের অভিযোগ সে প্রমাণ করতে পারেনি। নবী সা. এর আদালতে এ ধরনের একটি মামলা এসেছিল। তার একটি বর্ণনা মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদে
সাহল ইবনে সা’দ থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী সহকারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ “এক ব্যক্তি এসে
নবী সা. এর সামনে স্বীকারোক্তি করে, সে অমুক মেয়ের সাথে যিনা করেছে। তিনি মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। সে অস্বীকার করে। তিনি লোকটিকে শাস্তি দেন এবং মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে দেন।” এ হাদীসে তিনি কোন্ শাস্তিটি দেন তার
সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই।
দ্বিতীয় রেওয়ায়েতটি আবু দাউদ ও নাসাই ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, প্রথমে তার স্বীকারোক্তির
ভিত্তিতে তিনি তাকে যিনার শাস্তি দেন। তারপর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করে এবং এর ফলে
লোকটিকে আবার মিথ্যা অপবাদের জন্য বেত্রাঘাত করেন। কিন্তু এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে দুর্বল। কারণ এর একজন বর্ণনাকারী কাসেম ইবনে ফাইয়াযকে
বহু মুহাদ্দিস অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করেছেন। আবার এ হাদীসটি যুক্তিরও বিরোধী। কারণ নবী সা. থেকে আশা করা যেতে পারে না যে, তিনি যিনার জন্য বেত্রাঘাত
করার পর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করবেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও ইনসাফের যে সুস্পষ্ট দাবী নবী সা. উপেক্ষা
করতে পারেন না তা ছিল এই যে, লোকটি যখন মেয়েটির নাম নিয়েছিল তখন তিনি মেয়েটিকে ডেকে
জিজ্ঞেস না করে মামলার ফায়সালা করতে পারতেন না। সাহল ইবনে সা’দ বর্ণিত রেওয়ায়াতটি কিন্তু একথাই সমর্থন
করেছে। কাজেই দ্বিতীয় বর্ণনাটি
বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বাইশঃ অপরাধ প্রমাণ হবার পর যিনাকারী ও যিনাকারীনীকে কি শাস্তি
দেয়া হবে, এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ফকীহর মতামত নিচে পেশ করছিঃ
বিবাহিত পুরুষ ও নারীর যিনার শাস্তিঃ ইমাম আহমাদ, দাউদ যাহেরী, ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহের মতে এর শাস্তি হচ্ছে একশ বেত্রাঘাত এবং তারপর
প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু।
অন্য সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, কেবলমাত্র প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুই তাদের
শাস্তি। বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাতে
মৃত্যুকে একত্র করা যাবে না।
অবিবাহিতদের শাস্তিঃ ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ, ইসহাক,
দাউদ যাহেরী, সুফিয়ান সওরী, ইবনে আবী লাইলা ও হাসান ইবনে সালেহের মতে, নারী ও
পুরুষ উভয়ের শাস্তি একশত বেত্রাঘাত ও এক বছরের দেশান্তর।
ইমাম মালেক ও ইমাম আওযা’ঈর মতে, পুরুষের জন্য একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর
দেশান্তর এবং নারীর জন্য শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত। (তাঁদের সবার মতে দেশান্তর অর্থ হচ্ছে, একটি লোকালয় থেকে বের করে
কমপক্ষে এমন এক দূরত্বে পৌঁছে দেয়া যেখানে নামাযে কসর করা ওয়াজিব হয়। কিন্তু যায়েদ ইবনে আলী ও ইমাম জা’ফর সাদেকের
মতে কারাগারে বন্দী করলেও দেশান্তরের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়)।
ইমাম আবু হানীফা এবং তাঁর শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার ও ইমাম মুহাম্মাদ
বলেন, এ অবস্থায় পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য যিনার শাস্তি হচ্ছে
শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত। এর ওপর কারাদণ্ড বা দেশান্তরের বাড়তি শাস্তি বা অন্য কোন শাস্তি আসলে ‘হদ’
বা শরীয়াতী দণ্ড নয় বরং ‘তাযীর’ বা শাসনমূলক দণ্ড। কাযী যদি দেখেন অপরাধীর চালচলন খারাপ অথবা অপরাধী ও
অপরাধিনীর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর তাহলে প্রয়োজন মাফিক তিনি তাদেরকে দেশত্যাগী করতে
অথবা কারাদণ্ড দিতে পারেন।
(হদ ও তা’যীরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, হদ একটি
নির্ধারিত শাস্তি।
অপরাধ প্রমাণের শর্তাবলী পূর্ণ হবার পর অনিবার্যভাবে এ শাস্তি দেয়া হবে। আর তা’যীর এমন শাস্তিকে বলা হয় যা পরিমাণ ও
ধরনের দিক দিয়ে আইনের মধ্যে মোটেই নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি। বরং আদালত মামলার অবস্থার প্রেক্ষিতে তার মধ্যে কম-বেশী
করতে পারে।)
এসব মতাবলম্বীরা তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীসের সহায়তা
নিয়েছেন। নিচে আমি সেগুলো উদ্ধৃত
করছিঃ
হযরত উবাদাহ ইবনে সামেতের রেওয়ায়াত। মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযি ও ইমাম আহমাদ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এতে নবী সা. বলেছেনঃ
خُذُوا عَنِّى خُذُوا عَنِّى قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ
سَبِيلاً وَالْبِكْرُ بِالْبِكْرِ جَلْدُ مَاةٍ وَ تَغْرِيْبُ عَامِ وَالثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ
جَلْدُ ماةٍ وَالرَجْمُ(اورمى بالحجارة اورجم باالحجارة)
“আমার কাছ থেকে নাও, আমার কাছ থেকে নাও, আল্লাহ যিনাকারীনীদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অবিবাহিত পুরুষের অবিবাহিত মেয়ের সাথে
ব্যভিচারের জন্য একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর। আর বিবাহিতা পুরুষের বিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচারের জন্য
একশ বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু।”
(এ হাদিসটি যদিও বর্ণনা পরম্পরার দিক দিয়ে সহীহ কিন্তু বিপুল সংখ্যক সহীহ
হাদিস আমাদের একথা জানাচ্ছে যে, একে নবী ও খোলাফায়ে
রাশেদিনের যুগে কখনো কার্যকর করা হয়নি ফকিহদের একজনও হুবহু এর বক্তব্য অনুযায়ী
ফত্ওয়াও দেননি।
ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের এ সংক্রান্ত যে বিষয়ে সবাই একমত সেটি হচ্ছে এই যে, যিনাকারী ও যিনাকারীনীর
বিবাহিত ও অবিবাহিত হবার ব্যাপারটির ওপর আলাদা আলাদাভাবে দৃষ্টি দেওয়া হবে। অবিবাহিত পুরুষ বিবাহিত বা অবিবাহিতা যে কোন
নারীর সাথে যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই তার শাস্তি একই হবে। আর বিবাহিত পুরুষ অবিবাহিতা বা বিবাহিতা যে
কোন নারীর সাথে যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই একই শাস্তি হবে। নারীর ব্যাপারেও এই একই কথা । সে বিবাহিত হলে তার সাথে অবিবাহিত বা বিবাহিত
পুরুষ যেই যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই একই শাস্তি হবে। আর অবিবাহিত হলে তার সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত যে কোন
পুরুষ যিনা করলেও উভয় অবস্থায়ই তার একই শাস্তি হবে।)
হযরত আবু হুরাইরা রা. ও হযরত খালেদ জুহানীর রা. হাদীস। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাই, ইবনে মাজাহ ও
ইমাম আহমাদ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এ হাদীসে বলা হয়েছেঃ দু’জন গ্রামীন আরব নবী সা. এর কাছে একটি মামলা নিয়ে আসে। একজন বলে, আমার ছেলে এ ব্যক্তির বাড়িতে পারিশ্রমিকের
বিনিময়ে কাজ করতো। সে এর স্ত্রীর সাথে জড়িয়ে পড়ে। আমি একে একশ ছাগল ও একটি বাঁদি দিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আলেমগণ বলছেন, এ মীমাংসা আল্লাহর কিতাব বিরোধী। আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করে দিন। অন্যজনও বলে, আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী
ফায়সালা করে দিন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমি
আল্লাহর কিতাব অনুযায়ীই ফায়সালা করবো। ছাগল ও বাঁদী তুমি ফেরত নিয়ে যাও। তোমার ছেলের শাস্তি হচ্ছে, একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর। তারপর তিনি আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে বলেন, হে উনাইস! তুমি গিয়ে এর
স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো। যদি সে স্বীকারোক্তি করে তাহলে তাকে রজম করে দাও। দেখা গেলো তার স্ত্রী স্বীকারোক্তি করেছে। ফলে তাকে রজম করা হলো। (এখানে রজম করার আগে বেত্রাঘাতের কোন কথা নেই। আর অবিবাহিত পুরুষকে বিবাহিতা নারীর সাথে
ব্যভিচার করার ফলে বেত্রাঘাত ও দেশান্তরের শাস্তি দেয়া হয়।)
মা’ঈয ও গামেদীয়ার মামলার যতগুলো বিবরণী হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে
তার কোনটিতেও একথা পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সা. রজম করার আগে তাদেরকে একশ
বেত্রাঘাত করার ব্যবস্থাও করেছিলেন।
কোন হাদীসে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যা থেকে জানা যায় যে, নবী সা. কোন মামলায় রজমের সাথে
বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেন। বিবাহিতের যিনার শাস্তিতে তিনি শুধুমাত্র রজমের শাস্তিই দেন।
হযরত উমর রা. তাঁর বহুল প্রচারিত ভাষণে বিবাহিতের যিনার শাস্তি রজম বর্ণনা
করেছেন। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
ও নাসাই বিভিন্ন বর্ণনা পরম্পরায় এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমাদও এ থেকে বিভিন্ন বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এর কোন একটি বর্ণনায়ও রজমের সাথে বেত্রাঘাতের
উল্লেখ নেই।
খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে একমাত্র হযরত আলী রা. বেত্রাঘাত ও রজমকে একই শাস্তির
আওতায় একত্র করেছেন।
ইমাম আহমাদ ও বুখারী আমের শা’বী থেকে এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, শুরাহাহ নামক এক মহিলা অবৈধ
গর্ভের স্বীকারোক্তি করে। হযরত আলী রা. বৃহস্পতিবার দিন তাকে বেত্রাঘাত করান এবং শুক্রবার রজমের শাস্তি
দেন আর তারপর বলেন, আমি আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী তাকে বেত্রাঘাতের এবং রসূলের সুন্নাত
অনুযায়ী রজমের শাস্তি দিয়েছি। এ একটি ঘটনা ছাড়া খেলাফতে রাশেদার সমগ্র আমলে রজমের সাথে বেত্রাঘাতের শাস্তির
পক্ষে দ্বিতীয় কোন ঘটনা পাওয়া যায় না।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রা. একটি রেওয়ায়াত। আবু দাউদ ও নাসাঈ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এতে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি যিনা করে এবং নবী সা. তাকে কেবল
বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন। তারপর জানা যায় সে বিবাহিত ছিল। তখন তিনি তাকে রজমের শাস্তিই দেন। এছাড়াও ইতিপূর্বে আমি বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত করেছি। সেগুলো থেকে জানা যায়, অবিবাহিত যিনাকারীদেরকে তিনি কেবল
বেত্রাঘাতের শাস্তিই দেন। যেন যে ব্যক্তি মসজিদে গমনকারী এক মহিলার সাথে বলপূর্বক যিনা করেছিল এবং যে
ব্যক্তি যিনার স্বীকারোক্তি করেছিল এবং মেয়েটি করেছিল অস্বীকার।
হযরত উমর রা. বারী’আহ ইবনে উমাইয়াহ ইবনে খাল্ফকে মদ পানের অপরাধে দেশান্তর
করেন এবং সে পালিয়ে গিয়ে রোমানদের সাথে যোগ দেয়। এর ফলে হযরত উমর রা. বলেন, ভবিষ্যতে আমি আর কাউকে
দেশান্তরের শাস্তি দেবো না। অনুরূপভাবে হযরত আলী রা. অবিবাহিত পুরুষ ও নারীকে যিনার অপরাধে দেশান্তর করতে
অস্বীকার করেন এবং বলেন, এর ফলে ফিত্নার আশঙ্কা আছে। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩১৫ পৃষ্ঠা)।
এ সমস্ত হাদীসের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টি দিলে পরিষ্কার অনুভূত হয়, ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর
সহযোগীদের অভিমতই সঠিক। অর্থাৎ বিবাহিতের যিনার শাস্তি শুধুমাত্র রজম এবং অবিবাহিতের যিনার শাস্তি
শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত।
বেত্রাঘাত ও রজমকে একসাথে নবীর সা. আমল থেকে হযরত উসমানের রা. আমল পর্যন্ত কখনো
কার্যকর করা হয়নি। আর বেত্রাঘাত ও দেশান্তরের
শাস্তিকে কখনো একত্র করা হয়েছে আবার কখনো একত্র করা হয়নি। এ থেকে হানাফী অভিমতের নির্ভুলতা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়।
তেইশঃ বেত্রাঘাতের ধরন সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গিত কুরআনের শব্দ فاجلدوا এর মধ্যে পাওয়া যায়। جلد جلد (জাল্দ) শব্দটি جلد (জিল্দ অর্থাৎ চামড়া) থেকে গৃহীত। এ থেকে সকল অভিধান বিশারদ ও কুরআন
ব্যাখ্যাদাতা এ অর্থই নিয়েছেন যে, আঘাত এমন হতে হবে যার প্রভাব চামড়ার ওপর থাকে, গোশতের মধ্যে না পৌঁছে। এমন ধরনের বেত্রাঘাত যার ফলে গোশতের টুকরা উড়ে যেতে থাকে অথবা চামড়া ফেটে
আঘাত ভেতরে পৌঁছে যায়, তা কুরআন বিরোধী।
আঘাত করার জন্য কোড়া বা বেত যাই ব্যবহার করা হোক না কেন উভয় ক্ষেত্রেই তা
মাঝারি পর্যায়ের হতে হবে।
বেশী মোটা ও বেশী তীক্ষ্ম অথবা বেশী পাতলা ও বেশী নরম হতে পারবে না। মুআত্তা গ্রন্থে ইমাম মালেক রেওয়ায়াত করেছেন
যে, নবী সা.
বেত্রাঘাতের জন্য কোড়া আনতে বলেন। সেটি বেশী ব্যবহার করার কারণে অনেক বেশী হাল্কা পাতলা হয়ে
গিয়েছিল। তিনি বলেন, فوق هذا (এর চাইতে বেশী তীক্ষ্ম দেখে
আনো)। তখন একটি নতুন কোড়া আনা হয়। সেটি তখনো কোন প্রকার ব্যবহারের ফলে নরম হয়ে
যায় নি। তিনি বলেন, এ দু’য়ের মাঝামাঝি। তারপর এমন কোড়া আনা হয় যা সওয়ারীর পিঠে
ব্যবহার করা হয়েছিল। তা
দিয়ে তিনি আঘাত করান।
প্রায় একই বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি বর্ণনা আবু উসমান আন্নাহদী হযরত উমর রা.
সম্পর্কে বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি প্রায় মাঝারি ধরনের কোড়া ব্যবহার করতেন। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা) গাঁট বাঁধানো কোড়া অথবা দু’চামড়া-তিন চামড়া বা দু’রশি-তিন রশি
বাঁধানো কোড়া ব্যবহার করা নিষেধ।
আঘাতও হতে হবে মাঝারি পর্যায়ের। হযরত উমর রা. আঘাতকারীকে নির্দেশ দিতে لاترفع (يالاتخرج) ابطك অর্থাৎ “এমনভাবে মারো যেন
তোমার বগল খুলে না যায়।”
অর্থাৎ পূর্ণ শক্তিতে হাত উঁচিয়ে মেরো না। (আহকামুল কুরআন-ইবেন আরাবী, ২য় খণ্ড, ৮৪ পৃষ্ঠা, আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা)। সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত যে, এ ধরনের আঘাত হবে না যার ফলে
ঘা হয়ে যায়। একই জায়গায় মারা যাবে না
বরং সারা শরীরে মার ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র চেহারা ও লজ্জাস্থান এবং (হানাফীদের মতে মাথাও) অক্ষত রাখতে হবে। বাদবাকি সমস্ত অঙ্গে কিছু না কিছু মার পড়তে
হবে। এক ব্যক্তিকে যখন কোড়া মারা
হচ্ছিল তখন হযরত আলী রা. বলেন, “শরীরের প্রত্যেক অঙ্গকে তার প্রাপ্য দাও এবং শুধুমাত্র মুখ ও
লজ্জাস্থানকে নিষ্কৃতি দাও।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩২১ পৃষ্ঠা) নবী সা. বলেনঃ إِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَّقِ
الْوَجْهَ “তোমাদের কেউ যখন আঘাত করবে তখন
মুখে আঘাত করবে না।” (আবু দাউদ)
পুরুষকে দাঁড় করিয়ে ও স্ত্রী লোককে বসিয়ে মারা উচিত। ইমাম আবু হানীফার সময় কুফার কাযী ইবনে আবী লাইলা একটি
মেয়েকে দাঁড় করিয়ে মারার ব্যবস্থা করেন। ইমাম আবু হানীফা এর কঠোর সমালোচনা করেন এবং প্রকাশ্যে তার
এ কার্যক্রমকে ভুল বলে চিহ্নিত করেন। (এ থেকে আদালতের অমর্যাদা সংক্রান্ত ইমাম আবু হানীফার মতবাদের ওপরও আলোকপাত
হয়)। কোড়া মারার সময় স্ত্রীলোক
তার পূর্ণ পোশাক পরে থাকবে। বরং তার শরীরের কোন অংশ যাতে বের হয়ে না যায় এজন্য কাপড় তার সারা শরীরে
ভালোভাবে বেঁধে দেয়া হবে। শুধু
মোটা কাপড় খুলে নিতে হবে।
পুরুষের ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। কোন কোন ফকীহ বলেন, পুরুষ কেবল পাজামা পরে থাকবে। আবার অন্যেরা বলেন, জামাও খোলা যাবে না। হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ রা. এক
যিনাকারীকে কোড়া মারার হুকুম দেন। সে বলে, “এই শরীরটার ভালোভাবে মার খাওয়া উচিত।” একথা বলে সে জামা খুলতে শুরু করে। হযরত আবু উবাইদাহ বলেন, “তাকে জামা খুলতে দিয়ো না।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা)। হযরত আলীর আমলে এক ব্যক্তি নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে ছিল এ অবস্থায় তাকে কোড়া
মারা হয়।
প্রচণ্ড শীত ও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মারা নিষিদ্ধ। শীতকালে গরম সময়ে এবং গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডার মধ্যে মারতে হবে।
বেঁধে মারারও অনুমতি নেই। তবে অপরাধী যদি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তাহলে বেঁধে মারা যেতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, لايحل فى هذه الامة تجريد ولامد “এই উম্মতের মধ্যে উলঙ্গ করে এবং
খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারা জায়েজ নয়।”
ফকীহগণ প্রতিদিন অন্ততঃপক্ষে বিশ ঘা কোড়া মারা বৈধ বলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে সম্পূর্ণ শাস্তি দিয়ে দেয়া
উত্তম।
মূর্খ ও হিংস্র ধরনের জল্লাদের সাহায্যে মারার কাজ সম্পন্ন করা উচিত নয়। বরং শিক্ষিত ও মার্জিত জ্ঞানবান লোকদের সাহায্যে
এ কাজ সম্পন্ন করা উচিত।
যারা জানে শরীয়াতের দাবী পূর্ণ করার জন্য কিভাবে মারা উচিত তারাই এ কাজ করবে। ইবনে কাইয়েম যাদুল মা’আদ গ্রন্থে লিখেছেন, নবী সা. এর জামানায় হযরত আলী রা.,
হযরত যুবাইর রা., হযরত মিকদাদ ইবনে আমর রা.,
হযরত মুহাম্মাদ ইবনে মাস্লামাহ রা., হযরত আসেম
ইবনে সামেত দ্বাহ্হাক ইবনে সুফিয়ানের ন্যায় সজ্জন ও মর্যাদাশালী লোকেরা জল্লাদের
দায়িত্ব পালন করতেন। (১ম খণ্ড, ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠা)।
যদি অপরাধী রুগ্ন হয় অথবা তার আরোগ্য লাভ করার কোন আশা না থাকে কিংবা একেবারে
বৃদ্ধ হয় তাহলে একশ শাখাওয়ালা একটা ডাল বা শতকাঠিওয়ালা একটি ঝাড়ু দিয়ে তাকে
কেবলমাত্র একবার মেরে দেয়াই উচিত, যাতে আইনের দাবী পূর্ণ হয়। নবী সা. এর সময় এক বৃদ্ধ রোগী যিনার অপরাধে পাকড়াও হয়। তিনি তার জন্য এ শাস্তিই নির্ধারণ করেন। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ,
ইবনে মাজাহ) গর্ভবতী নারীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতে হলে শিশু
ভূমিষ্ঠ হবার পর নিফাসের সময় পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর তাকে রজম করতে হলে যতক্ষণ তার সন্তান দুধ
পান করা পরিত্যাগ না করে ততক্ষণ তাকে শাস্তি দেয়া যেতে পারবে না।
যদি সাক্ষ্যের মাধ্যমে যিনা প্রমাণ হয় তাহলে সাক্ষী মারের সূচনা করবে আর যদি
স্বীকারোক্তির মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কাযী নিজেই সূচনা করবেন, যাতে সাক্ষী নিজের সাক্ষ্যকে এবং বিচারক নিজের বিচারকে খেল-তামাশা মনে না
করেন। শুরাহাহর মামলায় যখন হযরত
আলী রাহি. রজমের ফায়সালা দেন তখন বলেন, “যদি তার অপরাধের কোন সাক্ষী থাকতো তাহলে
তাকেই মার শুরু করতে হতো। কিন্তু তাকে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কাজেই আমি নিজেই শুরু করবো।” হানাফীয়াদের মতে এমনটি করা ওয়াজিব। শাফেঈরা একে ওয়াজিব মনে করেন না। কিন্তু সবাই একে উত্তম মনে করেন।
বেত্রাঘাতের শাস্তির এ বিস্তারিত বিবরণ পড়ুন তারপর যারা এ শাস্তিকে বর্বরোচিত
বলে থাকে তাদের ধৃষ্টতার কথা ভাবুন। আজকাল কারাগারে কয়েদীদেরকে যে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা তাদের কাছে
বড়ই ভদ্রোচিত! বর্তমান আইনের দৃষ্টিতে কেবলমাত্র আদালতই নয়, জেলখানার একজন মামুলি
সুপারিন্টেনডেন্টও একজন কয়েদীকে হুকুম অমান্য বা গোস্তাখী করার অপরাধে ৩০ ঘা
পর্যন্ত বেত্রাঘাতের শাস্তি দেবার অধিকার রাখে। এ বেত্রাঘাত করার জন্য একজন লোককে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়
এবং সে সবসময় এটা মশ্ক করতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে বেতও বিশেষভাবে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তৈরী করা হয়, যাতে করে শরীরের ওপর তা ছুরির
মতো কেটে বসে যেতে পারে। অপরাধীকে নাঙ্গা করে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া হয়, যাতে সে একটু নড়াচড়াও করতে না
পারে। কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান
ঢাকার জন্য এক টুকরা পাতলা কাপড় তার পাছার সাথে জড়িয়ে দেয়া হয় এবং সেটিকেও টিংচার
আইওডিন দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়। জল্লাদ দূর থেকে দৌড়ে আসে এবং পূর্ণ শক্তিতে তার ওপর আঘাত করে। শরীরের একটি বিশেষ অংশ (অর্থাৎ পাছায়) বরাবর
আঘাত করা হতে থাকে। ফলে সেখান থেকে গোশ্ত কিমা
হয়ে উড়ে যেতে থাকে এবং অনেক সময় ভেতর থেকে হাড় দেখা যেতে থাকে। অধিকাংশ সময় এমন হয়, অত্যন্ত বলশালী ও শক্তিধর
ব্যক্তিও ৩০ ঘা বেত সম্পূর্ণ হবার আগেই বেহুশ হয়ে পড়ে যায়। এ অবস্থায় তার শরীর ভরাট হতে দীর্ঘ সময় লাগে। তথাকথিত এ ভদ্রজনোচিত শাস্তিকে যারা আজ
কারাগারে নিজেরাই প্রবর্তিত করে চলেছে তারা কোন্ মুখে ইসলাম প্রবর্তিত বেত্রাঘাতের
শাস্তিকে “বর্বরোচিত” বলার ধৃষ্টতা দেখাতে পরে! তারপর তাদের পুলিশ বাহিনী যেসব
অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে তাদেরকে নয় বরং নিছক সন্দেহভাজন লোকদেরকে ধরে এনে
অনুসন্ধান চালাবার উদ্দেশ্যে (বিশেষ করে রাজনৈতিক অপরাধ সন্দেহে) যেভাবে শাস্তি
দিয়ে থাকে তা আজ আর কারো দৃষ্টির অগোচরে নেই।
চব্বিশঃ রজমের শাস্তির ফলে অপরাধী মারা যাবার পর তার সাথে পুরোপুরি
মুসলমানের মতো ব্যবহার করা হবে। তার লাশকে গোসল দিয়ে কাফন পরানো হবে। তার জানাযার নামায পড়া হবে। তাকে মর্যাদা সহকারে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা হবে। তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা হবে। দুর্নাম সহকারে তার কথা আলোচনা করা কারোর জন্য
বৈধ হবে না। বুখারীতে জাবের ইবনে
আবদুল্লাহ আনসারীর রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, “রজমের ফলে মা’ঈয ইবনে মালেকের মৃত্যু হলে
নবী সা. সুনামের সাথে তাকে স্মরণ করতে থাকেন এবং নিজে তার জানাযার নামায পড়ান।” মুসলিমে হযরত বুরাইদার রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে নবী করীম সা. বলেছেনঃ
اسْتَغْفِرُوا لِمَاعِزِ بْنِ مَالِكٍ لَقَدْ تَابَ
تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ
“মা’ঈয ইবনে মালেকের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো। সে এমন তাওবা করেছে যে, যদি তা সমগ্র উম্মতের ওপর বন্টন করে দেয়া
হয়, তাহলে সবার জন্য যথেষ্ট হবে।”
এ হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, গামেদীয়া যখন রজম করার ফলে মারা যান তখন নবী করীম সা. নিজেই
তার জানাযার নামায পড়ান। আর হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ রা. যখন দুর্নাম সহকারে তার কথা বলতে থাকেন তখন তিনি
বলেনঃ
مَهْلاً يَا خَالِدُ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ
لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَغُفِرَ لَهُ
“হে খালেদ! চুপ করো। সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, সে এমন তাওবা করেছিল যে,
যদি নিপীড়নমূলক কর আদায়কারীও তেমন তাওবা করতো তাহলে তাকেও মাফ করে
দেয়া হতো।”
আবু দাউদে হযরত আবু হুরাইরার রা. রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মা’ঈযের ঘটনার পর একদিন রাসূলুল্লাহ সা. পথ
দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি দু’জন লোককে মা’ঈযের দুর্নাম করতে শুনলেন। কয়েক পা এগিয়ে গেলে একটি গাধার লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো। রাসূলুল্লাহ সা. থেমে গেলেন এবং ঐ দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে
বললেন, “তোমরা দু’জন
এটা থেকে কিছু খাও।” তারা বললেন, “হে আল্লাহর নবী! ওটা কে খেতে পারে।” তিনি বললেন, “এখনই তো তোমরা তোমাদের ভাইয়ের ইজ্জত-আব্রু
খাচ্ছিলে। ওটা এর চেয়ে অনেক খারাপ
জিনিস ছিল।” মুসলিমে ঈমরান ইবনে হুসাইন
বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত উমর রা. গামেদীয়ার জানাযার নামাযের সময় বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! এখন
কি এই যিনাকারীনীর জানাযার নামায পড়া হবে? তিনি জবাব দেনঃ
لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أَهْلِ
الْمَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ
“সে এমন তাওবা করেছে, যা সমগ্র মদীনাবাসীর মধ্যে ভাগ
করে দেয়া হলেও তা সবার জন্য যথেষ্ট হবে।”
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরাহ রা. বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তিকে মদপানের অপরাধে
শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। তা দেখে একজনের মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে, “আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন।” একথায় নবী সা. বলেন, “এভাবে বলো না। এর বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য করো না।” আবু দাউদে এর ওপর আর এতটুকু সংযোজন আছে যে, নবী সা. বলেন, বরং এভাবে বলোঃ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ “হে আল্লাহ তাকে মাফ করো,
হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করো।” এ হচ্ছে ইসলামে শাস্তির তাৎপর্য। ইসলাম কোন বৃহত্তম অপরাধীকেও শত্রুতার মনোভাব হবার পর তার
প্রতি স্নেহ ও মমতার দৃষ্টিতে দেখে। আধুনিক সভ্যতাই বর্তমানে এমন এক সংকীর্ণমনতার জন্ম দিয়েছে যার ফলে সরকারী সৈন্য
বা পুলিশ যাকে হত্যা করে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফলে যাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য
করা হয় তার লাশ বহন করে নিয়ে যাওয়া বা কারও মুখে তার প্রশংসা কীর্তিত হওয়াকে
কোনক্রমেই পছন্দ করা হয় না। এরপর দুনিয়াবাসীকে সহিষ্ণুতা ও উদারতার নসিহত করে নিজের নৈতিক সাহসের (এটা
আধুনিক সভ্যতায় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতার মার্জিত নাম) পরাকাষ্ঠা দেখানো হয়।
পঁচিশঃ মুহাররম নারীদের সাথে যিনার শাস্তি সম্পর্কিত শরীয়াতের আইন
তাফহীমুল কুরআনের সূরা নিসার ৩৪ টীকায় এবং লূতের জাতির কর্ম (সমকাম) সংক্রান্ত
শরীয়াতী ফায়সালা তাফহীমুল কুরআনের সূরা আ’রাফের ৬৪ থেকে ৬৮ টীকার বর্ণনা করা হয়েছে। আর পশুর সাথে ব্যভিচার করাকেও কোন কোন ফকীহ
যিনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং সে যিনার শাস্তি লাভের যোগ্য বলে অভিমত প্রকাশ
করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা রাহি., ইমাম আবু ইউসুফ রাহি., ইমাম মুহাম্মাদ রাহি., ইমাম যুফার রাহি., ইমাম মালেক রাহি. ও ইমাম শাফেঈ রাহি. একে যিনা বলেন না এবং তাঁরা এ ধরনের
কর্মে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর “হুদ” বা “তা’যীর” কোনটি জারি করার পক্ষপাতী নন। তা’যীর সম্পর্কে আমি আগেই বলে এসেছি যে, এর ফায়সালা করবেন কাযী নিজেই
অথবা রাষ্ট্রের মজলিসে শূরা প্রয়োজন বোধ করলে এজন্য কোন উপযোগী ব্যবস্থা নিজেই
প্রবর্তন করতে পারবে।
৩. এ আয়াতের প্রথম উল্লেখযোগ্য জিনিসটি হচ্ছে, এখানে ফৌজদারী আইনকে “আল্লাহর
দ্বীন” বলা হচ্ছে। এ
থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র নামায, রোযা, হজ্জ ও
যাকাতই দ্বীন নয় বরং দেশের আইনও দ্বীন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ শুধু নামায প্রতিষ্ঠা নয় বরং
আল্লাহর আইন ও শরীয়াত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও। যেখানে এসব প্রতিষ্ঠিত হয় না সেখানে নামায প্রতিষ্ঠিত হয়ে
গেলেও যেন অসম্পূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে। যেখানে একে বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন অবলম্বন করা
হয় সেখানে অন্য কিছু নয় বরং আল্লাহর দ্বীনকেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এখানে দ্বিতীয় যে জিনিসটি উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে, আল্লাহর এ সতর্কবাণীঃ যিনাকারী
ও যিনাকারীনীর ওপর আমার নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগকালে অপরাধীর জন্য দয়া ও মমতার
প্রেরণা যেন তোমাদের হাত টেনে না ধরে। নবী সা. একথাটি আরো স্পষ্টভাবে নিম্নোক্ত হাদীসটিতে বলেনঃ
يُؤتَى بِوَالٍ نَقَصَ مِنَ
الحَدِّ سَوْطاً فَيُقَالُ لَهُ لِمَ فَعَلْتَ ذَاكَ؟ فَيَقُوْلُ رَحْمَةٌ لِعِبَادِكَ
فَيُقَالُ لَهُ أَنْتَ أَرْحَمُ بهم مِنِّي؟ فَيَؤْمَرُ بِهِ إِلَى النَّارِ- وَيُؤْتَى
بِمَنْ زَادَ سَوْطاً فَيُقَالُ لَهُ لِمَ فَعَلْتَ ذَاكَ فيقولُ لِيَنْتَهَوا عَنْ
مَعَاصِيكَ فيقول أَنتَ أَحْكَمُ بِهِم مِنِّي؟ فَيُؤْمَرُ به إلى النَّار-
“কিয়ামতের দিন একজন শাসককে আনা হবে। সে হদের মধ্যে বেত্রাঘাতের সংখ্যা এক ঘা কমিয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হবে, এ কাজ তুমি কেন করেছিলে?
জবাব দেবে, আপনার বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহশীল
হয়ে। আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাহলে তাদের ব্যাপারে তুমি
আমার চেয়ে বেশী অনুগ্রহশীল ছিলে? তারপর হুকুম হবে, নিয়ে যাও একে দোযখে। আর একজন শাসককে আনা হবে। সে বেত্রাঘাতের সংখ্যা ১টি বাড়িয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি এ কাজ করেছিলে কেন? সে জবাব দেবে, যাতে লোকেরা আপনার নাফরমানি করা থেকে
বিরত থাকে। আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাদের ব্যাপারে তুমি তাহলে
আমার চেয়ে বেশী বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিলে? তারপর হুকুম হবে,
নিয়ে যাও একে দোযখে। (তাফসীরে কবীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৫
পৃষ্ঠা)
দয়া বা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে হদের মধ্যে কম-বেশী করার কাজ চললে এ অবস্থা হবে। কিন্তু কোথাও যদি অপরাধীদের মর্যাদার ভিত্তিতে
বিধানের মধ্যে বৈষম্য করা হতে থাকে তাহলে সেটা হবে জঘন্য ধরনের অপরাধ। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশার রা. একটি
রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, নবী সা. এক ভাষণে বলেনঃ “হে লোকেরা! তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত
হয়েছে তারা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কোন মর্যাদাশালী
ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিতো এবং কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করলে তাকে
শাস্তি দিতো।”
অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “একটি হদ্ জারি করা দুনিয়াবাসীর জন্য
চল্লিশ দিন বৃষ্টি হবার চাইতেও বেশী কল্যাণকর।” (নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, অপরাধ প্রমাণ হবার পর অপরাধীকে
ছেড়ে দেয়া যাবে না এবং তার শাস্তিও কম করা যাবে না বরং তাকে পুরো একশ কোড়া মারতে
হবে। আবার কেউ কেউ এ অর্থ
নিয়েছেন যে, অপরাধী যে মারের কোন কষ্ট অনুভব করতে না পারে এমন ধরনের কোন হাল্কা মার
মারা যাবে না।
আয়াতের শব্দাবলী উভয় ধরনের অর্থ সম্বলিত। বরং উভয় অর্থই প্রযোজ্য মনে হয়। বরঞ্চ সে সাথে এ অর্থও হয় যে, যিনাকারীকে সে শাস্তি দিতে হবে
যা আল্লাহ নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাকে অন্য কোন শাস্তিতে
পরিবর্তিত করা যাবে না। কোড়া মারার পরিবর্তে যদি অন্য কোন শাস্তি দয়া ও মমতার ভিত্তিতে দেয়া হয়, তাহলে তা হবে গোনাহ। আর যদি কোড়া মারাকে একটি বর্বরোচিত শাস্তি মনে
করে অন্য শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে তা হবে নির্জলা কুফরী, যা এক মুহূর্তকালের
জন্যও ঈমানের সাথে একই বক্ষে একত্র হতে পারে না। আল্লাহকে আল্লাহ বলে মেনে নেয়া আবার (নাউযুবিল্লাহ্) তাকে
বর্বরও বলা কেবলমাত্র এমন ধরনের লোকের পক্ষে সম্ভব যে জঘন্য পর্যায়ের মুনাফিক।
৪. অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ লোকের সামনে
শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে একদিকে অপরাধী
অপদস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা লাভ করবে। এ থেকে ইসলামের শাস্তি তত্ত্বের ওপর সুস্পষ্ট আলোকপাত হয়। সূরা আল মায়েদায় চুরির শাস্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে
বলা হয়েছেঃ جَزَآءًۢ بِمَا كَسَبَا نَكَالاً
مِّنَ اللّٰهِؕ “তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান এবং আল্লাহর পক্ষ
থেকে অপরাধ প্রতিরোধক শাস্তি।” (৩৮ আয়াত) আর এখানে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যিনাকারীকে প্রকাশ্য লোকদের সামনে শাস্তি
দিতে হবে। এ থেকে জানা যায়, ইসলামী আইনে শাস্তির তিনটি
উদ্দেশ্য। এক, অপরাধী থেকে তার জুলুম ও
বাড়াবাড়ির প্রতিশোধ নিতে হবে এবং সে অন্য ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি যে অন্যায়
করেছিল তার কিছুটা স্বাদ তাকে আস্বাদন করিয়ে দিতে হবে। দুই, তাকে পুনর্বার অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। তিন, তার শাস্তিকে শিক্ষণীয় করতে হবে, যাতে সমাজের খারাপ প্রবণতার অধিকারী অন্য লোকদের মগজ ধোলাই হয়ে যায় এবং
তারা যেন এ ধরনের কোন অপরাধ করার সাহসই না করতে পারে।। এছাড়াও প্রকাশ্যে শাস্তি দেবার আর একটি লাভ হচ্ছে এই যে, এ অবস্থায় শাসকরা শাস্তি দেবার
ক্ষেত্রে অহেতুক সুবিধা দান বা অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করার সাহস না দেখাতে পারে।
﴿الزَّانِي لَا يَنكِحُ إِلَّا
زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنكِحُهَا إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ
ۚ وَحُرِّمَ ذَٰلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ﴾
৩। ব্যভিচারী
যেন ব্যভিচারিনী বা মুশরিক নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে না করে এবং ব্যভিচারিনীকে যেন
ব্যভিচারী বা মুশরিক ছাড়া আর কেউ বিয়ে না করে। আর এটা
হারাম করে দেয়া হয়েছে মু’মিনদের জন্য।৫
৫. অর্থাৎ অ-তাওবাকারী ব্যভিচারীর জন্য
ব্যভিচারিণীই উপযোগী অথবা মুশরিক নারী। কোন সৎ মু’মিন নারীর জন্য সে মোটেই উপযোগী পুরুষ নয়। আর মু’মিনদের জন্য জেনে বুঝে নিজেদের
মেয়েদেরকে এ ধরনের অসচ্চরিত্র লোকদের হাতে সোপর্দ করা হারাম। এভাবে যিনাকারীনী (অ-তাওবাকারী) মেয়েদের জন্য
তাদেরই মতো যিনাকারীরা অথবা মুশরিকরাই উপযোগী। সৎ মু’মিনদের জন্য তারা মোটেই উপযোগী নয়। যেসব নারীর চরিত্রহীনতার কথা মু’মিনরা জানে
তাদেরকে বিয়ে করা তাদের জন্য হারাম। যে সমস্ত পুরুষ ও নারী তাদের চরিত্রহীনতার পথে গা ভাসিয়ে দিয়েছে একমাত্র
তাদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য। তবে যারা তাওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নিয়েছে তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। কারণ তাওবা ও সংশোধনের পর “যিনাকারী” হবার
দোষ আর তাদের জন্য প্রযুক্ত হয় না।
যিনাকারীর সাথে বিয়ে হারাম হবার অর্থ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এ নিয়েছেন যে, আদতে তার সাথে বিয়ে অনুষ্ঠিতই
হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক কথা
হচ্ছে, এর অর্থ
নিছক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে যদি কেউ বিয়ে করে তাহলে
আইনগতভাবে তা বিয়েই হবে না এবং এ বিয়ে সত্ত্বেও উভয় পক্ষকে যিনাকারী গণ্য করতে হবে
একথা ঠিক নয়। নবী সা. একটি সার্বজনীন
নিয়ম হিসেবে বলেনঃ الحرام لايحرم الحلال “হারাম হালালকে হারাম করে দেয় না।” (তাবারানী ও দারুকুতনী) অর্থাৎ একটি বেআইনী
কাজ অন্য একটি আইনসঙ্গত কাজকে বেআইনী করে দেয় না। কাজেই কোন ব্যক্তির যিনা করার কারণে সে যদি বিয়েও করে
তাহলে তা তাকে যিনায় পরিণত করে দিতে পারে না এবং বিবাহ চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ যে
ব্যভিচারী নয় সেও ব্যভিচারী গণ্য হবে না। নীতিগতভাবে বিদ্রোহ ছাড়া কোন অপরাধ এমন নেই, যা অপরাধ সম্পাদনকারীকে
নিষিদ্ধ ব্যক্তিতে (Outlaw) পরিণত করে। যার পরে তার কোন কাজই আইনসঙ্গত হতে পারে না। এ বিষয়টি সামনে রেখে যদি আয়াত সম্পর্কে
চিন্তা-ভাবনা করা যায়, তাহলে আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে এই মনে হয় যে, যাদের
ব্যভিচারী চরিত্র জনসমক্ষে পরিচিত তাদেরকে বিয়ে করার জন্য নির্বাচিত করা একটি
গোনাহর কাজ।
মু’মিনদের এ গোনাহ থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ এর মাধ্যমে ব্যভিচারীদের হিম্মত বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ শরীয়াত তাদেরকে সমাজের অবাঞ্ছিত ও ঘৃণ্য
জীব গণ্য করতে চায়।
অনুরূপভাবে এ আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তও টানা যায় না যে, যিনাকারী মুসলিম পুরুষের বিয়ে
মুশরিক নারীর সাথে এবং যিনাকারীনী মুসলিম নারীর বিয়ে মুশরিক পুরুষের সাথে সঠিক হবে। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বলা যে, যিনা একটি চরম নিকৃষ্ট কুকর্ম। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েও এ কাজ করে সে মুসলিম
সমাজের সৎ ও পাক-পবিত্র লোকদের সাথে আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার যোগ্যতা হারিয়ে
ফেলে। তার নিজের মতো যিনাকারীদের
সাথেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত অথবা মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা
উচিত, যারা আদৌ
আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাসই রাখে না।
এ প্রসঙ্গে নবী সা. থেকে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলোই আসলে আয়াতের সঠিক
অর্থ প্রকাশ করে। মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈতে
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসের রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, উম্মে মাহ্যাওল নামে একটি মেয়ে পতিতাবৃত্তি
অবলম্বন করেছিল। এক
মুসলমান তাকে বিয়ে করতে চায় এবং এজন্য নবী সা. এর কাছে অনুমতি চায়। তিনি নিষেধ করে এ আয়াতটি পড়েন। তিরমিযী ও আবু দাউদে বলা হয়েছে, মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ একজন
সাহাবী ছিলেন।
জাহেলী যুগে মক্কার ঈনাক নামক এক ব্যভিচারিণীর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পরে তিনি তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা করেন এবং রাসূলুল্লাহর
সা. কাছে অনুমতি চান।
দু’বার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি নীরব থাকেন। আবার তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করেন, এবার তিনি জবাব দেনঃ
يا مرثد الزَّانِى لاَ يَنْكِحُ إِلاَّ زَانِيَةً أَوْ
مُشْرِكَةً فلاَ يَنْكِحُهَا
“হে মারসাদ! ব্যভিচারী এক ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারী ছাড়া আর কাউকে বিয়ে
করবে না, কাজেই তাকে বিয়ে করো না।”
এছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. থেকেও
বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে বলা হয়েছে, নবী সা. বলেছেনঃ “কোন দাইয়ুস (অর্থাৎ যে ব্যক্তি জানে তার স্ত্রী
ব্যভীচারিনী এবং এরপরও সে তার স্বামী থাকে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।” (আহমাদ, নাসাঈ, আবু দাউদ)
প্রথম দুই খলীফা হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উমর রা. উভয়ই এ ব্যাপারে যে পদ্ধতি
অবলম্বন করেন তা ছিল এই যে, তাঁদের আমলে যে অবিবাহিত পুরুষ ও
নারী যিনার অভিযোগে গ্রেফতার হতো তাদেরকে তাঁরা প্রথমে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতেন
তারপর তাদেরকেই পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন। ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, একদিন এক ব্যক্তি বড়ই পেরেশান
অবস্থায় হযরত আবু বকরের রা. কাছে আসে। সে এমনভাবে কথা বলতে থাকে যেন তার মুখে কথা ভালভাবে ফুটছিল
না। হযরত আবু বকর রা., হযরত উমরকে রা. বলেন ওকে অন্য
জায়গায় নিয়ে গিয়ে একান্তে জিজ্ঞেস করুন ব্যাপারখানা কি? হযরত
উমর রা. জিজ্ঞেস করতে সে বলে, তাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে এক
ব্যক্তি এসেছিল। সে
তার মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসেছে। হযরত উমর রা. বলেনঃ قَبَّحَكِ اللَّهُ الا سترت على ابْنَتَكَ “তোমার মন্দ হোক, তুমি নিজের মেয়ের আবরণ ঢেকে দিলে না? ” শেষ পর্যন্ত
পুরুষটি ও মেয়েটির বিরুদ্ধে মামলা চলে। উভয়কে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হয়। তারপর উভয়কে পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে হযরত আবু বকর রা. এক
বছরের জন্য তাদেরকে দেশান্তর করেন। এ ধরনেরই আরো কয়েকটি ঘটনা কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁর আহকামুল কুরআন
গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন (পৃষ্ঠা ৮৬, ২য় খণ্ড)।
﴿وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ
ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا
تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
৪। আর যারা
সতী-সাধ্বী নারীর ওপর অপবাদ লাগায়, তারপর চারজন সাক্ষী আনে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করো
এবং তাদের সাক্ষ কখনো গ্রহণ করো না। তারা
নিজেরাই ফাসেক।
﴿إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا
مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫। তবে যারা
এরপর তাওবা করে এবং শুধরে যায়, অবশ্যই আল্লাহ (তাদের পক্ষে) ক্ষমাশীল ও
মেহেরবান।৬
৬. এ হুকুমটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজে লোকদের গোপন প্রণয় ও
অবৈধ সম্পর্কের আলোচনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া। কারণ এর মাধ্যমে অসংখ্য অসৎকাজ, অসৎবৃত্তি ও অসৎ প্রবণতার
প্রসার ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়
অসৎবৃত্তিটি হলো, এভাবে সবার অলক্ষ্যে একটি ব্যভিচারমূলক পরিবেশ তৈরী হয়ে যেতে থাকে। একজন নিছক কৌতুকের বশে কারোর সত্য বা মিথ্যা
কুৎসিত ঘটনাবলী অন্যের সামনে বর্ণনা করে বেড়ায়। অন্যেরা তাতে লবণ মরিচ মাখিয়ে লোকদের সামনে পরিবেশন করতে
থাকে এবং এ সঙ্গে আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও নিজেদের বক্তব্য বা কু-ধারণা বর্ণনা
করে। এভাবে কেবলমাত্র যৌন
কামনা-বাসনার একটি ব্যাপক ধারাই প্রবাহিত হয় না বরং খারাপ প্রবণতার অধিকারী
নারী-পুরুষরা জানতে পারে যে, সমাজের কোথায় কোথায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারবে। শরীয়াত প্রথম পদক্ষেপেই এ জিনিসটির পথ রোধ
করতে চায়। একদিকে সে হুকুম দেয়, যদি কেউ যিনা করে এবং
সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে তার যিনা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে এমন চরম শাস্তি দাও যা
কোন অপরাধে দেয়া হয় না। আবার অন্যদিকে সে ফায়সালা করে, যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ
আনে সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে আর যদি প্রমাণ করতে না
পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে
কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। ধরে নেয়া যাক যদি অভিযোগকারী কাউকে নিজের
চোখে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও তার নীরব থাকা উচিত এবং অন্যদের কাছে একথা না বলা
উচিত ফলে ময়লা যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে যেতে পারবে না। তবে তার কাছে যদি সাক্ষী থাকে তাহলে সমাজে
আজেবাজে কথা ছড়াবার পরিবর্তে বিষয়টি শাসকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং আদালতে
অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করে তাকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ আইনটি পুরোপুরি অনুধাবন করার জন্য এর বিস্তারিত বিষয়াবলী দৃষ্টি সমক্ষে
থাকা উচিত। তাই আমি নীচে এর বিস্তারিত
বর্ণনা দিচ্ছিঃ
একঃ আয়াতে وَالَّذِينَ يَرْمُونَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হয় “যেসব লোক অপবাদ দেয়।” কিন্তু পূর্বাপর আলোচনা বলে, এখানে অপবাদ মানে সব ধরনের
অপবাদ নয় বরং বিশেষভাবে যিনার অপবাদ। প্রথমে যিনার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে এবং সামনের দিকে আসছে
“লি’আন”-এর বিধান। এ দু’য়ের মাঝখানে এ
বিধানটির আসা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে এখানে অপবাদ বলতে কোন্ ধরনের অপবাদ বুঝানো
হয়েছে। তারপর يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (অপবাদ দেয় সতী মেয়েদেরকে) থেকেও এ মর্মে
ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখানে এমন অপবাদের কথা বলা হয়েছে যা
সতীত্ব বিরোধী।
তাছাড়া অপবাদদাতাদের কাছে তাদের অপবাদের প্রমাণস্বরূপ চারজন সাক্ষী আনার দাবী করা
হয়েছে। সমগ্র ইসলামী আইন ব্যবস্থায়
একমাত্র যিনার সাক্ষ্যদাতাদের জন্য চারজনের সংখ্যা রাখা হয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মতের আলেম
সমাজের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এ আয়াতে শুধুমাত্র যিনার অপবাদের বিধান
বর্ণনা করা হয়েছে।
এজন্য উলামায়ে কেরাম স্বতন্ত্র পারিভাষিক শব্দ “কাযাফ” নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাতে অন্যান্য অপবাদসমূহ (যেমন
কাউকে চোর, শরাবী, সূদখোর বা কাফের
বলা) এ বিধানের আওতায় এসে না পড়ে। “কাযাফ” ছাড়া অন্য অপবাদসমূহের শাস্তি কাজী নিজেই নির্ধারণ
করতে পারেন অথবা দেশের মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য অপমান বা মানহানির
কোন সাধারণ আইন তৈরী করতে পারেন।
দুইঃ আয়াতে يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (সতী নারীদেরকে অপবাদ দেয়) শব্দ
ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, শুধুমাত্র নারীদেরকে অপবাদ দেয়া পর্যন্ত এ
বিধানটি সীমাবদ্ধ নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষদেরকে অপবাদ দিলেও এ একই
বিধান কার্যকর হবে। এভাবে যদিও অপবাদদাতাদের জন্য الَّذِينَ يَرْمُونَ (যারা অপবাদ দেয়) পুরুষ নির্দেশক
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তবুও এর মাধ্যমে শুধুমাত্র পুরুষদেরকেই নির্দেশ করা হয়নি
বরং মেয়েরাও যদি “কাযাফ”-এর অপরাধ করে তাহলে তারাও এ একই বিধানের আওতায় শাস্তি
পাবে। কারণ অপরাধের ব্যাপারে
অপবাদদাতা ও যাকে অপবাদ দেয়া হয় তাদের পুরুষ বা নারী হলে কোন পার্থক্য দেখা দেয়
না। কাজেই আইনের আকৃতি হবে এ
রকম--- যে কোন পুরুষ ও নারী কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও নারীর ওপর
যিনার অপবাদ চাপিয়ে দেবে তার জন্য হবে এ আইন (উল্লেখ্য, এখানে “মুহসিন” ও “মুহসিনা”
মানে বিবাহিত পুরুষ ও নারী নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ ও নারী)।
তিনঃ অপবাদদাতা যখন কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও
নারীর বিরুদ্ধে এ অপবাদ দেবে একমাত্র তখনই এ আইন প্রযোজ্য হবে। কোন কলঙ্কযুক্ত ও দাগী চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ
ও নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে এটি প্রযুক্ত হতে পারে না। দুশ্চরিত্র বলে পরিচিত ব্যক্তি যদি ব্যভিচারী হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে “অপবাদ”
দেবার প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু যদি সে এমন না হয়, তাহলে তার
ওপর প্রমাণ ছাড়াই অপবাদদাতার জন্য কাজী নিজেই শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন অথবা এ
ধরনের অবস্থার জন্য মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে।
চারঃ কোন মিথ্যা অপবাদ (কাযাফ) দেয়ার কাজটি শাস্তিযোগ্য হবার
জন্য শুধুমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, একজন অন্য জনের ওপর কোন প্রমাণ ছাড়াই
ব্যভিচার করার অপবাদ দিয়েছে। বরং এজন্য কিছু শর্ত অপবাদদাতার মধ্যে, কিছু শর্ত যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে
এবং কিছু শর্ত স্বয়ং অপবাদ কর্মের মধ্যে থাকা অপরিহার্য।
অপবাদদাতার মধ্যে যে শর্তগুলো থাকতে হবে সেগুলো হচ্ছেঃ প্রথমত তাকে প্রাপ্ত
বয়স্ক হতে হবে। শিশু যদি অপবাদ দেবার অপরাধ
করে তাহলে তাকে আইন–শৃঙ্খলা বিধানমূলক (তা’যীর) শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার ওপর শরিয়াতী শাস্তি (হদ) জারি হতে
পারে না। দ্বিতীয়ত তাকে মানসিকভাবে
সুস্থ হতে হবে। পাগলের ওপর “কাযাফের”
শাস্তি জারি হতে পারে না।
অনুরূপভাবে হারাম নেশা ছাড়া অন্য কোন ধরনের নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যেমন
ক্লোরোফরমের প্রভাবাধীন অপবাদদাতাকেও অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। তৃতীয়ত সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় (ফকীহগণের
পরিভাষায় ‘তায়েআন’) এ কাজ করবে। কারোর বল প্রয়োগে অপবাদদানকারীকে অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। চতুর্থত সে, যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার
নিজের বাপ বা দাদা নয়। কারণ তাদের ওপর অপবাদের হদ জারি হতে পারে না। এগুলো ছাড়া হানাফীদের মতে পঞ্চম আর একটি শর্তও আছে। সেটি হচ্ছে, সে বাকশক্তি সম্পন্ন হবে,
বোবা হবে না। বোবা যদি ইশারা ইঙ্গিতে অপবাদ দেয় তাহলে তার ফলে অপবাদের শাস্তি ওয়াজিব হয়ে
যাবে না। ইমাম শাফেঈ এ থেকে ভিন্নমত
পোষণ করেন। তিনি বলেন যদি বোবার ইশারা
একেবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হয় এবং তা দেখে সে কি বলতে চায় তা লোকেরা বুঝতে
পারে, তাহলে তো
সে অপবাদদাতা।
কারণ তার ইশারা এক ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত ও বদনাম করে দেবার ক্ষেত্রে কথার মাধ্যমে
প্রকাশ করার তুলনায় কোন অংশে কম নয়। পক্ষান্তরে হানাফীদের মতে নিছক ইশারার মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ এত বেশী
শক্তিশালী নয়, যার ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া যেতে পারে। তারা তাকে শুধুমাত্র দমনমূলক (তা’যীর) শাস্তি
দেবার পক্ষপাতী।
যাকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় তার মধ্যেও নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যেতে হবে। প্রথমত তাকে বুদ্ধি সচেতন হতে হবে। অর্থাৎ তার ওপর এমন অবস্থায় যিনা করার অপবাদ
দেয়া হয় যখন সে বুদ্ধি সচেতন ছিল। পাগলের প্রতি (পরে সে বুদ্ধি সচেতন হয়ে গিয়ে থাক বা না থাক) যিনা করার
অপবাদদানকারী ‘কাযাফ’-এর শাস্তি লাভের উপযুক্ত নয়। কারণ পাগল তার নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সংরক্ষণ করার
ব্যবস্থা করতে পারে না। আর
তার বিরুদ্ধে যিনা করার সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও সে যিনার শাস্তির উপযুক্ত হয়
না এবং তার মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয় না। কাজেই তার প্রতি অপবাদদানকারীরও কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম লাইস ইবনে সা’দ বলেন, পাগলের প্রতি ব্যভিচারের
অপবাদদানকারী কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ সে একটি প্রমাণ বিহীন অপবাদ দিচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তার ওপর যিনা
করার অপবাদ দেয়া হয়।
শিশুর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া অথবা যুবকের বিরুদ্ধে এ মর্মে অপবাদ দেয়া যে, সে শৈশবে এ কাজ করেছিল,
এ ধরনের অপবাদের ফলে ‘কাযাফ’-এর শাস্তি ওয়াজিব হয় না। কারণ পাগলের মত শিশুও নিজের চারিত্রিক
নিষ্কলুষতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে কাযাফ-এর শাস্তি তার ওপর ওয়াজিব হয় না এবং তার
মান-সম্মানও নষ্ট হয় না।
কিন্ত ইমাম মালেক বলেন, যে ছেলে প্রাপ্ত বয়স্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তার বিরুদ্ধে যদি যিনা করার
অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তো অপবাদ দানকারীর ওপর কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হবে না কিন্তু
যদি একই বয়সের মেয়ের ওপর যিনা করার অভিযোগ আনা হয় যার সাথে সহবাস করা সম্ভব,
তাহলে তার প্রতি অপবাদদানকারী কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ এর ফলে কেবলমাত্র মেয়েরই নয় বরং তার
পরিরবারেরও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় এবং মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যায়। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলমান হতে হবে। অর্থাৎ মুসলিম থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে যিনা
করার অপবাদ দেয়া হয়।
কাফেরের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা মুসলিমের বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে কাফের থাকা অবস্থায় এ কাজ
করেছিল, তার জন্য কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, তাকে স্বাধীন হতে হবে। বাঁদি বা গোলামের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা স্বাধীনের
বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে গোলাম থাকা অবস্থায় এ কাজ করেছিল, তার জন্য
কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। কারণ গোলামীর অসহায়তা ও দুর্বলতার দরুন তার পক্ষে নিজের
চারিত্রিক নিষ্কলুষতার ব্যবস্থা করা সম্ভব নাও হতে পারে। স্বয়ং কুরআনই গোলামীর অবস্থাকে ‘ইহ্সান’ তথা পূর্ণ বিবাহিত
অবস্থা গণ্য করেনি। তাই সূরা নিসায় শব্দটি
বাঁদীর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দাউদ যাহেরী এ যুক্তি মানেন না। তিনি বলেন, বাঁদি ও গোলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা
অপবাদদানকারীও কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। পঞ্চম শর্ত হচ্ছে, তাকে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অর্থাৎ তার জীবন যিনা ও যিনাসদৃশ চালচলন থেকে
মুক্ত হবে। যিনা মুক্ত হবার অর্থ হচ্ছে, সে বাতিল বিবাহ, গোপন বিবাহ, সন্দেহযুক্ত মালিকানা বা বিবাহ সদৃশ যৌন
সঙ্গম করেনি।
তার জীবন যাপন এমন ধরনের নয় যেখানে তার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতা ও নির্লজ্জ
বেহায়াপনার অভিযোগ আনা যেতে পারে এবং যিনার চেয়ে কম পর্যায়ের চরিত্রহীনতার অভিযোগ
তার প্রতি ইতিপূর্বে কখনো প্রমাণিত হয়নি। কারণ এসব ক্ষেত্রেই তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ক্ষুণ্ণ হয়ে
যায় এবং এ ধরনের অনিশ্চিত নিষ্কলুষতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের
শাস্তি লাভের যোগ্য হতে পারে না। এমন কি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তি জারি হবার আগে যার
প্রতি অপবাদ দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে কখনো কোন যিনার অপরাধের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে
গিয়ে থাকে তাহলেও মিথ্যা অপবাদদানকারীকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ যার প্রতি সে অপবাদ আরোপ করেছিল সে নিষ্কলুষ থাকেনি।
কিন্তু এ পাঁচটি ক্ষেত্রে শরীয়াত নির্ধারিত শাস্তি (হদ্) জারি না হবার অর্থ এ
নয় যে, পাগল,
শিশু, কাফের, গোলাম বা
অনিষ্কলুষ ব্যক্তির প্রতি প্রমাণ ছাড়াই যিনার অপবাদ আরোপকারী দমনমূলক (তা’যীর)
শাস্তি লাভের যোগ্য হবে না।
এবার স্বয়ং মিথ্যা অপবাদ কর্মের মধ্যে যেসব শর্ত পাওয়া যেতে হবে সেগুলোর
আলোচনায় আসা যাক। একটি অভিযোগকে দু’টি
জিনিসের মধ্য থেকে কোন একটি জিনিস মিথ্যা অপবাদে পরিণত করতে পারে। এক, অভিযোগকারী অভিযুক্তের ওপর এমন ধরনের নারী
সঙ্গমের অপবাদ দিয়েছে যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির
ওপর যিনার শাস্তি ওয়াজিব হবে যাবে। দুই, অথবা সে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জারজ সন্তান গণ্য করেছে। কিন্তু উভয় অবস্থায়ই এ অপবাদটি পরিষ্কার ও
সুস্পষ্ট হতে হবে। ইশারা-ইঙ্গিত গ্রহণযোগ্য নয়। এর সাহায্যে যিনা বা বংশের নিন্দার অর্থ গ্রহণ
করা মিথ্যা অপবাদদাতার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল হয়। যেমন কাউকে ফাসেক, পাপী, ব্যভিচারী বা
দুশ্চরিত্র ইত্যাদি বলে দেয়া অথবা কোন মেয়েকে বেশ্যা, কস্বী
বা ছিনাল বলা কিংবা কোন সৈয়দকে পাঠান বলে দেয়া--- এসব ইশারা হয়। এগুলোর মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন মিথ্যা অপবাদ
প্রমাণ হয় না। অন্যরূপভাবে যেসব শব্দ নিছক
গালাগালি হিসেবে ব্যবহার হয়, যেমন হারামি বা হারামজাদা ইত্যাদিকেও সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ
গণ্য করা যেতে পারে না। তবে ‘তা’রীয’ (নিজের প্রতি আপত্তিকর বক্তব্য অস্বীকৃতির মাধ্যমে অন্যকে খোঁটা
দেয়া) এর ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে এটাও অপবাদ কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। যেমন কেউ অন্যকে সম্বোধন করে বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু
আমি তো আর যিনাকারী নই” অথবা “আমার মা তো আর যিনা করে আমাকে জন্ম দেয়নি।” ইমাম মালেক বলেন, এমন কোন “তা’রীয” “কাযাফ” বা
যিনার মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে যা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, প্রতিপক্ষকে যিনাকারী বা জারজ সন্তান গণ্য করাই বক্তার উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় “হদ” বা কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হয়ে
যায়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সাথীগণ এবং ইমাম শাফেঈ,
সুফিয়ান সওরী, ইবনে শুব্রুমাহ ও হাসান ইবনে
সালেহ বলেন, “তা’রীযে”র ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ থাকে
এবং সন্দেহ সহকারে কাযাফের শাস্তি জারি হতে পারে না। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, যদি ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে
“তা’রীয” করা হয়, তাহলে তা হবে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আর
হাসি-ঠাট্টার মধ্যে করা হলে তা ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ হবে না। খলীফাগণের মধ্যে হযরত উমর রা., হযরত আলী রা. তা’রীযের জন্য
কাযাফ-এর শাস্তি দেন। হযরত উমরের আমলে দু’জন লোকের মধ্যে গালিগালাজ হয়। একজন অন্য জনকে বলে, “আমার বাবাও যিনাকারী ছিল না, আমার মাও যিনাকারীনী ছিল না।” মামলাটি হযরত উমরের দরবারে পেশ হয়। তিনি উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা এ থেকে কি মনে করেন?
কয়েকজন বলে, “সে নিজের বাবা-মার প্রশংসা করেছে। দ্বিতীয় ব্যক্তির বাবা-মা’র উপর আক্রমণ করেনি।” আবার অন্য কয়েকজন বলে, “তার নিজের বাবা-মা’র প্রশংসা
করার জন্য কি শুধু এ শব্দগুলোই রয়ে গিয়েছিল? এ বিশেষ
শব্দগুলোকে এ সময় ব্যবহার করার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, দ্বিতীয়
ব্যক্তির বাবা-মা ব্যভিচারী ছিল।” হযরত উমর রা. দ্বিতীয় দলটির সাথে একমত হন এবং ‘হদ’ জারি
করেন। (জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা) কারোর প্রতি সমকামিতার অপবাদ দেয়া ব্যভিচারের অপবাদ কিনা এ
ব্যাপারেও মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ একে
ব্যভিচারের অপবাদ গণ্য করেন এবং ‘হদ’ জারি করার হুকুম দেন।
পাঁচঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ সরাসরি সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য
অপরাধ (Cognizable
Offence) কিনা এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে আবী লাইলা বলেন, এটি হচ্ছে আল্লাহর হক। কাজেই যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে
সে দাবী করুক বা নাই করুক মিথ্যা অপবাদদাতার বিরুদ্ধে কাযাফ-এর শাস্তি জারি করা
ওয়াজিব। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা
চালানো, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে, তার দাবীর
ওপর নির্ভর করে এবং এদিক দিয়ে এটি ব্যক্তির হক। ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আওযাঈও এ একই মত পোষণ করেছেন। ইমাম মালেকের মতে যদি শাসকের সামনে মিথ্যা
অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তা হবে সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ অন্যথায় এর বিরুদ্ধে
কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছে তার দাবীর ওপর
নির্ভরশীল।
ছয়ঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেবার অপরাধ, আপোসে মিটিয়ে ফেলার মতো অপরাধ
(Compoundable Offence) নয়। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির আদালতে মামলা দায়ের না করাটা ভিন্ন
ব্যাপার কিন্তু আদালতে বিষয়টি উত্থাপিত হবার পর অপবাদ দানকারীকে তার অপবাদ প্রমাণ
করতে বাধ্য করা হবে। আর
প্রমাণ করতে না পারলে তার ওপর ‘হদ’ জারি করা হবে। আদালত তাকে মাফ করতে পারে না, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিও পারে না
এবং কোন প্রকার অর্থদণ্ড দিয়েও ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে না। তাওবা করে মাফ চেয়েও সে শাস্তি থেকে রেহাই
পেতে পারে না। নবী সা. এর এ উক্তি আগেই
আলোচিত হয়েছেঃ
تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى
مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَبَ
“অপরাধকে আপোসে মিটিয়ে দাও কিন্তু যে অপরাধের নালিশ আমার কাছে চলে এসেছে,
সেটা ওয়াজিব হয়ে গেছে।”
সাতঃ হানাফীদের মতে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দাবী করতে পারে অপবাদ
আরোপিত ব্যক্তি নিজেই অথবা যখন দাবী করার জন্য অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি নিজে উপস্থিত
নেই এমন অবস্থায় যার বংশের মর্যাদাহানি হয় সেও দাবী করতে পারে। যেমন বাবা, মা, ছেলেমেয়ে এবং
ছেলেমেয়ের ছেলেমেয়েরা এ দাবী করতে পারে। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর মতে এ অধিকার উত্তরাধিকার
সূত্রে লাভযোগ্য। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি মারা
গেলে তার প্রত্যেক শরয়ী উত্তরাধিকার হদ্ জারি করার দাবী জানাতে পারে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ইমাম শাফেঈ স্ত্রী ও স্বামীকে
এর বাইরে গণ্য করছেন। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হচ্ছে, মৃত্যুর সাথে সাথেই দাম্পত্য সম্পর্ক খতম
হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় স্বামী বা স্ত্রী কোন এক জনের বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে অন্যের
বংশের কোন মর্যাদাহানি হয় না। অথচ এ দু’টি যুক্তিই দুর্বল। কারণ শাস্তি দাবী করাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার বলে মেনে নেবার পর
মৃত্যু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে বলে স্বামী ও
স্ত্রী এ অধিকারটি লাভ করবে না একথা বলা স্বয়ং কুরআনের বক্তব্য বিরোধী। কারণ কুরআন এক জনের মরে যাওযার পর অন্যজনকে
উত্তরাধিকারী গণ্য করেছে। আর
স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে কোন একজনের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হলে অন্য জনের বংশের কোন
মর্যাদাহানি হয় না একথাটি স্বামীর ব্যাপারে সঠিক হলেও হতে পারে কিন্তু স্ত্রীর
ব্যাপারে একদম সঠিক নয়।
কারণ যার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তার তো সমস্ত সন্তান-সন্ততির বংশধারাও
সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়।
তাছাড়া শুধুমাত্র বংশের মর্যাদাহানির কারণে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের শাস্তি
ওয়াজিব গণ্য করা হয়েছে, এ চিন্তাও সঠিক নয়। বংশের সাথে সাথে মান-সম্মান-ইজ্জত-আব্রুর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াও এর
একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন পুরুষ ও নারীর জন্য তার স্বামী বা স্ত্রীকে ব্যভিচারী বা
ব্যভিচারিণী গণ্য করা কম মর্যাদাহানিকর নয়। কাজেই ব্যভিচারের মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার দাবী যদি
উত্তরাধিকারিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে তাহলে স্বামী-স্ত্রীকে তা থেকে আলাদা
করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
আটঃ কোন ব্যক্তি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে একথা প্রমাণ
হয়ে যাবার পর কেবলমাত্র নিম্নলিখিত জিনিসটিই তাকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে। তাকে এমন চারজন সাক্ষী আনতে হবে যারা আদালতে এ
মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, তারা অপবাদ আরোপিত জনকে অমুক পুরুষ বা মেয়ের সাথে কার্যত যিনা করতে দেখেছে। হানাফীয়াদের মতে এ চারজন সাক্ষীকে একই সঙ্গে
আদালতে আসতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। কারণ যদি তারা একের পর এক আসে তাহলে তাদের প্রত্যেক মিথ্যা
অপবাদদাতা হয়ে যেতে থাকবে এবং তার জন্য আবার চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু এটি একটি দুর্বল কথা। ইমাম শাফেঈ ও উসমানুল বাত্তি এ ব্যাপারে যে
কথা বলেছেন সেটিই সঠিক।
তারা বলেছেন, সাক্ষীদের একসঙ্গে বা একের পর এক আসার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায় না। বরং বেশী ভাল হয় যদি অন্যান্য মামালার মতো এ
মামলায় সাক্ষীরা একের পর এক আসে এবং সাক্ষ্য দেয়। হানাফীয়াদের মতে এ সাক্ষীদের “আদেল” তথ্য ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া
জরুরী নয়। যদি অপবাদদাতা চারজন ফাসেক
সাক্ষীও আনে তাহলে সে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি থেকে রেহাই পাবে এবং অপবাদ আরোপিত
ব্যক্তিও যিনার শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। কারণ সাক্ষী “আদেল” নয়। তবে কাফের, অন্ধ, গোলাম বা
মিথ্যা অপবাদের অপরাধে পূর্বাহ্ণে শাস্তিপ্রাপ্ত সাক্ষী পেশ করে অপবাদদাতা শাস্তি
থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। কিন্তু ইমাম শাফেঈ বলেন, অপবাদদাতা যদি ফাসেক সাক্ষী পেশ করে, তাহলে
সে এবং তার সাক্ষী সবাই শরীয়াতের শাস্তির যোগ্য হবে। ইমাম মালেকও একই রায় পেশ করেন। এ ব্যাপারে হানাফীয়াদের অভিমতই নির্ভুলতার বেশী নিকটবর্তী
বলে মনে হয়। সাক্ষী যদি “আদেল”
(ন্যায়নিষ্ঠ) হয় অপবাদদাতা অপবাদের অপরাধ মুক্ত হয়ে যাবে এবং অপবাদ আরোপিত
ব্যক্তির বিরুদ্ধে যিনার অপরাধ প্রমাণিত হবে। কিন্তু সাক্ষী যদি “আদেল” না হয়, তাহলে অপবাদদাতার অপবাদ,
অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির যিনা ও সাক্ষীদের সত্যবাদিতা ও মিথ্যাচার সবাই
সন্দেহযুক্ত হয়ে যাবে এবং সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকেও শরীয়াতের শাস্তির উপযুক্ত গণ্য
করা যেতে পারবে না।
নয়ঃ যে ব্যক্তি এমন সাক্ষ্য পেশ করতে সক্ষম হবে না, যা তাকে অপবাদের অপরাধ থেকে
মুক্ত করতে পারে তার ব্যাপারে কুরআন তিনটি নির্দেশ দেয়ঃ এক, তাকে
৮০ ঘা বেত্রাঘাত করতে হবে। দুই, তার সাক্ষ্য কখনও গৃহীত হবে না। তিন, সে ফাসেক হিসেবে চিহ্নিত হবে। অতঃপর কুরআন বলছেঃ
إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا
فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“তারা ছাড়া যারা এরপর তাওবা করে ও সংশোধন করে নেয়, কেননা,
আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (আন নূর-৫)
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে তাওবা ও সংশোধনের মাধ্যমে যে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে তার সম্পর্ক ঐ
তিনটি নির্দেশের মধ্য থেকে কোনটির সাথে আছে? প্রথম হুকুমটির
সাথে এর সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারে ফকীহগণ একমত। অর্থাৎ তাওবার মাধ্যমে “হদ” তথা শরীয়াতের
শাস্তি বাতিল হয়ে যাবে না এবং যে কোন অবস্থায়ই অপরাধীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া
হবে। শেষ হুকুমটির সাথে ক্ষমার
সম্পর্ক আছে, এ ব্যাপারেও সকল ফকীহ একমত। অর্থাৎ তাওবা করার ও সংশোধিত হবার পর অপরাধী ফাসেক থাকবে
না। আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। (এ ব্যাপারে অপরাধী শুধুমাত্র মিথ্যা অপবাদ
দেবার কারণেই ফাসেক হয়, না আদালতের ফায়সালা ঘোষিত হবার পর ফাসেক হিসেবে গণ্য হয়, সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফেঈ ও লাইস ইবনে সাদের মতে, মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণেই
ফাসেক হয়। এ কারণে তাঁরা সে সময় থেকেই
তাকে প্রত্যাখ্যাত সাক্ষী গণ্য করেন। বিপরীতপক্ষে ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সহযোগীগণ ও ইমাম মালেক বলেন, আদালতের ফায়সালা জারি হবার পর সে ফাসেক হয়। তাই তাঁরা হুকুম জারি হবার পূব পর্যন্ত তাকে গ্রহণযোগ্য
সাক্ষী মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, অপরাধীর আল্লাহর কাছে ফাসেক
হওয়ার ব্যাপারটি মিথ্যা অপবাদ দেবার ফল এবং তার মানুষের কাছে ফাসেক হওয়ার বিষয়টি
আদালতে তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া এবং তার শাস্তি পাওয়ার ওপর নির্ভর করে।) এখন থেকে যায় মাঝখানের হুকুমটি অর্থাৎ
“মিথ্যা অপবাদদাতার সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করা হবে না।” إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا বাক্যাংশটির সম্পর্ক এ হুকুমটির সাথে আছে কিনা
এ ব্যাপারে ফকীহগণের অভিমত ব্যাপকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল বলেন, কেবলমাত্র শেষ হুকুমটির সাথে এ বাক্যাংশটির
সম্পর্ক আছে।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওবা ও সংশোধন করে নেবে সে আল্লাহর সমীপে এবং মানুষের কাছেও
ফাসেক থাকবে না। কিন্তু এ সত্ত্বে প্রথম
দু’টি হকুম অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ অপরাধীর বিরুদ্ধে শরীয়াতের শাস্তি জারি করা হবে এবং তার সাক্ষ্যও
চিরকাল প্রত্যাখ্যাত থাকবে। এ দলের রয়েছেন কাযী শুরাইহ, সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব, সাঈদ ইবনে জুবাইর,
হাসান বসরী, ইবরাহীম নাখঈ’, ইবনে সিরীন, মাকহুল, আবদুর রহমান
ইবনে যায়েদ, আবু হানীফা, আবু ইউসুফ,
যুফার, মুহাম্মাদ, সুফ্ইয়ান
সওরী ও হাসান ইবনে সালেহর মতো শীর্ষ স্থানীয় ফকীহগণ। দ্বিতীয় দলটি বলেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর সম্পর্ক প্রথম হুকুমটির
সাথে তো নেই-ই তবে শেষের দু’টো হুকুমের সাথে আছে অর্থাৎ তাওবার পর মিথ্যা অপবাদে
শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে এবং সে ফাসেক হিসেবেও গণ্য হবে না। এ দলে রয়েছেন আতা, তাউস, মুজাহিদ,
শা’বী, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, সালেম, যুহরী, ইকরামাহ,
উমর ইবনুল আযীয, ইবনে আবী নুজাইহ, সুলাইমান ইবনে ইয়াসার, মাসরূক, দ্বাহ্হাক, মালেক ইবনে আনাস, উসমান
আলবাত্তী, লাইস ইবনে সা’দ, শাফেঈ,
আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইবনে জারীর তাবারীর মতো শ্রেষ্ঠ ফকীহবৃন্দ। এরা নিজেদের মতের সমর্থনে অন্যান্য
যুক্তি-প্রমাণের সাথে সাথে হযরত উমর রা., মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলায় যে ফায়সালা
দিয়েছিলেন সেটিও পেশ করে থাকেন। কারণ তার কোন কোন বর্ণনায় একথা বলা হয়েছে যে, ‘হদ’ জারি করার পর হযরত উমর রা.,
আবু বাক্রাহ ও তার দুই সাথীকে বলেন, যদি তোমরা
তওবা করে নাও (অথবা “নিজেদের মিথ্যাচারিতা স্বীকার করে নাও”) তাহলে আমি আগামীতে
তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেবো অন্যথায় তা গ্রহণ করা হবে না। সাথী দু’জন স্বীকার করে নেয় কিন্তু আবু
বাক্রাহ নিজের কথায় অনড় থাকেন। বাহ্যত এটি একটি বড় শক্তিশালী সমর্থন মনে হয়। কিন্তু মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণী
আমি পূবেই পেশ করেছি সে সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার প্রকাশ হয়ে যাবে যে, এ নজিরের ভিত্তিতে এ বিষয়ে
যুক্তি প্রদর্শন করা সঠিক নয়। সেখানে মূল কাজটি ছিল সর্ববাদী সম্মত এবং স্বয়ং মুগীরাহ ইবনে শু’বাও এটি
অস্বীকার করেননি। মেয়েটি কে ছিল, এ নিয়ে ছিল বিরোধ। মুগীরাহ রা. বলছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী,
যাকে এরা উম্মে জামীল মনে করেছিলেন। এ সঙ্গে একথাও প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে, হযরত মুগীরার স্ত্রী ও উম্মে
জামীলের চেহারায় এতটা সাদৃশ্য ছিল যে, ঘটনাটি যে পরিমাণ আলোয়
যতটা দূর থেকে দেখা গেছে তাতে মেয়েটিকে উম্মে জামীল মনে করার মতো ভুল ধারণা হওয়ার
সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু আন্দাজ-অনুমান সবকিছু ছিল মুগীরার পক্ষে এবং বাদীপক্ষের একজন সাক্ষীও একথা
স্বীকার করেছিলেন যে, মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। এ কারণে হযরত উমর রা., মুগীরাহ ইবনে শু’বার পক্ষে রায় দেন এবং
ওপরে উল্লেখিত হাদীসে যে কথাগুলো উদ্ধৃত হয়েছে আবু বাক্রাহকে শাস্তি দেবার পর
সেগুলো বলেন।
এসব অবস্থা পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, হযরত উমরের উদ্দেশ্য ছিল আসলে একথা বুঝানো
যে, তোমরা অযথা একটি কুধারণা পোষণ করেছিলে, একথা মেনে নাও এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এ ধরনের কুধারণার ভিত্তিতে লোকদের
বিরুদ্ধে অপবাদ না দেবার ওয়াদা করো। অন্যথায় ভবিষ্যতে তোমাদের সাক্ষ্য কখনো গৃহীত হবে না। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে না যে, সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী প্রমাণিত
ব্যক্তিও যদি তাওবা করে তাহলে এরপর হযরত উমরের মতে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে
পারতো। আসলে এ বিষয়ে প্রথম দলটির
মতই বেশী শক্তিশালী মনে হয়। মানুষের তাওবার অবস্থা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমাদের সামনে যে ব্যক্তি তাওবা করবে আমরা তাকে
বড় জোর ফাসেক বলবো না।
এতটুকু সুবিধা তাকে আমরা দিতে পারি। কিন্তু যার মুখের কথার উপর আস্থা একবার খতম হয়ে গেছে সে কেবলমাত্র আমাদের
সামনে তাওবা করছে বলে তার মুখের কথাকে আবার দাম দিতে থাকবো, এত বেশী সুবিধা তাকে দেয়া যেতে
পারে না। এছাড়া কুরআনের আয়াতের
বর্ণনাভঙ্গীও একথাই বলছে--- إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا “তবে যারা তাওবা করেছে” এর
সম্পর্ক শুধুমাত্র أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ “তারাই ফাসেক” এর সাথেই রয়েছে। তাই এ বাক্যের মধ্যে প্রথম দু’টি কথা বলা
হয়েছে কেবলমাত্র নির্দেশমূলক শব্দের মাধ্যমে। অর্থাৎ “তাদেরকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো।” “এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না।” আর তৃতীয় কথাটি বলা হয়েছে খবর পরিবেশন করার
ভঙ্গীতে। অর্থাৎ “তারা নিজেরাই
ফাসেক”। এ তৃতীয় কথাটির পরে সাথে
সাথেই, “তারা ছাড়া
যারা তাওবা করে নিয়েছে” একথা বলা প্রকাশ করে দেয় যে, এ
ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষের খবর পরিবেশন সংক্রান্ত বাক্যাংশটির সাথে সম্পর্কিত। পূর্বের দু’টি নির্দেশমূলক বাক্যাংশের সাথে এর
সম্পর্ক নেই। তবুও যদি এ কথা মেনে নেয়া
হয় যে, এ
ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষ বাক্যাংশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, তাহলে
এরপর বুঝে আসে না তা “সাক্ষ্য গ্রহণ করো না” বাক্যাংশ পর্যন্ত এসে থেমে গেল কেন,
“আশি ঘা বেত্রাঘাত করো” বাক্যাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল না কেন?
দশঃ প্রশ্ন করা যেতে পারে, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর মাধ্যমে ব্যতিক্রম
করাটাকে প্রথম হুকুমটির সাথে সম্পর্কিত বলে মেনে নেয়া যায় না কেন? মিথ্যা অপবাদ তো আসলে এক ধরনের
মানহানিই। এরপর এক ব্যক্তি নিজের দোষ
মেনে নিয়েছে, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আর এ
ধরনের কাজ করবে না বলে তাওবা করেছে। তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না কেন? অথচ আল্লাহ নিজেই হুকুম বর্ণনা
করার পর বলছেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا......... فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ আল্লাহ মাফ করে দেবেন কিন্তু
বান্দা মাফ করবে না, এটাতো সত্যই বড় অদ্ভূত ব্যাপার হবে। এর জবাব হচ্ছেঃ তাওবা আসলে ت-و-ب-ه সমন্বিত চার অক্ষরের একটি
শব্দ মাত্র নয়। বরং হৃদয়ের লজ্জানুভূতি, সংশোধনের দৃঢ়-সংকল্প ও সততার
দিকে ফিরে যাওয়ার নাম। এর এ জিনিসটির অবস্থা আর কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই তাওবার কারণে পার্থিব শাস্তি মাফ হয় না। বরং শুধুমাত্র পরকালীন শাস্তি মাফ হয়। এ কারণে আল্লাহ বলেননি, যদি তারা তাওবা করে নেয় তাহলে
তোমরা তাদেরকে ছেড়ে দাও বরং বলেছেন, যারা তাওবা করে নেবে আমি
তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও করুণাময়। যদি তাওবার সাহায্যে পার্থিব শাস্তি মাফ হয়ে যেতে থাকে, তাহলে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য
তাওবা করবে না এমন অপরাধী কে আছে?
এগারঃ এ প্রশ্নও করা যেতে পারে, এক ব্যক্তির নিজের অভিযোগের
স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করতে না পারার মানে তো এ নয় যে, সে
মিথ্যুক। এটা কি সম্ভব নয় যে, তার অভিযোগ যথার্থই সঠিক
কিন্তু সে এর স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি? তাহলে
শুধুমাত্র প্রমাণ পেশ করতে না পারার কারণে তাকে কেবল মানুষের সামনেই নয়, আল্লাহর সামনেও ফাসেক গণ্য করা হবে, এর কারণ কি?
এর জবাব হচ্ছে, এক ব্যক্তি নিজের চোখেও যদি
কাউকে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও সে তা নিয়ে আলোচনা করলে এবং সাক্ষী ছাড়া তার
বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করতে থাকলে গোনাহগার হবে। এক ব্যক্তি যদি কোন ময়লা আবর্জনা নিয়ে এক কোণে বসে থাকে
তাহলে অন্য ব্যক্তি উঠে সমগ্র সমাজ দেহে তা ছড়িয়ে বেড়াক আল্লাহর শরীয়াত এটা চায় না। সে যদি এ ময়লা-আবর্জনার খবর জেনে থাকে তাহলে
তার জন্য দু’টি পথ থাকে।
যেখানে তা পড়ে আছে সেখানে তাকে পড়ে থাকতে দেবে অথবা তার উপস্থিতির প্রমাণ পেশ করবে, যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ
তা পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন। এ দু’টি পথ ছাড়া তৃতীয় কোন পথ তার জন্য নেই। যদি সে জনগণের মধ্যে এর আলোচনা শুরু করে দেয় তাহলে এক
জায়গায় আটকে থাকা আবর্জনাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার অপরাধে অভিযুক্ত হবে। আর যদি সে যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষ্য ছাড়াই বিষয়টি
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে নিয়ে যায় তাহলে শাসকগণ তা পরিষ্কার করতে পারবেন না। ফলে এ মামলায় ব্যর্থতা আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ার
কারণও হবে এবং ব্যভিচারীদের মনে তা সাহসের সঞ্চারও করবে। এজন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া মিথ্যা অভিযোগকারী বাস্তবে যতই
সত্যবাদী হোক না কেন সে একজন ফাসেকই।
বারঃ মিথ্যা অপবাদের ‘হদে’র ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের অভিমত
হচ্ছে অপবাদদাতাকে যিনাকারীর তুলনায় হাল্কা মার মারতে হবে। অর্থাৎ ৮০ ঘা বেতই মারা হবে কিন্তু যিনাকারীকে যেমন
কঠোরভাবে প্রহার করা হয় তাকে ঠিক ততটা কঠোরভাবে প্রহার করা হবে না। কারণ যে অভিযোগের দরুন তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে
সে ব্যাপারে তার মিথ্যাবাদী হওয়াটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তেরঃ মিথ্যা অপবাদের পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে হানাফী ও অধিকাংশ
ফকীহের অভিমত হচ্ছে এই যে, অপবাদদাতা শাস্তি পাবার আগে বা মাঝখানে যতবারই এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপবাদ
আরোপ করুক না কেন ‘হদ’ তার ওপর একবারই জারি হবে। আর যদি হদ জারি করার পর সে নিজের পূর্ববর্তী অপরাধেরই
পুনরাবৃত্তি করতে থাকে তাহলে যে ‘হদ’ তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে তা-ই যথেষ্ট হবে। তবে যদি হদ জারি করার পর সে ঐ ব্যক্তির
বিরুদ্ধে নতুন কোন যিনার অপবাদ দেয় তাহলে আবার নতুন করে মামলা দায়ের করা হবে। মুগীরাহ ইবনে শু’বার রা. মামলায় শাস্তির পাবার
পর আবু বাক্রাহ প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুগীরাহ যিনা করেছিল।’’ হযরত উমর রা. আবার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সংকল্প করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি আগের অপবাদেরই পুনরাবৃত্তি
করছিলেন, তাই হযরত আলী রা. তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলা চালানো যেতে পারে না বলে রায়
দেন। হযরত উমর তাঁর রায় গ্রহণ
করেন। এরপর ফকীহগণ ঐকমত্যে পৌঁছেন
যে, শাস্তিপ্রাপ্ত
মিথ্যা অপবাদদাতাকে কেবলমাত্র নতুন অপবাদেই পাকড়াও করা যেতে পারে, আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তিতে নয়।
চৌদ্দঃ কোন দল বা গোষ্ঠীর ওপর মিথ্যা অপবাদের ব্যাপারে ফকীহগণের
মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হানাফীরা বলেন, যদি এক ব্যক্তি বহু লোকের
বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়, যদিও তা একটি শব্দে বা আলাদা আলাদা
শব্দে হয়, তাহলেও তার ওপর একটি ‘হদ’ জারি করা হবে। তবে যদি ‘হদ’ জারির পর সে আবার কোন নতুন
মিথ্যা অপবাদের অবতারণা করে তাহলে সে জন্য পৃথক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কারণ আয়াতের শব্দের মধ্যে বলা হয়েছেঃ ‘‘যারা
সতী সাধ্বী মেয়েদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়।” এ কথা থেকে জানা যায়, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই নয়, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপকারীও শুধুমাত্র একটি ‘হদের’ হকদার হয়। এ ব্যাপারে আরো একটি যুক্তি এই যে, যিনার এমন কোন অপবাদই হতে পারে
না যা কমপক্ষে দু’ব্যক্তির ওপর আরোপিত হয় না। কিন্তু এ সত্ত্বেও শরীয়াত প্রবর্তক একটি ‘হদেরই হুকুম
দিয়েছেন। নারীর বিরুদ্ধে অপবাদের
জন্য আলাদা এবং পুরুষের বিরুদ্ধে অপবাদের জন্য আলাদা ‘হদ’ জারি করার হকুম দেননি। এর বিপরীতে ইমাম শাফেঈ বলেন, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ
দানকারী এক শব্দে বা আলাদা আলাদা শব্দে অপবাদ দান করুক না কেন, সে জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির বাবদ এক একটি পূর্ণ ‘হদ’ জারি করা হবে। উসমান আলবাত্তীও এ অভিমত প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে ইবনে আবীলাইলার উক্তি, শা’বী ও আওযাঈও যার সাথে
অভিন্ন মত পোষণ করেন তা হচ্ছে এই যে, একটি বিবৃতির মাধ্যমে
পুরো দলের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী একটি হদের হকদার হবে এবং আলাদা আলাদা
বিবৃতির মাধ্যমে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী প্রত্যেকটি অপবাদের
জন্য আলাদা আলাদা হদের অধিকারী হবে।
﴿وَالَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَاجَهُمْ
وَلَمْ يَكُن لَّهُمْ شُهَدَاءُ إِلَّا أَنفُسُهُمْ فَشَهَادَةُ أَحَدِهِمْ أَرْبَعُ
شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ ۙ إِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৬। আর যারা
নিজেদের স্ত্রীদেরকে অভিযোগ দেয় এবং তাদের কাছে তারা নিজেরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন
সাক্ষী থাকে না, তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির সাক্ষ হচ্ছে (এই যে, সে) চার বার আল্লাহর নামে কসম
খেয়ে সাক্ষ দেবে যে, সে (নিজের
অভিযোগে) সত্যবাদী
﴿وَالْخَامِسَةُ أَنَّ لَعْنَتَ
اللَّهِ عَلَيْهِ إِن كَانَ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
৭। এবং পঞ্চম
বার বলবে, তার প্রতি
আল্লাহর লা’নত হোক যদি সে (নিজের অভিযোগে) মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে।
﴿وَيَدْرَأُ عَنْهَا الْعَذَابَ
أَن تَشْهَدَ أَرْبَعَ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ ۙ إِنَّهُ لَمِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
৮। আর
স্ত্রীর শাস্তি এভাবে রহিত হতে পারে যদি সে চার বার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে সাক্ষ
দেয় যে, এ
ব্যক্তি(তার অভিযোগে) মিথ্যাবাদী
﴿وَالْخَامِسَةَ أَنَّ غَضَبَ
اللَّهِ عَلَيْهَا إِن كَانَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৯। এবং
পঞ্চমবার বলে, তার নিজের
ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসুক যদি এ ব্যক্তি (তার অভিযোগে) সত্যবাদী হয়।৭
৭. এ আয়াত পেছনের আয়াতের কিছুকাল পরে নাযিল হয়। মিথ্যা অপবাদের বিধান যখন নাযিল হয় তখন লোকদের
মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়, ভিন পুরুষ ও নারীর চরিত্রহীনতা দেখে তো মানুষ সবর করতে পারে, সাক্ষী না থাকলে ঠোঁটে তালা লাগাতে পারে এবং ঘটনাটি উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর চরিত্রহীনতা দেখলে কি
করবে? হত্যা করলে
তো উল্টো শাস্তি লাভের যোগ্য হয়ে যাবে। সাক্ষী খুঁজতে গেলে তাদের আসা পর্যন্ত অপরাধী সেখানে
অপেক্ষা করতে যাবে কেন? আর সবর করলে তা করবেই বা কেমন করে। তালাক দিয়ে স্ত্রীকে বিদায় করে দিতে পারে। কিন্তু এর ফলে না মেয়েটির কোন বস্তুগত বা
নৈতিক শাস্তি হলো, না তার প্রেমিকের। আর যদি তার অবৈধ গর্ভসঞ্চার হয়, তাহলে অন্যের সন্তান নিজের গলায় ঝুললো। এ প্রশ্নটি প্রথমে হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ একটি
কাল্পনিক প্রশ্নের আকারে পেশ করেন। তিনি এতদূর বলে দেন, আমি যদি আল্লাহ না করুন নিজের ঘরে এ অবস্থা দেখি, তাহলে
সাক্ষীর সন্ধানে যাবো না বরং তলোয়ারের মাধ্যমে তখনই এর হেস্তনেস্ত করে ফেলবো। (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু মাত্র কিছুদিন পরেই
এমন কিছু মামলা দায়ের হলো যেখানে স্বামীরা স্বচক্ষেই এ ব্যাপার দেখলো এবং নবী সা.
এর কাছে এর অভিযোগ নিয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও ইবনে উমরের রেওয়ায়াত অনুযায়ী আনসারদের এক ব্যক্তি
(সম্ভবত উওয়াইমির আজ্লানী) রসূলের সামনে হাযির হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি এক
ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর সাথে পরপুরুষকে পায় এবং সে মুখ থেকে সে কথা বের করে ফেলে,
তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের “হদ” জারি করবেন, হত্যা করলে আপনি তাকে হত্যা করবেন, নীরব থাকলে সে
চাপা ক্রোধে ফুঁসতে থাকবে। শেষমেশ সে করবে কি? এ কথায় রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করেনঃ হে আল্লাহ! এ বিষয়টির ফায়সালা করে দাও। (মুসলিম, বুখারী, আবু দাউদ,
আহমাদ ও নাসাঈ) ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, হেলাল
ইবনে উমাইয়াহ এসে নিজের স্ত্রীর ব্যাপারটি পেশ করেন। তিনি তাকে নিজের চোখে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকতে দেখেছিলেন। নবী সা. বলেন, “প্রমাণ আনো, অন্যথায় তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি জারি হবে।” এতে সাহাবীদের মধ্যে সাধারণভাবে পেরেশানী
সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হেলাল বলেন, সেই আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, আমি একদম সঠিক ঘটনাই তুলে ধরছি, আমার চোখ এ ঘটনা
প্রত্যক্ষ করেছে এবং কান শুনেছে। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার ব্যাপারে এমন হুকুম নাযিল
করবেন যা আমার পিঠ বাঁচাবে। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয়। (বুখারী, আহমাদ ও আবুদ দাউদ) এখানে মীমাংসার যে পদ্ধতি দেয়া হয়েছে তাকে ইসলাম আইনের
পরিভাষায় “লি’আন” বলা হয়।
এ হুকুম এসে যাবার পর নবী সা. যেসব মামলার ফায়সালা দেন সেগুলোর বিস্তারিত
বিবরণ হাদীসের কিতাবগুলোতে লিখিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সেগুলোই লি’আন
সংক্রান্ত বিস্তারিত আইনগত কার্যধারার উৎস।
হেলাল ইবনে উমাইয়ার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণ সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদ
এবং তাফসীরে ইবনে জারিরে ইবনে আব্বাস ও আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে
তাতে বলা হয়েছেঃ এ আয়াত নাযিল হবার পর হেলাল ও তার স্ত্রী দু’জনকে নবীর আদালতে
হাযির করা হয়। রাসূলুল্লাহ সা. প্রথমে আল্লাহর হুকুম শুনান। তারপর বলেন, “খুব ভালভাবে বুঝে নাও,
আখেরাতের শাস্তি দুনিয়ার শাস্তির চাইতে কঠিন।” হেলাল বলেন, “আমি এর বিরুদ্ধে একদম সত্য
অভিযোগ দিয়েছি।”
স্ত্রী বলে, “এ সম্পূর্ণ মিথ্যা।” রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “বেশ, তাহলে এদের দু’জনের মধ্যে লি’আন
করানো হোক।”
তদনুসারে প্রথমে হেলাল উঠে দাঁড়ায়। তিনি কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কসম খাওয়া শুরু করেন। এ সময় নবী সা. বারবার বলতে থাকেন, “আল্লাহ্ জানেন তোমাদের মধ্যে
অবশ্যই একজন মিথ্যেবাদী। তারপর কি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাওবা করবে?” পঞ্চম কসমের পূর্বে উপস্থিত
লোকেরা হেলালকে বললো, “আল্লাহকে ভয় করো। দুনিয়ার শাস্তি পরকালের শাস্তির চেয়ে হালকা। এ পঞ্চম কসম তোমার ওপর শাস্তি ওয়াজিব করে
দেবে।” কিন্তু হেলাল বলেন, যে আল্লাহ এখানে আমার পিঠ
বাঁচিয়েছেন তিনি পরকালেও আমাকে শাস্তি দেবেন না। একথা বলে তিনি পঞ্চম কসমও খান। তারপর তার স্ত্রী ওঠে। সেও কসম খেতে শুরু করে। পঞ্চম কসমের পূর্বে তাকেও থামিয়ে বলা হয়, “আল্লাহকে ভয় করো, আখেরাতের
আযাবের তুলনায় দুনিয়ার আযাব বরদাশত করে নেয়া সহজ। এ শেষ কসমটি তোমার ওপর আল্লাহর আযাব ওয়াজিব করে দেবে।” একথা শুনে সে কিছুক্ষণ থেমে যায় এবং ইতস্তত
করতে থাকে। লোকেরা মনে করে নিজের
অপরাধ স্বীকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারপর সে বলতে থাকে। “আমি চিরকালের জন্য নিজের গোত্রকে লাঞ্ছিত করবো না।” তারপর সে পঞ্চম কসমটিও খায়। অতঃপর নবী সা. তাদের উভয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং
ফায়সালা দেন, এর সন্তান (যে তখন মাতৃগর্ভে ছিল) মায়ের সাথে সম্পর্কিত হবে। বাপের সাথে সম্পর্কিত করে তার নাম ডাকা হবে না। তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবার অধিকার
কারোর থাকবে না। যে ব্যক্তি তার বা তার
সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবে সে মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তির অধিকারী হবে। ইদ্দতকালে তার খোরপোশ ও বাসস্থান লাভের কোন
অধিকার হেলালের ওপর বর্তায় না। কারণ তাকে তালাক বা মৃত্যু ছাড়াই স্বামী থেকে আলাদা করা হচ্ছে। তারপর তিনি লোকদের বলেন, তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর
দেখো সে কার মতো হয়েছে। যদি এ আকৃতির হয় তাহলে হেলালের হবে। আর যদি ঐ আকৃতির হয়, তাহলে যে ব্যক্তির সাথে মিলিয়ে একে অপবাদ
দেয়া হয়েছে এ তার হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখা গেলো সে শেষোক্ত ব্যক্তির আকৃতি পেয়েছে। এ অবস্থায় নবী সা. বলেন, لو لا الايمان অর্থাৎ যদি কসমসমূহ না হতো
(অথবা বর্ণনান্তরে لَكَانَ لِى وَلَهَا شَأْنٌ
(لَوْلاَ مَا مَضَى مِنْ كِتَابِ اللَّهِ) আল্লাহর কিতাব প্রথমেই
ফায়সালা না করে দিতো) তাহলে আমি এ মেয়েটির সাথে কঠোর ব্যবহার করতাম।
‘উওয়াইমির আজলানীর মামলার বিবরণ পাওয়া যায় বুখারী, মুসলিম,
আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে
মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ। সাহল ইবনে সা’দ সা’ঈদী ও ইবনে উমর রা. থেকে এগুলো বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেঃ উওয়াইমির ও তার স্ত্রী উভয়কে
মসজিদে নববীতে ডাকা হয়।
তারা নিজেদের ওপর ‘লি’আন’ করার আগে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়ে
তিনবার বলেন, “আল্লাহ্ খুব ভালভাবেই জানেন তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তাহলে কি তোমাদের কেউ তাওবা করবে?” দু’জনের কেউ যখন তাওবা করলো
না তখন তাদের ‘লি’আন’ করানো হয়। এরপর ‘উওয়াইমির বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি এ স্ত্রীকে
রেখে দেই তাহলে মিথ্যুক হবো।” একথা বলেই রাসূলুল্লাহ সা. তাকে হুকুম দেয়া ছাড়াই তিনি তিন তালাক দিয়ে দেন। সাহল ইবনে সা’দ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সা. এ তালাক জারি
করেন, তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং বলেন, “যে দম্পতি লি’আন করবে তাদের জন্য এ ছাড়াছাড়ি।” লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেবার এ সুন্নত
কায়েম হয়ে যায়। এরপর তারা আর কখনো একত্র
হতে পারবে না। সাহল ইবনে সা’দ একথাও
বর্ণনা করেন যে, স্ত্রী গর্ভবতী ছিল এবং ‘উওয়াইমির বলেন, এ গর্ভ আমার
ঔরসজাত নয়। এজন্য শিশুকে মায়ের সাথে
সম্পর্কিত করা হয় এবং এ সুন্নত জারি হয় যে, এ ধরনের সন্তান মায়ের উত্তরাধিকারী হবে এবং
মা তার উত্তরাধিকারী হবে।
এ দু’টি মামলা ছাড়া হাদীসের কিতাবগুলোতে আমরা এমন বহু রেওয়ায়াত পাই যেগুলো
থেকে এ মামলাগুলো কাদের সাথে জড়িত ছিল তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। হতে পারে সেগুলোর কোন কোনটি এ দু’টি মামলার
সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু কয়েকটিতে অন্য কিছু
মামলার কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে লি’আন আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর
আলোকপাত হয়।
ইবনে উমর একটি মামলার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী লি’আন শেষ করার পর নবী সা.
তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন। (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ ও ইবনে
জারীর) ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও
তার স্ত্রীর মধ্যে লি’আন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী সা. তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং
ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। (সিহাহে সিত্তা ও আহমাদ) ইবনে উমরেরই আর একটি রেওয়ায়াতে
বলা হয়েছে, উভয়ের লি’আন করার পরে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “তোমাদের
হিসাব এখন আল্লাহর জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, لَا سَبِيلَ لَكَ عَلَيْهَا (অর্থ এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর ওপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর ওপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার
প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই)। পুরুষটি বলে হে আল্লাহর রাসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে
দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ
لاَ مَالَ لَكَ ، إِنْ كُنْتَ صَدَقْتَ عَلَيْهَا ،
فَهْوَ بِمَا اسْتَحْلَلْتَ مِنْ فَرْجِهَا ، وَإِنْ كُنْتَ كَذَبْتَ عَلَيْهَا ، فَذَاكَ
أَبْعَدُ وأَبْعَدُ لَكَ منها
“সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার ওপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে
আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো। তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে
গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে
তা বেশী দূরে রয়েছে।”
(বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)।
দারুকুত্নী আলী ইবনে আবু তালেব ও ইবনে মাসউদ রা. এর উক্তি উদ্ধৃত করেছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত
হয়েছে যে, লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো একত্র হতে পারে না।” (অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আর কোনদিন তাদের মধ্যে
বিয়ে হতে পারে না)। আবার এ দারুকত্নী হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নবী সা. বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না।
কাবীসাহ ইবনে যুওয়াইব বর্ণনা করেছেন, হযরত উমরের আমলে এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর
গর্ভের সন্তানকে অবৈধ গণ্য করে তারপর আবার তা নিজের বলে স্বীকার করে নেয়। তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর বলতে থাকে, এ শিশু আমার নয়। ব্যাপারটি হযরত উমরের আদালতে পেশ হয়। তিনি তার ওপর কাযাফের শাস্তি জারি করেন এবং
ফায়সালা দেন, শিশু তার সাথেই সম্পর্কিত হবে। (দারুকুত্নী বাইহাকী)।
ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলে, আমার একটি
স্ত্রী আছে, আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, সে কোন স্পর্শকারীর হাত ঠেলে
দেয় না। (উল্লেখ্য, এটি একটি রূপক ছিল। এর অর্থ যিনাও হতে পারে আবার যিনার কম
পর্যায়ের নৈতিক দুর্বলতাও হতে পারে।) নবী সা. বলেন, তালাক দিয়ে দাও। সে বলে, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারি না। জবাব দেন, তুমি তাকে রেখে দাও। (অর্থাৎ তিনি তার কাছ থেকে তার ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা নেননি
এবং তার উক্তিকে যিনার অপবাদ হিসেবে গণ্য করে লি’আন করার হুকুম দেননি।) ---নাসাঈ।
আবু হুরাইরা রা. বলেছেন, এক ব্যক্তি হাজির হয়ে বলে, আমার স্ত্রী
কালো ছেলে জন্ম দিয়েছে। আমি তাকে আমার সন্তান বলে মনে করি না। (অর্থাৎ নিছক শিশু সন্তানের গায়ের রং তাকে সন্দেহের মধ্যে
নিক্ষেপ করেছিল। নয়তো তার দৃষ্টিতে স্ত্রীর
ওপর যিনার অপবাদ লাগাবার অন্য কোন কারণ ছিল না।) রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করেন, তোমার তো কিছু উট আছে? সে বলে, হ্যাঁ, আছে। জিজ্ঞেস করেন, সেগুলোর রং কি? জবাব দেয় লাল। জিজ্ঞেস করেন, তাদের মধ্যে কোনটা কি খাকি রংয়ের আছে? জবাব দেয়,
জি হ্যাঁ, কোন কোনটা এমনও আছে। জিজ্ঞেস করেন, এ রংটি কোথায় থেকে এলো?
জবাব দেয়, হয়তো কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে। (অর্থাৎ তাদের বাপ-দাদাদের কেউ এ রংয়ের থেকে
থাকবে এবং তার প্রভাব এর মধ্যে এসে গেছে।) তিনি বলেন, “সম্ভবত এ শিশুটিকেও কোন শিরা টেনে নিয়ে
গেছে।” তারপর তিনি তাকে সন্তানের
বংশধারা অস্বীকার করার অনুমতি দেননি। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও আবুদ দাউদ।)
আবু হুরাইরার রা. অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, নবী সা. লি’আন সম্পর্কিত আয়াত
আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, “যে স্ত্রী কোন বংশে এমন সন্তান
প্রবেশ করায় যে ঐ বংশের নয় (অর্থাৎ হারামের শিশু গর্ভে ধারণ করে স্বামীর ঘাড়ে
চাপিয়ে দেয়) তার আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তাকে কখ্খনো জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। আর যে পুরুষ নিজের সন্তানের বংশধারা অস্বীকার
করে অথচ সন্তান তাকে দেখছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে পর্দা করবেন এবং পূর্বের ও পরের সমস্ত সৃষ্টির
সামনে তাকে লাঞ্ছিত করবেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ ও দারেমী।)
লি’আনের আয়াত এবং এ হাদীসগুলো, নজিরসমূহ ও শরীয়াতের সাধারণ মূলনীতিগুলোই
হচ্ছে ইসলামের লি’আনের আইনের উৎস। এগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি’আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী
করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ
ধারাগুলো হচ্ছেঃ
একঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি’আনের পথ
অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন
হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না,
তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে
(অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিনার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে
দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন
যে, যাকে হত্যা
করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া
হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে
তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিনার চারজন সাক্ষী পেশ করবে
অথবা নিহত ব্যক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা
করছিল এবং এ সঙ্গে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে। (নাইলুল আওতার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৮
পৃষ্ঠা)।
দুইঃ ঘরে বসে লি’আন হতে পারে না। এজন্য আদালতে যাওয়া জরুরী।
তিনঃ লি’আন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার ওপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার
শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লি’আন দাবী করতে
পারে।
চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লি’আন হতে পারে অথবা এজন্য
তাদের দু’জনের মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে
নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি’আনের যোগ্যতা সম্পন্ন হবার জন্য
যথেষ্ট। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী
মুসলিম বা কাফের, গোলাম বা স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী হোক
বা না হোক এবং মুসলিম স্বামীর স্ত্রী মুসলমান বা জিম্মি যেই হোক না কেন তাতে কিছু
আসে যায় না। প্রায় একই ধরণের অভিমত ইমাম
মালেক ও ইমাম আহমাদেরও।
কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লি’আন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলমান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা
কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, গোলাম বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি
প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লি’আন হতে পারে না। এছাড়াও যদি স্ত্রী এর আগেও কখনো হারাম বা
সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি করে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রেও লি’আন ঠিক
হবে না। হানাফীগনের এর শর্তগুলো
আরোপ করার কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের মতে লি’আন ও কাযাফের আইনের মধ্যে এছাড়া আর কোন পার্থক্য
নেই যে, অন্য ব্যক্তি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয় তাহলে
তার জন্য রয়েছে ‘হদ’ আর স্বামী এ অপবাদ দিলে সে লি’আন করে অব্যাহতি লাভ করতে পারে। বাকি অন্যান্য সবদিক দিয়ে লি’আন ও কাযাফ একই
জিনিস। এ দেবার যোগ্যতা নেই এমন
কোন ব্যক্তিকে তারা এর অনুমতি দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে হানাফীদের অভিমত দুর্বল এবং ইমাম শাফেঈ যে
কথাটি বলেছেন সেটিই সঠিক। এর
প্রথম কারণ হচ্ছে, কুরআন স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফের ব্যাপারটিকে কাযাফের আয়াতের একটি অংশে
পরিণত করেনি বরং সেজন্য একটি স্বতন্ত্র আইন বর্ণনা করেছেন তাই তাকে কাযাফের আয়াতের
শব্দাবলী থেকে আলাদা এবং উভয় হুকুমও ভিন্ন। তাই লি’আনের আয়াত থেকেই লি’আনের বিধান গ্রহণ করা উচিত। কাযাফের আয়াত থেকে নয়। যেমন কাযাফের আয়াতের শাস্তি লাভের যোগ্য হচ্ছে এমন লোক যে
সতী সাধ্বী স্ত্রীর শর্ত আরোপ করা হয়নি। একটি মেয়ে কোন সময় হয়তো পাপ কাজ করেছিল, যদি পরবর্তীকালে সে তাওবা করে
কোন পুরুষকে বিয়ে করে এবং তারপর তার স্বামী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়,
তাহলে লি’আনের আয়াত একথা বলে না যে, এ মেয়ের
স্বামীকে এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেবার বা এর সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার ব্যাপক
অনুমতি দিয়ে দাও, কারণ এর জীবন এক সময় কলুষিত ছিল। দ্বিতীয় এবং ঠিক একই পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ
হচ্ছে এই যে, স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফ ও অপরিচিতার বিরুদ্ধে কাযাফের মধ্যে আসমান যমীন
ফারাক। এদের উভয়ের ব্যাপারে আইনের
প্রকৃতি এক হতে পারে না।
পরনারীর সাথে অন্য পুরুষের আবেগ-অনুভূত, ইজ্জত-আব্রু, সমাজ-সংস্কৃতি
ও বংশ গোত্রগত কোন সম্পর্ক হতে পারে না। তার চালচলনের ব্যাপারে যদি কোন ব্যক্তির খুব বেশী আগ্রহ
সৃষ্টি হতে পারে তাহলে তা হবে তার সমাজকে চরিত্রহীনতা মুক্ত দেখার আবেগ থেকে। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীর সাথে মানুষের
সম্পর্ক এক ধরনের নয়, কয়েক ধরনের এবং অত্যন্ত গভীর। সে একাধারে তার বংশধারা, ধন-সম্পদ ও গৃহের আমানতদার। তার জীবন সঙ্গিনী। তার গোপনীয়তার সংরক্ষক। তার অত্যন্ত গভীর ও সংবেদনশীল আবেগ-অনুভূতি তার সাথে জড়িত। তার খারাপ চালচলনে মানুষের আত্মমর্যাদা, ইজ্জত, স্বার্থ
ও ভবিষ্যত বংশধরদের পর সুগভীর আঘাত আসে। এ দু’টি ব্যাপার কোন্ দিক দিয়ে এক, যার ফলে উভয়ের জন্য আইনের একই
প্রকৃতি হতে হবে? একজন জিম্মি অথবা গোলাম কিংবা সাজাপ্রাপ্ত
ব্যক্তির জন্য তার স্ত্রীর ব্যাপার কি কোন স্বাধীন সাক্ষ্যদানের যোগ্য মুসলমানের
ব্যাপার থেকে সামান্যতম ভিন্ন অথবা গুরুত্ব ও ফলাফলের দিক দিয়ে একটুখানিও কম?
সে যদি নিজের চোখের নিজের স্ত্রীকে কারোর সাথে ডলাডলি করতে দেখতো
অথবা সে যদি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতো যে, তার স্ত্রী অন্য
কারোর সংস্পর্শে গর্ভবতী হয়ে গেছে, তাহলে তাকে লি’আন করার
অধিকার না দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? আর এ অধিকার
তার থেকে ছিনিয়ে নেবার পর আমাদের আইনে তার জন্য আর কি পথ আছে? কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার জানা যায়। বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে স্ত্রীর যথার্থ ব্যভিচার বা অবৈধ
গর্ভধারণের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা
অস্বীকারের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা
অস্বীকারের ফলে একজন স্ত্রী যে জটিল সমস্যায় ভুগতে থাকে কুরআন তাদেরকে তা থেকে
উদ্ধার করার জন্য একটি উপায় বের করতে চায়। এ প্রয়োজন শুধুমাত্র সাক্ষ্যদানের যোগ্য স্বাধীন
মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট নয় এবং কুরআনের শব্দাবলীর মধ্যেও এমন কোন জিনিস নেই যা
এ প্রয়োজনটি শুধুমাত্র তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। তবে কুরআন লি’আনের কসমকে সাক্ষ্যদান হিসেবে গণ্য করেছে তাই
সাক্ষ্যদানের শর্তাবলী এখানে আরোপিত হবে, এ যুক্তি পেশ করলে এর দাবী হবে, ন্যায়নিষ্ঠ গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী স্বামী যদি কসম খায় এবং স্ত্রী
কসম খেতে ইতস্তত করে তাহলে স্ত্রীকে রজম করা হবে। কারণ ব্যভিচারের ওপর সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এ অবস্থায় হানাফীগণ রজম করার
হুকুম দেন না।
তারা নিজেরাই যে এ কসমগুলোকে হুবহু সাক্ষ্যের মর্যাদা দান করেন না এটা তারই
সুস্পষ্ট প্রমাণ। বরং সত্য বলতে কি স্বয়ং
কুরআনও এ কসমগুলোকে সাক্ষ্য শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করল এগুলোকে সাক্ষ্য গণ্য করে
না। নয়তো স্ত্রীকে চারটি কসমের
পরিবর্তে আটটি কসম খাবার হুকুম দিতো।
পাঁচঃ নিছক ইশারা-ইঙ্গিত, রূপক, উপমা বা
সন্দেহ-সংশয় প্রকাশের ফলে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না। বরং কেবলমাত্র এমন অবস্থায় তা অনিবার্য হয় যখন স্বামী
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিনার অপবাদ দেয় অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে
নিতে অস্বীকার করে। ইমাম মালেক ও লাইস ইবনে
সা’দ এর ওপর আরো এ শর্তটি বাড়ান যে, কসম খাবার সময় স্বামীকে বলতে হবে, সে নিজের চোখে স্ত্রীকে ব্যভিচারে রত থাকতে দেখেছে। কিন্তু এটি একটি ভিত্তিহীন শর্ত। কুরআনে এর কোন ভিত্তি নেই, হাদীসেও নেই।
ছয়ঃ যদি অপবাদ দেবার পর স্বামী কসম খেতে ইতস্তত করে বা ছলনার
আশ্রয় নেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর সহযোগীগণ বলেন, তাকে বন্দী করতে হবে এবং
যতক্ষণ সে লি’আন না করে অথবা নিজের অপবাদকে মিথ্যা বলে না মেনে নেয় ততক্ষণ তাকে
মুক্তি দেয়া হবে না। আর মিথ্যা বলে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কাযাফের দণ্ড জারি হয়ে যাবে। এর বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেক, শাফেঈ, হাসান
ইবনে, সালেহ ও লাইস ইবনে সা’দের মতে, লি’আন
করতে ইতস্তত করার ব্যাপারটি নিজেই মিথ্যার স্বীকারোক্তি। তাই কাযাফের হদ্ ওয়াজিব হয়ে যায়।
সাতঃ স্বামীর কসম খাওয়ার পর স্ত্রী যদি লি’আন করতে ইতস্তত করে, তাহলে হানাফীদের মতে তাকে
বন্দী করতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না যতক্ষণ না সে লি’আন
করবে অথবা তারপর যিনার স্বীকারোক্তি না করে নেবে। অন্যদিকে উপরোক্ত ইমামগণ বলেন, এ অবস্থায় তাকে রজম করে দেয়া
হবে। তারা কুরআনের ঐ উক্তি থেকে
পেশ করেন যে, একমাত্র কসম খাওয়ার পরই স্ত্রী শাস্তি মুক্ত হবে। এখন যেহেতু সে কসম খাচ্ছে না, তাই নিশ্চিতভাবেই সে শাস্তি
যোগ্য হবে। কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা
হচ্ছে, কুরআন এখানে
“শাস্তির’ ধরণ বলে দেয়নি বরং সাধারণভাবে শাস্তির কথা বলছে। যদি বলা হয়, শাস্তি মানে এখানে যিনার
শাস্তিই হতে পারে, তাহলে এর জবাব হচ্ছে, যিনার শাস্তির জন্য কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় চার জন সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেছে। নিছক এক জনের চারটি কসম এ শর্ত পূরা করতে পারে
না। স্বামীর কসম তো তার নিজের
কাযাফের শাস্তি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং স্ত্রীর ওপর লি’আনের বিধান প্রবর্তিত হওয়ার
জন্য যথেষ্ট কিন্তু তার মাধ্যমে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ প্রমাণিত হবার জন্য
যথেষ্ট নয়। স্ত্রীর জবাবী কসম খেতে
অস্বীকার করার ফলে অবশ্যই সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় এবং বড়ই গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করে
সত্য কিন্তু সন্দেহের ভিত্তিতে হদ জারী করা যেতে পারে না। এ বিষয়টিকে পুরুষের কাযাফের হদের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। কারণ তার কাযাফ তো প্রমাণিত, এ কারণেই তাকে লি’আন করতে
বাধ্য করা হয়।
কিন্তু এর বিপরীতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ প্রমাণিত হয়। কারণ তার নিজের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন স্বচক্ষে
প্রত্যক্ষকারী সাক্ষীর সাক্ষ্য ছাড়া তা প্রমাণিত হতে পারে না।
আটঃ যদি লি’আনের সময় স্ত্রী গর্ভবর্তী থাকে তাহলে ইমাম আহমাদের
মতে স্বামী গর্ভস্থিত সন্তানকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করুক বা না করুক স্বামীর
গর্ভস্থিত সন্তানের দায়মুক্ত হবার এবং সন্তান তার ঔরসজাত গণ্য না হবার জন্য লি’আন
নিজেই যথেষ্ট। ইমাম শাফেঈ বলেন, স্বামীর যিনার অপবাদ ও
গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক জিনিস নয়। এজন্য স্বামী যতক্ষণ গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ
করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ তা যিনার অপবাদ সত্ত্বেও তার ঔরসজাত
গণ্য হবে। কারণ স্ত্রী যিনাকারীনী
হওয়ার ফলেই বর্তমান গর্ভজাত সন্তানটি যে, যিনার কারণে জন্ম নিয়েছে, এটা অপরিহার্য নয়।
নয়ঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম
আহমাদ স্ত্রীর গর্ভধারণকালে স্বামীকে গর্ভস্থিত সন্তান অস্বীকার করার অনুমতি
দিয়েছেন এবং এরই ভিত্তিতে লি’আনকে বৈধ বলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি স্বামীর অপবাদের ভিত্তি
যিনা না হয়ে থাকে বরং শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, সে স্ত্রীকে
এমন অবস্থায় গর্ভবতী পেয়েছ যখন তার মতে এ গর্ভস্থিত সন্তান তার হতে পারে না তখন এ
অবস্থায় লি’আনের বিষয়টিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় কোন কোন রোগের ফলে গর্ভ সঞ্চার
হয়েছে বলে সন্দেহ দেখা দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ভসঞ্চার হয় না।
দশঃ যদি পিতা সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে লি’আন
অনিবার্য হয় পড়ে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। আবার এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, একবার সন্তানকে গ্রহণ করে নেবার পর (সে
গ্রহণ করাটা যে কোন পর্যায়েরই হোক না কে, সুস্পষ্ট শব্দাবলী
ও বাক্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা হোক অথবা এমন কাজ করা হোক যাতে মনে হয় শিশুকে গ্রহণ করে
নেয়া হয়েছে যেমন, জন্মের পর মোবারকবাদ গ্রহণ করা অথবা শিশুর
সাথে পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করা কিংবা তার প্রতিপালনের ব্যাপারে আগ্রহ
প্রকাশ করা) পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় পিতা বংশধারা অস্বীকার করলে কাযাফের
শাস্তির অধিকারী হবে।
তবে পিতা কতক্ষণ পর্যন্ত বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার রাখে, এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইমাম মালেকের মতে, স্ত্রী যে সময় গর্ভবতী ছিল সে
সময় যদি স্বামী গৃহে উপস্থিত থেকে থাকে তাহলে গর্ভসঞ্চারের সময় থেকে নিয়ে সন্তান
ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়-কালের মধ্যে স্বামীর জন্য সন্তানের বংশধারা অস্বীকার
করার সুযোগ আছে।
এরপর তার অস্বীকার করার অধিকার নেই। তবে এ সময় যদি সে অনুপস্থিত থেকে থাকে এবং তার অসাক্ষাতে সন্তান জন্ম নিয়ে
থাকে তাহলে যখনই সে জানবে তখন তাকে অস্বীকার করে তাহলে লি’আন করে সন্তানের দায়িত্ব
মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এক-দু’বছর পরে
অস্বীকার করে তাহলে লি’আন হবে ঠিকই কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে
না। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরে বা জন্ম
সম্পর্ক জানার পরে চল্লিশ দিনের মধ্যে পিতার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার আছে। এরপর এ অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এ চল্লিশ দিনের শর্ত অর্থহীন। সঠিক কথা সেটিই যেটি ইমাম আবু হানীফা বলেছেন। অর্থাৎ জন্মের পর বা জন্মের কথা জানার পর
এক-দু’দিনের মধ্যেই বংশধারা অস্বীকার করা যেতে পারে। তবে যদি এক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে, যাকে যথার্থ বাধা বলে স্বীকার
করে নেয়া যেতে পারে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
এগারঃ যদি স্বামী তালাক দেবার পর সাধারণভাবে তালাকপ্রাপ্তা
স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে লি’আন হবে না। বরং তার বিরুদ্ধে কাযাফের মামলা দায়ের করা হবে। কারণ লি’আন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর তালাকপ্রাপ্তা নারীটি তার স্ত্রী নয়। তবে যদি রজ’ঈ তালাক হয় এবং রুজু (স্ত্রীকে
ফিরিয়ে নেবার) করার সময়-কালের মধ্যে সে অপবাদ দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ইমাম মালেকের মতে, এটি শুধুমাত্র এমন অবস্থায়
কাযাফ হবে যখন কোন গর্ভস্থিত বা ভূমিষ্ঠ সন্তানের বংশধারা গ্রহণ করা বা না করার
সমস্যা মাঝখানে থাকবে না। অন্যথায় বায়েন তালাক দেবার পরও পুরুষের লি’আন করার অধিকার থাকে। কারণ সে স্ত্রী লোককে বদনাম করার জন্য নয় বরং
নিজেই এমন এক শিশুর দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে লি’আন করছে যাকে সে
নিজের বলে মনে করে না।
ইমাম শাফেঈ প্রায় এই একই মত দিয়েছেন।
বারঃ লি’আনের আইনগত ফলাফলের মধ্য থেকে কোনটার ব্যাপারে সবাই
একমত আবার কোনটার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।
যেসব ফলাফলের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কোন
শাস্তি লাভের উপযুক্ত হয় না। স্বামী যদি সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের। সন্তান বাপের সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার
উত্তরাধিকারীও হবে না। মা
তার উত্তরাধিকারী হবে এবং সে মায়ের উত্তরাধিকারী হবে। নারীকে ব্যভিচারিণী এবং তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার
অধিকার কারোর থাকবে না।
যদিও লি’আনের সময় তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে তার ব্যভিচারিণী হবার
ব্যাপারে কারোর মনে সন্দেহ না থাকে তবুও তার সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের
পুনরাবৃত্তি করবে সে ‘হদে’র যোগ্য হবে। নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না। ইদ্দত পালনকালে নারী পুরুষের থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার
হবে না। নারী ঐ পুরুষের জন্য হারাম
হয়ে যাবে।
দু’টি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক, লি’আনের পরে পুরুষ ও নারী কিতাবে আলাদা হবে? দুই,
লি’আনের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাবার পর কি তাদের উভয়ের আবার মিলিত
হওয়া সম্ভব? প্রথম বিষয়ে ইমাম শাফেঈ বলেন, যখনই পুরুষ লি’আন শেষ করবে, নারী জবাবী লি’আন করুক
বা না করুক তখনই সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। ইমাম মালেক, লাইস ইবনে সা’দ ও যুফার বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই যখন লি’আন শেষ করে তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন,
লি’আনের ফলে ছাড়াছাড়ি আপনা আপনি হয়ে যায় না বরং আদালত ছাড়াছাড়ি করে
দেবার ফলেই ছাড়াছাড়ি হয়। যদি স্বামী নিজেই তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ভালো, অন্যথায় আদালতের বিচারপতি
তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করার কথা ঘোষণা করবেন। দ্বিতীয় বিষয়টিতে ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ, যুফার, সুফিয়ান সওরী, ইসহাক
ইবনে রাহওয়াইহ, শাফেঈ, আহমেদ ইবনে
হাম্বল ও হাসান ইবনে যিয়াদ বলেন, লি’আনের মাধ্যমে যে
স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেছে তারা এরপর থেকে চিরকালের জন্য পরস্পরের ওপর হারাম
হয়ে যাবে। তারা পুনর্বার পরস্পর বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও কোন অবস্থাতেই পারবে না। হযরত উমর রা., হযরত আলী রা. ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদও
রা. একই মত পোষণ করেন। বিপরীতপক্ষে সা’ঈদ ইবনে মুসাইয়েব, ইবরাহীম নাখঈ, শা’বী,
সাঈদ ইবনে জুবাইর, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ
রাহেমাহুমুল্লাহর মতে, যদি স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে
নেয় এবং তার ওপর কাযাফের হদ জারি হয়ে যায় তাহলে তাদের দু’জনের মধ্যে পুনর্বার বিয়ে
হতে পারে। তারা বলেন, তাদের উভয়কে পরস্পরের জন্য
হারামকারী জিনিস হচ্ছে লি’আন। যতক্ষণ তারা এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততক্ষণ হারামও প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু
যখনই স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নিয়ে শাস্তি লাভ করবে তখনই লি’আন খতম হয়ে
যাবে এবং হারামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
﴿وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ
عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ حَكِيمٌ﴾
১০। তোমাদের
প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকলে এবং আল্লাহ বড়ই মনোযোগ দানকারী ও
জ্ঞানী না হলে (স্ত্রীদের প্রতি অভিযোগের ব্যাপারে তোমাদেরকে বড়ই জটিলতার সম্মুখীন
করতো)।
﴿إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا
بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِّنكُمْ ۚ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ
لَّكُمْ ۚ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُم مَّا اكْتَسَبَ مِنَ الْإِثْمِ ۚ وَالَّذِي تَوَلَّىٰ
كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
১১। যারা এ
মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে৮ তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ।৯ এ ঘটনাকে
নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই।১০ যে এর
মধ্যে যতটা অংশ নিয়েছে সে ততটাই গোনাহ কামাই করেছে আর যে ব্যক্তি এর
দায়দায়িত্বের বড় অংশ নিজের মাথায় নিয়েছে১১ তার জন্য
তো রয়েছে মহাশাস্তি।
৮. হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে যে অপবাদ রটানো হয়েছিল সেদিকে
ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ অপবাদকে “ইফ্ক” শব্দের
মাধ্যমে উল্লেখ করে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই এ অপরাধকে পুরোপুরি খণ্ডন করা হয়েছে। ‘ইফ্ক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, কথা উল্টে দেয়া, বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করে দেয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে এ শব্দটিকে ডাহা মিথ্যা ও অপবাদ দেয়া
অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর
কোন দোষারোপ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করলে তখন এর অর্থ হয় সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ।
এ সূরাটি নাযিলের মূলে যে ঘটনাটি আসল কারণ হিসেবে কাজ করেছিল এখান থেকে তার
ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে।
ভূমিকায় এ সম্পর্কিত প্রারম্ভিক ঘটনা আমি হযরত আয়েশার বর্ণনার মাধ্যমে উদ্ধৃত
করেছি। পরবর্তী ঘটনাও তাঁরই মুখে
শুনুন। তিনি বলেনঃ “এ মিথ্যা
অপবাদের গুজব কমবেশি এক মাস ধরে সারা শহরে ছড়াতে থাকে। নবী সা. মারাত্মক ধরনের মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকেন। আমি কাঁদতে থাকি। আমার বাপ-মা চরম পেরেশানী ও দুঃখে-শোকে ভুগতে থাকেন। শেষে একদিন রাসূলুল্লাহ সা. আসেন এবং আমার
কাছে বসেন। এ সমগ্র সময়-কালে তিনি কখনো
আমার কাছে বসেননি। হযরত আবু বকর রা. ও উম্মে
রুমান (হযরত আয়েশার মা) অনুভব করেন আজ কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকর কথা হবে। তাই তাঁরা দু’জনেও কাছে এসে বসেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আয়েশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এই খবর
পৌঁছেছে। যদি তুমি নিরপরাধ হয়ে থাকো
তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার অপরাধ মুক্তির কথা প্রকাশ করে দেবেন। আর যদি তুমি সত্যিই গোনাহে লিপ্ত হয়ে থাকো
তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং ক্ষমা চাও। বান্দা যখন তার গোনাহ স্বীকার করে নিয়ে তাওবা করে তখন
আল্লাহ তা মাফ করে দেন।
একথা শুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। আমি আমার পিতাকে বলি, আপনি রসূলুল্লাহ্র কথার জবাব দিন। তিনি বলেনঃ “মা, আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, কি বলবো।”
আমি আমার মাকে বললাম, “তুমিই কিছু বলো” তিনিও একই কথা বলেন, “আমি কি বলবো
বুঝতে পারছি না।”
একথায় আমি বলি, আপনাদের কানে একটা কথা এসেছে এবং তা মনের মধ্যে জমে বসে গেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি নিরপরাধ এবং আল্লাহ সাক্ষী
আছেন আমি নিরপরাধ--- তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন না। আর যদি এমন একটি কথা আমি স্বীকার করে নিই যা আমি করিনি---
আর আল্লাহ জানেন আমি করিনি--- তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন। আমি সে সময় হযরত ইয়াকুবের (আঃ) নাম স্মরণ করার চেষ্টা করি
কিন্তু নামটি মনে করতে পারিনি। শেষে আমি বলি, এ অবস্থায় আমার জন্য এছাড়া আর কি উপায় থাকে যে, আমি
সেই একই কথা বলি যা হযরত ইউসুফের বাপ বলেছিলেন فَصَبْرٌ جَمِيلٌ (এখানে সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যখন
হযরত ইয়াকুবের সামনে তার ছেলে বিন ইয়াইমিনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদের কথা বর্ণনা
করা হয়েছিলঃ সূরা ইউসুফ ১০ রুকূ’তে একথা আলোচিত হয়েছে)। একথা বলে আমি শুয়ে পড়ি এবং অন্যদিকে পাশ ফিরি। সে সময় আমি মনে মনে বলছিলাম, আল্লাহ জানেন আমি গোনাহ করিনি,
তিনি নিশ্চয়ই সত্য প্রকাশ করে দেবেন। যদিও একথা আমি কল্পনাও করিনি যে, আমার স্বপক্ষে অহী নাযিল হবে
এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। আল্লাহ নিজেই আমার পক্ষ সমর্থন করবেন। এ থেকে নিজেকে আমি অনেক নিম্নতর মনে করতাম। কিন্তু আমার ধারণা ছিল, রাসূলুল্লাহ সা. কোন স্বপ্ন
দেখবেন, যার মাধ্যমে আল্লাহ আমার নির্দোষিতার কথা জানিয়ে
দেবেন। এরই মধ্যে রসূলুল্লাহ্র সা.
ওপর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেলো যা অহী নাযিল হবার সময় হতো, এমন কি ভীষণ শীতের দিনেও তাঁর
মুবারক চেহারা থেকে মুক্তোর মতো স্বেদবিন্দু টপকে পড়তে থাকতো। আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। আমি তো ছিলাম একদম নির্ভীক। কিন্তু আমার বাপ-মার অবস্থা ছিল যেন কাটলে শরীর থেকে এক
ফোঁটা রক্তও পড়বে না।
তারা ভয় পাচ্ছিল, না জানি আল্লাহ কি সত্য প্রকাশ করেন। যখন সে অবস্থা খতম হয়ে গেলো তখন রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন
অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি হেসে প্রথমে যে কথাটি
বলেন, সেটি ছিলঃ
মুবারক হোক আয়েশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন এবং এরপর নবী সা.
দশটি আয়াত শুনান (অর্থাৎ ১১ নম্বর আয়াত থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত)। আমার মা বলেন ওঠো এবং রসূলুল্লাহ্র সা. প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
আমি বললাম, “আমি তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না, তোমাদের
দু’জনের প্রতিও না। বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন। তোমরা তো এ মিথ্যা অপবাদ অস্বীকারও করোনি।” (উল্লেখ্য, এটি কোন একটি বিশেষ হাদীসের
অনুবাদ নয় বরং হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কিত যতগুলো বর্ণনা হযরত আয়েশার
রা. উদ্ধৃত হয়েছে সবগুলোর সার নির্যাস আমি এখানে পরিবেশন করেছি)।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি সূক্ষ্ম কথা অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশার রা. নিরপরাধ হবার কথা বর্ণনা করার আগে পুরো
একটি রুকূ’তে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ প্রকৃতপক্ষে এ সত্যটির
ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে দিয়েছেন যে, যিনার অপবাদ দেবার
ব্যাপারটি কোন ছেলেখেলা নয়, নিছক কোন মাহফিলে হাস্যরস সৃষ্টি
করার জন্য একে ব্যবহার করা যাবে না। এটি একটি মারাত্মক ব্যাপার। অপবাদদাতার অপবাদ যদি সত্য হয় তাহলে তাকে সাক্ষী আনতে হবে। যিনাকারী ও যিনাকারীনীকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া
হবে। আর অপবাদ যদি মিথ্যা হয়
তাহলে অপবাদদাতা ৮০ ঘা বেত্রাঘাত লাভের যোগ্য, যাতে ভবিষ্যতে সে আর এ ধরনের কোন কাজ করার
দুঃসাহস না করে। এ অভিযোগ যদি স্বামী দিয়ে
থাকে তাহলে আদালতে লি’আন করে তাকে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। একথাটি একবার মুখে উচ্চারণ করে কোন ব্যক্তি
ঘরে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না। কারণ এটা হচ্ছে একটা মুসলিম সমাজ। সারা দুনিয়ায় কল্যাণ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এ সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এখানে যিনা কোন আনন্দদায়ক বিষয়ে পরিণত হতে
পারে না এবং এর আলোচনাও হাস্য রসালাপের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারে না।
৯. হাদীসে মাত্র কয়েকজন লোকের নাম পাওয়া যায়। তারা এ গুজবটি ছড়াচ্ছিল। তারা হচ্ছে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই, যায়েদ ইবনে রিফা’আহ (এ ব্যক্তি
সম্ভবত রিফা’আ ইবনে যায়েদ ইহুদী মুনাফিকের ছেলে), মিস্তাহ
ইবনে উসামাহ, হাস্সান ইবনে সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ। এর মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল মুনাফিক এবং বাকি
তিনজন মু’মিন। মু’মিন তিন জন বিভ্রান্তি ও
দুর্বলতার কারণে এ চক্রান্তের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরা ছাড়া আর যারা কমবেশী এ গোনাহে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের
নাম হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে আমার নজরে পড়েনি।
১০. এর অর্থ হচ্ছে ভয় পেয়ো না। মুনাফিকরা মনে করছে তারা তোমাদের ওপর একটা বিরাট আঘাত
হেনেছে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্ এটি
উল্টো তাদের ওপরই পড়বে এবং তোমাদের জন্য ভালো প্রমাণিত হবে। যেমন আমি ইতিপূর্বে ভূমিকায় বর্ণনা করে এসেছি, মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের যে
আসল ময়দান ছিল মুনাফিকরা সেখানেই তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য এ প্রপাগাণ্ডা শুরু করে। অর্থাৎ নৈতিকতার ময়দান। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করার কারণে তারা প্রত্যেকটি ময়দানে
নিজেদের প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করে চলছিল। আল্লাহ তাকেও মুসলমানদের কল্যাণের উপকরণে পরিণত করে দিলেন। এ সময় একদিকে নবী সা. , অন্যদিকে হযরত আবু বকর ও তাঁর
পরিবারবর্গ এবং তৃতীয় দিকে সাধারণ মু’মিনগন যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেন তা থেকে
একথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তাঁরা
অসৎকর্ম থেকে কত দূরে অবস্থান করেন, কতটা সংযম ও সহিষ্ণুতার
অধিকারী, কেমন ন্যায়নিষ্ঠ ও কি পরিমাণ ভদ্র ও রুচিশীল
মানসিকতার ধারক।
নবী সা. এর ইজ্জতের ওপর যারা আক্রমণ চালিয়েছিল তাঁর একটি মাত্র ইঙ্গিতই তাদের
শিরচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এক মাস ধরে তিনি সবরের সাথে সবকিছু বরদাশ্ত করতে থাকেন
এবং আল্লাহর হুকুম এসে যাবার পর কেবলমাত্র যে তিনজন মুসলমানের বিরুদ্ধে কাযাফ তথা
যিনার মিথ্যা অপবাদের অপরাধ প্রমাণিত ছিল তাদের ওপর ‘হদ’ জারি করেন। এরপরও তিনি মুনাফিকদেরকে কিছুই বলেননি। হযরত আবু বকরের নিজের আত্মীয়, যার নিজের ও পরিবারের ভরণপোষন
তিনি করতেন, সেও তাঁদের কলিজায় তীর বিঁধিয়ে দিতে থাকে কিন্তু
এর জবাবে আল্লাহর এ নেক বান্দাটি না তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন,
না তার পরিবার-পরিজনকে সাহায্য-সহায়তা দেয়া বন্ধ করেন। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণের একজনও সতীনের দুর্নাম
ছড়াবার কাজে একটুও অংশ নেননি। বরং কেউ এ অপবাদের প্রতি নিজের সামান্যতমও সন্তোষ, পছন্দ অথবা মেনে নেয়ার মনোভাবও
প্রকাশ করেননি।
এমনিক হযরত যয়নবের সহোদর বোন হাম্না বিনতে জাহ্শ নিছক নিজের বোনের জন্য তার সতীনের
দুর্নাম রটাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি স্বয়ং সতীনের পক্ষে ভালো কথাই বলেন। হযরত আয়েশার নিজের বর্ণনা, রসূলের স্ত্রীগণের মধ্যে
সবচেয়ে বেশী আড়ি চলতো আমার যয়নবের সাথে। কিন্তু “ইফ্ক”-এর ঘটনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. যখন তাকে
জিজ্ঞেস করেন, আয়েশা সম্পর্কে তুমি কি জানো? তখন এর জবাবে তিনি
বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম, আমি
তার মধ্যে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানি না। হযরত আয়েশার নিজের ভদ্রতা ও রুচিশীলতার অবস্থা এই ছিল যে, হযরত হাস্সান ইবনে সাবেত তাঁর
দূর্নাম রটাবার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করেন কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সবসময়
তাঁর প্রতি সম্মান ও বিনয়পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। লোকেরা স্মরণ করিয়ে দেয়, ইনি তো সেই ব্যক্তি যিনি আপনার
বিরুদ্ধে দুর্নাম রটিয়েছিলেন। কিন্তু এ জবাব দিয়ে তিনি তাদের মুখ বন্ধ করে দেন যে, এ ব্যক্তি ইসলামের শত্রু কবি
গোষ্ঠীকে রাসূলুল্লাহ সা. ও ইসলামের পক্ষ থেকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। এ ঘটনার সাথে যাদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল এ ছিল
তাদের অবস্থা। আর সাধারণ মুসলমানদের
মানসিকতা কতদূর পরিচ্ছন্ন ছিল তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর স্ত্রী
যখন তাঁর কাছে এ গুজবগুলোর কথা বললেন তখন তিনি বলেন, “আইয়ুবের
মা! যদি সে সময় আয়েশার জায়গায় তুমি হতে, তাহলে তুমি কি এমন
কাজ করতে?” তিনি বলেন, “আল্লাহ্র কসম,
আমি কখনো এমন কাজ করতাম না।” হযরত আবু আইয়ুব বলেন, “তাহলে আয়েশা তোমার চেয়ে অনেক বেশী ভাল। আর আমি বলি কি, যদি সাফওয়ানের জায়গায় আমি হতাম,
তাহলে এ ধরনের কথা কল্পনাই করতে পারতাম না। সফওয়ান তো আমার চেয়ে ভালো মুসলমান।” এভাবে মুনাফিকরা যা কিছু চেয়েছিল ফল হলো তার
একেবারে উল্টো এবং মুসলমানদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব আগের তুলনায় আরো বেশী সুস্পষ্ট হয়ে
গেল।
এছাড়া এ ঘটনার মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। সেটি ছিল এই যে, এ ঘটনাটি ইসলামের আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও তামাদ্দুনিক নীতি-নিয়মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের
উপলক্ষ্যে পরিণত হয়। এর বদৌলতে মুসলমানরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব নির্দেশ লাভ করে যেগুলো
কার্যকর করে মুসলিম সমাজকে চিরকালের জন্য অসৎকর্মের উৎপাদন ও সেগুলোর সম্প্রসারণ
থেকে সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে আর অসৎকর্ম উৎপাদিত হয়ে গেলেও যথাসময়ে তার পথ রোধ
করা যেতে পারে।
এছাড়াও এর মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। মুসলমানরা সকলেই একথা ভালোভাবে জেনে যায় যে, নবী সা. অদৃশ্য জ্ঞানের
অধিকারী নন। যা কিছু আল্লাহ জানান তাই
তিনি জানেন। এর বাইরে তাঁর জ্ঞান
ততটুকুই যতটুকু জ্ঞান একজন মানুষের থাকতে পারে। একমাস পর্যন্ত হযরত আয়েশার রা. ব্যাপারে তিনি ভীষণ পেরেশান
থাকেন। কখনো চাকরানীকে জিজ্ঞেস
করতেন, কখনো পবিত্র
স্ত্রীগণকে, কখনো হযরত আলীকে রা., কখনো
হযরত উসামাকে রা.।
শেষ পর্যন্ত হযরত আয়েশাকে রা. জিজ্ঞেস করলেও এভাবে জিজ্ঞেস করেন যে, যদি তুমি এ গোনাহটি করে থাকো,
তাহলে তাওবা করো আর না করে থাকলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার নিরপরাধ
হওয়া প্রমাণ করে দেবেন। যদি তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হতেন তাহলে এ পেরেশানী, এ জিজ্ঞাসাবাদ এবং এ তাওবার
উপদেশ কেন? তবে আল্লাহর অহী যখন সত্য কথা জানিয়ে দেয় তখন
সারা মাসে তিনি যা জানতেন না তা জানতে পারেন। এভাবে আকীদার অন্ধ আবেগের বশবর্তী হয়ে সাধারণত লোকেরা
নিজেদের নেতৃবর্গের ব্যাপারে যে বাড়াবাড়ি ও আতিশয্যের শিকার হয়ে থাকে তা থেকে
আল্লাহ সরাসরি অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বাঁচার ব্যবস্থা করেন। বিচিত্র নয়, এক মাস পর্যন্ত অহী না পাঠাবার
পেছনে আল্লাহর এ উদ্দেশ্যটাও থেকে থাকবে। প্রথম দিনেই অহী এসে গেলে এ ফায়দা লাভ করা যেতে পারতো না। (আরো বেশী বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন
তাফহীমুল কুরআন, আন্ নাম্ল, ৮৩ টীকা)।
১১. অর্থাৎ আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই। সে ছিল এ অপবাদটির মূল রচয়িতা এবং এ কদর্য প্রচারাভিযানের
আসল নায়ক। কোন কোন হাদীসে ভুলক্রমে
হযরত হাস্সান ইবনে সাবেতকে রা. এ আয়াতের লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এটা মূলত বর্ণনাকারীদের নিজেদেরই
বিভ্রান্তির ফল। নয়তো হযরত হাস্সানের রা.
দুর্বলতা এর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না যে, তিনি মুনাফিকদের ছড়ানো এ ফিত্নায় জড়িয়ে
পড়েন। হাফেয ইবনে কাসীর যথার্থ
বলেছেন, এ হাদীসটি যদি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত না হতো, তাহলে এ
প্রসঙ্গটি আলোচনাযোগ্যই হতো না। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ হচ্ছে এই যে, বনী উমাইয়াহ হযরত আলী রা.কে এ
আয়াতের লক্ষ্য মনে করে। বুখারী, তাবারানী ও বাইহাকীতে হিশাম ইবনে আবদুল মালিক উমুবীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে الَّذِى تَوَلَّى كِبْرَهُ অর্থ হচ্ছে আলী ইবনে আবু তালেব। অথচ এ ফিত্নায় হযরত আলীর রা. গোড়া থেকেই কোন
অংশ ছিল না। ব্যাপার শুধু এতটুকু ছিল, যখন তিনি নবী সা. কে খুব বেশী
পেরেশান দেখেন, তখন নবী সা. তাঁর কাছে পরামর্শ চাওয়ায় তিনি
বলেন, আল্লাহ এ ব্যাপারে আপনাকে কোন সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ
রাখেননি, বহু মেয়ে আছে, আপনি চাইলে
আয়েশাকে তালাক দিয়ে আর একটি বিয়ে করতে পারেন। এর অর্থ কখনোই এটা ছিল না যে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে যে
মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছিল হযরত আলী তাকে সত্য বলেছিলেন। বরং শুধুমাত্র নবী সা. এর পেরেশানী দূর করাই
ছিল এর উদ্দেশ্য।
﴿لَّوْلَا
إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْرًا وَقَالُوا
هَٰذَا إِفْكٌ مُّبِينٌ﴾
১২। যখন তোমরা
এটা শুনেছিলে তখনই কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা
করেনি১২ এবং কেন
বলে দাওনি এটা সুস্পষ্ট মিথ্যা দোষারোপ?১৩
১২. অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের
সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করোনি কেন? আয়াতের
শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। আর এ দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর
তত্ত্ব। এটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে
হবে। হযরত আয়েশা রা. ও সাফ্ওয়ান
ইবনে মু’আত্তালের রা. মধ্যে যে ব্যাপারটি ঘটে গিয়েছিল তা তো এই ছিল যে, কাফেলার এক ভদ্র মহিলা (তিনি
নবী পত্নী ছিলেন একথা বাদ দিলেও) ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। আর কাফেলারই এক ব্যক্তি যিনি ঘটনাক্রমে পেছনে
থেকে গিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এখন যদি কেউ বলে, নাউযুবিল্লাহ্ এরা দু’জন নিজেদেরকে
একান্তে পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়ে গেছেন, তাহলে তার একথার
বাহ্যিক শব্দাবলীর আড়ালে আরো দু’টো কাল্পনিক কথাও রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, বক্তা (পুরুষ হোক বা নারী) যদি
নিজেই ঐ জায়গায় হতেন, তাহলে কখনোই গোনাহ না করে থাকতেন না। কারণ তিনি যদি গোনাহ থেকে বিরত থেকে থাকেন
তাহলে এটা শুধু এজন্য যে, বিপরীত লিংগের কেউ এ পর্যন্ত এভাবে একান্তে তার নাগালে আসেনি নয়তো এমন
সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবার লোক তিনি নন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে সমাজের তিনি একজন সদস্য, তার নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তার ধারণা হচ্ছে, এখানে
এমন একজন নারী ও পুরুষ নেই যিনি এ ধরনের সুযোগ পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হননি। এতো শুধুমাত্র তখনকার ব্যাপার যখন বিষয়টি নিছক
একজন পুরুষ ও একজন নারীর সাথে জড়িত থাকে। আর ধরুন যদি সে পুরুষ ও নারী উভয়ই এক জায়গার বাসিন্দা হন
এবং যে মহিলাটি ঘটনাক্রমে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি ঐ পুরুষটির কোন
বন্ধু, আত্মীয় বা
প্রতিবেশীর স্ত্রী, বোন বা মেয়ে হয়ে থাকেন তাহলে ব্যাপারটি
আরো গুরুতর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বক্তা নিজেই নিজের ব্যক্তি সত্ত্বা
সম্পর্কেও এমন জঘন্য ধারণা পোষণ করেন যার সাথে ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের দূরতম
সম্পর্কও নেই। কে
এমন সজ্জন আছেন যিনি একথা চিন্তা করতে পারেন যে, তার কোন বন্ধু, প্রতিবেশী বা পরিচিত ব্যক্তির গৃহের কোন মহিলার সাথে বিপদগ্রস্ত অবস্থায়
তার পথে দেখা হয়ে যাবে এবং প্রথম অবস্থায়ই তিনি তার ইজ্জত লুটে নেবার কাজ করবেন
তারপর তাকে গৃহে পৌঁছিয়ে দেবার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল এর চেয়ে হাজার গুণ গুরুতর
মহিলা অন্য কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. এর স্ত্রী, যাঁদেরকে
প্রত্যেকটি মুসলমান নিজের মায়ের চেয়েও বেশী সম্মানের যোগ্য মনে করতো এবং যাঁদেরকে
আল্লাহ নিজেই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর নিজের মায়ের মতই হারাম গণ্য করেছিলেন। পুরুষটি কেবলমাত্র ঐ কাফেলার একজন সদস্য, ঐ সেনাদলের একজন সৈন্য এবং ঐ
শহরের একজন অধিবাসীই ছিলেন না বরং তিনি মুসলমানও ছিলেন। ঐ মহিলার স্বামীকে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং
নিজের নেতা ও পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিয়েছিলেন আর তাঁর হুকুমে প্রাণ উৎসর্গ করে
দেয়ার জন্য বদরের যুদ্ধের মতো ভয়াবহ জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তো এ উক্তির মানসিক প্রেক্ষাপট জঘন্যতার এমন
চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার চেয়ে নোংরা ও ঘৃণা কোন প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ বলছেন, মুসলিম সমাজের যেসব ব্যক্তি
একথা তাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে অথবা কমপক্ষে একে সন্দেহযোগ্য মনে করেছে তারা
নিজেদের মন-মানসিকতারও খুবই খারাপ ধারণা দিয়েছে এবং নিজেদের সমাজের লোকদেরকেও
অত্যন্ত হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট নৈতিকবৃত্তির অধিকারী মনে করেছে।
১৩. অর্থাৎ একথাতো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলমানের একে
সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। সম্ভবত কেউ এখানে প্রশ্ন করতে পারে, একথাই যদি ঠিক হয়ে থাকে,
তাহলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকর সিদ্দীক রা.ই বা প্রথম দিনই
একে মিথ্যা বলে দিলেন না কেন? কেন তারা একে এতটা গুরুত্ব
দিলেন? এর জবাব হচ্ছে, স্বামী ও পিতার
অবস্থা সাধারণ লোকদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের হয়। যদিও স্ত্রীকে স্বামীর চেয়ে বেশী কেউ চিনতে বা জানতে পারে
না এবং একজন সৎ, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত স্ত্রী সম্পর্কে কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন স্বামী
লোকদের অপবাদের কারণে খারাপ ধারণা করতে পারে না, তবুও যদি
তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তখন সে এমন এক ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়
যার ফলে সে একে মিথ্যা অপবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করলে প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ হবে
না বরং তারা নিজেদের কণ্ঠ আরো এক ডিগ্রী উঁচুতে চড়িয়ে বলতে থাকবে, দেখো, বউ কেমন স্বামীর বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে,
সবকিছু করে যাচ্ছে আর স্বামী মনে করছে আমার স্ত্রী বড়ই সতী সাধ্বী। এ ধরনের সংকট মা-বাপের ক্ষেত্রেও দেখা দেয়। সে বেচারারা নিজেদের মেয়ের সতীত্বের বিরুদ্ধে
মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদে যদি মুখ খোলেও তাহলে মেয়ের অবস্থান পরিষ্কার হয় না। প্রচারণাকারীরা একথাই বলবে, মা-বাপ তো, কাজেই নিজের মেয়ের পক্ষ সমর্থন করবে না তো আর কি করবে। এ জিনিসটিই রাসূলুল্লাহ সা. এবং হযরত আবু বকর
ও উম্মে রুমানকে ভিতরে ভিতরে শোকে-দুঃখে জর্জরিত ও বিহবল করে চলছিল। নয়তো আসলে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। রাসূলুল্লাহ সা. তো তাঁর ভাষণে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন
খারাপ জিনিস দেখিনি এবং যে ব্যক্তির সম্পর্কে এ অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যেও না।
﴿لَّوْلَا جَاءُوا عَلَيْهِ
بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ ۚ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوا بِالشُّهَدَاءِ فَأُولَٰئِكَ عِندَ
اللَّهِ هُمُ الْكَاذِبُونَ﴾
১৩। তারা
(নিজেদের অপবাদের প্রমাণ স্বরূপ) চারজন সাক্ষী আনেনি কেন? এখন যখন তারা সাক্ষী আনেনি
তখন আল্লাহর কাছে তারাই মিথ্যুক।১৪
১৪. “আল্লাহর কাছে” অর্থাৎ আল্লাহর আইনে অথবা
আল্লাহর আইন অনুযায়ী।
নয়তো আল্লাহ তো জানতেন ঐ অপবাদ ছিল মিথ্যা। তারা সাক্ষী আনেনি বলেই তা মিথ্যা, আল্লাহর কাছে তার মিথ্যা হবার
জন্য এর প্রয়োজন নেই।
এখানে যেন কেউ এ ভুল ধারণার শিকার না হন যে, এক্ষেত্রে নিছক সাক্ষীদের
উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে অপবাদের মিথ্যা হবার যুক্তি ও ভিত্তি গণ্য করা হচ্ছে এবং
মুসলমানদের বলা হচ্ছে যেহেতু অপবাদদাতা চার জন্য সাক্ষী আনেনি তাই তোমরাও
শুধুমাত্র এ কারণেই তাকে সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ গণ্য করো। বাস্তবে সেখানে যা ঘটেছিল, তার প্রতি দৃষ্টি না দিলে এ
ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। অপবাদদাতারা এ কারণে অপবাদ দেয়নি যে, তারা তাদের মুখ দিয়ে যা কিছু বলে যাচ্ছিল
তারা সবাই বা তাদের কোন একজন স্বচক্ষে তা দেখেছিল। বরং হযরত আয়েশা রা. কাফেলার পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন এবং হযরত
সাফ্ওয়ান পরে তাঁকে নিজের উটের পিঠে সওয়ার করে কাফেলার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন
শুধুমাত্র এরই ভিত্তিতে তারা এতবড় অপবাদ তৈরী করে ফেলেছিল। কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তি এ অবস্থায় হযরত আয়েশার এভাবে
পিছনে থেকে যাওয়াকে নাউযুবিল্লাহ্ কোন ষড়ষন্ত্রের ফল ছিল বলে ভাবতে পারতেন না। সেনা প্রধানের স্ত্রী চুপিচুপি কাফেলার পিছনে
এ ব্যক্তির সাথে থেকে যাবে তারপর ঐ ব্যক্তিই তাকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে প্রকাশ্য
দিবালোকে ঠিক দুপুরের সময় সবার চোখের সামনে দিয়ে সেনা ছাউনিতে পৌঁছে যাবে, কোন ষড়যন্ত্রকারী এভাবে
ষড়যন্ত্র করে না।
স্বয়ং এ অবস্থাটাই তাদের উভয়ের নিরাপরাধ নিষ্পাপ হওয়ার প্রমাণ পেশ করছে। এ অবস্থায় যদি অপবাদদাতারা নিজেদের চোখে কোন
ঘটনা দেখতো তাহলে কেবলমাত্র তারই ভিত্তিতে অপবাদ দিতে পারতো। অন্যথায় যেসব লক্ষণের ওপর কুচক্রীরা অপবাদের ভিত্তি
রেখেছিল সেগুলোর ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
﴿وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ
عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِي مَا أَفَضْتُمْ
فِيهِ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
১৪। যদি
তোমাদের প্রতি দুনিয়ায় ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হতো তাহলে যেসব কথায়
তোমরা লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলে সেগুলোর কারণে তোমাদের ওপরে মহাশাস্তি নেমে আসতো।
﴿إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ
وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُم مَّا لَيْسَ لَكُم بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا
وَهُوَ عِندَ اللَّهِ عَظِيمٌ﴾
১৫। (একটু
ভেবে দেখো তো¸ সে সময়
তোমরা কেমন মারাত্মক ভুল করেছিলে) যখন তোমরা এক মুখ থেকে আর এক মুখে এ মিথ্যা
ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিলে এবং তোমরা নিজেদের মুখে এমন সব কথা বলে যাচ্ছিলে যা সম্পর্কে
তোমাদের কিছুই জানা ছিল না। তোমরা একে একটা মামুলি কথা
মনে করেছিলে অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল্ গুরুতর বিষয়।
﴿وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ
قُلْتُم مَّا يَكُونُ لَنَا أَن نَّتَكَلَّمَ بِهَٰذَا سُبْحَانَكَ هَٰذَا بُهْتَانٌ
عَظِيمٌ﴾
১৬। একথা
শোনার সাথে সাথেই তোমরা বলে দিলে না কেন, “এমন কথা মুখ দিয়ে বের করা
আমাদের শোভা পায় না, সুব্হানাল্লাহ! এ তো একটি জঘন্য অপবাদ।”
﴿يَعِظُكُمُ اللَّهُ أَن تَعُودُوا
لِمِثْلِهِ أَبَدًا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
১৭। আল্লাহ
তোমাদের উপদেশ দেন, যদি তোমরা
মু’মিন হয়ে থাকো,
﴿وَيُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ
الْآيَاتِ ۚ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
১৮। তাহলে
ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের কাজ করো না। আল্লাহ
তোমাদের পরিষ্কার নির্দেশ দেন এবং তিনি সবজ্ঞ ও বিজ্ঞানময়।১৫
১৫. এ আয়াতগুলো এবং বিশেষ করে আল্লাহর এ বাণী
“মু’মিন পুরুষ ও নারীরা নিজেদের লোকদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করে না কেন” থেকে এ
মূলনীতির উৎপত্তি হয় যে, মুসলিম সমাজে সকল ব্যবহারিক বিষয়ের ভিত্তি সুধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া
উচিত। কুধারণা কেবলমাত্র এমন
অবস্থায় পোষণ করা উচিত যখন তার জন্য কোন ইতিবাচক ও প্রমাণসূচক ভিত্তি থাকবে। এ ব্যাপারে নীতি হচ্ছেঃ প্রত্যেক ব্যক্তি
নির্দোষ, যতক্ষণ তার অপরাধী হবার বা তার প্রতি অপরাধের সন্দেহ করার কোন যুক্তিসঙ্গত
কারণ না থাকে আর প্রত্যেক ব্যক্তিই সত্যবাদী, যতক্ষণ তার
অনির্ভরযোগ্য হবার কোন প্রমাণ না থাকে।
﴿إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ
أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا
وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾
১৯। যারা চায়
মু’মিনদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক
শাস্তি ভোগ করবে।১৬ আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো
না।১৭
১৬. পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আয়াতের
প্রত্যক্ষ অর্থ হচ্ছে, যারা এ ধরনের অপবাদ তৈরী করে ও তা প্রচার করে মুসলিম সমাজে চরিত্রহীনতার
প্রসার ঘটাবার এবং উম্মতে মুসলিমার চরিত্র হননের চেষ্টা করছে তারা শাস্তি লাভের
যোগ্য। কিন্তু আয়াতের শব্দাবলী
অশ্লীলতা ছড়াবার যাবতীয় অবস্থার অর্থবোধক। কার্যত ব্যভিচারে আড্ডা কায়েম করার ওপরও এগুলো প্রযুক্ত হয়। আবার চরিত্রহীনতাকে উৎসাহিত করা এবং সেজন্য
আবেগ-অনুভূতিকে উদ্দীপিত ও উত্তেজিতকারী কিস্সা-কাহিনী, কবিতা, গান,
ছবি ও খেলাধূলার ওপরও প্রযুক্ত হয়। তাছাড়া এমন ধরনের ক্লাব, হোটেল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও
এর আওতায় এসে যায় যেখানে নারী-পুরুষের মিলিত নৃত্য ও মিলিত আমোদ ফূর্তির ব্যবস্থা
করা হয়। কুরআন পরিষ্কার বলছে, এরা সবাই অপরাধী। কেবল আখেরাতেই নয়, দুনিয়ায়ও এদের শাস্তি পাওয়া
উচিত। কাজেই অশ্লীলতার এসব
উপায়-উপকরণের পথ রোধ করা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন এখানে যে সমস্ত কাজকে জনগণের বিরুদ্ধে
অপরাধ গণ্য করছে এবং যেগুলো সম্পাদনকারীকে শাস্তিলাভের যোগ্য বলে ফায়সালা দিচ্ছে
ইসলামী রাষ্ট্রের দণ্ডবিধি আইনে সে সমস্ত কাজ শাস্তিযোগ্য ও পুলিশের হস্তক্ষেপ
লাভের উপযোগী হতে হবে।
১৭. অর্থাৎ তোমরা জানো না এ ধরনের এক একটি কাজের প্রভাব সমাজে
কোথায় কোথায় পৌঁছে যায়, কত লোক এগুলোতে প্রভাবিত হয় এবং সামষ্টিকভাবে এর কি পরিমাণ ক্ষতি সমাজ
জীবনকে বরদাশত করতে হয়। এ বিষয়টি আল্লাহই খুব ভালোভাবে জানেন। কাজেই আল্লাহর ওপর নির্ভর করো ও দাবিয়ে দেবার চেষ্টা কর। এগুলো ছোট ছোট বিষয় নয় যে, এগুলোর প্রতি উদারতা প্রদর্শন
করতে হবে। আসলে এগুলো অনেক বড় বিষয়। কাজেই যারা এসব কাজ করবে তাদের কঠোর শাস্তি
হওয়া উচিত।
﴿وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ
عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللَّهَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾
২০। যদি
আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর করুণা তোমাদের প্রতি না হতো এবং আল্লাহ যদি স্নেহশীল ও
দয়ার্দ্র না হতেন (তাহলে যে জিনিস এখনই তোমাদের মধ্যে ছড়ানো হয়েছিলো তার পরিণাম
হতো অতি ভয়াবহ।)
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
لَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ وَمَن يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ
فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ ۚ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ
وَرَحْمَتُهُ مَا زَكَىٰ مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ أَبَدًا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يُزَكِّي
مَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
২১। হে
ঈমানদানগণ! শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে চলো না। যে কেউ
তার অনুসরণ করবে তাকে সে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ করার হুকুম দেবে। যদি
তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না থাকতো তাহলে তোমাদের একজনও পবিত্র হতে
পারতো না।১৮ কিন্তু আল্লাহই যাকে চান তাকে
পবিত্র করে দেন এবং আল্লাহ শ্রবণকারী ও জ্ঞাত।১৯
১৮. অর্থাৎ শয়তান তো তোমাদের গায়ে অসৎকাজের নাপাকী মাখিয়ে
দেবার জন্য এমন উন্মুখ হয়ে বসে আছে যে, যদি আল্লাহ নিজেই অনুগ্রহ ও দয়া করে
তোমাদের সততা ও অসততার পার্থক্য না শেখান এবং তোমাদের সংশোধনের শিক্ষা ও সুযোগ
লাভের সৌভাগ্য দান না করেন, তাহলে তোমাদের একজনও নিজেদের
শক্তি-সামর্থ্যের জোরে পবিত্র ও পাপ-পংকিলতা থেকে মুক্ত হতে পারো না।
১৯. অর্থাৎ আল্লাহ চোখ বন্ধ করে, আন্দাজে যাকে তাকে পবিত্রতা
দান করেন না বরং নিজের নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে দান করেন। আল্লাহ জানেন কে কল্যাণ চায় এবং কে অকল্যাণ
আকাংখী। প্রত্যেক ব্যক্তি একান্তে
যেসব কথা বলে আল্লাহ তা সবই শুনে থাকেন। প্রত্যেক ব্যক্তি মনে মনে যা চিন্তা করে আল্লাহ তা থেকে
মোটেই বেখবর থাকেন না। এ
সরাসরি ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ ফায়সালা করেন, কাকে পবিত্রতা দান করবেন ও
কাকে পবিত্রতা দান করবেন না।
﴿وَلَا
يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنكُمْ وَالسَّعَةِ أَن يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبَىٰ وَالْمَسَاكِينَ
وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا ۗ أَلَا تُحِبُّونَ
أَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
২২। তোমাদের
মধ্য থেকে যারা প্রাচুর্য ও সামর্থের অধিকারী তারা যেন এ মর্মে কসম খেয়ে না বসে যে, তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, গরীব-মিসকীন ও আল্লাহর পথে
গৃহত্যাগকারীদেরকে সাহায্য করবে না। তাদেরকে
ক্ষমা করা ও তাদের দোষ-ক্রটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি
চাও না আল্লাহ তোমাদের মাফ করেন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীলতা ও দয়া গুণে
গুণান্বিত।২০
২০. হযরত আয়েশা রা. বলেন, ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ যখন
আমার নির্দোষিতার কথা ঘোষণা করেন তখন হযরত আবু বকর রা. কসম খেয়ে বসেন, তিনি আগামীতে মিস্তাহ ইবনে উসাসাকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেবেন। কারণ মিস্তাহ আত্মীয়-সম্পর্কের কোন পরোয়া
করেননি এবং তিনি সারা জীবন তার ও তার সমগ্র পরিবারের যে উপকার করে এসেছেন সেজন্য
একটুও লজ্জা অনুভব করেননি। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয় এবং এ আয়াত শুনেই হযরত আবু বকর রা. সঙ্গে সঙ্গেই
বলেন, بلى والله انا نحب ان تغفر
لنا يا ربنا ‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই
আমরা চাই, হে আমাদের রব! তুমি আমাদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করে
দেবে।’ কাজেই তিনি আবার মিস্তাহকে
সাহায্য করতে থাকেন এবং এবার আগের চেয়ে বেশী করে করতে থাকেন। হযরত আবদুল্লাহু ইবনে আব্বাসের রা. বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আবু বকর ছাড়া আর কয়েকজন
সাহাবীও এ কসম খেয়েছিলেন যে, যারা মিথ্যা অপবাদ ছড়াতে অংশ
নিয়েছিল তাদেরকে তাঁরা আর কোন সাহায্য-সহায়তা দেবেন না। এ আয়াতটি নাযিল হবার পর তারা সবাই নিজেদের কসম
ভেঙ্গে ফেলেন। এভাবে এ ফিত্নার ফলে মুসলিম
সমাজে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তা এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।
এখান একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, যদি কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারতো
এতে কোন কল্যাণ নেই এবং এর ফলে কসম ভেঙ্গে ফেলে যে বিষয়ে কল্যাণ আছে তা অবলম্বন
করে, তাহলে এক্ষেত্রে তাকে কসম ভাঙ্গার কাফ্ফারা আদায় করতে
হবে কি না। এক দল ফকীহ বলেন, কল্যাণের পথ অবলম্বন করাই
কাফ্ফারা, এছাড়া আর কোন কাফ্ফারার প্রয়োজন নেই। তারা এ আয়াত থেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, আল্লাহ হযরত আবু বকরকে কসম
ভেঙ্গে ফেলার হুকুম দেন এবং কাফ্ফারা আদায় করার হুকুম দেননি। এছাড়া নবী করীম সা. এর নিম্নোক্ত উক্তিটিকেও
তারা যুক্তি হিসেবে পেশ করেনঃ
مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا
مِنْهَا فَلْيَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَذَالِك كَفَّارتُهُ
“যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারে অন্য বিষয়টি তার
চেয়ে ভালো, এ অবস্থায় তার ভালো বিষয়টি গ্রহণ করা উচিত এবং এই
ভালো বিষয়টি গ্রহণ করাই তার কাফ্ফারা।”
অন্য দলটি বলেন, কসম ভাঙ্গার জন্য আল্লাহ কুরআন মজীদে একটি পরিষ্কার ও স্বতন্ত্র হুকুম
নাযিল করেছেন (আল বাকারাহ ২২৫ ও আল মায়েদাহ ৮৯ আয়াত)। এ আয়াতটা ঐ হুকুম রহিত করেনি এবং পরিষ্কারভাব এর মধ্যে কোন
সংশোধনও করেনি। কাজেই ঐ হুকুম স্বস্থানে
অপরিবর্তিত রয়েছে। আল্লাহ এখানে হযরত আবু
বকরকে অবশ্যি কসম ভেঙ্গে ফেলতে বলেছেন কিন্তু তাঁকে তো এ কথা বলেননি যে, তোমার ওপর কোন কাফ্ফারা ওয়াজিব
নয়। আর নবী সা. এর উক্তিটির
অর্থ হচ্ছে, শুধু এই যে, একটি ভুল ও অসঙ্গত বিষয়ের কসম খেয়ে
ফেললে যে গুনাহ হয় সঠিক ও সঙ্গত পন্থা অবলম্বন তার অপনোদন হয়ে যায়। কসমের কাফ্ফারা রহিত করা এর উদ্দেশ্য নয়। বস্তুতঃ অন্য একটি হাদীস-এর ব্যাখ্যা করে দেয়। তাতে নবী করীম সা. বলেনঃ
مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا
مِنْهَا فَلْيَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ , وَلْيُكَفِّرْ عَنْ يَمِينِهِ
“যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারে অন্য বিষয় তার
চেয়ে ভালো, তার যে বিষয়টি ভালো সেটিই করা উচিত এবং নিজের
কসমের কাফ্ফারা আদায় করা উচিত।”
এ থেকে জানা যায়, কসম ভাঙ্গার কাফ্ফারা আলাদা জিনিস এবং ভালো কাজ না করার গোনাহের কাফ্ফারা
অন্য জিনিস। ভালো কাজ করা হচ্ছে একটি
জিনিসের কাফ্ফারা এবং দ্বিতীয় জিনিসের কাফ্ফারা কুরআন নিজেই নির্ধারিত করে দিয়েছে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল
কুরআন, সূরা সা’দের
ব্যাখ্যা, ৪৬ টীকা)।
﴿إِنَّ
الَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ لُعِنُوا فِي الدُّنْيَا
وَالْآخِرَةِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
২৩। যারা সতী
সাধ্বী, সরলমনা২১ মু’মিন
মহিলাদের প্রতি অপবাদ দেয় তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে
মহাশাস্তি।
২১. মূলে غَافِلَاتِ (গাফেলাত) শব্দ ব্যবহার করা
হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সরলমনা ও ভদ্র মহিলারা,
যারা ছল-চাতুরী জানে না, যাদের মন নির্মল,
কলুষমুক্ত ও পাক-পবিত্র, যারা অসভ্যতা ও
অশ্লীল আচরণ কি ও কিভাবে করতে হয় তা জানে না এবং কেউ তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেবে
একথা যারা কোনদিন কল্পনাও করতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সা. বলেছেন, নিষ্কলুষ-সতী-সাধ্বী
মহিলাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া সাতটি “সর্বনাশা” কবীরাহ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। তাবারানীতে হযরত হুযাইফার বর্ণনায় বলা হয়েছে, নবী সা. বলেছেনঃ
قذف المحصنة يهدم عمل ماة سنة
“একজন নিরপরাধ সতী সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া একশ বছরের সৎকাজ ধ্বংস
করে দেবার জন্য যথেষ্ট।”
﴿يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ
أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
২৪। তারা যেন
সেদিনের কথা ভুলে না যায় যেদিন তাদের নিজেদের কন্ঠ এবং তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের
কৃতকর্মের সাক্ষ দেবে।২১(ক)
২১ (ক) ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইয়াসীন, ৫৫ এবং সূরা হা-মীম আস্ সাজ্দাহ, ২৫ টীকা।
﴿يَوْمَئِذٍ يُوَفِّيهِمُ
اللَّهُ دِينَهُمُ الْحَقَّ وَيَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ الْمُبِينُ﴾
২৫। সেদিন
তারা যে প্রতিদানের যোগ্য হবে, তা আল্লাহ তাদেরকে পুরোপুরি দেবেন এবং
তারা জানবে, আল্লাহই
সত্য এবং সত্যকে সত্য হিসেবে প্রকাশকারী।
﴿الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ
وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ ۖ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ
لِلطَّيِّبَاتِ ۚ أُولَٰئِكَ مُبَرَّءُونَ مِمَّا يَقُولُونَ ۖ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ
كَرِيمٌ﴾
২৬।
দুশ্চরিত্রা মহিলারা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা
মহিলাদের জন্য। সচ্চরিত্রা মহিলারা সচ্চরিত্র পুরুষদের
জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা মহিলাদের জন্য। লোকে যা
বলে তা থেকে তারা পূত-পবিত্র।২২ তাদের জন্য
রয়েছে মাগফিরাত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবিকা।
২২. এ আয়াতে একটি নীতিগত কথা বুঝানো হয়েছে। সেটি হচ্ছেঃ দুশ্চরিত্ররা দুশ্চরিত্রদের সাথেই
জুটি বাঁধে এবং সচ্চরিত্র ও পাক-পবিত্র লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই সচ্চরিত্র ও
পাক-পবিত্র লোকদের সাথেই মানানসই। একজন দুষ্কৃতকারী শুধু একটিমাত্র দুষ্কৃতি করে না। সে আর সব দিক দিয়ে একদম ভালো এবং শুধুমাত্র একটি দুষ্কর্মে
লিপ্ত--- ব্যাপারটা মোটেই এ রকম নয়। তার চলাফেরা, আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র সবকিছুর মধ্যে নানান
অসৎপ্রবণতা লুকিয়ে থাকে এবং এগুলো তার একটি বড় অসৎপবণতা কোন অদৃশ্য গোলার মতো
বিষ্ফোরিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, অথচ এর কোন আলামত
ইতিপূর্বে তার চালচলন ও আচার-আচরণে দেখা যায়নি, এটা
কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। মানব জীবনে প্রতিনিয়ত এ মনস্তাত্বিক সত্যটির প্রদর্শনী হচ্ছে। একজন পাক-পবিত্র মানুষ, যার সমগ্র জীবন সবার সামনে
সুস্পষ্ট, সে একটি ব্যভিচারী নারীর সাথে ঘর সংসার করে এবং
বছরের পর বছর তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ও প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, একথা কিভাবে বোধগম্য হয়? একথা কি চিন্তা করা যেতে
পারে যে, কোন নারী এমনও হতে পারে যে ব্যভিচারিণী হবে এবং
তারপর তার চলন-বলন, অংগভংগী, আচার-ব্যবহার
কোন জিনিস থেকেও তার এসব অসৎবৃত্তির কোন লক্ষণই ফুটে উঠবে না? অথবা কোন ব্যক্তি পবিত্র হৃদয়বৃত্তির অধিকারী ও উন্নত চরিত্রবানও হবে আবার
সে এমন নারীর প্রতি সন্তুষ্টও থাকবে যার মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা যাবে? একথা এখানে বুঝাবার কারণ হচ্ছে এই যে, ভবিষ্যতে যদি
কারোর প্রতি এ অপবাদ দেযা হয়, তাহলে লোকেরা যেন অন্ধের মতো
তা শুনেই বিশ্বাস করে না নেয়, বরং তারা যেন চোখ খুলে দেখে
নেয় কার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হচ্ছে, কি অপবাদ দেয়া হচ্ছে এবং
তা কোনভাবে সেখানে খাপ খায় কি না? কথা যদি জুতসই হয়, তাহলে মানুষ এক পর্যায় পর্যন্ত তা বিশ্বাস করতে পারে অথবা কমপক্ষে সম্ভব
মনে করতে পারে।
কিন্তু উদ্ভট ও অপরিচিত কথা, যার সত্যতার স্বপক্ষে একটি চিহ্নও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না,
তা শুধুমাত্র কোন নির্বোধ বা দুর্জনের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে বলেই তাকে
কেমন করে মেনে নেয়া যায়?
কোন কোন মুফাস্সির এ আয়াতের এ অর্থও করেছেন যে, খারাপ কথা খারাপ লোকদের জন্য
(অর্থাৎ তারা এর হকদার) এবং ভালো কথা ভালো লোকদের জন্য, আর
ভালো লোকদের সম্পর্কে দুমূর্খেরা যেসব কথা বলে তা তাদের প্রতি প্রযুক্ত হওয়া থেকে
তারা মুক্ত ও পবিত্র। অন্য কিছু লোক এর অর্থ করেছেন এভাবে, খারাপ কাজ খারাপ লোকদের পক্ষেই সাজে এবং
ভালো কাজ ভালো লোকদের জন্যই শোভনীয়, ভালো লোকেরা খারাপ কাজের
অপবাদ বহন থেকে পবিত্র। ভিন্ন কিছু লোক এর অর্থ নিয়েছেন এভাবে, খারাপ কথা খারাপ লোকদেরই বলার মতো এবং ভালো
লোকেরা ভালো কথা বলে থাকে, অপবাদদাতারা যে ধরনের কথা বলছে
ভালো লোকেরা তেমনি ধরনের কথা বলা থেকে পবিত্র। এসবগুলো ব্যাখ্যার অবকাশ আয়াতের শব্দাবলী মধ্যে আছে। কিন্তু এ শব্দগুলো পড়ে প্রথমেই যে অর্থ মনের
মধ্যে বাসা বাঁধে তা হচ্ছে যা আমি প্রথমে বর্ণনা করে এসেছি এবং পরিবেশ পরিস্থিতির
দিক দিয়েও তার মধ্যে যে তাৎপর্য রয়েছে, অন্য অর্থগুলোর মধ্যে তা নেই।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا
وَتُسَلِّمُوا عَلَىٰ أَهْلِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ﴾
২৭। হে
ঈমানদাগণ!২৩ নিজেদের
গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো২৪ এবং তাদেরকে
সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এদিকে নজর
রাখবে।২৫
২৩. সূরার শুরুতে যেসব বিধান দেয়া হয়েছিল সেগুলো
ছিল সমাজে অসৎ প্রবণতা ও অনাচারের উদ্ভব হলে কিভাবে তার প্রতিরোধ করতে হবে তা
জানাবার জন্য। এখন যেসব বিধান দেয়া হচ্ছে
সেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে অসৎবৃত্তির উৎপত্তিটাই রোধ করা এবং সাংস্কৃতিক
কর্মকাণ্ড এমনভাবে শুধরানো যাতে করে এসব অসৎ প্রবণতা সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়ে যায়। এসব বিধান অধ্যয়ন করার আগে দু’টি কথা ভালোভাবে
মনের মধ্য গেঁথে নিতে হবেঃ
একঃ অপবাদের ঘটনার পরপরই এ বিধান বর্ণনা করা পরিষ্কারভাবে
একথাই ব্যক্ত করে যে, রসূলের স্ত্রীর ন্যায় মহান ও উন্নত ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে এত বড় একটি ডাহা
মিথ্যা অপবাদের এভাবে সমাজের অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রচার লাভকে আল্লাহ আসলে একটি যৌন
কামনা তাড়িত পরিবেশের উপস্থিতির ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে এ যৌন কামনা তাড়িত পরিবেশ
বদলানোর একমাত্র উপায় এটাই ছিল যে, লোকদের পরস্পরের গৃহে নিঃসংকোচে আসা যাওয়া
বন্ধ করতে হবে, অপরিচিত নারী-পুরুষদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাত ও
স্বাধীনভাবে মেলামেশার পথরোধ করতে হবে, মেয়েদের একটি অতি
নিকট পরিবেশের লোকজন ছাড়া গায়ের মুহাররাম আত্মীয়-স্বজন ও অপরিচিতদের সামনে
সাজসজ্জা করে যাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে, পতিতাবৃত্তির পেশাকে
চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে, পুরুষদের ও নারীদের দীর্ঘকাল
অবিবাহিত রাখা যাবে না, এমনকি গোলাম ও বাঁদীদেরও বিবাহ দিতে
হবে। অন্য কথায় বলা যায়, মেয়েদের পর্দাহীনতা ও সমাজে
বিপুল সংখ্যক লোকের অবিবাহিত থাকাই আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী এমন সব মৌলিক কার্যকারণ
যেগুলোর মাধ্যমে সামাজিক পরিবেশ একটি অননুভূত যৌন কামনা সর্বক্ষণ প্রবাহমান থাকে
এবং এ যৌন কামনার বশবর্তী হয়ে লোকদের চোখ, কান, কণ্ঠ, মন-মানস সবকিছুই কোন বাস্তব বা কাল্পনিক
কেলেংকারিতে (Scandal) জড়িত হবার জন্য সবসময় তৈরী থাকে। এ দোষ ও ত্রুটি সংশোধন করার জন্য আলোচ্য
পর্দার বিধিসমূহের চেয়ে বেশী নির্ভুল, উপযোগী ও প্রভাবশালী অন্য কোন কর্মপন্থা
আল্লাহর জ্ঞান-ভাণ্ডারে ছিল না। নয়তো তিনি এগুলো বাদ দিয়ে অন্য বিধান দিতেন।
দুইঃ এ সুযোগে দ্বিতীয় যে কথাটি বুঝে নিতে হবে সেটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর শরীয়াত কোন অসৎকাজ
নিছক হারাম করে দিয়ে অথবা তাকে অপরাধ গণ্য করে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত করে
দেয়াই যথেষ্ট মনে করে না বরং যেসব কার্যকারণ কোন ব্যক্তিকে ঐ অসৎকাজে লিপ্ত হতে
উৎসাহিত করে অথবা তার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় কিংবা তাকে তা করতে বাধ্য করে,
সেগুলোকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তাছাড়া শরীয়াত অপরাধের সাথে সাথে অপরাধের কারণ, অপরাধের উদ্যোক্তা ও অপরাধের
উপায়-উপকরণাদির ওপরও বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এভাবে আসল অপরাধের ধারে কাছে পৌঁছার আগেই অনেক দূর থেকেই
মানুষকে রুখে দেয়া হয়।
মানুষ সবসময় অপরাধের কাছ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকবে এবং প্রতিদিন পাকড়াও হতে ও
শাস্তি পেতে থাকবে, এটাও সে পছন্দ করে না। সে নিছক একজন অভিযুক্তই (Prosecutor) নয় বরং একজন সহানুভূতিশীল সহযোগী, সংস্কারকারী ও সাহায্যকারীও। তাই সে মানুষকে অসৎকাজ থেকে নিষ্কৃতি লাভের ক্ষেত্রে
সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই সকল প্রকার শিক্ষামূলক, নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা
অবলম্বন করে।
২৪. মূলে حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا শব্দ
ব্যবহার করা হয়েছে। লোকেরা সাধারণত একে حتى تستاذنوا (অর্থাৎ যতক্ষণ না অনুমতি নাও) অর্থে ব্যবহার করে। কিন্তু আসলে উভয় ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থের
মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একে উপেক্ষা করা চলে না। حتى تستاذنوا বললে আয়াতের অর্থ হতোঃ “কারোর বাড়িতে প্রবেশ
করো না যতক্ষণ না অনুমতি নিয়ে নাও।” এ প্রকাশ ভংগী পরিহার করে আল্লাহ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا শব্দ ব্যবহার করেছেন। استيناس শব্দ انس ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আমাদের ভাষায় এর মানে হয় পরিচিত, অন্তরঙ্গতা, সম্মতি ও প্রীতি। এ ধাতু থেকে উৎপন্ন تستانسوا শব্দ যখনই বলা হবে তখনই এর
মানে হবে, সম্মতি আছে কি না জানা অথবা নিজের সাথে অন্তরঙ্গ করা। কাজেই আয়াতের সঠিক অর্থ হবেঃ “লোকদের গৃহে
প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তাদেরকে অন্তরঙ্গ করে নেবে অথবা তাদের সম্মতি জেনে নেবে।” অর্থাৎ একথা জেনে নেবে যে, গৃহমালিক তোমার আসাকে
অপ্রীতিকর বা বিরক্তিকর মনে করছে না এবং তার গৃহে তোমার প্রবেশকে সে পছন্দ করছে। এজন্য আমি অনুবাদে “অনুমতি নেবা’র পরিবর্তে
‘সম্মতি লাভ’ শব্দ ব্যবহার করেছি। কারণ এ অর্থটি মূলের নিকটতর।
২৫. জাহেলী যুগে আরববাসীদের নিয়ম ছিল, তারা حَيِّيتٌم صَبَاحًا , حُيِّيتُم
مساءً (সুপ্রভাত, শুভ
সন্ধ্যা) বলতে বলতে নিঃসংকোচে সরাসরি একজন অন্যজনের গৃহে প্রবেশ করে যেতো। অনেক সময় বহিরাগত ব্যক্তি গৃহ মালিক ও তার
বাড়ির মহিলাদেরকে বেসামাল অবস্থায় দেখে ফেলতো। আল্লাহ এর সংশোধনের জন্য এ নীতি নির্ধারণ করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির যেখানে সে
অবস্থান করে সেখানে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (Privacy) রক্ষা
করার অধিকার আছে এবং তার সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া তার এ গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা অন্য
ব্যক্তির জন্য জায়েয নয়। এ হুকুমটি নাযিল হবার পর নবী সা. সমাজে যেসব নিয়ম ও রীতি-নীতির প্রচলন করেন
আমি নীচে সেগুলো বর্ণনা করছিঃ
একঃ নবী সা. ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এ অধিকারটিকে কেবলমাত্র গৃহের
চৌহদ্দীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং একে একটি সাধারণ অধীকার গণ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে অন্যের গৃহে উঁকি ঝুঁকি মারা, বাহির থেকে চেয়ে দেখা এমনকি
অন্যের চিঠি তার অনুমতি ছাড়া পড়ে ফেলা নিষিদ্ধ। হযরত সওবান (নবী সা. এর আজাদ করা গোলাম) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সা. বলেনঃ
اذا دخل البصر فلا اذن
“দৃষ্টি যখন একবার প্রবেশ করে গেছে তখন আর নিজের প্রবেশ করার জন্য অনুমতি
নেবার দরকার কি?” (আবু দাউদ)
হযরত হুযাইল ইবনে শুরাহবীল বলেন, এক ব্যক্তি নবী সা. এর কাছে এলেন এবং ঠিক
তাঁর দরজার ওপর দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলেন। নবী (সা) তাকে বললেন, هكذا عنك , فائما الاستيذان من النظر “পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে দৃষ্টি না পড়ে সে জন্যই
তো অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ (আবু দাউদ) নবী করীমের সা. নিজের নিয়ম ছিল এই যে, যখন কারোর বাড়িতে যেতেন,
দরজার ঠিক সামনে কখনো দাঁড়াতেন না। কারণ সে যুগে ঘরের দরজায় পরদা লটকানো থাকতো না। তিনি দরজার ডান পাশে বা বাম পাশে দাঁড়িয়ে
অনুমতি চাইতেন। (আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহর সা.
খাদেম হযরত আনাস বলেন, এক ব্যক্তি বাইরে থেকে রসূলের সা. কামরার মধ্যে উঁকি দিলেন। রাসূলুল্লাহর সা. হাতে সে সময় একটি তীর ছিল। তিনি তার দিকে এভাবে এগিয়ে এলেন যেন তীরটি তার
পেটে ঢুকিয়ে দেবেন। (আবু দাউদ) হযরত আবদুল্লাহ
ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেছেনঃ
مَنْ نَظَرَ فِى كِتَابِ أَخِيهِ بِغَيْرِ إِذْنِهِ
فَإِنَّمَا يَنْظُرُ فِى النَّارِ
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তার পত্রে চোখ বুলালো সে যেন আগুনের
মধ্যে দৃষ্টি ফেলছে।” (আবুদ দাউদ)
বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী সা. বলেছেনঃ
لَوْ أَنَّ امْرَأً اطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ إِذْنٍ
فَخَذَفْتَهُ بِحَصَاةٍ ، فَفَقَأْتَ عَيْنَهُ مَا كَانَ عَلَيْكَ جُنَاحٌ
“যদি কোন ব্যক্তি তোমার গৃহে উঁকি মারে এবং তুমি একটি কাঁকর মেরে তার চোখ
কানা করে দাও, তাহলে তাতে কোন গোনাহ হবে না।”
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
مَنِ اطَّلَعَ فِى دَارِ قَوْمٍ بِغَيْرِ إِذْنِهِمْ
فَفَقَأُوا عَيْنَهُ فَقَدْ هَدَرَتْ عَيْنُهُ
“যে ব্যক্তি কারোর ঘরে উঁকি মারে এবং ঘরের লোকেরা তার চোখ ছেঁদা করে দেয়,
তবে তাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না।”
ইমাম শাফঈ এ হাদীসটিকে একদম শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং তিনি কেউ ঘরের
মধ্যে উঁকি দিলে তার চোখ ছেঁদা করে দেবার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু হানাফীগণ এর অর্থ নিয়েছেন এভাবে যে, নিছক দৃষ্টি দেবার ক্ষেত্রে এ
হুকুমটি দেয়া হয়নি। বরং এটি এমন অবস্থায় প্রযোজ্য যখন কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে গৃহ মধ্যে
প্রবেশ করে, গৃহবাসীদের বাধা দেয়ায়ও সে নিরস্ত হয় না এবং গৃহবাসীরা তার প্রতিরোধ করতে
থাকে। এ প্রতিরোধ ও সংঘাতের মধ্যে
যদি তার চোখ ছেঁদা হয়ে যায় বা শরীরের কোন অংগহানি হয় তাহলে এজন্য গৃহবাসীরা দায়ী
হবে না। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৮৫ পৃষ্ঠা)
দুইঃ ফকীহগণ শ্রবণ শক্তিকেও দৃষ্টিশক্তির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত
করেছেন। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যদি বিনা
অনুমতিতে আসে তাহলে তার দৃষ্টি পড়বে না ঠিকই কিন্তু তার কান তো গৃহবাসীদের কথা
বিনা অনুমতিতে শুনে ফেলবে। এ জিনিসটিও দৃষ্টির মতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ।
তিনঃ কেবলমাত্র অন্যের গৃহে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেবার হুকুম
দেয়া হয়নি। বরং নিজের মা-বোনদের কাছে
যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। এক ব্যক্তি নবী সা.কে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি
চাইবো? জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সে বললো, আমি ছাড়া তাঁর সেবা কারার আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে কি আমি যতবার তাঁর কাছে যাবো
প্রত্যেক বার অনুমতি নেবো? জবাব দিলেন, اتحب ان تراها عريانة “তুমি কি তোমার মাকে উলংগ অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?” (ইবনে
জারীর এ মুরসাল হাদীসটি আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন) আবদুল্লাহ ইবনে
মাসউদের উক্তি হচ্ছে, عليكم ان تستاذنوا على امهاتكم واخواتكم “নিজেদের মা-বোনদের
কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও।” (ইবনে কাসীর) বরং ইবনে মাসউদ তো বলেন, নিজের ঘরে নিজের স্ত্রীর কাছে
যাবার সময়ও অন্ততপক্ষে গলা খাঁকারী দিয়ে যাওয়া উচিত। তাঁর স্ত্রী যয়নবের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ
যখনই গৃহে আসতে থাকেন তখনই আগেই এমন কোন আওয়াজ করে দিতেন যাতেন তিনি আসছেন বলে
জানা যেতো। তিনি হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে
যাওয়া পছন্দ করতেন না।
(ইবনে জারীর)
চারঃ শুধুমাত্র এমন অবস্থায় অনুমতি চাওয়া জরুরী নয় যখন কারোর ঘরে
হঠাৎ কোন বিপদ দেখা দেয়।
যেমন, আগুন লাগে
অথবা কোন চোর ঢোকে। এ অবস্থায় সাহায্য দান করার জন্য বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা যায়।
পাঁচঃ প্রথম প্রথম যখন অনুমতি চাওয়ার বিধান জারি হয় তখন লোকেরা
তার নিয়ম-কানুন জানতো না।
একবার এক ব্যক্তি নবী সা. এর কাছে আসে এবং দরজা থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে االج (আমি কি ভেতরে ঢুকে যাবো?) নবী সা. তাঁর বাঁদী
রওযাহকে বলেন, এ ব্যক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানে না। একটু উঠে গিয়ে তাকে বলে এসো, السلام عليكم اادخل؟ (আসসালামু আলাইকুম, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?) বলতে হবে। (ইবনে জারির ও আবু দাউদ) জাবের ইবনে আবদুল্লাহ
বলেন, আমি আমার
বাবার ঋণের ব্যাপারে নবী সা. এর কাছে গেলাম এবং দরজায় করাঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি
বললাম, আমি। তিনি দু-তিনবার বললেন, “আমি? আমি?’ অর্থাৎ এখানে আমি বললে কে কি বুঝবে যে, তুমি কে?
(আবু দাউদ) কালাদাহ ইবনে হাম্বল নামে এক ব্যক্তি কোন কাজে নবী সা.
এর কাছে গেলেন।
সালাম ছাড়াই এমনিই সেখানে গিয়ে বসলেন। তিনি বললেন, বাইরে যাও এবং আস্সালামু আলাইকুম বলে ভেতরে এসো। (আবু দাউদ) অনুমতি চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি ছিল, মানুষ নিজের নাম বলে অনুমতি
চাইবে। হযরত উমরের রা. ব্যাপারে
বর্ণিত আছে নবী করীমের সা. খিদমতে হাজির হয়ে তিনি বলতেনঃ
السلام عليكم يارسول الله ايدخل عمر؟
“আস্সালামু আলাইকুম, হে আল্লাহর রাসূল! উমর কি ভেতরে
যাবে?” (আবু দাউদ) অনুমতি নেবার জন্য নবী করীম সা. বড় জোর
তিনবার ডাক দেবার সীমা নির্দেশ করেছেন এবং বলেছেন যদি তিনবার ডাক দেবার পরও জবাব
না পাওয়া যায়, তাহলে ফিরে যাও। (বুখারী মুসলিম, আবু দাউদ) নবী সা. নিজেও এ পদ্ধতি অনুসরণ
করতেন। একবার তিনি হযরত সা’দ ইবনে
উবাদার বাড়ীতে গেলেন এবং আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ বলে দু’বার অনুমতি
চাইলেন। কিন্তু ভেতর থেকে জবাব এলো
না। তৃতীয় বার জবাব না পেয়ে
তিনি ফিরে গেলেন। হযরত সা’দ ভেতর থেকে দৌড়ে
এলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার আওয়াজ শুনছিলাম। কিন্তু আমার মন চাচ্ছিল আপনার মুবারক কন্ঠ থেকে আমার জন্য
যতবার সালাম ও রহমতের দোয়া বের হয় ততই ভালো, তাই আমি খুব নীচু স্বরে জবাব দিচ্ছিলাম। (আবু দাউদ ও আহমাদ) এ তিনবার ডাকা একের পর এক
হওয়া উচিত নয় বরং একটু থেমে হতে হবে। এর ফলে ঘরের লোকেরা যদি কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সেজন্য তারা জবাব দিতে না পারে
তাহলে সে কাজ শেষ করে জবাব দেবার সুযোগ পাবে।
ছয়ঃ গৃহমালিক বা গৃহকর্তা অথবা এমন এক ব্যক্তির অনুমতি
গ্রহণযোগ্য হবে যার সম্পর্কে মানুষ যথার্থই মনে করবে যে, গৃহকর্তার পক্ষ থেকে সে অনুমতি
দিচ্ছে। যেমন, গৃহের খাদেম অথবা কোন
দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কোন ছোট শিশু যদি বলে, এসে যান, তাহলে তার কথায় ভেতর প্রবেশ করা উচিত নয়।
সাতঃ অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারে অযথা পীড়াপীড়ি করা অথবা অনুমতি না
পাওয়ায় দরজার ওপর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েয নয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর গৃহকর্তার পক্ষ থেকে অনুমতি
না পাওয়া যায় বা অনুমতি দিতে অস্বীকার জানানো হয়, তাহলে ফিরে যাওয়া উচিত।
﴿فَإِن لَّمْ تَجِدُوا فِيهَا
أَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوهَا حَتَّىٰ يُؤْذَنَ لَكُمْ ۖ وَإِن قِيلَ لَكُمُ ارْجِعُوا
فَارْجِعُوا ۖ هُوَ أَزْكَىٰ لَكُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ﴾
২৮। তারপর যদি
সেখানে কাউকে না পাও, তাহলে তাতে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি না দেয়া
হয়।২৬ আর যদি তোমাদের বলা হয়, ফিরে যাও তাহলে ফিরে যাবে, এটিই তোমাদের জন্য বেশী শালীন
ও পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি২৭ এবং যা কিছু তোমরা করো আল্লাহ
তা খুব ভালোভাবেই জানেন।
২৬. অর্থাৎ কারোর শূন্য গৃহে প্রবেশ করা জায়েয নয়। তবে যদি গৃহকর্তা নিজেই প্রবেশকারীকে তার খালি
ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে থাকে, তাহলে প্রবেশ করতে পারে। যেমন গৃহকর্তা আপনাকে বলে দিয়েছেন, যদি আমি ঘরে না থাকি, তাহলে আপনি আমার কামরায় বসে যাবেন। অথবা গৃহকর্তা অন্য কোন জায়গায় আছেন এবং আপনার আসার খবর
পেয়ে তিনি বলে পাঠিয়েছেন, আপনি বসুন, আমি এখনই এসে যাচ্ছি। অন্যথায় গৃহে কেউ নেই অথবা ভেতর থেকে কেউ বলছে
না নিছক এ কারণে বিনা অনুমতিতে ভেতরে ঢুকে যাওয়া কারোর জন্য বৈধ নয়।
২৭. অর্থাৎ এজন্য নারাজ হওয়া মন খারাপ করা উচিত নয়। কোন ব্যক্তি যদি করো সাথে দেখা করতে না চায়
তাহলে তার অস্বীকার করার অধিকার আছে। অথবা কোন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সে অক্ষমতা জানিয়ে দিতে পারে। ফকীহগণ اِرجِعُوا (ফিরে যাও) এর হুকুমের এ অর্থ
নিয়েছেন যে, এ অবস্থায় দরজার সামনে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে
যাওয়ার অনুমতি নেই বরং সেখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। অন্যকে সাক্ষাত দিতে বাধ্য করা অথবা তার দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে
তাকে বিরক্ত করতে থাকার অধিকার কোন ব্যক্তির নেই।
﴿لَّيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ
أَن تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ مَسْكُونَةٍ فِيهَا مَتَاعٌ لَّكُمْ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ
مَا تُبْدُونَ وَمَا تَكْتُمُونَ﴾
২৯। তবে
তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি নেই যদি তোমরা এমন গৃহে প্রবেশ করো যেখানে কেউ বাস করে না
এবং তার মধ্যে তোমাদের কোন কাজের জিনিস আছে২৮ তোমরা যা
কিছু প্রকাশ করো ও যা কিছু গোপন করো আল্লাহ সবই জানেন।
২৮. এখানে মূলত হোটেল, সরাইখানা, অতিথিশালা, দোকান, মুসাফির
খানা ইত্যাদি যেখানে লোকদের জন্য প্রবেশের সাধারণ অনুমতি আছে সেখানকার কথা বলা
হচ্ছে।
﴿قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا
مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ
خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ﴾
৩০। নবী!
মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে২৯ এবং
নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে।৩০ এটি তাদের
জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা
জানেন।
২৯. মূল শব্দগুলো হচ্ছে يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ এখানে غض মানে হচ্ছে, কোন জিনিস কম করা, হ্রাস
করা ও নিচু করা। غض بصر এর অনুবাদ সাধারণত করা হয়, “দৃষ্টি নামিয়ে নেয়া বা রাখা।” কিন্তু আসলে এ হুকুমের অর্থ সবসময় দৃষ্টি
নিচের দিকে রাখা নয়।
বরং এর অর্থ হচ্ছে, পূর্ণ দৃষ্টিভরে না দেখা এবং দেখার জন্য দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে না
দেয়া। “দৃষ্টি সংযত রাখা” থেকে এ
অর্থ ভালোভাবে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ যে জিনিসটি দেখা সঙ্গত নয় তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হবে। এজন্য দৃষ্টি নত করাও যায় আবার অন্য কোন দিকে
নজর ঘুরিয়েও নেয়া যায়। مِنْ أَبْصَارِهِمْ এর মধ্যে من (মিন) “কিছু” বা “কতক” অর্থ প্রকাশ করছে। অর্থাৎ সমস্ত দৃষ্টি সংযত করার হুকুম দেয়া
হয়নি বরং কোন কোন দৃষ্টি সংযত করতে বলা হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, আল্লাহর উদ্দেশ্য এ নয় যে, কোন জিনিসই পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় বরং তিনি কেবল মাত্র একটি বিশেষ
গণ্ডীর মধ্যে দৃষ্টির ওপর এ বিধি-নিষেধ যে জিনিসের ওপর আরোপ করা হয়েছে সেটি হচ্ছে,
পুরুষদের মহিলাদেরকে দেখা অথবা অন্যদের লজ্জাস্থানে দৃষ্টি দেয়া
কিংবা অশ্লীল দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা।
আল্লাহর কিতাবের এ হুকুমটির যে ব্যাখ্যা হাদীস করেছে তার বিস্তারিত বিবরণ নিচে
দেয়া হলোঃ
একঃ নিজের স্ত্রী বা মুহাররাম নারীদের ছাড়া কাউকে নজর ভরে দেখা
মানুষের জন্য জায়েয নয়।
একবার হঠাৎ নজর পড়ে গেলে ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলে সেখানে আবার দৃষ্টিপাত করা
ক্ষমাযোগ্য নয়। নবী সা. এ ধরনের দেখাকে
চোখের যিনা বলেছেন। তিনি বলেছেনঃ মানুষ তার
সমগ্র ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যিনা করে। দেখা হচ্ছে চোখের যিনা, ফুসলানো কণ্ঠের যিনা, তৃপ্তির সাথে কথা
শোনা কানের যিনা, হাত লাগানো ও অবৈধ উদ্দেশ্য নিয়ে চলা হাত ও
পায়ের যিনা। ব্যভিচারের এ যাবতীয় ভূমিকা
যখন পুরোপুরি পালিত হয় তখন লজ্জাস্থানগুলো তাকে পূর্ণতা দান করে অথবা পূর্ণতা দান
থেকে বিরত থাকে। (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ) হযরত
বুরাইদাহ বর্ণনা করেছেন, নবী সা. হযরত আলীকে রা. বলেনঃ
يَا عَلِىُّ لاَ تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ
فَإِنَّ لَكَ الأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الآخِرَةُ
“হে আলী! এক নজরের পর দ্বিতীয় নজর দিয়ো না। প্রথম নজর তো ক্ষমাপ্রাপ্ত কিন্তু দ্বিতীয় নজরের ক্ষমা নেই।” (আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ,
দারেমী)
হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ বাজালী বলেন, আমি নবী সা.কে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ চোখ পড়ে গেলে কি করবো? বললেন, চোখ ফিরিয়ে নাও অথবা নামিয়ে নাও। (মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, আবু
দাউদ, নাসাঈ) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. রেওয়ায়াত করেছেন,
নবী সা. আল্লাহর উক্তি বর্ণনা করেছেনঃ
اِنَّ النَّظْرَ سَهَمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ مَسْمُومٌ
مَنْ تَرَكَهَا مَخَافَتِى اَبْدَلْتُهُ اِيْمَانًا يُجِدُ حَلَاوَتَهُ فِى قَلْبِهِ
“দৃষ্টি হচ্ছে ইবলীসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্য থেকে একটি তীর, যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে তা ত্যাগ করবে আমি তার বদলে তাকে এমন ঈমান দান
করবো যার মিষ্টি সে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে।” (তাবারানী)
আবু উমামাহ রেওয়ায়াত করেছেন, নবী সা. বলেনঃ
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَى مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ
ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلاَّ أَخْلف اللَّهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلاَوَتَهَا
“যে মুসলমানের দৃষ্টি কোন মেয়ের সৌন্দর্যের ওপর পড়ে এবং এ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়,
এ অবস্থায় আল্লাহ তার ইবাদাতে বিশেষ স্বাদ সৃষ্টি করে দেন।” (মুসনাদে আহমাদ)
ইমাম জা’ফর সাদেক তাঁর পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকের থেকে এবং তিনি হযরত জাবের
ইবনে আবদুল্লাহ আনসারীর থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ বিদায় হজ্জের সময় নবী সা. এর চাচাত
ভাই ফযল ইবনে আব্বাস (তিনি সে সময় ছিলেন একজন উঠতি তরুণ) মাশ’আরে হারাম থেকে ফেরার
পথে নবী করীমের সা. সাথে তাঁর উটের পিঠে বসেছিলেন। পথে মেয়েরা যাচ্ছিল। ফযল তাদেরকে দেখতে লাগলেন। নবী সা. তার মুখের ওপর হাত রাখলেন এবং তাকে অন্যদিকে
ফিরিয়ে দিলেন। (আবু দাউদ) এ বিদায় হজ্জেরই
আর একটি ঘটনা। খাস্’আম গোত্রের একজন মহিলা
পথে রাসূলুল্লাহকে সা. থামিয়ে দিয়ে হজ্জ সম্পর্কে একটি বিধান জিজ্ঞেস করছিলেন। ফযল ইবনে আব্বাস তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
রইলেন। নবী সা. তার মুখ ধরে অন্য
দিকে ফিরিয়ে দিলেন। (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ)
দুইঃ এ থেকে কেউ যেন এ ভুল ধারণা করে না বসেন যে, নারীদের মুখ খুলে চলার সাধারণ
অনুমতি ছিল তাইতো চোখ সংযত করার হুকুম দেয়া হয়। অন্যথায় যদি চেহারা ঢেকে রাখার হুকুম দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে আবার দৃষ্টি সংযত করার
বা না করার প্রশ্ন আসে কেন? এ যুক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক
দিয়েও ভুল এবং ঘটনার দিক দিয়েও সঠিক নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে এর ভুল হবার কারণ হচ্ছে এই যে, চেহারার পর্দা সাধারণভাবে
প্রচলিত হয়ে যাবার পরও হঠাৎ কোন নারী ও পুরুষের সামনাসামনি হয়ে যাবার মতো অবস্থা
সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। আর একজন পর্দানশীন মহিলারও কখনো মুখ খোলার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে মুসলমান মহিলারা পর্দা করা সত্ত্বেও
অমুসলিম নারীরা তো সর্বাবস্থায় পর্দার বাইরেই থাকবে। কাজেই নিছক দৃষ্টি সংযত করার হুকুমটি মহিলাদের মুখ খুলে
ঘোরাফেরা করাকে অনিবার্য করে দিয়েছে, এ যুক্তি এখানে পেশ করার যেতে পারে না। আর ঘটনা হিসেবে এটা ভুল হবার কারণ এই যে, সূরা আহযাবে হিজাবের বিধান
নাযিল হবার পরে মুসলিম সমাজে যে পর্দার প্রচলন করা হয়েছিল চেহারার পর্দা তার
অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নবী সা. এর মুবারক যুগে এর প্রচলন হবার ব্যাপারটি বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অপবাদের ঘটনা সম্পর্কে হযরত আয়েশার হাদীস
অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত। তাতে তিনি বলেন, জংগল থেকে ফিরে এসে যখন দেখলাম কাফেলা চলে
গেছে তখন আমি বসে পড়লাম এবং ঘুম আমার দু’চোখের পাতায় এমনভাবে জেঁকে বসলো যে,
আমি ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দূর থেকে কাউকে ওখানে পড়ে থাকতে দেখে কাছে
এলেন।
فَعَرَفَنِى حِينَ رَآنِى ، وَكَانَ رَآنِى قَبْلَ
الْحِجَابِ ، فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِينَ عَرَفَنِى ، فَخَمَّرْتُ وَجْهِى
بِجِلْبَابِى
“তিনি আমাকে দেখতেই চিনে ফেললেন। কারণ পর্দার হুকুম নাযিল হবার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে চিনে ফেলে যখন তিনি “ইন্নালিল্লাহে ওয়া
ইন্না ইলাইহে রাজেউন” পড়লেন তখন তাঁর আওয়াজে আমার চোখ খুলে গেলো এবং নিজের চাদরটি
দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম।”
(বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, ইবনে জারীর,
সীরাতে ইবনে হিশাম)।
আবু দাউদের কিতাবুল জিহাদে একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে উম্মে খাল্লাদ নাম্নী এক মহিলার ছেলে এক
যুদ্ধে শহীদ হয়ে গিয়েছিল। তিনি
তার সম্পর্কে জানার জন্য নবী সা. এর কাছে এলেন। কিন্তু এ অবস্থায়ও তার চেহারা নেকাব আবৃত ছিল। কোন কোন সাহাবী অবাক হয়ে বললেন, এ সময়ও তোমার মুখ নেকাবে আবৃত। অর্থাৎ ছেলের শাহাদাতের খবর শুনে তো একজন
মায়ের শরীরের প্রতি কোন নজর থাকে না, বেহুঁশ হয়ে পড়ে অথচ তুমি একদম নিশ্চিন্তে
নিজেকে পর্দাবৃত করে এখানে হাজির হয়েছো! জবাবে তিনি বলতে লাগলেনঃ ان ارزا ابنى فلن ارزا حيائى “আমি পুত্র তো হারিয়েছি ঠিকই
কিন্তু লজ্জা তো হারাইনি।” আবু দাউদেই হযরত আয়েশার হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এক মহিলা পর্দার পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে রাসূলুল্লাহ
সা. এর কাছে আবেদন পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ
সা. জিজ্ঞেস করেন, এটা মহিলার হাত না পুরুষের? মহিলা বলেন, মহিলারই হাত। বলেন, “নারীর হাত হলে তো কমপক্ষে নখ মেহেদী রঞ্জিত হতো।’ আর হজ্জের সময়ের যে দু’টি ঘটনার কথা আমরা
ওপরে বর্ণনা করে এসেছি সেগুলো নববী যুগে চেহারা খোলা রাখার পক্ষে দলীল হতে পারে না। কারণ ইহরামের পোশাকে নেকাব ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবুও এ অবস্থায়ও সাবধানী মেয়েরা ভিন্ পুরুষদের
সামনে চেহারা খোলা রাখা পছন্দ করতেন না। হযরত আয়েশার বর্ণনা, বিদায় হজ্জের সফরে আমরা ইহরাম বাঁধা
অবস্থায় মক্কার দিকে যাচ্ছিলাম। মুসাফিররা
যখন আমাদের কাছ দিয়ে যেতে থাকতো তখন আমরা মেয়েরা নিজেদের মাথা থেকে চাদর টেনে নিয়ে
মুখে ঢেকে নিতাম এবং তারা চলে যাবার পর মুখ আবরণমুক্ত করতাম। (আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ মুখ আবৃত করা যেখানে হারাম)
তিনঃ যেসব অবস্থায় কোন স্ত্রীলোককে দেখার কোন যথার্থ প্রয়োজন থাকে
কেবলমাত্র সেগুলোই দৃষ্টি সংযত করার হুকুমের বাইরে আছে। যেমন কোন ব্যক্তি কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এ উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র মেয়েটিকে দেখার অনুমতি
আছে। বরং দেখাটা কমপক্ষে
মুস্তাহাব তো অবশ্যই।
মুগীরাহ ইবনে শু’বা বর্ণনা করেন, আমি এক জায়গায় বিয়ের প্রস্তাব দেই। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করেন, মেয়েটিকে দেখে নিয়েছো তো?
আমি বলি, না। বলেনঃ
انظر اليها فانه احرى ان يؤدم بينكما
“তাকে দেখে নাও। এর ফলে তোমাদের মধ্যে অধিকতর একাত্মতা সৃষ্টি হওয়ার আশা আছে।’ (আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ,
ইবনে মাজাহ, দারেমী)
আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি কোথাও বিয়ের পয়গাম দেয়। নবী সা. বলেনঃ ايظر اليها فان فى اعين الابصار سيئا “মেয়েটিকে দেখে নাও। কারণ আনসারদের চোখে কিছু দোষ থাকে।” (মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ)
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَقَدِرَ أَنْ
يَرَى مِنْهَا بَعْضَ مَا يَدْعُوهُ إِلَيْ نكاحها فَلْيَفْعَلْ-
“তোমাদের কেউ যখন কোন মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা করে তখন যতদূর সম্ভব তাকে
দেখে নিয়ে এ মর্মে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত যে, মেয়েটির মধ্যে
এমন কোন গুণ আছে যা তাকে বিয়ে করার প্রতি আকৃষ্ট করে।” (আহমাদ ও আবু দাউদ)
মুসনাদে আহমাদে আবু হুমাইদাহর বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা. এ উদ্দেশ্যে দেখার
অনুমতিকে فلا جناح عليه শব্দগুলোর সাহায্যে বর্ণনা
করেছেন। অর্থাৎ এমনটি করায় ক্ষতির
কিছু নেই। তাছাড়া মেয়েটির অজান্তেও
তাকে দেখার অনুমতি দিয়েছেন। এ থেকেই ফকিহগণ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অন্যভাবে দেখার বৈধতার বিধানও উদ্ভাবন
করেছেন। যেমন অপরাধ অনুসন্ধান
প্রসঙ্গে কোন সন্দেহজনক মহিলাকে দেখা অথবা আদালতে সাক্ষ্য দেবার সময় কাযীর কোন
মহিলা সাক্ষীকে দেখা কিংবা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের রুগিনীকে দেখা ইত্যাদি।
চারঃ দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশের এ অর্থও হতে পারে যে, কোন নারী বা পুরুষের সতরের
প্রতি মানুষ দৃষ্টি দেবে না। নবী সা. বলেছেনঃ
لاَ يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ وَلاَ
تَنْظُرُ الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ
“কোন পুরুষ কোন পুরুষের লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি দেবে না এবং কোন নারী
কোন নারীর লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি দেবে না।” (আহমাদ, মুসলিম, আবুদ দাউদ, তিরমিযী)
হযরত আলী রা. রেওয়ায়াত করেছেন, নবী করীম সা. আমাকে বলেনঃ لاتنظر الى فخذ حى ولاميت “কোন জীবিত বা মৃত মানুষের রানের ওপর দৃষ্টি
দিয়ো না।”
(আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
৩০) লজ্জাস্থানের হেফাজত অর্থ নিছক প্রবৃত্তির কামনা থেকে দূরে থাকা নয় বরং
নিজের লজ্জাস্থানকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করা থেকে দূরে থাকাও বুঝা। পুরুষের জন্য সতর তথা লজ্জাস্থানের সীমানা নবী
সা. নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ عورة الرجل مابين سرتة الى ركبته “পুরুষের সতর হচ্ছে তার নাভী
থেকে হাঁটু পর্যন্ত।” (দারুকুত্নী ও বাইহাকী) শরীরের এ অংশ স্ত্রী ছাড়া কারোর আমনে ইচ্ছাকৃতভাবে
খোলা হারাম। আসহাবে সুফ্ফার দলভুক্ত
হযরত জারহাদে আসলামী বর্ণনা করেছেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা. এর মজলিসে আমার রান
খোলা অবস্থায় ছিল।
নবী করীম সা. বললেনঃ اما علمت ان الفخذ عورة؟ “তুমি কি জানো না, রান
ঢেকে রাখার জিনিস?” (তিরমিযী, আবুদ
দাউদ, মুআত্তা) হযরত আলী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ لاتبرز (يالا تكشف) فخذ “নিজের রান কখনো খোলা রাখবে না।” (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ) কেবল অন্যের সামনে
নয়, একান্তেও
উলংগ থাকা নিষিদ্ধ। তাই নবী করীম সা. বলেছেনঃ
إِيَّاكُمْ وَالتَّعَرِّى فَإِنَّ مَعَكُمْ مَنْ لاَ
يُفَارِقُكُمْ إِلاَّ عِنْدَ الْغَائِطِ وَحِينَ يُفْضِى الرَّجُلُ إِلَى أَهْلِهِ
فَاسْتَحْيُوهُمْ وَأَكْرِمُوهُمْ
“সাবধান, কখনো উলংগ থেকো না। কারণ তোমাদের সাথে এমন সত্তা আছে যারা কখনো
তোমাদের থেকে আলাদা হয় না (অর্থাৎ কল্যাণ ও রহমতের ফেরেশতা), তোমরা যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া
দাও অথবা স্ত্রীদের কাছে যাও সে সময় ছাড়া, কাজেই তাদের থেকে
লজ্জা করো এবং তাদেরকে সম্মান করো।” (তিরমিযী)
অন্য একটি হাদীসে নবী করীম সা. বলেনঃ
احْفَظْ عَوْرَتَكَ إِلَّا مِنْ زَوْجَتِكَ أَوْ مِمَّا
مَلَكَتْ يَمِينُكَ
“নিজের স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া বাকি সবার থেকে নিজের সতরের হেফাজত করো।”
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আর যখন আমরা একাকী থাকি? জবাব দেনঃ فَاللهُ تبارك وتعالى أَحَقُّ
أَنْ يُسْتَحْيَا مِنْهُ “এ অবস্থায় আল্লাহ থেকে লজ্জা করা উচিত,
তিনিই এর বেশী হকদার।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
﴿وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ
مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا
مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ
زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ
أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي
إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ
أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ
لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ
مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ
لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾
৩১। আর হে
নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে৩১ এবং তাদের
লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে৩২ আর৩৩ তাদের
সাজসজ্জা না দেখায়,৩৪ যা নিজে
নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া।৩৫ আর তারা
যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে।৩৬ তারা যেন
তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া৩৭ স্বামী,বাপ,স্বামীর বাপ,৩৮ নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে,৩৯ ভাই,৪০ ভাইয়ের ছেলে,৪১ বোনের ছেলে,৪২ নিজের মেলামেশার মেয়েদের,৪৩ নিজের
মালিকানাধীনদের,৪৪ অধীনস্থ
পুরুষদের যাদের অন্য কোন রকম উদ্দেশ্য নেই৪৫ এবং এমন
শিশুদের সামনে ছাড়া যারা মেয়েদের গোপন বিষয় সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ।৪৬ তারা যেন
নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার
উদ্দেশ্য সজোরে পদক্ষেপ না করে।৪৭ হে
মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো,৪৮ আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।৪৯
৩১. নারীদের জন্যও পুরুষদের মতো দৃষ্টি সংযমের একই
বিধান রয়েছে। অর্থাৎ তাদের ইচ্ছা করে
ভিন্ পুরুষদের দেখা উচিত নয়। ভিন্ পুরষদের প্রতি দৃষ্টি পড়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া উচিত এবং অন্যদের সতর দেখা
থেকে দূরে থাকা উচিত।
কিন্তু পুরুষদের পক্ষে মেয়েদেরকে দেখার তুলনায় মেয়েদের পক্ষে পুরুষদেরকে দেখার
ব্যাপারে কিছু ভিন্ন বিধান রয়েছে। একদিকে হাদীসে আমরা এ ঘটনা পাচ্ছি যে, হযরত উম্মে সালামাহ ও হযরত উম্মে মাইমূনাহ
নবী সা. এর কাছে বসেছিলেন এমন সময় হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম এসে গেলেন। নবী সা. উভয় স্ত্রীকে বললেন, احتجبا منه “তার থেকে পর্দা করো।” স্ত্রীরা বললেনঃ
يا رسول الله اليس اعمى لا يبصرنا ولا يعرفنا
“হে আল্লাহর রাসূল! তিনি কি অন্ধ নন? তিনি আমাদের
দেখতে পাচ্ছেন না এবং চিনতেও পাচ্ছেন না।” বললেনঃ افعميا وان انتما , الستما تبصرانه “তোমরা দুজনও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না?”
হযরত উম্মে সালামাহ রা. পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ذالك بعد ان امر بالحجاب এটা যখন পর্দার হুকুম নাযিল হয়নি সে সময়কার
ঘটনা।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এবং মুআত্তার একটি রেওয়ায়াত এর সমর্থন করে, যাতে বলা হয়েছেঃ হযরত আয়েশা কাছে একজন অন্ধ এলেন এবং তিনি তার থেকে পর্দা
করলেন। বলা হলো, আপনি এর থেকে পর্দা করছেন কেন?
এ-তো আপনাকে দেখতে পারে না। উম্মুল মু’মিনীন রা. এর জবাবে বললেনঃ لكنى انظر اليه “কিন্তু আমি তো তাকে দেখছি।” অন্যদিকে আমরা হযরত আয়েশার একটি হাদীস পাই, তাতে দেখা যায়, ৭ হিজরী সনে হাবশীদের প্রতিনিধি দল মদীনায় এলো এবং তারা মসজিদে নববীর
চত্বরে একটি খেলার আয়োজন করলো। নবী সা. নিজে হযরত আয়েশাকে এ খেলা দেখালেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ) তৃতীয় দিকে আমরা দেখি,
ফাতেমা বিনতে কায়েসকে যখন তাঁর স্বামী তিন তালাক দিলেন তখন প্রশ্ন
দেখা দিল তিনি কোথায় ইদ্দত পালন করবেন। প্রথমে নবী করীম সা. বললেন, উম্মে শরীক আনসারীর কাছে থাকো। তারপর বললেন, তার কাছে আমার সাহাবীগণ অনেক
বেশী যাওয়া আশা করে (কারণ তিনি ছিলেন একজন বিপুল ধনশালী ও দানশীলা মহিলা। বহু লোক তাঁর বাড়িতে মেহমান থাকতেন এবং তিনি
তাদের মেহমানদারী করতেন।)
কাজেই তুমি ইবনে উম্মে মাকতুমের ওখানে থাকো। সে অন্ধ। তুমি তার ওখানে নিঃসংকোচে থাকতে পারবে।” (মুসলিম ও আবু দাউদ)
এসব বর্ণনা একত্র করলে জানা যায়, পুরুষদেরকে দেখার ব্যাপারে মহিলাদের ওপর
তেমন বেশী কড়াকড়ি নেই যেমন মহিলাদেরকে দেখার ব্যাপারে পুরুষের ওপর আরোপিত হয়েছে। এক মজলিসে মুখোমুখি বসে দেখা নিষিদ্ধ। পথ চলার সময় অথবা দূর থেকে কোন কোন জায়েয খেলা
দেখতে গিয়ে পুরুষদের ওপর দৃষ্টি পড়া নিষিদ্ধ নয়। আর কোন যথার্থ প্রয়োজন দেখা দিলে একই বাড়িতে থাকা অবস্থায়ও
দেখলে কোন ক্ষতি নেই।
ইমাম গায্যালী ও ইবনে হাজার আসকালানীও হাদীসগুলো থেকে প্রায় এ একই ধরনের
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
শাওকানী নাইলুল আওতারে ইবনে হাজারের এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, “এ থেকেও বৈধতার প্রতি সমর্থন
পাওয়া যায় যে, মেয়েদের বাইরে বের হবার ব্যাপারে সবসময়
বৈধতাকেই কার্যকর করা হয়েছে। মসজিদে, বাজারে এবং সফরে মেয়েরা তো মুখে নেকাব দিয়ে যেতো, যাতে
পুরুষরা তাদেরকে না দেখে। কিন্তু পুরুষদেরকে কখনো এ হুকুম দেয়া হয় না যে, তোমরাও নেকার পরো, যাতে মেয়েরা তোমাদেরকে না দেখে। এ থেকে জানা যায়, উভয়ের ব্যাপারে হুকুমের মধ্যে বিভিন্নতা
রয়েছে।” (৬ষ্ঠ খণ্ড, ১০১ পৃষ্ঠা) তবুও মেয়েরা
নিশ্চিন্ত পুরুষদেরকে দেখবে এবং তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকবে, এটা কোনক্রমেই জায়েয নয়।
৩২. অর্থাৎ অবৈধ যৌন উপভোগ থেকে দূরে থাকে এবং নিজের সতর
অন্যের সামনে উন্মুক্ত করাও পরিহার করে। এ ব্যাপারে মহিলাদের ও পুরুষদের জন্য একই বিধান, কিন্তু নারীদের সতরের সীমানা
পুরুষদের থেকে আলাদা। তাছাড়া মেয়েদের সতর মেয়েদের ও পুরুষদের জন্য আবার ভিন্ন ভিন্ন।
পুরুষদের জন্য মেয়েদের সতর হাত ও মুখ ছাড়া তার সারা শরীর। স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষ এমন কি বাপ ও ভাইয়ের সামনেও তা
খোলা উচিত নয়। মেয়েদের এমন পাতলা বা চোস্ত
পোশাক পরা উচিত নয় যার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় বা শরীরের গঠন কাঠামো ভেতর থেকে
ফুটে উঠতে থাকে। হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, তাঁর বোন হযরত আসমা বিনতে আবু
বকর রাসূলুল্লাহ সা. এর সামনে আসেন। তখন তিনি পাতলা কাপড় পড়ে ছিলেন। রসূলুল্লাহু সা. সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ
يَا أَسْمَاءُ إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ
لَمْ تَصْلُحْ لها أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلاَّ وهَذَا وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ
“হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার মুখ ও হাত ছাড়া শরীরের কোন
অংশ দেখা যাওয়া জায়েয নয়।” (আবুদ দাউদ)
এ ধরনের আর একটি ঘটনা ইবনে জারীর হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ তাঁর কাছে
তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনুত তোফায়েলের মেয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ সা. গৃহে প্রবেশ করে তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেন। হযরত আয়েশা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ হচ্ছে
আমার ভাইয়ের মেয়ে।
তিনি বলেনঃ
اِذَا عَرَكَتِ الْمَرْأَةُ لَمْ يَحِلُّ لَهَا اَنْ
تُظْهِرَ اِلِّا وَجْهَهَا وَاِلامَا دُوْنَ هَذَا وَقَبْضَ عَلَى ذِرَاعِ نَفْسِهِ
وَتَرَكَوَبَيْن قَبْضَتِهِ وَبَيْنَ الْكَف مِثْلَ قَبْضَةٍ اُخْرى
“মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার জন্য নিজের মুখ ও হাত ছাড়া আর কিছু বের
করে রাখা হালাল নয়, আর নিজের কব্জির ওপর হাত রেখে হাতের
সীমানা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর মুঠি ও হাতের
তালুর মধ্যে মাত্র একমুঠি পরিমাণ জায়গা খালি থাকে।”
এ ব্যাপারে শুধুমাত্র এতটুকু সুযোগ আছে যে, ঘরে কাজকর্ম করার জন্য মেয়েদের শরীরের
যতটুকু অংশ খোলার প্রয়োজন দেখা দেয় নিজেদের মুহাররাম আত্মীয়দের (যেমন বাপ-ভাই
ইত্যাদি) সামনে মেয়েরা শরীরে কেবলমাত্র ততটুকু অংশই খুলতে পারে। যেমন আটা মাখাবার সময় হাতের আস্তিন গুটনো অথবা
ঘরের মেঝে ধুয়ে ফেলার সময় পায়ের কাপড় কিছু ওপরের দিকে তুলে নেয়া।
আর মহিলাদের জন্য মহিলাদের সতরের সীমারেখা হচ্ছে পুরুষদের জন্য পুরুষদের সতরের
সীমা রেখার মতই। অর্থাৎ নাভী ও হাঁটুর
মাঝখানের অংশ। এর অর্থ এ নয় যে, মহিলাদের সামনে মহিলারা অর্ধ
উলংগ থাকবে। বরং এর অর্থ শুধুমাত্র এই
যে, নাভী ও
হাঁটুর মাঝখানের অংশটুকু ঢাকা হচ্ছে ফরয এবং অন্য অংশগুলো ঢাকা ফরয নয়।
৩৩. এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর শরীয়াত নারীদের কাছে
শুধুমাত্র এতটুকুই দাবী করে না যতটুকু পুরুষদের কাছে করে। অর্থাৎ দৃষ্টি সংযত করা এবং লজ্জাস্থানের
হেফাজাত করা। বরং তাদের কাছ থেকে আরো
বেশী কিছু দাবী করে। এ
দাবী পুরুষদের কাছে করেনি। পুরুষ ও নারী যে এ ব্যাপারে সমান নয় তা এ থেকে পরিষ্কার প্রকাশ হয়।
৩৪. আমি زينت শব্দের অনুবাদ করেছি “সাজসজ্জা”। এর দ্বিতীয় আর একটি অনুবাদ হতে পারে প্রসাধন। তিনটি জিনিসের ওপর এটি প্রযুক্ত হয়। সুন্দর কাপড়, অলংকার এবং মাথা, মুখ, হাত-পা ইত্যাদির বিভিন্ন সাজসজ্জা, যেগুলো সাধারণত মেয়েরা করে থাকে। আজকের দুনিয়ায় এজন্য “মেকআপ” (Makeup) শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ সাজসজ্জা কাকে দেখানো যাবে না এ ব্যাপারে
বিস্তারিত বর্ণনা সামনের দিকে আসছে।
৩৫. তাফসীরগুলোর বিভিন্ন বর্ণনা এ আয়াতটির অর্থ যথেষ্ট
অস্পষ্ট করে তুলেছে।
অন্যথায় কথাটি মোটেই অস্পষ্ট নয়, একেবারেই পরিষ্কার। প্রথম বাক্যাংশে বলা হয়েছে لَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ অর্থাৎ “তারা যেন নিজেদের সাজসজ্জা ও প্রসাধন
প্রকাশ না করে।” আর দ্বিতীয় বাক্যাংশে الا শব্দটি বলে এ নিষেধাজ্ঞায় যেসব জিনিসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে যাকে
আলাদা তথা নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে তা হচ্ছে, مَاظْهَرَ مِنْهَا “যা কিছু এ সাজসজ্জা থেকে আপনা আপনি প্রকাশ হয় বা প্রকাশ হয়ে যায়।” এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, মহিলাদের নিজেদের স্বেচ্ছায়
এগুলো প্রকাশ ও এসবের প্রদর্শনী না করা উচিত। তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় (যেমন চাদর বাতাসে উড়ে
যাওয়া এবং কোন আভরণ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া) অথবা যা নিজে নিজে প্রকাশিত (যেমন ওপরে
যে চারদটি জড়ানো থাকে, কোনক্রমেই তাকে লুকানো তো সম্ভব নয় আর নারীদের শরীরের সাথে লেপটে থাকার
কারণে মোটামুটিভাবে তার মধ্যেও স্বতঃষ্ফুর্তভাবে একটি আকর্ষন সৃষ্টি হয়ে যায়)
সেজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন জবাবদিহি নেই। এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে
মাসউদ, হাসান বসরী,
ইবনে সীরীন ও ইবরাহীম নাখ্ঈ। পক্ষান্তরের কোন কোন মুফাসসির مَاظْهَرَ مِنْهَا এর অর্থ নিয়েছেনঃ ما يظهره الانسان على العادة الجارية (মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ করে দেয়)
এবং তারপর তারা এর মধ্যে শামিল করে দিয়েছেন মুখ ও হাতকে তাদের সমস্ত সাজসজ্জাসহ। অর্থাৎ তাদের মতে মহিলারা তাদের গালে রুজ
পাউডার, ঠোঁটে লিপষ্টিক ও চোখে সুরমা লাগিয়ে এবং হাতে আংটি, চুড়ি ও কংকন ইত্যাদি পরে তা উন্মুক্ত রেখে লোকদের সামনে চলাফেরা করবে। ইবনে আব্বাস রা. ও তাঁর শিষ্যগণ এ অর্থ বর্ণনা
করেছেন। হানাফী ফকীহদের একটি বিরাট
অংশও অর্থ গ্রহণ করেছেন।
(আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৮৮-৩৮৯ পৃষ্ঠা) কিন্তু আরবী ভাষার কোন্
নিয়মে مَا يُظْهِرَ কে مَاظَهَرَ এর অর্থে ব্যবহার করা যেতে
পারে তা আমি বুঝতে অক্ষম।
“প্রকাশ হওয়া” ও “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে এবং আমরা দেখি
কুরআন স্পষ্টভাবে “প্রকাশ করার” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়ার” ব্যাপারে অবকাশ
দিচ্ছে। এ অবকাশকে “প্রকাশ করা”
পর্যন্ত বিস্তৃত করা কুরআনেরও বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেরও বিরোধ যেগুলো থেকে
প্রমাণ হয় যে, নববী যুগে হিজাবের হুকুম এসে যাবার পর মহিলারা মুখে খুলে চলতো না, হিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দাও শামিল ছিল এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য
সব অবস্থায় নেকাবকে মহিলাদের পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিল। তারপর এর চাইতেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই
যে, এ অবকাশের
পক্ষে যুক্তি হিসেবে একথা পেশ করা হয় যে, মুখ ও হাত
মহিলাদের সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ সতর ও হিজাবের মধ্যে যমীন আসমান ফারাক। সতর মুহাররাম পুরুষদের সামনে খোলাও জায়েয নয়। আর হিজাব তো সতরের অতিরিক্ত এটি জিনিস, যাকে নারীদের ও গায়ের
মুহাররাম পুরুষদের মাঝখানে আটকে দেয়া হয়েছে এবং এখানে সতরের নয় বরং হিজাবের
বিধান আলোচ্য বিষয়।
৩৬. জাহেলী যুগে মহিলারা মাথায় এক ধরনের আঁটসাঁট বাঁধন দিতো। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সাথে এর গিরো বাঁধা
থাকতো। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ
খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের ওপরের
দিকে অংশটি পরিষ্কার দেখা যেতো। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। পেছনের দিকে দুটো তিনটে খোঁপা দেখা যেতো। (তাফসীরে কাশ্শাফ, ২য় খণ্ড, ৯০ পৃষ্ঠা, ইবনে কাসীর, ৩য়
খণ্ড ২৮৩-২৮৪ পৃষ্ঠা) এ আয়াত নাযিল হবার পর মুসলমান মহিলাদের মধ্যে ওড়নার প্রচলন
করা হয়। আজকালকার মেয়েদের মতো তাকে
ভাঁজ করে পেঁচিয়ে গলার মালা বানানো এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এটি শরীরে জড়িয়ে মাথা, কোমর, বুক
ইত্যাদি সব ভালোভাবে ঢেকে নেয়া ছিল এর উদ্দেশ্য। মু’মিন মহিলারা কুরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে
একে কার্যকর করে হযরত আয়েশা রা. তার প্রশংসা করে বলেনঃ সূরা নূর নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ
সা. এর মুখ থেকে তা শুনে লোকেরা ঘরে ফিরে আসে এবং নিজেদের স্ত্রী, মেয়ে ও বোনদের আয়াতগুলো শোনায়। আনসারদের মেয়েদের মধ্যে এমন একজনও ছিল না وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ বাক্যাংশ শোনার পর নিজের জায়গায় চুপটি করে বসে
ছিল। প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে আবার
অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেললো। পরদিন ফজরের নামাযের সময় যতগুলো মহিলা মসজিদে
নববীতে হাজির হয়েছিল তাদের সবাই দোপাট্টা ও ওড়ানা পরা ছিল। এ সম্পর্কিত অন্য একটি হাদীসে হযরত আয়েশা রা. আরো
বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেনঃ মহিলারা পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে নিজেদের মোটা কাপড়
বাছাই করে তা দিয়ে ওড়না তৈরী করলেন। (ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ২৮৪ পৃঃ এবং আবু দাউদ, পোশাক অধ্যায়)
ওড়না পাতলা কাপড়ের না হওয়া উচিত। এ বিধানগুলোর মেজাজ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করলে এ বিষয়টি নিজে নিজেই
উপলব্ধি করা যায়। কাজেই আনসারদের মহিলারা হুকুম শুনেই বুঝতে
পেরেছিল কোন্ ধরনের কাপড় দিয়ে ওড়না তৈরী করলে এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। কিন্তু শরীয়াত প্রবর্তক সা. একথাটিকে
শুধুমাত্র লোকদের বোধ ও উপলব্ধির ওপর ছেড়ে দেননি বরং তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা করে
দিয়েছেন। দেহ্ইয়াহ কাল্বী বলেন, নবী সা. এর কাছে মিসরের তৈরী
সূক্ষ্ম মল্মল্ (কাবাতী) এলো। তিনি তা থেকে এক টুকরা আমাকে দিলেন এবং বললেন, এখান থেকে কেটে এক খণ্ড দিয়ে
তোমার নিজের জামা তৈরী করে নাও এবং এক অংশ দিয়ে তোমার স্ত্রীর দোপাট্টা বানিয়ে দাও,
কিন্তু তাকে বলে দেবে تَجْعَلَ تَحْتَهُ ثَوْبًا لاَ يَصِفُهَا এর নিচে যেন আর একটি কাপড়
লাগিয়ে নেয়, যাতে শরীরের গঠন ভেতর থেকে দেখা না যায়।” (আবু দাউদ, পোশাক অধ্যায়)।
৩৭. অর্থাৎ যাদের মধ্য একটি মহিলা তার পূর্ণ সৌন্দর্য ও
সাজসজ্জা সহকারে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে এসব লোক হচ্ছে তারাই। এ জনগোষ্ঠীর বাইরে আত্মীয় বা অনাত্মীয় যে-ই থাক না কেন কোন
নারীর তার সামনে সাজগোজ করে আসা বৈধ নয়। وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا বাক্যে যে হুকুম দেয়া হয়েছিল তার অর্থ এখানে
প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে এভাবে যে, এ সীমিত গোষ্ঠীর বাইরে যারাই আছেন তাদের সামনে নারীর সাজসজ্জা
ইচ্ছাকৃত বা বেপরোয়াভাবে নিজেই প্রকাশ করা উচিত নয়, তবে তার
প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অথবা তার ইচ্ছা ছাড়াই যা প্রকাশ হয়ে যায় অথবা যা গোপন করা
সম্ভব না হয় তা আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য।
৩৮. মূলে اباء শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ শুধু বাপ নয় বরং দাদা ও দাদার বাপ এবং
নানা ও নানার বাপও এর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই একটি মহিলা যেভাবে তার বাপ ও শ্বশুরের সামনে আসতে পারে ঠিক তেমনিভাবে
আসতে পারে তার বাপের ও নানার বাড়ির এসব মুরব্বীদের সামনেও।
৩৯. ছেলের অন্তর্ভুক্ত হবে নাতি, নাতির ছেলে, দৌহিত্র ও দৌহিত্রের ছেলে সবাই। আর এ ব্যাপারে নিজের ও সতীনের মধ্যে কোন ফারাক নেই। নিজের সতীন পুত্রদের সন্তানদের সামনে নারীরা
ঠিক তেমনি স্বাধীনভাবে সাজসজ্জার প্রকাশ করতে পারে যেমন নিজের সন্তানদের ও
সন্তানদের সন্তানদের সামনে করতে পারে।
৪০. ভাইয়ের মধ্যে সহোদর ভাই, বৈমাত্রেয় এবং বৈপিত্রেয় ভাই
সবাই শামিল।
৪১. ভাই-বোনদের ছেলে বলতে তিন ধরনের ভাই-বোনদের সন্তান বুঝানো
হয়েছে। অর্থাৎ তাদের নাতি, নাতির ছেলে এবং দৌহিত্র ও
দোহিত্রের ছেলে সবাই এর অন্তভুক্ত।
৪২. এখানে যেহেতু আত্মীয়দের গোষ্ঠী খতম হয়ে যাচ্ছে তাই সামনের
দিকে অনাত্মীয় লোকদের কথা বলা হচ্ছে। এজন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আগে তিনটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। কারণ এ বিষয়গুলো না বুঝলে বিভিন্ন ধরনের
সমস্যা দেখা দেয়।
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, কেউ কেউ সাজসজ্জা প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেবলমাত্র এমন সব আত্মীয় পর্যন্ত
সীমাবদ্ধ মনে করেন যাদের নাম এখানে উচ্চারণ করা হয়েছে। বাকি সবাইকের এমনকি আপন চাচা ও আপন মামাকে যেসব আত্মীয়দের
থেকে পর্দা করতে হবে তাদের মধ্য গণ্য করেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এদের নাম কুরআনে বলা হয়নি। কিন্তু একথা সঠিক নয়। আপন চাচা ও মামা তো দূরের কথা রাসূলুল্লাহ সা. তো দুধ চাচা
ও দুধ মামা থেকেও পর্দা করতে হযরত আয়েশাকে অনুমতি দেননি। সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা বর্ণিত একটি
হাদীসে বলা হয়েছেঃ আবুল কু’আইসের ভাই আফ্লাহ তাঁর কাছে এলেন এবং ভেতর প্রবেশের
অনুমতি চাইলেন। যেহেতু তখন পর্দার হুকুম
নাযিল হয়ে গিয়েছিল, তাই হযরত আয়েশা অনুমতি দিলেন না। তিনি বলেন পাঠালেন, তুমি তো আমার ভাইঝি, কারণ
তুমি আমার ভাই আবুল কু’আইসের স্ত্রীর দুধ পান করেছো। কিন্তু এ সম্পর্কটা কি এমন পর্যায়ের যেখানে পর্দা উঠিয়ে
দেয়া জায়েয এ ব্যাপারে হযরত আয়েশা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ইত্যবসরে নবী সা. এসে গেলেন। তিনি বললেন, সে তোমার কাছে আসতে পারে। এ থেকে জানা যায়, নবী সা. নিজেই এ আয়াতকে এ
অর্থে নেননি যে, এর মধ্যে যেসব আত্মীয়ের কথা বলা হয়েছে কেবল
তাদের থেকে পর্দা করা হবে না এবং বাকি সবার থেকে পর্দা করা হবে। বরং তিনি এ থেকে নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, যেসব আত্মীয়ের সাথে একটি মেয়ের
বিয়ে হারাম তারা সবাই এ আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন চাচা, মামা, জামাতা ও দুধ
সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন। তাবে’ঈদের মধ্যে হযরত হাসান বসরীও এ মত প্রকাশ করেছেন এবং আল্লাম আবু বকর
জাস্সাস আহকামুল কুরআনে এর প্রতিই সমর্থন জানিয়েছেন। (৩য় খণ্ড, ৩৯০ পৃষ্ঠা)
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, যেসব আত্মীয়ের সাথে চিরন্তন হারামের সম্পর্ক নয় (অর্থাৎ যাদের সাথে একজন
কুমারী বা বিধবার বিয়ে বৈধ) তারা মুহাররাম আত্মীয়দের অন্তর্ভুক্ত নয়। মেয়েরা নিসংকোছে সাজসজ্জা করে তাদের সামনে
আসবে না। আবার একেবারে অনাত্মীয়
অপরিচিতদের মতো তাদের থেকে তেমনি পূর্ণ পর্দাও করবে না যেমন ভিন পুরুষদের থেকে করে। এ দুই প্রান্তিকতার মাঝামাঝি কি দৃষ্টিভংগী
হওয়া উচিত তা শরীয়াতে নির্ধারিত নেই। কারণ এটা নির্ধারিত হতে পারে না। এর সীমানা বিভিন্ন আত্মীয়ের ব্যাপারে তাদের আত্মীয়তা, বয়স, পারিবারিক
সম্পর্ক ও সম্বন্ধ এবং উভয়পক্ষের অবস্থার (যেমন এক গৃহে বা আলাদা আলাদা বাস করা)
প্রেক্ষিতে অবশ্যি বিভিন্ন হবে এবং হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে নবী সা. এর নিজের নিয়ম ও কর্মপদ্ধতি যা কিছু
ছিল তা থেকে আমরা এ দিকনির্দেশনাই পাই। হযরত আসরা বিনতে আবু বকর ছিলেন নবী সা. এর শ্যালিকা। বহু হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি রসূলের সা. সামনে আসতেন
এবং শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর ও নবী সা. এর মধ্যে কমপক্ষে চেহারা ও হাতের ক্ষেত্রে কোন
পর্দা ছিল না।
বিদায় হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় নবীর সা. ইন্তিকালের মাত্র কয়েক মাস আগে এবং সে সময় এ
অবস্থাই বিরাজিত ছিল (দেখুন আবু দাউদ, হজ্জ অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ
মুহাররাম তার গোলামকে আদব শিক্ষা দেবে)। অনুরূপভাবে হযরত উম্মেহানী ছিলে আবু তালেবের মেয়ে ও নবী সা.
এর চাচাতে বোন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত
তিনি নবী করীমের সা. সামনে আসতেন এবং কমপক্ষে তাঁর সামনে কখনো নিজের মুখ ও চেহারার
পর্দা করেননি। মক্কা বিজয়ের সময়ের একটি
ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। এ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। (দেখুন আবু দাউদ, কিতাবুস সওম, বাবুন ফীন নীয়্যাত ফিস সওমে ওয়ার
রূখসাতে ফকীহ।)
অন্যদিক আমরা দেখি, হযরত আব্বাস তাঁর ছেলে ফযলকে এবং বারী’আহ ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালিব
(নবী সা. এর আপন চাচাত ভাই) তাঁর ছেলে আবদুল মুত্তালিবকে নবী সা. এর কাছে এ বলে
পাঠালেন যে, এখন তোমরা যুবক হয়ে গেছো, তোমরা
রোজাগারের ব্যবস্থা করতে না পারলে তোমাদের বিয়ে হতে পারে না, কাজেই তোমরা রসূলের সা. কাছে গিয়ে কোন চাকরির দরখাস্ত করো। তারা দু’জন হযরত যয়নবের গৃহে গিয়ে রাসূলুল্লাহর
খিদমতে হাযির হলেন। হযরত যয়নব ছিলেন ফযলের আপন
ফুপাত বোন আর আবদুল মুত্তালিব ইবনে রাবী’আর বাপের সাথেও তাঁর ফযলের সাথে যেমন
তেমনি আত্মীয় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি তাদের দু’জনের সামনে হাযির হলেন না এবং রসূলের সা. উপস্থিতিতে
পর্দার পেছন থেকে তাদের সাথে কথা বলতে থাকলেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল খারাজ) এ দু’ধরনের ঘটনাবলী মিলিয়ে
দেখলে ওপরে আমি যা বর্ণনা করে এসেছি বিষয়টির সে চেহারাই বোধগম্য হবে।
তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, যেখানে আত্মীয়তা সন্দেহপূর্ণ হয়ে যায় সেখানে মুহাররাম আত্মীয়দের থেকেও
সতর্কতা হিসেবে পর্দা করা উচিত। বুখারী, মুসলিম ও আবুদ দাউদে উদ্ধৃত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন
হযরত সওদার রা. এক ভাই ছিল বাঁদিপুত্র (অর্থাৎ তাঁর পিতার ক্রীতদাসীর গর্ভজাত ছিল)। তাঁর সম্পর্ক হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসকে রা.
তাঁর ভাই উত্বা এ মর্মে অসীয়াত করেন যে, এ ছেলেকে নিজের ভাতিজা মনে করে তার
অভিভাবকত্ব করবে কারণ সে আসলে আমার ওরসজাত। এ মামলাটি নবী সা. এর কাছে এলো। তিনি হযরত সাদের দাবী এই বলে নাকচ করে দিলেন যে, “যার বিছানায় সন্তানের জন্ম
হয়েছে সে-ই সন্তানের পিতা। আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর।” কিন্তু সাথে সাথেই তিনি হযরত সওদাকে বলে দিলেন, এ ছেলেটি থেকে পর্দা করবে (احتجبى منه) কারণ সে যে সত্যিই তার ভাই এ ব্যাপারে
নিঃসন্দেহ হওয়া যায়নি।
৪৩. মূলে نِسَائِهِنَّ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে, “তাদের মহিলারা” এখানে কোন্
মহিলাদের কথা বলা হয়েছে সে বির্তকে পরে আসা যাবে। এখন সবার আগে যে কথাটি উল্লেখযোগ্য এবং যেদিকে দৃষ্টি দেয়া
উচিত সেটি হচ্ছে, এখানে নিছক “মহিলারা” (النساء) বলা হয়নি, যার ফলে মুসলমান মহিলার জন্য সমস্ত
মহিলাদের এবং সব ধরনের মেয়েদের সামনে বেপর্দা হওয়া ও সাজসজ্জা প্রকাশ করা জায়েয
হয়ে যেতো। বরং نسائهن বলে মহিলাদের সাথে তার
স্বাধীনতাকে সর্বাবস্থায় একটি বিশেষ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। সে গণ্ডীর যে কোন পর্যায়েরই হোক না কেন তাতে
কিছু আসে যায় না। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, এটা কোন্ গণ্ডী এবং সে
মহিলারাই বা কারা যাদের ওপর نِسَاءهِنَّ শব্দ
প্রযুক্ত হয়? এর জবাব হচ্ছে, এ ব্যাপারে ফকীহ ও মুফাসসিরগণের
উক্তি বিভিন্নঃ
একটি দল বলেন, এখানে কেবলমাত্র মুসলমান মেয়েদের কথা বলা হয়েছে। যিম্মী বা অন্য যে কোন ধরনের অমুসলিম মেয়েরাই
হোক না কোন মুসলমান মেয়েদেরকে তাদের থেকে পুরুষদের থেকে যেমন করা হয় তেমনি পর্দা
করা উচিত। ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও জুরাইজ এ মত পোষণ
করেন। এরাঁ নিজেদের সমর্থনে এ
ঘটনাটিও পেশ করে থাকেন যে, হযরত উমর রা. হযরত আবু উবাইদাহকে লেখেন, “আমি শুনেছি
কিছু কিছু মুসলিম নারী অমুসলিম নারীদের সাথে হাম্মামে যাওয়া শুরু করেছেন। অথচ যে নারী আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান
রাখে তার জন্য তার শরীরের ওপর তার মিল্লাতের অন্তর্ভুক্তদের ছাড়া অন্য কারোর
দৃষ্টি পড়া হালাল নয়।” এ
পত্র যখন হযরত আবু উবাইদাহ পান তখন তিনি হঠাৎ ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং বলতে থাকেন, “হে আল্লাহ! যে সব মুসলমান
মহিলা নিছক ফর্সা হবার জন্য এসব হাম্মামে যায় তাদের মুখ যেন আখেরাতে কালো হয়ে যায়।” (ইবনে জারীর, বায়হাকী ও ইবনে কাসীর)
দ্বিতীয় দলটি বলেন, এখানে সব নারীদের কথা বলা হয়েছে। ইমাম রাযীর দৃষ্টিতে এ মতটিই সঠিক। কিন্তু একথা বোধগম্য নয় যে, যদি সত্যিই আল্লাহর উদ্দেশ্য
এটিই হয়ে থাকে তাহলে আবার نساءهن বলার অর্থ কি? এ অবস্থায় তো শুধু النساء বলা উচিত ছিল।
তৃতীয় মতটিই যুক্তিসঙ্গত এবং কুরআনের শব্দের নিকটতরও। সেটি হচ্ছে, যেসব নারীদের সাথে তারা মেলামেশা করে,
যাদের সাথে তাদের জানাশোনা আছে, যাদের সাথে
তারা সম্পর্কে রাখে এবং যারা তাদের কাজে-কর্মে অংশ নেয় তাদের কথা এখানে বলা হয়েছে। তারা মুসলিমও হতে পারে আবার অমুসলিমও। অপরিচিত মহিলাদের যাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণের অবস্থা জানা নেই
অথবা যাদের বাইরের অবস্থা সন্দেহজনক এবং যারা নির্ভরযোগ্য নয়, তাদেরকে এ গণ্ডীর বাইরে রাখাই এর উদ্দেশ্য। কিছু সহীহ হাদীস থেকে এ মতের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীসগুলোতে নবী সা. এর পবিত্র স্ত্রীদের কাছে
যিম্মি মহিলাদের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে যে আসল জিনিসটির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হবে সেটি
ধর্মীয় বিভিন্নতা নয় বরং নৈতিক অবস্থা। অমুসলিম হলেও পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য পরিবারের ভদ্র, লজ্জাশীলা ও সদাচারী মহিলাদের
সাথে মুসলিম মহিলারা পুরোপুরি নিঃসংকোচে মেলামেশা করতে পারে। কিন্তু মুসলমান মেয়েরাও যদি বেহায়া, বেপর্দা ও অসদাচারী হয় তাহলে
প্রত্যেক শরীফ ও ভদ্র পরিবারের মহিলার তাদের থেকে পর্দা করা উচিত। কারণ নৈতিকতার জন্য তাদের সাহচার্য ভিন্
পুরুষদের সাহচর্যের তুলনায় কম ক্ষতিকর নয়। আর অপরিচিত মহিলারা যাদের অবস্থা জানা নেই, তাদের সাথে মেলামেশা করার
সীমানা আমাদের মতে গায়ের মুহাররাম আত্মীয়দের সামনে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার
সর্বাধিক সীমানার সমপরিমাণ হতে পারে। অর্থাৎ তাদের সামনে মহিলারা কেবলমাত্র মুখ ও হাত খুলতে
পারে, বাকি সারা
শরীর ও অংগসজ্জা ঢেকে রাখতে হবে।
৪৪. এ নির্দেশটির অর্থ বুঝার ব্যাপারেও ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ
হয়েছে। একটি দল এর অর্থ করেছেন এমন
সব বাঁদী যারা কোন মহিলার মালিকানাধীন আছে। তাদের মতে, আল্লাহর উক্তির অর্থ হচ্ছে, বাঁদী মুশরিক বা আহলি কিতাব যে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন মুসলিম মহিলা
মালিক তার সামনে তো সাজসজ্জা প্রকাশ করতে পারে কিন্তু মহিলার নিজেরই মালিকানাধীন
গোলামের থেকেও পর্দা করার ব্যাপারটি অপরিচিত স্বাধীন পুরুষের থেকে পর্দার
সমপর্যায়ের। এটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., মুজাহিদ, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন, সা’ঈদ
ইবনে মুসাইইব, তাউস ও ইমাম আবু হানীফার মত। ইমাম শাফেঈ’র একটি উক্তিও এর সমর্থনে পাওয়া
যায়। এ মনীষীদের যুক্তি হচ্ছে, গোলামের জন্য তার মহিলা মালিক
মুহাররাম নয়।
যদি সে স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে তার আগের মহিলা মালিককে বিয়েও করতে পারে। কাজেই নিছক গোলামী এমন কোন কারণ হতে পারে না
যার ফলে মহিলারা তাদের সামনে এমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে যার অনুমতি মুহাররাম
পুরুষদের সামনে চলাফেরা করার জন্য দেয়া হয়েছে। এখন বাকী থাকে এ প্রশ্নটি যে, مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ শব্দাবলী ব্যাপক অর্থবোধক, গোলাম ও বাঁদী উভয়ের জন্য
ব্যবহার হয়, তাহলে আবার বিশেষভাবে বাঁদীদের জন্য একে ব্যবহার
করার যুক্তি কি? এর জবাব তারা এভাবে দেন যে, এ শব্দাবলী যদিও ব্যাপক অর্থবোধক তবুও পরিবেশ ও পরিস্থিতি এগুলোর অর্থকে
মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ করছে। প্রথমে نساءهن বলা হয় তারপর বলা হয় مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ প্রথমে نساءهن শব্দ শুনে সাধারণ মানুষ মনে
করতে পারতো এখানে এমন নারীদের কথা বলা হয়েছে যারা কোন নারীর পরিচিত মহলের বা
আত্মীয়-স্বজনদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ থেকে হয়তো বাঁদীরা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, এ ভুলধারণা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ বলে দিয়ে একথা পরিষ্কার করে
দেয়া হয়েছে যে, স্বাধীন মেয়েদের মতো বাঁদীদের সামনেও সাজসজ্জার প্রদর্শনী করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় দলের মতে এ অনুমতিতে বাঁদী ও গোলাম উভয়েই রয়েছে। এটি হযরত আয়েশা রা. ও হযরত উম্মে সালামাহ রা. ও অন্য কতিপয়
আহলে বায়েত ইমামের অভিমত।
ইমাম শাফে’ঈর একটি বিখ্যাত উক্তিও এর সপক্ষে রয়েছে। তাদের যুক্তি শুধুমাত্র مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ এর ব্যাপক অর্থ থেকে নয় বরং তারা সুন্নাতে রাসূল
থেকেও এর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করেন। যেমন এ ঘটনাটিঃ নবী সা. আবদুল্লাহ ইবনে মাস্আদাতিল ফাযারী নামক এক গোলামকে
নিয়ে হযরত ফাতেমার বাড়িতে গেলেন। তিনি সে সময় এমন একটি চাদর গায়ে দিয়ে ছিলেন যা দিয়ে মাথা ঢাকতে গেলে পা খুলে
যেতো এবং পা ঢাকতে গেলে মাথা খুলে যেতো। নবী সা. তাঁর হতবিহবল ভাব দেখে বললেন, ليس عليك باس انما هو ابوك وغلامك “কোন দোষ নেই, এখানে
আছে তোমার বাপ ও তোমার গোলাম।” (আবু দাউদ, আহমাদ ও বায়হাকী আনাস ইবনে মালেকের উদ্ধৃতি থেকে। ইবনে আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, নবী সা. হযরত ফতেমাকে এ
গোলামটি দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একে লালন-পালন করেছিলেন এবং তারপর মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ উপকারের প্রতিদান সে এভাবে দিয়েছিলেন
যে, সিফফীনের
যুদ্ধের সময় হযরত আলীর প্রতি চরম শত্রুতার প্রকাশ ঘটিয়ে আমীর মু’আবিয়ার একান্ত
সমর্থকে পরিণত হয়েছিল।) অনুরূপভাবে তারা নবী সা. এর এ উক্তিটি থেকেও যুক্তি প্রদর্শন করেন-
اذا كان لاحد اكن مكاتب وكان له ما يودى فلتحتجب منه
“যখন তোমাদের কেউ তার গোলামের সাথে “মুকাতাবত” তথা অর্থ আদায়ের বিনিময়ে
মুক্তি দেবার লিখিত চুক্তি করে এবং চুক্তিকৃত অর্থ আদায় করার ক্ষমতা রাখে তখন তার
সে গোলাম থেকে পর্দা করা উচিত।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ উম্মে সালামার রেওয়ায়াত থেকে।)
৪৫. মূলে التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ শব্দাবলী বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “পুরুষদের মধ্য থেকে এমন সব পুরুষ যারা
অনুগত, কামনা রাখে না।” এ শব্দগুলো থেকে প্রকাশ হয়, মুহাররাম পুরুষদের ছাড়া অন্য
কোন পুরুষের সামনে একজন মুসলমান মহিলা কেবলমাত্র এমন অবস্থায় সাজসজ্জার প্রকাশ
করতে পারে, যখন তার মধ্যে দু’টি গুণ পাওয়া যায়, এক, সে অনুগত অর্থাৎ অধীনস্থ ও কর্তৃত্বের অধীন। দুই, তার মধ্যে কামনা নেই। অর্থাৎ নিজের বয়স, শারীরিক অসামর্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা, দারিদ্র ও অর্থহীনতা অথবা
অন্যের পদানত হওয়া ও গোলামীর কারণে তার মনে গৃহকর্তার স্ত্রী, মেয়ে, বোন বা মা সম্পর্কে কোন কুসংকল্প সৃষ্টি হবার
শক্তি বা সাহস থাকে না। এ হুকুমকে যে ব্যক্তিই নাফরমানীর অবকাশ অনুসন্ধানের নিয়তে নয় বরং আনুগত্য
করার নিয়তে পড়বে সে প্রথম দৃষ্টিতেই অনুভব করবে যে, আজকালকার বেয়ারা, খানসাম, শোফার ও অন্যান্য যুবক কর্মচারীরা অবশ্য এ
সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হবে না। মুফাস্সির ও ফকীহগণ এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তার ওপর একবার নজর বুলালে জ্ঞানী ও
বিশেষজ্ঞগণ এ শব্দগুলোর কি অর্থ বুঝেছেন তা জানা যেতে পারেঃ
ইবনে আব্বাসঃ এর
অর্থ হচ্ছে এমন সব সাদাসিধে বোকা ধরনের লোক যারা মহিলাদের ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
কাতাদাহঃ এমন পদানত ব্যক্তি যে নিজের
পেটের খাবার যোগাবার জন্য তোমার পেছনে পড়ে থাকে।
মুজাহিদঃ এমন লোক যে
ভাত চায়, মেয়েলোক চায় না।
শা’বীঃ
যে ব্যক্তি কোন পরিবারের সাথে লেগে
থাকে। এমনকি তাদের ঘরের লোকে
পরিণত হয় এবং সে পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়। ঘরের মেয়েদের প্রতি সে নজর দেয় না এবং এ ধরনের নজর দেবার
হিম্মতই করতে পারে না।
পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই সে তাদের সাথে লেগে থাকে।
তাউস ও যুহ্রীঃ নির্বোধ ব্যক্তি, যার মধ্যে মেয়েদের প্রতি উৎসাহ
নেই এবং এর হিম্মতও নেই।
(ইবনে জারীর, ১৮ খণ্ড, ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠা এবং ইবনে আসীর, ৩য় খণ্ড, ২৮৫ পৃষ্ঠা)
এ ব্যাখ্যাগুলোর চাইতেও বেশী স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। এটি ঘটেছিল নবী সা. এর জামানায়। বুখারী, মুসলিম আবু দাউদ, নাসাঈ
ও আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এটি হযরত আয়েশা রা. ও উম্মে সালামাহ রা. থেকে রেওয়ায়াত
করেছেন। ঘটনাটি হচ্ছেঃ মদীনা
তাইয়েবায় ছিল এক নপুংশক হিজড়ে। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণ ও অন্য মহিলারা তাকে غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ এর মধ্যে গণ্য করে নিজেদের কাছে আসতে দিতেন। একদিন নবী সা. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে
সালামাহর কাছে গেলেন।
সেখানে তিনি তাকে উম্মে সালামার রা. ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়ার সাথে কথা বলতে
শুনলেন। সে বলছিল, কাল যদি তায়েফ জয় হয়ে যায়,
তাহলে আপনি গাইলান সাকাফির মেয়ে বাদীয়াকে না নিয়ে ক্ষান্ত হবেন না। তারপর সে বাদীয়ার সৌন্দর্য ও তার দেহ সৌষ্ঠবের
প্রশংসা করতে থাকলো এমনকি তার গোপন অংগগুলোর প্রশংসামূলক বর্ণনাও দিলে দিল। নবী সা. তা কথা শুনে বললেন, “ওরে আল্লার দুশমন! তুই তো
তাকে খুবই লক্ষ্য করে দেখেছিস বলে মনে হয়।” তারপর তিনি হুকুম দিলেন, তার সাথে পর্দা করো এবং
ভবিষ্যতে যেন সে গৃহে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর তিনি তাকে মদীনা থেকে বের করে দিলেন এবং অন্যান্য
নপুংশক পুরুষদেরকেও অন্যের গৃহে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করে দিলেন। কারণ তাদেরকে নপুংশক মনে করে মেয়েরা তাদের
সামনে সতর্কতা অবলম্বন করতো না এবং তারা এক ঘরের মেয়েদের অবস্থা অন্য ঘরের
পুরুষদের কাছে বর্ণনা করতো। এ থেকে জানা যায়, কারো غَيْرِ
أُولِي الْإِرْبَةِ (কামনাহীন) হবার জন্য কেবলমাত্র এতটকুই
যথেষ্ট নয় যে, সে শারীরিক দিক দিয়ে ব্যভিচার করতে সমর্থ নয়। যদি তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন যৌন কামনা থেকে থাকে
এবং সে মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয় তাহলে অবশ্যি সে অনেক রকমের বিপদের কারণ
হতে পারে।
৪৬. অর্থাৎ যাদের মধ্যে এখনো যৌন কামনা সৃষ্টি হয়নি। বড় জোর দশ-বারো বছরের ছেলেদের ব্যাপারে একথা
বলা যেতে পারে। এর বেশী বয়সের ছেলেরা
অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও তাদের মধ্যে যৌন কামনার উন্মেষ হতে থাকে।
৪৭. নবী সা. এ হুকুমটিকে কেবলমাত্র অলংকারের ঝংকারের মধ্যে
সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং এ থেকে এ নীতি নির্ধারণ
করেছেন যে, দৃষ্টি ছাড়া অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে উত্তেজিতকারী জিনিসগুলোও আল্লাহ
তা’আলা মহিলাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যের প্রকাশনী করতে নিষেধ করেছেন
তার বিরোধী। তাই তিনি মহিলাদেরকে খোশ্বু
লাগিয়ে বাইরে বের না হবার হুকুম দিয়েছেন। হযরত আবু হুরাইরার রা. রেওয়ায়াত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ
لاَ تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللَّهِ مَسَاجِدَ اللَّهِ
وَلَكِنْ لِيَخْرُجْنَ وَهُنَّ تَفِلاَتٌ
“আল্লাহর দাসীদেরকে আল্লাহর মসজিদে আসতে নিষেধ করো না। কিন্তু তারা যেন খোশবু লাগিয়ে না আসে।” (আবু দাউদ ও আহমাদ) একই বক্তব্য সম্বলিত অন্য
একটি হাদীসে বলা হয়েছে, একটি মেয়েটি মসজিদ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। হযরত আবু হুরাইরা রা. তার পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। তিনি অনুভব করলেন মেয়েটি খোশ্বু মেখেছে। তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর
দাসী! তুমি কি মসজিদ থেকে আসছো? সে বললো হ্যাঁ? বললেন ‘আমি আমার প্রিয় আবুল কাসেম সা.কে বলতে শুনেছি, যে মেয়ে মসজিদে খোশবু মেখে আসে তার নামায ততক্ষণ কবুল হয় না যতক্ষণ না সে
বাড়ি ফিরে ফরয গোসলের মত গোসল করে।” (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ
নাসাঈ)। আবু মূসা আশআরী বলেন, নবী সা. বলেছেনঃ
إِذَا اسْتَعْطَرَتِ الْمَرْأَةُ فَمَرَّتْ عَلَى الْقَوْمِ
لِيَجِدُوا رِيحَهَا فَهِىَ كَذَا وَكَذَا قَالَ قَوْلاً شَدِيدًا
“যে নারী আতর মেখে পথ দিয়ে যায়, যাতে লোকেরা তার
সুবাসে বিমোহিত হয়, সে এমন ও এমন। তিনি তার জন্য খুবই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)
তাঁর নির্দেশ ছিল, মেয়েদের এমন খোশ্বু ব্যবহার করা উচিত,
যার রং প্রগাঢ় কিন্তু সুবাস হাল্কা। (আবু দাউদ)
অনুরূপভাবে নারীরা প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের আওয়াজ পুরুষদেরকে শোনাবে এটাও তিনি
অপছন্দ করতেন। প্রয়োজনে কথা বলার অনুমতি
কুরআনেই দেয়া হয়েছে এবং নবী সা. এর পবিত্র স্ত্রীগণ নিজেরাই লোকদেরকে দ্বীনী
মাসায়েল বর্ণনা করতেন।
কিন্তু যেখানে এর কোন প্রয়োজন নেই এবং কোন দ্বীনী বা নৈতিক লাভও নেই সেখানে
মহিলারা নিজেদের আওয়াজ ভিন্ পুরুষদেরকে শুনাবে, এটা পছন্দ করা হয়নি। কাজেই নামাযে যদি ইমাম ভুলে যান তাহলে
পুরুষদের সুবহানাল্লাহ বলার হুকুম দেয়া হয়েছে কিন্তু মেয়েদেরকে এক হাতের ওপর অন্য
হাত মেরে ইমামকে সতর্ক করে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। التَّسْبِيحُ لِلرِّجَالِ وَالتَّصْفِيقُ لِلنِّسَاءِ (বুখারী, মুসলিম,
আহমাদ, তিরমিযী, আবু
দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)।
৪৮. অর্থাৎ এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি তোমরা
করেছো তা থেকে তাওবা করো এবং ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব নির্দেশ
দিয়েছেন সে অনুযায়ী নিজেদের কর্মপদ্ধতি সংশোধন করে নাও।
৪৯. প্রসঙ্গত এ বিধানগুলো নাযিল হবার পর কুরআনের মর্মবাণী
অনুযায়ী নবী সা. ইসলামী সমাজে অন্য যেসব সংস্কারমূলক বিধানের প্রচলন করেন সেগুলোর
একটি সংক্ষিপ্তসারও এখানে বর্ণনা করা সঙ্গত মনে করছিঃ
একঃ মুহাররাম আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে তিনি অন্য লোকদেরকে
(আত্মীয় হলেও) কোন মেয়ের সাথে একাকী সাক্ষাত করতে ও তার কাছে নির্জনে বসতে নিষেধ
করেছেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর
রেওয়ায়াত হচ্ছে, নবী করীম সা. বলেছেনঃ
لاَ تَلِجُوا عَلَى الْمُغِيبَاتِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ
يَجْرِى مِنْ أَحَدِكُمْ مَجْرَى الدَّمِ
“যেসব নারীর স্বামী বাইরে গেছে তাদের কাছে যেয়ো না। কারণ শয়তান তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের রক্ত
ধারায় আবর্তন করছে।” (তিরমিযী) হযরত জাবের থেকে
অন্য একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাতে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ
فَلاَ يَخْلُوَنَّ بِامْرَأَةٍ لَيْسَ مَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ مِنْهَا فَإِنَّ ثَالِثَهُمَا
الشَّيْطَانُ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কখনো কোন
মেয়ের সাথে নির্জনে সাক্ষাত না করে যতক্ষণ না ঐ মেয়ের কোন মুহাররাম তার সাথে থাকে। কারণ সে সময় তৃতীয়জন থাকে শয়তান।” (আহমাদ)
প্রায় এ একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত তৃতীয় একটি হাদীস ইমাম আহমাদ আমের ইবনে
রাবীআহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর সা. নিজের সতর্কতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একবার রাতের বেলা তিনি হযরত
সাফিয়ার সাথে তাঁর গৃহের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে দু’জন আনসারী তাঁর পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তাদেরকে থামিয়ে বললেন, আমার সাথের এ মহিলা হচ্ছে আমার
স্ত্রী সাফিয়া।
তারা বললেন, সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সম্পর্কেও কি কোন কুধারণা হতে পারে?
বললেন, শয়তান মানুষের মধ্যে রক্তের মতো চলাচল
করে। আমার আশঙ্কা হলো সে আবার
তোমাদের মনে কোন কুধারণা সৃষ্টি না করে বসে। (আবু দাউদ, সওম অধ্যায়)।
দুইঃ কোন পুরুষের হাত কোন গায়ের মুহাররাম মেয়ের গায়ে লাগুক এটাও
তিনি বৈধ করেননি। তাই তিনি পুরুষদের হাতে হাত
রেখে বাই’আত করতেন। কিন্তু মেয়েদের বাই’আত
নেবার সময় কখনো এ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না। হযরত আয়েশা রা. বলেন, “নবী সা. এর হাত কখনো কোন ভিন্ মেয়ের শরীরে
লাগেনি। তিনি মেয়েদের থেকে
শুধুমাত্র মৌখিক শপথ নিতেন এবং শপথ নেয়া শেষ হলে বলতেন, যাও তোমাদের বাই’আত হয়ে গেছে।” (আবু দাউদ, কিতাবুল খারাজ)।
তিনঃ তিনি মেয়েদের মুহাররাম ছাড়া একাকী অথবা গায়ের মুহাররামের
সাথে সফর করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। বুখারী ও মুসলিম ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. খুতবায় বলেনঃ
لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ وَمَعَهَا
ذُو مَحْرَمٍ وَلاَ تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلاَّ مَعَ ذِى مَحْرَمٍ
“কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাত না করে যতক্ষণ তার সাথে
তার মুহাররাম না থাকে এবং কোন মহিলা যেন সফর না করে যতক্ষণ না তার কোন মুহাররাম
তার সাথে থাকে।”
এক ব্যক্তি উঠে বললো, আমার স্ত্রী হজ্জে যাচ্ছে এবং আমার নাম অমুক অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের
মধ্যে লেখা হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ
সা. বললেন, فانطلق فحج مع امرأتك “বেশ, তুমি তোমার
স্ত্রীর সাথে হজ্জে চলে যাও।” এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বহু হাদীস ইবনে উমর, আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরা রা. থেকে
নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোতে শুধুমাত্র সফরের সময়সীমা অথবা সফরের দূরত্বের
ক্ষেত্রে বিভিন্নতা আছে কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী
মু’মিন মহিলার পক্ষে মুহাররাম ছাড়া সফর করা বৈধ নয়। এর মধ্যে কোন হাদীসে ১২ মাইল বা এর চেয়ে বেশী দূরত্বের
সফরের ওপর বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে। কোনটিতে একদিন, কোনটিত এক দিন এক রাত, কোনটিতে দু’দিন আবার কোনটিতে
তিন দিনের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিভিন্নতা এ হাদীসগুলোর নির্ভরযোগ্যতা খতম করে
দেয় না এবং এ কারণে এর মধ্য থেকে কোন একটি হাদীসকে অন্য সব হাদীসের ওপর প্রাধান্য
দিয়ে এ হাদীসে বর্ণিত সীমারেখাকে আইনগত পরিমাপ গণ্য করার চেষ্টা করাও আমাদের জন্য
অপরিহার্য হয় না। কারণ এ বিভিন্নতার একটি
যুক্তিসঙ্গত কারণ বোধগম্য হতে পারে। অর্থাৎ বিভিন্ন সময় ঘটনার যেমন অবস্থা রসূলের রা. সামনে এসেছে সে অনুযায়ী
তিনি তার হুকুম বর্ণনা করেছেন। যেমন কোন মহিলা যাচ্ছেন তিন দিনের দূরত্বের সফরে এবং এক্ষেত্রে তিনি মুহাররাম
ছাড়া তাকে যেতে নিষেধ করেছেন। আবার কেউ এক দিনের দূরত্বের সফরে যাচ্ছেন এবং তিনি তাকেও থামিয়ে দিয়েছেন। এখানে বিভিন্ন প্রশ্নকারীর বিভিন্ন অবস্থা এবং
তাদের প্রত্যেককে তাঁর পৃথক পৃথক জবাব আসল জিনিস নয়। বরং আসল জিনিস হচ্ছে ওপরে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতে যে নিয়ম
বর্ণনা করা হয়েছে সেটি।
অর্থাৎ সফর, সাধারণ পরিভাষায় যাকে সফর বলা হয় কোন মেয়ের মুহাররাম ছাড়া এ ধরনের সফর করা
উচিত নয়।
চারঃ রাসূলুল্লাহ সা. মৌখিকভাবে এবং কার্যতও নারী ও পুরুষের
মেলামেশা রোধ করার প্রচেষ্ট চালান। ইসলামী জীবনে জুম’আ ও জামা’আতের গুরুত্ব কোন ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির
অজানা নয়। জুম্আকে আল্লাহ নিজেই ফরয
করেছেন। আর জামা’আতের সাথে নামায
পড়ার গুরুত্ব এ থেকেই অনুধাবন করা যেতে পারে যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন প্রকার
অক্ষমতা ছাড়াই মসজিদে হাজির না হয়ে নিজ গৃহে নামায পড়ে নেয় তাহলে নবী সা. এর উক্তি
অনুযায়ী তার নামায গৃহীতই হয় না। আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারুকুত্নী ও হাকেম ইবনে
আব্বাসের রেওয়ায়াতের মাধ্যমে) কিন্তু নবী সা. জুম্আর নামায ফরয হওয়া থেকে
মেয়েদেরকে বাদ রেখেছেন। (আবু দাউদ উম্মে আতীয়্যার রেওয়ায়াতের মাধ্যমে দারুকুত্নী ও বাইহাকী জাবেরের
রেওয়ায়াতের মাধ্যমে এবং আবু দাউদ ও হাকেম তারেক ইবনে শিহাবের রেওয়ায়াতের মাধ্যমে)
আর জামা’আতের সাথে নামাযে শরিক হওয়াকে মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক তো করেনইনি। বরং এর অনুমতি দিয়েছেন এভাবে যে, যদি তারা আসতে চায় তাহলে
তাদেরকে বাধা দিয়ো না। তারপর এ সাথে একথাও বলে দিয়েছেন যে, তাদের জন্য ঘরের নামায মসজিদের নামাযের
চেয়ে ভালো। ইবনে উমর রা. ও আবু
হুরাইরার রা. রেওয়ায়াত হচ্ছে, নবী করীম সা. বলেছেনঃ لاَ تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللَّهِ
مَسَاجِدَ اللَّهِ “আল্লাহর দাসীদেরকে আল্লাহ মসজিদে যেতে বাধা
দিয়ো না।” (আবু দাউদ) অন্য
রেওয়ায়াতগুলো বর্ণিত হয়েছে ইবনে উমর থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী এবং এর সাথে
সামঞ্জস্যশীল শব্দাবলি সহকারেঃ
ائْذَنُوا لِلنِّسَاءِ إِلَى الْمَسَاجِدِ بِاللَّيْلِ
“মহিলাদেরকে রাতের বেলা মসজিদে আসার অনুমতি দাও।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী,
নাসাঈ, আবু দাউদ)
অন্য একটি রেওয়ায়াতের শব্দাবলি হচ্ছেঃ
لاَ تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ وَبُيُوتُهُنَّ
خَيْرٌ لَهُنَّ
“তোমাদের নারীদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না, তবে
তাদের ঘর তাদের জন্য ভালো।” (আহমাদ, আবু দাউদ)
উম্মে হুমাইদ সায়েদীয়া বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পেছনে নামায পড়তে আমার
খুবই ইচ্ছা হয়। তিনি বললেন, “তোমার নিজের কামরায় নামায পড়া
বারান্দায় নামায পড়ার চাইতে ভালো, তোমার নিজের ঘরে নামায পড়া
নিজের মহল্লার মসিজদে নামায পড়ার চাইতে ভালো এবং তোমার মহল্লার মসজিদে নামায পড়া
জামে মসজিদে নামায পড়ার চেয়ে ভালো।” (আহমাদ ও তাবারানী) প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত
হাদীস আবু দাউদে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর হযরত উম্মে সালামার রা. রেওয়ায়াতে নবী সা. এর শব্দাবলী
হচ্ছেঃ خَيْرُ مَسَاجِدِ النِّسَاءِ
قَعْرُ بُيُوتِهِنَّ “মহিলাদের জন্য তাদের ঘরের
অভ্যন্তর ভাগ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মসজিদ।” (আহমদ, তাবারানী) কিন্তু হযরত আয়েশা রা. বনী উমাইয়া আমলের অবস্থা
দেখে বলেন, “যদি নবী সা. নারীদের আজকের অবস্থা দেখতেন তাহলে
তাদের মসজিদে আসা ঠিক তেমনিভাবে বন্ধ করতেন যেমনভাবে বনী ইসরাঈলদের নারীদের আসা
বন্ধ করা হয়েছিল।
(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ) মসজিদে নববীতে নারীদের প্রবেশের
জন্য নবী সা. একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। হযরত উমর রা. নিজের শাসনামলে এ দরজা দিয়ে পুরুষদের যাওয়া
আসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। (আবু দাউদ ই’তিযালুন নিসা ফিল মাসাজিদ ও মা জাআ ফী খুরুজিন নিসা ইলাল মাসাজিদ
অধ্যায়) জামা’আতে মেয়েদের লাইন রাখা হতো পুরুষদের লাইনের পেছনে এবং নামায শেষে রাসূলুল্লাহ
সা. সালাম ফেরার পর কিছুক্ষণ বসে থাকতেন, যাতে পুরুষদের ওঠার আগে মেয়েরা উঠে চলে
যেতে পারে। (আহমাদ, বুখারী উম্মে সালামার
রেওয়ায়াতের মাধ্যমে) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, পুরুষদের
সর্বোত্তম লাইন হচ্ছে তাদের সর্বপ্রথম লাইনটি এবং নিকৃষ্ঠতম লাইনটি হচ্ছে সবচেয়ে
পেছনের (অর্থাৎ মেয়েদের নিকটবর্তী) লাইন এবং মেয়েদের সর্বোত্তম লাইন হচ্ছে সবচেয়ে
পেছনের লাইন এবং তাদের নিকৃষ্টতম লাইন হচ্ছে সবার আগের (অর্থাৎ পুরুষদের
নিকটবর্তী) লাইন।
(মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও
আহমাদ) দুই ঈদের নামাযে মেয়েলোকেরা শরীক হতো কিন্তু তাদের জায়গা ছিল পুরুষদের থেকে
দূরে। নবী সা. খুতবার পরে
মেয়েলোকদের দিকে গিয়ে তাদেরকে পৃথকভাবে সম্বোধন করতেন। (আবু দাউদ, জাবের ইবনে আবদুল্লার বর্ণনার মাধ্যমে
বুখারী ও মুসলিম ইবনে আব্বাসের বর্ণনার মাধ্যমে) একবার মসজিদে নববীর বাইরে নবী সা.
দেখলেন, পথে নারী-পুরুষ এক সাথে মিশে গেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি নারীদেরেক বললেন,
اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْتضنَ
الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ
“থেমে যাও, তোমাদের পথের মাঝখান দিয়ে চলা ঠিক নয়,
কিনারা দিয়ে চলো।” এ কথা শুনতেই মহিলারা এক পাশে হয়ে গিয়ে একবারে দেয়ালের পাশ দিয়ে চলতে লাগলো। (আবু দাউদ)
এসব নির্দেশ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, নারী-পুরুষের মিশ্র সমাবেশাদি ইসলামের
প্রকৃতির সাথে কত বেশী বেখাপ্পা! যে দ্বীন আল্লাহর ঘরে ইবাদাত করার সময়ও উভয়
গোষ্ঠীকে পরস্পর মিশ্রিত হতে দেয় না তার সম্পর্কে কে ধারণা করতে পারে যে, সে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ক্লাব-রেস্তরাঁ
ও সভা-সমিতিতে তাদের মিশ্র হওয়াকে বৈধ করে দেবে?
পাঁচঃ নারীদেরকে ভারসাম্য সহকারে সাজসজ্জা করার তিনি কেবল অনুমতিই
দেননি বরং অনেক সময় নিজেই এর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সীমা অতিক্রম করা থেকে কঠোরভাবে বাধা
দিয়েছেন। সেকালে আরবের মহিলা সমাজে
যে ধরনের সাজসজ্জার প্রচলন ছিল তার মধ্য থেকে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোকে তিনি
অভিস্পাতযোগ্য এবং মানবজাতির ধ্বংসের কারণ হিসেব গণ্য করেছেনঃ
-
নিজের চুলের সাথে পরচুলা লাগিয়ে তাকে বেশী লম্বা
ও ঘন দেখাবার চেষ্টা করা।
-
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উল্কি আঁকা ও কৃত্রিম তিল
বসানো।
-
ভ্রূর চুল উপড়ে ফেলে বিশেষ আকৃতির ভ্রূ নির্মাণ
করা এবং লোম ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখ পরিষ্কার করা।
-
দাঁত ঘসে ঘসে সুঁচালো ও পাতলা করা অথবা দাঁতের মাঝখানে
কৃত্রিম ছিদ্র তৈরী করা।
-
জাফরান ইত্যাদি প্রসাধনীর মাধ্যমে চেহারায় কৃত্রিম
রং তৈরী করা।
এসব বিধান সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা রা., হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা.,
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও
আমীর মুআবীয়া রা. থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পরম্পরায় উদ্ধৃত হয়েছে।
আল্লাহ ও রসূলের এসব পরিষ্কার নির্দেশ দেখার পর একজন মু’মিনের জন্য দু’টোই পথ
খোলা থাকে। এক, সে এর অনুসরণ করবে এবং নিজের ও
নিজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে এমনসব নৈতিক অনাচার থেকে পবিত্র করবে, যেগুলোর পথরোধ করার জন্য আল্লাহ কুরআনে এবং তাঁর রাসূল সুন্নাতে এমন
বিস্তারিত বিধান দিয়েছেন। দুই, যদি সে নিজের মানসিক দুর্বলতার কারণে এগুলোর মধ্য থেকে কোনটির বিরুদ্ধাচরণ
করে, তাহলে কমপক্ষে গোনাহ মনে করে করবে ও তাকে গোনাহ বলে
স্বীকার করে নেবে এবং অনর্থক অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে গোনাহকে সওয়াবে পরিনত করার
চেষ্টা করবে না। এ
দু’টি পথ পরিহার করে যারা কুরআন ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে
কেবল পাশ্চাত্য সমাজের পদ্ধতি অবলম্বন করেই ক্ষান্ত থাকে না বরং এরপর সেগুলোকেই
যথার্থ ইসলাম প্রমাণ করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে দেয় এবং ইসলামে আদৌ পর্দার কোন
বিধান নেই বলে প্রকাশ্যে দাবী করতে থাকে তারা গোনাহ ও নাফরমানীর সাথে সাথে মূর্খতা
ও মুনাফিকসুলভ ধৃষ্টতাও দেখিয়ে থাকে। দুনিয়ায় কোন ভদ্র ও মার্জিত রুচি সম্পন্ন ব্যক্তি এর প্রশংসা করতে পারে না
এবং আখেরাতে আল্লাহর কাছ থেকেও এর আশা করা যেতে পারে না। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মুনাফিকদের চাইতেও দু’কদম এগিয়ে
আছে এমন সব লোক যারা আল্লাহ ও রসূলের এসব বিধানকে ভুল প্রতিপন্ন করে এবং এমন সব
পদ্ধতিকে সঠিক ও সত্য মনে করে যা তারা অমুসলিম জাতিসমূহের কাছ থেকে শিখেছে। এরা আসলে মুসলমান নয়। কারণ এরপরও যদি তারা মুসলমান থাকে তাহলে ইসলাম ও কুফর শব্দ
দু’টি একেবারেই অর্থহীন হয়ে যায়। যদি তারা নিজেদের নাম বদলে নিতো এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম থেকে বের হয়ে
যেতো, তাহলে আমরা
কমপক্ষে তাদের নৈতিক সাহসের স্বীকৃতি দিতাম। কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে, এ ধরনের চিন্তা পোষণ করেও তারা
মুসলমান সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের চেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ সম্ভবত দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া যায় না। এ ধরনের চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী লোকদের
থেকে যে কোন প্রকার জালিয়াতী, প্রতারণা, দাগাবাজী, আত্মসাত ও বিশ্বাসঘাতকতা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।
﴿وَأَنكِحُوا الْأَيَامَىٰ
مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ ۚ إِن يَكُونُوا فُقَرَاءَ
يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾
৩২। তোমাদের
মধ্যে যারা একা ও নিসংগ৫০ এবং তোমাদের গোলাম ও বাঁদীদের
মধ্যে যারা সৎ৫১ ও বিয়ের যোগ্য তাদের বিয়ে দাও।৫২ যদি তারা
গরীব হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ আপন মেহেরবানীতে তাদেরকে ধনী করে দেবেন,৫৩ আল্লাহর বড়ই প্রাচুর্যময় ও
সবজ্ঞ।
৫০. মূলে ايامى শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একে সাধারণত লোকেরা নিছক বিধবা শব্দের অর্থে
গ্রহণ করে থাকে। অথচ আসলে এ শব্দটি এমন সকল
পুরুষ ও নারীর জন্য ব্যবহৃত হয় যারা স্ত্রী বা স্বামীহীন। ايامى শব্দটি ايم এর বহুবচন। আর ايم এমন প্রত্যেক পুরুষকে বলা হয়
যার কোন স্ত্রী নেই এবং এমন প্রত্যেক নারীকে বলা হয় যার কোন স্বামী নেই। তাই আমি এর অনুবাদ করেছি “একা ও নিসঙ্গ।”
৫১. অর্থাৎ তোমাদের প্রতি যাদের মনোভাব ও আচরণ ভালো এবং যাদের
মধ্যে তোমরা দাম্পত্য জীবন যাপনের যোগ্যতাও দেখতে পাও। যে গোলাম ও বাঁদীর আচরণ মালিকের সাথে সঠিক নয় এবং যার
মেজায দেখে বিয়ের পরে জীবন সঙ্গীর সাথে তার বনিবনা হবে বলে আশাও করা যায় না তাকে
বিবাহ দেবার দায়িত্ব মালিকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কারণ এ অবস্থায় সে অন্য এক ব্যক্তির জীবন নষ্ট করে দেবার
জন্য দায়ী হবে। এ শর্তটি স্বাধীন লোকদের
ব্যাপারে আরোপ করা হয়নি।
কারণ স্বাধীন ব্যক্তির বিয়েতে অংশ গ্রহণকারীর দায়িত্ব আসলে একজন পরামর্শদাতা, সহযোগী ও পরিচিত করাবার
মাধ্যমের বেশী কিছু হয় না। বিবাহকারী ও বিবাহকারিনীর সম্মতির মাধ্যমে আসল দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু গোলাম ও বাঁদীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক
গড়ে তোলার পূর্ণ দায়িত্ব হয় মালিকের। সে যদি জেনে বুঝে কোন হতভাগিনীকে একজন বদ স্বভাব ও বদচরিত্র সম্পন্ন লোকের
হাতে তুলে দেয় তাহলে এর সমস্ত দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে।
৫২. বাহ্যত এখানে আদেশমূলক ক্রিয়াপদ দেখে একদল আলেম মনে করেছেন, এ কাজটি করা ওয়াজিব। অথচ বিষয়টির ধরণ নিজেই বলছে, এ আদেশটি ওয়াজিব অর্থে হতে
পারে না। একথা সুস্পষ্ট, কোন ব্যক্তির বিয়ে করানো
অন্যদের ওপর ওয়াজিব হতে পারে না। কার সাথে কার বিয়ে করানো ওয়াজিব? ধরা যাক, যদি ওয়াজিব হয়ও তাহলে যার বিয়ে হতে হবে তার অবস্থা কি? অন্য লোকেরা যার সাথেই তার বিয়ে দিতে চায় তার সাথে বিয়ে কি তার মেনে নেয়া
উচিত? এটি যদি তার ওপর ফরয হতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তার
বিয়ে তার নিজের আয়ত্তে নেই। আর যদি তার অস্বীকার করার অধিকার থাকে তাহলে যাদের ওপর এ কাজ ওয়াজিব তারা
কিভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে? এসব দিক ভালোভাবে বিবেচনা করে অধিকাংশ ফকীহ
এ রায় দিয়েছেন যে, আল্লাহর এ উক্তি এ কাজটিকে ওয়াজিব নয় বরং
“মান্দুব” বা পছন্দনীয় গণ্য করে। অর্থাৎ এর মানে হবে, মুসলমানদের সাধারণভাবে চিন্তা হওয়া উচিত
তাদের সমাজে যেন লোকেরা অবিবাহিত অবস্থায় না থাকে। পরিবারে সাথে জড়িত লোকেরা, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহ নেবে এবং যার কেউ নেই তার এ কাজে সাহায্য
করবে রাষ্ট্র্।
৫৩. এর অর্থ এ নয় যে, যারই বিয়ে হবে আল্লাহ তাকেই ধনাঢ্য করে
দেবেন। বরং এখানে বক্তব্য হচ্ছে, লোকেরা যেন এ ব্যাপারে খুব
বেশী হিসেবী না বনে যায়। এর মধ্যে মেয়ে পক্ষের জন্যও নির্দেশ রয়েছে। বলা হয়েছে, সৎ ও ভদ্র রুচিশীল ব্যক্তি যদি তাদের কাছে
পয়গাম পাঠায়, তাহলে নিছক তার দারিদ্র দেখেই যেন তা
প্রত্যাখ্যান না করা হয়। ছেলে পক্ষকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কোন যুবককে নিছক এখনো খুব বেশী আয়-রোজগার
করছে না বলে যেন আইবুড়ো করে না রাখা হয়। আর যুবকদেরকেও উপদেশ দেয়া হচ্ছে, বেশী সচ্ছলতার অপেক্ষায় বসে
থেকে নিজেদের বিয়ের ব্যাপারকে অযথা পিছিয়ে দিয়ো না। সামান্য আয় রোজগার হলেও আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিয়ে করে
নেয়া উচিত। অনেক সময় বিয়ে নিজেই
মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীর সহায়তায় খরচপাতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। দায়িত্ব মাথার ওপর এসে পড়ার পর মানুষ নিজেও
আগের চাইতেও বেশী পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। অর্থকরী কাজে স্ত্রী সাহায্য করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভবিষ্যতে কার জন্য কি লেখা আছে
তা কেউ জানতে পারে না। ভালো অবস্থা খারাপ অবস্থায়ও পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে এবং খারাপ অবস্থা
পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে ভালো অবস্থায়। কাজেই মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবী হওয়া উচিত নয়।
﴿وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ
لَا يَجِدُونَ نِكَاحًا حَتَّىٰ يُغْنِيَهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَالَّذِينَ يَبْتَغُونَ
الْكِتَابَ مِمَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيهِمْ
خَيْرًا ۖ وَآتُوهُم مِّن مَّالِ اللَّهِ الَّذِي آتَاكُمْ ۚ وَلَا تُكْرِهُوا فَتَيَاتِكُمْ
عَلَى الْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّنًا لِّتَبْتَغُوا عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
ۚ وَمَن يُكْرِههُّنَّ فَإِنَّ اللَّهَ مِن بَعْدِ إِكْرَاهِهِنَّ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৩৩। আরা যারা
বিয়ে করার সুযোগ পায় না তাদের পবিত্রতা ও সাধুতা অবলম্বন করা উচিত, যতক্ষণ না আল্লাহ নিজ
অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন।৫৪ আর তোমাদের
মালিকানাধীনদের মধ্যে থেকে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদন করে৫৫ তাদের সাথে
চুক্তিবদ্ধ হও৫৬ যদি তাদের মধ্যে কল্যাণের
সন্ধান পাও।৫৭ আর আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদ
দিয়েছেন তা থেকে তাদেরকে দাও।৫৮ আর তোমাদের
বাঁদীরা যখন নিজেরাই সতী সাধ্বী থাকতে চায় তখন দুনিয়াবী স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে
তাদেরকে দেহ বিক্রয়ে বাধ্য করো না।৫৯ আর যে
তাদেরকে বাধ্য করে, তবে এ
জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
৫৪. এ প্রংসগে নবী সা. থেকে যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই
এ আয়াতগুলোর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেছেন, নবী সা. বলেনঃ
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ
الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ
لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
“হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে বিয়ে করতে পারে তার বিয়ে করে নেয়া উচিত। কারণ এটি হচ্ছে চোখকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার
এবং মানুষের সততা ও সতীত্ব রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। আর যার বিয়ে করার ক্ষমতা নেই তার রোযা রাখা উচিত। কারণ রোযা মানুষের দেহের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে
দেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ
ثَلاَثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللَّه عَوْنُهُمُ النَّاكِحُ
يُرِيدُ الْعَفَافَ والْمُكَاتَبُ يُرِيدُ الأَدَاءَ وَالغازى فِى سَبِيلِ اللَّهِ
“তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব। এক ব্যক্তি হচ্ছে, যে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য
বিয়ে করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, মুক্তিলাভের জন্য যে গোলাম
লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তার মুক্তিপণ দেয়ার নিয়ত রাখে। আর তৃতীয় ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে জিহাদ করার
জন্য বের হয়।”
(তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ। এছাড়া আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল
কুরআন, আন নিসা,
২৫ আয়াত)।
৫৫. মূল শব্দ হচ্ছে مُكَاتَبَتْ এর শাব্দিক অর্থ লিপিবদ্ধ। কিন্তু পারিভাষিক দিক দিয়ে এ শব্দটি তখন বলা হয় যখন কোন
গোলাম বা বাঁদী নিজের মুক্তির জন্য নিজের প্রভুকে একটি মূল্য দেবার প্রস্তাব দেয়
এবং প্রভু সে প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয় তখন উভয়ের মধ্যে এর শর্তাবলী লিপিবদ্ধ হয়ে
যায়। ইসলামে গোলামদের মুক্ত করার
জন্য যেসব পথ তৈরী করা হয়েছে এটি তার অন্যতম। এ মূল্য অর্থ বা সম্পদের আকারে দেয়া অপরিহার্য নয়। উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে প্রভুর জন্য কোন বিশেষ
কাজ করে দেয়াও মূল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চুক্তি হয়ে যাবার পর কর্মচারীর স্বাধীনতায় অনর্থক
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অধিকার প্রভুর থাকে না। মূল্য বাবদ দেয় অর্থ সংগ্রহের জন্য সে তাকে কাজ করার সুযোগ
দেবে। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে
গোলাম যখনই তার দেয় অর্থ বা তার ওপর আরোপিত কাজ সম্পন্ন করে দেবে তখনই সে তাকে
মুক্ত করে দেবে। হযরত উমরের আমলের ঘটনার। একটি গোলাম তার কর্ত্রীর সাথে নিজের মুক্তির
জন্য লিখিত চুক্তি করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থ
সংগ্রহ করে তার কাছে নিয়ে যায়। কর্ত্রী বলে, আমিতো সমুদয় অর্থ এক সাথে নেবো না। বরং বছরে বছরে মাসে মাসে বিভিন্ন কিস্তিতে নেবো। গোলাম হযরত উমরের রা. কাছে অভিযোগ করে। তিনি বলেন, এ অর্থ বায়তুল মালে দাখিল করে দাও এবং চলে
যাও তুমি স্বাধীন।
তারপর কর্ত্রীকে বলে পাঠান, তোমার অর্থ এখানে জমা হয়ে গেছে, এখন তুমি চাইলে এক
সাথেই নিয়ে নিতে পারো অথবা আমরা বছরে বছরে মাসে মাসে তোমাকে দিতে থাকবো। (দারুকুত্নী, আবু সাঈদ মুকবেরীর রেওয়ায়াতের
মাধ্যমে)।
৫৬. একদল ফকীহ এ আয়াতের এ অর্থ নিয়েছেন যে, যখন কোন বাঁদী বা গোলাম মুল্য
দানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের লিখিত চুক্তি করার আবেদন জানায় তখন তা গ্রহণ করা প্রভুর
জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। এটি আতা, আমর ইবনে দ্বীনার, ইবনে সীরান, মাসরূক, দ্বাহ্হাক, ’ইক্রামাহ,
যাহেরীয়্যা ও ইবনে জারীর তাবারীর অভিমত। ইমাম শাফে’ঈও প্রথমে এরই প্রবক্তা ছিলেন। দ্বিতীয় দলটি বলেন, এটি ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব ও
মান্দুব তথা পছন্দনীয়। এ দলে শা’বী, মুকাতিল ইবনে হাইয়ান, হাসান বাস্রী, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ, সুফিয়ান সওরী, আবু হানীফা, মালেক ইবনে আনাসের মতো মনীষীগণ আছেন। শেষের দিকে ইমাম শাফে’ঈও এ মতের প্রবক্তা হয়ে
উঠেছিলেন। প্রথম দলটির মতে সমর্থন
করতো দু’টো জিনিস। এক, আয়াতের শব্দ كَاتِبُوهُمْ “তাদের সাথে লিখিত চুক্তি করো।” এ শব্দাবলী পরিষ্কার প্রকাশ করে যে, এটি আল্লাহর হুকুম। দুই, নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে প্রমাণ হয়,
প্রখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস হযরত মুহাম্মাদ ইবনে সীরীনের পিতা সীরীন
যখন তাঁর প্রভু হযরত আনাসের রা. কাছে মূল্যের বিনিময়ে গোলামী মুক্ত হবার লিখিত
চুক্তি করার আবেদন জানায় এবং তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তখন সীরীন হযরত
ওমরের রা. কাছে নালিশ করে। তিনি ঘটনা শুনে দোর্রা নিয়ে আনাসের রা. ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বলেন, আল্লাহর হুকুম হচ্ছে, “গোলামী মুক্তির লিখিত চুক্তি করো।” (বুখারী) এ ঘটনা থেকে যুক্তি পেশ করা হয়ঃ এটি হযরত উমরের
ব্যক্তিগত কাজ নয় বরং সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে তিনি এ কাজ করেছিলেন এবং কেউ এর
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি, কাজেই এটি এ আয়াতের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় দলটির যুক্তি হচ্ছে, আল্লাহ শুধুমাত্র كَاتِبُوهُمْ বলেননি, বলেন فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ
فِيهِمْ خَيْرًا “তাদের সাথে লিখিত চুক্তি করো যদি তাদের
মধ্যে কল্যাণের সন্ধান পাও।” এ কল্যাণের সন্ধান পাওয়াটা এমন একটি শর্ত যা নির্ভর করে একমাত্র মালিকের
রায়ের ওপর। এর এমন কোন নির্দিষ্ট
মানদণ্ড নেই যার ভিত্তিতে কোন আদালত এটা যাচাই-পর্যালোচনা করতে পারে। আইনগত বিধানের রীতি এ নয়। তাই হুকুমটিকে উপদেশের অর্থেই গ্রহণ করা হবে আইনগত হুকুমের
অর্থে নয়। আর সীরীনের যে নজির পেশ করা
হয়েছে তার জবাব তারা এভাবে দেনঃ সেকালে তো আর লিখিত চুক্তির আবেদনকারী গোলাম একজন
ছিল না। নবীর যুগে ও খেলাফতে
রাশেদার আমলে হাজার হাজার গোলাম ছিল এবং তাদের বিপুল সংখ্যক মুক্তির জন্য লিখিত
চুক্তি করেছিল। কিন্তু কেবলমাত্র সীরীনের
ঘটনাটি ছাড়া কোন প্রভুকে আদালতের হুকুমের মাধ্যমে গোলামী মুক্তির লিখিত চুক্তি
করতে বাধ্য করার আর একটিও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কাজেই হযরত উমরের এ কাজটিকে আদালতের ফায়সালা মনে করার
পরিবর্তে আমরা একে এ অর্থে গ্রহণ করতে পারি যে, তিনি মুসলমানদের মাঝখানে কেবল কাযীর
ভূমিকায় অধিষ্ঠিত ছিলেন না বরং ব্যক্তি ও সমাজের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল পিতা ও
সন্তানের মতো।
অনেক সময় তিনি এমন অনেক বিষয়েও হস্তক্ষেপ করতেন যাতে একজন পিতা হস্তক্ষেপ করতে
পারেন কিন্তু একজন বিচারক পারেন না।
৫৭. কল্যাণ বলতে তিনটি জিনিস বুঝানো হয়েছেঃ
একঃ চুক্তিবদ্ধ অর্থ আদায় করার ক্ষমতা গোলামের আছে। অর্থাৎ সে উপার্জন বা পরিশ্রম করে নিজের
মুক্তি লাভের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পারে। যেমন একটি মুরসাল হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ ان علمتم فيهم حرفة ولاترسلوهم
كلا على الناس “যদি তোমার জানো তারা উপার্জন করতে পারে
তাহলে লিখিত চুক্তি করে নাও। তাদেরকে যেন লোকদের কাছে ভিক্ষা করতে ছেড়ে দিয়ো না।” (ইবনে কাসীর, আবু দাউদের বরাত দিয়ে)
দুইঃ তার কথায় বিশ্বাস করে তার সাথে চুক্তি করা যায়, এতটুকু সততা ও বিশ্বস্ততা তার
মধ্যে আছে। এমন না হয় যে, লিখিত চুক্তি করার পর সে
মালিকের খিদমত করা থেকে ছুটিও পেয়ে গেলো। আবার এ সময়ের মধ্যে যা কিছু আয়-রোজগার করে তাও খেয়ে পরে
শেষ করে ফেললো।
তিনঃ মালিক তার মধ্যে এমন কোন খারাপ নৈতিক প্রবণতা অথবা ইসলাম ও
মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতার এমন তিক্ত আবেগ-অনুভূতি পাবে না যার ভিত্তিতে এ
আশঙ্কা হয় যে, তার স্বাধীনতা মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক হবে। অন্য কথায় তার ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যে, সে মুসলিম দেশের ও সমাজের একজন
ভালো ও স্বাধীন নাগরীক হতে পারবে, কোন বিশ্বাসঘাতক ও ঘরের
শত্রু আস্তিনের সাঁপে পরিণত হবে না। এ প্রসঙ্গে একথা সামনে রাখতে হবে যে, বিষয়টি ছিল যুদ্ধবন্দী
সংক্রান্তও এবং তাদের সম্পর্কে অবশ্যি এ ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন ছিল।
৫৮. এটি একটি সাধারণ হুকুম। প্রভু, সাধারণ মুসলমান এবং ইসলামী হুকুমাত সবাইকে এখানে সম্বোধন করা
হয়েছে।
প্রভুদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদনকারীদের দেয়
অর্থ থেকে কিছু না কিছু মাফ করে দাও। কাজেই বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে প্রমাণ হয় সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের চুক্তিবদ্ধ
গোলামদের দেয় অর্থ থেকে বেশ একটা বড় পরিমাণ অর্থ মাফ করে দিতেন। এমন কি হযরত আলী রা. হামেশা এক চতুর্থাংশ মাফ
করেছেন এবং এরই উপদেশ দিয়েছেন। (ইবনে জারীর)
সাধারণ মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যে কোন লিখিত চুক্তিবদ্ধ গোলাম তার দেয়
অর্থ আদায় করার জন্য তাদের কাছে আবেদন জানাবে, তাদেরকে যেন
প্রাণ খুলে সাহায্য করে। কুরআন মজীদে যাকাতের যে ব্যয় ক্ষেত্র বর্ণনা করা হয়েছে فِي الرِّقَابِ তার মধ্যে একটি অর্থাৎ
“দাসত্বের জোয়াল থেকে গর্দানমুক্ত করা।” (সূরা তওবা, ৬০ আয়াত) আর আল্লাহর নিকট فَكُّ رَقَبَةٍ “গর্দানের বাঁধন খোলা” একটি বড় নেকীর কাজ। (সূরা বালাদ, ১৩ আয়াত) হাদীসে বলা হয়েছে এক গ্রামীন
ব্যক্তি এসে নবী সা.কে বললো, আমাকে এমন কাজ বলুন যা করলে আমি
জান্নাতে প্রবেশ করবো। রাসূলুল্লাহ
সা. বললেন, “তুমি অতি সংক্ষেপে অনেক বড় কথা জিজ্ঞেস করেছো। গোলামকে মুক্ত করে দাও, গোলামদের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করো,
কাউকে পশু দান করলে অত্যধিক দূধেল পশু দান করো এবং তোমাদের যে
আত্মীয় তোমাদের প্রতি জুলুম করে তুমি তার সাথে সৎ ব্যবহার করো। আর যদি তা না করতে পারো, তাহলে অভুক্তকে আহার করাও,
পিপাসার্তকে পানি পান করাও, মানুষকে ভালো কাজ
করার উপদেশ দাও এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করো। আর যদি এও না করতো পারো, তাহলে নিজের মুখ বন্ধ করে রাখো। মুখ খুললে ভালোর জন্য খুলবে আর নয়তো বন্ধ করে
রাখবে।” (বায়হাকী ফী শু’আবিল ঈমান, আনিল বারাআ ইবনে আযিব)।
ইসলামী রাষ্ট্রকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বায়তুল মালে যে যাকাত জমা হয় তা থেকে লিখিত
চুক্তিবদ্ধ গোলামদের মুক্তির জন্য একটি অংশ ব্যয় করো।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ, প্রাচীন যুগে তিন ধরনের গোলাম হতো। এক, যুদ্ধবন্দী। দুই, স্বাধীন ব্যক্তিকে ধরে গোলাম বানানো হতো এবং তারপর তাকে বিক্রি করা হতো। তিন, যারা বংশানুক্রমিকভাবে গোলাম হয়ে আসছিল,
তাদের বাপ-দাদাকে কবে গোলাম বানানো হয়েছিল এবং ওপরে উল্লেখিত
দু’ধরনের গোলামের মধ্যে তারা ছিল কোন্ ধরনের তা জানার কোন উপায় ছিল না। ইসলামের আগমনের সময় আরব ও আরবের বাইরের জগতের
মানব সমাজ এ ধরনের গোলামে পরিপূর্ণ ছিল। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা শ্রমিক ও চাকর বাকরদের চাইতে
এ ধরনের গোলামদের ওপর বেশী নির্ভরশীল ছিল। ইসলামের সামনে প্রথম প্রশ্ন ছিল, পর্ব থেকে এই যে গোলামদের ধারা
চলে আসছে এদের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল আগামীর জন্য গোলামী সমস্যার কি সমাধান
দেয়া যায়? প্রথম প্রশ্নের জবাবে ইসলাম কোন আকস্মিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্রাচীনকাল থেকে গোলামদের যে বংশানুক্রমিক
ধারা চলে আসছিল হঠাৎ তাদের সবার ওপর থেকে মালিকানা অধিকার খতম করে দেয়নি। কারণ এর ফলে শুধু যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো তাই নয় বরং আরবকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের চাইতেও অনেক বেশী কঠিন ও
ধ্বংসকর গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হতো। এরপরও মূল সমস্যার কোন সমাধান হতো না, যেমন আমেরিকায় হয়নি এবং
কালোদের (Negroes) লাঞ্ছনার সমস্যা সেখানে রয়েই গেছে। এ নির্বোধসুলভ ও অবিবেচনা প্রসূত সংস্কারের পথ
পরিহার করে ইসলাম فَكُّ رَقَبَةٍ তথা দাসমুক্তির একটি শক্তিশালী নৈতিক আন্দোলন
শুরু করে এবং উপদেশ, উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধর্মীয় বিধি-বিধান ও দেশজ
আইন-কানুনের মাধ্যমে লোকদেরকে গোলাম আজাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদেরকে আখেরাতে নাজাত লাভ করার জন্য
স্বেচ্ছায় গোলাম আজাদ করার অথবা নিজের গোনাহের কাফ্ফারা দেবার জন্য গোলামদেরকে
মুক্তি দানের কিংবা অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেবার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। এ আন্দোলনের আওতাধীন নবী সা. নিজে ৬৩ জন
গোলামকে মুক্ত করে দেন।
তার স্ত্রীগণের মধ্য থেকে একমাত্র হযরত আয়েশারই রা. আজাদকৃত গোলামদের সংখ্যা ছিল
৬৭। রাসূলুল্লাহর সা. চাচা হযরত আব্বাস রা. নিজের
জীবনে ৭০ জন গোলামকে স্বাধীন করে দেন। হাকিম ইবনে হিযাম ১০০, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ১০০০, যুল কিলাহ হিম্ইয়ারী ৮
হাজার এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ ৩০ হাজার গোলামকে আজাদ করে দেন। এমনি ধরনের ঘটনা অন্যান্য সাহাবীদের জীবনেও
ঘটেছে। এদের মধ্যে হযরত আবু বকর রা.
ও হযরত উমরের রা. নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি সাধারণ প্রেরণা। এ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকেরা ব্যাপকভাবে
নিজেদের গোলামদেরকেও মুক্ত করে দিতেন এবং অন্যদের গোলাম কিনে নিয়ে এসে তাদেরকে
আজাদ করে দিতে থাকতেন।
এভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার আগেই পূর্ব যুগের প্রায় সমস্ত গোলামই
মুক্তিলাভ করেছিল।
এখন প্রশ্ন হলো ভবিষ্যতে কি হবে। এ ব্যাপারে ইসলাম কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গোলাম বানানো এবং তার কেনা
বেচা করার ধারাকে পুরোপুরি হারাম ও আইনগতভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে যুদ্ধবন্দীদেরকে শুধুমাত্র এমন অবস্থায়
গোলাম বানিয়ে রাখার অনুমতি (আদেশ নয় বরং অনুমতি) দেয় যখন তাদের সরকার আমাদের
যুদ্ধবন্দীদের সাথে তাদের যুদ্ধবন্দীদের বিনিময় করতে রাজী হয় না এবং তারা নিজেরাও
নিজেদের মুক্তিপণ আদায় করে না। তারপর এ গোলামদের জন্য একদিকে তাদের মালিকদের সাথে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে
মুক্তি লাভ করার পথ খোলা রাখা হয় এবং অন্যদিকে প্রাচীন গোলামদের ব্যাপারে যেসব
নির্দেশ ছিল তা সবই তাদের পক্ষে বহাল থাকে, যেমন নেকীর কাজ মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জনের লক্ষ্য তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া অথবা গোনাহর কাফ্ফারা আদায় করার জন্য
তাদেরকে আজাদ করা কিংবা কোন ব্যক্তির নিজের জীবদ্দশায় গোলামকে গোলাম হিসেবে রাখা
এবং পরবর্তীকালের জন্য অসিয়ত করে যাওয়া যে, তার মৃত্যুর পরই
সে আজাদ হয়ে যাবে (ইসলামী ফিকাহর পরিবভাষায় একে বলা হয় তাদবীর এবং এ ধরনের গোলমকে
“মুদাব্বার” বলা হয়)। অথবা কোন ব্যক্তি নিজের বাঁদীর সাথে সঙ্গম করা এবং তার গর্ভে সন্তান জন্ম লাভ
করা, এ অবস্থায়
মালিক অসিয়ত করুক বা না করুক মালিকের মৃত্যুর সাথে সাথেই সে নিজে নিজেই স্বাধীন
হয়ে যাবে। ইসলাম গোলামী সমস্যার এ
সমাধান দিয়েছে। অজ্ঞ আপত্তিকারীরা এগুলো না
বুঝে আপত্তি করে বসেন।
পক্ষান্তরে ওজর পেশকারীগণ ওজর পেশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত এ বাস্তব সত্যটাকেই
অস্বীকার করে বসেন যে, ইসলাম গোলামীকে কোন না কোন আকারে টিকিয়ে রেখেছিল। (তা যে কারণেই হোক না কেন)।
৫৯. এর অর্থ এ নয় যে, বাঁদীরা নিজেরা যদি সতী সাধ্বী না থাকতে
চায়, তাহলে তাদেরকে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করা যেতে পারে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, বাঁদী যদি স্বেচ্ছায়
ব্যভিচারের লিপ্ত হয়, তাহলে নিজের অপরাধের জন্য সে নিজেই
দায়ী, তার অপরাধের জন্য আইন তাকেই পাকড়াও করবে। কিন্তু যদি তার মালিক জোর করে তাকে এ পেশায়
নিয়োগ করে, তাহলে এজন্য মালিক দায়ী হবে এবং সে পাকড়াও হবে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, জোর করার প্রশ্ন তখনই দেখা দেয়
যখন কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে বাধ্য করা হয়। আর “দুনিয়াবী স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে”
বাক্যাংশটি দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়নি যে, যদি মালিক তার উপার্জন না খায় তাহলে
বাঁদীকে দেহ বিক্রয়ে বাধ্য করার কারণে সে অপরাধী হবে না বরং বুঝানো হয়েছে যে,
এ অবৈধ বল প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত উপার্জনও হারামের শামিল।
কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞাটির পূর্ণ উদ্দেশ্য নিছক এর শব্দাবলী ও পূর্বাপর আলোচনা
থেকে বুঝা যেতে পারে না।
একে ভালোভাবে বুঝতে হলে যে পরিস্থিতিতে এ হুকুমটি নাযিল হয় সেগুলোও সামনে রাখা
জরুরী। সেকালে আরব দেশে দু’ধরনের
পতিতাবৃত্তির প্রচলন ছিল। এক, ঘরোয়া পরিবেশে গোপন
বেশ্যাবৃত্তি এবং দুই, যথারীতি বেশ্যাপাড়ায় বসে বেশ্যাবৃত্তি।
ঘরোয়া বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত থাকতো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত
বাঁদীরা, যাদের কোন পৃষ্ঠপোষক ছিল না। অথবা এমন ধরনের স্বাধীন মেয়েরা, কোন পরিবার বা গোত্র যাদের
পৃষ্ঠপোষক ছিল না।
তারা কোন গৃহে অবস্থান করতো এবং একই সঙ্গে কয়েকজন পুরুষের সাথে তাদের এ মর্মে
চুক্তি হয়ে যেতো যে, তারা তাকে সাহায্য করবে ও তার ব্যয়ভার বহন করবে এবং এর বিনিময়ে পুরুষরা
নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করতে থাকবে। সন্তান জন্ম নিলে মেয়েরা যে পুরুষ সম্পর্কে বলে দিতো যে, এ সন্তান অমুকের। সে-ই সন্তানের পিতা হিসেবে স্বীকৃত হতো। এটি যেন ছিল জাহেলী সমাজের একটি স্বীকৃত প্রথা। জাহেলিয়াতের যুগে লোকেরা একে এক ধরনের ‘বিয়ে’
মনে করতো। ইসলাম এসে বিয়ের জন্য ‘এক
মেয়ের এক স্বামী’ এ একমাত্র পদ্ধতিকেই চালু করলো। এছাড়া বাদবাকি সমস্ত পদ্ধতি আপনা আপনিই যিনা হিসেবে গণ্য
হয়ে অপরাধে পরিণত হয়ে গেলো। (আবু দাউদ, বাবুন ফী অজুহিন নিকাহ আল্লাতী কানা ইয়াতানাকিহু আহলুল জাহেলিয়াহ)।
দ্বিতীয় অবস্থাটি অর্থাৎ প্রকাশ্য বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হতো বাঁদীদেরকেই। এর দু‘টি পদ্ধতি ছিল। প্রথমত লোকেরা নিজেদের যুবতী বাঁদীদের ওপর একটি নির্দিষ্ট
অংক চাপিয়ে দিতো। অর্থাৎ প্রতি মাসে একটি
নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে তাদেরকে দিতে হবে। ফলে তারা দেহ বিক্রয় করে তাদের এ দাবী পূর্ণ করতো। এছাড়া অন্য কোন পথে তারা এ পরিমাণ অর্থ
উপার্জন করতেও পারতো না। আর
তারা কোন পবিত্র উপায়ে এ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে এনেছে বলে তাদের মালিকরাও মনে
করতো না। যুবতী বাঁদীদের ওপর সাধারণ
মজুরদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী রোজগার করার বোঝা চাপিয়ে দেবার এছাড়া আর কোন
যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না।
দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল, লোকেরা নিজেদের সুন্দরী যুবতী বাঁদীদেরকে আলাদা ঘরে বসিয়ে রাখতো এবং তাদের
দরজায় ঝাণ্ডা গেড়ে দিতো। এ চিহ্ন দেখে দূর থেকেই “ক্ষুধার্তরা” বুঝতে পারতো কোথায় তাদের ক্ষুধা
নিবৃত্ত করতে হবে। এ মেয়েদেরকে বলা হতো
“কালীকীয়াত” এবং এদের গৃহগুলো “মাওয়াখীর” নামে পরিচিত ছিল। বড় বড় গণ্যমান্য সমাজপতিরা এ ধরনের বেশ্যালয় পরিচালনা করতো। স্বয়ং আবদুল্লাহ ইবনে উবাই (মুনাফিক প্রধান, যাকে নবী সা. এর আগমনের পূর্বে
মদীনাবাসীরা নিজেদের বাদশাহ করার সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিল এবং যে হযরত আয়েশার
বিরুদ্ধে অপবাদ রটানোর কাজে সবার আগে ছিল) মদীনায় এ ধরনের একটি বেশ্যালয়ের মালিক
ছিল। সেখানে ছিল ছয়জন সুন্দরী
বাঁদী। তাদের মাধ্যমে সে কেবলমাত্র
অর্থই উপার্জন করতো না বরং আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নামী দামী মেহমানদের আদর
আপ্যায়নও তাদের দিয়েই করাতো। তাদের অবৈধ সন্তানদের সাহায্যে সে নিজের পাইক, বরকন্দাজ ও লাঠিয়ালের সংখ্যা
বাড়াতো। এ বাঁদীদেরই একজনের নাম ছিল
মু’আযাহ। সে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল এবং
এ পেশা থেকে তাওবা করতে চাচ্ছিল। ইবনে উবাই তার ওপর জোর জবরদস্তি করলো। সে গিয়ে হযরত আবু বকরের রা. কাছে নালিশ করলো। তিনি ব্যাপারটি রসূলের সা. কাছে পৌঁছে দিলেন। (ইবনে জারীর, ১৮ খণ্ড, ৫৫-৫৮ এবং ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা, আল ইসতি’আব লি ইবনি আবদিল
বার, ২ খণ্ড, ৭৬২ পৃষ্ঠা, ইবনে কাসীর, ৩ খণ্ড, ২৮৮-২৮৯
পৃষ্ঠা)। এ সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে
এ আয়াত নাযিল হয়। এ পটভূমি দৃষ্টি সমক্ষে
রাখলে পরিষ্কার জানা যাবে, শুধুমাত্র বাঁদীদেরকে যিনার অপরাধে জড়িত হতে বাধ্য করার পথে বাধা সৃষ্টি
করাই নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বেশ্যাবৃত্তির (Prostitution) ব্যবসায়ে সম্পূর্ণরুপে আইন বিরোধী গণ্য করা এবং একই সঙ্গে যেসব মেয়েকে জোর
জবরদস্তি এ ব্যবসায়ে নিয়োগ করা হয় তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণাও এখানে এর মূল উদ্দেশ্য।
আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ফরমান এসে যাবার পর নবী সা. ঘোষণা করেন لاَ مُسَاعَاةَ فِى الإِسْلاَمِ “ইসলামে বেশ্যাবৃত্তির কোন অবকাশই নেই।” (আবু দাউদ, ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতের
মাধ্যমে, বাবুন ফী ইদ্দিআয়ে ওয়ালাদিয যিনা) দ্বিতীয় যে
হুকুমটি তিনি দেন সেটি ছিল এই যে, যিনার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ
হারাম, নাপাক ও পুরোপুরি নিষিদ্ধ। রাফে’ ইবন খাদীজের রেওয়ায়াত হচ্ছে, নবী করীম সা. مَهْرُ الْبَغِىِّ অর্থাৎ যিনার বিনিময়ে অর্জিত অর্থকে নষ্ট, সর্বাধিক অকল্যাণমূলক উপার্জন,
অপবিত্র ও নিকৃষ্টতম আয় গণ্য করেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি ও নাসাঈ) আবু হুজাইফা রা. বলেন,
রাসূলুল্লাহ সা. كَسْبِ الْبَغِىِّ অর্থাৎ দেহ বিক্রয়লব্ধ
অর্থকে হারাম গণ্য করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ) আবু মাস’উদ উকবাহ ইবনে আমরের
রেওয়ায়াত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সা. مَهْرُ الْبَغِىِّ তথা যিনার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের লেনদেনকে
নিষিদ্ধ গণ্য করেছেন।
(সিহাহে সিত্তা ও আহমদ) তৃতীয় যে হুকুমটি তিনি দিয়েছিলেন তা ছিল এই যে, বাঁদীর কাছে থেকে বৈধ পন্থায়
কেবলমাত্র হাত ও পায়ের শ্রম গ্রহণ করা যেতে পারে এবং মনিব তার ওপর এমন পরিমাণ কোন
অর্থ চাপিয়ে দিতে বা তার কাছ থেকে আদায় করতে পারে না যে সম্পর্কে সে জানে না অর্থ
সে কোথা থেকে ও কিভাবে উপার্জন করে। রাফে’ ইবনে খাদীজ বলেনঃ
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ كَسْبِ
الأَمَةِ حَتَّى يُعْلَمَ مِنْ أَيْنَ هُوَ
“রাসূলুল্লাহ সা. বাঁদীর মাধ্যমে কোন উপার্জন নিষিদ্ধ গণ্য করেন যতক্ষণ না
একথা জানা যায় যে, এ অর্থ কোথা থেকে অর্জিত হয়।” (আবু দাউদ, কিতাবুল ইজারাহ)
রাফে’ ইবনে রিফা’আহ আনসারীর বর্ণনায় এর চাইতেও সুস্পষ্ট হুকুম পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছেঃ
نَهَانَا نَبِىُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ
كَسْبِ الأَمَةِ إِلاَّ مَا عَمِلَتْ بِيَدِهَا وَقَالَ هَكَذَا بِأَصَابِعِهِ نَحْوَ
الْخَبْذى وَالْغَزْلِ وَالنَّفْشِ
“আল্লাহর নবী সা. বাঁদীর সাহায্যে অর্থোপর্জন করতে আমাদের নিষেধ করেছেন,
তবে হাতের সাহায্যে পরিশ্রম করে সে যা কিছু কামাই করে তা ছাড়া। এবং তিনি হাতের ইশারা করে দেখান যেমন এভাবে
রুটি তৈরী করা, সূতা কাটা বা উল ও তুলা ধোনা।” (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, কিতাবুল
ইজারাহ)
একই বক্তব্য সম্বলিত একটি হাদীস আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা রা.
থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে كسب الاماء (বাঁদীর কামাই) ও مهر البغى (ব্যভিচারের উপার্জন) গ্রহণ করতে নিষেধ করা
হয়েছে। এভাবে নবী সা. কুরআনের এ
আয়াতের উদ্দেশ্য অনুযায়ী সেকালে আরবে প্রচলিত বেশ্যাবৃত্তির সকল পদ্ধতিকে ধর্মীয়
দিক দিয়ে অবৈধ ও আইনগত দিক দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বরং আরো অগ্রসর হয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ---এর বাঁদী
মু’আযার ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত তিনি দেন তা থেকে জানা যায়, যে বাঁদীকে তার মালিক জোর করে
এ পেশায় নিয়োগ করে তার ওপর থেকে তার মালিকের মালিকানা সত্বও খতম হয়ে যায়। এটি ইমাম যুহরীর রেওয়ায়াত। ইবনে কাসীর মুসনাদে আবদুর রাযযাকের বরাত দিয়ে
তাঁর গ্রন্থে এটি উদ্ধৃত করেছেন।
﴿وَلَقَدْ
أَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ آيَاتٍ مُّبَيِّنَاتٍ وَمَثَلًا مِّنَ الَّذِينَ خَلَوْا مِن
قَبْلِكُمْ وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ﴾
৩৪। আমি
দ্ব্যর্থহীন পথনির্দেশক আয়াত তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি, তোমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত
জাতিদের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তও তোমাদের সামনে উপস্থাপন করেছি এবং
মুত্তাকীদের জন্য উপদেশও দিয়েছি।৬০
৬০. এ আয়াতটির সম্পর্ক কেবলমাত্র ওপরের শেষ আয়াতটির সাথে নয়। বরং সূরার শুরু থেকে এখান পর্যন্ত যে বর্ণনা ধারা
চলে এসেছে তার সবের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। দ্ব্যর্থহীন পথনির্দেশক আয়াত বলতে এমনসব আয়াত বুঝানো হয়েছে
যেগুলোতে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের আইন বর্ণনা করা হয়েছে, ব্যভিচারী
পুরুষ ও মহিলার সাথে মু’মিনদের বিয়েশাদী না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সৎ চরিত্রবান ও সম্ভ্রান্ত লোকদের ওপর ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়া এবং সমাজে
দুষ্কৃতি ও অশ্লীলতার প্রচার ও প্রসারের পথ বন্ধ করা হয়েছে, পুরুষ
ও নারীকে দৃষ্টি সংযত ও যৌনাংগ হেফাজত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে, নারীদের জন্য পর্দার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিবাহযোগ্য
লোকদের বিবাহ না করে একাকী জীবন যাপনকে অপছন্দ করা হয়েছে, গোলামদের
আজাদীর জন্য লিখিত চুক্তি করার নিয়ম প্রবর্তন করতে বলা হয়েছে এবং সমাজকে
বেশ্যাবৃত্তির অভিশাপ মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব কথা বলার পর বলা হচ্ছে, আল্লাহকে ভয় করে সহজ-সরল পথ
অবলম্বনকারীদেরকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া দরকার তাতো আমি দিয়েছি, এখন যদি তোমরা এ শিক্ষার বিপরীত পথে চলো, তাহলে এর
পরিষ্কার অর্থ দাঁড়াবে এই যে, তোমরা এমন সব জাতির মতো
নিজেদের পরিণাম দেখতে চাও যাদের ভয়াবহ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমি এ কুরআনে তোমাদের
সামনে পেশ করেছি।
---সম্ভবত একটি নির্দেশনামার উপসংহারে এর চেয়ে কড়া সতর্কবাণী আর হতে পারে না। কিন্তু অবাক হতে হয় এমন জাতির কার্যকলাপ দেখে
যারা এ নির্দেশনামা তেলাওয়াতও করে আবার এ ধরনের কড়া সাবধান বাণীর পরও এর বিপরীত
আচরণও করতে থাকে!
﴿اللَّهُ
نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ
الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ ۖ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِن
شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا
يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ ۚ نُّورٌ عَلَىٰ نُورٍ ۗ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ
مَن يَشَاءُ ۚ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ
عَلِيمٌ﴾
৩৫। আল্লাহ৬১ আকাশ
মন্ডলী ও পৃথিবীর আলো।৬২ (বিশ্ব-জাহানে) তাঁর আলোর উপমা
যেন একটি তাকে একটি প্রদীপ রাখা আছে, প্রদীপটি আছে একটি চিমনির
মধ্যে, চিমনিটি
দেখতে এমন যেন মুক্তোর মতো ঝকঝকে নক্ষত্র, আর এ প্রদীপটি যয়তুনের এমন
একটি মুবারক৬৩ গাছের তেল
দিয়ে উজ্জল করা হয়, যা
পূর্বেরও নয়, পশ্চিমেরও
নয়।৬৪ যার তেল আপনা আপনিই জ্বলে ওঠে, চাই আগুন তাকে স্পর্শ করুক বা
না করুক। (এভাবে) আলোর ওপরে আলো (বৃদ্ধির সমস্ত
উপকরণ একত্র হয়ে গেছে) ৬৫ আল্লাহ যাকে চান নিজের আলোর
দিকে পথনির্দেশ করেন।৬৬ তিনি উপমার
সাহায্যে লোকদের কথা বুঝান। তিনি প্রত্যেকটি জিনিস খুব
ভালো করেই জানেন।৬৭
৬১. এখান থেকে শুরু হয়েছে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ। ইসলামী সমাজের মধ্যে অবস্থান করে তারা একের পর
এক গোলযোগ ও বিভ্রাট সৃষ্টি করে চলছিল এবং ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী রাষ্ট্র ও দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে তৎপর ছিল
যেমন বাইরের প্রকাশ্য কাফের ও দুশমনরা তৎপর ছিল। তারা ছিল ঈমানের দাবীদার। মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা। মুসলমানদের বিশেষ করে আনসারদের সাথে ছিল তাদের আত্মীয়তা ও
ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক। এ জন্য তারা
মুসলমানদেরমধ্যে ফিতনা বিস্তারের সুযোগও বেশী পেতো এবং কোন কোন আন্তরিকতা সম্পন্ন
মুসলমানও নিজের সরলতা বা দুর্বলতার কারণে তাদের ক্রীড়নক ও পৃষ্ঠপোষকেও পরিণত হয়ে
যেতো। কিন্তু আসলে বৈষয়িক স্বার্থ
তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল এবং ঈমানের দাবী সত্ত্বেও কুরআন ও মুহাম্মাদ সা. এর
বদৌলতে দুনিয়ায় যে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তা থেকে তারা ছিল একেবারেই বঞ্চিত। এ সুযোগে তাদেরকে সম্বোধন না করে তদের
সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে তিনটি উদ্দেশ্য। প্রথমত তাদেরকে উপদেশ দেয়া। কারণ আল্লাহর রহমত ও রবুবিয়াতের প্রথম দাবী হচ্ছে, পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত মানুষকে
তার সকল নষ্টামি ও দুষ্কৃতি সত্ত্বেও শেষ সময় পর্যন্ত বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত ঈমান ও মুনাফিকির পার্থক্যকে
পরিষ্কার ও খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দেয়া। এভাবে কোন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য মুসলিম সমাজে
মু’মিন ও মুনাফিকের মধ্যে ফারাক করা কঠিন হবে না। আর এ ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বর্ণনার পরও যে ব্যক্তি
মুনাফিকদের ফাঁদে জড়িয়ে পড়বে অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে সে তার নিজের এ কাজের
জন্য পুরোপুরি দায়ী হবে।
তৃতীয়ত মুনাফিকদেরকে পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দেয়া। তাদেরকে এ মর্মে জানিয়ে দেয়া যে, মু’মিনদের জন্য আল্লাহর যে
ওয়াদা রয়েছে তা কেবলমাত্র তাদের জন্য যারা সাচ্চা দিলে ঈমান আনে এবং তারপর এ
ঈমানের দাবী পূরণ করে। এ প্রতিশ্রুতি এমন লোকদের জন্য নয় যারা নিছক আদমশুমারীর মাধ্যমে মুসলমানদের
দলে ভিড়ে গেছে। কাজেই মুনাফিক ও ফাসিকদের এ
প্রতিশ্রুতির মধ্য থেকে কিছু অংশ পাওয়ার আশা করা উচিত নয়।
৬২. আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী শব্দ সাধারণভাবে কুরআন মজীদে
“বিশ্ব-জাহান” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই অন্য কথায় আয়াতের অনুবাদ এও হতে পারেঃ আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আলো।
আলো বলতে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে যার বদৌলতে দ্রব্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ যে নিজে নিজে প্রকাশিত হয় এবং অন্য
জিনিসকেও প্রকাশ করে দেয়।
মানুষের চিন্তায় নূর ও আলোর এটিই আসল অর্থ। কিছুই না দেখা যাওয়ার অবস্থাকে মানুষ অন্ধকার নাম দিয়েছে। আর এ বিপরীতে যখন সবকিছু দেখা যেতে থাকে এবং
প্রত্যেকটি জিনিস প্রকাশ হয়ে যায় তখন মানুষ বলে আলো হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলার জন্য “নূর” তথা আলো শব্দটির ব্যবহার ও
মৌলিক অর্থের দিক দিয়েই করা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ তিনি এমন কোন আলোকরশ্মি নন যা সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল
বেগে চলে এবং আমাদের চোখের পর্দায় পড়ে মস্তিষ্কের দৃষ্টি কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে, আলোর এ ধরণের কোন অর্থ এখানে
নেই। মানুষের মস্তিষ্ক এ অর্থের
জন্য এ শব্দটি উদ্ভাবন করেছে, আলোর এ বিশেষ অবস্থা সে অর্থের মৌল তত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তার ওপর এ শব্দটি আমরা এ বস্তুজগতে আমাদের
অভিজ্ঞতায় যে আলো ধরা দেয় তার দৃষ্টিতে প্রয়োগ করি। মানুষের ভাষায় প্রচলিত যতগুলো শব্দ আল্লাহর জন্য বলা হয়ে
থাকে সেগুলো তাদের আসল মৌলিক অর্থের দৃষ্টিতে বলা হয়ে থাকে, তাদের বস্তুগত অর্থের দৃষ্টিতে
বলা হয় না। যেমন আমরা তাঁর জন্য দেখা
শব্দটি ব্যবহার করি। এর
অর্থ এ হয় না যে, তিনি মানুষ ও পশুর মতো চোখ নামক একটি অংগের মাধ্যমে দেখেন। আমরা তাঁর জন্য শোনা শব্দ ব্যবহার করি। এর মানে এ নয় যে, তিনি আমাদের মতো কানের
সাহায্যে শোনেন।
তাঁর জন্য আমরা পাকড়াও ও ধরা শব্দ ব্যবহার করি। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি হাত নামক একটি অংগের সাহায্যে ধরেন। এসব শব্দ সবসময় তাঁর জন্য একটি প্রায়োগিক
মর্যাদায় বলা হয়ে থাকে এবং একমাত্র একজন স্বল্প বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এ ভুল ধারণা
করতে পারে যে, আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় শোনা, দেখা ও ধরার যে
সীমাবদ্ধ ও বিশেষ আকৃতি রয়েছে তার বাইরে এগুলোর অন্য কোন আকৃতি ও ধরন হওয়া অসম্ভব। অনুরূপভাবে “নূর” বা আলো সম্পর্কেও একথা মনে
করা নিছক একটি সংকীর্ণ চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, এর অর্থের ক্ষেত্র শুধুমাত্র
এমন রশ্মিরই আকারে পাওয়া যেতে পারে যা কোন উজ্জ্বল অবয়ব থেকে বের হয়ে এসে চোখের
পর্দায় প্রতিফলিত হয়। এ সীমিত অর্থে আল্লাহ আলো নন বরং ব্যাপক, সার্বিক ও আসল অর্থে আলো। অর্থাৎ এ বিশ্ব-জাহানে তিনিই এক আসল “প্রকাশের
কার্যকারণ”, বাকি সবই এখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যান্য আলোক বিতরণকারী জিনিসগুলোও তাঁরই দেয়া আলো থেকে
আলোকিত হয় ও আলো দান করে।
নয়তো তাদের কাছে নিজের এমন কিছু নেই যার সাহায্যে তারা এ ধরনের বিস্ময়কর কাণ্ড
করতে পারে।
আলো শব্দের ব্যবহার জ্ঞান অর্থেও হয় এবং এর বিপরীতে অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাকে
অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এ অর্থেও আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের আলো। কেননা, এখানে সত্যের সন্ধান ও সঠিক পথের জ্ঞান একমাত্র তাঁর মাধ্যমেই
এবং তার কাছ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। তাঁর দান গ্রহণ করা ছাড়া মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার এবং
তার ফলশ্রুতিতে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।
৬৩. মুবারক অর্থাৎ বহুল উপকারী, বহুমুখী কল্যাণের ধারক।
৬৪. অর্থাৎ যা খোলা ময়দানে বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করে। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর রোদ
পড়ে। তার সামনে পেছনে কোন আড়
থাকে না যে, কেবল সকালের রোদটুকু বা বিকালের রোদটুকু তার ওপর পড়ে। এমন ধরনের যয়তুন গাছের তেল বেশী স্বচ্ছ হয়
এবং বেশী উজ্জ্বল আলো দান করে। নিছক পূর্ব বা নিছক পশ্চিম অঞ্চলের যয়তুন গাছ তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছ তেল
দেয় এবং প্রদীপে তার আলোও হালকা থাকে।
৬৫. এ উপমায় প্রদীপের সাথে আল্লাহর সত্তাকে এবং তাদের সাথে
বিশ্ব-জাহানকে তুলনা করা হয়েছে। আর চিমনি বলা হয়েছে এমন পর্দাকে যার মধ্যে মহাসত্যের অধিকারী সমস্ত
সৃষ্টিকুলের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন, অর্থাৎ এ পর্দাটি যেন গোপন
করার পর্দা নয় বরং প্রবল প্রকাশের পর্দা। সৃষ্টির দৃষ্টি যে তাঁকে দেখতে অক্ষম এর কারণ এটা নয় যে, মাঝখানে অন্ধকার আছে, বরং আসল কারণ হচ্ছে, মাঝখানের পর্দা স্বচ্ছ এবং এ
স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে আগত আলো এত বেশী তীক্ষ্ম, তীব্র,
অবিমিশ্র ও পরিবেষ্টনকারী যে, সীমিত শক্তি
সম্পন্ন চক্ষু তা দেখতে অক্ষম হয়ে গেছে। এ দুর্বল চোখগুলো কেবলমাত্র এমন ধরনের সীমাবদ্ধ আলো দেখতে
পারে যার মধ্যে কমবেশী হতে থাকে, যা কখনো অন্তর্হিত আবার কখনো উদিত হয়, যার
বিপরীতে কোন অন্ধকার থাকে এবং নিজের বিপরীতধর্মীর সামনে এসে সে সমুজ্জ্বল হয়। কিন্তু নিরেট, ভরাট ও ঘন আলো, যার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগীই নেই, যা কখনো
অন্তর্হিত ও নিশ্চিহ্ন হয় না এবং যা সবসময় একইভাবে সব দিক আচ্ছন্ন করে থাকে তাকে
পাওয়া ও তাকে দেখা এদের সাধ্যের বাইরে।
আর “এ প্রদীপটি যয়তুনের এমন একটি মুবারক গাছের তেল দিয়ে উজ্জ্বল করা হয় যা
পূর্বেরও নয় পশ্চিমের নয়।” এ
বক্তব্য কেবলমাত্র প্রদীপের আলোর পূর্ণতা ও তার তীব্রতার ধারণা দেবার জন্য বলা
হয়েছে। প্রাচীন যুগে যয়তুনের তেলের
প্রদীপ থেকে সর্বাধিক পরিমাণ আলোক লাভ করা হতো। এর মধ্যে আবার উঁচু ও খোলা জায়গায় বেড়ে ওঠা যয়তুন গাছগুলো
থেকে যে তেল উৎপন্ন হতো সেগুলোর প্রদীপের আলো হতো সবচেয়ে জোরালো। উপমায় এ বিষয়বস্তুর বক্তব্য এই নয় যে, প্রদীপের সাথে আল্লাহর যে
সত্তার তুলনা করা হয়েছে তা অন্য কোন জিনিস থেকে শক্তি (Energy) অর্জন করছে। বরং একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, উপমায় কোন মামুলি ধরনের প্রদীপ নয় বরং
তোমাদের দেখা উজ্জ্বলতম প্রদীপের কথা চিন্তা করো। এ ধরনের প্রদীপ যেমন সারা বাড়ি আলোকাজ্জল করে ঠিক তেমনি
আল্লাহর সত্তাও সারা বিশ্ব-জাহানকে আলোক নগরীতে পরিণত করে রেখেছে।
আর এই যে বলা হয়েছে, “তার তেল আপনা আপনিই জ্বলে ওঠে আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও”, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রদীপের আলোকে অত্যধিক তীব্র করার ধারণা দেয়া। অর্থাৎ উপমায় এমন সর্বাধিক তীব্র আলো দানকারী
প্রদীপের কথা চিন্তা করো যার মধ্যে এ ধরণের স্বচ্ছ ও চরম উত্তেজক তেল রয়েছে। এ তিনটি জিনিস অর্থাৎ যয়তুন, তার পুরবীয় ও পশ্চিমী না হওয়া
এবং আগুনের স্পর্শ ছাড়াই তার তেলের আপনা আপনি জ্বলে ওঠা উপমার স্বতন্ত্র অংশ নয়
বরং উপমার প্রথম অংশের অর্থাৎ প্রদীপের আনুসঙ্গিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। উপমার আসল অংশ তিনটিঃ প্রদীপ, তাক ও স্বচ্ছ চিমনি বা কাঁচের
আবরণ।
আয়াতের “তাঁর আলোর উপমা যেমন” এ বাক্যাংশটিও উল্লেখযোগ্য। “আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আলো” আয়াতের একথাগুলো পড়ে
কারোর মনে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারতো ওপরের বাক্যাংশটির মাধ্যমে তা দূর হয়ে
যায়। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহকে “আলো” বলার মানে এ নয়
যে, নাউযুবিল্লাহ, আলোই তাঁর স্বরূপ। আসলে তিনি তো হচ্ছেন একটি পরিপূর্ণ ও পূর্ণাংগ
সত্তা। তিনি জ্ঞানী, শক্তিশালী, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ইত্যাদি হবার সাথে সাথে আলোর
অধিকারীও। কিন্তু তাঁর সত্তাকে আলো
বলা হয়েছে নিছক তাঁর আলোকোজ্জলতার পূর্ণতার কারণে। যেমন কারোর দানশীলতা গুণের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করার জন্য
তাকেই “দান” বলে দেয়া অথবা তার সৌন্দর্যের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে স্বয়ং
তাকেই সৌন্দর্য আখ্যা দেয়া।
৬৬. যদিও আল্লাহর এ একক ও একচ্ছত্র আলো সমগ্র বিশ্ব-জাহান
আলোকিত করছে কিন্তু তা দেখার, জানার ও উপলব্ধি করার সৌভাগ্য সবার হয় না। তা উপলব্ধি করার সুযোগ এবং তার দানে অনুগৃহীত
হবার সৌভাগ্য আল্লাহই যাকে চান তাকে দেন। নয়তো অন্ধের জন্য যেমন দিনরাত সমান ঠিক তেমনি অবিবেচক ও
অদূরদর্শী মানুষের জন্য বিজলি, সূর্য, চাঁদ ও তারার আলো তো আলোই,
কিন্তু আল্লাহর নূর ও আলো সে ঠাহর করতে পারে না। এ দিক থেকে এ দুর্ভাগার জন্য বিশ্ব-জাহানে
সবদিকে অন্ধকারই অন্ধকার।
দু’চোখ অন্ধ। তাই নিজের একান্ত কাছের
জিনিসই সে দেখতে পারে না।
এমনকি তার সাথে ধাক্কা খাওয়ার পরই সে জানতে পারে এ জিনিসটি এখানে ছিল। এভাবে ভিতরের চোখ যার অন্ধ অর্থাৎ যার
অন্তর্দৃষ্টি নেই সে তার নিজের পাশেই আল্লাহর আলোয় যে সত্য জ্বলজ্বল করছে তাকেও
দেখতে পায় না। যখন সে তার সাথে ধাক্কা
খেয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের শিকলে বাঁধা পড়ে কেবলমাত্র তখনই তার সন্ধান পায়।
৬৭. এর দু’টি অর্থ হয়। এক, তিনি জানেন কোন্ সত্যকে কোন্ উপমার সাহায্যে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বুঝানো
যেতে পারে। দুই, তিনি জানেন কে নিয়ামতের হকদার
এবং কে নয়। যে ব্যক্তি সত্যের আলোর
সন্ধানী নয়, যে ব্যক্তি সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে নিজের পার্থিব স্বার্থেরই মধ্যে বিলীন হয়ে
যায় এবং বস্তুগত স্বাদ ও স্বার্থের সন্ধানে নিমগ্ন থাকে আল্লাহ জানেন যে, সে এর সন্ধানী ও ঐকান্তিক সন্ধানী সে-ই এ দান লাভের যোগ্য।
﴿فِي بُيُوتٍ
أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ
وَالْآصَالِ﴾
৩৬। (তাঁর
আলোর পথ অবলম্বনকারী)ঐ সব ঘরে পাওয়া যায়, যেগুলোকে উন্নত করার ও
যেগুলোর মধ্যে নিজের নাম স্মরণ করার হুকুম আল্লাহ দিয়েছেন।৬৮ সেগুলোতে
এমন সব লোক সকাল সাঁঝে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।
৬৮. কোন কোন মুফাস্সির এ “ঘরগুলো”কে মসজিদ অর্থে
গ্রহণ করেছেন এবং এগুলোকে উন্নত করার অর্থ নিয়েছেন এগুলো নির্মাণ ও এগুলোকে
মর্যাদা প্রদান করা।
আবার অন্য কতিপয় মুফাস্সির এর অর্থ নিয়েছেন মু’মিনদের ঘর এবং সেগুলোকে উন্নত করার
অর্থ তাঁদের মতে সেগুলোকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করা। “সেগুলোর মধ্যে নিজের নাম স্মরণ করার আল্লাহ হুকুম
দিয়েছেন” এ শব্দগুলো বাহ্যত মসজিদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার বেশী সমর্থক দেখা যায়। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে জানা যাবে
এটি প্রথম ব্যাখ্যাটির মতো এ দ্বিতীয় ব্যখ্যাটিরও সমান সমর্থক। কারণ আল্লাহর শরীয়াত বৈরাগ্যবাদগ্রস্ত ধর্মের
ন্যায় ইবাদাতকে কেবল ইবাদাতখানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে না। পুরোহিত বা পূজারী শ্রেণীর কোন ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া
সেখানে বন্দেগী ও পূজা-অর্চনা করা যেতে পারে না। বরং এখানে মসজিদের মত গৃহ ও ইবাদাতখানা এবং প্রত্যেক
ব্যক্তিই তার নিজের পুরোহিত। কাজেই এ সূরায় সকল প্রকার ঘরোয়া জীবন যাপনকে উচ্চ ও সমুন্নত করার নির্দেশ
দেয়া হয়েছে। তাই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি
পরিবেশ ও পরিস্থিতির দিক দিয়ে বেশী উপযোগী বলে আমাদের মনে হচ্ছে, যদিও প্রথম ব্যাখ্যাটিকে রদ
করে দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আমাদের কাছে নেই। বিচিত্র নয়, এর অর্থ হচ্ছে মু’মিনদের গৃহ ও মসজদি
দু’টোই।
﴿رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ
تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ
ۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ﴾
৩৭। যারা
ব্যবসায় ও বেচাকেনার ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ এবং নামায কায়েম ও যাকাত আদায়
করা থেকে গাফিল হয়ে যায় না। তারা সেদিনকে ভয় করতে থাকে
যেদিন হৃদয় বিপর্যস্ত ও দৃষ্টি পাথর হয়ে যাবার উপক্রম হবে।
﴿لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ
مَا عَمِلُوا وَيَزِيدَهُم مِّن فَضْلِهِ ۗ وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَن يَشَاءُ بِغَيْرِ
حِسَابٍ﴾
৩৮। (আর তারা
এসব কিছু এ জন্য করে) যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম কর্মের প্রতিদান দেন
এবং তদুপরি নিজ অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ
যাকে চান বেহিসেব দান করেন।৬৯
৬৯. আল্লাহর আসল আলো উপলব্ধি ও তার ধারায় অবগাহন করার জন্য
যেসব গুণের প্রয়োজন এখানে সেগুলোর ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছ। আল্লাহ অন্ধ বন্টনকারী নন। যাকে ইচ্ছা এমনি বিনা কারণে তার পাত্র এমনভাবে ভরে দেবেন
যে, উপচে পড়ে
যেতে থাকবে আবার যাকে ইচ্ছ গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন, এটা
আল্লাহর বণ্টন নীতি নয়। তিনি যাকে দেন, দেখে-শুনেই দেন। সত্যের নিয়ামত দান করার ব্যাপারে তিনি যা কিছু দেখেন তা হচ্ছেঃ মানুষের মনে
তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আগ্রহ, আকর্ষণ, ভয় এবং তাঁর
পুরস্কার গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা ও ক্রোধ থেকে বাঁচার অভিলাষ আছে। সে পার্থিব স্বার্থ পূজায় নিজেকে বিলীন করে
দেয়নি। বরং যাবতীয় কর্মব্যস্ততা
সত্ত্বেও তার সমগ্র হৃদয়-মন আচ্ছন্ন করে থাকে তার মহান প্রতিপালকের স্মৃতি। সে রসাতলে যেতে চায় না বরং কার্যত এমন
উচ্চমার্গে উন্নীত হতে চায় যেদিক তার মালিক তাকে পথ দেখাতে চায়। সে এ দু’দিনের জীবনের লাভ প্রত্যাশী হয় না বরং
তার দৃষ্টি থাকে আখেরাতের চিরন্তন জীবনের ওপর। এসব কিছু দেখে মানুষকে আল্লাহর আলোয় অবগাহন করার সুযোগ
দেবার ফায়সালা করা হয়।
তারপর যখন আল্লাহ দেবার জন্য এগিয়ে আসে তখন এত বেশী দিয়ে দেন যে, মানুষে নিজের নেবার পাত্র
সংকীর্ণ থাকলে তো ভিন্ন কথা, নয়তো তাঁর দেবার ব্যাপারে কোন
সীমাবদ্ধতা এবং শেষ সীমানা নেই।
﴿وَالَّذِينَ
كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّىٰ إِذَا
جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا وَوَجَدَ اللَّهَ عِندَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ ۗ وَاللَّهُ
سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
৩৯। কিন্তু
যারা কুফরী করে৭০ তাদের কর্মের উপমা হলো
পানিহীন মরুপ্রান্তরে মরীচিকা, তৃঞ্চাতুর পথিক তাকে পানি মনে করেছিল, কিন্তু যখন সে সেখানে পৌঁছুলো
কিছুই পেলো না বরং সেখানে সে আল্লাহকে উপস্থিত পেলো, যিনি তার পূর্ণ হিসেব মিটিয়ে
দিলেন এবং আল্লাহর হিসেব নিতে দেরী হয় না।৭১
৭০. অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবীগণ এবং সে
সময় আল্লাহর নবী সাইয়েদুনা মুহাম্মাদ সা. যে সত্যের শিক্ষা দিচ্ছিলেন সরল মনে তা
মেনে নিতে অস্বীকার করে।
ওপরের আয়াত নিজেই বলে দিচ্ছে, আল্লাহর আলো লাভকারী বলতে সাচ্চা ও সৎ মু’মিনদেরকে বুঝানো
হয়েছে। তাই এখন তাদের মোকাবিলায়
এমন সব লোকের অবস্থা জানানো হচ্ছে যারা এ আলো লাভের আসল ও একমাত্র মাধ্যম অর্থাৎ রাসূলকেই
মেনে নিতে ও তাঁর আনুগত্য করতে অস্বীকার করে। মন থেকে অস্বীকার করুক অথবা নিছক মৌখিক অস্বীকৃতির ঘোষণা
দিক কিংবা মনে ও মুখে উভয়ভাবে অস্বীকৃতি জানাক তাতে কিছু আসে যায় না।
৭১. এ উপমায় এমনসব লোকের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যারা কুফরী ও
মুনাফিকী সত্ত্বেও বাহ্যত সৎকাজও করে এবং মোটামুটিভাবে আখেরাতকেও মানে আবার এ অসার
চিন্তাও পোষণ করে যে, সাচ্চা ঈমান ও মু’মিনের গুণাবলী এবং রসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ ছাড়া এ
কার্যাবলী তাদের জন্য আখেরাতে কোন কাজে লাগবে না। উপমার আকারে তাদেরকে জানান হচ্ছে, তোমরা নিজেদের যেসব বাহ্যিক ও
প্রদর্শনীমূলক সৎকাজের মাধ্যমে আখেরাতে লাভবান হবার আশা রাখো সেগুলো নিছক মরীচিকা
ছাড়া আর কিছুই নয়।
মরুভূমিতে দূর থেকে চিকচিক করা বালুকারাশি দেখে যেমন পিপাসার্ত তাকে একটি তরংগায়িত
পানির দরিয়া মনে করে নিজের পিপাসা নিবৃত্তির জন্য ঊর্ধশ্বাসে সেদিকে দৌড়াতে থাকে, ঠিক তেমনি তোমরা এসব কর্মের
ওপর মিথ্যা ভরসা করে মৃত্যু মনযিলের পথ অতিক্রম করে চলছো। কিন্তু যেমন মরীচিকার দিকে ছুটে চলা ব্যক্তি
যখন যে স্থানে পানির দরিয়া আছে মনে করেছিল সেখানে পৌঁছে কিছুই পায় না ঠিক তেমনি
তোমরা যখন মৃত্যু মনযিলে প্রবেশ করবে তখন জানতে পারবে সেখানে এমন কোন জিনিস নেই যা
থেকে তোমরা লাভবান হতে পারবে। বরং এর বিপরীত দেখবে তোমাদের কুফরী ও মুনাফিকী এবং লোক দেখানো সৎকাজের সাথে
তোমরা যেসব খারাপ কাজ করেছিলে সেগুলোর হিসেব নেবার এবং পুরোপুরি প্রতিদান দেবার
জন্য আল্লাহ সেখানে উপস্থিত রয়েছেন।
﴿أَوْ كَظُلُمَاتٍ فِي بَحْرٍ
لُّجِّيٍّ يَغْشَاهُ مَوْجٌ مِّن فَوْقِهِ مَوْجٌ مِّن فَوْقِهِ سَحَابٌ ۚ ظُلُمَاتٌ
بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ إِذَا أَخْرَجَ يَدَهُ لَمْ يَكَدْ يَرَاهَا ۗ وَمَن لَّمْ
يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِن نُّورٍ﴾
৪০। অথবা তার
উপমা যেমন একটি গভীর সাগর বুকে অন্ধকার। ওপরে ছেয়ে
আছে একটি তরংগ, তার ওপরে
আর একটি তরংগ আর তার ওপরে মেঘমালা অন্ধকারের ওপর অন্ধকার আচ্ছন্ন। মানুষ
নিজের হাত বের করলে তাও দেখতে পায় না।৭২ যাকে
আল্লাহ আলো দেন না তার জন্য আর কোন আলো নেই।৭৩
৭২. এ উপমায় সকল কাফের মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা
করা হয়েছে। লোক দেখানো সৎকাজকারীরাও এর
অন্তর্ভুক্ত। এদের সবার সম্পর্কে বলা
হচ্ছে, জাগতিক
পরিভাষায় তারা মহাপণ্ডিত ও জ্ঞান সাগরের মহান দিশারী হলেও হতে পারে কিন্তু নিজেদের
সমগ্র জীবন যাপন করছে তারা চরম ও পূর্ণ মূর্খতার মধ্যে। তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তির মতো যে এমন কোন
জায়গায় আবদ্ধ হয়ে আছে যেখানে পুরোপুরি অন্ধকারের রাজত্ব, আলোর সামান্যতম শিখাও যেখানে
পৌঁছতে পারে না।
তারা মনে করে আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, শব্দের চেয়ে দ্রুত গতি সম্পন্ন
বিমান এবং চাঁদে ও গ্রহান্তরে পাড়ি দেবার জন্য মহাশূন্য যান তৈরী করার নাম জ্ঞান। তাদের মতে, খাদ্য নীতি, অর্থনীতি,
আইন শাস্ত্র ও দর্শনে পারদর্শিতা অর্জন করার নাম জ্ঞান। কিন্তু আসল জ্ঞান এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন
জিনিসের নাম। তার স্পর্শ থেকে তারা অনেক
দূর রয়ে গেছে। সেই জ্ঞানের দৃষ্টিতে তারা
নিছক মূর্খ ও অজ্ঞ ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে একজন অশিক্ষিত গেঁয়ো যদি সত্যকে চেনে ও উপলব্ধি করে তাহলে সে
জ্ঞানবান।
৭৩. এখানে পৌঁছে আসল কথা পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। এর সূচনা করা হয়েছিল اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ এর বিষয়বস্তু থেকে। বিশ্ব-জাহানে যখন মূলত আল্লাহর আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই
এবং সে আলো থেকেই হচ্ছে যাবতীয় সত্যের প্রকাশ তখন যে ব্যক্তি আল্লাহর আলো পাবে না
সে পূর্ণ ও নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে থাকবে না তো আর কি হবে? আর কোথাও তো আলো নেই। কাজেই অন্য কোথাও থেকে আলোর একটি শিখাও লাভ
করার সম্ভাবনা করো নেই।
﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ
يُسَبِّحُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ ۖ كُلٌّ قَدْ
عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ﴾
৪১। তুমি৭৪ কি দেখ না, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা
করেছে যারা আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তারা সবাই এবং যে পাখির ডানা বিস্তার করে
আকাশে ওড়ে? প্রত্যেকেই জানে তার নামাযের ও পবিত্রতা বর্ণনা করার পদ্ধতি। আর এরা যা
কিছু করে আল্লাহ তা জানেন।
৭৪. ওপরে বলা হয়েছে, আল্লাহ সমগ্র-জাহানের আলো
কিন্তু একমাত্র সৎ মু’মিনরাই এ আলো লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন, বাদবাকি সব লোকেরাই এ পূর্ণাঙ্গ আলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও ঘোর
অন্ধকারে অন্ধের মতো হাতড়ে মরে। এখন এ আলোর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে নমুনা
স্বরূপ মাত্র কয়েকটি এখানে পেশ করা হচ্ছে। মনের চোখ খুলে কেউ সেগুলোর দিকে তাকালে সবসময় সবদিকে
আল্লাহকেই সক্রিয় দেখতে পাবে। কিন্তু যাদের মনের চোখ অন্ধ তারা কপালের দুটো চোখ বিস্ফোরিত করে দেখলেও
জীববিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যার বিভিন্ন রকম বিদ্যা তাদের চোখে ভালমতোই সক্রিয় রয়েছে
বলে তাদের চোখে ঠেকবে কিন্তু আল্লাহকে কোথাও সক্রিয় দেখতে পাবে না।
﴿وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضِ ۖ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ﴾
৪২। আকাশ
মন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই এবং তাঁরই দিকে সবাই ফিরে যেতে হবে।
﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ
يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ رُكَامًا فَتَرَى الْوَدْقَ
يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ مِن جِبَالٍ فِيهَا مِن بَرَدٍ
فَيُصِيبُ بِهِ مَن يَشَاءُ وَيَصْرِفُهُ عَن مَّن يَشَاءُ ۖ يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِ
يَذْهَبُ بِالْأَبْصَارِ﴾
৪৩। তুমি কি
দেখ না, আল্লাহ মেঘমালাকে ধীর গতিতে সঞ্চালন করেন, তারপর তার খন্ডগুলোকে পরস্পর
সংযুক্ত করেন, তারপর তাকে
একত্র করে একটি ঘন মেঘে পরিণত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার খোল থেকে বৃষ্টি
বিন্দু একাধারে ঝরে পড়ছে। আর তিনি আকাশ থেকে তার মধ্যে
সমুন্নত পাহাড়গুলোর বদৌলতে ৭৫ শিলা বর্ষণ করেন, তারপর যাকে চান এর দ্বারা
ক্ষতিগ্রস্ত করেন এবং যাকে চান এর হাত থেকে বাঁচিয়ে নেন। তার
বিদ্যুৎচমক চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
৭৫. এর অর্থ ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া মেঘপুঞ্জও হতে পারে
রূপক অর্থে একেই হয়তো আকাশের পাহাড় বলা হয়েছে। আবার পৃথিবীর পাহাড়ও হতে পারে, যা শূন্যে মাথা উঁচু করে
দাঁড়িয়ে আছে।
এগুলোর চূড়ায় জমে থাকা বরফের প্রভাবে অনেক সময় বাতাস এত বেশী ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে, মেঘমালা জমে গিয়ে শিলা বৃষ্টি
হতে থাকে।
﴿يُقَلِّبُ اللَّهُ اللَّيْلَ
وَالنَّهَارَ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِي الْأَبْصَارِ﴾
৪৪। তিনিই
রাত-দিনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য এর
মধ্যে রয়েছে একটি শিক্ষা।
﴿وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ
مِّن مَّاءٍ ۖ فَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَىٰ بَطْنِهِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَىٰ
رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِي عَلَىٰ أَرْبَعٍ ۚ يَخْلُقُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ
ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৪৫। আর আল্লাহ
প্রত্যেক প্রাণ বিশিষ্টকে এক ধরনের পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্য
থেকে কেউ চলেছে পেটে ভর দিয়ে, কেউ চলেছে দু’পায়ে হেঁটে আবার কেউ চারপায়ে
ভর দিয়ে। যা কিছু তিনি চান পয়দা করেন, তিনি প্রত্যেক জিনিসের ওপর
শক্তিশালী।
﴿لَّقَدْ أَنزَلْنَا آيَاتٍ
مُّبَيِّنَاتٍ ۚ وَاللَّهُ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾
৪৬। আমি
পরিষ্কার সত্য বিবৃতকারী আয়াত নাযিল করে দিয়েছি তবে আল্লাহই যাকে চান সত্য সরল পথ
দেখান।
﴿وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللَّهِ
وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٌ مِّنْهُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ
ۚ وَمَا أُولَٰئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ﴾
৪৭। তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রাসূলের
প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল
(আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মু’মিন
নয়।৭৬
৭৬. অর্থাৎ আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াই তাদের
ঈমানের দাবী মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। তাদের এহেন কার্যকলাপ থেকে বুঝা যায় যে, তারা যখন বলেছে আমরা ঈমান এনেছি ও আনুগত্য
স্বীকার করেছি তখন তারা অসত্য বলেছে।
﴿وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ
وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُم مُّعْرِضُونَ﴾
৪৮। যখন
তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে, যাতে রাসূল তাদের পরস্পররে
মোকদ্দমার ফায়সালা করে দেন৭৭ তখন তাদের মধ্যকার একটি দল
পাশ কাটিয়ে যায়।৭৮
৭৭. এ শব্দগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, রসূলের ফায়সালা হচ্ছে আল্লাহর
ফায়সালা এবং তাঁর হুকুম আল্লাহরই হুকুমের নামান্তর মাত্র। রসূলের দিকে আহবান করা নিছক রসূলের দিকেই
আহবান করা নয় বরং আল্লাহ ও রাসূল উভয়েরই দিকে আহবান করা। তাছাড়া এ আয়াতটি এবং ওপরের আয়াতটি থেকে একথা নিঃসন্দেহে
পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য ছাড়া ঈমানের দাবী অর্থহীন এবং আল্লাহ
ও রসূলের আনুগত্যের এছাড়া আর কোন অর্থ নেই যে, মুসলমান
ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দেয়া আইনের অনুগত হবে। সে যদি এ কর্মনীতি অবলম্বন না করে, তাহলে তার ঈমানের দাবী একটি
মুনাফিকী দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়। (তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য সূরা নিসা ৫৯-৬১ আয়াত ৮৯-৯২ টীকা
সহকারে দেখুন)।
৭৮. উল্লেখ্য, এ ব্যাপারটি কেবল মাত্র নবী সা. এর জীবনেরই জন্য ছিল না বরং
তারপর যিনিই ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকের পদে আসীন থাকেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের
সুন্নাত অনুযায়ী ফায়সালা দেন তাঁর আদালতের সমন হচ্ছে আসলে আল্লাহ ও রসূলের আদালতের
সমন এবং যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে মূলত তা থেকে নয় বরং আল্লাহ ও
রসূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নবী সা. এর একটি মুরসাল হাদীসে এ বিষয়ে এ ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে। হাসান বস্রী রহমাতুল্লাহে আলাইহে এ হাদীসটি
রেওয়ায়াত করেছেন। হাদীসটি হচ্ছেঃ
مَنْ دُعِىَ إِلَى حَاكِمٍ مِنْ حُكَّامِ الْمُسْلِمِينَ
فَلَمْ يُجِبْ فَهُوَ ظَالِمٌ لاَ حَقَّ لَهُ
“যে ব্যক্তিকে মুসলমানদের আদালতের বিচারপতিদের মধ্য থেকে কোন বিচারপতির
কাছে ডাকা হয় এবং সে হাজির হয় না সে জালেম, তার কোন অধিকার
নেই।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩ খণ্ড, ৪০৫
পৃষ্ঠা)
অন্য কথায় এ ধরনের লোক শাস্তি লাভের যোগ্য আবার এ সঙ্গে তাকে অন্যায়কারী
প্রতিপন্ন করে তার বিরুদ্ধে একতরফা ফায়সালা দিয়ে দেয়াও ন্যায়সঙ্গত।
﴿وَإِن يَكُن لَّهُمُ الْحَقُّ
يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ﴾
৪৯। তবে যদি
সত্য তাদের অনুকূল থাকে, তাহলে বড়ই বিনীত হয়ে রাসূলের কাছে আসে।৭৯
৭৯. এ আয়াতটি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করছে যে, শরীয়াতের লাভজনক কথাগুলোকে যে
ব্যক্তি সানন্দে গ্রহণ করে নেয় কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু তার স্বার্থ ও
আশা-আকাংখার বিরোধী হয় তাকে সে প্রত্যাখ্যান করে এবং তার মোকাবিলায় দুনিয়ার
অন্যান্য আইনকে প্রাধান্য দেয়, সে মু’মিন নয় বরং মুনাফিক। তার ঈমানের দাবী মিথ্যা। কারণ সে আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান রাখে না বরং ঈমান রাখে
নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ওপর। এ নীতি অবলম্বন করে এর সাথে সাথে সে যদি আল্লাহর শরীয়াতের কোন অংশকে মেনেও
নেয়, তাহলে
আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ধরনের মেনে নেয়ার কোন মূল্য ও মর্যাদা নেই।
﴿أَفِي
قُلُوبِهِم مَّرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا أَمْ يَخَافُونَ أَن يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ
وَرَسُولُهُ ۚ بَلْ أُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾
৫০। তাদের মনে
কি (মুনাফিকীর) রোগ আছে? না তারা সন্দেহের শিকার হয়েছে? না তারা ভয় করছে আল্লাহ ও
তাঁর রাসূল তাদের প্রতি যুলুম করবেন? আসলে তারা নিজেরাই যালেম।৮০
৮০. অর্থাৎ মানুষের এ কর্মনীতি অবলম্বনের পেছনে তিনটি সম্ভাব্য
কারণই থাকতে পারে। এক, যে মানুষটি ঈমানের দাবীদার সে
আসলে ঈমানই আনেনি এবং মুনাফিকী পদ্ধতিতে নিছক ধোঁকা দেবার এবং মুসলিম সমাজে প্রবেশ
করে অবৈধ স্বার্থলাভের জন্য মুসলমান হয়েছে। দুই, ঈমান আনা সত্ত্বেও তার মনে এ মর্মে সন্দেহ রয়ে গেছে যে,
রাসূল আসলে আল্লাহর রাসূল কি না, কুরআন
আল্লাহর কিতাব কি না এবং কেয়ামত সত্যি সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না অথবা এগুলো সবই
নিছক মুখরোচক গালপল্প বরং আসলে আল্লাহর অস্তিত্ব আছে কি অথবা এটাও নিছক একটা
কল্পনা, কোন বিশেষ স্বার্থোদ্বারের উদ্দেশ্যে এ কাল্পনিক
বিষয়টি তৈরী করে নেয়া হয়েছে। তিন, সে আল্লাহকে আল্লাহ এবং রাসূলকে রাসূল বলে মেনে নেবার পরও তাঁদের পক্ষ
থেকে জুলুমের আশঙ্কা করে। সে মনে করে আল্লাহর কিতাব অমুক হুকুমটি দিয়ে তো আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে এবং
আল্লাহর রসূলের অমুক উক্তি বা অমুক পদ্ধতি আমাদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এ তিনটি কারণের মধ্যে যেটিই সত্য হোক না কেন, মোটকথা এ ধরনের লোকদের জালেম
হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এ ধরনের চিন্তা সহকারে যে ব্যক্তি মুসলমানদের দলভুক্ত হয়, ঈমানের দাবী করে এবং মুসলিম
সমাজের একজন সদস্য সেজে এ সমাজ থেকে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্বার্থ হাসিল করতে থাকে,
সে একজন বড় দাগাবাজ, বিশ্বাসঘাতক, খেয়ানতকারী ও জালিয়াত। সে নিজের ওপরও জুলুম করে। রাত-দিন মিথ্যাচারের মাধ্যমে নিজেকে সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাবের মানুষে পরিণত
করতে থাকে। সে এমন ধরনের মুসলমানদের
প্রতিও যুলুম করে যারা তার বাহ্যিক কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের ওপর নির্ভর করে তাকে এ
মিল্লাতের এটি অংশ বলে মেনে নেয় এবং তারপর তার সাথে নানান ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
﴿إِنَّمَا
كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ
أَن يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
৫১। মু’মিনদের
কাজই হচ্ছে, যখন
তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রাসূল তাদের মোকদ্দমার ফায়সালা করেন, তখন তারা বলেন, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। এ ধরনের
লোকেরাই সফলকাম হবে।
﴿وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ﴾
৫২। আর সফলকাম
তারাই যারা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মেনে চলে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর
নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে।
﴿وَأَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ
أَيْمَانِهِمْ لَئِنْ أَمَرْتَهُمْ لَيَخْرُجُنَّ ۖ قُل لَّا تُقْسِمُوا ۖ طَاعَةٌ
مَّعْرُوفَةٌ ۚ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾
৫৩। এ
মুনাফিকরা আল্লাহর নামে শক্ত কসম খেয়ে, বলে, “ আপনি হুকুম দিলে আমরা অবশ্যই
ঘর থেকে বের হয়ে পড়বো। “ তাদেরকে
বলো, “ কসম খেয়ো
না, তোমাদের আনুগত্যের অবস্থা জানা আছে।৮১ তোমাদের
কার্যকালাপ সম্বন্ধে আল্লাহ বেখবর নন।৮২
৮১. দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে, মু’মিনদের থেকে কাংখিত আনুগত্য
হচ্ছে এমন পরিচিত ধরনের আনুগত্য যা সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকে। তা এমন ধরনের আনুগত্য নয় যার নিশ্চয়তা দেবার
জন্য কসম খাবার প্রয়োজন হয় এবং এরপরও তার প্রতি অবিশ্বাস থাকে। যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আদেশের অনুগত হয়
তাদের মনোভাব ও কর্মনীতি গোপন থাকে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের কার্যধারা দেখে অনুভব করে, এরা আনুগত্যশীল লোক। তাদের ব্যাপারে এমন কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশই
নেই যে, তা দূর করার জন্য কসম খাবার প্রয়োজন দেখা দেবে।
৮২. অর্থাৎ সৃষ্টির মোকাবিলায় এ প্রতারণা হয়তো সফল হয়ে যেতে
পারে কিন্তু আল্লাহর মোকাবিলায় কেমন করে সফল হতে পারে? তিনি তো প্রকাশ্য ও গোপন সকল
অবস্থা বরং মনের প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা, চিন্তা ও আশা-আকাংখাও
জানেন।
﴿قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا
الرَّسُولَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ
ۖ وَإِن تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا ۚ وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾
৫৪। বলো, “ আল্লাহর অনুগত হও এবং রাসূলের
হুকুম মেনে চলো। কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। তাহলো
ভালোভাবে জেনে রাখো, রাসূলের
ওপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য রাসূল দায়ী এবং তোমাদের ওপর যে
দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য তোমরাই দায়ী। তাঁর
আনুগত্য করলে তোমরা নিজেরাই সৎ পথ পেয়ে যাবে, অন্যথায় পরিষ্কার ও
দ্ব্যর্থহীন হুকুম শুনিয়ে দেয়া ছাড়া রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই।”
﴿وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ
آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا
اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ
لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ
بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
৫৫। আল্লাহ
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে
তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত
লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে
দেবেন, যাকে
আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায়
পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা শুধু আমার বন্দেগী করুক
এবং আমার সাথে কাউকে যেন শরীক না করে।৮৩ আর যারা
এরপর কুফরী করবে৮৪ তারাই ফাসেক।
৮৩. এ বক্তব্যের শুরুতেই আমি ইঙ্গিত করেছি, এ উক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে
মুনাফিকদেরকে এ মর্মে সতর্ক করা যে, আল্লাহ মুসলমানদের
খিলাফত দান করার যে প্রতিশ্রুতি দেন তা নিছক আদমশুমারীর খাতায় যাদের নাম মুসলমান
হিসেবে লেখা হয়েছে তাদের জন্য নয় বরং এমন মুসলমানদের জন্য যারা সাচ্চা ঈমানদার,
চরিত্র ও কর্মের দিক দিয়ে সৎ, আল্লাহর
পছন্দনীয় দ্বীনের আনুগত্যকারী এবং সব ধরনের শিরক মুক্ত হয়ে নির্ভেজাল আল্লাহর
বন্দেগী ও দাসত্বকারী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, নিছক মুখে ঈমানের দাবীদার, তারা এ
প্রতিশ্রুতি লাভের যোগ্য নয় এবং তাদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি দানও করা হয়নি। কাজেই তারা যেন এর অংশীদার হবার আশা না রাখে।
কেউ কেউ খিলাফতকে নিছক রাষ্ট্র ক্ষমতা, রাজ্য শাসন, প্রাধান্য
ও প্রতিপত্তি অর্থে গ্রহণ করেন। তারপর আলোচ্য আয়াত থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, দুনিয়ায় যে ব্যক্তিই এ শক্তি
অর্জন করে সে মু’মিন, সৎ, আল্লাহর
পছন্দনীয় দ্বীনের অনুসারী, আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বকারী এবং
শিরক থেকে দূরে অবস্থানকারী। এরপর তারা নিজেদের এ ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রতিপন্ন করার জন্য ঈমান, সৎকর্মশীলতা, সত্য দ্বীন, আল্লাহর ইবাদাত ও শির্ক তথা প্রত্যেকটি
জিনিসের অর্থ বিকৃত করে তাকে এমন কিছু বানিয়ে দেন যা তাদের এ মতবাদের সাথে খাপ
খেয়ে যায়। এটা কুরআনের নিকৃষ্টতম
অর্থগত বিকৃতি। এ বিকৃতি ইহুদী ও
খৃস্টানদের বিকৃতিকেও ম্লান করে দিয়েছে। এ বিকৃতির মাধ্যমে কুরআনের একটি আয়াতের এমন একটি অর্থ করা
হয়েছে যা সমগ্র কুরআনের শিক্ষাকে বিকৃত করে দেয় এবং ইসলামের কোন একটি জিনিসকেও তার
স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয় না। খিলাফতের এ সংজ্ঞা বর্ণনা করার পর নিশ্চিতভাবে এমন সব লোকের ওপর এ আয়াত
প্রযোজ্য হয় যারা কখনো দুনিয়ায় প্রাধান্য ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে অথবা বর্তমানে
রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। তারা আল্লাহ, অহী, রিসালাত, আখেরাত সবকিছু
অস্বীকারকারী হতে পারে এবং ফাসেকী ও অশ্লীলতার এমন সব মলিনতায় আপ্লুতও হতে পারে
যেগুলোকে কুরআন কবীরা গুনাহ তথা বৃহৎ পাপ গণ্য করেছে, যেমন
সুদ, ব্যভিচার, মদ, জুয়া।
এখন যদি এসব লোক সৎ মু’মিন হয়ে থাকে এবং এজন্যই তাদেরকে খিলাফতের উন্নত আসনে
অধিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে, তাহলে এরপর ঈমানের অর্থ প্রাকৃতিক আইন মেনে নেয়া এবং সৎকর্মশীলতা অর্থ এ
আইনগুলোকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা ছাড়া আর কি হতে পারে? আর
আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন বলতে প্রাণী বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা ও
জ্যোতির্বিদ্যা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে শিল্প, কারিগরী,
বাণিজ্য ও রাজনীতিতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করা ছাড়া আর কি হতে পারে?
এরপর আল্লাহর বন্দেগী বলতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচেষ্টা ও
সংগ্রামে সাফল্য লাভ করার জন্য যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রকৃতিগতভাবে লাভজনক ও
অপরিহার্য হয়ে থাকে সেগুলো মেনে চলা ছাড়া আর কি হতে পারে? তারপর
এ লাভজনক নিয়ম-কানুনের সাথে কোন ব্যক্তি বা জাতি কিছু ক্ষতিকর পদ্ধতি অবলম্বন করলে
তাকেই শির্ক নামে অভিহিত করা ছাড়া আর কাকে শির্ক বলা যাবে? কিন্তু
যে ব্যক্তি কখনো দৃষ্টি ও মন আচ্ছন্ন না রেখে বুঝে কুরআন পড়েছে সে কি কখনো একথা
মেনে নিতে পারে যে, সত্যিই কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ঈমান,
সৎকাজ, সত্য দ্বীন, আল্লাহর
ইবাদাত এবং তাওহীদ ও শিরকের এ অর্থই হয়? যে ব্যক্তি কখনো
পুরো কুরআন বুঝে পড়েনি এবং কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত নিয়ে সেগুলোকে নিজের চিন্তা-কল্পনা
ও মতবাদ অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়েছে সে-ই কেবল এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অথবা এমন এক ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে, যে কুরআন পড়ার সময় এমন সব
আয়াতকে একেবারেই অর্থহীন ও ভুল মনে করেছে যেগুলোতে আল্লাহকে একমাত্র রব ও ইলাহ,
তাঁর নাযিল করা অহীকে পথনির্দেশনার একমাত্র উপায় এবং তাঁর পাঠানো
প্রত্যেক নবীকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অপরিহার্যভাবে মেনে নেবার ও নেতা বলে স্বীকার করে
অনুসরণ করার আহবান জানানো হয়েছে। আর এই সঙ্গে বর্তমান দুনিয়াবী জীবনের শেষে দ্বিতীয় আর একটি
জীবন কেবল মেনে নেবারই দাবী করা হয়নি বরং একথাও পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, যারা এ জীবনে নিজেদের
জবাবদিহির কথা অস্বীকার করে বা এ ব্যাপারে সকল প্রকার চিন্তা বিমুক্ত হয়ে নিছক এ
দুনিয়ায় সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা চূড়ান্ত সাফল্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। কুরআনে এ বিষয়বস্তুগুলো এত বেশী পরিমাণে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে এবং সুস্পষ্ট
ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারবার বলা হয়েছে যে, খিলাফত লাভ
সম্পর্কিত এ আয়াতের এ নতুন ব্যাখ্যাদাতাগণ এ ব্যাপারে যে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন,
যথার্থ সততা ও আন্তরিকতার সাথে এ কিতাব পাঠকারী কোন ব্যক্তি কখনো
তার শিকার হতে পারেন, একথা মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে
পড়ে। অথচ খিলাফত ও খিলাফত লাভের
যে অর্থের ওপর তারা নিজেদের চিন্তার এ বিশাল ইমারত নির্মাণ করেছেন তা তাদের
নিজেদের তৈরী। কুরআনের জ্ঞান রাখে এমন কোন
ব্যক্তি কখনো এ আয়াতের এ অর্থ করতে পারেন না।
আসলে কুরআন খিলাফত ও খিলাফত লাভকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। প্রত্যেক জায়গায় পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় থেকে
কোথায় এ শব্দটি কি অর্থে বলা হয়েছে তা জানা যায়।
এর একটি অর্থ হচ্ছে, “আল্লাহর দেয়া ক্ষমতার অধিকারী হওয়া।” এ অর্থ অনুসারে সারা দুনিয়ার সমস্ত মানব সন্তান পৃথিবীতে
খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, “আল্লাহর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তাঁর শরীয়তী বিধানের (নিছক প্রাকৃতিক
বিধানের নয়) আওতায় খিলাফতের ক্ষমতা ব্যবহার করা।” এ অর্থে কেবল মাত্র সৎ মু’মিনই খলীফা গণ্য হয়। কারণ সে সঠিকভাবে খিলাফতের হক আদায় করে। বিপরীতপক্ষে কাফের ও ফাসেক খলীফা নয় বরং
বিদ্রোহী। কারণ তারা আল্লাহ প্রদত্ত
ক্ষমতাকে নাফরমানীর পথে ব্যবহার করে।
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, “এক যুগের বিজয়ী ও ক্ষমতাশালী জাতির পরে অন্য জাতির তার স্থান দখল করা।” খিলাফতের প্রথম দু’টি অর্থ গৃহীত হয়েছে
“প্রতিনিধিত্ব” শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ থেকে। আর এ শেষ অর্থটি “স্থলাভিষিক্ত” শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এ শব্দটির এ দু’টি অর্থ আরবী ভাষায় সর্বজন
পরিচিত।
এখন যে ব্যক্তিই এখানে এ প্রেক্ষাপটে খিলাফত লাভের আয়াতটি পাঠ করবে সে এক
মুহূর্তের জন্যও এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে না যে, এখানে খিলাফত শব্দটি এমন এক
রাষ্ট্র ব্যবস্থার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আল্লাহর শরীয়াতী
বিধান অনুযায়ী (নিছক প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী নয়) তাঁর প্রতিনিধিত্বের যথাযথ হক
আদায় করে। এ কারণেই কাফের তো দূরের
কথা ইসলামের দাবীদার মুনাফিকদেরকেও এ প্রতিশ্রুতিতে শরীক করতে অস্বীকৃতি জানানো
হচ্ছে। তাই বলা হচ্ছে, একমাত্র ঈমান ও সৎকর্মের গুণে
গুণান্বিত লোকেরাই হয় এর অধিকারী। এজন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠার ফল হিসেবে বলা হচ্ছে, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন অর্থাৎ
ইসলাম মজবুত বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আর এজন্য পুরস্কার দানের শর্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগীর
ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। এ বন্দেগীতে যেন শিরকের সামান্যতমও মিশেল না থাকে। এ প্রতিশ্রুতিকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক ময়দানে
পৌঁছিয়ে দেয়া এবং আমেরিকা থেকে নিয়ে রাশিয়া পর্যন্ত যারই শ্রেষ্ঠত্ব ও
প্রতাপ-প্রতিপত্তির ডংকা দুনিয়ায় বাজতে থাকে তারই সমীপে একে নজরানা হিসেবে পেশ করা
চূড়ান্ত মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ শক্তিগুলো যদি খিলাফতের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে থাকে তাহলে ফেরাউন ও নমরূদ
কি দোষ করেছিল, আল্লাহ কেন তাদেরকে অভিশাপ লাভের যোগ্য গণ্য করেছেন? (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল
আম্বিয়া, ৯৯ টিকা)।
এখানে আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালের মুসলমানদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি পরোক্ষভাবে পৌঁছে যায়। প্রত্যক্ষভাবে এখানে এমন সব লোককে সম্বোধন করা
হয়েছিল যারা নবী সা. এর যুগে ছিলেন। প্রতিশ্রুতি যখন দেয়া হয়েছিল তখন সত্যিই মুসলমানরা ভয়-ভীতির মধ্যে অবস্থান
করছিল এবং দ্বীন ইসলাম তখনো হিজাযের সরেজমিনে মজবুতভাবে শিকড় গেড়ে বসেনি। এর কয়েক বছর পর এ ভয়ভীতির অবস্থা কেবল
নিরাপত্তায় বদলে যায়নি বরং ইসলাম আরব থেকে হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বৃহত্তর অংশে
ছড়িয়ে পড়ে এবং তার শিকার কেবল তার জন্মভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বেও মজবুতভাবে
প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আল্লাহর তাঁর এ প্রতিশ্রুতি আবু বকর সিদ্দীক, উমর ফারুক ও উসমান গনী রা. এর
জামানায় পুরা করে দেন, এটি একথার একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ। এরপর এ তিন মহান ব্যক্তির খিলাফতকে কুরআন
নিজেই সত্যায়িত করেছে এবং আল্লাহ নিজেই এদের সৎ মু’মিন হবার সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোন ন্যায়নিষ্ঠ
ব্যক্তির পক্ষে সন্দেহ পোষণ করা কঠিন। এ ব্যাপারে যদি কারোর মনে সন্দেহ দেখা দেয় তাহলে তাঁর
“নাহ্জুল বালাগায়’ সাইয়েদুনা হযরত আলী রা. এর ভাষণ পাঠ করা দরকার। হযরত উমরকে ইরানীদের বিরুদ্ধে সশরীরে যুদ্ধে
অবতীর্ণ হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি এ ভাষণটি দিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেনঃ এ কাজের বিস্তার বা দুর্বলতা সংখ্যায় বেশী
হওয়া ও কম হওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। তিনি একে বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত করেছেন। আর আল্লাহর সেনাদলকে তিনি সাহায্য-সহায়তা দান করেছেন। শেষ পর্যন্ত উন্নতি লাভ করে তা এখানে পৌঁছে
গেছে। আল্লাহ নিজেই আমাদের বলেছেনঃ
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا
الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ...................
“আল্লাহ নিশ্চয়ই এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন এবং নিশ্চয়ই নিজের সেনানীদেরকে
সাহায্য করবেন।
মোতির মালার মধ্যে সূতোর যে স্থান, ইসলামে কাইয়েম তথা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারীও
সে একই স্থানে অবস্থান করছেন। সূতো ছিড়ে গেলেই মোতির দানাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং শৃংখলা বিনষ্ট হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর আবার একত্র হওয়া কঠিন
হয়ে পড়ে সন্দেহ নেই, আরবরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু ইসলাম তাদেরকে বিপুল সংখ্যায় পরিণত করেছে এবং সংঘবদ্ধতা তাদেরকে
শক্তিশালী করে দিয়েছে।
আপনি কেন্দ্রীয় পরিচালক হিসেবে এখানে শক্ত হয়ে বসে থাকুন, আরবের যাঁতাকে নিজের চারদিকে
ঘুরাতে থাকুন এবং এখানে বসে বসেই যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে থাকুন। নয়তো আপনি যদি একবার এখান থেকে সরে যান তাহলে
সবদিকে আরবীয় ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করবে এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছবে
যে, আপনাকে
সামনের শত্রুর তুলনায় পেছনের বিপদের কথা বেশী করে চিন্তা করতে হবে। আবার ওদিকে ইরানীরা আপনার ওপর দৃষ্টি
কেন্দ্রীভূত করবে। তারা মনে করবে, এই তো আরবের মূল গ্রন্থি,
একে কেটে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কাজেই আপনাকে খতম করে দেবার জন্য তারা নিজেদের সর্বশক্তি
নিয়োগ করবে। আর আজমবাসীরা এসময় বিপুল
সংখ্যায় এসে ভীড় জমিয়েছে বলে যে কথা আপনি বলেছেন এর জবাবে বলা যায়, এর আগেও আমরা তাদের সাথে লড়েছি,
তখনো সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে লড়িনি বরং আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তাই
আজ পর্যন্ত আমাদের সফলকাম করেছে।”
জ্ঞানী পর্যবেক্ষক নিজেই দেখতে পারেন হযরত আলী রা. এখানে কাকে খিলাফত লাভের
ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করছেন।
৮৪. এখানে কুফরী করা মানে নিয়ামত অস্বীকার করাও হতে পারে আবার
সত্য অস্বীকার করাও।
প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর ক্ষেত্র হবে এমন সব লোক যারা খিলাফতের নিয়ামত লাভ করার
পর সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আর দ্বিতীয় অর্থের দৃষ্টিতে এর ক্ষেত্র হবে মুনাফিকবৃন্দ, যারা আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি
শুনার পরও নিজের মুনাফিকী মনোভাব ও কর্মনীতি পরিহার করে না।
﴿وَأَقِيمُوا
الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾
৫৬। নামায
কায়েম করো, যাকাত দাও
এবং রাসূলের আনুগত্য করো,আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে।
﴿لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ
كَفَرُوا مُعْجِزِينَ فِي الْأَرْضِ ۚ وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ۖ وَلَبِئْسَ الْمَصِيرُ﴾
৫৭। যারা
কুফরী করছে তাদের সম্পর্কে এ ভুল ধারণা পোষণ করো না যে, তারা পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম
করে দেবে। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তা বড়ই
নিকৃষ্ট আশ্রয়।
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
لِيَسْتَأْذِنكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ
مِنكُمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ۚ مِّن قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُم
مِّنَ الظَّهِيرَةِ وَمِن بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ۚ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَّكُمْ ۚ
لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ ۚ طَوَّافُونَ عَلَيْكُم بَعْضُكُمْ
عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ
حَكِيمٌ﴾
৫৮। হে
ঈমানদারগণ!৮৫ তোমাদের
মালিকানাধীন দাসদাসী৮৬ এবং তোমাদের এমন সব সন্তান
যারা এখনো বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছেনি,৮৭ তাদের অবশ্যি তিনটি সময়ে
অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিতঃ ফজরের নামাযের আগে, দুপুরে যখন তোমরা পোশাক ছেড়ে
রেখে দাও এবং এশার নামাযের পর। এ তিনটি তোমাদের গোপনীয়তার
সময়।৮৮ এরপরে তারা বিনা অনুমতিতে এলে
তোমাদের কোন গুনাহ নেই এবং তাদেরও না।৮৯ তোমাদের
পরস্পরের কাছে বারবার আসতেই হয়।৯০ এভাবে
আল্লাহ তোমাদের জন্য নিজের বাণী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ও
বিজ্ঞ।
৮৫. এখান থেকে আবার সামাজিক বিধানের ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু
হচ্ছে। সূরা নূরের এ অংশটি ওপরের
ভাষণের কিছুকাল পরে নাযিল হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
৮৬. অধিকাংশ মুফাস্সির ও ফকীহের মতে “মালিকানাধীন” বলতে
দাস-দাসী উভয়কে বুঝানো হয়েছে। কারণ এখানে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ইবনে উমর ও মুজাহিদ এ আয়াতে মামলুক তথা মালিকানাধীন
শব্দটি কেবলমাত্র দাস অর্থে নিয়েছেন। তাঁরা দাসীকে এর বাইরে রেখেছেন। অথচ সামনের দিকে যে হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে এ বিশেষ
অর্থের কোন কারণ দেখা যায় না। একান্তে অবস্থান করার সময় যেমন নিজের ছেলেমেয়েদের অকস্মাৎ এসে যাওয়া সঙ্গত নয়
তেমনি দাসী-চাকরানীর এসে যাওয়াও অসঙ্গত।
এ আয়াতের আদেশ প্রাপ্ত বয়স্ক-অপ্রাপ্ত বয়স্ক উভয় ধরনের দাস-দাসীর জন্য সমানভাবে
প্রযোজ্য, এ ব্যাপারে সবাই একমত।
৮৭. দ্বিতীয় অনুবাদ হতে পারে, “প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো স্বপ্ন
দেখার বয়সে পৌঁছেনি।” এ থেকেই ফকীহগণ স্বপ্নদোষকে ছেলেদের বয়ঃপ্রাপ্ত হবার সূচনা বলে মেনে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু আমি নিজে মূল অনুবাদে যে অর্থ করেছি তা অগ্রগণ্য
হবার কারণ হচ্ছে এই যে, এ হুকুমটি ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য। অন্যদিকে স্বপ্নদোষকে বয়ঃপ্রাপ্ত হবার আলামত হিসেবে গণ্য
করার পর হুকুমটি শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। কারণ মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক হবার সূচনা হচ্ছে মাসিক
ঋতুস্রাব, স্বপ্নদোষ নয়। কাজেই আমার মতে হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যতদিন ঘরের ছেলে মেয়েরা যৌন চেতনা জাগ্রত
হবার বয়সে পৌঁছে না ততদিন তারা এ নিয়ম মেনে চলবে। এরপর যখনই তারা এ নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে যাবে তখনই তাদের যে
হুকুম মেনে চলতে হবে তা সামনে আসছে।
৮৮. মূলে عَوْرَاتٍ (আওরাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “এ তিনটি সময় তোমাদের জন্য আওরাত।” আওরাত বলতে আমাদের ভাষায় মেয়েলোক বা নারী
জাতি বুঝায়। কিন্তু আরবী ভাষায় এর মানে
হয় বাধা ও বিপদের জায়গা এবং যে জিনিসের খুলে যাওয়া মানুষের জন্য লজ্জার ব্যাপার
এবং যার প্রকাশ হয়ে পড়া তার জন্য বিরক্তিকর হয় এমন জিনিসের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহার
করা হয়। তাছাড়া কোন জিনিসের
অসংরক্ষিত হওয়া অর্থেও এর ব্যবহার হয়। এ অর্থগুলো সবই পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত এবং আয়াতের অর্থের সাথে কোন না কোন
পর্যায়ে সংযুক্ত। এর অর্থ হচ্ছে এ সময়গুলোতে
তোমরা একাকী বা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে এমন অবস্থায় থাকো যে অবস্থায় গৃহের
ছেলেমেয়ে বা চাকর বাকরদের হঠাৎ তোমাদের কাছে চলে যাওয়া সংগত নয়। কাজেই এ তিন সময়ে তারা যখন তোমাদের নির্জন
স্থানে আসতে চায় তখন তাদের পূর্বাহ্ণে অনুমতি নেবার নির্দেশ দাও।
৮৯. অর্থাৎ এ তিন সময় ছাড়া অন্য সময় নাবালক ছেলেমেয়েরা এবং
গৃহস্বামীর ও গৃহকর্ত্রীর মালিকানাধীন গোলাম ও বাঁদীরা সবসময় নারীর ও পুরুষদের
কাছে তাদের কামরায় বা নির্জন স্থানে বিনা অনুমতিতে যেতে পারে। এ সময় যদি তোমরা কোন অসতর্ক অবস্থায় থাকো এবং তারা অনুমতি
ছাড়াই এসে যায় তাহলে তাদের হুমকি-ধামকি দেবার অধিকার তোমাদের নেই। কারণ কাজের সময় নিজেদেরকে এ ধরনের অসতর্ক
অবস্থায় রাখা তোমাদের নিজেদেরই বোকামী ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তবে যদি তোমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সত্ত্বেও নির্জনবাসের এ তিন
সময় তারা অনুমতি ছাড়াই আসে তাহলে তারা দোষী হবে। অন্যথায় তোমরা নিজেরাই যদি তোমাদের সন্তান ও গোলামী-বাঁদীদের
এ আদব-কায়দা ও আচার-আচরণ শিক্ষা না দিয়ে থাকো, তাহলে তোমরা নিজেরাই গোনাহগার হবে।
৯০. উপরোক্ত তিনটি সময় ছাড়া অন্য সবসময় ছোট ছেলেমেয়ে ও
গোলাম-বাঁদীদের বিনা হুকুমে আসার সাধারণ অনুমতি দেবার এটিই হচ্ছে কারণ। এ থেকে উসূলে ফিকাহর এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে
ওঠে যে, শরীয়াতের বিধানসমূহ কোন না কোন প্রয়োজন ও উপযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত
এবং প্রত্যেক হুকুমের পেছনে নিশ্চিতভাবেই কোন না কোন কার্যকারণ আছেই, তা বিবৃত হোক বা না হোক।
﴿وَإِذَا
بَلَغَ الْأَطْفَالُ مِنكُمُ الْحُلُمَ فَلْيَسْتَأْذِنُوا كَمَا اسْتَأْذَنَ الَّذِينَ
مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ
حَكِيمٌ﴾
৫৯। আর যখন
তোমাদের সন্তানরা বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছে যায়৯১ তখন তাদের
তেমনি অনুমতি নিয়ে আসা উচিত যেমন তাদের বড়রা অনুমতি নিয়ে থাকে। এভাবে
আল্লাহ তাঁর আয়াত তোমাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ও
বিজ্ঞ।
৯১. অর্থাৎ সাবালক হয়ে যায়, যেমন ৮৭ টীকায় বলা হয়েছে ছেলেদের ক্ষেত্রে
স্বপ্নদোষ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক ঋতুস্রাব থেকেই তাদের সাবালকত্ব শুরু হয়। কিন্তু যেসব ছেলেমেয়ে কোন কারণে বেশী বয়স
পর্যন্ত এসব পরিবর্তন মুক্ত থাকে তাদের ব্যাপারে ফকীহগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আহমাদের মতে এ অবস্থায় ১৫ বছরের ছেলেমেয়েকে সাবালক
মনে করা হবে।
ইমাম আবু হানীফার একটি উক্তি এর সমর্থন করে। কিন্তু ইমামের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে এ অবস্থায় ১৭ বছরের
মেয়ে ও ১৮ বছের ছেলেকে সাবালক গণ্য করা হবে। কুরআন ও হাদীসের কোন বক্তব্য এ দু’টি উক্তির ভিত্তি নয় বরং
এর ভিত্তি গড়ে উঠেছে ফিকাহভিত্তিক ইজতিহাদের ওপর কাজেই সারা দুনিয়ায় চিরকালই যেসব
ছেলের স্বপ্নদোষ হয়নি ও যেসব মেয়ের ঋতুস্রাব দেখা দেয়নি তাদের সাবালকত্বের জন্য ১৫
বা ১৮ বছর বয়সকেই যে সীমানা হিসেবে মেনে নেয়া হবে এমন কোন কথা নেই। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন যুগে শারীরিক
বৃদ্ধি ও বিকাশের অবস্থা বিভিন্ন হয়। আসলে, সাধারণত কোন দেশে যেসব বয়সের ছেলেমেয়েদের স্বপ্নদোষ ও মাসিক ঋতুস্রাব হওয়া
শুরু হয় তাদের গড়পড়তা পার্থক্য বের করে নিতে হবে, তারপর যেসব
ছেলেমেয়ের মধ্যে কোন অস্বাভাবিক কারণে এ চিহ্নগুলো যথাযথ উপযোগী সময়ে প্রকাশিত না
হয় তাদের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ বয়সের ওপর এ গড়পড়তার বৃদ্ধি ধরে তাকে সাবালকত্বের
বয়স গণ্য করতে হবে। যেমন কোন দেশে সাধারণত কমপক্ষে ১২ এবং বেশীরপক্ষে ১৫ বছর বয়সের ছেলের
স্বপ্নদোষ হয়। এক্ষেত্রে গড়পড়তা পার্থক্য
হবে দেড় বছর। আর অস্বাভাবিক ধরনের
ছেলেদের জন্য আমরা সাড়ে ষোল বছর বয়ঃসীমাকে সাবালকত্বের বয়স গণ্য করতে পারবো। এ নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের আইনবিদগণ নিজেদের
এলাকার অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি সীমা নির্ধারণ করতে পারেন।
১৫ বছরের সীমার পক্ষে একটি হাদীস পেশ করা হয়। এটি ইবনে উমর রা. বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, “আমার বয়স ছিল চৌদ্দ, সে সময় ওহোদ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য নবী সা. এর সামনে আমাকে পেশ করার হয়। তিনি আমাকে যুদ্ধে অংশ নেবার অনুমতি দেননি। তারপর খন্দকের যুদ্ধের সময় আমাকে আবার পেশ করা
হয়। তখন আমার বয়স হয় ১৫ বছর। এ সময় তিনি আমাকে অনুমতি দেন।” (সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহাদ) কিন্তু দু’টি
কারণে এ হাদীসটি থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করা যেতে পারে না। এক ওহোদ যুদ্ধ ৩ হিজরীর শওয়াল মাসের ঘটনা এবং খন্দকের
যুদ্ধ মুহাম্মাদ ইবনে সা’দের বক্তব্য মতে ৫ হিজরীর যিলকদ মাসে সংঘটিত হয়। দুটো যুদ্ধের মধ্যে পুরো দু’বছর বা তার চেয়ে
বেশী দিনের ব্যবধান রয়েছে। এখন যদি ওহোদ যুদ্ধের সময় ইবনে উমরের বয়স হয় ১৪ বছর তাহলে কেমন করে খন্দকের
যুদ্ধের সময় তা শুধুমাত্র ১৫ বছর হয়?” হতে পারে তিনি ১৩ বছর ১১ মাস বয়সে ১৪ বছর
এবং ১৫ বছর ১১ মাসকে ১৫ বছর বলেছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যুদ্ধের জন্য সাবালক হওয়া এক জিনিস এবং
সামাজিক ব্যাপারের জন্য আইনগতভাবে সাবালক হওয়া অন্য জিনিস। এ দু’য়ের মধ্যে কোন অনিবার্যতার সম্পর্ক নেই। কাজেই এদের একটিকে অন্যটির জন্য প্রমাণ হিসেবে
দাঁড় করানো যেতে পারে না।
তাই যেসব ছেলের স্বপ্নদোষ হয়নি তাদের সাবালকত্বের জন্য ১৫ বছর বয়ঃসীমা নির্ধারণ
করা একটি আনুমানিক ও ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত, কুরআন ও হাদীসের হুকুম নয়, এ ব্যাপারে এটিই সঠিক কথা।
﴿وَالْقَوَاعِدُ
مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَن
يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ ۖ وَأَن يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ
لَّهُنَّ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
৬০। আর যেসব
যৌবন অতিক্রান্ত মহিলা৯২ বিয়ের আশা রাখে না, তারা যদি নিজেদের চাদর নামিয়ে
রেখে দেয়,৯৩ তাহলে
তাদের কোন গোনাহ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী হবে না।৯৪ তবু তারাও
যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করে তাহলে তা তাদের জন্য ভালো এবং আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও
জানেন।
৯২. মূলে বলা হয়েছে وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ অর্থাৎ
“মহিলাদের মধ্য থেকে যারা বসে পড়েছে” অথবা “বসে পড়া মহিলারা।” এর অর্থ হচ্ছে, হতাশার বয়স অর্থাৎ মহিলাদের এমন বয়সে পৌঁছে
যাওয়া যে বয়সে আর তাদের সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা থাকে না। যে বয়সে তার নিজের যৌন কামনা মৃত হয়ে যায় এবং
তাকে দেখে পুরুষদের মধ্যেও কোন যৌন আবেগ সৃষ্টি হতে পারে না। পরবর্তী বাক্য এ অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করেছে।
৯৩. মূল শব্দ হচ্ছে يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ “নিজেদের কাপড় নামিয়ে রাখে।” কিন্তু এর অর্থ সমস্ত কাপড় নামিয়ে উলংগ হয়ে
যাওয়া তো হতে পারে না।
তাই সকল মুফাস্সির ও ফকীহ্ সর্বসম্মতভাবে এর অর্থ নিয়েছেন এমন চাদর যার সাহায্যে
সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার হুকুম সূরা আহযাবের يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ আয়াতে দেয়া হয়েছিল।
৯৪. মূল শব্দ হচ্ছে غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ “সৌন্দর্য সহকারে সাজসজ্জা
প্রকাশকারী হয় না। تَبَرَج মানে হচ্ছে প্রকাশ ও প্রদর্শনী করা। بَارِج বলা হয় এমন খোলা নৌকা বা
জাহাজকে যার ওপর ছাদ হয় না। এ অর্থে মহিলাদের জন্য এ শব্দটি তখনই বলা হয় যখন তারা পুরুষদের সামনে তাদের
নিজেদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা প্রদর্শনী করে। কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, চাদর নামিয়ে দেবার এ অনুমতি
এমন সব বৃদ্ধাদেরকে দেয়া হচ্ছে যাদের সাজসজ্জা করার ইচ্ছা ও শখ খতম হয়ে গেছে এবং
যৌন আবেগ শীতল হয়ে গেছে। কিন্তু যদি এ আগুনের মধ্যে এখনো একটি স্ফুলিংগ সজীব থেকে থাকে এবং তা
সৌন্দর্যের প্রদর্শনীর রূপ অবলম্বন করতে থাকে তাহলে আর এ অনুমতি থেকে লাভবান হওয়া
যেতে পারে না।
﴿لَّيْسَ
عَلَى الْأَعْمَىٰ حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْمَرِيضِ حَرَجٌ
وَلَا عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَن تَأْكُلُوا مِن بُيُوتِكُمْ أَوْ بُيُوتِ آبَائِكُمْ
أَوْ بُيُوتِ أُمَّهَاتِكُمْ أَوْ بُيُوتِ إِخْوَانِكُمْ أَوْ بُيُوتِ أَخَوَاتِكُمْ
أَوْ بُيُوتِ أَعْمَامِكُمْ أَوْ بُيُوتِ عَمَّاتِكُمْ أَوْ بُيُوتِ أَخْوَالِكُمْ
أَوْ بُيُوتِ خَالَاتِكُمْ أَوْ مَا مَلَكْتُم مَّفَاتِحَهُ أَوْ صَدِيقِكُمْ ۚ لَيْسَ
عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَأْكُلُوا جَمِيعًا أَوْ أَشْتَاتًا ۚ فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا
فَسَلِّمُوا عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً
ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ﴾
৬১। কোন অন্ধ, খঞ্জ বা রুগ্ন (যদি কারোর
গৃহে খেয়ে নেয় তাহলে) কোন ক্ষতি নেই, আর তোমাদের কোন ক্ষতি নেই নিজেদের গৃহে
খেলে অথবা নিজেদের বাপ-দাদার গৃহে, নিজেদের মা-নানীর গৃহে, নিজেদের ভাইয়ের গৃহে, নিজেদের বোনের গৃহে, নিজেদের চাচার গৃহে, নিজেদের ফুফুর গৃহে, নিজেদের মামার গৃহে, নিজেদের খালার গৃহে অথবা এমন
সব গৃহে যার চাবি তোমাদের হাতে সোপর্দ করে দেয়া হয়েছে কিংবা নিজেদের বন্ধুদের গৃহে।৯৫ তোমরা এক
সাথে খাও বা আলাদা আলাদা, তাতে কোন ক্ষতি নেই।৯৬ তবে গৃহে
প্রবেশ করার সময় তোমরা নিজেদের লোকদের সালাম করো, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত
হয়েছে কল্যাণের দোয়া, বড়ই বরকতপূর্ণ ও পবিত্র। এভাবে
আল্লাহ তোমাদের সামনে আয়াত বর্ণনা করেন, আশা করা যায় তোমরা বুঝে শুনে কাজ করবে।
৯৫. এ আয়াতটি বুঝতে হলে তিনটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত এ আয়াতটির দু’টি অংশ। প্রথম অংশটি রুগ্ন, খঞ্জ, অন্ধ
ও অনুরূপ অন্যান্য অক্ষমদের ব্যাপারে এবং দ্বিতীয় অংশটি সাধারণ লোকদের ব্যাপারে
বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত কুরআনের নৈতিক
শিক্ষাবলীর মাধ্যমে আরববাসীদের মন-মানসে যে বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়েছিল সে কারণে
হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের পার্থক্যের ব্যাপারে তাদের অনুভূতি হয়ে উঠেছিল চরম
সংবেদশীল। ইবনে আব্বাসের উক্তি
অনুযায়ী আল্লাহ যখন তাদের হুকুম দিলেনঃ لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ (একে অন্যের সম্পদ নাজায়েয পথে খেয়ো
না) তখন লোকেরা একে অন্যের বাড়িতে খাবার ব্যাপারেও খুব বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে
লাগলো। এমনকি যতক্ষণ গৃহ মালিকের
দাওয়াত ও অনুমতি একেবারে আইনগত শর্ত অনুযায়ী না হতো ততক্ষণ তারা মনে করতো কোন
আত্মীয় ও বন্ধুর বাড়ীতে খাওয়াও জায়েয নয়। তৃতীয়ত এখানে নিজেদের গৃহে খাবার যে কথা বলা হয়েছে তা
অনুমতি দেবার জন্য নয় বরং একথা মনের মধ্যে বসিয়ে দেবার জন্য যে, নিজের আত্মীয় ও বন্ধুর বাড়িতে
খাওয়াও ঠিক তেমনি যেমন নিজের বাড়িতে খাওয়া। অন্যথায় একথা সবাই জানে, নিজের বাড়িতে খাবার জন্য কারোর
অনুমিত নেবার প্রয়োজন ছিল না। এ তিনটি কথা বুঝে নেয়ার পর আয়াতের এ অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, অক্ষম ব্যক্তি নিজের ক্ষুধা
নিবারণ করার জন্য প্রত্যেক গৃহে ও প্রত্যেক জায়গায় খেতে পারে। তার অক্ষমতাই সমগ্র সমাজে তার অধিকার
প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
তাই যেখান থেকেই সে খাবার জিনিস পাবে তা তার জন্য জায়েয হবে। আর সাধারণ লোকের ব্যাপারে বলা হয় যায়, তাদের জন্য তাদের নিজেদের গৃহ
এবং যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের গৃহ সমান। তার মধ্যে যেখানেই তারা খাক না কেন সেজন্য গৃহস্বামীর
যথারীতি অনুমতি পেলে তবে খাবে, অন্যথায় তা অবিশ্বস্ততা ও আত্মসাত বলে গণ্য হবে, এ ধরনের কোন শর্তের প্রয়োজন নেই। লোকেরা যদি তাদের মধ্য থেকে কারোর গৃহে যায়, সেখানে গৃহস্বামী উপস্থিত না
থাকে এবং তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা কিছু খাবার নিয়ে আসে তাহলে তারা নিঃসংকোচে তা খেতে
পারে।
যেসব আত্মীয়-পরিজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে সন্তানদের উল্লেখ
এজন্য করা হয়নি যে, সন্তানদের গৃহ নিজেরই গৃহ হয়ে থাকে।
বন্ধুদের ব্যাপারে মনে রাখতে হবে, অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কথা বলা হয়েছে, যাদের অনুপস্থিতিতে অতিথি বন্ধুরা যদি তাদের সবকিছু খেয়েও চলে যায় তাহলে
তারা নারাজ হওয়া তো দূরের কথা উল্টো আরো খুশিই হবে।
৯৬. প্রাচীন আরবের কোন কোন গোত্রের আচার ও রীতিনীতি এই ছিল যে, তারা প্রত্যেকে নিজের খাবার
নিয়ে আলাদা বসে খেতো। তারা সবাই মিলে এক জায়গায় বসে খাওয়াটা খারাপ মনে করতো। যেমন হিন্দুরা আজও এটা খারাপ মনে করে। অন্যদিকে কোন কোন গোত্র আবার একাকী খাওয়া খারাপ মনে করতো। এমন কি সাথে কেউ খেতে না বসলে তারা অভুক্ত
থাকতো। এ আয়াতটি এ ধরনের
বিধি-নিষেধ খতম করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।
﴿إِنَّمَا
الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَىٰ
أَمْرٍ جَامِعٍ لَّمْ يَذْهَبُوا حَتَّىٰ يَسْتَأْذِنُوهُ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ
لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَن لِّمَن شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللَّهَ
ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৬২। মু’মিন৯৭ তো আসলে
তারাই যারা অন্তর থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মানে এবং যখন কোন সামষ্টিক কাজে রাসূলের
সাথে থাকে তখন তার অনুমতি ছাড়া চলে যায় না।৯৮ যারা তোমার
কাছে অনুমতি চায় তারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাসী। কাজেই
তারা যখন তাদের কোন কাজের জন্য তোমার কাছে অনুমতি চায়৯৯ তখন যাকে
চাও তুমি অনুমতি দিয়ে দাও১০০ এবং এ ধরনের লোকদের জন্য
আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দোয়া করো।১০১ আল্লাহ
অবশ্যই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
৯৭. মুসলমানদের জামায়াতের নিয়ম-শৃংখলা আগের তুলনায়
আরো বেশী শক্ত করে দেবার জন্য শেষ নির্দেশাবলী দেয়া হচ্ছে।
৯৮. নবী সা. এর পরে তাঁর স্থলাভিষিক্তগণ এবং ইসলামী জামায়াত ব্যবস্থার আমীরগণের
জন্যও এ একই বিধান। কোন সামগ্রীক উদ্দেশ্যে
যুদ্ধ বা শান্তি যে কোন সময় মুসলমানদের যখন একত্র করা হয় তখন আমীরের অনুমতি ছাড়া
তাদের ফিরে যাওয়া বা ছড়িয়ে পড়া কোনক্রমেই জায়েয নয়।
৯৯. এর মধ্যে এ সতর্কবাণী রয়েছে যে, কোন যথার্থ প্রয়োজন ছাড়া
অনুমতি চাওয়া তো আদতেই অবৈধ। বৈধতা কেবল তখনই সৃষ্টি হয় যখন যাবার জন্য কোন প্রকৃত প্রয়োজন দেখা দেয়।
১০০. অর্থাৎ প্রয়োজন বর্ণনা করার পরও অনুমতি দেয়া বা না দেয়া
রসূলের এবং রসূলের পর জামায়াতের আমীরের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। যদি তিনি মনে করেন সামগ্রিক প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তুলনায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাহলে অনুমতি না দেবার
পূর্ণ অধিকার তিনি রাখেন। এ
অবস্থায় একজন মু’মিনের এর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকা উচিত নয়।
১০১. এখানে আবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, অনুমতি চাওয়ার মধ্যে যদি
সামান্যতম বাহানাবাজীরও দখল থাকে অথবা সামগ্রিক প্রয়োজনের ওপর ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে
প্রাধান্য দেবার প্রবণতা সক্রিয় থাকে, তাহলে এ হবে একটি
গোনাহ। কাজেই রাসূল ও তাঁর
স্থলাভিষিক্তের শুধুমাত্র অনুমতি দিয়েই ক্ষান্ত হলে চলবে না বরং যাকেই অনুমতি
দেবেন সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলে দেবেন যে, আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন।
﴿لَّا تَجْعَلُوا دُعَاءَ
الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُم بَعْضًا ۚ قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ
يَتَسَلَّلُونَ مِنكُمْ لِوَاذًا ۚ فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ
أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
৬৩। হে
মুসলমানরা! রাসূলের আহবানকে তোমাদের মধ্যে পরস্পরের আহবানের মতো মনে করো না।১০২ আল্লাহ
তাদেরকে ভালো করেই জানেন যারা তোমাদের মধ্যে একে অন্যের আড়ালে চুপিসারে সটকে পড়ে।১০৩ রাসূলের
হুকুমের বিরুদ্ধাচারণকারীদের ভয় করা উচিত যেন তারা কোন বিপর্যয়ের শিকার না হয়১০৪ অথবা তাদের
ওপর যন্ত্রণাদায়ক আযাব না এসে পড়ে।
১০২. মূলে دُعَاء শব্দ
ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ ডাকা ও আহবান করা
হয় আবার দোয়া করাও হয়।
তাছাড়া دُعَاءِ الرَّسُول এর মানে রসূলের ডাক বা দোয়াও
হতে পারে আবার রসূলের আহবানও হতে পারে। এসব বিভিন্ন অর্থের প্রেক্ষিতে আয়াতের তিনটি অর্থ হতে পারে এবং তিনটি অর্থই
সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত।
একঃ “রসূলের আহবানকে কোন সাধারণ মানুষের আহবানের মতো মনে করো
না।” অর্থাৎ রসূলের আহবান
অস্বাভাবিক গুরুত্বের অধিকারী। অন্য কারোর আহবানে সাড়া দেয়া না দেয়ার স্বাধীনতা আছে কিন্তু রসূলের আহবানে না
গেলে বা মনে ক্ষীণতম সংকীর্ণতা অনুভব করলে ঈমান বিপন্ন হয়ে পড়বে।
দুইঃ “রসূলের দোয়াকে সাধারণ মানুষের দোয়ার মতো মনে করো না” তিনি
খুশী হয়ে দোয়া করলে তোমাদের জন্য এর চেয়ে বড় আর কোন নিয়ামত নেই আর নারাজ হয়ে
বদদোয়া করলে তার চেয়ে বড় আর কোন দুর্ভাগ্য তোমাদের জন্য থাকবে না।
তিনঃ “রসুলকে ডাকা সাধারণ মানুষের একজনের অন্য একজনকে ডাকার মতো
হওয়া উচিত নয়।” অর্থাৎ তোমরা সাধারণ
লোকদেরকে যেভাবে তাদের নাম নিয়ে উচ্চস্বরে ডাকো সেভাবে রাসূলুল্লাহ সা.কে ডেকো না। এ ব্যাপারে তাঁর প্রতি চরম শিষ্টাচার ও মর্যাদা প্রদর্শন
করতে হবে। কারণ তাঁর প্রতি সামান্যতম
বেআদবীর জন্যও আল্লাহর কাছে জবাবদিহির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না।
১০৩. মুনাফিকদের আর একটি আলামত হিসেবে একথাটি বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইসলামী সামগ্রিক কাজের জন্য যখন ডাকা হয়
তখন তারা এসে যায় ঠিকই কিন্তু এ উপস্থিতি তাদের কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর ও
অপছন্দনীয় হয়, ফলে কোন রকম গা ঢাকা দিয়ে তারা সরে পড়ে।
১০৪. ইমাম জাফর সাদেক রা. বিপর্যয় অর্থ করেছেন “জালেমদের
কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি।”
অর্থাৎ যদি মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ সা. এর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে তাদের ওপর
জালেম ও স্বৈরাচারী শাসক চাপিয়ে দেয়া হবে। মোটকথা এটাও এক ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। আর এছাড়াও আরো অসংখ্য ধরনের বিপর্যয় হওয়া
সম্ভবপর। যেমন পরস্পরের মধ্যে
বিচ্ছিন্নতা, গৃহযুদ্ধ, নৈতিক অবক্ষয়, জামা’আতী
ব্যবস্থায় বিশৃংখলা, আভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য, রাজনৈতিক ও বস্তুগত শক্তি ভেঙ্গে পড়া, বিজাতির অধীন
হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
﴿أَلَا إِنَّ لِلَّهِ مَا
فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ قَدْ يَعْلَمُ مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ وَيَوْمَ يُرْجَعُونَ
إِلَيْهِ فَيُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
৬৪। সাবধান
হয়ে যাও, আকাশে ও
পৃথিবীতে যা কিছু সব আল্লাহরই। তোমরা যে নীতিই অবলম্বন করো
আল্লাহ তা জানেন। যেদিন লোকেরা তাঁর দিকে ফিরে যাবে সেদিন
তিনি তাদের বলে দেবেন তারা কি সব করে এসেছে। তিনি সব
জিনিসের জ্ঞান রাখেন।
কোন মন্তব্য নেই
মতামতের জন্য ধন্যবাদ।